এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব -১৪+১৫+১৬

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৪

“অপূর্ব ভাই আপনার ওয়াশরুমের ভেতরে একটা বড়ো ব্রাশ। ওটা দিয়ে কি দাঁত ব্রাশ করেন? আমিও করব। দাঁতগুলো মোটা হয়ে আছে। দুদিন ধরে ব্রাশ করা হয়না।”

বলেই অপূর্ব ভাইয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি রান্না ঘরে ডিমের অমলেট করতে ব্যস্ত। খুন্তিটা নিয়ে বলে, “কর। পারলে নিচ থেকে বালু এনে ঘসে ঘসে পরিষ্কার কর। বিরক্তকর!”

পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমিও কাঁচুমাচু করে অপূর্ব ভাইয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন, “ওটা ওয়াশরুম পরিষ্কার করার জন্য বরাদ্দ। ওটা দিয়ে তুই দাঁত মাজতে চাইছিস। ওয়াক থু থু!”

বমি পেল আমার। দু’হাতে মুখ চেপে বললাম, “আগে বললেন না। ছিঃ ছিঃ! একটু হলে আমি মেজেই ফেলতাম। এখন আমি দাঁত মাজব কীভাবে?”

“যা। ব্রাশদানিতে এক্সট্রা ব্রাশ আছে। ওটা দিয়ে ব্রাশ কর।”

আমি চললাম ওয়াশরুমে। ব্রাশদানিতে কত ব্রাশ। খোলা একটা ব্রাশ নিলাম। টুথপেস্ট দিয়ে ঘসতে ঘসতে আয়নাতে নিজেকে দেখছি।
___
ডান হাতটা অপূর্বর ভাইয়ের আয়ত্বে। কুঁজো হয়ে হাঁটছি আমি। অপূর্ব ভাই স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটছেন। উঁচু উঁচু বিল্ডিং দেখলে এমনিতেই মাথা নিচু হয়ে আসে। হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামালেন।

আমি উঠে বসেই হুড টেনে নিলাম। তাড়াহুড়োয় অপূর্ব ভাইয়ের চোখে লাগল। চোখ ধরে বসলেন পাশে। ওড়না নিয়ে ভাব দিলেন। অতঃপর বজ্রকণ্ঠে বলেন, “ইচ্ছে করছে ঠাস করে একটা লাগিয়ে দিতে। বিল্ডিং ভেঙে যদি পড়েই যায়। রিকশার এই হুড ধরে রাখতে পারবে?”

কাঁচুমাচু মুখে করে অন্যদিকে ফিরে রইলাম। জ্যাম রাস্তাঘাট। বড়ো বড়ো রাস্তাঘাট। অথচ গ্ৰামে সরু রাস্তায় জ্যাম হয়না। রিকশা এসে থামল পার্কের সামনে।

আমি নেমেই পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।‌ অপূর্ব ভাই ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টারে গেলেন টিকেট কা/টতে। ভিড় ঠেলে আমরা ঢুকে গেলাম পার্কের ভেতরে। কত সরঞ্জাম। কত খাবার।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে জোড়ায় জোড়ায় সবাই। আড়ালে আবডালে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমিও এক বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। অপূর্ব ভাই হাতের ইশারায় ডেকে বললেন, “পরেরবার যখন আসবি, তখন ঘুরে দেখাব। আজ নয়।”

আজ রাতের ট্রেনে গ্ৰামে ফিরছি। আবদার রাখতে পার্কে এনেছেন তিনি। হঠাৎ না করে দেওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ খুঁজে পেলাম না।‌ হাতটা ধরে আদুরে গলায় বললাম, “প্লীজ থাকি না। থাকি। একটু থাকি। আমার ময়না পাখিকে বলে এসেছি, অনেক অনেক ছবি তুলে তাকে দেখাবো।”

প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “আজ কত তারিখে আরু?”

