এক শহর প্রেম পর্ব -২৩+২৪

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৩
হাসি-ঠাট্টা মুখর পরিবেশ দেখে সাগরের সহ্য হচ্ছে না। সে ফোঁস ফোঁস করছে দুই হাত মুঠোবন্দি করে। এদিকে নিলয় একধ্যানে রাত্রির রোদের মতো উজ্জ্বল হাসি ঠিকরে পরা মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করে চলেছ। হৃদয় গহ্বরে এক অতিমাত্রায় সুখ কাজ করছে সাথে অজানা এক অস্থিরতা। নিলয়ের হাঁসফাঁস লাগছে। মনে হচ্ছে সে পা*গল হয়ে যাবে। নিলয় চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

–সাগর, আমার একটু কাজ আছে। আমাকে এখনি বাড়িতে যেতে হবে।

সাগর কিছু বলল না। সেও এখান থেকে চলে গেল। নিলয় ওর বাড়ির জন্য চলে গেলো।

আহনাফ তীক্ষ্ম নেত্রযুগল কুঁচকে মাহিকে পর্যবেক্ষণ করছে আর খাচ্ছে। মাহি এরকম পরোটা ভাজি আগে খেতো না কিন্তু এখন খাচ্ছে। মেয়েটার অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। মারসাদের নজর ফোনের দিকে। আজকে নতুন ভিপি ঘোষনা হবে। আশিক ভাই তাকে আধঘণ্টার মধ্যে যেতে বলেছে অডিটোরিয়ামের কাছে। মারসাদের এতে কোনো চিন্তা নেই। ভিপি যে সেই হবে তা কাল রাতেই জানা হয়েছে। আদিরা খাওয়ার ফাঁকে আড়নজরে মারসাদের দিকে তাকাচ্ছে। সে যে কয়েকদিন ধরে নিজের মনে একটা অস্থিরতা উপলব্ধি করতে পারছে! যা মারসাদকে দেখলে তার হৃদকুটিরে প্রকাণ্ড বিস্তৃত ঝরের সূত্রপাত হয়। নজর মেলাতে তার নজর ঝুঁকে আসে। আদিরার আড়চোখে তাকানোর মাঝে মারসাদ ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর সরিয়ে নেত্রযুগল আদিরার সলজ্জ আঁখিযুগলে শুভদৃষ্টি ঘটায়। আদিরা ধরা পরে অতিসত্তর দৃষ্টি নিচু করে। মারসাদ মুচকি হাসে।

খাওয়া-দাওয়ার পর্বের সমাপ্তির পর ওরা সকলে এখন যার যার ক্লাসে যাবে তখন রাফিন বলে,

–আহ! আজ পেট আমার শান্তি। তোমরা পারলে প্রতিদিন এমন করে খাবার আনবে হ্যাঁ?

সকলে হেসে উঠে রিন্তি কিছুক্ষণ যাবত রাহিনের খাওয়ার ধরন দেখে কিছু বলতে চাইছিল। বলা বাহুল্য যে রাহিন একটু পেটুক টাইপ। রিন্তি মুখ ফসকে বলেই ফেলে,

–এরকম রা*ক্ষসের মতো খাওয়ার জন্য আপনাকে বলবো!

রাহিন চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়। রিন্তি সাথে সাথে নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে। বিড়বিড় করে বলতে যেয়ে জোরে বলে ফেলেছে সে। রিন্তি ব্যাপারটা ঘুরাতে আদিরাদের তাড়া দিয়ে বলে,

–এই জলদি চল। নোট করতে হবে আর ক্লাস শুরু হবে। চল চল।

রিন্তি সবার আগে সেখান থেকে সটকে পরে। রাহিন আহনাফদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায়। মৃদুল হেসে রাহিনের পেটে খোঁচা দেয়।

