#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২১
সন্ধ্যার সময় বান্দবান থেকে রাদিবের মৃ*ত্যুর খবর এলো। রাদিবের পরিবারে শোকের মাতম। রাদিবের মায়ের প্রেশার ফল করে সেন্স হারিয়ে ফেলেছিল। এখন তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। কতক্ষণ পরপর সে রাদিবের নাম নিয়ে বিলাপ করছেন। রাদিবের লা*শ আনার ব্যাবস্থা হচ্ছে দ্রুত। রুহুল আমিন বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছেন না। সাগরকে তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন। সাগর তখনও খবরটা জানে না। সাগর চট্টগ্রামে তার বাড়িতে এখন। সাগর ঘুমিয়েছিল। কয়েকবার ফোনের রিংটোনে সে বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে চিৎকার করে অকথ্য গা*লাগা-ল শুরু করে।
রুহুল আমিন প্রচণ্ড রেগে বললেন,
–তোর ঘুম আমি বের করবো। তুই না বলছিলি বান্দরবান তোর পরিচিত আছে। তাহলে রাদিব আ*ত্মহ*নন করলো কেন? জবাব দে।
সাগর হুড়মুড় করে উঠে বসে। রাদিব যে কিনা নিজের জীবন বাঁচাতে এতো বছর পালিয়ে ছিল! সে সু*ই*সা*ইড করেছে? সাগর বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে বলল,
–কী সব বলছেন? রাদিবের এন্টারটেইনিং এর জন্য তো সব ব্যাবস্থা করা ছিল। যা আমি নিজে হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলে করেছি। তাহলে সু*ই*সা*ইডের কারণ কী? সে তো আনন্দেই ছিল।
রুহুল আমিন বিরক্ত হয়ে ফোন কে*টে দেয়। রাদিবের পরিবার তদন্ত করতে চায় তাদের ছেলে কী আ*ত্মহ*ত্যা করেছে নাকি খু*ন হয়েছে। কিন্তু রুহুল আমিন সেখানে বাধ সাধেন। কারণ তিনি জানেন রাদিব কিছুটা হলেও মা*দকা*স*ক্ত। এখন যদি ব্যাপারটা জানাজানি হয় তাহলে আরও ঝামেলা হবে। আর রাদিব যা যা সেবন করতো তা চুলের স্যাম্পলে ৯০ দিন মা*দ*কের প্রভাব পাওয়া যায়। তাই জলদি ক*বরস্থানে নিয়ে ক*বর দিয়ে দিতে চান।
…….
রাদিবের মৃ*ত্যুর নিশ্চিত খবর পেয়ে মারসাদ উচ্চস্বরে হেসে উঠে। আহনাফরা মারসাদের সাথেই। মারসাদ হোস্টেলের ব্যালকনি দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে বলে,
–এল*এস*ডি কাজে দিয়েছে। জাস্ট দুইটা হাইডোজ। আর সাথে আপিলির বেশে ঘুরে বেড়ানো রমণী। রাদিব যে সামান্য হলেও মা*দ*কা*স*ক্ত তা আমি জানতাম। আজ আপিলির এক কা*লপ্রি*টের বিনাশ হলো। এখন রুহুল আমিন। তবে রুহুল আমিনকে ধরাশায়ী করতে হবে ওর অ*বৈধ ব্যাবসাতে। মা*দক ব্যাবসা। যখন পাচার করার সময় ওর ট্রাক গুলো ধরা পরবে তখন ওর কোটি টাকার লোকসান সাথে মানহানি।
আহনাফ চিন্তিত হয়ে বলল,
–তোর কী মনে হয়? সে পারবে? সে তো রাদিবের মামাতো ভাই। আমাদের সাহায্য কেনো করছে সে?