আঙুলের কড় মেপে বললাম, “আজ তেরো তারিখ। আগামীকাল ভ্যালেন্টাইন ডে। আজ ওম্মা দিবস।”

“তোকে এখানে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।” হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। অপূর্ব ভাইয়ের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “কালকে তো লাভ হওয়ার দরকার ছিল। ভ্যালেন্টাইন ডে কেন? লাভ অর্থ ভালোবাসা।”

“একজন অসৎ লোকের নাম ছিল ভ্যালেন্টাইন এবং তাকে ১৪ তারিখ ফাঁ/সি দেওয়া হয়েছিল। তার নাম স্মরণার্থে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস পালিত হয়।”

“কী অসৎ কাজ?” বলতে বলতে বেরিয়ে এলাম।‌ অপূর্ব ভাই রিকশা ডেকে নিলেন। একই রিকশায় পুনরায় চড়ে চেম্বারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম। একই প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, “কী উদ্দেশ্য বললেন না কিন্তু?”

“আমার মনে হয় না তুই সাইন্সের স্টুডেন্ট। জীব বিজ্ঞান ভালো ভাবে পড়লে জানতে পারতি।” বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভেবে বুঝতে সক্ষম হলাম। ভেংচি দিয়ে বললাম, “আপনি এটা বুঝাতে চাইলেন? মুখ ফুটে বললে কী হতো? শিউলি আছেন না আমার বান্ধুবী? ওর তো আরও আগে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর প্রতিদিন গোসল করে স্কুলে আসতো। আমরা তো বুঝতাম না। আমাদের বলতো, ওর স্বামীর কথা। ওকে না-কি অনেক ভালোবাসে। আমরা সবাই মিলে একদিন বুদ্ধি করে ওদের বাড়িতে গেলাম রাতে। টিনের ঘর। টিন ফাটা। সেই ছিদ্র দিয়ে সব দেখে এসেছি।”

রিকশা চালাক হেসে ফেললেন। মৃদু স্বরে বললেন, “আজকালকার মেয়েরা যা পাকা। একবার কৌতুহল জাগলে না মেটানো পর্যন্ত শান্তি পায় না।”

অপূর্ব ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। হুড টেনে খুলে ফেললেন। ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে বললেন, “মামা এখানেই থামান। আরু নাম।”

টাকাটা এগিয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে নামলেন। ফুটপাত ধরে এগিয়ে গেলাম। একটা কথাও বলেন নি। পৌঁছে গেলাম অপূর্ব ভাইয়ের চেম্বারে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম শাপলা চত্বর। সেদিনের ঠিকানা। একই চেম্বার। দেখতে দেখতে অপূর্ব ভাই ঢুকে গেলেন। আমিও এগিয়ে গেলাম। পথ আটকে দাঁড়াল এসিস্ট্যান্ট। বললেন, “বের হ। তোকে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ।”

অপূর্ব ভাই ফিরে এসে বললেন, “জাহাঙ্গীর সাহেব। ওকে আসতে দিন।”

“স্যার এই তো সেই মেয়েটা।”

“জানি। আয়।”

মনে মনে উচ্চারণ করলাম, “তাহলে আপনিই জাইঙ্গা। কয়েকদিন এখানে থাকলে আপনার জাইঙ্গা ফুটপাতে বিক্রি করতাম। বাইচ্ছা লন ১০ টাকা, কিন্না লন ১০ টাকা। মাইপা লন ১০ টাকা।
____

অপূর্ব ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে আছি।‌ একজনের পর একজনের আগমন ঘটছে। বিশ্রাম নেই বললেই চলে। দৃষ্টি সরিয়ে টেবিলের দিকে তাকালাম। আমার সামনে ফুচকা রাখা। আগে কখনো খাইনি। এই প্রথমবার স্বাদ নিবো। একটা ফুচকায় টক নিয়ে উপরে মশলা দিয়ে মুখে নিলাম। চোখ মুখ কুঁচকে গেল।

