এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব -১৫+১৬

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৫+১৬ |

———————–
মাজেদা বেগম পান চিবুতে চিবুতে সারিফাকে দেখছেন। সূক্ষ্ম, সন্দিহান নজরে। যেন সারিফা বড়ো কোনো অ”পরাদ করে ফেলেছে। আজ অনেকদিন পর মাজেদা বেগম বেশ ফুরফুরে, চাঙ্গা অনুভব করছেন। তাইতো মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ভারি পা জোড়া চালিয়ে বৈঠকঘর অবধি আসলেন৷

আবেশে সোফায় বসে মেয়ের সাথে খোশ-গল্প করতে করতে পান বানালেন। তৃপ্তি সহকারে মুখে পুরতেই সারিফা এসে হাজির হয়। সারিফা মাজেদাকে দেখতেই তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়না দিয়েছে। যা দেখে মাজেদা বেগমের চক্ষু বড়োই অপারগ! নজর এমন যেন সারিফা তাঁর চোখে তাকালেই ভষ্ম করে দিবে।

মাজেদা বেগম আবার ওড়না ছাড়া মেয়েদের একদম দেখতে পারে না। অথচ তাঁর নিজের মেয়ে-ই সারা ঘরে মাথায় কাপড় ছাড়া ঘুরে বেড়ায়। তাঁর ভাষ্যমতে মৌসুমি তো ঘরেই থাকছে, আজকালকার মেয়েদের মতো তো ঘুরে বেড়াচ্ছে না। মৌসুমি সারিফার দিকে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,

–“এই অসময়ে আসলি যে?”
–“তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম বড়ো চাচী!”
সারিফার কন্ঠস্বর ছিলো খুবই ধীর। এতই ধীর যেন মাজেদা বেগমও শুনতে পাবে না। মৌসুমি নড়েচড়ে বসে হাসলো। এবং বললো,
–“সন্ধ্যার পরে আসিস। এখন মাকে সময় দিচ্ছি।”

সারিফা বাধ্য মেয়ের মতো ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে চলে আসতে নিলেই মাজেদা বেগম পিছু ডাকলো। সারিফার যেন আত্মা কেঁপে উঠলো। মাজেদা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে গলায় কাঠিন্য এনে বলে,
–“হুনলাম তোদের বাসায় নাকি কোন মাইয়া আইছে?”

সারিফা কম্পিত পায়ে পিছে ফিরে দাঁড়ালো। মাজেদা বেগমের সম্মুখে। আমতা আমতা করে জানায়,
–“জ্বী নানু।”
মাজেদা বেগম নাকে হাত দিয়ে এক টান দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস টেনে বলে,
–“কই ওই মেয়ে? আন আমার সামনে, দেহুম আমি।”

সারিফা পরে গেলো বিব্রতিকর অবস্থায়। কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। বরং তীব্র আতঙ্কে ঢোল পে!টাচ্ছে। সারিফা কোনোরকমে উত্তর দিলো,
–“আচ্ছা।”

———————-
প্রথম দিনের মতো দুটো টিউশনি করিয়ে বেরিয়ে আসতেই নওরি অদূরে ইরা’দকে দেখতে পেলো। বাইকে বসে কয়েকজন ছেলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।এই স্থানটি বেশ নিরিবিলি, নির্জন। খুব একটা মানুষ নেই।
নওরিকে ইরা’দের খেয়াল হতেই বেশ সুন্দর করে বললো,
–“রিকশা ডেকে ওর কাছে পাঠা। আমার মেলা কাজ!”

বলেই বাইকে ঠিকভাবে বসে চলে গেলো। নওরি হ্যাবলার মতো চেয়ে রইলো ইরা’দের যাওয়ার পানে। যেই কয়েকজন ছেলে ছিলো তাদের মধ্যে একজন থেকে বাকিরাও বাইক নিয়ে চলে গেলো ইরা’দের পিছু পিছু।

সেই ছেলেটা ভুলক্রমেও নওরির দিকে আসলো না বরং সেখান থেকে একটি রিকশা ডেকে নওরির দিকে পাঠিয়ে দিলো। নওরি সবকিছুই নিরবে দেখে গেলো। বুঝতে পারলো না ইরা’দ কেন এখানে?
রিকশাওয়ালা নওরির সামনে রিকশা নিয়ে এসে বললো,
–“কই যাইবেন আপা?”