মারসাদ বাঁকা হেসে বলে,
–কারণ রাদিব তার মামাতো ভাই নিহাদের হবু স্ত্রীকে ধ*র্ষ*ণ করে হ*ত্যা করেছিল। সাথে রুহুল আমিনও যুক্ত। নিহাদ খুব ভালোবাসতো তার হবু স্ত্রীকে। সাত বছরের প্রেমের পর বিয়ে করবে ঠিক করেছিল। রাদিব ওই ঘটনার পর বিদেশ চলে গিয়েছিল অনার্সে ক্রেডিট ট্রান্সফার করে। নিহাদ ও নিহাদের বর্তমান স্ত্রী সাথি ছাড়া কেউ জানতো না। সাথি হচ্ছে কথা মানে নিহাদের সাথে যার সাত বছরের সম্পর্ক ছিল তার আপন ছোটোবোন। সাথি নিজের বোনের মৃ*ত্যুর প্রতিশোধের জন্য নিহাদকে বিয়ে করেছিল কথার মৃ*ত্যুর ৪ বছর পর। কিন্তু সব সত্যি জানার পর সাথি নিহাদের সাথে মিলে রাদিবকে শাস্তি দিতে আমাদের সাহায্য করেছে।
রবিন বলে,
–এক ন*রপ*শুর পতন হলো। তবে কথা হচ্ছে সাগরকে নিয়ে। সাগর কিন্তু রুহুল আমিনের সাথে হাত মিলিয়েছে মনে হচ্ছে। আর রাত্রিকে টোপ হিসেবে ব্যাবহার করছে। রাত্রিকে কিভাবে এসব থেকে বাঁচাবো?
মৃদুল হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
–জানি না।
ওরা পাঁচজন পরবর্তীর কাজের ছক কষতে থাকে।
……..
পরেরদিন আদিরা আহনাফের নাম্বার থেকে তার মাকে ফোন করে। আদিরার মা আদিরার কন্ঠস্বর শুনে তৃপ্তি পায়। দুইদিন সে অনেক চিন্তায় ছিল। আদিরার মা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
–কেমন আছিস মা? কাল ঠিকঠাক পৌঁছাইছিলি? আমি চিন্তায় ছিলাম অনেক।
আদিরা হালকা হেসে তার মাকে আশ্বস্ত কন্ঠে জবাব দেয়,
–হ্যাঁ মা। আমি ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছেছি। বাবা ও ভাই কেমন আছে? গ্রামে কোনো ঝামেলা হয়েছিল? কালকে আমাকে ফোন করতে বারণ করেছিল যদি দেলোয়ার খোঁজ পেয়ে যায় তাই।
আদিরার মা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
–তোর বাপ, ভাই ভালো আছে। দেলোয়ার কাইল সকাল সকাল আসছিল। তারপর তোরে না পাইয়া হুমকি-ধামকি দিয়ে গেছিল। তোর বাপে বিকালে সব দেনা পরিশোধ কইরা দিয়া আসছে।
আদিরা শেষোক্ত কথায় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–এতো টাকা আব্বা কই পাইলো? দুই লাখ তো কম না!
আদিরার মা মেয়েকে কি বলবেন বুঝতে পারছে না। তিনি কিছু বলবেন তার আগেই আদিরার হাত থেকে মারসাদ ফোনটা নিয়ে নেয়। হুট করে এমন হওয়ায় আদিরা চমকে উঠে। মারসাদ ফোন নিজের কানে নিয়ে আদিরার মাকে বলেন,
–আন্টি আমি মারসাদ। চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে একদম সুস্থ ও ঠিক আছে। আপনি কেমন আছেন আন্টি? আঙ্কেল কেমন আছেন? আর আপনার ছেলে?
