এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব -১৩+১৪

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৩ |

—————————–
–“তুই পালিয়ে যাবার পরদিন-ই প্রিতম তাঁর বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজন সহ তোদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো সেদিন-ই তোকে প্রিতমের সাথে বিয়ে করিয়ে নিজেদের ঘরে তুলবে। কিন্তু যখন তোকে বাড়িতে পায় না তখন এলাহি কান্ড ঘটে যায়। প্রিতমের বিশ্বাস রাফিয়া এবং তাঁর মা মিলে তোকে কোথাও সরিয়ে ফেলেছে। এ নিয়ে প্রিতম যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছে। প্রিতমের মা তো তখনই বলেছে,

“আমার প্রিতমের বউকে যেখান থেকেই হোক আমি খুঁজে বের করবোই।”

রাফিয়া প্রিতমের এমন রূপ এবং তাদের পরিবারের রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছিলো। সেদিন প্রিতমের ব্যবহার মানতে না পেরে আ!ত্মহ!ত্যা অবধি করতে গেছিলো৷ কিন্তু তাকে থামিয়ে ফেলা হয়।”

সবটা শুনে নওরি স্তব্ধ, বিমূঢ়, থমকালো! তাঁর অগোচরে এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেলো? সত্যি-ই অবিশ্বাস্য! নওরি অস্ফুট স্বরে বলে,
–“এগুলো কী সুরভী বলেছে?”
–“তা নয়তো কী? তুই পালিয়ে গেছিস শুনে আমার মাও আমার উপর কড়া নজরদারি শুরু করেছে। হয়তো তার মনে সন্দেহের দানা বুনেছে। এখন থেকে আমি তোকে সবসময় কল দিতে পারবো না। আমি ভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়েই কথা বলতে পারবো। কারণ, আমি চাই না তোর সম্পর্কে কেউ জেনে যাক। পরে দেখা গেলো তোর কথা আমার মা গিয়ে প্রিতমের মায়ের কাছে লাগিয়ে দিলো। এসব নেত্রীদের জন্যে বা হাতের কাজ। তুইও সাবধানে থাকিস নওরি। একদম ভয় পাবি না, নিজেকে শক্ত রাখবি।”

নওরির মনে আজ বড্ড কুঁ ডাকছে। একরাশ ভয় তাকে ঝেঁকে ধরেছে। এখন? এখন কী হবে? সে কী প্রিতমের হাতে ধরা পরে যাবে? এ কোন পরীক্ষায় ফেললো উপরওয়ালা। পরমুহূর্তেই আবার মনে হলো, নাহ! ভয় পেতে তো সে পালায়নি। পালিয়েছে নিজের মতো করে বাঁচবার জন্যে। নওরি আর অন্তত নিজের উপর কারো কর্তৃত্ব ফলাতে দিবে না। কিন্তু রাফিয়ার জন্যে বড্ড খারাপ লাগছে তাঁর। বোনটা সব সত্য জেনে যে এই পযক্ষেপ গ্রহণ করবে কে জানতো?

নওরি আপনমনে বলে ওঠে,
–“তুমি বলছো ভয় না পেতে, কিন্তু তোমার গলা কাঁপছে কেন আপা?”
মাহি থতমত খেয়ে গেলো। রুদ্ধশ্বাস ফেলে বলে,
–“আশঙ্কা নওরি। আমি ভয় পাচ্ছি বলে এই না যে তোর ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে হবে। নিজেকে শক্ত কর কারণ, এই দুনিয়া কঠিনের বন্ধু নরমের জম।”

————
রাত প্রায় দেড়টা। নিদ্রাহীন ইরা’দ আনমনে কফি পান করছে। হাতে কিছু এগ্রিমেন্ট। সেগুলোতে একবার চোখ বুলাচ্ছে তো আরেকবার জানালা ভেদ করে বিশাল আসমানে নজর বুলাচ্ছে। ছমছমে, শব্দহীন রাত। ইরা’দ কী মনে করে হাতে থাকা এগ্রিমেন্টগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। রাগে রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে ইরা’দ।