_______

নিলয় নিজের বাড়িতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁপাচ্ছে। তার বাড়ি থেকে ইউনিভার্সটির দূরত্ব দেড় ঘণ্টার মতো তাও সে সেকেন্ড ইয়ার শেষে হোস্টেল নিয়েছে। তারপর থেকেই সে সাগরের সাথে অতিমাত্রায় মিশতে মিশতে বদলে গেছে। আগেও ফ্রেন্ডশিপ থাকলেও সে বর্তমানেরর নিলয়ের মতো ছিল না। সাগর কলেজ থেকেই ঝামেলাত জড়ানো স্বভাবের তবে নিলয় ঠিক তার উল্টোটা। কিভাবে সে সঙ্গদোষে খারাপ পথে ধাবিত হলো সে কয়েকদিন ধরে সেটাই উপলব্ধিতে আছে। তার হুট করে এই উপলব্ধির কারণ তার বোন নিহা।
ছুটির মধ্যে একদিন রাত তিনটা বাজে নিহার রুমের বাইরে দিয়ে পানি খেতে যাবার সময় নিহার ফিসফিস কন্ঠে কথা বলার আওয়াজ পায়। নিহা একটা ছেলের সাথে প্রেম করে আর ছেলেটার জন্য এই রাত তিনটা বাজে জেগে হেসে হেসে কথা বলছিল। নিলয়ের তখন মনে পরলো, রাত্রিও তার সাথে এভাবে কথা বলে। রাত্রিও তার বোনের মতো আশায় বুক বাঁধে। তাহলে সাগরের কথায় রাত্রির সাথে ধোঁকা খেলাটাতো ঠিক না। তখন সে কীসব ভাবতে ভাবতে রাত্রির সাথে দুইদিন যোগাযোগ করে নি। ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। তৃতীয়দিন ফোন অন করে রাত্রির শখানেকের বেশি মেসেজ ও মিসডকল দেখে তার বুক ধক করে উঠে। কেনো সে নিজেও জানেনা। সে রাত্রিকে তৎক্ষণাৎ ফোন করলে রাত্রি কেঁদে কেঁদে কথা বলে। তারপর থেকেই সে রাত্রির প্রতি নিজেকে অনেক দুর্বলতা বুঝতে পারে। নিলয়ের মাঝে মাঝে মনে হয় যদি তার বোনকেও কেউ এভাবে কষ্ট দেওয়ার পরিকল্পনা করে থাকে? এক ভীতু মনের ভাই সে। নিজের সদ্য কলেজ পড়ুয়া বোনকে নিয়ে তার ভয়ের শেষ নেই।

“পৃথিবীর প্রতিটা ভাই যদি সময় থাকতে তার বোনের সাথে নিজের প্রেমিকা বা স্ত্রীর মানসিক অবস্থার তুলনা করে তাহলে সমাজ সুস্থ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।”

_______

শ্রাবণ মাসের আর দুইদিন বাকি। আজ সারাদিন গুড়ি গুড়ি হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির হালকা ছাঁট গায়ে লাগলেও তার অতিমাত্রায় কম। ভার্সিটির ছুটির পর আদিরা টিউশনে যাচ্ছে। সে রাতের টিউশনটার দুইদিন যে বিকেলে পড়ায় সেটাতেই। আদিরা সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছে তার পেছোনে কেউ আসছে। আদিরা পেছোনে ঘুরে দেখে এক ছোটো বাচ্চা মেয়ে একহাত ভরতি কদম ফুলের গুচ্ছ আর আরেকহাতে একটা ডালা যেটাতে কাঠগোলাপ ও বকুল ফুলের সমাহার। আদিরা এতো সুন্দর ফুল দেখে হা করে তাকিয়ে রয়। আদিরাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চা মেয়েটা আদিরার কাছে এসে কদম ফুলগুলো আর ফুলের ডালাটা দেয়। তারপর দৌঁড়ে চলে যায়। আদিরা এই কান্ডে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। ডালাটার উপর এক শুভ্র রঙের কাগজ প্রজাপতির মতো করে শেপ করা। আদিরা কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে দেখে,

“এই যে মেয়ে, শুভ্র আভায় ফুলগুলো দিয়ে তোমাকে আমন্ত্রণ। শরতের নিমন্ত্রণ রইলো।

‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।’
[কাজী নজরুল ইসলাম]
তারার মতো বকুলের ঘ্রাণে তোমার হৃদয় বিমোহিত হোক শুধু আমাতে।

