#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫২
একটি মেয়ে যখন অনুভব করতে পারে , যে তার ভেতরে আরও একটি প্রাণ বেড়ে ওঠছে, আমার মনে হয়না এর থেকে কোনো সুখকর জিনিস তার কাছে আর আছে। আমার অনুভূতিটা ঠিক সেরকম। হ্যাঁ, আমার গর্ভে আনভীরের একটা ছোট্ট অংশ বেড়ে ওঠছে , এর প্রতিক্রিয়া আমার আসলে কি দেখানো উচিত আমি নিজেও জানি না। একজন মেয়ের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মা হওয়ার প্রাপ্তিটা , যেটা আমি পেয়েছি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার জীবন হয়ে গিয়েছিলো অন্ধকার, প্রতিটা পদে পদে অপমান, হতাশা আর লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি। তবে আনভীর আমার অনধকার জীবনে এসেছিলেন দূত হয়ে, যে আমার সবচেয়ে বেশি হতাশার কারন ছিলো। আমাদের বিয়ের প্রথম দিকে যে মানুষটা আমায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে , তিনি আনভীর ছাড়া আর কেউ নন।তবে কেউ কি জানতো যে আমার হতাশার মানুষটিই আমার জীবন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিবে?
ঘটনাটি ছিলো কিছুদিন আগের। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আমার শরীরের কন্ডিশন খুব একটা ভালো ছিলোনা। ঘন ঘন জ্বর আসতো, কোনো খাবারের স্মেল নিতে পারতাম না, খেলেই বমি করে দিতাম। প্রথম কয়েকদিন ব্যাপারটা আমি স্বাভাবিকভাবে নিলেও আমার হুট করে খেয়াল হলো লাস্ট মান্থে আমার পিরিয়ড স্কিপ করেছে। আমার মনে অজানা আশঙ্কা ঢুকলো এবার। আনভীরকে ভয়ে বলতেও পারছিনা কারন উনি সরাসরিই আমায় বলেছিলেন এখন কনসিভ না করতে। তবে আমার আর উনার দ্বারা অজান্তেই একটা ভুল হয়ে গিয়েছিলো , যার জন্য এ ব্যাপারে খচখচানি জেগেছে আমার মনে। পরে আনভীর আমায় হসপিটালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলেও আমি ভয়ে কিছু বললাম না। তবে এ কথা কি আর লুকিয়ে রাখা যায়? যা হলো তাই। ডক্টর আমায় প্রেগনেন্সি টেস্ট করতে দিলেই আনভীরের হাত পায়ে হিম ধরে গেলো। কেননা উনি ধারনাও করতে পারেননি যে আমার প্রেগনেন্সিজনিত কোনো কারন হবে এটি। রিপোর্ট হসপিটালে সাধারনত ১২ ঘন্টা পর দেয়। তবে আনভীর ইমার্জেন্সির কথা বলে এক্সট্রা চার্জের ভিত্তিতে অল্পসময়েই রিপোর্ট ফেরত পাওয়ার ব্যস্থার করলেন।
রিপোর্ট দেখার পর আমার সন্দেহ পুরোপুরি দূর হলো এবার। আমার চোখ নিষ্প্রভ। গলার স্বর ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে এসেছে। আমি অবাক নয়নে একবার আনভীরের দিকে তাকিয়ে আবার রিপোর্ট দেখলাম। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘POSITIVE’ , তারপর আনভীরও দেখে বিমূঢ় হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।ডক্টর আমাদের দুজনকেই সাধুবাদ জানালেন তবে আনভীর একটি টু’ও করলেন না এতে। ডক্টর ভেবেছেন যে উনি হয়তো এখনও শক এ আছেন এ সুসংবাদ শুনে। তবে আমি জানি উনার এমন প্রতিক্রিয়ার কারন অন্যকিছু।
