#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-০3
অয়ন এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে।অয়নের হাতে চা দেখে পৃথীর মুখটা মুহূর্তে হাসোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।সে চট করে বলে উঠে,
“এই চা টা নিশ্চয়ই আমার জন্যে?জানেন,কালরাতে ভালো মতো ঘুমতে পারি নি।সারারাত জেগে জেগে খুব কেঁদেছি।তার ফলশ্রুতিতে মাথাটা এখন প্রচন্ড ভার হয়ে আছে। এবার চা টা আমাকে দিন আমি আয়েশ করে খেয়ে নিয়ে মাথাটাকে একটু আরাম করি।ওহ হাত তো আবার দড়ি দিয়ে বাঁধা।আচ্ছা তাড়াতাড়ি দড়িটা খুলে দিন!”
অয়ন বিস্ময়ের সাথে অনেকটা হতবুদ্ধিকর হয়ে যায়!মেয়েটা তারসাথে কেমন বাচ্চা বাচ্চা বিহেভ করছে!এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন সে মিস্টার অয়নকে এর আগে কখনো দেখে নি বা তার ক্ষমতা সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই!এর জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে হলে ত এতক্ষণে ভয়ে চুপসে যেত নাহলে আকুতি মিনতি করে তার প্রাণ ভিক্ষা চাইতো।তাতেও না সায় পেলে পায়ে এসে লুটে পড়তো।অয়নের ভাবনার মাঝেই পৃথী আবার বলে উঠে,
“এই যে মিস্টার গ্যাংস্টার, এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন? চা’টা ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!চা ঠান্ডা হয়ে গেলে খাওয়াবেন?”
পৃথীর কন্ঠস্বরে অয়ন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।তবে ভাবনাটা পৃথীকে বুঝতে না দিয়ে সে টি-টেবিলের উপর চায়ের কাপটা রাখে।তারপর পৃথীর দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এসে সামনে থাকা চেয়ারটায় আওয়াজ করে বসে।বাম হাতে থাকা ব্লাক ঘড়িটা উঁচিয়ে সেদিকে পৃথীকে ইঙ্গিত করে বলে,
“সময় মাত্র তিন মিনিট!আমি হাতের বাঁধন খুলে দিচ্ছি।এই তিন মিনিটের মধ্যে চা টা শেষ করে আবার আগের মতন,অর্থাৎ এই মুহূর্তে যেভাবে বাঁধা বস্থায় আছো ঠিক সেভাবে বসে যাবে।যদি বেরুনোর জন্যে লাফালাফি করো ….”
সম্পূর্ণ কথা শেষ না করে অয়ন শার্টের তলা থেকে একটা পিস্তল বের করে তা সটান পৃথীর মাথার দিকে তাক করে বলে,
“এই যে পিস্তল দেখছো না?এই পিস্তল দিয়ে তোমার মাথার খুলি একদম উড়িয়ে দিব!”
পৃথী পিস্তল দেখে ভয়ে একদম জড়োসড়ো হয়ে যায়।সে এমনিতেই সাধারণত খেলনার পিস্তল দেখলে ভয় পায় আর এই পিস্তলে এখন ত তার জানটা বেরুবার অপেক্ষা মাত্র!বার কয়েক ঢোকর গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন?”
অয়ন এবার পিস্তলটা মাথা থেকে নামিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
“অয়ন মানুষদের খুব সহজে মারে না।যদি মানুষ অয়নের কথার নড়চড় করে তাহলে ত লাশ একটা/দুইট….!”
বলেই অয়ন মুখে একটা পৈশাচিক হাসি টানে।অয়ন হাসার সময় তার গালের দুই পাশে দু’টা ছোট্ট টোল পড়ে।
পৃথী সেই হাসিতে মায়াবী ময়াবী চোখ করে তাকিয়ে থেকে বলে,
“আপনি গ্যাংস্টারের লুকে অথবা যেভাবেই হাসার চেষ্টা করেন আপনার হাসি সত্যিই খুব সুন্দর !”
পৃথীর কথায় অয়নের চোখদুটো সরু হয়ে আসে!বলে,
“অয়নকে তেল মেখে যদি ভেবে থাকো এখান থেকে চলে যেতে পারবে তাহলে তোমার ধারণা ভুল!”
“আমি তেল মাখছি না।সত্যি বলছি!আমার কথা না বিলিভ হলে আপনি আয়নার সামনে গিয়ে দেখুন নিজেকে!”
