কলঙ্কের ফুল পর্ব ২৯(শেষ)

#কলঙ্কের_ফুল
#পর্ব_২৯ (শেষ পর্ব)
#Saji_Afroz
.
.
.
মেহেরীকার মুখে দিবার নাম শুনে চমকে যায় রানা।
আমতাআমতা করে মেহেরীকার উদ্দেশ্যে বললো-
কে দিবা?
-বিয়ে কতটা করতে চলেছো? একজনকে করলে নামটা মনে রাখার উচিত ছিলো।
-তুমি কি করে দিবাকে চিনো?
-সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করছিনা। তবে হ্যাঁ এই বিয়েটা আমি হতে দিতে পারিনা।
.
মেহেরীকার কথা শুনে হো হো শব্দে হেসে রানা।
কিছুক্ষণ হেসে সে বললো-
দিবার কাছে কিভাবে প্রমাণ করবে? তুমি বলবে আর সে সহজেই বিশ্বাস করে নিবে! বোকা মেয়েটা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে বুঝেছো?তাইতো বুঝতে পারেনি সে, এইরকম কতো মেয়ের সাথে আমি সম্পর্ক করেছি। শুধুমাত্র চৌধুরী বাড়ির মেয়ে বলে তাকে বেছে নিয়েছি আমি জীবনসাথী করার জন্য।
.
রানার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় দিবা। নিজের কানে এসব শোনার পরেও তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার পিকু এমন!
.
মেহেরীকার কাছে কোনো সাড়া না পেয়ে রানা বললো-
তোমার কিছু নেই রুপটা ছাড়া। অপরূপা তুমি। আর তাই তোমাকেও বউ হিসেবে রাখতে আমার কোনো আপত্তি নেই। দিবাকে টাকার জন্য আর তোমাকে রূপের জন্য। তাছাড়া তোমার পেটে আমার বাচ্চা রয়েছে। কে বিয়ে করবে তোমাকে! আমি তোমাকে ভালোও বাসি। তাই বলছিলাম কি, চুপচাপ আমার কাছে চলে এসো। দিবাকে বললে সে কিছু বিশ্বাস করবেনা। তার চেয়ে ওকে সতীন হিসেবে মেনে নাও।
.
কথাটি বলে আবারো হো হো শব্দে হেসে উঠে রানা।
.
আর সহ্য করতে না পেতে রানার উদ্দেশ্যে দিবা বলে উঠলো-
আমি সবটা বিশ্বাস করেছি।
.
দিবার গলার স্বর শুনে চমকে যায় রানা।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো-
দিবা তুমি!
-হুম আমি। মেহেরীকাকে অসহায় পেয়ে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছো তুমি। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম বলে এটার সুযোগও নিতে চাইছো তুমি রানা!
-ভুল বুঝছো তুমি দিবা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
-একটু আগেও আমি সেটাই ভাবতাম। কিন্তু এখন প্রমাণ পেয়েও তোমার এই কথাটা কিভাবে বিশ্বাস করবো বলো!
-আমি ভাবতে পারছিনা তুমি এতোটা নিচু মনের মানুষ। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে কতো সহজে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছো। লজ্জা করেনা তোমার? তোমার মা বাবা জানলে কতোটা কষ্ট পাবেন! কি নেই তোমাদের! ভালো পরিবারের ছেলে হয়েও এতোটা খারাপ কাজগুলো কিভাবে করতে পারো তুমি!
না রানা। আমার সাথে এটা করে তুমি পার পাবেনা, আমি তোমাকে শাস্তি দিবোই।
-আচ্ছা তাই! কি করবে তুমি?
-পুলিশের কাছে যাবো আমি। একজনকে প্রেগন্যান্ট করে আরেকজনকে বিয়ে করার খুব শখ তাইনা তোমার!
-হুম অনেক শখ। যাওনা পুলিশের। কিভাবে কি প্রমাণ করবে শুনি! বড়জোর মেহেরীকার পেটে আমার বাচ্চা এটা পারবে। ক্ষতি কি! ওকে বিয়ে করে নিবো, তারপর ওর সাথে কি কি হবে সেটা তোমরা ভাবতেও পারবেনা। প্রথমে ওর পেটের বাচ্চাটাকে নষ্ট করবো।
.
