এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব -১৭+১৮+১৯

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭

অপূর্ব ভাই ও আমি শপিং মলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। সময় দেখতে দেখতে অপেক্ষা করছি পরিবারের সবার জন্য। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কয়েকটা সিএনজি এসে থামল। একে একে বেরিয়ে এলো সবাই। বাদ যায়নি পিয়াসও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।

‘দুলহান ফ্যাশন’ লেখা একটি দোকানের ভেতরে প্রবেশ করলাম। একের পর এক শাড়ি দেখিয়ে চলেছে কর্মীরা। তিস্তা আপুর মুখ ভার বিধায় পাত্তা দিচ্ছে না সেই সব। মনের কোণে সুজন ভাই বিরাজমান। মামিরা তিস্তা আপুর শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিজেরাই পছন্দ করে চলেছে। তুর অপূর্ব ভাইয়ের হাত ধরে বলে,

“ভাইয়া। আমার একটা শাড়ি নেই। একটা নিবো।”

“জীবনেও তো শাড়ি পড়তে দেখলাম না। নিয়ে সেই আলমারিতে তুলে রাখবি।”

শেফালী অপূর্ব ভাইয়ের ফোনে গেমস খেলছিল। দূর থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ছুটে আসে। উত্তেজিত হয়ে বলে,

“অপূর্ব ভাই আমিও একটা শাড়ি নেই। তুর আপনার বোন বলে কি শুধু ওকেই দিবেন?”‌ বলেই শেফালী অপূর্ব ভাইয়ের অন্য হাতটি জড়িয়ে ধরে। অপূর্ব ভাই সম্মতি দিয়ে জানায়, “তিস্তা থেকে শুরু করে বাড়ির সবার জন্য শপিং-এর টাকা আমি দিচ্ছি। ইচ্ছে মতো করে নে।’
ওরা সবাই ছুটে গেল।
আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। পর মুহুর্তে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলেন, “তোর শাড়ি লাগবে না? কিনে নে।”

সাজিয়ে রাখা একটা সাদা শাড়ি তার নজরবন্দি হলো। মাঝে মাঝে মতির কাজ। শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলেন, “বিয়ের দিন এটা পরিস, সুন্দর লাগবে।”

বিরক্ত হলাম আমি। সবাই রঙ বেরঙের পোশাক পড়বে আর আমি বিধবার মতো সাদা পরে ঘুরঘুর করব কেন? আশ্চর্য! তেজ নিয়ে বললাম, “পারব না। বিয়ের দিন আমার কত কাজ জানেন? গেট ধরতে হবে, জুতা লুকাতে হবে, প্রয়াস ভাইয়ের খাবারে ভাগ বসাতে হবে। আমি বিধবা ভাতা পেতে চাইনা।”

“সাদা মানে শান্তি। মনে শান্তি এনে দেয়। ইচ্ছে শক্তি বাড়ায়। সাদা শাড়ির সাথে নীল ব্লাউজ পরবি। দূর থেকে দেখে মনে হবে, এক টুকরো শুভ্র নীলাভ মেঘ।
যা, পরে দেখ। ভালো লাগে কি-না?” নতজানু হয়ে মিরে রইলাম। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। শাড়িটা নিয়ে ট্রায়াল রুম খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। দুইটা ট্রায়াল রুম খুঁজে পেলাম। দুটোই আমাদের দখলে। তিস্তা আপু, শেফালী, তুর ও মামিদের দখলে একটা‌। অন্যটা প্রয়াস ভাইয়ের দখলে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর আরেকটা ট্রায়াল রুম খুঁজে পেলাম। ব্লাউজের হুকের সাথে কাঁধের ছোটো চুলগুলো প্যাঁচিয়ে গেল। দু’হাতে ধরে ছাড়ানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না। টানাটানির এক পর্যায়ে পিঠে আঁচড় লাগল। উপায়হীন হয়ে দরজা খুলে উঁকি দিলাম। ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলাম। তুরকে দেখতে পেলাম। তুরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “একটু ভেতরে আয়। চুলগুলো ছাড়িয়ে দিয়ে যা।”