আদিরার মা বুঝতে পারলেন যে মারসাদ চাইছে না আদিরা টাকার ব্যাপারে জানুক। আদিরার মা টুকটাক কুশল বিনিময় করেন মারসাদের সাথে। কথা বলা শেষে মারসাদ কল ডিসকানেক্ট করে দিয়ে আদিরাকে বলে,
–এই মেয়ে শোনো! আজকে যে তুমি এক্সট্রা বেশি সময় টিউশনে পড়াবে তো যাও তৈরি হও গিয়ে। সন্ধ্যা সাতটায় পড়ানোর সময় আজ। আমিও আজ এক্সট্রা সময় পড়াবো। জলদি যাও।
আদিরা মনের মধ্যে অসন্তোষ নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো। আদিরা যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে,
“তার কি আমাকে ধ*মক না দিয়ে কথা বললে হয় না! এমন কেনো সে? কথার প্যাঁচ কিছুই বুঝি না।”
মারসাদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি টেনে আদিরার গমনপথে চেয়ে রয়। মারসাদ নিজে নিজে স্বগোতক্তি করে,
“দিন দিন তুমি পরিবর্তন হচ্ছো। এখন তুমি মুখে না বললেও তোমার ভাব-ভঙ্গীতে প্রকাশ পায়। বড্ড অবাধ্য যে তুমি। তাইতো তোমাকে ধমকের উপর রাখতে হয়। যেদিন তুমি আমার হিয়ার মাঝে সেচ্ছায় ডুববে সেদিন তোমার শহরে ভালোবাসার বর্ষণ ঘটাবো আমি।”
মারসাদ এক পা এক পা করে পেছোতে থাকে পকেটে দুইহাত পু’রে সামনে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে। এরপর আহনাফদের সাথে টঙের দোকানে গিয়ে পাঁচ বন্ধু সিগরেট ধরায়।
________
সাগর চট্টগ্রাম থেকে ফিরে নিলয়কে ডেকেছে। নিলয় ঢাকাতেই থাকে। সাগর বলে,
–মারসাদদের কী খবর?
নিলয় জবাব দেয়,
–রাত্রি বললো মারসাদরা নাকি চট্টগ্রাম গিয়েছিল। সেখানে এক রাত থেকে ফিরে এসেছে।
সাগর বলে,
–এসব খবর তোর রাত্রি ফেসবুক দেখে এমনেই পাবে। যা আমরাও পাবো। আর রাত্রিকে লাই দিস না। এবার রাত্রিকে দিয়ে মারসাদদের ব্যাবস্থা করতে হবে। আর কতোদিন অভিনয় করবি? কাজে লাগ এবার। মারসাদের নাম খারাপ হবে পুরো ভার্সিটিতে। সবাই ছি ছি করবে।
সাগর কথাটা বলেই হেসে উঠলো। নিলয়ের মুখে হাসি ফুটলো না। নিলয় কয়েকদিন ধরে রাত্রির প্রতি নিজেকে দুর্বল অনুভব করছে। যেখানে সে নিজেদের উদ্দেশ্যের জন্য রাত্রির সাথে অভিনয় করছিল। নিলয় মা*থা থেকে রাত্রির চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে চাইল।
…….
ফাঁকা রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর একটা দুটো প্রাইভেট কার ও রিকশা দেখা যায়। আর পশ্চিমাকাশে ঈষৎ লালাভ গোধূলির আভা। দুইজন মানব-মানবী পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। বাতাসে আজ শীতল অনুভূতি হচ্ছে। আকাশ কিছুটা কৃষ্ণ মেঘের ছায়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। আদিরার মাথায় ওড়না দেয়াটা বারবার পরে যাচ্ছে। শুষ্ক চুলগুলো চোখে মুখে বারবার ভীড় জমাচ্ছে আর আদিরা হাত দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে। মারসাদ সেই দৃশ্য আঁড়চোখে অবলোকন করছে। মারসাদ ইচ্ছে করে আজ রিকশা নেয় নি। অদ্ভুতভাবে আদিরা একটা প্রশ্নও করে নি রিকশা না নেওয়াতে। দুইজন মানব-মানবীর মনে প্রথম প্রেমের অনুভূতি। মারসাদ নিজের পকেট থেকে একটা কিটকেট ও একটা ডেইরিমিল্ক চকোলেট বের করে আদিরার দিকে বারিয়ে দেয়। আদিরা হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। মারসাদও থেমে যায়। মারসাদ বাঁকা হেসে বলে,
–তোমাকে রেড ও পার্পলের মিশ্রণে ঠিক এই চকোলেট দুটোর মতো লাগছে। তাই চকোলেট দুটোকে সঠিক পাত্রে হস্তান্তর করলাম।
আদিরা অবাক হয়ে বলল,
–আপনি কিসের সাথে কি মিলালেন? আপনার কথা আমি বুঝতেই পারি না।
মারসাদ সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে বলল,
–অতো বুঝে কাজ নেই। বেশি বুঝলে তোমার ড্রাই হেয়ার আরও ড্রাই হয়ে ঝরে পরবে। কম কম বুঝবে। বুঝেছো?