‘কাঠগোলাপের সাদার মায়ায় মিশিয়ে দিয়ে ভাবি,
আবছা নীল তোমার লাগে ভালো।’
[গা’ন]
হলুদাভ সাদা রঙে রাঙুক আজ তোমার মনের ধরণী। রঙিন কাঠগোলাপের অভ্যর্থনা তোমাকে দিতে আজ আমি অপরাগ।

‘এক সূর্য কুসমে বহু শুভ্র ঝালর!
মনে হয় বর্ষা তার রূপ ঢেলে দিয়েছে।’
_____তিথী
কদম ফুলের সিক্ত অভ্যর্থনা। ”

আদিরা বড়ো আকারের প্রজাপতি আকারের কাগজটার লেখাগুলো পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। এতো ফুল নিয়ে তো স্টুডেন্টের বাড়িতে যেতে পারবে না তাই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে স্টুডেন্টের মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো রাতে পড়াতে আসবে। এখন আদিরা চিন্তায় পরে গেলো এসব কে তাকে পাঠালো? তবে ফুলগুলো অতিমাত্রায় সুন্দর। মন ভালো করার ক্ষমতা রাখে। আদিরার মন বলছে হয়তো মারসাদ! আবার নাও হতে পারে। আদিরা ফুলগুলো নিয়ে হাঁটছে। আবারও তার সিক্সথ সেন্স বলছে কেউ তাকে আড়ালে অনুসরণ করছে। আদিরা পেছোনে ঘুরে কাউকে দেখতে পেলো না। আদিরা ভাবলো সে এবার অন্য উপায়ে পর্যবেক্ষণ করবে। হুট করে হো*চট খাওয়ার ভঙ্গিমায় পরে যেতে নিয়ে ফাঁকা রাস্তার সাইডে বসে পড়ে। তারপর পা ধরে হালকা চিৎকার করে। ফুলের ডালা থেকে দুয়েকটা ফুল ভূমিতে ছড়িয়েছে। আদিরা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

আড়ালে দাঁড়ানো মানুষটি তার প্রেয়সীর আচমকা চিৎকারে দৌঁড়ে আসে। তারপর পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিতে নিলে আদিরা পা সরিয়ে নিয়ে থতমত কন্ঠে বলে উঠে,

–আপনি? আপনি এখানে কেনো?

মারসাদ আদিরার পা সরিয়ে নেওয়া দেখে গম্ভীর কন্ঠে ধমক দিয়ে বলে,
–এতো প্রশ্ন কেনো? চুপচাপ পা দেও। দেখি কোথায় মোচড় লেগেছে।

আদিরার পা জোর করে টেনে নিয়ে মারসাদ দেখতে লাগলো আর আদিরা নিরব হাসলো। তার সন্দেহ সঠিক ছিল। কিন্তু এই ত্যাড়া মানবটি তো নিজ মুখে স্বিকার করবে না। আদিরা কিছু একটা ভেবে বলল,

–সব দোষ এই ফুলগুলোর! এগুলো কে দিলো তা ভাবতে ভাবতে আমার পায়ে মোচড় লেগেছে। লাগবে না এই ফুল! আমি সামনের ডাস্টবিনে ফেলে দিবো। এখন আমি হাঁটবো কী করে!

মারসাদ মাথা তুলে আদিরার মুখের দিকে তাকালো। তারপর পায়ের থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে গম্ভীর স্বরে বলল,

–অভিনয় খুব ভালোই আয়ত্ত করেছ। তোমার পায়ে কোনো মোচড় আসে নি। আমি যদি খেয়াল না করে আরেকটা উলটো মোচড় দিতাম তবে তুমি সত্যি সত্যি হাঁটতে পারতে না।

আদিরা ধরা পরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো। মারসাদ বাঁকা হাসলো। আদিরা উঠে দাঁড়িয়ে ফুলগুলো নিয়ে মাটি থেকে তুলে নিয়ে বলল,

–মোচড় না খেলাম তবে নখে তো ঘষা লেগেছে! আর এই ফুলগুলো কে দিলো তাই ভাবুন আপনি। আমার ভয় হচ্ছে অনেক। আমি ফেলে দিবো এগুলো।

