#কর্নেল_সাহেব
লেখিকা সুরিয়া মিম
পর্ব- ৪
“পাগলি একটা,ধন্যবাদ বাবা।তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে দামী উপহার দিয়েছো আমাকে।” রায়হান সাহেব হঠাৎ এসে তখন ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
– কি হয়েছে বাবা? এতো খুশিখুশি মনে হচ্ছে কেন তোকে? ইমান তাকে চমকে দিয়ে বলে,
– ভাগ্যিস ইশানের সাথে ওর বিয়ে হয়নি বাবা।তুমি কয়লার ভেতর থেকে হীরে খুঁজে এনে দিয়েছ আমাকে।রায়হান সাহেব কিছু না বলে শান্ত ভাবে তাকিয়ে আছেন ছেলের মুখের দিকে।তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেন,
– তোর মা কে হয়তো আমি সুস্থ করে তুলতে পারিনি।কিন্তু আমি অসম্ভব ভালোবাসি তাকে।ছোটোবেলা থেকে তোরা তোদের মাকে কাছে পাওনি।তাই বাবা হিসেবে আমি চেয়েছি দুনিয়ায় সব সুখ টুকু তোদের দুই ভাইবোন উজার করে দিতে।আর মিমকে আমার এতোই পছন্দ ছিলো যে ইশান এবং ওর বিয়েতে এতো ঝামেলা হওয়ার পর ও আমি এক মুহূর্তের জন্য অবিশ্বাস করতে পারিনি মেয়ে টাকে।তোর বড় আব্বু আর আমি ভেবে নিয়ে ছিলাম, যে কোনো ভাবে এই বাড়ির বউ করে করে আনে হবে এই মেয়ে টাকে।হয় তুই আর নয়তো সাদ।দুটো অপশন খোলা ছিল আমাদের কাছে।সংসার টা ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছিল তাই ধরেনে যোগ্য মেয়েকে তোর বউ করে এনেছি বাড়িতে।ইমান রায়হান সাহেব কে জড়িয়ে ধরে বলে,
– দেখো বাবা,আমার সবাই মিলে সুস্থ করে তুলবো মা কে।রায়হান সাহেব ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
– কি জানি? আমার কোন পাপের সাজা আল্লাহ তাআ’লা দিচ্ছে তোর মা কে? এতোকিছুর মধ্যে ও সবচেয়ে শান্তির কি জানিস? মিম এসেই সামলে নিয়েছে তোর দুই মাকে।আজকাল হৃদিকা কে দেখিনা হিংসে করতে এনাকে।হৃদিকা এহসান রান্নাঘরে এসে মিমকে দেখে বলে,
– শুনলাম মা,তুই পিঠেপুলি করে খাওয়াবি তোর বাবাকে? মিম নারকেল এবং গুড় জাল দিয়ে পিঠেপুলির পুর তৈরি করতে করতে বলে,
– কি যে বলো না মা? বাবা একা কেন তোমরা সবাই খাবে।আমি দুধ গরম করে রেখেছি তুমি গিয়ে খাইয়ে আসো না রিক্ত কে?
– ও জীবনে ও আমার হাতে খাবে না মা।একদম পছন্দ করে না আমাকে।ইমান আমাকে ওর বড় মা মনে করলে ও এনা একাই ওর মা ওর কাছে।যাগগে বাদদে আমি পুর টা দেখছি,
তুই ততক্ষণে গিয়ে খাইয়ে দিয়ে আয় ওকে।জানিস পিঠেপুলি কিন্তু ইমানের ও খুব পছন্দ তবে আমি কখনো পিঠে বানিয়ে খাওয়াতে পারিনি এ বাড়িতে।আসলে জানি না কেমন করে বানায় তুই শিখিয়ে দিবি আমাকে? মিম হাসতে হাসতে বলে,
– অবশ্যই মা শেখার কি কোনো বয়স আছে? তুমি চাইলেই শিখতে পারবে কোনো সমস্যা নেই তাতে।মিহা বড় চাচা শশুরের ছোটো ছেলের বউ নিপা কে দেখিয়ে বলে,
– দেখেছ ভাবি? মেয়ে টা এসেই আর্দশ বউ হওয়ার চেষ্টা করছে সবার কাছে।নিপা একটু বিরক্ত হয়ে বলে,
– শোনো মিহা,মিম যা সেটাই প্রকাশ করছে সবার কাছে।তোমাকে আমরা ছয় মাস ধরে দেখছি।মিম কে কিন্তু চিনি আরো এক বছর আগে থেকে।অধরা এসে মিহা কে বলে,