পানি পান করে বললাম, “অপূর্ব ভাই, দেখুন তো কী পরিমাণ চুকা হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কালকে রেখে দিয়েছিল।”

“ফুচকার টক এমনই হয়। তাড়াতাড়ি খা।” বলেই অপূর্ব ভাই হেলান দিয়ে বসলেন। রোগী দেখার ভিজিটিং আওয়ার শেষ।

পরপর তিনটা ফুচকা মুখে নিলাম। আর নিতে পারলাম না। চোখ মুখ কুঁচকে আসে। গালে হাত দিয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই। আমারও মনের অসুখ করেছে। একটু সারিয়ে দিবেন?”

“কাজে আয়।”

ছোটো ছোটো পা ফেলে কাছে গেলাম। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাকে তার চেয়ারে বসার নির্দেশ দিলেন। একটা যন্ত্র হাতে দিয়ে বললেন, “এটা বুকে চেপে ধর।”

আমি চেপে ধরলাম। তার নাল অপূর্ব ভাইয়ের কানে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের মতো বলেন, “হার্টবিট ঠিকই আছে। তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়?”

“ডাক্তার সাহেব আপনি আমার সমস্যা জানেন না? আমার সমস্যা গোটা আপনিটাই। আপনি কাছে থাকলে আমার হার্ট দ্রুত গতিতে ছুটে যায়। মনে হয় ওরা মিছিল করছে।”

“আচ্ছা তাই? আমি তো সেই মিছিল শুনতে পারছি না।”

অপূর্ব ভাইয়ের ডান হাতটা ছুঁয়ে দিলাম। এবার সেই মিছিল অনুভব করছি। ভ্রু কুঁচকে বললাম, “দেখেছেন?”

“হম। শুনেছি মিছিল। আল্ট্রাসাউন্ড করেছেন? রিপোর্ট দেখব। সংক্ষেপে লক্ষণ বলেন তারপরে সমাধান দিবো।”

আমার দৃষ্টি গেল অদূরে তাকের ভাঁজে। হাজারো বইয়ের ভাঁজে আদর্শলিপি বইটা। ছোটো ছোটো পা ফেলে বইয়ের কাছে গিয়ে আয়ত্বে নিয়ে এলাম। বড়ো হাতের ABCD বের করে এগিয়ে দিয়ে বললাম, এটাই আমার আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট।
A-তে আস্তে আস্তে ব্যথা করে, B-তে বুকের ভিতরে, C-তে কইতে পারি না কাউরে, D-তে ডর যে করে, E-তে একটু হলে, E-তে একটু হলে, F-এ ফুইলা উঠে পেটের ভিতরে। আমার পেটের ভেতরে।”

“পাকা বুড়ি একটা।”

পেরিয়ে গেল‌‌ কিছু মুহুর্ত। ইতস্তত করে বললাম, “অপূর্ব ভাই সেদিন যখন আমি এই চেম্বারে ঢুকেছিলাম, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? দেখি নি তো।”

“আমার বন্ধু তৌফিক ছিল। আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। তোর কথা শুনে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাই। তোকে পাই না। দাড়োয়ানের‌ কাছে শুনেছি তুই উত্তর দিকের রাস্তার ধরে নদীর পাড়ের দিকে গিয়েছিলি। ব্যাস আমিও গেলাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৫

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।

স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। ভিড় ভাট্টা দিয়ে ঘিরে আছে। ট্রেন এনে থামল সামনে। দু’পা সামনে এগিয়ে বললাম,

“চলুন, ট্রেন চলে এসেছে। সেদিনের মতো ছেড়ে যাবে।”

বলতে বলতে ভিড়ের এক ধাক্কা লাগল। কাঁধে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলাম। অপূর্ব ভাই এক হাতে টেনে কাছে নিয়ে এলেন। ধমকে বললেন, “আগে সবাইকে নামতে দে। নাহলে জায়গা পাবো কিভাবে?”

