#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৫৬)
হুরহুর করে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। নীল অম্বরের গা ঘেঁষে উড়তে থাকা, পেঁজা তুলোর মত মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, উলটে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের খসখসে পাতা।
বৃক্ষের নব নব পল্লব ছুঁয়ে যাওয়া সেই শীতল ঝড়ো হাওয়ার বেগে, একদিন দরজায় এসে হাজির হলো পিউয়ের এইচ-এস-সি পরীক্ষার দিন। ততদিনে মেয়েটা পড়তে পড়তে কাহিল প্রায়। । নাওয়া -খাওয়া ভুলে পরে থেকেছে পড়ার টেবিলে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য নিদারুণ ব্যস্ত। নতুন নতুন সভাপতিত্বের ভার তখন ধূসরের কাঁধে। সাথে যোগ হয়েছে খলিলের মেয়র হওয়ার আরেক চাপ।
ফুরসতই যেন মেলেনা। যখন বাড়ি ফেরে তখন গভীর রাত। পিউ সহ সকলের ভারী নিঃশ্বাস পরা বাড়িটা তিঁমিরে ডুবে থাকে। অথচ ধূসর প্রত্যেক সময় ওর কক্ষে চোখ বুলিয়ে আসে। এসির বাতাসে,মাঝরাতে শীতে কুঁকড়ে থাকা পিউটার গায়ে কাঁথা টেনে দেয়। গহীন চুঁমু একে দেয় কপালের চুল সরিয়ে।
প্রথম পরীক্ষায় পিউয়ের অবস্থা করূণ ! টেনশনে তার হাত পা কাঁ*পছে। এতটা চিন্তা ওর কখনও হয়নি। জীবনের সব পরীক্ষায় হেলেদুলে হাজির হওয়া মেয়ের নার্ভাসনেসে পেট মোচড়াচ্ছে আজ। মাথার সবকটা কোষ লাফাচ্ছে। সবার মধ্যে বুক ফুলিয়ে বলা ধূসর ভাইয়ের কথাগুলো রাখতে পারবে কী না! এই আ*তঙ্কে তার সমস্ত পৃথিবী বিষন্ন।
সবাইকে সালাম করে সে বাড়ি ছাড়ল। যেহেতু আজ প্রথম দিন,সঙ্গে পুষ্পর যাওয়ার কথা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কলেজে হল পড়েছে ওদের। ওটা বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরের পথ।
কিন্তু তাদের গাড়িটা বাড়ি থেকে কিছুদূর এগিয়েই থেমে যায়। পিউ সিটে বসে পড়ছিল। গাড়ি থামতেই তাকাল। দেখা গেল ইকবালের গাড়ি ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। পুষ্প ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ ভালো করে পরীক্ষা দিস,কেমন? ‘
পিউ আগা-মাথা না বুঝে বলল,
‘ কেন? তুই কোথাও যাবি?’
‘ ইকবালের সাথে বের হব। ‘
‘ আমার সাথে হলে যাবিনা?’
‘ ধূসর ভাই যাবেন। ‘
পিউ অবাক হয়ে বলল,
‘ উনি কী করে যাবেন? সেতো ব্যস্ত।’
পুষ্প মুচকি হেসে বলল,
‘ তোর কাছে ওনার সব ব্যস্ততা তুচ্ছ। আসি।’
পুষ্প সেকেন্ডে নেমে গেল। পিউ চোখের পাতা পিটপিট করল বসে বসে। ধূসর ভাই কীভাবে যাবেন? কই সে? ওই সময় ওপাশের গাড়ির জানলা থেকে ইকবালের মাথাটা বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। সে হাত নেড়ে বলল,
‘ এই পিউপিউ,অল দ্য বেস্ট!’
পিউ ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ থ্যাংক ইউ।’
ইকবালের গাড়ি শা বেগে পাশ কাটিয়ে প্রস্থান নিলো। পিউ নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই ধূসরের বাইক এসে দাঁড়াল তার জানলার কাছে। বলল,
‘ নেমে আয়।’
পিউ চোখ গোল-গোল করে তাকাল। উনি সত্যিই যাবেন? এটাতো ওর কাছে চাঁদ আকাশ ছেড়ে হাতে নেমে আসার মতোন। পিউ তড়িঘড়ি করে ফাইল পত্র গুছিয়ে নামল। যেন ট্রেইন ছুটে যাচ্ছে ওর। বলার আগেই উঠে বসল পেছনে। তার চিন্তিত চেহারার স্থলে এখন ঝকমকে হাসি। ধূসর পকেট থেকে পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে ড্রাইভার কে দিল। বলল,
‘ এখনই বাড়িতে যেওনা। আমি ফোন দিলে তারপর।’
তিনি ঘাড় কাত করলেন,
‘জি আচ্ছা।’
বাইক চলতে চলতে পিউ জিজ্ঞেস করল,
‘ বাড়ি থেকে আমার সাথে এলেই তো পারতেন ধূসর ভাই।’
‘ তখন এলে,তুই এত অবাক হতি?’