মারসাদ ধ*মক দিয়ে বলে,
–ফুলের কী দোষ? তোমাকে তোমার কোন প্রেমিক ফুল দিয়েছে তার জন্য তুমি এই ফুলগুলোর অসম্মান করবে? চুপচাপ এগুলো নিজের কাছে রাখো।

আদিরা মুখ ফুলিয়ে মারসাদের দিকে চাইলো। মারসাদ নিজে দিয়েছে সেটা স্বিকার না করার খুব ভালো পন্থা অবলম্বন করেছে। আদিরা অসন্তোষ কন্ঠে বলল,

–যদি ফুলগুলো আমায় দেলোয়ার দিতো তখন? তখনও কী এভাবে রাখতাম? শোনেন, ফুলের পবিত্রতা সর্বত্র হলেও যখন কেউ সেটা কাউকে দেয় তখন তার মনের উপর ফুলের পবিত্রতার তারতম্য হয়। অশুভ হাতে ফুলের পবিত্রতা অসম্মানিত হয়। তাই যে দিবে তার নিয়তের উপর সবটা নির্ভর করে।

মারসাদ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। বোকা বোকা মেয়েটার মুখে এখন দারুন বুলি ফুটছে যে সে মারসাদকেও মাত দিতে প্রস্তুত। মারসাদ একরোখা স্বরে বলে,

–তুমি কী জানো? যে দিয়েছে সে খারাপ উদ্দেশ্যে দিয়েছে? চুপচাপ নিজের কাছে রাখো। আর চিরকুটে তো সব বলাই আছে!

আদিরা হুট করে খিলখিল করে হেসে উঠলো। মারসাদ হাসির মানে না বুঝে কনফিউজড হয়ে চেয়ে রইল।
#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
হৃদয়কারা হাসিতে বিমোহিত হয়ে মারসাদ একটা ঘোরে পরে গেছে। পড়ন্ত বিকেলে ঈষৎ রক্তিম আভা মুগ্ধকরা হাসি আরও দৃশ্যায়িত করেছে। পাখিরা নিজ নিজ নীড়ে কলরব করে ফিরছে। সময়টা উপভোগ্য। আর হৃদয়ের রানীর হাসির ঝংকার এক আলাদা সুর তোলে। আদিরা মারসাদের দিকে এক পলক দৃষ্টি বিনিময় করে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। কিছুটা এগিয়ে পেছোন মুড়ে জোড়ালো কন্ঠে বলে,

–ফুলগুলো সুন্দর। এক অন্যরকম শুভ্রতার সৌন্দর্য। চিরকুটের কথাগুলো হৃদয় ছোঁয়ানো। ধন্যবাদ আপনাকে। এত সুন্দর উপহার গুলোর জন্য!

কথাগুলো বলে আদিরা সামনের দিকে অগ্রসর হয় আর পেছোনে চায় না। পেছোনে তাকালে সে মারসাদের মুখশ্রীতে অবাক মিশ্রিত সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখতে পেতো। মারসাদ নিজে নিজেই বলে,

–বুঝে গেছে সে। শুরু তবে এক শহর প্রেমের অন্যরকম উপাখ্যান!

মা*থা চুলকে হেসে স্থান প্রস্থান করে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
………………

মাহি ও আহনাফ একটা ওপেন ক্যাফেতে বসে আছে। ওপেন বলার কারণ ক্যাফেটা কোনো বদ্ধ ঘরের ভিতরে না। খোলামেলা জায়গায় খোলা আকাশের নিচে শুধু প্রতিটা টেবিলে বেতের তৈরি ছাউনি দেয়া। আশেপাশে বিভিন্ন রকম ফুল ও ক্যাকটাস গাছের সমাহার। মাহি কোল্ডকফি স্ট্র দিয়ে খাচ্ছে আর আহনাফ ব্ল্যাক কফি। মাহি মা*থা তুলে কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেসা করে,

–দাভাই ভিপি হবার জন্য রাজী হলো কী করে? সে তো এক প্রকার পণ করে বসেছিল যে ভিপি হবেই না।