উচ্চে পড়া ভিড়। একদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পরিচিত কিছু মুখ নজরে এলো। চোখ পরিস্কার করে পুনরায় তাকালাম। হাত ছাড়াতে ছাড়াতে অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “দেখুন না, শেফু ও তুর এসেছে। পেছনে মামিরাও আছে।”

ভিড় একটু কমলেই অপূর্ব ভাই হাতটা ছেড়ে দিলেন। হাতটা বন্ধনহীন হতেই ছুটে গেলাম। শেফু তুরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। অশ্রু মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে বললাম, “কেমন আছিস তোরা?”

“ভালো না, তোকে প্রচণ্ড মনে পড়ছিল আরু।”

“আমারও মনে পড়েছে। একটু পর আমরা ট্রেনে করে গ্রামে যাচ্ছিলাম। তোরা কেন এলি।”

বড়ো মামি পেছন থেকে কানটা টেনে ধরলেন। ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, “লাগতে তো সোনাপাখি।”

“কাউকে কিছু না বলে, চলে এলি। তখন আমাদের জানটা বেরিয়ে গেছিল। আমাদেরও প্রচুর লেগেছে।” কাঁচুমাচু করে হাসলাম। নানা ভাই তার শক্তপোক্ত লাঠি দিয়ে মৃদু পিঠে আঘাত করলেন,

“তোর মা-ও এত দুষ্টু ছিল না। যতটা তুই হয়েছিস। কি তাই তো?”

ব্যঙ্গ করে বললাম, “হ্যাঁ, তাই তো। তাই তো! আমি বলেই লাঠি দিয়ে মা/র/ছ। মেয়েকে মা/র/তে গেলে সাত ভাই তোমাকে যা করত। কি তাই তো?”
___

অপূর্ব ভাইয়ের ফ্লাটে আজ জ্যোৎস্না রাত। তিস্তা আপুর বিয়ের শপিং করতে এসেছে। মামিরা রান্না করতে ব্যস্ত। নানা ভাই ঘুমিয়েছেন পাশের ঘরে। অপূর্ব ভাই ও তিয়াস বাজার করতে গেছে। তুর শেফালী টেলিভিশন দেখছে। গ্ৰামে বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল নেই। ক্যাবল নেটওয়ার্ক থাকার কারণে মনযোগ টিভিতে। আজ আমার মা সুস্থ থাকলে তিনিও আসতেন। দেখতে পারতেন শহরের বড়ো বড়ো ইমারত।

চায়ের ট্রে নিয়ে মামি মা এলেন। সবাইকে চা দিয়ে এক চা আলাদা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “তিস্তার শরীরটা না-কি ভালো লাগছে না। দ্রুত গিয়ে চায়ের চাপটা দিয়ে আয়। দেখি করলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

নিজের চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে তিস্তা আপুর কাছে গেলাম। অপূর্ব ভাইয়ের দুইটা শোবার ঘর, এক বড়ো একটা হলঘর বা বৈঠকখানা, একটা রান্নাঘর ও দুইটা ওয়াশরুম।

তিস্তা আপু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মুখে অমাবস্যার অন্ধকার। আলতো করে ডাক দিলাম,

“তিস্তা আপু, তোমার চা।”

তিস্তা আপু এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে চোখ জোড়া দ্রুত হাতে মুছে নিলেন। বোঝা গেল তিনি কাঁদছেন। নত গলায় বলেন,

“ভেতরে আয়।”

চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে পাশে বসলাম। তিস্তা আপু অধৈর্য গলায় বলেন, “প্রয়াস আসছে জানিস?”

সন্দিহান গলায় বললাম, “প্রয়াস ভাই তো গ্ৰামে। এখানে কীভাবে এসেছেন?”