এতক্ষণ আদি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও এই পর্যায়ে মেহেরীকার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে রানার উদ্দেশ্যে বললো-
তুই এতোক্ষণ যে কথাগুলি বললি, সবগুলোই অটোমেটিক রের্কড হয়ে গিয়েছে। প্রমাণ আর কি লাগে! এবার কিভাবে বাঁচতে পারবি তুই! আমি বেঁচে থাকতে আমার মেহের আর আমার ছোট বোন দিবার কোন ক্ষতি আমি হতে দিবোনা। আর তোকেও শাস্তি দিয়ে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।
.
আদির কথা শুনে আর কিছু না বলেই রানা ফোনের লাইন কেটে সুইচড অফ করে দেয়।
.
দিবা ফ্লোরে বসে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে-
আমি কি করে এতো বড় ভুল করলাম মানুষ চিনতে! কি করে!
.
তার পাশে বসে শান্ত গলায় আদি বললো-
রানা ভালো পরিবারের শিক্ষিত ছেলে। একটা ভালো চাকরীও সে পেয়েছে। সত্যি বলতে কোনো ভাবেই বুঝার উপায় নেই তার স্বভাব এতোটা খারাপ! আর তুই তার সাথে মিশেছিস বা কতোদিন! নিজেকে দোষী ভাবিস না। আল্লাহর কাছে শোকর আদায় কর। মেহেরীকার মাধ্যমে সত্যটা না জানলে ওমন একটা চরিত্রহীন, বাজে ছেলের সাথে তোর বিয়েটা হতো।
.
দিবা দাঁড়িয়ে মেহেরীকার হাত ধরে বললো-
আমায় ক্ষমা করে দাও ভাবী। ভুল বুঝেছিলাম তোমায়।
-তোমার জায়গায় থাকলে আমিও এটাই করতাম।
-ভাবী তুমি রানাকে ছাড়বেনা, উপযুক্ত শাস্তি তাকে তুমি দিবে। আমি আর ভাইয়া তোমার পাশে থাকবো।
.
দিবার কথায় সম্মতি জানিয়ে আদি বললো-
হুম মেহের। এই ছেলেকে শাস্তি না দিলে আরো অনেক মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করবে সে।
শাস্তি দিবেনা তাকে?
.
মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে মেহেরীকা বললো-
দিবো।
.
মেহেরীকার কাছে সম্মতি পেয়ে আদি তার ফোন বের করে ডায়েল করে তার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের নাম্বারে। যে পেশায় পুলিশ।
-হ্যালো ভাইয়া?
-কি অবস্থা আদি তোর?
-জ্বী ভালো আছি। আমার একটু সাহায্য দরকার ছিলো। তুমি থানায় আছো?
-নারে আমি একটা কাজে বাইরে আছি। কি সাহায্য?
-সরাসরি দেখা হলেই তোমাকে বলতে চাচ্ছিলাম। আর এই সাহায্যটা একমাত্র তুমিই করতে পারো আমায়।
-তাহলে কাল সকাল ১০টার দিকে থানায় আসিস।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
.
ফোন রেখে মেহেরীকার উদ্দেশ্যে আদি বললো-
রানার পাপের শাস্তি ওকে ভোগ করতেই হবে।
.
.
.
কুনসুম হকের পাশে বসে গায়ে হাত দিতেই রাজীব বুঝতে পারে তার শরীর অনেক গরম।
তার মায়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আর সে কিনা এসব অভিনয় ভেবেছে!
নিজের উপরে নিজের ঘৃণা কাজ করছে রাজীবের। না হতে পেরেছে সে ভালো প্রেমিক না হতে ভালো সন্তান।
.
চোখ জোড়া মিটিমিটি করে খুলে কুনসুম হক দেখলেন তার ছেলের চোখে পানি।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বললেন-
রাজীব?
.
চোখ জোড়া হাত দিয়ে মুছে রাজীব বললো-
আম্মা? কেমন লাগছে তোমার?
-আমি ঠিক আছি। কিন্তু তুই ঠিক নেই।
.