পিউয়ের কণ্ঠ ছল্কে উঠল,
‘ আপনি কি আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন?’
ধূসর আর জবাব দিলো না। কিন্তু পিউ একা একা হাসল। এই সারপ্রাইজের জোরে তার মন মেজাজ নিমিষে ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে। আপাতত পরীক্ষার চিন্তা মাথাতেই নেই। তার ধারণা, ধূসর ভাইয়ের কাছে চমক নামক বিশেষ ঝুলী আছে। হঠাৎ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত কিছু করে,চমকে দেওয়ার অসাধারণ এক ক্ষমতা তার৷
স্বীয় দায়িত্বে,পিউকে হলে নিয়ে যাওয়ার দিনটি কেবল ওইদিন সীমাবদ্ধ রাখল ধূসর। ইচ্ছে রইলেও ব্যস্ততায় উপায় ছিল না যে। পার্লামেন্ট, অফিস দুদিকেই সমান চাপ। দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে হিমশিমে অবস্থা ওর। কিন্তু এ নিয়ে ছোট্ট পিউয়ের অভিযোগ নেই। মানুষটা প্রথম দিন তার জন্য সময় বের করেছে এইত ঢেড়।
_____
এর মধ্যে পুষ্প গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল৷ মার্কেট যাওয়ার পথে বমি করে ভাসাল গোটা গাড়ি। বেশ কদিন ধরেই হচ্ছে এমন। মাঝ রাস্তায় গাড়ির চাকা ঘুরে গেল,ফের ছুটে এলো বাড়ির আঙিনায়। দারোয়ান দৌড়ে গিয়ে, বিপ*র্যস্ত পুষ্পর খবর ঘোষণা করে এলেন। সেদিন সরকারি ছুটি। ধূসর ব্যাতীত সকলে বাড়িতে।
সংবাদ পেয়ে গেটের কাছে ছুটে এলো তারা। পুষ্পকে ধরে ধরে নামানো হলো। তার মাথা ঘুরছে,চোখের পাতা নির্জীব।
পুষ্প মৃদূ শব্দে গো*ঙাচ্ছে। ঘরে নিয়ে আসার মধ্যে আরেক দফা বমি করা শেষ। চিন্তায় সবার মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে। অথচ এর মধ্যেই, মিনা বেগম একটু পরপর ধম*কাচ্ছেন মেয়েকে।
সারাদিন আজেবাজে খায় বলে ফুড পয়েজনিং হয়েছে ওনার ধারণা।
আমজাদ ফোন কানে নিয়ে পায়চারি করছেন। পারিবারিক ডাক্তার, রহমত আলী কল রিসিভ করছেনা দেখে রা*গে গজগজ করছেন তিনি। আফতাব চিন্তিত গলায় প্রস্তাব ছুড়লেন,
‘ ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই ভাইজান?’
পুষ্প দুপাশে রকেট বেগে মাথা নাড়ল। অসুস্থ গলায় বলল,
‘ না না, হাসপাতালে নেওয়ার মত কিছু হয়নি আমার।’
মিনা ধমক দিলেন, ‘ হ্যাঁ ডাক্তার সাহেবা এলেন! এত অসুস্থ আর ওনার কিছু হয়নি।’
‘ আমার সত্যিই তেমন কিছু হয়নি আম্মু।’
জবা মাথার কাছে বসে ছিলেন ওর। বললেন,
‘ এমন করিস না মা। হঠাৎ এত অসুস্থ হলি, কী হয়েছে জানতে হবেনা? ‘
পুষ্প উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ আরে,আমি তো জানি আমার কী হয়েছে! আর দেখার দরকার নেই।’
মিনা দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন , ‘ তাই না কী, জানিস?তা শুনি, কী হয়েছে?’
