#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫
মারসাদ মাহির ভাই এটা জানতে পেরে আদিরা তাজ্জব বনে যায়। আদিরা হতভম্ব হয়ে বলে,
–উনি তোমার ভাই? কিন্তু….
মাহি ভ্রুঁ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–কিন্তু কী?
আদিরা মুখ ছোট করে বলে,
–কিছু না। যাই আমি হ্যাঁ। নাচ তো বাধ্যতামূলক করতেই হবে। কিছু করার নেই। থাকো তুমি। মৌমি আপু চলো।
আদিরা মৌমির সাথে চলে গেলে মাহি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্টেজে লাগানো ফুলের কম্বিনেশন দেখছে।
–এই মেয়ে তুমি আজও শার্ট-প্যান্ট পড়েছ?
আকস্মিক পুরুষালী কন্ঠস্বরের ধ’মকে ঘুরে তাকালো মাহি। তীক্ষ্ম নয়নজোড়া কন্ঠস্বরের অধিকারী পুরুষটিকে দেখছে। মাহি ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
–তো!
পুরুষটি তার সোচ্চার করা কন্ঠস্বরে বলে,
–আজ একটা অনুষ্ঠান আর তুমি এসব পড়েছ? শাড়ি পড়লেও পারতে। আর শাড়ি না থাকলে বলতে আমায়।
রাগে কটমট করে উঠে মাহি। বলে কীনা শাড়ি নেই তার কাছে। মাহি খলবলিয়ে বলে,
–ও মিস্টার! শাড়ি কিনতে চাইলে আমি যত ইচ্ছা কিনতে পারি। আপনারটা নিতে যাবো কেন? আপনার কেনা শাড়ি আপনি আপনার বউকে পড়াইয়েন। আপনার ভবিষ্যৎ বউকে সারাদিন শাড়ি পড়িয়ে নিজের সামনে সং সাঁজায়ে রাখবেন। তাও আমাকে বলতে আসবেন না। যান ফু’টেন এখান থেকে।
আলতো হাসলো পুরুষটি। পরক্ষনেই বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলে,
–তুমিই হবে এই আহনাফ ইকবালের বউ। তখন সারাদিন চব্বিশঘণ্টা শাড়ি পড়িয়ে বসিয়ে রাখবো মেয়ে!
মাহি কান খাড়া করে আহনাফের বিড়বিড় করা বুলি শুনতে চাইলো কিন্তু মাঝের দূরত্ব কয়েক হাত হওয়ায় তা সম্ভপর হলো না। মাহি তীক্ষ্ম নজরে আহনাফকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–এই আপনি বিড়বিড় করে কী বলছেন? আপনি মানুষটা এতো বিড়বিড় করেন কেনো বলেন তো?
আহনাফ হেসে পকেটে হাত গুঁজে বলে,
–তুমি কৌতুহল দেখাও তাই। সেসব বাদ দেও। আমি সুমিকে বলছি তোমার জন্য শাড়ি ও শাড়ি পড়ানোর ব্যাবস্থা করতে।
মাহি ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
–নাআআ। এই কাঁদা বৃষ্টির মধ্যে আমা শাড়ি কখনোই পড়বো না। আমার এমনিতেও শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই। এই এই আপনি চট্টগ্রাম থেকে এখানে কেনো এলেন? আমাকে জ্বালাতে? আমার ভাইটাও যে কেনো আপনি বলতে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এলো! আপনারা দুটোই হচ্ছেন মা’থামোটা। এসেছেন যখন তখন আমাকেই বা এখানেই কেনও চান্স পেতে হলো! আ’জব কিসমত আমার।
মাহির হাহুতাশ শুনে আহনাফ উচ্চস্বরে হেসে দিলো। আহনাফের হাসি দেখে মাহি নাক ফুলিয়ে ফুঁসছে। আহনাফ সামনে এগিয়ে মাহির নাকে টোকা দেয় যার বৌদলতে মাহি একটু সরে গিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে চাইল। আহনাফ বলে,
–আমি মারসাদের জন্য চবি ছেড়েছি আর মারসাদ ঢাবি ছেড়েছে। এক বছর লস হলেও আমরা দুই বন্ধু একসাথে আছি এখন এবং নিজেদের পছন্দের সাবজেক্টে। তাই আমাদের কোনে আফসোস নেই।
মাহি কিছু বলল না। তার ফোন বেজে উঠলে সে কথা বলতে বলতে আশেপাশে দেখে সামনে আরেক বান্ধুবীকে দেখে আহনাফকে হাতের ইশারায় বিদায় জানিয়ে চলে যায়। আহনাফ মুচকি হেসে স্বগোতক্তি করে,
“তোমার নীড় আমাতে হবে মাহিপাখি!”
