কলঙ্কের ফুল পর্ব ১২

#কলঙ্কের_ফুল
#পর্ব_১২
#Saji_Afroz
.
.
.
আদির রুমে প্রবেশ করে মেহেরীকা দেখতে পায়, আদি ল্যাপটপে হেসে হেসে কি যেনো করছে।
এদিকে ভাইয়ের কাজের চাপে সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে আর সে কিনা বিছানায় বসে ল্যাপটপ টিপাটিপি করছে! আদিয়াত এর বাচ্চা আদিয়াত এর ব্যবস্থা করতেই হবে তার।
.
নিজের মনে কথাগুলো বলে মেহেরীকা এগিয়ে গিয়ে আদির ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়।
অবাক চোখে তাকিয়ে আদি বলে-
এটা কি হলো!
-যেটা হওয়ার ছিলো সেটাই হয়েছে।
-মানেটা কি! মুভি ডাউনলোড করছিলাম আমি আর তুমি এসে বাগড়া বসাচ্ছো।
-একশবার বসাবো একশবার।
-কেনো শুনি?
-তোমার কি বাসায় বসে থাকতে লজ্জা করেনা?
-আমার বাসায় আমি বসতে লজ্জা করবে কেনো?
.
চোখ রাঙ্গিয়ে মেহেরীকা বললো-
ভাইয়ার উপর কাজের কতোটা চাপ পড়ে সে খেয়াল আছে তোমার! উনার উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তুমি শুধু মাস্তি করতে থাকো। এসব কোন ধরনের কথা! এতোদিন না হয় একা ছিলে, এখন ঘরে বউ আছে সেই খেয়াল আছে তোমার?
.
বউ কথাটি শুনেই উচ্চশব্দে হেসে উঠে আদি।
আদির হাসির কারণ বুঝতে পেরে মেহেরীকা বলে-
সবাই কিন্তু এটাই জানে যে তোমার বউ আছে ঘরে। আর বউ নিয়ে এভাবে বাবা ভাই এর ঘাড়ের উপর বসে খেতে তোমার লজ্জা না লাগলেও নকল বউ হয়ে আমার লজ্জা করছে।
-তুমি একটু বেশি বলছো মেহের।
.
আদির পাশে বসে মেহেরীকা শান্ত গলায় বললো-
আদিয়াত দেখো আমি কড়াভাবে কিছু বলতে চাইনি। কিন্তু তুমি কাজে হাত লাগালে বাবা কতো খুশি হবেন বুঝতে পারছো? আর আরিফ ভাইয়ারও কাজের চাপ কমবে। তোমার নিজেরও ভালো লাগবে।
.
মেহেরীকার দিকে তাকিয়ে আদি কোনো জবাব না দিয়ে রুম ছেড়ে চলে যায়।
.
.
.
কলিং বেল এর শব্দ শুনে কুনসুম হক দরজা খুলেই চমকে যান।
-মুনিয়া তুমি!
-জ্বী আমি। আসতে পারিনা বুঝি?
-কেনো নয়! ভেতরে আসো।
.
বাসার ভেতর ঢুকে চারদিকে চোখ বুলাতে থাকে মুনিয়া।
-বসো মুনিয়া।
-আমি বসবো না। রাজীব ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
-রাজীবের সাথে কেনো?
-কিছু কথা ছিলো উনার সাথে আমার।
.
নিজের রাগ সংযত করে কুনসুম হক বলেন-
এক বোন জ্বালিয়ে ক্ষান্ত হয়নি এখন তুমিও চলে এসেছো। আমার ছেলেটাকে কি তোমরা শান্তি পেতে দিবেনা?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুনিয়া বললো-
আন্টি কোনো কড়া কথা বলার ইচ্ছা নেই আপনাকে। তবে প্লিজ আমার বোন কে নিয়ে কিছু বলবেন না।
-কেনো বলবো না! তোমার বোন…..
-লাখে বাছা একটা মেয়ে। যে আপনার ছেলেকে ভালোবেসেছিলো। কিন্তু আপনার ছেলে…..
-আমার ছেলেও তাকে ভালোবেসেছিলো।
-দেখুন আন্টি আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাইনা। রাজীব ভাইয়াকে ডেকে দিন।
-সে বাসায় নেই।
-কোথায়?
-জানিনা আমি।
.
.
.
-আসবো মা?
.
সালেহা চৌধুরীর ডাকে মেহেরীকা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।
মৃদু হেসে বললো সে-
মা আপনি! আসুন না ভেতরে।
.
সালেহা চৌধুরী ভেতরে এসে সোফার উপর বসে বলেন-
এদিকে আসোতো মা। আমার পাশে বসো।
.
মেহেরীকা তার পাশে বসতে বসতে বলে-
আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম মা।
-কেনো? কিছু দরকার?
-বসে থাকতে আর ভালো লাগছেনা মা। আমাকেও কোনো কাজ দিন না।
.
মেহেরীকার কথায় হেসে উঠে সালেহা চৌধুরী।
মেহেরীকা তার হাসি দেখে বলে-
ভুল কিছু বলেছি মা?