নওরি একপলক ছেলেটির দিকে তাকাতেই ছেলেটি পিছের গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখের সামনে বিরাট খবরের কাগজ তুলে ধরলো। যেন নওরিকে সে চিনে-ই না। অথচ একটু পরপর খবরের কাগজ অল্প করে সরিয়ে নওরির পদক্ষেপ দেখছে। নওরি তপ্তশ্বাস ফেলে বলে,
–“শিখিয়েই তো দেয়া হয়েছে। আলাদা করে ঠিকানা জিজ্ঞেস করবার কী আছে?”

রিকশাওয়ালা অপ্রস্তুত হলো নওরির উক্তিতে। তিনি নিজেকে শুধরে বলেন,
–“উইঠা পরেন।”
নওরি বিনা-বাক্যেই রিকশায় উঠে হুড উঠিয়ে নিলো। রিকশা চলতে শুরু করলো। সেই যুবকটির সামনে দিয়েই রিকশা গেলো। নওরি ছেলেটিকে দেখেও না দেখার ভান করে সামনে তাকিয়ে রইলো। পরবর্তীতে নওরির অনুভব হলো কেউ তাদের পিছু নিচ্ছে।

কী ভেবে নওরি রিকশার পেছনে তাকাতেই দেখলো ছেলেটা নওরির পিছেই আরেক রিকশা করে আসছে। নওরি বেশ চমকালো। কী চায় এই ছেলে? অদ্ভুত তো! নওরি আবার সোজা হয়ে বসলো। মিনিট দশেকের মাঝেই নওরিদের গলিতে রিকশা প্রবেশ করলো। নওরি গলি দিয়ে ঢুকতেই ছেলেটা রিকশা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। নওরি এটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

তবে বাড়ির সামনেও একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। যা প্রথমে উপেক্ষা করলেও পরবর্তীতে ছেলেটির নজর নিজের দিকে দেখতেই ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকালো। নওরি বুঝলো না, সব ছেলে মানুষ আজ তাঁর দিকেই কেন? নওরি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলো। বাড়ির সামনে আসতেই রিকশা ওয়ালাকে থামতে বললো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে গেলেই ছেলেটি এগিয়ে এলো। নরম সুরে নওরির উদ্দেশ্যে বললো,
–“ভা.. ইয়ে মানে আপু, আপনি যান! আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি।”

নওরি কোণা চোখে ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটিকে একদম-ই সুবিধার লাগলো না তাঁর। ব্যাগ থেকে টাকা বের করার ভঙ্গিতে কিছুটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
–“নো, থ্যাংকস! নিজের ভাড়া আমি নিজেই দিয়ে দিবো।”

ছেলেটা মাথা চুলকালো, কী বলবে বুঝে এলো না তাঁর। পরবর্তীতে আবার জোর করলো। নওরি ছেলেটির কোনো কথা তোয়াক্কা না করেই রিকশাওয়ালার দিকে তার পাওনা টাকা বাড়িয়ে দিলো। ছেলেটি আবার বললো,
–“প্লিজ! আমাকে টাকাটা দিতে দিন।”
–“চেনেন না, জানেন না একজন মেয়ের রিকশা ভাড়া হুট করে দিতে আসছেন, কেন? প্লিজ দূরে থাকুন।”