“প্রয়াস গ্ৰামে আমাকে দেখতে গিয়েছিল আরু। ও শহরে চাকুরি করে। প্রয়াস আর পিয়াস দুজনে। দু’জনেই আসছে।”

পেরিয়ে গেল কিছু অপ্রিয় মুহূর্ত। ধোঁয়া ওঠা চা বরফের পরিনত হয়েছে। নম্র গলায় বললাম, “সুজন ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে তোমার?”

“হম। হয়েছিল।” তিস্তার আপুর সংক্ষিপ্ত জবাব। দরজাটা একটু ভিরিয়ে দিয়ে বললাম, “তুমি কী বলেছ? আর কী বলেছে?”

“আমার বিয়ের কথা তাকে বলেছি। বলেছি চলো পালিয়ে যাই। কিন্তু সে বলছে, স্যাটেল না হয়ে বিয়ে করবে না।”

“মামা বা মামিকে বলেছিলে?”

“না। ভয় করে।”

“তাহলে আর কী একজন দেবদাস আরেকজন দেবদাসী হয়ে যাও।” বলেই বেরিয়ে এলাম। মনটা অশান্ত। ভালোবাসা শব্দটার সাথে আমি অপরিচিত হলেও পুরোনো সিনেমাতে দেখছি। কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই পিয়াস ও প্রয়াস ভাইকে দেখতে পেলাম। দূর থেকে আমার ময়না পাখিটা ছুটে এসে আমার কাঁধে বসল। গালে ঠোকর দিয়ে বলে, “আরুপাখি, ঐ ব/জ্জা/ত ছেলেটা এসেছে। একটা শিক্ষা দিবি না ওকে?”

“হম। দিবো তো!”

রান্নাঘরে মামিরা কাজ করছেন। শরবত তৈরি থেকে সেমাই পর্যন্ত। তাকের উপর মরিচের গুঁড়া শব্দটা দৃষ্টিগোচর হলো। আশেপাশে তাকিয়ে ট্রেটা হাতে নিয়ে বললাম, “আমি দিয়ে আসি?”

“না তুই পারবি না।”

বড়ো মামি বলেন, “সাবধানে নিস। যাতে না পরে।”

সকলের অগোচরে দুই চামচ মরিচের গুঁড়া একটা শরবতের গ্লাসে মিশিয়ে হাসলাম। রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললাম, “থাক তোমরাই দাও।”

অতঃপর ওয়াশরুমে গেলাম। ব্যবহার করা স্যাবলন সাবান সামনে ঘঁষে ঘষে লাগিয়ে রাখল।

তিস্তা আপু ঘরে গেলাম পুনরায়। শেফালী তুর। তিস্তা আপু ঘরে বসে আছে। ছেলেদের সামনে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ। তিস্তা আপু উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, “কোথায় গিয়েছিলি?”

পিয়াস ও প্রয়াস ভাইয়ের সামনে শরবতের ট্রে রাখা। পিয়াস গ্লাস নিয়ে পান করতেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললাম, “৩, ২, ১ । খেলা শুরু।”

“কীসের খেলা?” সবাই একসাথে। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকাল। পিয়াসের চোখ মুখ কালো হয়ে গেল। চোখগুলো টকটকে লাল। ‘কী হলো এটা?’ আমি ব্যতিত বুঝতে পারল না কেউ। গ্লাস রেখে ছুটে গেল ওয়াশরুমে। পরক্ষণেই ধপাস শব্দ পাওয়া গেল। সবাই একসাথে ছুটে গেলাম সেখানে। পিয়াস ওয়াশরুমে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ভিজে গেছেন।

তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলেন অপূর্ব ভাই। ওয়াশরুমে পা রাখতে পিছলে গেলেন তিনিও। দেয়াল ধরে সামনে নিলেন নিজেকে। মেঝেতে এক পলক তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমরা মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছি বাইরে। দরজা খুলে অপূর্ব ভাই বললেন, “আমার একটা পোশাক নিয়ে আয়।”