“পারব না। শেফালীকে বল।” পরক্ষণেই কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললাম, “শেফালীকে দেখতে পেলে তোকে বলতাম। তাড়াতাড়ি আয়।”

ভেংচি দিয়ে তুর চলে গেল। বিয়ের মরসুম হওয়ার দরুন ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফাঁকা দেখলে যখন তখন ছুটে আসবে ট্রায়াল নিতে। দরজাটা আস্তে ভিরিয়ে আয়নাতে তাকালাম। অপূর্ব ভাই পার্লার থেকে হেয়ার স্টাইল করেছেন। দেখতে স্টাইলিশ আরু লাগছে। তৎক্ষণাৎ গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম,
“আরু, কী হয়েছে? তুর বলল তুই ডাকছিস।”

“শেফুকে পাঠান একটু।”

“খুঁজে পেলাম না কোথাও, হয়তো অন্য কোনো ট্রায়াল রুমে। আমাকে বল, কী সমস্যা?”

“হুকটায় চুল প্যাঁচিয়ে গেছে। খুলতে পারছি না।”

“দরজা খোল। আমি দেখছি।”

“আপনি?”

“হম। আশেপাশে কাউকে দেখছি না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি। ট্রাস্ট মি। চোখ বন্ধ করে সাহায্য করব।”

গভীর ভাবনায় লিপ্ত হয়ে দরজা খুলে দিলাম। ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভিরিয়ে দিলেন অপূর্ব ভাই। চোখ বন্ধ করে নিলাম। কাঁধে স্পর্শ লাগতেই কেঁপে উঠলাম আমি। সরে দাঁড়ালাম। আচম্কা চোখ খুলে ফেললাম। আঙুল উঁচিয়ে চুল ছাড়াতে লাগলেন। আয়না থেকে দেখে চলেছি অপূর্ব ভাইয়ের সুক্ষ্ম হাতের কাজগুলো। শুভ্র রঙের শাড়িতে মন্দ লাগছে না।

সবাই শপিংয়ে জমে উঠল। আমি তাদের ভারি ব্যাগ বহন করলাম। প্রয়াস ভাই সবাইকে উপহার দিলেন। আমাকে দিলেন না। মন খারাপ নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবাকে খুব মনে পড়ছে। কোথায় তিনি? আমার ভাই থাকলে আমাকেও উপহার দিতো। চোখ দুটো মুছে বললাম, “মামি আর কতক্ষণ লাগবে তোমাদের?”

বড়ো মামি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, “মেয়ের বিয়ে বলে কথা, মনমতো কিনব না? তুই বাড়িতে থেকে যেতি।”

বাক্যটি না করে একপাশে চুপটি করে দাঁড়ালাম। চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। এখনো অনেক কিছু রয়েছে। অপূর্ব ভাই বিরক্ত হয়ে বলেন, “হয়েছে এবার তো বাড়িতে চলো। ক্ষুধায় পেটে নাচছে।”

“একটা রেস্তোরাঁ আছে না এখানে? আসার সময় দেখলাম। সেখানে চল, খেয়ে আবার কিনব।”

অপূর্ব ভাই সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার। প্রয়াস ভাইকে দায়িত্ব রেখে আমাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।

বাড়ির অদূরে সিএনজি থামতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল আমার। ধোঁয়ায় আকাশ কালো হয়ে গেছে। বাড়ির চারপাশে ভিড়। কত মানুষের হাহাকার। শেফালী ও তুরকে রেখে ছুটে গেলাম আমি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজে ব্যস্ত হয়েছে। পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। শেফালী উত্তেজিত হয়ে বলে, “কত তলায় আগুন লেগেছে আরু, ফ্লাটে আমাদের জামা কাপড় আছে। পু/ড়ে যাবে।”

তুর বলে, “তোর ময়না পাখিটা কোথায় আরু? বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমি ওকে খাঁচায় দেখেছিলাম।”

হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে গেল আমার। ময়নাকে একবার হারিয়েছি আর হারাতে পারব না। ‘ময়না’ বলে চিৎকার করে ছুটে গেলাম। আমাকে এসে ধরল ফায়ার সার্ভিসের নারী কর্মীরা। বলেন, “কত তলায় থাকেন আপনি ম্যাম?”