রাজীবকে চুপ থাকতে দেখে কুনসুম হকেরও কষ্ট হচ্ছে।
রাজীবের পাশেই তিনি সুপ্তিকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পান।
সুপ্তির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-
মারে? তুই একটু নিজের রুমে যাবি? রাজীবের সাথে কিছু কথা আছে আমার।
-ঠিক আছে। কিছু লাগলে বলো আমায়।
.
সুপ্তি রুম ছেড়ে চলে যেতেই রাজীবের উদ্দেশ্যে কুনসুম হক বললেন-
আমি জানি আমি যা করেছি ঠিক করিনি। আমি তোকে নিয়ে ভেবেছি আর সুপ্তিকে নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু মেহেরীকাকে নিয়ে ভাবিনি। কি ভাববো বল? সারাজীবন মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি, মেহেরীকার জন্য আমাদের মাথা নিচু হবে এটা আমি মানতে পারিনি। মেহেরীকাকে আমি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিনা। তোর পাশে আমি সুপ্তিকেই দেখতে চাই রাজীব। কিন্তু আজ বলবো, যেহেতু জীবনটা তোর সিদ্ধান্ত টা তোর নেওয়ার অধিকার রয়েছে। আমি তোর উপরে কিছু চাপিয়ে দিতে চাইনা। সবটা ভেবে দেখ শেষ বারের মতো। তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি আমি তা মেনে নিবো।
.
.
.
দুপুরের খাবারের পর নিজের রুমে এসে আদি দেখতে পায় বিছানার উপরে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে মেহেরীকা।
আদি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে বললো-
কি ভাবছো?
-তুমি এতো ভালো কেনো।
-এটা ভাবছো?
-হু।
-যাক বাবা, আমাকে নিয়েও ভাবো তাহলে তুমি।
.
মুচকি হেসে আদির চোখের দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বললো-
ঘেন্না করছেনা আমায়?
-কেনো?
-আমার মাঝে অন্যজনের সন্তান রয়েছে তাই?
-এতে যদি তোমার হাত থাকতো তাহলে ঘৃণা অবশ্যই করতাম।
-হুম।
-আমি কি রাজীবের সাথে একবার কথা বলে দেখবো?
.
লম্বা একটা দম ফেলে মেহেরীকা বললো-
তার আর প্রয়োজন নেই। আসলে রাজীবের কোনো দোষ নেই। ও কেনো অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান বলবে! তাছাড়া সেদিন হাসপাতালে রাজীব বলেছিলো ও বলার পরেও ওর মা এটা বিশ্বাস করবেনা এটা ওর সন্তান। আর বিশ্বাস করলেও উনি খুব কষ্ট পাবেন। বিয়ের আগেই আমরা এমন কিছু করেছি শুনে। এসবের জন্যও রানার সন্তানকে রাজীব নিজের সন্তান হিসেবে মেনে নিতে পারছেনা।
-কোনদিন বলেছে রাজীব এসব?
-কাল এখান থেকে চলে গিয়েছিলাম রাজীবের কাছে আমি। শরীর খারাপ করায় সে আমাকে ডাক্তারের নিয়ে যায়। ওখানেই জানতে পারলাম প্রেগন্যান্ট আমি। আর ওখানেই রাজীবের আম্মাকে আনা হয়। উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
কাল নিজ চোখে দেখিছি আন্টির শরীর অনেকটায় খারাপ হয়ে গিয়েছে এসব ভাবতে ভাবতে। আসলেইতো, কে মেনে নিবে আমাকে!
রাজীবের দোষ নেই। এভাবে সে আমাকে মানতে নারাজ। আর তাই আমি আনিকার বাসায় গিয়ে উঠি।
-তুমি রাজীবকে ভালোবাসো তাইনা? তাকে বুঝাও, সে নিশ্চয় তোমাকে মেনে নিবে।
.
মৃদু হেসে মেহেরীকা বললো-
হু নিবে। তবে শুধু আমাকে। বাচ্চাটাকে নয়।
.
.
.