বলেই একপ্রকার হনহন করে ভেতরে প্রবেশ করলো নওরি।
——————-

নূরজাহান চিন্তিত হয়ে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করেই চলেছে। একটি বিষয় নিয়ে বড্ড চিন্তিত সে। চিন্তার কারণটি স্বয়ং মাজেদা বেগম। নওরিকে দেখতে চেয়েছেন উনি। ওদিকে নওরিও বাসায় নেই। টিউশনির জন্যে গেছে। আসবেও আধঘন্টা পর। নূরজাহান অবশ্য এসব নিয়ে চিন্তিত নয়। চিন্তিত নওরির পরিচয় এবং পরিজন নিয়ে। সারিফাও সোফায় বসে কপালে হাত গুঁজে বসে আছে। ফ্রিশা একুরিয়ামের কাছাকাছি বসে পিটপিট করে তাকিয়ে মা- মেয়ের কান্ড দেখছে। ক্ষণে ক্ষণে লেজও নাড়ছে। সারিফা হঠাৎ চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে,

–“এখন কী করা যায় আম্মু?”
–“সেটাই তো ভাবছি। মাজেদা খালার বচনভঙ্গি ভালো না। কী থেকে কী বলে ফেলবে ধারণা করাই দায়! বড্ড চিন্তা হচ্ছে।”
–“আর আমার ভয় হচ্ছে। ওনার চাহনি-ই তো কেমন বা!ঘিনীর মতোন। যেন এই এসে আমায় খপ করে খেয়ে ফেলবে।”
–“বাজে ব!কিস না তো! চিন্তা তো নওরি মেয়েটাকে নিয়েও হচ্ছে। যদি ভুলবশত কিছু বলে ফেলে?”

ফ্রিশা এবার সটান মেরে বসে পরে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় নূরজাহানের পানে। তাদের কথা না বুঝলেও “নওরি” নামটা তাঁর রক্তের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। নিশ্চয়ই নওরিকে নিয়েই কথা বলছে। ফ্রিশা এদিক ওদিক ছুট দিয়ে একদম নওরির রুমে চলে গেলো।

ঠিক সেসময়ে হাতে গুলতি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো নিদ্র। এক হাতে গুলতি তো আরেক হাতে ছোট আম। সারিফা, নূরজাহান উভয়কে বৈঠকঘরে দেখে নিদ্র তড়িৎ আমটি পেছনে লুকালো। ভয়াতুর চোখে পরখ করে নিলো মা, বোনকে। মায়ের হাতে ধরা খেলে নিদ্র’র কপালে দুঃখ আছে৷

পরখ করে যখন দেখলো দু’জনের কারোই তাঁর দিকে নজর নেই তখন নিদ্র পা টিপে টিপে নওরির রুমের দিকে চলে গেলো। নওরির রুমে প্রবেশ করতেই কিছু একটার সাথে পা লেগে ধপ করে ফ্লোরে নেতিয়ে পরলো সে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে মুহূর্তে-ই ক্ষীণ আর্তনাদ করে উঠলো নিদ্র। হাতের আমটাও ছিটকে বিছানার নিচে চলে গেলো।

বিকট শব্দ পেয়ে সারিফা এবং নূরজাহান নওরির রুমের উদ্দেশ্যে যেতে নিলেও নওরিকে দেখে দুজনের পা জোড়া থেমে গেলো। ভুলে গেলো কোনো এক বিকট শব্দের কথা। নওরি ক্লান্ত ভঙ্গিতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মুখের কালো বর্ণের মাস্কটি খুলে ফেললো।

তপ্ত গরমে ঘেমে চুপচুপে হয়ে গেছে তাঁর সমগ্র পিঠ। কোনো রকমে বোরকা, হিজাব থেকে নিস্তার পেলেই যেন একটু শান্তি পাবে। নূরজাহান তড়িৎ এগিয়ে এলো নওরির দিকে। নওরি ক্লান্তিমাখা হাসি দিয়ে সালাম দেয় নূরজাহানকে। নূরজাহান জোরপূর্বক হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলে,
–“যেতে আসতে সমস্যা হয়নি তো?”