পুষ্প দোনামনা করল। লাজুক চোখে একবার বাবা,ভাইদের দেখে নিলো। মিনা মেয়ের দৃষ্টি বুঝে,আমজাদকে বললেন,
‘ আপনারা একটু বাইরে যাবেন? ‘
ভদ্রলোকরা কেউই কথা বাড়ালেন না। টু শব্দ না করে, চুপচাপ ঘর ছাড়লেন। সুমনা উৎকন্ঠিত,
‘ এবার বল,কী হয়েছে? ‘
পুষ্প আস্তে-ধীরে উঠে বসল। মাথা এখনও চতুর্দিকে ঘুরছে। ওড়নার সুতোতে আঙুল প্যাচাতে প্যাচাতে মিনমিন করল। মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেলল পরপর।
গুরুজনরা যা বোঝার এতেই বুঝে নিলেন। প্রথম দফায় হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ওর দিকে। রুবা জোর ধ্বনিতে বললেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ! ‘
পিউ কিছু বোঝেনি। সে মাথা চুলকে সবার হাসিমুখের দিক তাকাচ্ছে। জবা দৌড়ে গিয়ে, মিনাকে জড়িয়ে ধরলেন। খুশিতে আর্ত*নাদ করে বললেন,
‘ আপা আমরা নানু হব।’
সবেগে তার কোঁচকানো ভ্রু শিথিল হলো। অভিভূতের ন্যায় চাইল বোনের দিকে। এর মানে আপু মা হবে? সে খালামনি হবে? একটা পুচকি আসবে তাদের বাড়িতে? পিউ হূলস্থূল বাধিয়ে গিয়েই ঝা*পিয়ে পড়ল বোনের ওপর। পুষ্প হেসে ওর গায়ে,মাথায় হাত বোলাল। মিনা পাথর বনে দাঁড়িয়ে। অতর্কিত হো*চট সামলাতে বিলম্ব হয়েছে। তার অত ছোট মেয়েটা মা হবে এখন? ভাবতেই আপ্লুত হয়ে পড়লেন তিনি। টলমল করে উঠল অক্ষিপট। ধীরুজ কদমে মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘ খুব সুখী হ মা। খুব সুখী হ।’
_______
বাড়িতে মিষ্টি খাওয়ার হিঁড়িক পড়েছে। আমজাদ,আফতাব,আনিস ডগমগ করছেন নানাভাই হওয়ার আনন্দে। গরম গরম রসগোল্লায় টি-টেবিল ভর্তি তখন। আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেই
ইকবাল আর ধূসর একসাথে ঢুকল। ইকবাল সপ্তাহে দুইদিন এখানে আসে। শুক্র ও শনি। বাকী পাঁচদিন নিজের গৃহে। মন অবশ্য আঁকুপাঁকু করে। চব্বিশ ঘন্টাই মাই লাভের নিকট থাকতে চায় ওটা। কিন্তু এটা যে শ্বশুর বাড়ি! একটা লজ্জা শরমের ব্যাপার আছেনা?
ওরা যখন ঢুকল, তখন সবাই বসার ঘরেই। বিশাল বিশাল সোফা জুড়ে বসে একেকজন। আজকের পরিবেশ একটু বেশিই স্বতঃস্ফূর্ত। ধূসর গিয়ে আনিসের পাশে বসল। ক্লান্ত কণ্ঠে মাকে বলল,
‘পানি দাও।’
ইকবাল চোখ দিয়ে পুষ্পকে খুঁজল। মেয়েটা এখানে নেই কেন? সেও বসতে যাবে এর মধ্যেই সাদিফ সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ভাইয়া হা করুন তো।’
ইকবাল বুঝতে না পেরে বলতে গেল,
‘ হা করব কেন?’
অথচ হা অবধি মুখ খোলার আগেই সাদিফ জোরেশোরে একটা মিষ্টি ঠুসে দিলো মুখে।
দু বাহু ধরে প্রমোদ কণ্ঠে বলল,
‘ কংগ্রাচুলেশনস!’
ইকবাল ভড়কেছিল। এখন মিষ্টি চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করল,
‘ কীসের জন্য?