হঠাৎ ইরা’দের মুঠোফোন বেজে ওঠে। দ্রুত কল রিসিভ করে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরলো।
–“ওদের বলে দে, ইরা’দ কারো কেনা সম্পদ কখনো হয়নি আর না হবে। আমার এলাকায় ওরা মা!দ!কের ব্যবসা চালাবে এত সোজা? আমিও দেখবো, আমার বুকের পাঠা থাকতে জা** বা** গুলা কেমনে বার বসায়।”
–“চেতিস কেন? মাথা ঠান্ডা কর, এগুলাকে আবর্জনা ভেবে দূরে থাক!”
–“চেতার কথা বললে চেতবো না? সাহস কত বড়ো! গার্লস স্কুলের সামনে মো!দখোড় গুলা ঘুরে বেড়াবে, সদ্য যৌবনে পা রাখা ছেলেপুলেকে ভুল রাস্তায় হাঁটাতে চায়? কোন গর্ভের সন্তান এরা? জা** এর দল!”
–“আচ্ছা থাম, এগ্রিমেন্ট ছিঁড়েছিস! এখন চুপ করে ঘুমা। ঘুম না এলে আরেক কাপ কফি বানিয়ে বেলকনি নিয়ে আকাশ বিলাস কর, ভালো লাগবে।”

ইরা’দ নিখিলের কথার উত্তরে জবাব না দিয়ে খট করে কল কেটে দেয়। রাগে এখনো ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। সীমাহীন ক্রোধ উপচে আসছে যেন। পরপর কয়েকবার ঢোঁক গিলে অবশিষ্ট কফিটুকু পান করলো। ঠান্ডা হয়েছে সেই কখনোই। কিন্তু অতিরিক্ত রাগে অন্যমনস্ক ছিলো ইরা’দ। তাই হয়তো খেয়ালে আসেনি।

কফি আর বানালো না সে। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে চলে গেলো শূন্য মগটি রাখতে। ভালোমতোন ধুঁয়ে জায়গা মতো রেখে দিলো। অতঃপর কী মনে করে মাজেদা বেগমের রুমে চলে গেলো। মাজেদা বেগম নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। সেদিকে ইরা’দের খেয়াল নেই। ইরা’দ সূক্ষ্ম নজর মাজেদা বেগমের মোটা লাঠিটার দিকে। নজরেই ক্ষান্ত হলো না ইরা’দ। পরপর এগিয়ে গেলো লাঠির দিকে। হাতে নিয়ে কিছুটা পর্যবেক্ষণ করলো। মিনমিন স্বরে বললো,
–“আসিস তোরা আমার সাথে লাগতে। বারের সংজ্ঞা এবং বর্ণনা বুঝায় দিবো।”

পরপর তাঁর ছাদের ন্যায় বারান্দায় চলে আসলো। বড্ড খোলামেলা এই বিশাল বারান্দা। মন স্বতঃস্ফূর্ত হয়। গায়ে হিম হাওয়া ছুঁয়ে যেতে গরম হয়ে থাকা ইরা’দ ধপ করে নিভে গেলো। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তাঁর। খোলা আসমানে চোখ জোড়া নিবদ্ধ করতেই আজকের ব্ল্যাক এঞ্জেল যেন হৃদয় এবং মস্তিষ্কে হানা দিলো। ক্ষণেই অধরে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি। হাসিতে এঁটে আছে একরাশ প্রশান্তি। কিছুক্ষণ চোখ বুজে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। রাতের শহরটা হঠাৎ-ই কেমন বিশুদ্ধ লাগছে। বিশুদ্ধ লাগছে এই প্রকৃতির উৎসর্গ করা বাতাস। আজ ইরা’দ মনেপ্রাণে একটি জিনিস বড্ড উপলব্ধি করেছে। আকাশের পানে তাকিয়ে হাসি- মুখেই হঠাৎ বলে ওঠে,

–“আজ উপলব্ধি করলাম আমার জন্যে নির্ধারণ করা সর্ব!নাশিনীর প্রেমে পরেছি আমি। গভীরতম দাগ কেটেছে সেই সর্ব!নাশিনী। এই সর্ব!নাশিনীকে আমি হাসি-মুখে, হাজারো মানুষকে সাক্ষী রেখে বরণ করে নিবো আমার জীবনে। স্বাগতম আমার নাশ রাণী, আমার নৌরি ফুল। আপনাকে আমার জীবনে স্বাগতম। আজ থেকে আপনার এই ইরা’দ আপনার সেবক এবং ছায়া হয়ে আপনার জীবনে পদার্পণ করেছে। স্বাগতম জানিয়েছেন নিশ্চয়ই?”