__________________
প্র্যাকটিস শেষ করে আদিরা চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এর আগে সে কখনও স্টেজে নাচ করেনি। স্কুলে একবার স্টেজে কবিতা আবৃতি করে দ্বিতীয় হয়েছিল। তার চিন্তায় জোর খিদে পাচ্ছে। পাশে রাখা পানির বোতল থেকে বারবার পানি পান করছে। মারসাদ দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করে নিরবে হাসছে। স্টেজ পারফর্মেন্স আরও দুই ঘন্টা পরে। এর আগে আরেকবার লাস্ট ফিনিশিং দেখানো হবে। আদিরাকে স্বস্থি দিতে সেখানে মাহি আসে। মাহি এসে মারসাদকে জড়িয়ে ধরে। মারসাদও ছোটোবোনকে আলতোভাবে নিজের সাথে আগলে নেয়। মাহি মারসাদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে,
–দাভাই তুমি পঁচা। কাল বাসায় গেলে কিন্তু আমার সাথে দেখা না করেই চলে এলে। আমি জানতে পেরে খুব রাগ করেছি তোমার উপর।
মারসাদ মাহির চুল হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে আদুরে সুরে বলে,
–তুই তো ঘুমোচ্ছিলিস পাখি। দাদী বলল মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়েছিস। তাই আর জাগাই নি।
মারসাদের জবাবে মাহি মুখ ভাড় করে বলে,
–রাতে থেকে আসতে পারতে। আমি তো অতো জলদিও ঘুমাই নি। তুমি গিয়েছিলেই রাত করে। রাতে তো থেমে থেমে বৃষ্টিও হয়েছে। থেকে আসতে রাতটা।
মারসাদ মলিন কন্ঠে বলে,
–না রে। আমার সাধ্য থাকলে আমি বহুদূরে চলে যেতাম। তোর আর দাদীর জন্য পারি না। তিন বছর আগে সেখান থেকে শূণ্য হাতে অনেক কিছু ছেড়ে চলে এসেছিলাম। জানি না কখনও ফিরবো কিনা। বাবা তো বাবাই। সে তার নিজের দুনিয়াতে ব্যাস্ত।
মাহি প্রতিউত্তরে কিছু বলবে তার আগেই মারসাদ থামিয়ে দিয়ে বলে,
–তোর বান্ধুবীর কাছে যা। বেচারি নার্ভাস হয়ে বারবার পানি খাচ্ছে। দেখ গিয়ে। সেন্স টেন্স হারালে প্রবলেম হয়ে যাবে কিন্তু।
মারসাদ সেখান থেকে চলে যায়। মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিরার কাছে যায়। আদিরা মাহিকে দেখে হড়বড়িয়ে বলে,
–মাহি আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে। হাত পা ঘেমে যাচ্ছে, বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আর খিদেও পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি পারর্ফম করতে পারবো না। খুব ভয় হচ্ছে।
মাহি আদিরার মন ডাইভার্ট করতে উচ্ছাসিত হয়ে বলল,
–সেসব পরে দেখা যাবে। আর আমার ভাই সামলে নিবে। আগে তুই বল, তুই পারর্ফমেন্সে কী ড্রেস পড়বি? গানের সাথে মিলিয়ে পড়িস।
আদিরা পাশ থেকে একটা ড্রেস বের করে মাহিকে দেখিয়ে বলে,
–এটা তোমার ভাইয়া দিয়ে বলল নাচের জন্য পড়তে।
মাহি ড্রেসটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাদা রঙের জর্জেটের লং ঘেরালো কুর্তি সাথে পাজামা ও ওড়না। সব শুভ্রতায় রাঙানো। মাহি চোখের কোনে জমে উঠা জলের বিন্দু আঙুল দিয়ে মুছে ফেলে। তারপর ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে মলিন কন্ঠে বলে,
–ড্রেসটা খুব সুন্দর। তোকে খুব সুন্দর লাগবে। একদম এক পরীর মতো।
মাহি ড্রেসটা আদিরার হাতে দিয়ে চলে যায়। আদিরা মাহির চোখের কোনে জমে উঠা অশ্রকণা দেখেছিল। হুট করে হাসিখুশি মেয়েটার মনে আষাঢ় ঘিরে এলো কেনো তা তার বোধগম্য হলো না।
……..