সাদিফ চাপা কণ্ঠে বলল,
‘ এই যে,ছক্কা মারলেন বলে। বছর না হতেই বাবা হয়ে যাচ্ছেন। ”
সে বেখায়লে বলল, ‘ও আচ্ছা।’
পরপর তাজ্জব বনে তাকাতেই সাদিফ হেসে ফেলল। দুষ্টুমি করে বলল,
‘ জি আচ্ছা।’
ইকবাল বিকট নেত্রে ধূসরের দিক ফিরল। সেও বিস্মিত।
মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন বেজে উঠল ওর। বাবা হওয়ার স্লোগান গোলমাল বাধিয়ে ফেলল।
বাকী সবাইকে পেছনে ফেলে ত্রস্ত পায়ে ছুট লাগাল ঘরের দিকে। বসার ঘরে হাসির রোল পড়ল ওমনি।
আমজাদের হাসি হাসি চেহারাটা হঠাৎ এক চিন্তায় নিভে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। মেয়েটা মা হচ্ছে যখন, দুটো বছর নিজের কাছে রাখতে চাওয়ার ইচ্ছেটা তো আর পূরণ হবেনা।
______
পিউ বিস্তর গল্প নিয়ে বসেছে। ওর মুখোমুখি, পুষ্প বিছানায় আধশোয়া। দুজনের মধ্যে ঝুড়িভর্তি কালো আঙুর। পিউ খুব যত্ন নিয়ে আঙুরের খোসা ছাড়িয়ে বোনের মুখে দিচ্ছে। পুষ্প ওর বকবক শুনছে মন দিয়ে। একটুও বিরক্তি নেই সেখানে। সেসময় ইকবাল কামড়ায় ঢুকল। আওয়াজ পেয়ে দুবোন একযোগে চাইল। পিউ ওকে দেখতেই উঠে দাঁড়াল। তার আর এখানে কাজ নেই। ফলের ঝুড়ি টেবিলে রেখে হাঁটা ধরল সে।
পাশ কাটানোর সময় বলল
‘ কংগ্রাচুলেশনস, আমার ফাস্টেস্ট দুলাভাই।’
ইকবাল ঘাড় চুল্কে লাজুক হাসে। পিউ বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় নিজ উদ্যোগেই দরজা টেনে দিলো কক্ষের।
ইকবাল সেদিক থেকে দৃষ্টি এনে স্ত্রীর দিক চায়। কিছুক্ষণ চেয়েই থাকে নির্নিমেষ। খুঁজে বেড়ায় প্রিয়তমার সুপ্ত সৌন্দর্য।
ওমন দৃষ্টি দেখেই পুষ্প কুণ্ঠায় নুইয়ে গেল। চট করে গায়ের কাথাটা উঁচিয়ে মুখ ঢেলে ফেলল ও। ইকবাল শান্ত পায়ে এগিয়ে আসে। বিছানায় ওর কোমড়ের কাছটায় বসে। আস্তেধীরে পুষ্পর মুখ থেকে কাঁথাটা নামাতেই, সে মেয়ে দুহাতে মুখ আড়াল করল এবার। ইকবাল মুচকি হাসল। কোমল নিবেশে হাত বোলাল পুষ্পর পেটের ওপর। পাঁচটা আঙুলই কম্পিত। এখানেই তার সন্তান আছে? ওর যে এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা, বাবা হবে। ইকবাল ফিসফিস করে বলল,
‘ মাই লাভ,তাকাবেনা?’
পুষ্প দুপাশে মাথা নাড়ল। বলল,
‘ আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে ইকবাল!’
ইকবাল শব্দ করে হেসে উঠল। ঝুঁকে এসে দুহাতের ওপরেই চুমু খেলো ওর। পুষ্প বাধন ঢিলে করে নিভু চোখে তাকায়। ইকবাল বলল,
‘ আমরা তাহলে বাবা মা হচ্ছি মাই লাভ?’
পুষ্প চোখ নামিয়ে মাথা ঝাঁকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘ তুমি খুশি তো?’
ইকবাল টুপ করে অধর বসাল তার ললাটে। পরপর ওকে টেনে এনে, একদম বুকের মধ্যে পেঁচিয়ে ধরে বলল,
‘ আমি এত খুশি কোনও দিন হইনি মাই লাভ,বিশ্বাস করো। ‘
পুষ্প হাসল, তৃপ্তির হাসি।
হঠাৎ টের পেলো তার গাল ছুঁয়ে এক ফোটা উষ্ণ জলের স্পর্শ। অবাক দুই লোঁচন ওপরে তুলে চাইল সে। ইকবালের কোটরে জল দেখে তৎপর হাতে মুছিয়ে দিয়ে বলল,
‘ কাঁদছো কেন ইকবাল?’