বলেই পিছে ঘুরে মাথা উচু করে নওরির বারান্দার দিকে চাইলো। শূণ্য বারান্দায় চেয়ে আনমনেই স্মিত হাসলো ইরা’দ। এক ফুলের সুগন্ধিতে রাগ, ক্রোধ কোথায় যেন উবে গেলো তাঁর।

——————–
টিউশনি নিয়ে নূরজাহানের সাথে একান্তে কথা বলেছে নওরি। নূরজাহান সমাধান হিসেবে জানিয়েছে এ বিষয়ে একমাত্র ইরা’দ-ই সাহায্য করত্র পারবে। ঠিক সেই কারণে ইরা’দ বর্তমানে নূরজাহানের সঙ্গে বৈঠকঘরে বসে আছে। নওরি দূরে দাঁড়িয়ে ইরা’দের দিকে ভীত নজরে তাকিয়ে আছে। নূরজাহান একে একে সবটা খুলে বলছে। আর ইরা’দ ক্ষণে ক্ষণে কোণা চোখে নওরিকে দেখছে। সেই চাহনি অস্বস্তিকর হলেও সেই চাহনিতে কোনো খাদ খুঁজে পায়নি সে। এছাড়া টিউশনির ব্যাপারটা ইরা’দের হাতেই আছে। তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে চললো।

নূরজাহানের মুখ থেকে টিউশনির কথা শুনে ইরা’দ হঠাৎ কিছুটা উগ্র কন্ঠে বলে ওঠে,
–“টিউশনি মানে কী? ওর বাবা-মা ওকে খরচ পাঠায় না? কী দরকার খামাখা টিউশনি করার?”

ইরা’দের কথায় কিছুটা ব্যথা অনুভব হলো নওরির। চিনচিনে ব্যথা। শান্ত মুখশ্রীতে হঠাৎ-ই আঁধার ছেঁয়ে গেলো। নূরজাহানও বুঝলেন না ইরা’দের করা এহেম প্রশ্নে কী উত্তর দিবেন। মেয়েটার কথা যে সে ছাড়া কেউ-ই জানে না। ইরা’দ ক্ষণিক চুপ থেকে দু’জনের মুখমন্ডল পর্যবেক্ষণ করলো। দু’জনের মুখশ্রী জুড়েই আঁধারের মেলা। ভুল বলে ফেললো নাকি তাঁর করা প্রশ্নে অসন্তোষ বোধ করলো? মিনিটখানেক নিস্তব্ধতা বিরাজ করলেও ইরা’দ এই নিস্তব্ধতাকে দীর্ঘ করলো না। পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে বেশ দৃঢ় স্বরে শুধায়,
–“টিউশনির কথা বুঝলাম। কিন্তু সমস্যা কী জানেন চাচী? আজকাল কেউ সেভাবে সাহায্যের মর্ম দেয় না। এই যে আমি! যাকে সাহায্য করব তাঁর কী উচিত ছিলো না আমি বলার আগেই এক কাপ চা করে আমার গলা ভেঁজানোর? হায়রে দুনিয়া!”

কথাগুলো নওরিকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলা হলো যেন। নূরজাহান কাজের মেয়েকে চা বানিয়ে দেয়ার কথা বলার পূর্বেই বাঁধ সাধে নওরি। আমতা আমতা করে বলে,
–“আ..আমি যাচ্ছি চা বানাতে।”

বলেই হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটলো। ইরা’দ মাথা কিছুটা উঁচু নওরির যাওয়ার পানে তাকিয়ে অধর প্রসারিত করলো। নূরজাহান ইরা’দের দিকে ফিরতেই ইরা’দ তড়িৎ স্বাভাবিক হয়ে বসলো। যেন সে ভদ্র মানুষ। নূরজাহান ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–“মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তায় থাকি ইরা’দ!”