শেষ সময়ের প্রস্তুতির সময় মারসাদ আদিরাকে বলে,
–শোনো, তুমি স্টেপ ভুলে গেলেও টেনশন করবে না। আমি যেই ফ্লোতে যাবো তুমিও সেই ফ্লোতে যাবে। না পারলে আমি আস্তে করে বলে বলে দিবো। বুঝেছো?
আদিরা মাথা নিচু করে ঘার নাড়ায়। মারসাদ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে স্টেজের পেছোন দিকে গান সেট করার ডিরেকশন দিতে চলে যায়। তখন সেখানে সামিরার আগমন ঘটে। সামিরা এসে আদিরার চারপাশে একবার ঘুরে এসে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,
–কা’ককে পেখম লাগালে কা’কই লাগে। আমিও দেখব কী ডান্স করো স্টেজে। পুরো অডিয়েন্সের হাসির পাত্র হবে তুমি।
আদিরার নার্ভাসনেস যেনো আরও বেড়ে গেলো। মাহি তখন আদিরার থেকে কিছুটা দূরে ছিল। মাহি এসে সামিরাকে হাসিমুখে সুন্দর করে বলে,
–আহ! সামিরা আপু। বাদ দেও না। আদুর পারর্ফমেন্সে নিয়ে তোমাকে ভাবতেও হবে না। তুমি নিজের পারর্ফমেন্সে ধ্যান দেও তো বেটার হবে। আদুরটা দাভাই সামলে নিবে রিল্যাক্স।
সামিরা রাগে কটমট করে বলে,
–তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে? তুমি যে আমাকে একটুও পছন্দ করো না তা আমার জানা আছে। বাট আই ডোন্টকেয়ার এবাউট ইউ।
মাহি মুচকি হেসে বলে,
–বাট আই কেয়ার এবাউট ইউ মাই ডিয়ার সামিরা আপু। দেখো দেখো অধিক চিন্তার কারণে তোমার চেহারায় রিংকেলস পরে যাচ্ছে। দিন দিন বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হচ্ছো!
অপমানে দগ্ধ সামিরা তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করে। মাহি দাঁত কেলিয়ে হাসে। আদিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–চিল আদু। একদম রিল্যাক্সে থাক। সব পারফেক্ট হবে।
আদিরা প্রতিউত্তরে মলিন হাসলো।
……
স্টেজে কয়েকটা পারর্ফমেন্সের পর নাচের জন্য স্টেজে মারসাদ ও আদিরা। দুজনের পড়নেই সাদা আউটফিট। সাউন্ড বক্সে জুবিন নিটুয়ালের গান বাজছে।
“Rim jhim ye saawan phir barsaatein le Aaya hai.
Mausam mohabbaton ka khud chalke aaya hai.
sare shehar mein sirf humko bheegaya hai,
Rim jhim ye saawan phir barsaatein le Aaya hai.
Pehli Mohabbat hai aur pehli ye baarish hai
Bharlo bahon mein aasmaan ki nabajish hai.
Kitna kush hai dekho na ye aasmaan.
Hai khushnaseebi meri sari zamaane mein,
Jo hamsafar tune mujhko banaya hai,
Rim jhim ye saawan phir barsaatein le Aaya hai.”