তার নিষ্পাপ স্বীকারোক্তি,
‘ এটা আনন্দের কা*ন্না মাই লাভ। বাবা হওয়ার আনন্দ।’
পুষ্প ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলল,
‘ কিন্তু আমি চাইনা তুমি আনন্দেও কাঁ*দো। আমার ইকবালের ঠোঁটে শুধু হাসি মানায় । আর মানায় দুষ্টু দুষ্টু কথা। যা শুনলে সর্বচ্চ মন খারাপেও একটা মানুষ হেসে ফেলতে পারে।’
ইকবাল সন্তুষ্টি হাসল। মুখটা গুঁজে রাখল পুষ্পর কাধের ভাঁজে। পুষ্প নীরবে শুকরিয়া আদায় করল সবকিছুর। ওর জীবনে আর কিচ্ছু পাওয়ার নেই,সত্যিই নেই।
________
‘ বড় আব্বু!’
আমজাদ চায়ের কাপ থেকে মুখ তুললেন। ধূসর বলল,
‘ আমার একটা কথা ছিল!’
‘ হ্যাঁ, বলো!’
তখন ইকবাল, পুষ্পর হাত ধরে ধরে সিড়ি বেয়ে নামিয়ে আনল। মেয়েটার সদ্য দু মাসে পরেছে। এতে যত্নে হুটোপুটি লাগিয়ে দিয়েছে সকলে।
পুষ্প মেজো মায়ের পাশে বসল এসে। তিনি ওকে দেখেই শুধালেন,
‘ এখন ভালো লাগছে?’
‘ একটু।’
ইকবাল বসল ধূসরের পাশে। আমজাদ বললেন,
‘ বলো কী বলবে?’
তার চোখেমুখে কৌতুহল।
ধূসর রিমোর্ট চেপে টেলিভিশন বন্ধ করল প্রথমে। সবাই তখন উৎসুক নজরে ওকেই দেখছে।
ও বলল,
‘ আমাদের পার্লামেন্টে থেকে প্রতি বছর গরীব -অসহায় মানুষদের মাঝে কিছু জামাকাপড় বিলি করা হয়। এ বছরও হবে। আমি চাইছি,এবার বাড়ির সবাই উপস্থিত থাকুক সেখানে। ‘
আফতাব ঘাবড়ে গেলেন। চায়ের কাপ থেকে তার শশব্যস্ত মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হলো ছেলের ওপর। তার বড় ভাইয়ের চক্ষুশূল বিষয়ে কথাবার্তা? এক্ষুনি রে*গে বো*ম হলেন বলে। না,এই ছেলের ঠিক কী রোগ আছে কে জানে? একটা ভালো পরিবেশ এক্ষুনি ঘেঁটে দেবে।
আনিস বললেন,
‘ কিন্তু তখন তো আমাদের অফিস থাকে ধূসর।’
‘ হ্যাঁ। সেজন্যে শুক্রবার ডেইট ফেলেছি ছোট চাচ্চু। যাতে সবাই যেতে পারো। সাদিফ,তুইও থাকবি কিন্তু।’
সে মাথা ঝাঁকাল, ‘ আচ্ছা।’
আমজাদ একটু চুপ থেকে বললেন,
‘ বেশ তো। যারা যেতে চায়, নিয়ে যেও।’
ধূসর বলল,
‘ কিন্তু আমি চাই,আপনি ও সেখানে থাকুন।’
‘ আমি? আমি গিয়ে কী করব?’
ধূসর নরম গলায় বলল,
‘ কিছুইনা। আপনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন,সেটা দেখলেও আমার ভালো লাগবে।’
আফতাব ভ্রু তালুতে ওঠালেন। বিড়বিড় করে বললেন,
‘ বাবাহ! হঠাৎ এত ভালো কথা বলছে কেন?’
আমজাদের কোমল মনে কথাটুকু প্রবেশ করল। বলতে গেলেন,
‘ তাই বলে আমি…
ধূসর টেনে নিলো কথা,
‘ আমি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর আপনার কাছে কেন,আমার বাবার কাছেও কোনও বিষয় নিয়ে দ্বারস্থ হইনি বড় আব্বু। কিছু নিয়ে অনুরোধ তো দূরের কথা! আজ বলছি,আপনি, চাচ্চুরা, এমনকি বাড়ি সবাই ওখানে থাকুন আমি চাই। এটা আমার অনুরোধ!’