ইরা’দ ভ্রু কুচকে তাকালো নূরজাহানের পানে। নওরির ক্ষেত্রে সবার কেন এত চাপা দীর্ঘশ্বাস? কী হয়েছে নওরির সাথে? খারাপ কোনো ঘটনা? সেটাই বা কী? ফুলের একটা পাঁপড়িও সে ঝরতে দিবে না। তাই জানার জন্যে কিছুটা নয় বরং অনেকটা আগ্রহী হয়ে পরলো। ইরা’দ সন্দিহান কন্ঠে শুধায়,
–“কী হয়েছে ওর? কেন তোমরা এত বিচলিত?”

নূরজাহান কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। যা ইরা’দের বুঝতে অসুবিধা হলো না। ইরা’দ আবার কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই নওরি হাতে চা নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসলো। ইরা’দের কন্ঠস্বর দমে গেলো নওরির উপস্থিতিতে। নওরি একপলক ইরা’দের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। ইরা’দের সামনের টি-টেবিলে চা রাখতে গেলে ইরা’দ হুট করে বলে ওঠে,
–“চা হাতে দেয়াটা ভদ্রতা।”

নওরি আড়চোখে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে বেশ ধীরে ইরা’দের দিকে পেয়ালাসহ চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়। ইরা’দ অধর চেপে হেসে ইচ্ছাকৃত নওরির আঙুলে স্পর্শ করে চায়ের কাপটা নিয়ে নিলো। নওরি ছিটকে পেছনে আসলো ইরা’দের সামনে থেকে। হঠাৎ এরকম হওয়ায় নূরজাহান বিচলিত হয়ে পরে৷ উৎকন্ঠা হয়ে বলে,
–“ঠিকাছো নওরি?”
নওরি ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে দ্রুত প্রস্থান করলো। নওরির অস্থিরতা বুঝতে পেরে পুণরায় অধরে চেপে হাসলো ইরা’দ। অতঃপর চায়ের কাপটি টি-টেবিলে রেখে টিউশনির বেতন সম্পর্কে টুকটাক আলোচনা করে নেয়। আলোচনা শেষে তৃপ্তির সাথে কাপটি হাতে তুলে নিলো। প্রেয়সীর হাতে বানানো চা, অবশ্যই তৃপ্তিদায়ক। প্রেয়সীর চায়ের স্বাদ নিতে বড্ড ব্যাকুল সে। ধীরে গতিতে চায়ে এক চুমুক বসালো। তৃপ্তিতে তাঁর চোখ বুজে গেলো। কী অসাধারণ স্বাদ! যাক, মেয়েটার চা বানানোর গুণ ভালো। আরেক চুমুক দিতেই ইরা’দের পায়ে সুড়সুড়ি লাগলো। অল্প নয় বরং গাঢ়রকম সুড়সুড়ি। সুড়সুড়ির তাড়নায় গিলতে পারলো না চা টুকু। সব মুখ দিয়ে “ফ্রুৎ” করে বেরিয়ে গেলো। চায়ের কাপটাও গায়ে পরতে পরতে বেঁচেছে। কোনরকমে চায়ের কাপ টি-টেবিলে রেখে পায়ের দিকে তাকালো। একী! এটা তো নওরির পোষা বিড়ালটা। তাঁর নরম, মসৃণ লোমে আবৃত পিঠ দিয়ে ইরা’দের পা ঘঁষছে। ইরা’দ পা দিয়ে সরাতে চাইলো, কিন্তু ফ্রিশা আরও লেগে বসলো। পিটপিট করে ইরা’দের দিকে তাকালো। ইরা’দ বেশ কাঠ কাঠ গলায় বলে,
–“নির্বোধ! তোর জ্বালায় আমার চা খাওয়া হলো না!”

নূরজাহান ভ্রু কুচকে বলে,
–“পায়ে কী ফ্রিশা নাকি? এজন্যই চা এভাবে ফেলেছো?”
–“এটা আবার কেমন নাম? যাইহোক, বিড়ালটা আমার অপছন্দের তালিকায় এসে গেছে, নিদ্র!! লিটল নিদ্র কই তুমি?”

নিদ্র ফট করে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। নিদ্রকে দেখতেই ইরা’দ সিটকানো কন্ঠে বললো,
–“এরে সরাও। আমার পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে, বসে থাকাই সম্ভব হচ্ছে না!”