পুরোটা পথে উনি একটাও কথা বললেন না আমার সাথে। এমনকি আমায় এপার্টমেন্টের সামনে নামিয়েই নিজের গাড়ি নিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। বাসায় সবাই যখন আমার প্রেগনেন্সির খবর পেলো , খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেলো সবাই। মা আমায় নিজের কাছে টেনে প্রাণভোরে দোয়া করে দিলেন আমার আর আমার অনাগত সন্তানের জন্য। শিউলি ভাবিও সাধুবাদ জানাচ্ছে এবার। বলেছে , এতদিন আমি ভাবির খেয়াল রেখেছি , এবার ভাবি আমার খেয়াল রাখবে। অয়নের তো তিনমাস অলরেডি পার হয়ে গিয়েছে তাই বেবির সাথে ঘর সংসার সামলানো খুব একটা কঠিন কাজ হবেনা ভাবির জন্য। আমি পুরোটা সময় রইলাম নির্বিকার। কেননা আনভীরের ব্যবহার বেশ ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে।উনি কি কোনোভাবে খুশি না এ ব্যাপারে? মা ভাবি বারবার জিজ্ঞেস করলো যে উনি কোথায় , তবে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। চুপ করে চলে গেলাম নিজের রুমে।
সময় ঘনিয়ে রাত নেমে এলো এবার। সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আনভীরের। সাড়ে এগারোটা প্রায় বেজে গিয়েছে , কিন্ত উনার কোনো খবর নেই। আমি অনেকবার কল দিলাম কিন্ত একবারও রিসিভ করলেন না। শেষমেষ সুইচ অফ করেদিতেই আমার চোখে অশ্রু ভর করলো। শিউলি ভাবি তন্মধ্যেই এসেছেন আমায় শুভরাত্রি জানানোর জন্য। আমার কাদো কাদো মুখ দেখে উনি বিচলিত হয়ে বসে পড়লেন আমার পাশে। বললেন,
-কি হয়েছে আহি বোন? তোমার চোখ মুখ এমন ফুলে আছে কেন?
আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। শিউলি ভাবিকে জড়িয়ে অঝোরে ধারায় কাদতে লাগলাম। ভাবি সান্তনা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন এতে। জিজ্ঞেস করছেন যে কি হয়েছে। আমি কাদো কাদো হয়ে বলে ওঠলাম,
-আনভীর,,,,,,আনভীর রাগ করেছেন ভাবি। উনি,,,,উনি এই বাচ্চা চান না। নাহলে বাবা হয়েছেন জেনেও কেনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না উনি?
পাঁচ বছরের শিশুর মতো আনভীরের নামে অভিযোগ করছি আমি ভাবির কাছে। কেননা উনার এই শীতল প্রতিক্রিয়াটা খুবই কষ্ট দিয়েছে আমায়। এটা সত্যি যে আমার প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা আনএক্সপেকটেড ছিলো। আমাদের কাছাকাছি আসার পরই উনি আমার হাতে পিল ধরিয়ে দিয়েছেন যার দরুন আমি বুঝলাম উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল। ভাবির অবস্থা দেখে উনি এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে উনি আপাদত চাচ্ছিলেন না বাচ্চা নিতে। তবুও আমাদের একটা ভুলের কারনেই আজ আমি এই প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। ভাবি মৌনতা কাটাচ্ছিলেন আমার কান্নাসুরে। তারপর জড়ানো গলায় বললেন,
-এর জন্য কান্না করতে লাগে বোকা? আনভীর শুধু একটু শকড আছে। দেখো , রাতের মধ্যেই ও ফিরে আসবে। তারপর ওই হতচ্ছাড়া কে আমি কান মলা দিয়ে ধরবো। কতো বড় সাহস ! আমার বোনকে কাদায় ও?