আহনাফ বাঁকা হেসে কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে,
–একটু ভয়, একটু সংকা। তোমার কথা ভেবে ভিপি পদ থেকে সরে গিয়েছিল তারপর তার জীবনে এক রমণীর আবির্ভাব ঘটে আর সে তখন আরও চিন্তিত হয়ে পরে। তোমাদের দুইজনের জন্য সে আবার নিজের পদে দাঁড়িয়েছে। নিজের অতীতকে পেছোনে ফেলে। এতে সাগরেরও ভূমিকা আছে। সাগরের কাজের কারণে মারসাদ নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নিয়েছে। আর কয়েকদিন পর আশিক ভাই পদ ছেড়ে দিবে আর মারসাদ অফিশিয়ালি ভিপির দায়িত্ব নিবে।

মাহি দাঁত বের করে হেসে আবার স্ট্র মুখে নেয়। আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
–এই তুমি ব্রাশ করো না? এতো হলুদ কেনো দাঁত?

মাহি আচমকা এমন কথায় চমকে উঠার কারণে কফি নাকে মুখে উঠে হিচকি উঠে যায়। আহনাফ দ্রুত ওয়েটারকে ডেকে পানির বোতল আনিয়ে নেয়। মাহি পানি পান করে স্বাভাবিক হয়ে আহনাফের দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর রেগে বলে,

–অ*সভ্য পুরুষ! আমাকে না খোঁচালে আপনার হয় না? আমার দাঁত হলুদ আপনাকে কে বলল? প্রতিদিন দুইবার ব্রাশ করি আমি। চকলেটের কারণে এমন দেখাচ্ছে আর আপনি…!

আহনাফ বাঁকা হেসে বলে,
–আমি যা দেখেছি তাই তো বলেছি।

মাহি রাগে মুখ ঘুরিয়ে কফি খাচ্ছে। আহনাফ মাহির রাগ দেখে নিঃশব্দে হাসলো। নিজের ফোনটা মাহির দিকে টেবিলে এগিয়ে দিলো। মাহি আঁড়চোখে একবার আহনাফকে দেখে ফোনের দিকে দেখল। ফোনের স্ক্রিনে নিজের আঁকা ছবি বড়ো করে ফ্রেমে বাঁধাই করা দেখে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো ওটা আহনাফের বাড়িতে ওর বেডরুমে বেডের পেছোনের দেয়ালে লাগানো। মাহি অবাক হয়ে সুধালো,

–আপনি এইজন্য আমাকে দিয়ে আঁকিয়েছেন? ওয়াও।

আহনাফ হাসিমুখে বলল,
–ইয়েস মেম।

মাহি মুখ ভাড় করে বলল,
–আমি আপনাকে কতো সুন্দর একটা ছবি এঁকে দিলাম কিন্তু আপনি তো আমায় বিনিময়ে কিছু দিলেন না!

আহনাফ মাহির অভিযোগ শুনে ওর দিকে সামান্য ঝুঁকে গেল। তারপর সম্মোহিত কন্ঠে বলল,

–কী চাই বলো? আমি পুরোটাই তোমার সামনে উপস্থিত!

মাহি আহনাফের কপালে আঙুল ঠেকিয়ে আহনাফের মাথা নিজের কাছে থেকে সরিয়ে বলে,
–সময় মতো চেয়ে নিবো। আপনার সাহয্য দরকার পরবে। তখন ফেরালে আর কোনোদিন কিচ্ছু চাইবো না।

আহনাফ মাহির কথার মানে না বুঝে তীক্ষ্ম নজরে চেয়ে আছে। মাহি তা দেখে হেসে বলে,
–বাদ দিন। এবার বলেন, সেলিব্রেশন কবে আপনাদের? দাভাইয়ের সে কী জানে? নাকি আমি জানাবো?

আহনাফ বলে,
–জানাতে পারো। কবে যে ওদের মাঝে সব সেটেল হবে! তোমার ভাইকে বলি সরাসরি বলতে কিন্তু সে সরাসরি বলবে না। খাবার সামনাসামনি না খেয়ে মাথার পেছোন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে খাবে! পোলার ধৈর্য মাশাআল্লাহ্!