আদিরা হা হয়ে গেল মারসাদের কথা শুনে। নিজের চুলে হাত দিয়ে ঠোঁট উল্টালো। শহুরে মেয়েদের মতো চুলের যত্ন সে নেয় না বলে তার কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো শুষ্ক প্রকৃতির। তার চুল নিয়ে কিছু বলা তার পছন্দ না। সে দ্রুত পা চালিয়ে মারসাদের পাশাপাশি গিয়ে বলল,
–আপনি আমার চুল নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেন না। আমার চুলে আমি মায়ের বানানো খাঁটি নারকেল তেল ব্যাবহার করি। আজ শ্যাম্পু করাতে এমন উড়ছে।
মারসাদ পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটছে। আদিরার কথায় জবাব দিচ্ছে না। আদিরা ভ্রুঁ কুঁচকে হাঁটতে হাঁটতে মারসাদের জবাবের অপেক্ষা করলো কিন্তু মারসাদের নিরবতা আদিরাকে হতাশ করলো। আদিরা মুখ ফুলিয়ে চলতে লাগলো।
#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
আকাশের ঘন ঘন ক্ষণে ক্ষণে মন খারাপ হয়। তাই বলেই তো নিজের বুক চিঁড়ে অঢেল অশ্রু বর্ষণ আকারে বিসর্জন দেয়। টিউশন করিয়ে ফেরার পথে মাঝ রাস্তায় মেঘে মেঘে গর্জন সহ বৃষ্টির দেখা মিলল মারসাদ ও আদিরার। মেঘের চিৎকার তো বহু পূর্ব থেকে শোনা যাচ্ছিল। তবে আবহাওয়া যে এতক্ষণ থম মেরে থাকবে বুঝতে পারেনি। রিকশা খুঁজছিল দুজনে। এখন দুজনে একটা দোকানের ছাদের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। দুজনেই হালকা ভিজে গেছে। দোকানের টুলে বসে আছে দুইজন। দোকানদার ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই দোকানে। এটা একটা ছোটোখাটো খাবারের দোকান। যেখানে পেঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি ও জিলাপি বিক্রি হয়। দোকানের সব খাবার শেষের পর্যায়ে তবে দোকানিকে জিলাপি বানাতে দেখা যাচ্ছে। মারসাদ ফোনের দিকে নজর দিয়ে কিছু একটা করছে আর আদিরা দোকানির জিলাপি বানানো দেখে যাচ্ছে। আদিরা উঠে গিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেসা করলো,
–চাচা, এই বৃষ্টির মধ্যে তো কোনো খরিদদার নেই আপনার। তাছাড়া রাত তো ভালোই হয়েছে। এখন জিলাপি ভাজছেন কেনো?
দোকানদার তার ক্লান্ত শ্রান্ত মুখশ্রীতে হাসির ফোয়ারা এঁকে বলেন,
–আমার ছোটো মাইয়াটা জিলাপি অনেক পছন্দ করে। আমি রাইতের বেলা বাড়িতে গেলে ওয় আমারে জড়ায়ে ধইরা জিলাপির জন্য আহ্লাদ করে। বড়ো দুই পোলা-মাইয়ার পর আমার এই ছোটো মাইয়া। বয়স তো আর কম হইলো না আমার। এই বয়সে ছোটো একটা মাইয়ার আহ্লাদ ফেলতো পারি না। তাই সব বিক্রি শেষে ওর জন্য জিলাপি ভাইজ্জা লইয়া যাই। তয় মাইয়া কিন্তু ওর মায়েরে, আমারে, ওর ভাইয়েরে না দিয়া খায় না। বড়ো মাইয়ার তো বিয়া দিছি।
আদিরার মনে হুট করে খুব সুখ সুখ কাজ করলো। সেও ছোটোবেলায় তার বাবার কাছে জিলাপির বায়না করতো অনেক। আদিরার বাবা দোকান থেকে ফেরার সময় অনেক খুঁজে পরিচিত দোকানে বলে হলেও জিলাপি আনতো। আদিরার চোখে হুট করে অশ্রুকনারা ভীর জমাতে শুরু করলো। আদিরা দোকানিকে বলে,