নিদ্র অবাক হওয়ার সুরে বলে,
–“সে কী? তোমার আবার সুড়সুড়ি আছে নাকি?”
–“এই বেড়ালটার শরীরে আমার সুড়সুড়ির ভাইরাস আছে, সরা এটারে। আমি সহ্য করতে পারছি না!”

নিদ্র ফিক করে হেসে দিয়ে ইরা’দের কাছে এলো। হাসি বজায় রেখেই ফ্রিশাকে নিয়ে চলে গেলো। নূরজাহানও হেসে বলে,
–“আমার বড়ো নিদ্রকে মনে হচ্ছে পছন্দ করে ফেলেছে ফ্রিশা!”
–“আর বলিও না তো, চা খাচ্ছি।”

————————
মাজেদা বেগম পান চিবুচ্ছে এবং নিদ্রকে দেখছে। নিদ্র মূলত লাঠি নিতে আসছিলো। কিন্তু এসে দেখে লাঠি নেই। লাঠির জায়গা শূন্য! নিদ্র এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে বলে,
–“ও নানী, লাঠি কই?”
–“ক্যা? কিয়ারবি লাঠি দিয়া?”
–“বুড়ো বুড়ো খেলবো। আমি বুড়ো সাজবো, লাঠিতে ভার দিয়ে হাঁটবো, আর আমার মিছেমিছি বউয়ের জন্যে কষ্ট করে বাজারে যাবার এক্টিং করবো!”

মাজেদা বেগমের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বলে কী একটুকুনি পোলাপান?
–“এই বয়সে গাছ পাকনা কাঁঠাল হইয়া গেছিস তাই না? মিছেমিছি বউ? বউয়ের সংজ্ঞা জানোস হতচ্ছাড়া?”
–“নিদ্র ভাইয়াকে বলে দিও বউ সম্পর্কিত একটি বই আনতে। সেটা থেকে মুখস্থ করে তোমার সংজ্ঞা বলে দিবো!”
–“পোলায় কয় কী! যা ভাগ এহেন্তে! তোর বকবক হোনার সময় নাই।”
–“আমারও সময় নেই। তুমি শুধু লাঠিটা দাও!”
–“সেই স্বপ্ন ভুলেও দেহিস না। তোর মতো বিচ্ছুরে আমার এত সাধের লাঠি দিমু? আরেকবার চাইলে লাঠি দিয়া বাইড়ামু!”
–“আমিও তখন লাঠি নিয়া ভাগমু। মনে রাইখ!”

নিদ্র মাজেদা বেগমের ভাষায় কথাগুলো বলে দুলতে দুলতে বেরিয়ে গেলো। তাঁর বোঝা হয়ে গেছে যে লাঠি মাজেদার কাছে নেই। কে নিছে সেটাও জানে। তাই কথা খুব একটা বাড়ালো না। মাজেদা বেগম নিদ্র’র যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুখ বাঁকায়। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
–“পোলাপাইনে বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখে আর এই পোলায় বুইড়া হওয়ার নাটক করে। কী দিনকাল আইলো রে মাবুদ!”

—————————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৪ |

—————–
নিদ্র বিষণ্ণ মনে নওরির রুমে ফিরে এলো। নওরি তখন ফ্রিশার খাওয়া দেখছিলো। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। নিদ্রকে নজরে এলেই ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকালো নওরির। নিদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–“নানুটা একদম ভালো না।”
নওরি বেশ চমকে তাকালো নিদ্র’র পানে।
–“কার কথা বলছো নিদ্র?”
–“মাজেদা নানুর কথা৷ আমার মিছেমিছি বউটা বেড়াতে চলে গেছে। তাই ভেবেছিলাম তোমার সাথে এক্টিং, এক্টিং খেলবো। কিন্তু নানুটা লাঠি দিলো-ই না। উল্টো লাঠি দিয়ে আমায় উত্তম-মাধ্যম দেয়ার হুমকি দিয়ে দিলো।”