(বেশি বড় গানের লাইন লেখার জন্য সরি। বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।)
নাচের স্টেপগুলো নিজেদের বানানো। নাচের মাঝে যখন আদিরা মারসাদের হাত ধরে ঘুরছিল তখন পায়ের কাছে থাকা একটা তার কেউ হেঁচকা টান দেয়। যার ফলশ্রুতিতে আদিরা ঘুরা অবস্থায় একদম পরে যেতে ধরলে স্টেজের ফ্লোরের কয়েক ইঞ্চি উঁচু থেকে মারসাদ আদিরার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। তারপর সেখান থেকে মারসাদ নাচের অন্য স্টেপ তুলে। আদিরা পরে যাওয়ার ভয়ে চোখ-মুখ খিঁচে নিয়েছিল কিন্তু কোমড়ে কারও স্পর্শে সম্বিত ফিরে পেলে সে আর নাচের কোনো স্টেপ নিজ থেকে দিতেই পারছে না। মারসাদ যেমন ভাবে বলে দিচ্ছে ও ঘুরাচ্ছে তেমনভাবেই করছে। অবশেষে পারফর্মেন্স শেষ হলে সবাই করতালির মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করে।
ব্যাক স্টেজে সামিরা ক্রুদ্ধ হয়ে সাউন্ডবক্সে লা’থি দিয়ে এখন নিজেই এখন পা ধরে লাফাচ্ছে। এই দৃশ্য রবিন, মৃদুল ও রাফিন দেখে হেসে গড়াগড়ি অবস্থা। সামিরা রাগে কটমট চাহনি নিক্ষেপ করছে ওদের দিকে কিন্তু ওদের এতে কোনো হেলদোল নেই। আদিরা ও মারসাদ স্টেজ থেকে নেমে এলে মাহি গিয়ে আদিরাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর উৎফুল্লতা নিয়ে বলে,
–মাঝের ওই স্টেপটা ওয়াও ছিল জাস্ট। আদু পড়ে যাচ্ছিলো আর দাভাই এন্ড মোমেন্টে ধরে তারপর কী সুন্দর করে টেনে তুলে আবারও ঘুরালো এরপর টেনে আনলো। আর প্রথম দিকেও দারুণ ছিল। শেষটা মাইন্ড ব্লোয়িং।
আদিরা বিনিময়ে মুচকি হাসলো। মারসাদ ঘরি ঠিক করতে করতে বললো,
–অনেক স্টেপ প্র্যাকটিসের বাহিরে দিতে হয়েছে। সে তখন পরে যাওয়ার ভান ধরে নি! সে পড়েই যাচ্ছিলো কারও হিংসার বদৌলতে।
মারসাদ আঁড় চোখে পায়ে হাত দিয়ে বসে থাকা সামিরার দিকে তাকিয়ে বলল। মাহি ও আহনাফ সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝে গেলো ব্যাপারটা। মারসাদ আবার বলে,
–তার ওড়না আমার ঘরির সাথে বারবার বেজে যাচ্ছিলো ওই সিনটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। সে আবার স্টেপ ভুলেও গিয়েছিল। যাই হোক, সবটা ঠিক ভাবে মিটে গেছে।
মারসাদ বাঁকা হেসে আহনাফকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আদিরা লাজুক হাসলো। ওদের আরেক বান্ধুবী এসে আদিরাকে নিয়ে নাচ নিয়ে কথা বলছে। মাহি ওই মেয়েটার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–এই সাবিহা, আমার ও আদুর একটা ছবি তুলে দেও তো। এই ড্রেসটাতে আদুকে ঠিক একজনের মতো লাগছে। যে আমার ও দাভাইয়ের হৃদয়ের খুব কাছের। একটা ছবি তুলে দেও পরে আমি সেটা দেখে দেখে একটা চিত্র আঁকবো। আমি ওর নাচের সময় কয়েকটা ছবিও তুলে নিয়েছি পরে আঁকবো বলে।
সাবিহা মেয়েটা মাহি ও আদিরার ছবি তুলে দিলো।
#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বিকেল পাঁচটা বেজে যাবে। আদিরা সাড়ে চারটায় টিউশনের সময় এগিয়ে এনেছে যাতে জলদি পড়িয়ে মেসে ফিরতে পারে। আদিরা আশেপাশে কাউকে খুঁজছে যার কাছে নাচের সময় পড়া ড্রেসটা দিয়ে যেতে পারবে। খুঁজতে খুঁজতে সুমিকে পেয়ে গেলো। সুমির কাছে ড্রেসটা দিয়ে সে চারটার দিকে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যায়। স্টুডেন্টের বাড়ি বেশি দূরে না। হেঁটে গেলে বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগে। আগের দিন গলিতে গলিতে ঘুরার কারণে খুঁজতে বেগ পেতে হয়েছিল। আদিরা টিউশন করাতে গেলো।
….
মাহি চারুকলা ভবনের কাছে একটা পদ্ম জলাশয় আছে সেখানে বসে বসে ছোট ছোট ইটের কণা ছুড়ছে আনমনে। আজ তার রঙ তুলিও তার মন খারাপের সঙ্গী হচ্ছে না। হঠাৎ আচমকা তার পাশে কারও উপস্থিতির আভাস পেয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে আহনাফকে দেখলো সামনের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। মাহি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। আবারও একই কাজ করতে নিলে আহনাফ মাহির হাত ধরে ফেলে বলে,
–এতো সুন্দর ফুটন্ত পদ্ম দেখেও তোমার মনের বিষন্নতা কাটে নি?
মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–উহুম। মন আমার কথা কোনো কালেই শোনে না। তার যখন যা ইচ্ছে হয় সে তাই করে।
আহনাফ মাহিকে কিছু বলল না। ওদিকে মারসাদও একাকি থাকার জন্য কোথায় একটা গেলো আহনাফকে বলে নি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। যেকোনো সময় কাঁদতে শুরু করবে। আহনাফ ও মাহি পাশাপাশি বসে আছে নিঃশব্দে। নীরবতায় আচ্ছন্ন তাদের মাঝে। কিয়ৎক্ষণ পর মাহি আনমনে বলে,
–তিন বছর আগে আপিলির আমাদের থেকে দূরে চলে যাওয়ার কী কোনো দরকার ছিল? আপিলি চলে গেলো সাথে করে দাভাইকে ঘর ছাড়া করে গেলো। আমার শান্তশিষ্ট দাভাই হয়ে গেলো রাগী ও বদমেজাজি। খুব কী দরকার ছিল?
আহনাফ জবাব দিলো না। সন্ধ্যা নেমে আসছে খুব দ্রুত। মূলত ভারী বর্ষণ হবার পূর্বাভাস হিসেবে সূর্য সময়ের আগেই লুকিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের মেঘের আড়ালে। আহনাফ আকাশের অবস্থা দেখে মাহিকে বাড়ি ফিরতে তাগদা দিলে মাহি ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বলে।
_______
মারসাদ একটা সোনালু ফুল গাছের নিচে বসে আছে। বসে বসে ফোন টিপছে। সন্ধ্যার আজানের আরও আধ ঘণ্টা বাকি। রাস্তার পথচারি হাঁটার জায়গায় মারসাদ বসে আছে। সাথে একটা রিকশাওয়ালাকে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে। সোনালু ফুল পুরো রাস্তায় চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে। গতকাল রাতে বৃষ্টির দরুণ ফুলগুলো ভেজা অবস্থায় লেপ্টে আছে। আরেকটু দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেও ফুল ভেজা অবস্থায় চাদরের মতো বিছিয়ে আছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসার মতো অবস্থায় নেই। ভিজে স্যাঁতসেঁতে তাই এখানে সোনালু ফুল গাছটার কাছে বসেছে। এই রাস্তায় বাস ও ট্রাক চলাচল করে না। প্রাইভেট কার ও রিকশা চলে। আশেপাশে বড়ো বড়ো দুই-একটা অট্টালিকা থাকলেও রাস্তাটা নিরব থাকে প্রায় সময়।
ঘরিতে সোয়া ছয়টা বাজার কিছুক্ষণ আগেই আদিরা হন্তদন্ত হয়ে একটা গলির থেকে বেরোলো। আজ তাকে স্টুডেন্টের মা জোর করে ছুটির পর চা নাস্তা খাইয়েছে। পড়ানোর সময় নাস্তা দেয় নি কারণ স্টুডেন্টের মা প্রকৃতির রূপ বিশ্লেষণ করে মেয়ের টিচারের সাথে একসাথে চা পান করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। আদিরা বারবার আকাশে জমা কালো মেঘের দিকে তাকাচ্ছে আবার হাতের বাটন মোবাইলে সময় দেখছে। তার অসাবধানতার কারণে একটা রিকশার সাথে লেগে যেতেও যায় নি। একদম নাক বরাবর রিকশাটা গেলো তার।
আশেপাশে কে আছে নাকি নেই তাতে তার বিন্দুমাত্র নজর নেই। সে তো বৃষ্টি ও সন্ধ্যার আগে মেসে ফিরতে পারলেই হলো। আদিরা মারসাদের পাশ দিয়ে যাওয়া ধরলে মারসাদ আদিরাকে ডেকে উঠে,
–ওহ মিস পার্পল কুইন! এতো তাড়া কিসের তোমার যে আশেপাশে নজর নেই?
আদিরা চমকে তাকালো। চেনা কন্ঠস্বর শুনে ঘুরে মারসাদকে দেখতে পেলো। মারসাদ বসা থেকে উঠে আদিরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো পকেটে ফোন ঢুকিয়ে। আদিরা অবাক কন্ঠে সুধায়,
–আপনি এখানে ভাইয়া?