নিজের রুমে পায়চারী করে মায়ের বলা কথাগুলো আওড়াতে থাকে রাজীব।
বারবার একটা কথায় তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
— সারাজীবন মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি, মেহেরীকার জন্য আমাদের মাথা নিচু হোক এটা আমি মানতে পারিনি।
.
মায়ের বলা কথাটা না চাইতেও বারবার তার কানে বেজে চলেছে।
তবে ভুল কি বলেছে তার মা!
প্রত্যেকের একটা ইচ্ছা থাকে স্বাভাবিক। মেহেরীকা যদি সত্যি তাকে ভালোবাসে তাহলে নিশ্চয় সে তার কথা মেনে তার কাছে চলে আসবে। অন্যায় কি চেয়েছে সে! অন্যের পাপের ফসলটাকে বিনাশ করতে বলাটা কি ভুল? নিশ্চয় নয়। সারাজীবন এই পাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর কোনো মানেই হয়না। মেহেরীকাকে বোঝালে সে নিশ্চয় বুঝবে।
ঠান্ডা মাথায় ভালো করে বুঝালে সে অবশ্যই তার ভালোবাসাকে বেছে নিবে। ওই পাপের ফসলকে নয়।
মনে আশা নিয়ে রাজীব ডায়েল করে মেহেরীকার ফোন নাম্বারে।
.
.
.
ফোন বেজে উঠলো মেহেরীকার। বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ছলছল করে উঠলো।
কোনোমতে নিজেকে শক্ত করে রিসিভ করে বললো-
হ্যালো রাজীব?
-ভালো আছো মেহের?
-হু। খুব ভালো। কেনো জানো?
-কেনো?
-আমার অপরাধীতে শাস্তি দিতে পারবো আমি।
-কিভাবে?
-আদিয়াত আমায় সাহায্য করবে বলেছে। আর তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণও জোগাড় হয়ে গিয়েছে।
-কে সে?
-অপরাধীর পরিচয় জানতে চাইছো?
-হুম।
-এতোদিন পর! যাক ওর নাম রানা। যে ছেলেটিকে রেস্টুরেন্ট এ মেরেছিলে তুমি, সে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই আমার সাথে এসব করেছে।
.
রানার কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় রাজীব। রানা সামান্য মারামারির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এমন করবে তার মাথায় আসেনি।
লম্বা একটা দম ফেলে রাজীব বললো-
যা হওয়ার তাতো হয়ে গিয়েছে। এখন রানাকে শাস্তি দেওয়ার কি প্রয়োজন মেহের? সবকিছু সবার সামনে চলে আসবে। তার চেয়ে বরং তুমি ওই পাপটাকে ফেলে আমার কাছে চলে এসো।
-কোন পাপ?
-রানার পাপ।
.
মেহেরীকার কাছে কোনো সাড়া না পেয়ে রাজীব বললো-
আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি মেহের। আম্মাও বলেছে আমার মত তিনি মেনে নিবেন। কিন্তু আম্মা এটাও বলেছে, তোমার জন্য তার মাথা নিচু হোক এটা তিনি চাননা। তাছাড়া আমি নিজেও বাচ্চাটিকে মানতে পারবোনা। চোখের সামনে ওর বেড়ে উঠা মানতে পারবোনা। অন্যজনের পাপকে তুমি আগলে রাখবে তাও মানতে পারবোনা। তাই আমার কথাটা রাখো মেহের।
শুনছো তুমি?
-হু।
-তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাইনা?
-হু।
-তাহলে আমার আর ওই অনাগত বাচ্চার মাঝে আজ যেকোনো একজনকে বেছে নাও তুমি। আমি জানি তুমি আমাকেই বেছে নিবে।
.
মৃদু হেসে মেহেরীকা বললো-
আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই কেউ তোমাকে মারতে বললে মারতে পারবোনা তেমনি আমি আমার অনাগত সন্তানকে ভালোবাসি। সে আমার অংশ। তার বাবা পাপী বলে তাকে তুমি পাপ কিভাবে বলতে পারো!