-আরে না। কাজতো অনেক আছে। করবা আস্তে ধীরে। এখনও নতুন বউ তুমি।
-অন্তত রান্নাটা?
-আর যাই করো, রান্না করতে পারবেনা।
-কেনো?
-রান্না মিলির শখ বুঝেছো, ও করতে দিবেনা।
.
কথাটি শুনে হেসে উঠে মেহেরীকা।
.
.
.
রাত ১০টা….
ডাইনিং টেবিলে বসেছে সবাই রাতের খাবার খেতে। আদির সাথে আজ মেহেরীকাও আসে।
মেহেরীকাকে দেখেই মিলি বলে উঠে-
এই যে মেহেরীকা? তোমার ভাসুর কে দেখবেনা?
-এসেছেন ভাইয়া?
.
আরিফের দিকে দেখিয়ে দিয়ে মিলি বলে –
এই যে, এটা তোমার ভাইয়া।
.
আরিফের দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বলে-
আসসালামু-আলাইকুম ভাইয়া।
.
সালামের জবাব দিয়ে আরিফ বললো-
কেমন আছো?
-জ্বী, ভালো। আপনি?
-ভালো। বসোনা, ডিনার করো আমাদের সাথে।
-জ্বী।
.
আদি আর মেহেরীকা পাশাপাশি চেয়ারে বসে।
ওদের একসাথে দেখে সানিয়ার রাগে হাত পা কাঁপতে শুরু করে। আদিকে কবে সে এতো ভালোবেসে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি। আদির পাশে মেহেরীকা নামক মেয়েটাকে সানিয়ার অসহ্য লাগছে। কিন্তু এখন চুপচাপ থেকে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
.
এদিকে আর কেউ খেয়াল না করলেও মেহেরীকা খেয়াল করে দিবা খেতে আসেনি।
শ্বাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে-
মা, দিবা কোথায়?
-আমিতো খেয়াল করলাম না। আছে বোধহয় রুমে।
-আচ্ছা আমি দিয়ে আসবো ওকে খাবার।
.
এপর্যায়ে মুখ খুলেন আমজাদ চৌধুরী। গম্ভীর মুখে তিনি বলেন-
খাওয়ার সময় এতো বলতে নেই। আর আমার বাসায় একটা নিয়ম আছে। যে ডাইনিং টেবিলে এসে রাতের খাবার খাবেনা সে আর সেই রাতে খাবার পাবেনা। সামাজিকতা বলতে একটা কথা আছে। এটা তুমিও মাথায় রাখবে।
.
মাথা নেড়ে জবাব দেয় মেহেরীকা –
জ্বী।
.
.
.
রাত ১১টা….
সবাই যে যার রুমে গেলেও আদি আর মেহেরীকা বসে থাকে ড্রয়িংরুমে।
-মেহের?
-হু?
-যাও, ঘুমাও তুমি।
-তুমি কি করবে?
-দিবার জন্য খাবার নিয়ে যাবো। জানো যতবার আমি রাগ করে খেতে আসিনা, দিবা লুকিয়ে ঠিকই আমার জন্য রুমে খাবার নিয়ে যায়। তবে ও কখনো খেতে আসেনি এমনটা হয়নি।
-তুমি বসো, আমি নিয়ে যাই ওর জন্য খাবার।
-সিউর?
-আরে হুম।
-কিন্তু আওয়াজ না করে নিবে। বাবা জানতে পারলে রেগে যাবে।
-ঠিক আছে।
.
.
নিজেকে নিজের কাছে ছোট লাগছে দিবার।
পিকু বলেছিলো ডার্ক রেস্টুরেন্ট এ বসে শুধু কথা বলবে। কিন্তু কথা বলতে বলতে পিকু, দিবার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়েছিলো। দিবা মানা করা সত্ত্বেও পিকু তার অনেকটা কাছে চলে আসে। পিকুর ছোঁয়া পেয়ে দিবাও নিজেকে সামলাতে পারেনি। আজ অনেক বেশিই ক্লোজ হয়ে গিয়েছে তারা, যেটা একেবারেই উচিত হয়নি।
.
এসব ভাবতে ভাবতে কল আসে দিবার ফোনে।
হাতে নিয়ে দেখে পিকুর ফোন।
আজ তার পিকুর ফোন কেনো যেনো রিসিভ করতে ইচ্ছে করছেনা।
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে রিসিভ করে বলে-
হ্যালো পিকু, আমি ঘুমোচ্ছি।
-আজ এতো তাড়াতাড়ি! আমি ভেবেছি সারারাত কথা বলবো আজ।
-ঘুম পাচ্ছে আজ আমার। ঘুমাই কেমন?
-উহু দিবা! পরে ঘুমাও। আগে বলো আজ কেমন লেগেছে তোমার?
-ভালো।
-শুধু ভালো?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দিবা বলে-
আমরা আজ একটু বেশি বাড়াবাড়ি করেছিনা?
.