ভাবি আমায় ঘুমোতে বলে প্রস্থান করলেন ঘর থেকে। আমার শরীরটা আগের তুলনায় দুর্বল লাগছে অনেক। অল্পতেই চোখে ঘুম বিরাজ করে। তাই খাটে শরীর এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ঘুমের তলদেশে চলে গেলাম।
রাত বাজে তিনটা কি সাড়ে তিনটা। হঠাৎ নিজের খুব কাছাকাছি কারও অস্তিত্ব পেতে চোখ খুললাম আমি। দরজা খানিকটা ভিড়ানো, আনভীর আমায় নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জরিয়ে ধরে গলায় মুখ গুঁজে বেসামালভাবে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। আমি অনঢ় হয়ে গেলাম উনার এমন কাজে। পরনে শার্ট আর প্যান্ট দেখে বুঝতে বাকি রইলো না উনি মাত্রই বাড়িতে ফিরেছেন। ডুপ্লিকেট চাবি থাকাতে ঘরে আসতেও তেমন একটা কষ্ট হয়নি। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম,
-আমায় ছাড়ুন আনভীর । দম আটকে আসছে আমার।
উনি ছাড়লেন না। বরং কথার পরিপ্রেক্ষিতে আরও শক্ত করে মিশিয়ে রাখলেন আমায় উনার নিজের সাথে। যার দরুন উনার ঠোঁট আমার গলায় গভীরভাবে ঠেঁকে গিয়েছি। আবেশে শরীর উষ্ণ হয়ে আসলো আমার। নিঃশ্বাস পড়তে থাকলো ঘনঘন। আনভীর শুকনো ঢোক গিললেন। গলায় মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললেন,
-আমাদের মাঝে নতুন একটা প্রাণ আসতে চলছে আহি , (আমার পেটে হত স্পর্শ করে) এখানে, এখানে হবে তার সূচনা। আমি কিভাবে সামলাবো আমার অগোছালো অনুভূতিটাকে?
চোখে অভিমানের অশ্রু ভর করেছে আমার। উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে অভিমানী গলায় বললম,
-সরুন আমার কাছ থেকে। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি ? এখন মনে পড়েছে যে আপনি বাবা হতে চলেছেন? জানেন কতক্ষণ আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম? আর আপনি পাষাণের মতো আমায় রেখে চলে গেলেন দূরে। ফোনও ধরলেন না। এর মানে কি এটাই যে আপনি বাবা হওয়াতে খুশি………..’
আমায় কথা বলতে না দিয়ে আমার চোখে কপালে চিবুকে থুতনিতে তৃষ্ণার্তের মতো নিজের অধর যুগলের আগ্রাসী রাজত্ব চালাচ্ছেন আনভীর। আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম। চোখ হয়ে আসছে নিষ্প্রভ। এই মানুষটা জানে না যে উনার অহেতুক আক্রমণে আমি অন্য জগতে চলে যাই? আনভীর আমার কোমড়ে জড়িয়ে কপালে একটা দীর্ঘক্ষণ চুমু দিয়ে আবেশিত দৃষ্টি এলিয়ে দিলেন আমার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়ায়। গভীর সম্মোহনী কন্ঠে বললেন,
-ডাক্তার যখন তোমায় টেস্ট করাতে বললো তখনই আমার একটু সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্ত আমি চাইনি যে তুমি প্রেগনেন্ট হও এখন। বিশ্বাস করো আহি, ভাবিমণির কথাগুলো ভাবতেই আমার বুক কেপে ওঠে। সেদিন ভাবির কি কষ্টটাই না হয়েছিলো। আর তুমি তো এখনও ছোট , পড়ালেখা বাকি, সবচেয়ে বড় কথা কনসিভ করার ক্যাপাবিলিটি তোমার থাকলেও আমি ভয় পাচ্ছি। আমার নিজের ওপরই অবিশ্বাস জমেছে যে আজরান ভাইয়ার মতো যদি আমি কোনো ভুল করে ফেললে কি অবস্থা হবে তোমার? আজরান ভাইয়া যেখানে শক্ত ছিলো, আমি মরে যাবো আহি। এজন্যই চাইনি যে তুমি এখন কনসিভ করো। তবে ডাক্তার যখন বললো যে রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে, আমার কি হলো জানিনা। শুধু প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে ছিলাম। তাইতো তোমায় বাড়িতে দিয়ে এসে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম লোকালয় থেকে অনেক দূরে। ক্রমেই আমার বোধ ফিরে এলো। আমি অনুভব করতে পারলাম পিতৃত্ব লাভ করার এক আকুল আনন্দ। আই,,,,আই এম গোয়িং টু বি ফাদার আহি! আমার ভালোবাসার একটা ছোট্ট অংশ একটু একটু করে তোমার মধ্যে বেড়ে ওঠবে।আমি,,,,,আমি বেসামাল হয়ে পড়েছি আহি, এমন সুখে চরমভাবে বেসামাল হয়ে পড়েছি।
আমার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো উনার সম্মোহনী কন্ঠে। নীরবে কাদছেন আনভীর। এই প্রথম উনায় কাদঁতে দেখলাম। অশ্রুটা সুখকর হলেও একই সাথে আমার জন্য ভয় কাজ করেছে। আমি উনার কন্ঠনালিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে ওঠলাম,
-আপনার এই বেবি আপনার মতোই কেয়ারিং হবে দেখেন? একটুও তার মা’কে কষ্ট দেবে না।
ফিক করে হেসে দিলেন আনভীর। সেই সাথে আমিও। আমাদের দুজনের মনে এক চরম ভালোলাগা কাজ করছে। সেই সাথে আরও গভীর হয়েছে আমাদের বন্ধন। কে জানতো আনভীরের মতো শীতল মানুষটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে?