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “চৌদ্দ তলায়।”

“উপরে যাবেন না ম্যাম। আঠার তলায় আগুন লেগেছে। ষোলো তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আপনি যাবেন না।”

হাতটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, “আমার ময়না আঁটকে পড়েছে। আমাকে যেতেই হবে। প্লীজ ছাড়ুন।”

“ম্যাম, বোঝার চেষ্টা করুন। আগুন অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা আপনার ময়নাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করব। কিন্তু আপনাকে ছাড়তে পারব না।”

অবজ্ঞা করে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিলাম। আশেপাশে পাশে দৃষ্টি গভীর করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেলাম। উপরের উঠার সাথে সাথে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ কমে আসছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। দৌড়ে বারো তলা পর্যন্ত উঠে মাটিতে বসে পড়লাম। লিফট শব্দটির সাথে অপরিচিত আমি। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় আরও আগে অসম্ভব এর ব্যবহার। রেলিং-এ হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে দিলাম। শরীরে শক্তি নেই। পেছনে পেছনে দু’জন কর্মী এসেছে। পুনরায় দৌড় শুরু করলাম। ফ্লাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম। বড়ো একটা তালা ঝুলছে। চাবি অপূর্ব ভাইয়ের কাছে। হাত দিয়ে জোরে আঘাত করলাম। হিতে বিপরীত হলো। হাতে ব্যথা পেলাম। দরজায় আঘাত করতে করতে দরজার সাথে মাথা ঠেকালাম। কর্মীদের দেখতে পেলাম না। দু’জন কর্মীকে না দেখে কেঁদে অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনাদের পায়ে পড়ি বোন। আমার ময়না পাখিকে মুক্ত করে দিন। তার মৃ/ত্যুর জন্য আমাকে দায়ি করবেন না।”

মেঝে তখন গরম হয়ে গেছে। সব কিছু ঘোলাটে। চোখে ঝাপসা দেখছি। টকটকে লাল হয়ে গেছে। অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়ে জ্ঞান হারালাম আমি। পরবর্তী দৃশ্য মনে নেই।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল]#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৮

শক্তহীন ডান হাতটায় স্যালাইনের ক্যানেল চলছে গত দুইদিন ধরে। খাবার গলা দিয়ে নামার চান্স নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দুই এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা খুললে তিন সেকেন্ডের মাথায় চোখজোড়া আঁধারে তলিয়ে যায়। চোখজোড়া নিদ্রায় তলিয়ে যেতে ব্যস্ত। দুইদিন অর্থাৎ আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় লাগল নিদ্রাকে বিদায় দিয়ে স্বজ্ঞানে ফিরতে। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে মিনিট দুই সময় মাথার উপর থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। অপূর্ব ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। সামনে বসে আছেন সাদা পোশাক পরিহিতা এক নারী। নিঃসন্দেহে নার্স। শহরের নামকরা হাসপাতালে ভর্তি আমি। বামহাতে মোটা ব্যান্ডেজ দেখে কিছুক্ষণ সময় লাগল ঘটনা উপলব্ধি করতে। মনে হলো কিছুক্ষণ আগেই সবকিছু ঘটেছে। উত্তেজিত হয়ে চারপাশে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার ময়না পাখি কোথায়? সে কি নেই? আমি হাসপাতালে এলাম কীভাবে? ‘বেঁচে আছি’ বর্ণ দুটি কঠিন ঠেকল। আশেপাশে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম,

“ময়না কোথায় তুই?”