আমার পরিচয়ে বড় হবে সে। আমার কাউকে দরকার নেই রাজীব। এতো ভেবোনা। সুপ্তিকে বিয়ে করে নাও। আমিতো রানাকে শাস্তি দিবোই। ও শুধু আমার জীবন নিয়ে নয়। আরো অনেক মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করেছে।
-যা বলছো ভেবে বলছো তো? আমি কিন্তু আর ফিরে আসবোনা তোমার কাছে।
-ভাবাভাবির কিছু নেই। একে আমি আমার অংশ ভেবেছি, কারো পাপ নয়।
-হুম, আজ তাহলে আমার চেয়েও এই সন্তান তোমার কাছে বড় হয়ে গেলো!
.
মেহেরীকার কাছে কোনো জবাব না পেয়ে রাজীব বললো-
ভালো থেকো মেহের।
-তুমিও।
.
.
.
ফোনের লাইন কাটতেই চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে মেহেরীকার।
এতোক্ষণ যাবৎ রাজীবকে বলা মেহেরীকার কথাগুলো শুনছিলো আদি।
তার দিকে তাকিয়ে আদি বললো-
মন শক্ত করো মেহের।
.
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে মেহেরীকা বললো-
করেছি।
.
হঠাৎ সালেহা চৌধুরী তাদের রুমে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন-
আদি? সর্বনাশ হয়েছে!
-কি হয়েছে?
-রানার বাবা ফোন দিয়েছিলো। রানা নাকি ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাওয়ার জন্য বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো। মেরিন ড্রাইভ রোড়ে তার
বাইক এক্সিডেন্ট এ ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।
.
মায়ের মুখে কথাটি শুনে হতভম্ব হয়ে যায় মেহেরীকা।
তার দিকে তাকিয়ে আদি বললো-
তুমি গিয়ে দিবাকে দেখো। ছেলেটাকে ভালোবেসেছিলো সে। আমি গিয়ে দেখে আসি ঘটনা সত্যি নাকি।
.
.
.
সালেহা চৌধুরী ও মিলির সাথে মেহেরীকা প্রবেশ করলো দিবার রুমে।
তারা দেখলেন, আমজাদ চৌধুরী দিবার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাকে।
-মারে, আমাদের জীবনে কখন কি ঘটে যায় কেউ বলতে পারেনা। বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর তার মৃত্যু হলে তোর কি হতো ভেবে দেখেছিস! আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ওর হায়াত শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এতে কারো হাত নেই। তুই এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না মা। তোর জন্য ভালো ছেলে খুঁজে আনবো আমি।
.
চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো দিবার। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো –
আমাকে নিয়ে ভেবোনা বাবা। আমি ঠিক আছি। আর একটা কথা রাখবে বাবা?
-হুম, মা বল?
-আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এখন বিয়ে করতে চাইনা।
– আলহামদুলিল্লাহ, আমিও সবসময় এটাই চেয়েছি। তোকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার আমার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা।
-হুম।
-রানা কে দেখতে যাবি?
-নাহ।
-ঠিক আছে।
.
আমজাদ চৌধুরী চলে যাওয়ার পর সালেহা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দিবা বললো-
আমি ঠিক আছি মা। ভেবোনা আমায় নিয়ে।
.
.
.
ঘড়িতে সময় রাত ৮টা…
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মেহেরীকা।
তার পাশে এসে আদি বললো-
কতো অদ্ভুত কিছুকিছু মানুষের জীবন তাইনা?
-হু।
-রানাকে আমরা শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আল্লাহ’র তরফ থেকেই সে শাস্তি পেয়েছে।
আর ভাগ্যিস দিবা সবটা জেনেছিলো ওর সম্পর্কে তোমার কাছ থেকে, তাই নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে। নাহলে ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট সহজে ভুলতে পারতোনা। এখন এক প্রতারককে সে সহজেই ভুলে যেতে পারবে।
.
মেহেরীকা কোন কথা বলার আগেই আদির ফোন বেজে উঠলো।
পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো সানিয়ার ফোন।
-হ্যালো?
-ভালো আছো আদি?
-হুম, তুমি?
-আছি ভালো। আগামী সপ্তাহে আমার বিয়ে।
-কি বলো!