–চাচা, আমার জন্য কয়েকটা জিলাপি বানাতে পারবেন? আমারও জিলাপি অনেক পছন্দের। বৃষ্টির মধ্যে খুব গরম গরম জিলাপি খেতে ইচ্ছে করছে।
দোকানি কিছু একটা ভাবলেন। আদিরা দোকানিকে ভাবতে দেখে বলে,
–এক পোয়া পরিমান দিলেই হবে। আমি মূল্য চুকিয়ে দিবো। তাও মানা করবেন না।
দোকানি আদিরার সরল মুখপানে তাকিয়ে আশ্বস্ত হাসলেন। তারপর বললেন,
–না গো মা। তোমার টাকা দেওয়া লাগবো না। আমি তো আমার মাইয়ার জন্য জিলাপি বানাইতাছি আর তুমিও আমার মাইয়ার মতোই। এই কয়টা জিলাপির টাকা আমি নিমু না।
আদিরা কিছুক্ষণ ভাবলো। দোকানি অনেকটা বয়স্ক। তাই আদিরা বিক্রি না হওয়া খাবারগুলো দেখে দোকানিকে বলল,
–তাহলে চাচা আমি আপনার থেকে পাঁচটা সিঙ্গারা, পাঁচটা পুরি, তিনটা আলুর চপ ও তিনটা বেগুনি নিবো। পেঁয়াজু তো নেই। আর জিলাপি ফ্রি। ওগুলার টাকা কিন্তু নিবেন। হ্যাঁ?
দোকানি হেসে আদিরার মাথায় হাত রাখলো। যেকয়টা করে প্রতিটা পদ খাবার থেকে আদিরা নিচ্ছে তার প্রতিটাতে আরও দুইটা করে অবশিষ্ট থাকবে আদিরার নেওয়ার পর। দোকানি সেগুলো তার মেয়ের জন্য নিয়ে যেতে পারবে।
আদিরা যেহেতু সন্ধ্যার সময় বেরিয়ে এসেছে তাই মেসে তার ভাত রান্না করা নেই। দুপুরে সকালের রান্নাই খেয়েছিল। একটু তরকারি আছে। সেটা গরম করে রেখে দিবে সকালের জন্য। কেনা খাবার সে রাতের খাবারের জন্য নিবে। একা তো এতোগুলো খেতে পারবে না। মারসাদকে সে মনে মনে ট্রিট দিতে চাইলো। আদিরা মারসাদের পাশে বসে একটু হালকা করে শব্দ করলো কিন্তু মারসাদের ভাবান্তর নেই। মারসাদ কানে হেডফোনে গান লাগিয়ে বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। আদিরা কিভাবে মারসাদকে ডাকবে বুঝতে পারছে না। গায়ে হাত দিয়ে ডাকবে নাকি অন্যভাবে? অতঃপর আদিরা চিন্তায় পরে গেল। কিছু একটা ভেবে আদিরা দোকানদারের কাছ থেকে খাবার গুলো প্যাকেটে করে নিয়ে এসে মারসাদের পাশে বসে প্যাকেটটা মারসাদের সামনে বাড়িয়ে দেয়।
সামনে হুট করে প্যাকেট দেখে মারসাদ কান থেকে হেডফোন খুলে আদিরার দিকে ঘুরে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। মারসাদের এহেনো দৃষ্টিতে আদিরা থতমত খেয়ে গেলো। আদিরা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
–এখান থেকে কিছু খান।
মারসাদ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
–কেনো?
আদিরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে বলে,
–এমনেই। আমি কিনেছি তো। আর আপনি সাথে আছেন। আপনিও তো আমাকে কতো কতো সাহায্য করেছেন কিন্তু আমি আপনার জন্য কিছুই তো করিনি। একটু ভাজাপো*ড়া খাবার খেতে বলছি আরকি।
মারসাদ প্যাকেট থেকে একটা সিঙ্গারা নিয়ে বলল,
–ট্রিট দিচ্ছো? ট্রিট দিলে নিজের হাতের রান্না খাওয়াও তাহলেই হবে। আর তুমি এতোগুলো কিনেছো কেনো? আমাকে খাওয়াতে? এই রাতের বেলা ভাজাপো*ড়া এতো কে খাবে?