হঠাৎ নওরির সর্বাঙ্গে শিহরণ খেলে গেলো। অন্তঃস্থলে শীতল ঢেঊয়ের অস্তিত্ব অনুভব করলো। চক্ষু-দ্বয়ে ভেসে উঠলো ইরা’দের মুখশ্রী এবং ফেরার পথের ঘটনা। নওরি লম্বা নিঃশ্বাস টেনে জোরপূর্বক হাসলো। হাসি বজায় রেখে ধীর গলায় বলে,
–“জ্বী, আন্টি। কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু আপনাদের এমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”

নূরজাহানের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার নেমে এলো। বেশ জড়তার স্বরে আওড়ায়,
–“মাজেদা খালা তোমায় ডেকেছে।”

কপালে দুটো ভাঁজ পরলো নওরির। চিন্তিত গলায় শুধায়,
–“কেন আন্টি?”
দু’জনের মাঝে হঠাৎ সারিফা বলে ওঠে,
–“তোমায় দেখতে চায়। নির্ঘাত ভেতরে কিছু পুষে রেখেছেন নানু। এছাড়া তোমার পরিচয় নিয়েও অবশ্যই প্রশ্ন তুলবে!”
–“এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার সারিফা। ভয়ের কী আছে?”
–“ভয়ের দেখেছো কী তুমি? ভ!য়ানক মহিলা উনি। তাঁর সাথে কথায় টক্কর দেয়া অসম্ভব।”

নওরি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও স্বাভাবিক-ই নিলো। সবাই মাজেদা বেগমকে যতটা ভয় পায় সে মনের দিক দিয়ে নিশ্চয়ই নরম? নওরি তাকে সম্মান জানিয়ে সারিফার উদ্দেশ্যে বললো,
–“তুমি হয়তো বেশি-ই ভয় পাচ্ছো সারিফা। হতেও পারে উনি সেই ধরণের মানুষ নয়।”
–“রতনে রতন চিনে আপু। এখনো সাক্ষাৎ হয়নি তো, তাই ওনার কথার ঝাল বুঝোনি। যাইহোক, দ্রুত ফ্রেধ হয়ে আসো। নানুর কাছে যেতে হবে।”
–“হ্যাঁ সেই ভালো। নওরি যাও মা! ফ্রেশ হয়ে আসো।”

নিদ্র একটু উঁকি মেরে দেখে নিলো। নাহ৷ কেউ তাঁর শব্দ শুনতে পায়নি তাহলে। যাক, শান্তিতে এখন আম খেতে পারবে। ভেবে নিদ্র যেই পায়ের দিকে তাকালো তখন দেখলো ফ্রিশা বসে আছে। ফ্রিশার পাশেই বড়ো একটি পাতিল। এই পাতিলে হোঁচট খেয়েছে? কী লজ্জাজনক বিষয়। নিদ্র মিনমিন করে শুধালো,

–“এই ঘটনা যদি আমার মিছেমিছি বউ এবং আমায় আজীবন হিংসে করা হিংসুকটা জানতে পারে, আমার জামা-কাপড় খুলে ফেলার মতো ইজ্জত হারাবো। নাহ! বি কেয়ারফুল হতে হবে। নিদ্র ভাইয়ার মতো আমার মাথাকে বোঝাতে হবে “বি কেয়ারফুল!”

নিদ্র’র বিড়বিড়ানির সময়েই নওরি রুমে প্রবেশ করলো। নওরিকে দেখে নিদ্র এদিক সেদিক আমটিকে খুঁজলো৷ নিদ্রকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে নওরি নির্বাক কন্ঠে শুধায়,
–“এ কী নিদ্র? এভাবে মেঝেতে বসে আছো কেন? ঠিক আছো?”

নিদ্র কোনো রকমে উঠে দাঁড়ায়। কৃত্রিম হাসি দিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
–“এমনি নৌরি ফুল। কিছু হয়নি তো। আমি যাই..?”

নিদ্র কোনোরকমে কথা ঘুরিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। হাঁটার অবস্থা দেখে নওরি ভ্রু কুচকে বলে,
–“কিছু হয়নি নাকি হয়েছে?”