নওরি হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না। নিদ্র এবার নাক ফুলিয়ে বুকে দুই হাত গুঁজে বেশ বড়ো বড়ো ভাব নিয়ে বলে,
–“আমি নানুকে উচিত শিক্ষা দিবো।”
–“ভুলেও না নিদ্র। ভুলে গেছো তুমি তাঁর চশমা ভেঙেছো? এটা ঠিক না।”
এবার নিদ্র নেতিয়ে গেলো। কিছু একটা করতে গিয়েও বাঁধা পেলো। ভেবেছিলো নওরির থেকে সাপোর্ট নিবে কিন্তু সে বাঁধা দিলো দিলো তো অবশ্যই সাথে চশমা ভাঙার কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিলো। নিদ্র হালকা ঢোঁক গিললো। চশমা ভেঙেছে জানলে সত্যি সত্যি-ই মাজেদা বেগমের মোটা লাঠিটা তাঁর পিঠের হাড্ডি গুরিয়ে দিলো। নিদ্র ভয়াতুর চোখে নওরির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। আমতা আমতা করে বলে,
–“আ..আসলে আজকে নিদ্র ভাইয়া লাঠিটা নিয়ে গেছে তো তাই নানু দেয়নি। আমি কিন্তু একদম মন খারাপ করিনি।”
নওরির ভ্রু আরও কিছুটা কুচকালো। সন্দিহান কন্ঠে বললো,
–“উনি নিয়ে কী করবে?”
–“আরে জানো না? আমার নিদ্র ভাইয়া সেই রকম ফাইটার। ঢিশুম ঢিশুমে সেরা আমার বিগ ব্রাদার।”

নওরি নিজের অজান্তেই একটি কল্পনা করে বসলো। কল্পনা করলো মারপিট দেয়ার সময় ইরা’দকে কেমন দেখাবে? পরবর্তীতে নিজেকেও কল্পনা করে ফেললো। ইরা’দ যদি ওই লাঠি নিয়ে নওরিকে মারে? নিদ্র’র বর্ণনা অনুযায়ী লাঠিটা বেশ শক্তপোক্ত। ওটা পিঠে পরলে তো… ধুর! কী ভাবছে সে? নওরিকে কেন মারবে ইরা’দ? আশ্চর্য কান্ড! নওরি নিজের ভাবনার উপর নিজে-ই চরম বিরক্ত হয়ে পরলো।

———————–
নওরি তাঁর বোরকা খামচে হেঁটে চলেছে। বোরকাটা সারিফার সাথে নিউ মার্কেট থেকে কিনেছে৷ নওরির হাতে যতটুকু টাকা ছিলো তাঁর মধ্যে সাড়ে সাতশো টাকা দিয়ে নরমাল বোরকা কিনেছে। এমনি, এমনি নয়! দাম কষাকষি করে। বোরকা হিজাব নেবার কারণ, নিজেকে আড়ালে রাখা। খোলামেলা চলাফেরা করলে যে কেউ চিনে ফেলার সম্ভাবনা আছে। তাই আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করেছে নওরি।

নওরির ঠিক পাশেই ইরাদ বেপরোয়া হয়ে হাঁটছে। প্রতিবারের মতো-ই তাঁর মুখে মাস্ক৷ নওরি কোণা চোখে সামান্য চেয়ে নজর ঘুরিয়ে ফেললো। বড্ড অস্বস্তি লাগছে ওর। কিন্তু উপায় নেই। ছাত্র-ছাত্রীর বাসা চিনতে হলে ইরাদের সাহায্য লাগবেই। এছাড়া এই শহরের কিছু-ই চেনে না নওরি। তাই আজকের দিনটা সে ঢাকা ঘুরবে, পরিচিত হবে ঢাকার অলিগলির সাথে। এতক্ষণের মধ্যে অবশ্য ইরাদ কিছু জায়গা চিনিয়ে দিয়েছে৷ গরমে জর্জরিত নওরির মুখ লাল হয়ে আছে। সূর্যের তীক্ষ্ম কিরণ তাঁর মুখে লাগছে৷ এই তীব্র গরমে আবার মুখোশ বেঁধেছে৷ কাহিল অবস্থা নওরির। নওরি নাক এবং কপাল যতটুকু মুখোশ ব্যতীত দৃশ্যমান সেসব পৃষ্ঠে জর্জেট হিজাবের একাংশ দিয়ে ঘাম মুছছে।
–“বেশি কষ্ট হচ্ছে নৌরি ফুল? ছাতার ব্যবস্থা করব?”