আমার বলা শব্দগুলো আমি নিজেই শুনতে পেলাম না। দ্রুত পা রাখলাম মাটিতে। ক্লান্ত শরীর। মাথা ঘুরছে যার দরুন সবকিছু ঘোলাটে। ধোঁয়াতে আবৃত। নার্স মেয়েটা আমাকে লক্ষ্য করে। ধরার প্রচেষ্টা করছেন। অপূর্ব ভাইকে ডেকে বলেন, “স্যার, শুনছেন। প্যাসেন্ট উঠে গেছে।”

অপূর্ব ভাই তেজহীন শরীর নিয়ে এগিয়ে আসেন। আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে থাকেন, যাতে ক্যানেল-এ কোনোরূপ রক্ত না উঠে। বে-সুরেলা গলায় বলেন, “শান্ত হ, আমি আছি। ভয় পাস না।”

মৃদু স্বরে বললাম, “আমার ময়না? ও কেমন আছে?”

অপূর্ব ভাই শুনতে পেলেন না। ঠোঁট জোড়ার দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভ্র কুঁচকে বলেন, “আবার বল।”

“ম-য়-না কোথায়?” শব্দহীন স্বর। হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলেন, “ময়না, এদিকে আয়।”

ময়না তার ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এসে উড়তে লাগল। ছোটো ছোটো লাগছে। পশম নেই। তাপে পু/ড়ে গেছে। নেত্রযুগল পল্লবে ঢাকা পড়েছে। নোনা জল জমেছে। আস্তে ধিরে গাল গড়িয়ে ঝরল। ময়না উড়ে এসে নাকের উপর বসল। কাঁদলে নাকটা আমার লাল টকটকে হয়ে যায়। ময়না তার ডানা দুটো দিয়ে আমার মুখমণ্ডল ঢেকে দিল। সর্বদা আমাকে কাঁদতে দেখলে এমন করে ময়না। কপালে ঠোকর দিয়ে বলে, “আরুপাখি, কাঁদে না। আরুপাখি কাঁদে না।”

“তোর কোনো ক্ষতি হয়নি তো ময়না? তোকে কে ছাড়িয়ে এনেছে?” আমার প্রশ্নে ময়না প্রত্যুত্তর করল না। অপূর্ব ভাই আগ বাড়িয়ে বলেন, “চাবি তো আমার কাছে। আমি ছাড়া কে ছাড়াবে? আমার উছিলায় আল্লাহ দুইবার বাঁচিয়ে দিয়েছে। (প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন) কেমন লাগছে এখন?

মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে বললাম, “ভালো।”

নার্স মেয়েটা আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “স্যার, পেসেন্ট কী বলছে আমি বুঝতে পারছি না। আপনি পারছেন। হাউ কিউট, আপনি লিপ রিপিট করতে পারেন?”

অপূর্ব ভাইকে কেমন অন্যমনস্ক দেখা যাচ্ছে। যাওয়ার আগে ছোটো করে বললেন ‘আজ রাতের বাসে আমরা গ্ৰামে ফিরছি।’ অপূর্ব ভাইয়ের থমথমে গলায় ভীত হলাম আমি। ‘তুর, শেফালী, তিয়াস ভাই, তিস্তা আপু কিংবা মামি’ – কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমার বিপদের সময় দূরে থাকার মতো মানুষ নয় বড়ো মামি। নিজের ভেতরের জবাব খুঁজে পেলাম না।

ভালো একটা ঢিলে ঢালা পোশাক পরতে সাহায্য করল নার্স। এক বাটি স্যুপ খেয়ে তৈরি হলাম। অপূর্ব ভাই ততক্ষণে ফিরে এসেছেন। আমাকে হাসপাতাল থেকে ডিস্চাজ করেছেন। ব্যান্ডেজ করা পা। নার্সকে শুষ্ক ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে পাঁজাকোলা করে নিলেন। ময়না পাখি অপূর্ব ভাইয়ের কাঁধে বসেছে। হাসপাতালের সবাই আমাদের দেখছে। আমি লজ্জায় নত হয়ে ছিলাম। নিচে নামতেই বাস দেখতে পেলাম। বাসের সামনের সিটে বসালেন আমায়। পাশে তিনি। কিছু খাবার নিয়ে নিয়েছেন। সবকিছু অসহনীয় লাগছে আমার। মনে হচ্ছে আমার থেকে বড়োসড়ো কিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সন্দিহান গলায় ফিসফিস করে বললাম, “অপূর্ব ভাই, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। কালকে গেলে হয় না?”