আহনাফ কথাগুলো বলছিল আর অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দেখাচ্ছিল। মাহি হাসতে হাসতে মুখের কফি ছিটকে ফেলে দিয়েছে যা কিছুটা আহনাফের শার্টে লেগেছে। আহনাফ শার্টের দিকে চেয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল। মাহি টিসু নিয়ে জলদি করে আহনাফের কাছে গিয়ে শার্ট মুছে দিচ্ছে আর মিটমিট হাসছে। আহনাফ ভাবেনি মাহি এরকম করবে। আহনাফ হা করে তাকিয়ে আছে। মাহি আহনাফের কাছ থেকে সরে আসার সময় আলতো স্বরে বলল,

–আপনারা দুই বন্ধু একই প্রজাতির!

মাহি নিজের জায়গার বসে কোল্ডকফিতে শেষবারের মতো চুমুক দিয়ে বলে,

–আজকে আর না। আমার বুঝা হয়ে গেছে যে আজকে আমি কফিটা শান্তিতে আর খেতে পারব না। এখানে আরও থাকলে আরও অনেক কিছু হবে। এর চেয়ে ভালো আজ উঠি। সন্ধ্যা নেমে আসছে।

আহনাফও উঠে দাঁড়ায়। মাহিকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আহনাফ মসজিদের দিকে চলে যায় তারপর টিউশনে যাবে।
………….

সন্ধ্যার পর মারসাদ ও আদিরা একই রিকশায় যাচ্ছে। রিকশার প্যাডেলের শব্দ ব্যাতিত মাঝেমধ্যে গাড়ির হর্ণ কিন্তু ওদের দুজনের মাঝে বিস্তর নিরবতা। মারসাদ নিরবতা ভেঙে বলে,

–তো তোমার সিদ্ধান্ত কী?

আদিরা সাইডের দিকে এরেকটু চেপে বসলো অতঃপর কী বলবে ভেবে পেলো না। মারসাদ জবাব না পেয়ে বলে,

–জবাব হয়তো আমার জানা তবে তোমার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। সাহস সঞ্চারেই যুগ কাটিয়ে দিও না যেন!

আদিরা মুচকি হেসে এবার মুখ খুলল।
–আপনি তো আমার বাবা-মায়ের মত নিয়েই রেখেছেন! তাহলে এই ঘটা করে বলা না বলাতে কী এসে যায়?

মারসাদ চমকে তাকালো কিন্তু আলোক স্বল্পতার কারণে আদিরার মুখাবয়ব দৃশ্যমান হলো না। আদিরা নিজ থেকেই বলে,

–জানতে চান তাই না? যে আমি কী করে জানলাম? মাকে ফোন করেছিলাম। তখন মা আপনার কথা জিজ্ঞেস করল। এর আগে যে দুইদিন কথা বলেছি প্রতিবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছে। তাই আজ আমিই তাকে জিজ্ঞেস করলাম কারণ। তখন বলতে না চাইলেও বলেছে যে আপনি নাকি এই একা শহরে আমার খেয়াল রাখতে পারবেন। আর কিছু বলেনি। যেখানে আমার মা আপনাকে এক দেখায় এতো ভরসা করে সেখানে আমি আপনাকে তার থেকে কিছুটা হলেও জানি।