ঠিক সেসময়ে কাজের মেয়েটি রুমে প্রবেশ করলো। নওরি একপলক ফ্রিশার দিকে তাকালো। কাজের মেয়েটা আসার পূর্বেই নওরি বোরকা, হিজাব খুলে ফেলে। কাজের মেয়েটা মেঝে থেকে পাতিলটা নিয়ে গরম নজরে তাকালো ফ্রিশার দিকে। ফ্রিশাও মুখ গম্ভীর করে দুই ধাপ এগিয়ে গেলো কাজের মেয়েটার দিকে। ফ্রিশার এমন অভিব্যক্তি যেন মাছের মতো কামড়ে খাবে কাজের মেয়েটাকে। সাহস কত বড়ো, তাকে চোখ রাঙানি দেয়?

ফ্রিশার এরূপ দেখে কাজের মেয়েটা ঢোঁক গিলে ফেললো। নজরও তাঁর নরম হলো। আতঙ্কিত কন্ঠে নওরির কাছে বিচার স্বরূপ বললো,
–“দ্যাখেন আফা! আপনের বিলাইটারে সামলায় রাখেন। রান্নাঘরের নিচে পাতিল রাখসিলাম। ভেতরে কিছু চাউলও আছে। আপনের বিলাই এডারে ঠেলতে ঠেলতে নিয়াইছে!”

নওরি একপলক ফ্রিশার দিকে তাকিয়ে বড্ড নরম গলায় বললো,
–“আমি অত্যন্ত দুঃখিত লতা। তুমি যাও, ফ্রিশা আর রান্নাঘরে ঢুকবে না!”

লতা আরেক পলক ফ্রিশার দিকে ভীত নজর নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেলো। ফ্রিশা বসে লতার যাওয়ার পানেই তাকিয়ে আছে। নওরি ফ্রিশার উদ্দেশ্যে বলে,
–“তোকে বাসায় রেখে যাই তোর নামে অভিযোগ শোনার জন্যে? কেন বুঝিস না, আমি বাইরে থাকলেও আমার মনটা আমি বাসাতেই রেখে যাই। তোর জন্যে আমার তীব্র চিন্তা হয়। এমতাবস্থায় এরকম অভিযোগ শুনলে কী রকম লাগে বল তো? এসব করতে নেই রে ফ্রিশা।”

ফ্রিশা এবার নওরির দিকে তাকালো। নওরির মুখশ্রীতে ক্লান্তি ভাব। পিটপিট করে নওরির দিকে তাকিয়ে রয়।
–“মিঁয়্যাও!”
–“পরবর্তীতে যেন এসব না শুনি।”

———————
মাজেদা বেগম অদ্ভুত দৃষ্টিতে নওরির দিকে তাকিয়ে আছে। নওরি মাজেদা বেগমের বিপরীত সোফায় চুপটি মেরে বসে আছে। মাথায় কপাল অবধি ঘোমটা টানা। দৃষ্টিও নত। তাঁর পাশেই নিদ্র বসে আছে।

এমন শান্ত-শিষ্ট, সভ্য মেয়েটাকে মোটামুটি ভালোই লাগছে মাজেদার। কিন্তু তাও সাবধানের মার নেই। সরু কন্ঠে বলে ওঠে,
–“এত দেরী হইলো ক্যা আইতে?”
নওরি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো না। নওরির বাবা সবসময়ই বলেছে বড়ো’রা প্রশ্ন করলে কিছুটা সময় নিয়ে তারপর উত্তর দিতে। এতে ভদ্রতা প্রকাশ পায়। নওরি কয়েক সেকেন্ড সময় দিয়ে অতিব শীতল গলায় শুধায়,
–“টিউশনি করিয়ে এসেছি। এজন্য।”
–“আদব-কায়দা তইলে আছে ভালো। তো, নাম কী?”
নওরির অধর জোড়া কাঁপছে। সারিফা ভুল কথা বলেনি। মাজেদা বেগমের কন্ঠের একেকটি ধ্বনি সর্বাঙ্গ আতঙ্কে কাঁপিয়ে ফেলার মতোই। নওরি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললো,
–“নওরিয়া তাফরিন।”
–“এত বড়ো নাম? তা বাপ-মা কই থাকে? আছে নাকি এমনেই অন্যের ঘাড়ে বসাই দিয়া ভাগছে। কী আকাম করছিলা?”