ময়না পাখি টা কোলে বসে বলে, “একটু দেরি করে গেলে তুই চরম আফসোস করবি আরুপাখি। তোর অগোচরে অনেক কিছু ঘটেছে।”

অপূর্ব ভাই আমার পা জোড়া নিজের কোলে নিয়েন। আমি সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতেই বললেন, “রাখ, ভালো লাগবে। একবার ভেবেছিলাম, অ্যাম্ভুলেন্সে করে যাবো। তোর তো অ্যাম্ভুলেন্সের সাইলেন্ট শুনলে ভয় করে। তাই গেলাম না।
এখন তোর স্বর একটু শুনতে পারছি। জ্ঞান ফেরার পর একটুও শুনি নি।”

বাস গতিশীল হলো। ঢাকার ব্যস্ত শহর পেরিয়ে ছুটল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। জানালা থেকে উঁকি দিয়ে শহরকে জানালাম বিদায়। কখনো আসা হবে কি-না জানা নেই।

বাসস্টপে এসে বাস থামল রাত নয়টায়। অপূর্ব ভাইয়ের বুকের সাথে হেলে একটু ঘুম পড়েছিলাম। অপূর্ব ভাই ডেকে ঘুম ভাঙালেন। তবে বেশ আদুরে ও বিষাদে ভরা গলা, “আরু, আমরা পৌঁছে গেছি উঠ।”

ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বললাম, “চলুন।” অপূর্ব ভাই পুনরায় আমাকে কোলে তুলে চললেন। বাসস্টপ জনবহুল স্থান। সারারাত ভিড় থাকে। টঙ দোকানের সামনে ভিড় লক্ষ্য করা যায়। টুলে বসে চা খাচ্ছে যাত্রীরা। পরবর্তী বাস ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। অপূর্ব ভাই টুলের উপর রেখে বললেন, “তুই বস, আমি দেখছি ভ্যান পাওয়া যায় কি-না?”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। টঙ দোকানদার চা বানাতে বানাতে বলেন, “চেয়ারম্যান বাড়িতে যেই বোন ছিল না? মৃধা বাড়িতে বিয়ে দিছিল? সে-তো প্যারালাইড হয়েছিল অনেক আগে। গত দুইদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আজ শুনলাম…

বাক্য শেষ না করেই থেমে গেলেন।
আমাকে চেনা না থাকলেও অপূর্ব ভাইকে চেনেন। অপূর্ব ভাইকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, “অপু বাড়ির কী খবর? মা/রা গেল দুপুরে। তুমি এলে রাতে। দুদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। আগে আসবা না।”

অপূর্ব ভাই ঠোঁট চেপে আকাশের দিকে তাকালেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আরু, আমার ফুফাতো বোন। হাসপাতালে ভর্তি ছিল গত দু’দিন। সবাই চলে আসলেও আমি আসতে পারি নি ওর জন্য।”

“তাড়াতাড়ি যাও, শেষ দেখা দেখতে পারো কিনা দেখো।”
ভ্যান চালক এসেছেন আগেই। অপূর্ব ভাইয়ের সাহায্যে ভ্যানে চললাম। গ্ৰামীণ ছোঁয়া আমার দেহে প্রবাহিত হয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে দিচ্ছে লোম কূপ। এ আমার অচেনা গ্ৰাম। বুকের ভেতরে হাহা করে উঠছে।

বাড়ির সামনে এসে থামল ভ্যান গাড়ি‌। আমাকে কোলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন অপূর্ব ভাই। বাড়িতে এতো ভিড় দেখে কেঁপে উঠছি আমি। টঙ দোকানের লোকজনের কথা কি সত্যি হতে চলেছে? ‘চেয়ারম্যান বাড়ির লোক’ আমার মামার বাড়িকে বলে।

নানি মা আঁচল চেপে ঢুকরে কাঁদছেন। মামারা প্রাণহীন হয়ে বসে আছে। নানা ভাই নানি মাকে দিলেন, “কেঁদো না, এতে পারুল কষ্ট পাবে। অপু তো এখনো এলো না। মেয়েটাকে কতক্ষণ এভাবে রাখব?”