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫৩
আমার প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকে আনভীরের ‘কেয়ারিং’ নামক অত্যাচার যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে গিয়েছে এবার। এটা করো না, ওটা করো না, এটা খাও, ওটা খাও আরও কতো কি। শুধু আনভীর না , মা-বাবা , শিউলি ভাবি, আজরান ভাইয়া সবাই অতিরিক্ত কেয়ার টাইপ টর্চারে আমার মতো মাসুম মেয়েকে ফালাফালা করে ফেলেছে। আমাদের বেডরুমে এখন আমার জামাকাপড় কম, বেবির জামা-কাপড় খেলনা বেশি। যেদিকে আমার চলছে মাত্র চার মাস। সবই আমার পাগল বর সাহেবের কেরামতি। আজরান ভাইয়া তো সরাসরি আনভীরকে বলে দিয়েছে, আমার যত্নের কোনো ক্রুটি হলে আমার সামনে উনাকে চড় থাপ্পড় মারতেও দু’বার ভাববে না, ধমকানো তো দূরের কথা। শিউলি ভাবি এর আগে পড়ে গিয়েছিলো বলে আমার সময়ে পুরো ঘরে ওয়াটারপ্রুফ কার্পেট মুড়িয়ে দিয়েছেন। নুড়ী আপা আমার পেছনে চব্বিশ ঘন্টা নিয়োজিত। আনভীর আগে ভার্সিটিতে ক্লাস এটেন্ট করে টিচার্স রুমে ওভারটাইম কাজ করতেন, কখনও কলিগদের সাথে এদিক ওদিক যেতেন। তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও সরাসরি বাসায় এসে পড়েন। তারপর ফ্রেস হয়ে বাচ্চা ছেলেদের মতো আমার কোলে মাথা রেখে গল্প করতে থাকেন বেবির সাথে।
এইতো কিছুদিন আগের কথা। ভার্সিটির এক প্রফেসরের মেয়ের বার্থডে অনুষ্ঠান থেকে আসার সময় আমার জন্যও কেক নিয়ে এসেছেন। উনি বলেছেন আগে নুড়ী আপা যেই ফলগুলো কেটে দিয়েছে ওগুলো শেষ করার জন্য। কিন্ত আমি আমার সিদ্ধান্তে অনঢ়। আগে কেক খাবো মানে কেকই খাবো। উনি ইতিমধ্যে শার্ট প্যান্ট পাল্টে একটা হাফ হাতা টিশার্ট আর ট্রাউয়ার পড়ে শুয়ে পড়লেন আমার কোলেমাথা রেখে। তারপর পেটে মুখ গুঁজে বললেন,
-দেখেছো চ্যাম্প! তোমার পিচ্চি মাম্মিটা কতো পাজি। আমার একটা কথাও শুনছে না। এখন ধমক দিলেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেদে ফেলবে। তুমি জলদি বের হয়ে আমার দলে যোগ দাও। তারপর ফাদার-চ্যাম্প দুজন মিলে তোমার পাজি মাম্মিটাকে সাইজ করবো।
আমি উনার কথা শুনে চোখ তাকিয়ে তাকালাম। বললাম,
-এখনই আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন ওকে?