মারসাদের অধরে খেলে যায় পরিতৃপ্তির হাসি। না বলেও ভালোবাসা যায়।

________

কাজী অফিসের ভেতর থেকে নিলয় ও রাত্রি বের হলো। রাত্রির চোখে-মুখে লাজুকতা। তারা আজ বিয়ে করেছে। বিয়ের খবরটা আপাততো গোপন রাখবে। রাত্রির কান্না ও জোরাজুরিতে বিয়েটা হলো। নিলয় অনেক ভেবে-চিন্তে রাত্রির সাথে সম্পর্ক শেষ করতে চেয়েছিল। নিলয় রাত্রিকে বলেছিল, ওদের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ক্ষয়-ক্ষতির কারণ হতে পারে তাছাড়া ওরা দুজন একেঅপরের শত্রু পক্ষের। তাই সমাপ্তি সময় থাকতে করা উত্তম।
কিন্তু চাইলেই কী এতো সহজে এক লহমায় ভালোবাসা ভুলা যায়? রাত্রির সাথে নিলয় টানা এক সপ্তাহ কোনো যোগাযোগ করে নি। এদিকে রাত্রি কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে হোস্টেলে পরে ছিল। সুমি ও মৌমিরা রাত্রির অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত হয়ে পরেছিল। মারসাদদের জানালে আফসোস ছাড়া কীইবা করবে! তারপরেও ওরা সবাই রাত্রির মন ভালো করতে ঘুরতেও গিয়েছিল কয়েক জায়গায়। নিলয় এক মেয়ের মাধ্যমে রাত্রির খবর জানতে পেরে রাত্রিকে ফোন করে। রাত্রি ফোন হাতে নিয়ে সুমি ও মৌমির সামনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। কান্নার জন্য সে কথাও বলতে পারছিল না। সুমিরা বুঝিয়েছিল মুভ অন করতে কিন্তু এতোদিনের ভালোবাসা ভুলতে পারছে না রাত্রি। রাত্রি স্বভাবত নরম মনের। এরপর দুই-তিনদিন পর রাত্রির কান্না ও জোরাজুরিতে হার মেনে নিলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা বিয়ে করবে কিন্তু দুই পক্ষের কারও বন্ধুদের জানাবে না। আর আজ ওদের বিয়ে হলো।

নিলয় রাত্রির বামহাত নিজের ডানহাতে মুঠোবন্ধি করে রাত্রির লাজুক হাসি দেখে চলেছে। কতোটা মুগ্ধতা এই হাসিতে। কিন্তু সে নিজের কর্মের কারণে এই হাসি স্লান হওয়ার কারণও হতে পারে। নিলয়ের নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কেনো সে ভালোবাসা নিয়ে খেলতে গেল! আর খেলতেই যখন গেল তখন এতো গভীরভাবে মায়ায় কেনো পড়ল!

“পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।”

নিলয় চাইলেও পারছে না সব ছেড়ে চলে আসতে। সাগর অনবরত তাকে হু*মকি দিচ্ছে। কেনো রাত্রির সাথে ফিজিক্যাল হয়ে ভিডিও বানিয়ে তা এডিট করে মারসাদের নাম খারাপ করছে না? কেনো এত সময় নিচ্ছে?
এতসব প্রশ্নের নিলয়ের কাছে কোনো জবাব নেই। কীইবা জবাব দিবে? অভিনয়ের বেড়াজাল থেকে কখন সে অভিনয়ের বাহিরে চলে গেছে নিজেও সে বিষয়ে সন্দিহান। নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিলয় ভাবে, সাগরকে বলতে হবে যে রাত্রি ওসব খারাপ কাজের জন্য একদম রাজি হয়নি বলে সে রাত্রির সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। আরও ভাবে, সে এখন থেকে বাড়ি থেকে এসে ক্লাস করবে এবং সাগরকে বলবে, তার বাড়িতে এই সময় থাকাটা জরুরী।

রাত্রি অনেকক্ষণ যাবত নিলয়কে অন্যমনস্ক দেখে হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
–এই কী হয়েছে তোমার?

নিলয় রাত্রির দিকে চেয়ে কৃতিম হেসে মা*থা নাড়ায়। তারপর বলে,
–রাতপাখি শোনো, তোমার সাথে আমি ক্যাম্পাসের ভিতর খুব একটা দেখা করব না। আমি এখন থেকে আমার বাসায় থাকব। তুমি তো সব বুঝো। আমি তুমি এখন বিবাহিত। আমাদের সম্পর্ক সবার সামনে আসলে আরও বিপদ। তোমাকে এটুকু তো বুঝতে হবে।

রাত্রি মন খারাপ করে বসে আছে। এতো লুকোচুরি তার ভালো লাগে না। নিলয় রাত্রির হাতে চুমু দেয় আর রাত্রি আবারও লাজুকলতার ন্যায় নুইয়ে পরে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here