নানি মা উত্তেজিত হয়ে বলেন, “অপু আসলে আরুকে রেখে আসবে? গোসল দিয়ে দা/ফ/নের ব্যবস্থা করো।”

আমাকে সবার সামনে নামিয়ে দিলেন। চার মামি এসে ঘিরে ধরলেন আমায়। তাদের চোখে পানি থাকলেও ঝরছে না। বোনের রুহুর কষ্ট হবে বলে কাঁদা নিষেধ মামাদের।

মামির আঁচল টেনে বললাম, “মামি সবাই এমন করছে কেন? দেখো না বাড়িতে কত ভিড়, কী হয়েছে গো?”

নানা ভাই নরম গলায় বলে, “সামনে তোর মা। শেষবারের মতো দেখে নে।”

বলেই ইশারা করলেন সামনে। হোগলায় সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে শায়িত আছেন একজন। পৃথিবীটা এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল আমার। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। মৃদু হাওয়াতে উড়ে গেল চাদর। গলার স্বরটা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। চোখেরা অনশন শুরু করেছে। মাথাটা ঘুরে নিস্তেজ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম আমি।

[চলবে..ইন শা আল্লাহ]#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৯

আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ। চাঁদের পাশে একটি উজ্জ্বল সুখতাঁরা দেখা যাচ্ছে। দখিনা হাওয়াতে আমার অবাধ্য চুলগুলো উড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘলা আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে আমার মনটাও ভিশন ভার। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। দরজা খোলা খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ শুনতে পেলাম। জানালার গ্ৰিল ধরে উঠে বসলাম। মামি এসেছেন। মাথায় হাত রেখে বলেন, “তোর এক মা নেই তাতে কি? পারুলের সাত ভাই থেকে চার ভাই চার ভাবী আছে। তারা ঠিক তোর যত্ন নিবে।”

মামি মায়ের কোমর জড়িয়ে বললাম, “মা এখন কোথায় মামি? আমাকে কখনো আরু বলে ডাকেনি। আমি আমার জীবনে কখনো মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পারি নি। মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে পারি নি। মা এত স্বার্থপর কেন মামি? এই পৃথিবীতে একা কেন রেখে গেল?”

মামির কাছে কোনো প্রত্যুত্তর নেই। মগডালে একটা ডাহুক পাখি ডেকে চলেছে তার সুরেলা কণ্ঠে। সেই সুর পৌঁছে গেছে ময়নার কানে। ময়না ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম ভঙ্গ হতেই ময়না তিনবার ডাকল আমাকে, “আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি।”

আমি অশান্ত মন নিয়ে ময়নার দিকে তাকালাম। আমার বলতে ময়না আছে শুধু। কিছুক্ষণের ভেতরে শেফালী ও তুর ঘরে এলো। মামি মাকে উদ্দেশ্যে করে বলে তুর,

“মা, তুমি কি আজকে আমাদের সাথে ঘুমাবে?”