-হুম। এখন থেকেই মিশন স্টার্ট করছি। এখন দূরে না সরালে পরে আমি তোমার কাছাকাছি আসবো কখন? আর যাই হোক, তোমায় নিয়ে কম্প্রোমাইজ আমার পক্ষে ইম্পসিবল।যতই আমাদের বেবি হোক না কেনো? আহি ইজ অনলি মাইন এন্ড উইল বি মাইন ফরেভার❤️
আমার ঠোঁট কোলে আচমকা একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। ক্লান্ত লাগছে উনাকে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। অবিন্যস্ত চুলগুলো কপালে আছড়ে পড়াতে বিপদজনক লাগছে উনাকে। ঠোঁট নাড়িয়ে যেভাবে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলছেন নিমিষেই আমার হৃদয় কাপিয়ে দিতে বাধ্য। আনভীরের মধ্যে পরিবর্তনটা আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে আমার কাছে। আমি কথা না বাড়িয়ে আলতো হাতে উনার অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলাতে থাকলাম।
_____________
আজ মামুন ভাইয়া খাগড়াছড়ি থেকে অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। আমার শরীরের কন্ডিশন জেনেই আনভীরের চাচি ভাইয়াকে দিয়ে আচার, পাহাড়ি পেপে সহ পাঠিয়েছেন আরও অনেক কিছু। আচারের প্রতি সবসময়েই আমার একটা দুর্বলতা কাজ করতো। আবার এ সময়ে এমনিতেও অনেক টক টক খেতে মন চায়। তাই আচারের কৌটো নিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসে পড়লাম আমি। অয়নকে ভাবি আমার পাশে একটা কাথাঁ দিয়ে শুয়িয়ে রেখেছে। কি সুন্দর কিউট বেবিটা। ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে যখন আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতহীন মাড়ির সাহায্যে হাসতে থাকে আমার প্রচন্ড ভালো লাগে দেখতে। আমি অজান্তেই আমার পেটে হাত বুললাম। উফফফ! তুমি যে কবে আসবে?
তন্মধ্যেই হতদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন আনভীর। আজ সময়ের আগে বাড়িতে ফিরে আসাতে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। সচরাচর উনি এত দ্রুত বাড়িতে আসেন না। আমার সাথে কোনোরূপ কোনো কথা না বলেই উনি বড় বড় পা ফেলে চলে গেলেন বেডরুমে। আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম। অয়নকে এখানে রেখে যেতেই পারছি না। ভাবি না আসা পর্যন্ত আমি বসে রইলাম অয়নের পাশে। তারপর আমি বেডরুমে গিয়ে দেখি উনি আসলে বেডরুমে নেই, ছিলেন বারান্দায়। সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকারে উনাকে ডিভানে শরীর এলিয়ে বসে থাকতে দেখে আমি অবাক। উনি বসে আছেন চোখ বন্ধ করে, ঠোঁটজোড়া অল্পবিস্তর কেপে উঠছে বারবার। আমি উনার পাশে গিয়ে বসলাম। কপালে হাতের উল্টোপিঠ স্পর্শ করে বললাম,
-আপনার তো জ্বর আসেনি। তাহলে এমন শরীর খারাপ দেখাচ্ছে কেনো?
-অনেক বড় কিছু হয়েছে আহি!
অজানা আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে উঠলো আমার বুক। ভয়ে রীতিমতো ঢিপঢিপ শব্দটা দ্বিগুন হারে বেড়ে গিয়েছে। আলো আধারের খেলায় উনার অন্ধকার মুখ দেখে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা যে হয়েছেটা কি। আমি স্থির হয়ে বসে রইলাম অল্পক্ষণ। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-ক-কি হ-হয়েছে?
-রিপোর্ট এসেছে তোমার আলট্রাসনোগ্রাফির।
নিজের অনাগত সন্তানের ব্যাপারটা উঠতে আমার ভয় যেন আরও জেঁকে বসলো মনে। মনে পড়লো দুদিন আগে আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর সময়কার কথা। অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। তটস্থ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
-ক-কি অবস্থা রিপোর্টের? কোনো খারাপ কিছু হয়েছে যে আপনি এত চিন্তিত? প্লিজ বলুন?
নিশ্চুপ রইলেন আনভীর। আমি অধীর হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
-বলছেন না কেনো আনভীর? কি হয়েছে?
-আমাদের টুইন বেবি হবে আহি!
আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে৷ তৎক্ষণাৎ বলা এই কথাটি এখনও আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র ধারন করতে পারেনি৷ ক্রমেই আমি আন্দাজ করতে পারলাম উনার বলা কথাটা। হয়ে গেলাম নিস্তব্ধ।
আনভীর নির্বিকার হয়ে ডিভানে নিজের শরীর ছেড়ে দিয়েছেন৷ নিঃশ্বাসের দরুন ওঠানামা করছে উনার প্রসস্থ বুক। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম,
-আমাদের ট টুইন বেবি হ হবে?
-হুম, আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট এসেছে।
আমার চোখে মুখে প্রকাশ পেলো এবার নতুন এক আভা। বিগত কয়েকদিন ধরেই আমার অবস্থা অনেকটাই খারাপ ছিলো। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বমি আর পেটের আকারটাও সময়ের তুলনায় বড় হওয়াতে দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আনভীরের। তাই আনভীর চেকাপ করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমায়। তবে আমার যে টুইন বেবি হবে এটা একেবারেই আমার ধারনায় ছিলো না। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার পেট স্পর্শ করলাম আবার৷ কেননা এখানে এখন দুটো প্রাণের উপস্থিতি টের পাচ্ছি।
আমায় তুমুল অবাক করে দিয়ে আনভীর হাঁটু দিয়ে বসে পড়লেন আমার পেটের কাছটাতে। তারপর কামিজের ওপর দিয়ে গভীরভাবে নিজের অধরের আদ্র স্পর্শ করালেন। আমি নিষ্প্রভ। উনি আমার কোলে মাথা রেখে শীতল গলায় বললেন,
-আমার পাগলাটে ফিলিংসের তোমার কোনো ধারনা আছে আহি! ছোটবেলা থেকেই টুইন বেবির প্রতি আমার অন্যরকম একটা ভালোলাগা ছিলো। আর আজ আমি টুইন বেবির বাবা হতে চলেছি জানতে পেরে আমি যেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লাম। ইসস! আহি, তোমায় এই ছোট্ট পেটে কিভাবে আমার আমার দুটো চ্যাম্পকে রাখবে তুমি? সুইটহার্টস! জলদি তোমরা বের হয়ে পাপার কাছে আসো৷ মা’কে বেশি কষ্ট দিও না কেমন?
আমি নির্বাক হয়ে রইলাম উনার কথায়৷ আমি জানি উনি ওপর দিয়ে হাসিখুশি থাকলেও ভেতর ভেতর চিন্তায় পাগলপ্রায়৷ আর যাই হোক, টুইন বেবি নেওয়ার মতো হেলথ কন্ডিশন আমার হয়নি৷ আর টুইন বেবির সময়ে অনেক প্রবলেমই নাকি হয়৷ মায়ের লাইফ রিস্ক ও থাকে। আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লা। এসব কথা ভাবলে আমিও উনার মতো অধিক শোকে কাহিল হয়ে যাবো। আপাদত সময়টি হচ্ছে ভালোভাবে কাটানোর সময়৷
.
.
দিনেক দিন আনভীর আরও যত্নশীল হয়ে উঠেছেন আমার প্রতি। টুইন বেবি হবে জানার পর তো সেই মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ উনি এমন একটা কান্ড করছেন যে এই পৃথিবীতে আমিই প্রথম নারী যার টুইন বেবি হবে। আমিও যে কম যাচ্ছি এমন ধারনাটা ভুল। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু দ্বারাই উনাকে অতিষ্ঠ করে তুলছি। যখন তখন দুস্প্রাপ্য আবদার করছি আর উনি যদি পূরণ করতে না পারেন, তারপরই জারি করি ‘মিশন ইগ্নোরেন্স’, কেননা আনভীর আর যাই হোক, আমার এড়িয়ে চলাটা কখনোই সহ্য করতে পারেন না।