দিবার কথা শুনে উচ্চশব্দে হেসে উঠে পিকু।
আজ পিকুকে তার ভিলেন ছাড়া কিছুই লাগছেনা।
.
-এই দিবা? রাগ করেছো তুমি? আসলে তোমাকে এতো কাছে পেয়ে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।
-হুম।
-আর আমাদের মাঝে আজ যা কিছু হয়েছে এসব নরমাল বিষয়। গভীর কিছু আমরা করিনি। দুইটা ভালোবাসার মানুষ এসব করতেই পারে। আরো বেশি করতে পারে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।তুমি নিজেই আমাকে বলবা, পিকু তোমার আদর নিতে ইচ্ছে করছে আমার।
.
কথাটি বলে আবার হেসে উঠে পিকু।
.
দিবা তার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে পিকুকে বলে-
কেউ এসেছে পিকু, আমি রাখছি এখন।
.
দিবা বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখতে পায় মেহেরীকাকে।
-ভাবী তুমি?
-তোমার জন্য খাবার নিয়ে এলাম।
-আমার ক্ষিদে নেই ভাবী।
-ভেতরে আসতে বলবেনা?
-ওহ সরি! আসো।
.
মেহেরীকা ভেতরে এসে হাতের ট্রে বিছানার পাশের টেবিলের উপর রেখে বলে-
ক্ষিদে নেই বললে হবেনা ননদিনী। এতো বড় রাত, মাঝরাতে ক্ষিদে পাবে।
-হুম।
.
দিবার মুখের দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বলে-
মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো? কিছু হয়েছে?
-না ভাবী। বসোনা তুমি।
-বসবো। তোমাকে খাইয়েই যাবো আমি। নাহলে আরেকজন মুখ ফুলাবেন।
-কে?
-তোমার ছোট ভাইয়া।
.
.
.
ড্রয়িংরুমে আদিকে দেখে সানিয়া আসে তার পাশে। কিন্তু আদির ধ্যান সম্পূর্ণ টিভির দিকে।
সানিয়া খেয়াল করে আদির হাতের উপর একটা মশা বসেছে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সানিয়া তার হাতের উপর চড় মারতেই আদি চমকে যায়।
-কি করছো কি সানিয়া?
-মশা মেরেছি আদি, মশা!
-মশা?
-হুম। হাতে দেখো, রক্ত এখনো লেগে রয়েছে।
.
আদি তার হাতে দেখে আসলেই রক্ত রয়েছে।
সানিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে-
ধন্যবাদ, মশা থেকে রক্ষা করার জন্যে।
.
আদির মুখে হাসি দেখে সানিয়া বলে উঠে-
এভাবে হেসোনা আদি।
-সরি?
.
আদির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে আদির এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় ঢুকিয়ে সানিয়া বললো-
আদি হাত সরাবেনা প্লিজ। কিছু কথা বলেই চলে যাবো।
.
সানিয়ার এমন কাণ্ডে আদি বিব্রতবোধ করলেও কোনো উপায় না পেয়ে বলে-
হুম বলো।
-জানো আদি আমি কখনো মশা মারিনি। কেনো জানো? হাত ময়লা হবে ভেবে। কিন্তু আজ এই মশা তোমার রক্ত চুষে নিচ্ছে দেখে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। কিছু না ভেবেই মশাটাকে খতম করেছি আমি। আমার আদিকে একটা মশাও কামড়াক, এটা আমি চাইনা। এটাকে কি বলে জানো? ভালোবাসা আদি, ভালোবাসা।
.
কি পাগল টাইপের কথা বলছে সানিয়া? মশা মেরে সে ভালোবাসা প্রমাণ করতে চাইছে! মাথা কি খারাপ হয়ে গেলো এই মেয়ের!
আপনমনে কথাগুলো বলে মুখ টিপে হেসে চলেছে আদি।
.
সানিয়া সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে বলতে থাকে-
তোমার পাশে একটা মশা আমি সহ্য করতে পারিনা আর এই আস্ত একটা মেয়ে মানে মেহেরীকাকে সহ্য করতে আমার কতো কষ্ট হয় ভেবে দেখেছো?
-কিন্তু মেহের মশার মতো কামড়ায় না আমায়, আদর করে। কামড়ালে ওই একটু আধটু আমিই কামড়ায় আর কি। যেটাকে লাভ বাইট বলে।
-আদি!
.
সানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আদি বললো-
তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো বলেই বললাম। মেহের মোটেও মশার মতো নয়।
-মেহেরীকা মশার চেয়েও জঘন্য। কারণ সে তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়েছে। আমার খুব কষ্ট লাগে আদি, খুব কষ্ট লাগে।
.
কথাটি বলেই সানিয়া আচমকা আদিকে জড়িয়ে ধরে।
.
হঠাৎ সানিয়ার এমন কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে যায় আদি।
.
এদিকে দিবাকে খাইয়ে তার রুম থেকে মেহেরীকা এগিয়ে আসতে থাকে ড্রয়িংরুমে আদির কাছে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here