– এই যে আপনার স্বামী খুঁজছে আপনাকে।মিহা লজ্জা পেয়ে ওর ঘরে ছুটে এসে দেখে আজ একদম অন্য রকম লাগছে ইশানকে ওর কাছে।ইশান হঠাৎ উত্তেজনা বশত কাছে টেনে নেয় ওকে।সহবাস করার মুহূর্তে কথায় কথায় হঠাৎ ইশান মিহা কে বলে ওঠে,
– মিমের কোনো গুন নেই তোমরা মাঝে।তোমরা এক মায়ের সন্তান মা হলে ও এক বাবার সন্তান তো? তাহলে কি করে কথায় ও কাজে মিল নেই তোমাদের মাঝে? আমি তো শত চেষ্টা করে ও ভুলতে পারছিনা মেয়ে টাকে।ও তোমার মতো আহামরি সুন্দরী না হলে ও।ওর সৌন্দর্য খুব টানে আমাকে।আমার মাঝেমধ্যে জানতে ইচ্ছে করে ইমান ও কি নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এভাবে? আজ অব্ধি ওরা কতবার সহবাস করেছে একসাথে? না সব আমাকে কষ্ট দেওয়ার ধান্দা? আমি যে বিয়ের আসরে ওকে ছেড়ে বিয়ে করেছি তোমাকে? আমার ভাই আমার কথায় ওকে বিয়ে করতে রাজি হলে ও।ও কেন বউ হয়ে এসেছে এ বাড়িতে? মিহা স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে ইশানের মুখের দিকে।ও মনেমনে বলে,”আচ্ছা যুদ্ধ ও ভালোবাসায় সবকিছু জায়েজ,তাহলে আমি কেন পেয়ে ও পাচ্ছি না এই লোকটা কে? বারবার কেন আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্তে মিম নামক মেয়েটির কথা উঠে আসে? আমি কি তাসের সংসারের পেছনে সময় ব্যায় করছি? আমি রাতেই কথা বলবো মিমের সাথে,প্রয়োজনে ওর হাত ও পা ধরে বলবো যেন নিজের স্বামীকে নিয়ে চলে যায় এখান থেকে।” প্লিজ বোন তুই চলে যা এখান থেকে।মিম সবটা শুনে বলে,
– এটা কি করে সম্ভব? এটা যেমন তোমারো শশুর বাড়ি তেমন আমারো ঠিক আছে? আর তুমি আমার সাথে যা করার করেছ।আমার মায়ের সংসার নষ্ট করার জন্য আমি কখনো ক্ষমা করবো না তোমাকে।এখন যা বোঝাপড়া করার বাবার সাথে করে নাও।আমি কোনো দ্বিমত পোষণ করবো না তাতে।তবে আমি আমার অধিকার একচুল ও ছেড়ে দেবো না মনের ভুলে ও সে আশা রেখো না বোন।
– ঠিক আছে।তারপর মিহা রায়াহান সাহেব কে এসে বলে,
– বাবা আপনি দয়া করে মিমকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিন ইমানের সাথে।কথা শেষ হতে না হতেই আহমেদ সাহেব বলেন,
– তুমি যেচে পড়ে কেন মা ঝামেলা করতে চাও ওর সাথে? রায়হান পাঠিয়ে দিতে চাইলেও আমি কখনো সেই অনুমতি দেবো না ঠিক আছে।
– বড় চাচা মিমের জন্যে আমি ঠিক মতো সংসার করতে পারছিনা ইশানের সাথে।রায়হান সাহেব এবার রেগে গিয়ে বলেন,
– মিমকে তো কখনো দেখিনি তোমার সংসারে মাথা গলাতে? ও ওর মতোই ব্যস্ত আছে একবার ও আগে যা ঘটে গিয়েছে তাই নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখিনি মেয়ে টাকে।ও কোথাও যাবে না ব্যস এটুকুই আজ খোলাসা করে বলে দিলাম তোমাকে।তুমি তো দেখছি মনে ক্ষোভ পুষে রেখেছ? আর চাইছ আমার ছেলে যেন চলে যায় এই বাড়ি থেকে? তাহলে ভালো করে শুনে রাখো এটা যেমন তোমার বাড়ি,তেমন মিমের বাড়ি ঠিক আছে? মিম সুন্দর করে পিঠেপুলি প্লেটে সাজিয়ে এনে রায়হান সাহেব কে বলে,
– বাবা তুমি চেঁচামেচি বন্ধ করো।নয়তো প্রেশার হাই হয়ে যাবে।দেখ আজ তোমার ও তোমার ছেলের পছন্দের পিঠেপুলি বানিয়েছি মায়ের রেসিপি দেখে।মিমের মায়াভরা মুখ টা দেখে রায়হান সাহেব এবং আহমেদ সাহেব দু’জনেই শান্ত হয়ে গেছে।ইমান গন্ধ শুকতে শুকতে নিচে এসে বলে,
– আহ!