নওরি চমকে পাশ ফিরে তাকায়। মাথা উঁচু করতেই দেখতে পেলো ঘর্মাক্ত, চিন্তিত ইরাদকে। নওরি অস্ফুট স্বরে শুধায়,
–“কে..কেন?”
–“রোদ লাগছে না আপনার। এজন্য রোদের হাত থেকে বাঁচার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা!”

গরমে জর্জরিত নওরি কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থাকে ইরাদের পানে। পিটপিট করে। অতঃপর আমতা আমতা করে বলে,
–“প্রয়োজন নেই। আমি ঠিকাছি। এছাড়া এভাবেই কী হাঁটব?”

ইরা’দ নওরির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই লহু কন্ঠে আওড়ায়,
–“আপনি তো বাইক আনতে দিলেন না। তাহলে হাঁটা ছাড়া আর কী করব?”

নিরাশ নওরি পুণরায় তৃষ্ণার্তের মতো হাঁটতে লাগলো। আজ হাওয়া’রাও তীব্র প্রতারণা করছে। একটু বাতাস নেই আজ। কী যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা! ইরা’দ মুচকি হেসে বলে ওঠে,
–“অবশ্য একটি উপায় আছে!”
নওরি হুট করে থেমে যায়। ইরাদের দিকে ফিরে অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“কী?”

ইরা’দ ঝুঁকে এলো নওরির দিকে। একদম নওরির মুখোমুখি। নওরি চমকালো, প্রচন্ড ভড়কালোও বটে৷ আশংকায় তড়িৎ মাথা কিছুটা পিছের দিকে নিয়ে নিলো। দৃষ্টি তাঁর বড়ো বড়ো। অন্তঃস্থল প্রচন্ড কাঁপছে, কেউ যেন ঢোল পি!টাচ্ছে বক্ষস্থলে। নিঃশ্বাস গলায় আটকে হতভম্ব চাহনি নিক্ষেপ করে রইলো ইরা’দের পানে। ইরা’দ মাস্ক কিছুটা খুলে আলতো হেসে বলে,
–“রিকশায় চড়বেন? খোলা আকাশের নিচে আপনি আমি ঘুরে বেড়াবো৷ বাতাস অনুভব করবো, আলাদা জগতে হারাবো।”

নওরির চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। বলে কী এই ছেলে? রিকশা? রিকশা মানেই তো পাশাপাশি বসতে হবে। এবার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো নওরির। ঘনঘন নেতিবাচক মাথা নেড়ে ভয়ার্ত গলায় বলে ওঠে,
–“একদম না। কখনো না। সম্ভব না!”

নওরির এলোমেলো কথা শুনে ইরা’দ হাসতে হাসতে পুণরায় মুখে মাস্ক পরে নিলো। এদিকে ওদিক তাকিয়ে হাসছে সে। শব্দহীন প্রাণখোলা হাসি তাঁর। হাসির তীব্রতা খুব বেশি। একসময় হাসি থামিয়ে বলে,
–“এত ভয় পান আমায়? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
–“দুটোই! পুরুষজাতিকে আমি বিশ্বাস করি না। এরা আমার জন্যে অচেনা এবং আতঙ্কের পাত্র।”
–“নিজের বাবাকেও?”

নওরি নিরব হয়ে গেলো। এর উত্তর কী দিবে সে? কী উত্তর দেয়ার প্রয়োজন? হ্যাঁ বলবে নাকি না? মনের মধ্যে হঠাৎ-ই রেষারেষি এবং দ্বন্দ্ব শুরু হলো। এই দ্বন্দ্ব মূলত তাঁর বাবাকে নিয়ে। ইরা’দকে কী উত্তর দিবে সেটা দিয়ে। একসময় ক্লান্ত হয়ে নিরব থাকলো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–“আমার কেউ নেই।”

নওরি পূণরায় অগ্রসর হয় সামনের দিকে। ইরা’দ সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটার কেউ নেই মানে? ভুল শুনেছে নাকি ইরা’দ। আসলেই তাহলে মেয়েটার মধ্যে রহস্য আছে। হঠাৎ ইরা’দের মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো নিদ্র’র বলা কথাটি। কিসের অসুখ এই পিচ্চি মেয়েটার?