“আমি আনছি” বলে ঘরে ছুটে গেলাম। অপূর্ব ভাইয়ের একটা পোশাক বের করলাম। অপূর্ব ভাইয়ের বারান্দায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। যেন আস্তো একটা বাগান। প্রয়োজন মতো বিচুটি মিশিয়ে দিলাম।

[চলবে .. ইন শা আল্লাহ]

পেজের রীচ ডাইন। রেসপন্স করার অনুরোধ রইল#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৬

“বংশের চুলকানি একবার ব্যবহারেই খ/ত/ম। মাত্র দশ টাকায়। মাত্র দশ টাকা। চুলকানি মলম, ইঁদুর মা/রা/র মলম।”

মনে মনে উচ্চারণ করে পিয়াস ভাইয়ের কান্ড দেখছি। কিছুদিন আগে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগিতায় বেলেন্ডার না দিয়ে মাইক দিলে। দুদিনের জন্য ভাড়া নিতাম।
অপূর্ব ভাইয়ের পোশাক পরিধান করার পর নাজেহাল অবস্থা হলো পিয়াস ভাইয়ের। চুলকানির জন্য শান্তিতে দু দন্ড বসতে পারছেন না। ছুটে গেলেন ওয়াশরুমে। দরজা খোলা রেখেই পানি ঢাললেন। মুখ টিপে হাসছি আমি। তিস্তার আপুর দৃষ্টি এড়ালো না। হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “পিয়াসের সাথে কী করেছিস তুই? সত্যি বলবি কিন্তু।”

গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বললাম, “আমি পিয়াসের সাথে কিছু করি নি। আমি শরবতের সাথে করেছি, ওয়াশরুমের মেঝের সাথে করেছি, অপূর্ব ভাইয়ের পোশাকের সাথে করেছি। এখন যদি পিয়াস মাঝখানে ঢুকে পরে, তাতে আমার করণীয় কী?”

তিস্তা আপু মাথায় হাত দিয়ে উল্টো ঘুরে রইলেন। ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। তিস্তা আপুর সময় ঠিক একই গতিতে ছুটছে। বিচলিত হয়ে বলেন, “বুঝার চেষ্টা কর আরু। এখানে প্রয়াস আর না পিয়াস। কারো দোষ নেই। দোষ সব আমার ভাগ্যের। আমি সুজনকে ভালোবেসে ভুল করেছি।”

ভ্রু নাচিয়ে কপাল কুঁচকে বললাম, “তোমার জন্য পিয়াসকে এমন নাকানিচোবানি খাইয়েছি, কে বলেছে? সে আমার ময়না পাখির গলা চে/পে ধরেছিল। তার শাস্তি পেয়েছে।”

“কে শাস্তিটা দিয়েছে শুনি?” দুহাত বুকে গুঁজে বললেন অপূর্ব ভাই। সৌজন্য হাসি দিয়ে তিস্তা আপুর হাত টেনে ধরলাম। পেছনে লুকিয়ে গেলাম। বিরাগী হয়ে বললাম, “তিস্তা আপু, তোমার ভাইয়ের থেকে আমাকে বাঁচাও।”

“তিস্তা ঘরে যা। প্রয়াসের কী লাগবে দেখ।” তিস্তা আপু মাথা নেড়ে ঘরে গেলেন। আমিও বড়ো বড়ো কদম ফেললাম। বিলম্বে হাতটা অপূর্ব ভাইয়ের হাতে দখল হলো। বারান্দার দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলেন। রেলিং-এ হাত রেখে বলেন, “চৌদ্দ তলা থেকে একটা বল পড়লে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে, মানুষ পড়লে কী হবে নিশ্চয়ই বোঝাতে হবে না। অতিথি বাড়িতে এলে তার সাথে এমন আচরণ করা কোথায় শিখেছিস?”