-হুম, মাত্রই ঠিক হলো। আর সাথে সাথেই তোমাকে জানালাম আমি। মেহেরীকাকে অবশ্য আগে জানাতে চেয়েছি কিন্তু ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি।
-ওর শরীরটা আসলে ভালোনা।
-ওহ আচ্ছা! বাবা যাবেন তোমাদের বাসায় দাওয়াত দিতে। আসতে হবে কিন্তু আমার বিয়েতে তোমাদের।
-আগে বলো বিয়ে কার সাথে? ওই পাথরের সাথেইতো?
-হুম।
.
.
ফোন রাখার পর আদির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেহেরীকা বললো-
আমারও কাজ শেষ তাহলে। সানিয়ার বিয়ে, আমি যেতে পারি এখন?
-বিয়ে হওয়ার পরেই না হয়….
-না প্লিজ, আমাকে কোনো টাকা দিতে হবেনা। আমি চলে যেতে চাই। মিথ্যে মায়ার বাধনে আর আঁটকে থাকতে আমি চাইনা। এভাবে সবাইকে আর ঠকাতে পারছিনা আমি।
-কোথায় যাবে?
-জানিনা।
.
আর কোনো কথা না বলে আদি বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে।
.
.
.
রাজীবের রুমে গিয়ে সুপ্তি তার হাতে সিগারেট দেখে বললো-
এসব না খেলেই কি নয় রাজীব ভাই?
.
সুপ্তির কথা শুনে রাজীব সিগারেট অ্যাসট্রেতে ফেলে তার দিকে এগিয়ে এসে বললো-
আমাকে আর রাজীব ভাই না বললেই কি নয়?
.
অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে সুপ্তি-
কি ডাকবো তাহলে?
-শুধু রাজীব।
-বুঝলাম না।
-নতুন করে জীবনটা শুরু করতে চাই সুপ্তি। সাহায্য করবি তুই? আমার মন থেকে মেহেরের নাম মুছে দিতে পারবি তুই?
.
মৃদু হেসে সুপ্তি বললো-
মেহেরীকার নাম মুছতে পারবো নাকি জানিনা। তবে তোমার মনের এক কোণে নিজের নামটি লিখতে পারবো। কারণ আমি তোমাকে অনেক বেশিই ভালোবাসি।
.
.
.
সালেহা চৌধুরী আচমকা মেহেরীকার রুমে এসে বললেন-
এতো বড় কথাটি আমার কাছ থেকে কিভাবে লুকোলে?
.
বিছানার উপরে বসে ছিলো মেহেরীকা। তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে সে বললো-
কি হয়েছে মা?
-তুমি প্রেগন্যান্ট আমায় বলোনি কেনো?
.
মেহেরীকা কিছু বলার আগে তিনি আবারো বললেন-
যেভাবে যা হবার হয়েছে। আমার ঘরে নাতি/নাতনি আসতে চলেছে এতেই আমি মহাখুশি। আমি যাই মিষ্টির ব্যবস্থা করি।
.
সালেহা চৌধুরী কথাগুলো বলে চলে গেলেও মেহেরীকা কিছু বুঝতে পারলোনা তার কথা।
আদি তাদের কি বলেছে!
এখুনি আদিকে জিজ্ঞেস করা দরকার।
এই ভেবে মেহেরীকা আদির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।
.
.
.
-আমিতো শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলাম, এমন কিছু নিশ্চয় হয়েছে যার কারণে এভাবে হুট করে বিয়েটা করেছিস তোরা। কিন্তু তোরা বিয়ের আগেই যে এসব করবি আমি ভাবতে পারিনি।
.
আমজাদ চৌধুরীর মুখে এসব কথা শুনে আদি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তাকে এভাবে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি আরো বললেন-
ছিঃ ছিঃ! আমার ছেলে হয়ে বিয়ের আগে এসব কি করে করলি তুই!
.
আদি কিছু বলার আগেই সালেহা চৌধুরী তাদের মাঝে এগিয়ে এসে বললেন-
আহ! ভুল হয়ে গিয়েছে বাচ্চাগুলার। কিন্তু ভুলটা শোধরে তারাতো বিয়ে করে নিয়েছে নাকি!
-তুমি বুঝছো সালেহা? তারা কতো বড় অপরাধ করেছে?