নওরি কিছুটা বিব্রত হলো। সারিফা তাদের থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছিলো। কান খাড়া করে শুনছিলো ওদের কথোপকথন। মাজেদা বেগমের এহেন কথায় কিছুটা তেঁতে উঠলো সারিফা। সারিফা হুট করে বলে ওঠে,
–“নওরি এখানে পড়তে আসছে নানু! ওর বাবা মা কেন….”
–“ওই চুপ! বি!য়াদবি শিখছিস? বড়োদের মুখে মুখে তর্ক?”

নওরি আরও চুপসে গেলো। মৌসুমি চোখের ইশারায় সারিফাকে চুপ থাকতে বললো। সারিফাও মাজেদা বেগমের হুংকারময় ধমকে উপায়ন্তর না পেয়ে চুপসে গেলো। নওরি কামিজের কিছু অংশ শক্ত করে খামচে ধরে আছে। বৈঠকঘর খুবই নিরব হয়ে গেছে মুহূর্তে-ই। শুনশান রাতের ন্যায়। এখানে যে কয়েকজন মানুষ উপস্থিত রয়েছে বোঝার জো নেই। পরিবেশ ঠান্ডা হতেই মাজেদা বেগম নওরির দিকে ফিরলো।
–“কী হইলো? চুপ ক্যা?”

নওরি আমতা আমতা করে বলে,
–“এখানে পড়াশোনা করতে এসেছি নানু!”
–“বাপ-মায় কই থাকে? কিয়ারে?”

নওরি চুপ বুজে নিঃশ্বাস নিলো। গলায় কথা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।
–“মা নেই আমার।”

ইরা’দ ফোনে কথা বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে তাঁর রুমের দিকে ছুটছিলো। বৈঠকঘর অতিক্রম করতে গিয়ে নওরির কন্ঠস্বর শুনতে পেলো। হঠাৎ-ই ইরা’দের পা জোড়া থেমে গেলো। চমকে তাকালো সোফায় বসা মানবীর দিকে। সবকিছু বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো তাঁর। এরপর কী মনে করে হাসলো। হেসেই বললো,
–“পরে কথা বলছি। জরুরি কাজে আটকে গেছি।”

বলেই কল কেটে ফোনটি পকেটে পুরে নিলো। নিদ্র’র ইরা’দের দিকে নজর যেতেই নিদ্র চোখ বড়ো বড়ো করে ইরা’দকে ইশারা দিলো। ভাগ্যক্রমে ইরা’দও ঠিক তখনই নিদ্র’র দিকে তাকিয়েছিলো। নিদ্র ইশারায় মাজেদার দিকে দেখালো। ইরা’দ ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করলো।
মাজেদা হাই তুলে বললো,
–“ও আচ্ছা। মা ছাড়া পোলাপাইন এমনেই বিঁগড়ায়। বাপ ছাড়া আগে পিছে আর কোনো মেয়ে অভিভাবক নাই? এমনেই দিন চালাইসো?”

মাজেদা বেগমের কথাগুলো ডিরেক্ট তীরের মতোন লাগলো ইরা’দের। কী বললো মাজেদা? সত্যি? নওরির মা নেই? ভেতরটা হঠাৎ কেমন দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। দেরী করলো না। লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। ইরা’দের অন্তত মাজেদা বেগমকে বিশ্বাস নেই। যে মা হারা মেয়েকে এসব বলতে পারে তাকে দ্বারা সব সম্ভব।

প্রশ্নমুখর আলোচনার মাঝে ব্যঘাত ঘটালো ইরা’দ। একদম নওরির বাম পাশে গিয়ে বসলো। এরকম দৃশ্য দেখে মৌসুমির মাথায় হাত। তাঁর ছেলে কি না অচেনা একটা মেয়ের পাশে? কিছু বলতে গিয়েও পারলো না ইরা’দের কণ্ঠধ্বনি পেয়ে।
–“কী গো নানু। এতো ইন্টারভিউ কিসের? নাতবউ বানাবা নাকি?”

————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here