‘অপূর্ব ভাই আমার ও তিস্তা আপুর কথা শুনেছে’ – বুঝতে বাকি রইল না। হাতটা ছাড়িয়ে কোমরে হাতে দিলাম। অন্যহাতে নাক ঢলে বললাম, “অন্যের বাড়িতে গিয়ে এমন ব্যবহার সে কোথায় শিখেছে।”

“পিয়াস তো বড়ো হয়।”

“কিন্তু আমার বেয়াই হয়। বেয়াই বেয়ানের দুষ্টু সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির ঢুকতে নেই।” বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। অপূর্ব ভাই আমার গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে এতে সন্দেহ নেই। আমিও একটু কোমর দুলিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
___
একটা ঘরে পিয়াস আর প্রয়াস ভাই ঘুমিয়েছেন। অন্যঘরে নানা ভাই, অপূর্ব ভাই ও তিয়াস ভাই। মেয়েরা ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বিছানা করে শুয়েছে।

চোখে আলো পড়তেই ঘুম বিদায় নিল আমার। পরপর তিনবার হাঁচি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে উঠে বসলাম। মেঝেতে শোবার দরুন ঠান্ডা লেগেছে। গলা চুলকাচ্ছে। গলা চুলকে সামনে হাত আনতেই নজর বন্দি হলো কিছু চুল। পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওড়না ঝাড়া দিতেই একগাদা চুল নিচে পড়ল। অবুঝ দৃষ্টিতে চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাতটা কাঁধে রাখতেই হতভম্ব হলাম। আচম্কা বাম চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু কাঁধে ঝরল। বিলম্ব হলো গলায় স্বর আসতে। কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে দিলাম এক চিৎকার, “মামি..

গ্ৰাম থেকে দুই মামি ঢাকায় এসেছেন। উভয়েই রান্না রেখে ছুটে এলেন। তুর শেফালী ঘুমিয়ে ছিল পাশে। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় উঠে বসল তারা। বড়ো মামি বলেন,

“কী হয়েছে আরু? চিৎকার দিলি কেন? দুঃস্বপ্ন দেখেছি?”

দু’হাতে চুলগুলো মুঠো করে কেঁদে দিলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম, “আমার চুল কোথায় মামি? কোমরের নিচে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো মাটিতে কেন গড়াগড়ি করছে?”

আমার কথা অনুসরণ করে তাজ্জব বনে গেল সবাই। ছোটো মামি বলেন, “রান্না ঘরে যাওয়ার আগেও সব ঠিক দেখেছিলাম। হঠাৎ এমন কীভাবে হলো?”

বড়ো মামি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “লক্ষি মা আমার। শান্ত হ।”

অপূর্ব ভাই চেম্বারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। চুলে হাত চালাতে চালাতে বললেন, “কী হয়েছে এখানে? সাতসকালে চিৎকার করছিস কেন আরু?”

অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠে গেল। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। কথা বলতে পারলাম না। বড়ো মামি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন, “দেখ না, একটু আগেও দেখলাম মেয়েটার চুলগুলো ঠিক আছে। এখন দেখছি কে/টে পড়ে আছে। (ছোট মামিকে উদ্দেশ্যে করে বলেন) সবজি ভাজি পুড়ে যাবে, তুই রান্নাঘরে যা।”

“ওকে তৈরি করে দাও। দেখি কান্না থামাতে পারি কি-না।” বলেই অপূর্ব ভাই ঘরে চলে গেলেন। ‘এতগুলো ব্রাশ দেখে বুঝতে পারল না আমার ব্রাশ কোনটা?’ – যার দরুন শেফালী ব্রাশদানীটা খুলে নিয়ে এলো। মামি টুথপেস্ট নিয়ে বললেন, “তোর ব্রাশ কোনটা?”