অয়ন এ কথার পিঠে আর জবাব দিলো না।সে পাশে ফিরে এক পলক চায়ের কাপটার দিকে তাকায়।চা থেকে এখনো হালকা গরম গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাত বরফ হয়ে যাবে।তাই আর দেরী না করে পৃথীর হাতের বাঁধন খুলে দেয়।তারপর চায়ের কাপটা তার দিকে দিয়ে,
“কুইক,ডান!ডোন্ট ওয়েস্ট আ সেকেন্ড!”
পৃথী কাপটা হাতে নেয়। চুমুক বসায়!ওমনি তৃপ্তিতে পৃথীরর দুইচোখ বুঁজে আসে।একেবারে আয়েশ করে পুরো চা সে তিন মিনিটের জায়গায় ছয় মিনিটে শেষ করে!তা দেখে অয়ন ত রাগে পুরো আগুন!পৃথী যে এটা ইচ্ছে করে করেছে তা সে বুঝেতে পেরেছে।পৃথীর চা খাওয়া শেষ হলে সে কাপটা টি-টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বলে উঠে,
“মিস্টার অয়ন আপনার হাতে ত জাদু আছে!আপনি এত ভালো চা বানাতে পারেন আল্লাহ !তবে যাইহোক আপনি আপনার হাতের এই চা খাইয়েই আপনার বউয়ের অভিমান ভাঙ্গাতে পারবেন!”
“তোমাকে কত মিনিটস সময় দিয়েছি?”
পৃথী এবার ভড়কে উঠে।উফফস শালা ত আস্ত একটা পাথর!এত সুন্দর সুন্দর কথা বলতেছি তাও ওই আগের কথায়ই পড়ে আছে!
“কী হলো জবাব দিচ্ছ না কেন!?”(চেঁচিয়ে)
পৃথী কেঁপে উঠে।এদিক ওদিক পিটপিট চোখে তাকিয়ে ওমনি হাঁটু ভেঙ্গে অয়নের সামনে ধপাস করে বসে পড়ে।
” আমি তিন মিনিটের জায়গায় ছয় মিনিট লস করেছি।এতে আপনার কথায় নড়চড় করে ফেলেছি।এবার আমাকে যা শাস্তি দিতে ইচ্ছে হয় দিন। আমি তা মাথা পেতে নেব!যদি গুলিও করতে ইচ্ছে হয় গুলি করুন। আমি তাতেও বাঁধা দিব না!”
অয়ন কি বলবে নিজেও ভেবে পাচ্ছে না।এ মেয়ে ত অভিনয় করে তাকে একদম ইমোশনাল করে ফেলবে!একদমই!অয়ন ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে!নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রেখে বলে,
“তুমি বাড়িতে যেতে চাও?”
“আমাকে যেতে দিবেন আপনি?” (গদগদ গলায়)
“যদি ইচ্ছে হয় চলে যাও!”
“আর বললেন যে কি শাস্তি দিবেন?সেটা….!”
“বলছি না ইচ্ছে হলে চলে যাও!”(আওয়াজ গলায়)
পৃথী আরেক দফা কেঁপে উঠে।তবে কাঁপুনিটা খুশির।এই লোকটা তাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবে যেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না!ভেতরে ত ইতোমধ্যে ডাকডাকুম নাচ শুরু হয়ে গেছে।সে অয়নের চোখের আড়ালে লম্বা একটা হাসি শেষ করে বলে,
” আচ্ছা! ”
বলেই দরজার দিকে এগিয়ে যায়।তারপর কি ভেবে যেন আবার পেছনে ফেরে,
“ধন্যবাদ,মিস্টার গ্যাংস্টার!আপনাকে যতটা খারাপ ভেবেছি আপনি ততটা খারাপ নন!”
বলেই আর দেরী করলো না।হুড়মুড় করে ওমনি সিড়ি বেয়ে নেমে আসে।
পৃথী চলে যাওয়ার পর অয়ন চায়ের কাপটা খুব জোরে ফ্লোরের উপর ছুঁড়ে মারে।প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার নিজের উপর এই মুহূর্তে! মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল?কথা ত ছিল অপমাণের প্রতিশোধ নিয়ে তারপর!কিন্ত…কোথায় তার দুর্বলতা!কোথায়!অন্য কারো বেলায় হলে ত সে সুদে আসলে ঠিকই কষিয়ে নিত।প্রয়োজন হলে তাকে খুনও করে ফেলতো!আর এই মেয়েকে…!!!!