মিনা ভ*য়ে ভ*য়ে স্বামীর দিক চেয়ে। বাকীরাও তাই। প্রত্যেকের তটস্থ চোখ-মুখ ওনাকে দেখছে। কী প্রতিক্রিয়া দেবেন এখন, কে জানে!
আমজাদ ফোস করে শ্বাস ঝাড়লেন। সোজাসাপটা বললেন’
‘ আমার রাজনীতি পছন্দ না, জানোইত। তবে একটা ভালো কাজে সামিল হওয়া খারাপ কিছু নয়। আবার তুমিও এত করে বলছো যখন, শুধুমাত্র সেজন্যেই যেতে রাজি হচ্ছি।’
আফতাব ধরে রাখা নিঃশ্বাসটা কেবল ছাড়লেন। তবে বিস্মিত হয়েছেন ভাইয়ের কথায়। আগে হলেতো বজ্রকণ্ঠে মানা করে দিতেন। হঠাৎ যে এদের কী হলো?
ধূসরের ঠোঁটে হাসি ফুটল। প্রসন্ন হয়ে বলল,
‘ থ্যাংক ইউ বড় আব্বু।’
ইকবাল একা একা মাথা দোলাল। সে নিশ্চিত ছিল,হিটলার শ্বশুর মানবেনা। এত সহজে মেনে নেওয়ায় ধূসরকে বাহবা দিলো মনে মনে।
একই সঙ্গে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন সকলে। এই পরিবারে সহজে কারো মধ্যে বিবাদ হয়না। সহজে কী,হয়ইনা বলতে গেলে। একমাত্র ঠোকা-ঠুকি লেগে যায় ধূসর আর আমজাদের ভেতর। দুজনেই যে গরম মাথার মানুষ! তাই এই এদের প্রসঙ্গ এলেই সকলে সিটিয়ে থাকেন আত*ঙ্কে। এই বুঝি কিছু হলো,তর্ক বিধল,ঝগড়া লাগল। তাই আজ প্রথম বার একটা বিষয় সাদামাটা ভাবে মিটে যাওয়ায় নিশ্চিন্ত হলেন তারা৷
ওই আলাপ মোটামুটি স্থিত হতেই, আমজাদ ইকবালকে ডাকলেন,গম্ভীর তার কণ্ঠ।
‘ ইকবাল?’
ইকবাল অন্য ধ্যানে ছিল। ডাক শুনে নড়েচড়ে বলল,
‘ জী!’
‘ তোমার বাবা মাকে বোলো,আগামীকাল দেখা করতে যাব আমি।’
মিনা শুধালেন, ‘ হঠাৎ? ‘
আমজাদ সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে জানালেন,
‘ পুষ্পকে খুব দ্রুত তাদের হাতে তুলে দেব এবার।’
সবে সবে আনন্দিত হওয়া মুহুর্তটা নিমিষে মিলিয়ে গেল। বাড়ি ছাড়তে হবে ভেবেই, মুছে গেল পুষ্পর উচ্ছ্বাস। অথচ হৃদয় সানন্দে নেঁচে উঠল ইকবালের। মাই লাভ এবার পার্মানেন্টলি ওর ঘরে আসছে তাহলে!
_______
পিউ এখন থেকে উড়ন্ত পাখি। নেঁচে-কুদে বেড়ালেও কেউ কিচ্ছু বলবে না ওকে। পরীক্ষা তো শেষ। সে লাফাতে লাফাতে সিড়ি বেঁয়ে নামার সময় ধূসরের মুখোমুখি হলো। ও উঠছিল ওপরে। ওকে দেখেই পিউ হৈচৈ বাধিয়ে বলল,
‘ ধূসর ভাই শুনেছেন? আমি খালামনি হচ্ছি,আপনি মামা হচ্ছেন।’
বলার সময় তার কণ্ঠ ছিল শৃঙ্গে। যেন উপচে পরছে খুশি। অথচ ধূসর চোখ সরু করে বলল,
‘ তুই আর আমি ভাইবোন?’