-হুম বুঝেছি। কিন্তু এখন চেঁচামেচি করে, রাগ দেখিয়ে কি লাভ? তার চেয়ে বরং যে আসতে চলেছে তার জন্য শুভকামনা করাটাই উচিত নয় কি?
.
খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমজাদ চৌধুরী বললেন-
হুম।
.
মিলিও তাদের মাঝে ছুটে এসে বললো-
আমি চাচী হতে চলেছি! উফ..
আর তর সইছেনা, কখন যে পুচকেটার কান মলে দিতে পারবো!
.
তার কথা শুনে আদি বলে উঠলো-
এই ভাবী? একদম আমার পুচকুর পেছনে লাগবেনা তুমি।
-চাচী বলে কথা, অবশ্যই লাগবো!
.
মিলির কথা শুনে উচ্চশব্দে হেসে উঠে সকলে।
.
দূর থেকে এসব দেখে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায় মেহেরীকা।
.
.
.
আদি রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেলো মেহেরীকা বিছানার উপর বসে কাঁদছে। তার পাশে বসে আদি বললো-
ওভাবে চলে এসেছো কেনো?
-তুমি আমায় দেখেছো?
-হুম।
-তুমি কেনো বললে এসব? কেনো সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিলে? দয়া দেখাচ্ছো আমায়?
.
মেহেরীকার কথা শুনে মৃদু হেসে আদি বললো-
একদমই না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, বলেছিলাম না?
-হু।
-ভালোবাসি বলেই করেছি এসব। কারণ আমি তোমাকে হারাতে চাইনা।
-সবাইকে ঠকানো হবে।
-আমি যখন এই অনাগত সন্তানটিকে নিজের সন্তান হিসেবে মেনে নিচ্ছি তাহলে কি করে ঠকানো হয় বলতে পারো?
.
মেহেরীকার কাছে কোনো জবাব না পেয়ে আদি বললো-
আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসোনা। কিন্তু যাকে ভালোবাসতে তার কাছে যেতেও আমি তোমাকে আটকায়নি। তবে আমার বিশ্বাস ছিলো, তুমি ফিরে আসবে আমার কাছে। এই দেখো, আমার বিশ্বাসের জোরেই তুমি আজ আমার পাশে। আমি সবটা মেনে তোমার পাশে থাকতে চাই মেহের। তাহলে তুমি সবটা ভুলে কেনো আমার সাথে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারোনা?
যাক, আমি তোমায় জোর করবোনা। তবে এই বাড়ির সকলে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। কতো খুশি হয়েছে তারা দেখেছো তুমি?
-হুম। কিন্তু নিজের জীবনটা আমার মতো মেয়ের সাথে জড়ানোটা ঠিক হবে তোমার? অনেক ভালো মেয়ে পাবে তুমি।
-তোমার মতন পাবোনা। আমার খুশি তোমাতেই।
আমার তরফ থেকে কোনো বাঁধা বিপত্তি নেই। এখন তুমি যা ভালো মনে করো করতে পারো। তবে হ্যাঁ, আমার মতো তোমাদের কেউ ভালোবাসতে বা ভালো রাখতে পারবেনা।
-তোমাদের?
-তুমি আর তোমার অনাগত সন্তান।
.
ছলছল দৃষ্টিতে আদির দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বললো-
কপালে এতো সুখ সইবেতো আমার?
-আসতে দিলে কই সুখ এখনো! এক্সেপ্ট করেই দেখতে একবার আমার প্রপোজালটা।
.
আদির কথা শুনে মেহেরীকা হেসে চলেছে।
তার হাসির দিকে তাকিয়ে আদি বললো-
এই হাসিটা আজীবন দেখতে চাই। সুযোগটা দিবে প্লিজ?
নকল বউ থেকে আসল বউ হবে আমার?
.
মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বললো-
হু।
.
মেহেরীকার জবাব হ্যাঁ শোনা মাত্রই আদি তার হাত ধরে বললো-
এবার বলো আমাদের মেয়ের নাম কি হবে?
-মেয়ে!
-হুম মেয়ে।
-কিভাবে বুঝলে মেয়ে হবে?