৫.
সকাল থেকেই পৃথীর মার শরীরটা খারাপ।পৃথী যখন বাসা থেকে বেরিয়েছিলো তখন হালকা পাতলা বুক ব্যথা করেছিল।এরকরম প্রায়ই হয়।হৃদরোগে বুকে ব্যথা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।তাই পৃথীর মা তা ওতটা মাথায় নেয়নি।কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ব্যথাটা হালকা থেকে আরো ভয়ংকরভাবে রূপ নিচ্ছে!হাত-পা সারা শরীরে ব্যথাটা বেড়ে যাচ্ছে!এরসাথে শ্বাসকষ্ট ত আছেই!
“খালা,মনে হয় আমি আর বাঁচবো না।কেমন যে লাগছে নিজেই বুঝতে পারছি না।মেয়েটা আসছে দোকান থেকে?”
পিয়ারা বেগম মেইন ফটকের দিকে তাকান।পৃথীকে আসতে এখনো দেখতে পাচ্ছেন না দেখে কপালের চামড়ায় আবার ঘন স্তর পড়ে।চিন্তার স্তর ।পৃথীর মার অবস্থা আসলেই খুবই শোচনীয়! দেখে মনে হচ্ছে হাসপাতালে না নিলে খুব বড় বিপদ হয়ে যাবে।এখন তিনি একা একা কি করবেন,কোথায় যাবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।পৃথীও বাসায় আসছে না!ব্যস্ততাকে চেপে নরম গলায় পৃথীর মাকে বলেন,
“না এখনো আসে নি রহিমা। তুই অস্থির হোস না।কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে তোর মেয়ে।”
তার বিশ মিনিট পর পৃথী বাসায় চলে আসে।এসেই দেখে তার মার এই অবস্থায়।সে কান্না করে উঠে।ব্যাকুল হয়ে পিয়ারা বেগম সহ সে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।ডাক্তার টেস্ট করে।অনেক বড় রোগ ধরা খায়!হার্ট এ্যাটাক করেছে!রোগী খুবই রিস্কিতে।এখন একটা অপারেশন লাগবে।৭ লাখ হলেই অপারেশনটা পূর্ণাঙ্গভাবে সাকসেস করা যাবে।ডাক্তারের কথা শুনে পৃথী পুরো দিশেহারা হয়ে যায়!সাত লাখ!সাত লাখ মুখের কথা?তার সাথে ত সাতশো টাকাও মনে হয় নেই!তাহলে এত টাকা সে এখন কোথায় থেকে জোগাড় করবে?কে দিবে তাকে এত টাকা?সেই রাতেই সে তার কত্ত আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করে।কত পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ করে কিন্তু তারা যেই তার মার অসুখের কথা শুনে ওমনি তারা সবাই তার থেকে কেঁটে পড়ে আর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।পৃথীর পাগল পাগল অবস্থা!কি থেকে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
নামাজের জায়নামাজে খুব কাঁদে,
“মাকে কীভাবে বাঁচাবো, আল্লাহ?কীভাবে?এত টাকা জেগাড় করার মতো ত আমাদের সেই ক্ষমতা নেই!এত বড় অগ্নি পরিক্ষায় কেন তুমি আমাদের কেন ফেললে!কেন!কেন!?”
পৃথী পরদিন আবার হাসপাতালে ছুটে যায়।ডাক্তারদের তাড়া পড়ে।বেশি দেরী হলে রোগীকে আর বাঁচানো যাবে না!এখন!এখন উপায়!?হ্যাঁ আছে একটা উপায়- অয়ন!
“অয়ন”-শব্দটা মুখে চাপতেই পৃথীর বুক ভরে গলা থেকে এক দলা কান্না বেরিয়ে আসতে চায়।কিন্তু পৃথী কাঁদতে পারে নি।কারণ কেঁদেও লাভ হবে না।তার মাকে বাঁচাতে হলে তাকে জঘন্য এবং খুবই জঘন্য একটা কাজ করতে হবে!অথচ আগে যে কাজের কথা মনের অগোচরে কখনো ভাবলেই সে নিজের মৃত্যুর কথা একশোবার কামনা করতো!আজ আর করবে না।ছুটে চললো অয়নের বাড়ির দিকে!
চলবে….