পিউ হাসি কমিয়ে ফেলল তৎক্ষনাৎ। দুপাশে মাথা নেড়ে জানাল,
‘ না-তো।’
‘ সাইড দে।’
পিউ বাধ্য নেয়ের মত গুটিশুটি মেরে একপাশ হয়ে দাঁড়াল। ধূসর উঠে গেল লম্বা পায়ে। ও সেদিক চেয়ে রইল,বোকা বোকা চাউনীতে। নিজেই বলল,
‘ সত্যিইত,সে খালামনি হলে আর ধূসর ভাই মামা হলে ওরা যে ভাইবোন হয়ে যাবে। তাহলে আপুর ছেলেমেয়ে ওকে কী বলে ডাকবে? হাফ খালামনি,আর হাফ মামুনি? ইশ,কী বিশ্রী নাম হবে তাহলে! পিউয়ের মায়া হলো খুব। পুষ্পর ভবিষ্যৎ সন্তানের প্রতি দুঃখ লাগল। ওদের জন্যে এখন বাচ্চা গুলো শেষমেশ এই ডাক বিভ্রাটে পরবে?
পিউ বসার ঘরের আলোচনায় আর গেল না। ইউটার্ন নিলো পিলপিল পায়ে। ধূসরের কামড়ার সামনে এসে থামল। পর্দার ফাক গলে উঁকি দিলো ভেতরে। ধূসর সোফায় মাথা এলিয়ে বসে। চোখ বন্ধ। পিউ আস্তে করে অনুমতি চাইল,
‘ আসব ধূসর ভাই?’
উত্তর এলো, ‘ আয়।’
পিউ নরম পায়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ধূসরের মুখবিবর তৃষিত নয়নে, নিরীক্ষণ করে শুধাল,
‘ আপনার কী শরীর খারাপ?’
‘ না।’
‘ তবে, মাথা ব্যথা করছে?’
‘ হু।’
পিউ একটু রয়ে সয়ে শুধাল,
‘ টিপে দেব আমি?’
ধূসরের ক্ষুদ্র জবাব আসে, ‘ দে।’
পিউ খুশি হয়ে গেল। চঞ্চল কদমে চলে গেল সোফার পেছনে। ধূসরের পেছন দিকে এলিয়ে রাখা মাথা প্রযত্নে দুহাতে আগলে ম্যাসাজ করতে শুরু করল। কপাল,ভ্রুঁ,চোখের চারপাশ নিপূন হাতে মালিশ করল। একটা সময় পর ধূসরের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ এলো কানে। ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত। পিউয়ের হাতদুটো যত্র থামে। প্রেমিকা সুলভ হৃদয়ে উঁকি দেয় দুষ্টুমি। একবার সতর্ক চোখে দরজার দিক দেখে নেয়। তারপর ধূসরের মুখের ওপর সচেতন ভাবে, ডানে বামে হাত নাড়ল। যখন বুঝল, মানুষটা সত্যিই নিদ্রায় তলিয়েছে,বুকে অসীম সাহস ভর করল ওর। পিউ ওমন দাঁড়িয়ে থেকেই ঝুঁকে গেল। পৃথিবীর সবথেকে ক্ষুদ্র চুমুটা চট করে বসিয়ে দিলো ধূসরের পাতলা অধরের ওপর। বিদ্যুৎ বেগে সরেও এলো আবার। ভেবেছিল,এই সাংঘাতিক, ভয়া*বহ চুরি খানা করে ধরা পরবেনা। কিন্তু বিধিবাম,তড়াক করে চোখ মেলল ধূসর। এতটাই দ্রুত,পিউ চমকে,হকচকিয়ে একশেষ! হৃদপিণ্ড শব্দ করে এক স্থল থেকে আরেক স্থলে লাফ দিলো। সেই ঝাঁপা-ঝাপির শব্দ স্পষ্ট টের পেলো পিউ। ধূসর চোখ উলটো করে তার দিক চেয়ে আছে। পিউ অবস্থা বেগতিক,ধরা পরেছে বুঝতেই, পালাতে চাইল। প্রতিবারের মত ছুট লাগাল যেই, খপ করে হাতখানা টেনে ধরল ধূসর। পরপর উঠে দাঁড়াতেই,চোয়াল ঝুলে গেল মেয়েটার। ভী*ত,শ*ঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
‘ আর,আর করব না ধূসর ভাই।’
সে মানুষটা নিশ্চুপ। তবে শক্ত-পোক্ত চাউনী পিউয়ের ত্রাস তরতর করে বাড়িয়ে দেয়। যেন একটা ছোট্ট চুঁমু খেয়ে মহাপাপ করে ফেলল ও। পিউ আতঙ্কে পেয়ে পিছিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে ধূসর এগিয়ে আসে। পিউ নিচু স্বরে আবার বলল,