এই মাঝরাস্তায় সব জানার জন্যে ব্যাকুল হলো না ইরা’দ। বরং নওরিকে স্বাভাবিক করতে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ হাতে টান পরায় নওরি থেমে গেলো। পিছে ফিরে দেখে ইরা’দ পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি নওরির চোখ জোড়ায়। ওই চোখের ভাঁজে ইরা’দ আজ অসহায়ত্ব এবং বেদনা দেখতে পাচ্ছে।

ইরা’দ যেমন ঝড়ের গতিতে নওরির হাত ধরেছিলো তেমন ঝড়ের গতিতে ইরা’দ হাত সরিয়েও নিয়েছে। ইরা’দের এরূপ দায়সারা ভাব দেখে নওরি উগ্র মেজাজ দেখিয়ে বললো,
–“এভাবে হাত ধরলেন কেন?”
–“প্রমাণ কী?”
নওরি থতমত খেয়ে গেলো। কী বলবে বুঝলো না। আসলেই তো! তার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া লাগাও সম্ভব না। নওরির বোকাসোকা চেহারা দেখে ইরা’দ এক গাল হাসলো। মুগ্ধময় হাসি। নওরির মাথায় হালকা টোকা দিয়ে বলে,
–“আপনি খুব নরম প্রকৃতির মেয়ে। আই লাইট ইট। আজকাল তোমার মতো মেয়ে গলিতে গলিতে হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।”
–“কেমন লোক আপনি?”

ইরা’দ নওরির দিকে দুই ধাপ এগিয়ে বলে,
–“আপনার নজরে আমি যেমন, ঠিক তেমন-ই। এখন রিকশা নিচ্ছি, কোনো কথা শুনবো না।”

—————–
ইরা’দের বাহুর সাথে নওরির বাহুর সংঘর্ষণে নওরির সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে। নওরির বাহু যেন মুঁচড়ে অবশ হয়ে পরছে বারংবার। কী এক অস্বস্তিকর অবস্থা। ঘর্মাক্ত কপাল আরও ঘেমে যাচ্ছে নওরির। বর্তমানে ইরা’দের সাথে রিকশায় বসেছে নওরি। ইরা’দ তাঁর ক্ষতি করবে না জানে, কিন্তু পুরুষ তো! নওরি বারবার সরে যাচ্ছে। একসময় ইরা’দ হুট করে নওরির হাত ধরে বলে,
–“রিকশা থেকে পরে রাস্তায় গড়াগড়ি খাবার তীব্র ইচ্ছে জেগেছে বুঝি?”
–“ছা..ছাড়ুন হাত। রিকশা থামাতে বলেন। আমি পারব না, আপনার সাথে এক রিকশায় বসতে। সম্ভব না আমার পক্ষে!”
ইরা’দ এদিকে ওদিক তাকিয়ে বলে,
–“আর মাত্র পাঁচ মিনিট। একটু কষ্ট করুন।”
–“এত দূরে টিউশনি খুঁজতে বলেছে কে?”
ইরা’দ অবাক হবার ভান ধরে বলে,
–“যার জন্যে করি চুরি, সেই বলে চোর। কে বললো দূর? বরং কাছে৷ শুধু এই সেক্টর থেকে ওই সেক্টর, দ্যাট’স ইট!”
–“আপনার মতো ব্যস্ত মানুষকে আমার পাশে বেমানান দেখায়!”
ইরা’দ অসম্ভব ভ্রু কুচকালো। এদিকে নওরি তীব্র অস্বস্তি এবং গরমে অতীষ্ঠ হয়ে কিসব বলেছে নিজেও জানে না। রিকশা চলমান অবস্থায় বেশ কয়েক জায়গায় ইরা’দের ছবির পোস্টার দেখতে পেলো সে। সেই থেকেই মূলত মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। ইরা’দ কপালে দু-তিনটে ভাঁজ ফেলে বলে,
–“আপনার জন্যে আমি হলাম ব্যস্তহীন মানুষ!”
–“কেন?”
ইরা’দ গভীর নজরে নওরির চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“আপনার ছায়া তো! ছায়াদের মূল কাজ হচ্ছে তাঁর প্রতিপক্ষের মানুষটির সাথে আঁঠার মতো লেগে থাকা। আমি আঁঠা না লাগালেও লাগানোর প্রচেষ্টায় রয়েছি।”

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here