-আরে আমি বাবা বলে কথা! বুঝতে পেরেছি। বলোনা এখন নাম কি রাখবে?
-তোমার নামের সাথে মিলিয়ে কিছু রাখি।
-না, দুজনের নামের সাথে মিলিয়েই রাখো।
.
পেছন থেকে দিবা বলে উঠলো-
আদরীকা কেমন হয়?
.
দিবার দিকে তাকিয়ে আদি বললো-
দরজায় আড়ি পেতে ভাই ভাবীর কথা শোনা হচ্ছে?
.
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দিবা বললো-
আমার এতো শখ নেই। এদিকে এসেছিলাম, তোদের কথা এটা কানে এসেছে তাই বললাম। যাক আদি + মেহেরীকা= আদরীকা।
কেমন হলো নামটা?
-বাহ দারুণ! এই না হলে আমার বোন তুই!
-আদরীকার ফুফিও আমি।
ভাবী তুমি বলো কেমন হয়েছে নামটা?
.
দিবার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহেরীকা বললো-
খুব সুন্দর।
-সত্যি?
-হুম।
ধন্যবাদ তোমায়। এভাবে আমার পাশে থাকার জন্য।
-ভাবী তোমাকে ধন্যবাদ।
তুমি না থাকলে আমি রানা নামক ব্যক্তিটার আসল পরিচয় কখনো জানতেই পারতাম না।
-হুম।
-এসব বাদ দাও, তোমাদের বিয়ে কখন সেটা বলো?
.
সালেহা চৌধুরী মিষ্টির প্লেইট হাতে নিয়ে ভেতরে আসতে আসতে বললেন-
কার বিয়ে?
-ইয়ে মানে… ভাইয়া ভাবীরতো জমজমাট করে বিয়ে হয়নি, এটার কথাই বলছিলাম।
-আমার নাতি/নাতনি আগে সুস্থভাবে জন্ম নিক। তারপর নাহয় বড় করে অনুষ্ঠান করে আবার বিয়ে দিবো আদি আর মেহেরীকার। কি বলিস তোরা?
.
মুচকি হেসে মেহেরীকা বললো-
আপনি যা ভালো বুঝেন মা।
.
.
.
আদরীকার যখন দুই মাস……
.
মেহেরীকার আর আদি বসে আছে একটি পার্কের বেঞ্চের উপর। তাদের সাথে রয়েছে তাদের মেয়ে আদরীকা।
মেহেরীকার দিকে তাকিয়ে আদি বললো-
এই প্রথম কোনো বাচ্চা মা বাবার বিয়ে দেখেছে, তাইনা মেহের? আমাদের ফুল গতকাল আমাদের বিয়েতে কতো মজা করেছো দেখেছো?
-সবার কোলে চড়ে চড়ে?
-হুম।
-জানো আদিয়াত? সবটায় যেনো আমার স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। ভেবেছিলাম আমার মা অন্তত ঝামেলা করবে। কিন্তু তিনিও কতো সহজভাবে বললো, যা হয়েছে তাতে আমার কোনো হাত ছিলোনা। যা হচ্ছে তা যেনো ধরে রাখতে পারি। উনিও বুঝি সৎ মা থেকে মা হয়ে উঠতে পারলো!
-তুমিতো সবসময় এটাই চেয়েছিলে তাইনা?
-হুম।
.
আদরীকার দিকে তাকিয়ে আদি বললো-
এই যে আমার ফুল? আব্বুর কোলে আসবে?
.
আদির কথা শুনে মুচকি হেসে মেহেরীকা বললো-
তুমি ওকে আদরীকা ডাকোইনা। খেয়াল করেছি আমি।
-হু, আমি ওকে ফুল ডাকি।
-কলঙ্কের ফুল বলে?
.
মৃদু হেসে আদি বললো-
না, ও আমাদের ভালোবাসার ফুল। আর ও আমার ফুল কুমারী। ফুল সবসময় পবিত্র হয় জানোনা?
-হু।
-আর কখনো এসব বলবেনা তুমি।
.
আদির চোখের দিকে তাকিয়ে মেহেরীকা বললো-
আদিয়াত?
-হু?
-ভালো না বেসে পারলাম না তোমায়।
.
(সমাপ্তি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here