“হ্যাঁ, আরুর সাথে একটু শুতে চেয়েছিলাম। জানি ঘুম আসবে না। তবে ওর ঘুমটা জরুরি। অসুস্থ শরীর নিয়ে জেগে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।” বলেই মামি মশারি টানাতে লাগলেন। শহরে থাকতে একদিন আমি মশারি টানিয়ে ছিলাম। তারপরে অপূর্ব ভাই স্প্রে করে মশা তাড়িয়েছেন। ছোটো মামি ভাত নিয়ে হাজির হলেন। বড়ো মামির হাতে দিয়ে বললেন, “ভাত খাবার পর ওষুধ দিও। খেতে না চাইলে জোর করে দিও।”

ঠোঁট কামড়ে বললাম, “হঠাৎ আমার মা মা/রা গেল কেন মামি। যাওয়ার আগেও কত সুস্থ দেখেছিলাম।”

“মায়ের মন ম্যাজিক জানে, তারা জানে মেয়ের বিপদ আপদ। তোর মা প্যারালাইড থাকলেও প্রাণ ছিল। সেদিন আপা ফোন করে বলল, ‘তুই আগুনের ভেতরে আটকা পড়েছিস। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জ্ঞান নেই।’ তখন আমি তোর পাশের কাছাকাছি ছিলাম। আমার কথা নিশ্চয় সে শুনতে পেয়েছে। একটু পরেই দেখলাম, চোখ উল্টে যাচ্ছে, হাত পা ঠান্ডা কেমন হয়ে যাচ্ছে। আমরা দ্রুত হাসপাতালে নেই। জানতে পারি তোর মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। দুইদিন নিজের সাথে লড়াই করে চলে যায় না ফেরার দেশে।”

আকাশের সুখতারা হঠাৎ করে জ্বলে উঠল। আমি তাকাতেই মিষ্টি করে হাসল। আমিও হাসলাম। এতক্ষণ সঞ্চয় করে রাখা অশ্রু ধারা এবার অবাধ্য হয়ে গাল গড়িয়ে ঝরে পড়ল। মামি গালে হাত দিয়ে সেই পানিটুকু মুছিয়ে দিলেন। আচম্কা নিয়ন্ত্রণ হীন হয়ে জড়িয়ে ধরলাম মামিকে। ভেতরের চিৎকার গুলো প্রকাশ পেল বিলম্বে। মামি আমাকে শান্তনা দিলেন না। কেউ আমাকে শান্তনা দিতে চাইলে তিনি হাতের ইশারায় থামিয়ে দেন তাদের। চোখের ইশারায় বলে, “কাঁদ আরু, একটু কাঁদ। ভেতরের কষ্টগুলো বের করে নিজেকে হালকা কর।”

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠেছে। বিছানার চারপাশে মশারি গুঁজে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন মামি। চুলগুলো টেনে দিতে দিতে ঘুমাতে বললেন। আজ বাড়িতে মৃ/ত্যুর শোক আছে, কালকেও থাকবে, থাকবে পরশু। ধীরে ধীরে শোক বিলিন হয়ে যাবে। তিস্তা আপুর বিয়ের ফুল ফুটবে‌। শুধু আমার মা থাকবে না।

মাঝরাতে শুয়ে পড়েছে সবাই‌। আমার চোখে ঘুম নেই। বাইরে দুইশ পাওয়ারের বাতিটা সর্বোচ্চ আলো ছড়াচ্ছে। বিছানার পাশ থেকে ওড়না নিয়ে বাইরে হাঁটা দিলাম। আমার মা গত দুইদিন ধরে কিচ্ছু খায়নি। রান্নাঘরে থেকে খাবার থালায় নিয়ে বের হলাম বাড়ি থেকে। বাইরের পরিবেশ অন্য ধরনের। চিরচেনা সেই মা মা গন্ধ। বড় হয়ে যাচ্ছি‌।

মাকে রাখা হয়েছে তার তিন ভাইয়ের কাছাকাছি। অন্য দিনগুলোতে রাতের বেলা কবরের সামনে গেলে প্রচুর ভয় পেতাম। আজ ভয় নেই। আমার অভয় মা আছে। তিনি আমাকে তার অদৃশ্য ডানা দিয়ে আগলে রাখবে। মাকে রাখা হয়েছে সেখানে বকুল ফুলের গাছ আছে‌। আমি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসলাম। খাবারের থালাটা গাছের পাশে রেখে অস্ফুট স্বরে বললাম, “তোমার ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিও। কেউ তোমার খোঁজ না রাখলেও আমি রাখব মা।”