‘ আমি আর করব না, সত্যি বলছি। প্রমিস।’
কে শোনে কথা! ধূসরকে ক্রমশ এগোতে দেখে ওর হৃদযন্ত্রের লাফ-ঢাপ বাড়ছে। কেন যে চুমুটা খেতে গেল? কার বুদ্ধিতে? কোন শয়তানের ইশারায়?নির্ঘাত না বলে এভাবে চুমু খাওয়াতেই ভীষণ রে*গে গিয়েছেন উনি! কিন্তু সেওতো চুমু খেয়েছিল পিউকে। কই, পিউতো রা*গ করেনি। এমন গিলে ফেলার মত তাকায়ওনি।
ভাবার মধ্যেই পিউয়ের পিঠ দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খায়। ধ্যান ভেঙে চমকে ওঠে সে। গোল গোল, গ্রাসিত নজর তাক করে উঁচুতে,ধূসরের চেহারায়। সে মানুষটা তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল,একদম নিকটে। পিউ যেই পাশ থেকে পালাতে যাবে, তার বলিষ্ঠ একটা হাত উঠে এলো মাথার কাছের দেয়ালে। পিউ আরেকপাশ দিয়ে ছুটতে গেলে সে পাশেও হাত রেখে আটকাল ধূসর। পিউ অথৈ জলে সাতার কেটে হাঁপিয়ে যাওয়া নাবিকের মতন, অসহায় চোখে তাকাল। কম্পিত কণ্ঠে ডাকল,
‘ ধূ ধূসর ভভাইইই!আমি,আমি….’
ধূসর এক হাত নামিয়ে তার বাম হাত ধরল। কথা থেমে গেল ওর। অনামিকা জুড়ে থাকা জ্বলজ্বলে হীরের আংটিতে আঙুল বুলিয়ে বলল,
‘ যেহেতু তুই আমার বাগদত্তা,আমার হবু স্ত্রী,তাই একটা বড় চুমু তোকে খেতেই পারি।’
অবিশ্বাস্য কিছু শুনে পিউয়ের কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। কোটর ফু*ড়ে আসা প্রকট নেত্রযূগল আরো বৃহৎ করে চাইল সে। বলতে গেল,
‘বড় চুঁমু খাবেন? ‘
অথচ হা করার পূর্বেই ধূসরের চিকণ,পুরুষালি, উষ্ণ ঠোঁটজোড়া সবেগে, সদর্পে আকড়ে ধরল তার গোলাপী অধর। পিউ থমকে গেল। দীঘল কালো পল্লব, অগোছালো ঝাপটে একসময়,ক্লান্ত ভঙিতে বুজে ফেলল। ধূসর নিজেই ওর কাঁ*পতে থাকা হস্তযূগল তার পিঠে উঠিয়ে দেয়। নীরবে আকড়ে ধরতে বলে।
একটা সময় বলবান দেহের ভারে ছটফটিয়ে ওঠে পিউ। শ্বাস -প্রঃস্বাস থিঁতিয়ে আসে। ধূসর তবু ছাড়ল না,থামল না। সহজে কাছে না ঘেঁষা মানুষটার, অকষাৎ এই অল্প আদরের তোপে পিউয়ের অবস্থা তখন দূঃসহ। যেন এই এক্ষুনি শ্বাস নিতে না পারলে ম*রে যাবে। ধূসরের চুম্বনের তীব্রতা মাত্রা ছাড়ায়,পাহাড় ডিঙায়।
হয় গাঢ় থেকে প্রগাঢ়।
সেই ক্ষণে ইকবালের আগমন। তার ধুপধাপ পদচারণ আর উচু আমুদে কণ্ঠ ভেসে এলো বাইরে থেকে। ‘ধূসর জানিস’… বলতে বলতে আসছে সে। আওয়াজ পেতেই ধূসর বিদুৎ বেগে পিউকে ছেড়ে দিলো। পিউয়ের মনে হলো এতক্ষনে প্রান ফিরল ওর। ইকবাল তখন এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিউ ঝড়ের গতিতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ইকবাল আহাম্মক বনে দেখে গেল তা। তারপর সামনে ফিরে শুধাল,
‘ ও এভাবে ছুটল কেন?’
ধূসর দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধাঙুল দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে, কাঁধ উচিয়ে বলল,
‘ আমি কী জানি!’
চলবে,
নিরামিষ ধূসর ভাইকে আমিষ বানিয়ে দিলাম আজ🫣