আদিরা হেসে বলে,
–আমি মেসে গিয়ে আর রান্না করবো না। আজকে এগুলোই খাবো। আর পরিমানে বেশি কিনেছি যাতে দুইজনে খেতে পারি। দোকানদার চাচাকে জিলাপি ভাজতে দেখে তার কাছে জিলাপি কিনতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি তার মেয়ের জন্য ভাজছেন বলে টাকা নিবেন না। তাই ভাবলাম তার বিক্রি না হওয়া কিছু খাবার কিনে নেই। বৃষ্টি না থাকলে এখন মনে হয় তিনি আরও কিছু বিক্রি করতে পারতেন।
মারসাদ হাসলো। এই সরল ও সাফ মনের মেয়েটার প্রতিটা কাজে সে মুগ্ধতা খুঁজে পায়। সঠিক কী কারণে মেয়েটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল নিজেও বুঝতে পারে না। মনে হয় সবকিছুতেই ভালাবাসা খুঁজে পায়। মারসাদ আরও কয়েকটা ভাজাপো*ড়া নিলো। আদিরাও নিলো। এরপর প্রতিটার একটা একটা করে আইটেম আদিরা প্যাকেটে পেঁচিয়ে ব্যাগে নিয়ে নিলো। যা খেয়েছে তাতে তার পেট ভরে গিয়েছে। বাকিগুলো ভাবছে রুমমেটকেও দিবে। আদিরা দোকানদারের কাছ থেকে গরম গরম জিলাপি নিয়ে মারসাদকে দিলো। মারসাদ একটা জিলাপি হাতে নিয়ে দেখে আদিরা গরম গরম জিলাপি কতো তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। মারসাদ দেখলো জিলাপিগুলো এখনও অনেকটা গরম। মারসাদ জিলাপি হাতে নিয়ে একধ্যানে আদিরার খাওয়া দেখছে।
আদিরা খেতে খেতে মারসাদের দিকে তাকিয়ে ওকে জিলাপি হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশারা করে। তারপর মুখের জিলাপিটা শেষ করে বলে,
–আপনি খাচ্ছেন না কেনো? গরম গরম জিলাপি অনেক মজা লাগে। খেয়ে দেখেন।
মারসাদ যেনো কোনো একটা ঘোরে পরে গিয়েছিল। আদিরার মুখ নিঃশ্রিত শব্দে ঘোর থেকে বের হয়ে আদিরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–কারও এতো তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে আমার মন এমনিতেই ভরে গেছে।
তারপর মারসাদও জিলাপি খেলো। আদিরা জিলাপি খাওয়ার মধ্যে মজে ছিল যে কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করলো না। এদিকে বৃষ্টির তেজ থেমে এসেছে। ঘড়ির কাটায় সাড়ে নয়টার একটু বেশি বাজে। দশটার মধ্যে মেসে ও হোস্টেলে ঢুকতে হবে। আদিরা ও মারসাদ দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে নিজ নিজ গন্তব্যে।
_________
কয়েকদিন পরে,,
ভার্সিটির ছুটি শেষ। শূণ্য ক্যাম্পাস আবারও মুখরিত ছাত্র-ছাত্রীর কলরবে। অনেকদিন পর মাহি, রিন্তি, সাবিহা ও আদিরার দেখা। চারজন ক্লাস শেষে কদম গাছের কাছে গেছে। আজ ছবি আঁকবে না তবে আজ ওরা কদম গাছের নিচে প্লাস্টিকের কিছু বিছিয়ে একসাথে খাবার খাবে। আদিরা বেশি করে ডালসবজি ও ভাজি করে এনেছে আর রুটি-পরোটা ওরা হোটেল থেকে কিনে এনেছে। আদিরারা চারজন হেসে মজা করে খাচ্ছে তখন সেখানে মারসাদরা সবাই হাজির হয়। সুমি, মৌমি ও রাত্রিকে দেখে মাহি উৎফুল্লিত হয়ে বলে,
–কেমন আছো আপুরা? আসো বসো না।
ওরা বসে। মারসাদরা পাঁচ ছেলে বন্ধুকে মাহি কিছু বললো না দেখো ওরা তীক্ষ্ণ নজরে মাহির দিকে তাকিয়ে আছে। মাহি সেটা দেখে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–তোমরা এভাবে ছোঁ*চার মতো চেয়ে আছো কেনো? যাও ভাগো এখান থেকে।
রাহিন বলে,
–তুমি আমাদের বসতে বলবা না পুচকি?