মারসাদ রুষ্ঠ হলো। আদিরার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
–কেনো? জায়গাটা কী তোমার নামে রেজেস্ট্রি করা? না তো। তাহলে আমি এখানে আসতে পারবো না কেনো? আর মুখ দিয়ে তো ভাইয়া! ভাইয়া! বলে ফেনা তুলে ফেলছো। একটু তো দম নেও। চলো আমার সাথে।
আদিরা ভীত হলো। নাচ শেষ করার মাধ্যমে তো সে মারসাদের হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিল কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? আদিরা আমতা আমতা করে বলে,
–ভাইয়া সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকে মেসে ফিরতে হবে।
মারসাদ কিছুটা সামনে এগিয়ে বলে,
–আমি কী বলেছি আমার সাথে ডেটে চলো?
আদিরা তাজ্জব বনে গেলো। আদিরার মনোভাবে,
“লোকটা বেশি অহেতুক কথা বলে। কখন কী বলে বোঝাই যায় না।”
মারসাদ ভ্রুঁ চুলকাতে চুলকাতে বলে,
–তোমাকে বুঝতেও হবে না। চলো আমার সাথে।
আদিরা বেঁকে বসলো। সে যাবে না। মারসাদের কথায় নাচ তো করলো। তারপরেও কেনো পিছু পরে রয়েছে! মারসাদ গলার স্বরে গম্ভীর্যতা এনে বলে,
–দেখো আদিরা, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তখন তোমারই বিপদ। আমি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবো না। তোমাকে তোমার মেস অব্ধি পৌঁছে দিবো। দেখো রিকশাওয়ালা মামাকে সেই আধঘণ্টা ধরে দাঁড়া করিয়ে রেখেছি।
আদিরা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
–আমি একা যেতে পারবো ভাইয়া। আপনাকে কস্ট করতে হবে না।
মারসাদ কপাল কুঁচকে বলে,
–তোমায় কে বলল আমি কস্ট করছি? আমি এখানে প্রায়ই একা একা বসে থাকতে আসি। আর এই রিকশা আমার জন্যই ঠিক করা। পথিমধ্যে তোমাকে দেখলাম তাই ভাবলাম এটা আমার দায়িত্ব তোমাকে সেফলি তোমার মেসে পৌঁছে দেই। চলো এবার। আমাকেও তো ফিরতে হবে। তোমার জন্য অযথা সময় নষ্ট করতে পারবো না।
আদিরা কী করবে বুঝতে পারছে না। একটা ছেলের সাথে একসাথে রিকশায় গেলে মানুষজন কতো রকম মন্তব্য করবে আর যদি রুমমেটদের কেউ দেখে ফেলে!
মারসাদ মনে হয় আদিরার ভাবনা বুঝলো। মারসাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–তোমাকে কিছুটা দূরেই নাহয় নামিয়ে দিবো। আর এই রাস্তাটার সামনে একটা একদম নিরব গলি পরে। সেই গলিতে মাঝেমধ্যে কিছু ছেলেদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। ওদের মনে কী আছে তা না তুমি জানো আর না আমি। এখন ভেবে দেখো।
আদিরা পরশুদিনের কথা চিন্তা করলো। সেদিন সে কয়েকটা ছেলেকে দেখেছিল। তবে তারা কিছু বলে নি বা করে নি। এমন সময় রিকশাওয়ালা বলে উঠে,
–আফামনি, ভাইজান ঠিকই কইছে। কিছু পোলাগো ওই মোরের দিকে দেহা যায়। আর আইজকা তো আন্ধার হইয়া আইছে। আপনার লাইগ্যাই ভালা হইবো ভাইজানের লগে গেলে। ভাইজানরে মুই চিনি। হে বহুত ভালা মানুষ। আপনে চলেন। ডরাইয়েন না।
আদিরা দ্বিমনা করতে করতেও রিকশায় উঠলো। মারসাদ বাঁকা হেসে নিজেও রিকশায় আদিরার পাশে উঠে বসলো। আদিরা কিনারার দিকে চেপে বসলো যা দেখে মারসাদ আলতো হাসলো। রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘুরিয়ে চালাতে শুরু করলো। দশ মিনিটের মধ্যে আদিরার মেস থেকে কিছুটা দূরে আদিরাকে নামিয়ে দিয়ে মারসাদ রিকশাতে করে চলে গেলো। মাগরিরের আজান হয়ে যাবে দুই মিনিটের মধ্যে। মারসাদ ভার্সিটির হলের কাছে মসজিদের দিকে রিকশাওয়ালাকে যেতে বললো।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,