বউ তোমার তো সবার আগে খেতে দেওয়া উচিত ছিলো আমাকে? মিম একটু দুশ্চিন্তা করে বলে,
– আগে খেয়ে দেখুন কর্নেল সাহেব কেমন হয়েছে? রায়হান সাহেব খেতে খেতে বলেন,
– দারুণ মা,তোর দাদির কথা মনে পরে গেছে।মিম হাসতে হাসতে বলে,
– তার জন্যে প্লেট সাজিয়ে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি অধরা ভাবির কাছে।আহমেদ সাহেব খুশি হয়ে বলেন,
– তোর দাদি খেতে তো পারবে না মা।তবে দেখে খুশি হবে।অন্তত জানবে তার ছোটো নাতবউ তাকে নিয়ে কত ভাবে? ইমান বেশ গর্ব করে বলে,
– আরে ভাই কার বউ? বউ টা কার সেটা তো দেখতে হবে আগে? রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে ছেলেকে বলেন,
– ভুলে যাসনে বাপ,মেয়ে কিন্তু আমরা পছন্দ করেছি ঠিক আছে? ইমান মুখ ভেংচে বলে,
– এ্যাহ আসছে? আমি না বিয়ে করলে ও বাড়ির হয়ে আসতো কি ভাবে? মিম ইমানের মুখে একপিস পিঠেপুলি পুরে দিয়ে বলে,
– জানো বাবা? এই লোকটা না টা বড্ড বেশি বকবক করে কানের কাছে।রাতে ঘুম থাকলে ডেকে জিজ্ঞেস করে ঘুম না জেগে আছি? কি আশ্চর্য? কানা নাকি? দেখে না চোখে? ইমান মনেমনে বলে,”একবার ঘরে যাই বউ? তারপর তোমার আজকে হবে।” ইশান মিমের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল হঠাৎ ওর চোখ যায় মিমের কোমরে দিকে।অস্থির হয়ে মনেমনে বলে,”তাহলে কি আমি যা ভাবছি তাই ঠিক? নাহ! এ বিষয়ে কথা বলতে হবে ইমানের সাথে।”
রিক্ত পিঠেপুলি খেতে খেতে মিমকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– জানো রাঙা মা? এই বাড়িতে একমাত্র আমার মা ছাড়া কেউ পারেনা পিঠে বানাতে।আচ্ছা তুমি পাকোন পিঠের নাম শুনেছ?
– হ্যাঁ সোনা আমি কাল বানিয়ে খাওয়াবো তোমাকে।আমাকে তো কেউ আগে বলেনি নাহলে আজি বানিয়ে রাখতাম।
– ঠিক আছে,ইরাদ ইমানকে বলে,
– খেয়াল করে দেখেছিস বোন আজকে মিমের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ফ্রক পরেছে।রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে মিমকে বলে,
– জানিস মা,এই কচি কলাপাতা কালারের ফ্রক টা আগে কখনো পরাতে পারিনি মেয়ে টাকে।আর তুই কি সুন্দর করে বললি? পরে নিয়েছে।মিম মৃদু হেসে রিক্তর চুল বেঁধে দিতে দিতে বলে,
– বাবা ওর কতোই বা বয়স হয়েছে? বাচ্চারা সবসময় আদর পেতে চায় সবার কাছ থেকে।অধরা মিমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– সেটাই দু’জনের বেশ ভাব হয়েছে? একবার তার রাঙা মা কিছু বললে হয়? সাথেসাথে করার জন্যে রেডি থাকে সে।মিম সবাইকে তাড়া দিয়ে বলে,
– রাত অনেক হয়েছে এবার যারযার ঘরে শুতে চলুন।নয়তো আমি বকবো সবাইকে।রিক্ত সোনা দুধ টুকু শেষ করে ফেলো?
– আমার ভালো লাগে না দুধ খেতে।মিম তারপর ওকে কোলে নিয়ে বলে,
– চলো মা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।ইমান দুষ্টুমি করে বলে,
– আজকে শুতে নেবো না তোকে।রিক্ত শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
– তা নিবি কেন দাদাভাই? তোর তো ভাগে কম পরে যাবে।ঘর শুদ্ধো লোক সব স্তব্ধ হয়ে রিক্তর দিকে তাকিয়ে আছে।মিম কিছু টা লজ্জা পেয়ে ইমানে বকে বলে,
– বলি ঘরে যাওয়ার জন্য কি আপনাকে নিমন্ত্রণ পাঠাতে হবে? ইমান বিড়বিড় করে বলে,”বুড়ি টা একটু বেশি পেকে গেছে?” ও খেয়াল করে দেখে মিম নিজের সন্তানের মতো ঘুমন্ত রিক্ত কে আগলে রেখেছে নিজের বুকে।ইমান নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে মিমের কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আল্লাহ যদি কখনো আমাদের সন্তান না দেয় আফসোস থাকবে না বলো? আমাদের রিক্ত যে আছে?” মিম ইমানের হাত চুমু খেয়ে বলে,
– সে তো বুঝলাম,তবে আপনার মতলব ঠিক লাগছে না আমার কাছে।ইমান হঠাৎ মিমকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে কাউচে শুয়ে দিয়ে ড্রিম লাইট টা অফ করে দেয় সাথেসাথে।মিম লজ্জা পেয়ে আস্তে আস্তে বলে,
– কি করছেন? রিক্ত টা একা বিছানায় শুয়ে আছে।ইমান ওর কানের কাছে মুখ এনে বলে,
– হুসস,আমি আর কোনো বাহানা শুনতে চাই না তোমার কাছে।