সেদিন রাতে উনি বাহির থেকে আমার জন্য ক্লিয়ার থাই সুপ নিয়ে এসেছিলেন। কারন দুপুরে আমি যা খেয়েছি সবই বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। পরন্তু শিউলি ভাবি আমার এ অবস্থা আনভীরকে বলতেই উনি সুপ নিয়ে আসেন আমার জন্য৷ কিন্ত খাওয়ার প্রতি একদন্ডও মন ছিলো না আমার। উনি শত চেষ্টা করে চলছেন এমনকি আমি খেলে আমায় আর বেবিকে কিসিও দিবেন বলেছেন আমার হেলদোল নেই৷ পরে আমায় জোর করে খাওয়ানো মাত্রই আমি উনার ওপর বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। তবে আনভীর কিছু বললেন না আমায়। বরং নীরবতার সাথে সবকিছু পরিষ্কার করে শুয়িয়ে দিলেন খাটে।
এমনই চলছিলো দিনকাল।আনভীর সকালে আমায় খাবার খাইয়ে চলে যান ভার্সিটিতে। তারপর রাতে এসে কোলে মাথা পেতে শুয়ে থাকেন। কখনও কখনও অয়নকে নিয়ে খেলা করতে থাকেন খাটে। এটা সত্য যে বাবা হওয়ার আনন্দে সেই গোমরামুখো আনভীর অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছেন। আগে যেই মানুষটা আমায় ধমকের ওপর রাখতো, এখন পারলে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখেন আমায়। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো আমার যত্ন নেন। হুটহাট মুড সুয়িং, উনাকে উত্যক্ত করা এসব করে কি মজা পাচ্ছিলাম কে জানে? এখন প্রায় মধ্যরাত। বাহিরে আঁধারে পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে আছে৷ আমি ড্রসিংটেবিলের ওপর বসে খুব মনোযোগ দিয়ে শেভ করছি উনার খোচা খোচা দাড়ি৷ চরম বিরক্ত আনভীর। মাঝরাতে এভাবে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমার এমন কাজে চরম বিরক্ত না হয়ে কি উপায় আছে? আনভীর বলে ওঠলেন,
-আজীবন শুনেছি মাঝরাতে প্রেগন্যান্ট মেয়েরা বরের কাছে কত কিছু খাওয়ার আবদার নিয়ে বসে। আর তুমি? আবদার হলো আমার দাঁড়ি শেভ করবে৷ এত ছোট ছোট দাঁড়ি কেউ শেভ করে?
-শেভ করবো না কি করবো হ্যাঁ? আপনি যখন আমার কোলে মাথা রাখেন ,আপনার ওই পিপড়া সিপাহীগুলো পেটে বিঁধে আমার। তাই শেভ করে দিচ্ছি। আর আপনি জানেন না, এই দাঁড়িতে আপনাকে কত মারাত্নক লাগে? তাই ছোলা মুরগি বানিয়ে রাখবো। যাতে অন্য কেউ আমার বেবি দুইটার পাপার দিকে নজর দিতে না পারে।
অসাবধানতাবশত রেজার দিয়ে আমি খানিকটা কেটে ফেললাম উনার গালের কাছটা। হয়তো এটা হওয়ার কথাই ছিলো। এত ছোট ছোট দাঁড়ি সেভ করলে তো কাটবে , এটাই স্বাভাবিক। একটু রক্ত বেরোচ্ছে উনার গাল থেকে। আনভীর এবার আহতসুরে বললেন,
-দিলে তো আমার গাল কেটে।
উনি কথা না বাড়িয়ে আমায় কোলে তুলে খাটে শুয়িয়ে দিলেন। কানের কাছে হিসহিসিয়ে বললেন,
-অনেক পাগলামি হয়েছে আহি জান। এবার কিউট বেবির মতো ঘুমিয়ে পড়ো। ঠিকাছে?
-হুম।
-কিছু খাবে এখন। খেলে বলো আমি নিয়ে আসছি।
-উহু। আপনি আমার পাশে ঘুমান তো ! আমি আপনাকে খাবো!
সশব্দে হেসে দিলেন আনভীর। লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন আমার পাশে।আমিও কথা না বাড়িয়ে উনার বুকে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়লাম। তারপর তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
এই গল্পটা অনেকের কাছেই নিছক গল্প নয়।এটা হলো একরাশ অনুভূতির প্রকাশ যা বলে বুঝানো হয়তো অসম্ভব। আমি আনভীর আর আহি চরিত্রটি এমন ভাবে লিখার চেষ্টা করেছি যিতে আপনাদের চোখের সামনেই সেটা প্রকাশ পাবে আর যেটা কম বেশি সবাই ধারন করতে পারবে। যদি গল্পটা শেষ হয়ে যায় তবে মিস করবেন ওদের?
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।