“একটাতে দিলেই হবে। কালকে সবুজটা দিয়ে ব্রাশ করেছি, আজকে লালটা দাও। আমার চুল না লাগিয়ে দিলে কিন্তু আমার কান্না থামবে না।” মামি কথা বাড়ালেন না। সংক্ষেপে বললেন, ‘ ঠিক আছে।’
পরিপাটি হয়ে অপূর্ব ভাইয়ের সাথে বের হলাম চেম্বারের উদ্দেশ্যে। নিত্যদিনের ন্যায় আজকেও রিকশায় চড়ে গেলাম। আগের দিনগুলোর মতো অট্টালিকা ভেঙে পড়ার মতো ভয় নেই। শরীরে একটু তেজ বিরাজ করছে। পুরোপুরি শাপলা চত্বরে গেলাম না। একটা বড়ো রেস্তোরাঁ দেখে রিকশা থামালেন। ভাড়া মিটিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে গেলাম। অতিপরিচিত এক রেস্তোরাঁ।বিটিভির ধারাবাহিককে অনেকবার দেখেছি।

মুখোমুখি বসে মেনু কার্ড সামনে রেখে বললেন, “দেখ, কী খাবি?”

“চুল লাগবে আমার।”

“চুল খেলে পেটে প্যাঁচ লেগে ম/রবি। চুল ছাড়া কী খাবি সেটা বল।”

অপূর্ব ভাই ওয়েটার ডেকে পরটা ও সবজি ভাজি অর্ডার করলেন। পাশের চেয়ার টেনে বসলেন। মাথার ঘোমটা খুলে বললেন, “তোকে তো সেই লাগছে আরু। পিয়াসকে দুটো ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”

ভ্রু কুঁচকে বললাম, “তারমানে আপনি জানেন, এটা পিঁয়াজু করেছে?”

“শেফালীকে মিষ্টি কুমড়ার ফালি, তুরকে তুর পাহাড়, তিস্তাকে বিচ্ছু নদী, তিয়াসকে তিন হাস। এখন পিয়াসকে পিঁয়াজু। আমার নাম ঠিক করিস নি।”

“মামি আপনার এমন নাম রেখেছে, ভেঙাবো কীভাবে?”

ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির হলো। অপূর্ব ভাই সবজি মিশিয়ে পরটার টুকরো মুখে তুলে দিলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আলতো করে গাল চেপে মুখে দিলেন। অতঃপর নিজে পরটার টুকরো মুখে দিয়ে বললেন, “এজন্য আমি বলেছি বড়দের সাথে না লাগতে। গতরাতেও বুঝাতে চাইলাম। তুই কি বললি বেয়াই বেয়ান।”

তার বারণে তখন মন সায় না দিলেও এখন আফসোস লাগছে। দ্বিতীয়বারের মতো পূর্বের ভুলটি করলাম না। মৃদু স্বরে বললাম, “স্যরি।”

অপূর্ব ভাই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন। টোল পড়া গালের হাসিটা মারাত্মক লাগল বুকে। নাকে ফুলের সুবাস পৌঁছে গেল। আজ পঞ্জিকায় পহেলা ফাল্গুনের উপস্থিতি।

বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা!
কারা যে কোকিল পিছে/ বসন্ত এসে গেছে!

টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে দিলেন। হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, “চল। একটু বসন্তের ছোঁয়ায় দুজনে বিলীন হয়ে যায়। দু’হাতে বই কুড়াবো।”

পিচের রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি অজানায়। একটি হাত অপূর্ব ভাইয়ের হাতে বন্দি।‌ অপর হাতটা দিয়ে দৃঢ় ধরলাম। মাথাটা কাঁধে হেলান দিয়ে বললাম, “শাড়ি পরলে ভালো লাগতো না? হাতে দু মুঠো কাঁচের চুড়ি। আমাদের সাথে সাথে রিনিঝিনি শব্দে বাজতে থাকতো।”

নীরব থেকে মোলায়েম কণ্ঠে বলে, “মন্দ হতো না।”

অট্টালিকার বারান্দায় গাঁদা ফুলের সমারোহ। পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় কয়েকটা পাপড়ি মাথার পড়ল। অপূর্ব ভাই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে ছন্দ তুলে বললেন, “রঙ্গবতী।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here