মাহি রাহিনের কথা শুনে চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,
–না! না! আমাকে তুমি পুচকি বলো কেনো রাহিন ভাইয়া? আমাকে তোমার বাচ্চা মনে হয়? যাও সরো এখান থেকে।
রাহিন কিউট করে বলে,
–ওলে আমার কিউটি আপু। তোমার এই ভাইকে দেখে তোমার একটুও মায়া হয় না?
মাহি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
–না। হয় না। যাও। আর এই ট্যারা চোখের লোকটাকেও নিয়ে যাও। কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখো। যেনো চোখ দিয়ে গি*লে খাবে। এই দাভাই, তোর এই বন্ধুটাকে বল এমন করে তাকালে আমি মোটেও ভয় পাই না। হুহ্!
মারসাদ, রাহিন, মৃদুল ও রবিন আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ ওদেরকে তাকাতে দেখে গম্ভীর স্বরে বলে,
–তোদের বোনকে বলে দে, আমি যেভাবে ইচ্ছে তাকাবো। তাতে তার কী?
মাহি মুখ ভে*ঙচি দিয়ে খাওয়াতে মন দিলো। রাহিনের খিদে পেয়েছে এমনিতে। সে আদিরাকে রিকুয়েস্ট করে,
–আপু! আমাদের দিকেও একটু নজর দেন! না মানে একটু খেতে দেন।
আদিরা মুচকি হেসে বলে,
–বসেন ভাইয়া। কিন্তু এতোজনের পরোটাতে মনে হয় হবে না। আমরা তো বেশি করে পরোটা আনি নি।
মৃদুল হুট করে বলে উঠে,
–আমি ফোন করে আনিয়ে নিচ্ছি। হোটেলবয় মতিনকে বললে দিয়ে যাবে।
অতঃপর রাহিন, মুদুল ও রবিন মাহিদের সাথে বসলো। মারসাদ ও আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুল তা দেখে বলে,
–তোদের কি নিমন্ত্রণ পত্র দিতে হবে? বস।
মারসাদ গম্ভীর স্বরে বলে,
–আমাদের তো বসতে বলে নি।
রবিন ভ্যাবলার মতো বলে,
–রাহিনকে তো বললো। তো সবাইকেই বলা।
মারসাদ ও আহনাফ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তখন সাবিহা হেসে বলে,
–আপনারাও বসেন ভাইয়া।
তারপর ওরা দুইজন বসে কিন্তু একটা ভাব নিয়ে। মাহি ওদের দুইজনের ভাব দেখে চোখ-মুখ বাঁকিয়ে বলে,
–ঢং! এতো ঢং যে কই পায়! আলাদা করে বলতে হবে এদের!
আদিরা মাহিকে কনুই দিয়ে খোঁ*চা দেয় এভাবে না বলতে। মাহি মুখ ঘুরিয়ে খেতে থাকে। আদিরা সবার দিকে পরোটা ও সবজি এগিয়ে দেয়।
_____
হোটেলবয় মতিনকে অনেকগুলা পরোটা ও কিছু ভাজি কোথাও নিয়ে যেতে দেখে সাগর ডাক দিলো। মতিন ভয়ে ভয়ে সাগরের কাছে গেলে সাগর জিজ্ঞাসা করে,
–এতো খাবার নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
মতিন ভয়ে আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
–ওই। ওই যে মৃদুল ভাই ফোন করে বলল। এগুলো নিয়ে যেতে।
নিলয় সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
–কোথায় নিতে বলেছে?
মতিনের জবাব,
–উত্তরের কদম গাছটার কাছে। আমি যাই ভাই।
এটা বলে মতিন দৌঁড়ে চলে যায়। সাগর নিলয় ও বাকিদের বলে,
–চলতো। দেখি গিয়ে।
ওরা ছয়জনও সেখানে যেতে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,