‘তোমার ম/র/ণকালে কাঁদবে যেজন, সেজন তোমার আপনজন, থাকতে জীবন যায় না চেনা মানুষেরই মন।’

সকালের আলো ফুটেছে‌। চাঁদ মামা অদৃশ্য হয়েছে সূর্যের আগমনে। তারা একজন অন্যজনকে প্রচুর ভয় পায়। বিরোধী পক্ষ। কাঁধে শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে তাকালাম আগন্তুকের দিকে। অপূর্ব ভাই এসেছেন। কখন যে চোখের পাতা লেগে এসেছিল খেয়াল করা হয়নি। অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য হাসি দিয়ে বললাম, “এত সকালে আপনি উঠেছেন।”

অপূর্ব ভাই পাশে বসে বললেন, “আমি তো রোজ সকালেই উঠি। আজ নতুন বুঝি?”

“ওহ্।” সংক্ষিপ্ত জবাব। অপূর্ব ভাই পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “পায়ের ব্যথা ভালো হয়নি। ক্ষতটা দিলি তো তাজা করে।”

তাকালাম পায়ের দিকে। সত্যি ক্ষতটা তাজা হয়েছে। শরীরের ব্যথার চেয়ে মানসিক ব্যথা বেশি জোড়ালো হয়েছে আমার। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ল‌। অপূর্ব ভাই আলতো করে মুছে দিয়ে বললেন, “চোখের পানির মূল্য সীমাহীন। তাই ফেলতে নেই।”

নিজেকে সামলে আরেকবার হাসলাম আমি। অপূর্ব ভাই তার হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “বাবা তোকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি চল। আজ তোর জীবনের একটা বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে।”

হাতের উপর হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই প্রকট হলো ব্যথা। হাতটা খামচে ধরে ধরলাম। দু’হাতে আবদ্ধ করে থালাকে ইঙ্গিত করে বললেন, “খাবারের থালা এখানে কেন এনেছিস?”

“মায়ের জন্য এনেছিলাম। কিন্তু খাবার কোথায় গেল?”

“শে/য়া/ল কু/কুর বা বন্য প্রাণী খেয়ে গেছে। তারা তোর মায়ের জন্য দোয়া করবে। বেশি বেশি দান সদকা দিবি। তোর মায়ের শান্তির জন্য।”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। অপূর্ব ভাই আমাকে ধরে হাঁটতে লাগলেন। আমিও ছোটো ছোটো পা ফেললাম। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। কতগুলো গাড়ি থেমে আছে। গুনে নিলাম ‘তিনটা’ গাড়ি। উঠান পেরিয়ে ঘরে ঢুকলাম। বৈঠকখানায় মামারা বসে আছেন। তাদের থেকে কিছুটা দূরত্ব চোখ পড়তেই থেমে গেলাম। সেই ট্রেনের মানুষটি। ইমদাদুল হোসেন মৃধা। অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনি এখানে চাচা।”

অতঃপর সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ইনিই তিনি। আমাকে ট্রেন থেকে তার বোনের বাড়ি নিয়ে গেছিলেন। ভালো মানুষ।”

বড়োমামা গম্ভীর গলায় বিদ্রুপ করে বলেন, “তোর কাছে ভালো হতে পারে। কিন্তু আমাদের পরিবারের কাছে জ/গ/ন্য। আমাদের পরিবারের সুখ করে নিয়েছে। ইনি তোর বাবা।”

মুহুর্তেই সব বিশ্বাস দূর হয়ে গেল। ঘাড় কাত করে মানুষটিকে দেখলাম। মুখশ্রীতে কত মিল। এ যেন আমি। তার প্রতি জমিয়ে রাখা আমার শত অভিযোগ। ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে বললাম, “আপনি কি সত্যি আমার বাবা? না-কি আমার মায়ের খু/নি, প্র/তা/রক, ছলনাকারী।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here