#কাকতাড়ুয়া
#পর্ব_১০+অন্তিম_পর্ব
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা
________
“আমার বান্ধবীদের সবার বাবা তাদের সাথে স্কুলে আসে,তাদের আদর করে,চকোলেট কিনে দেয়।অনেক অনেক ভালোবাসে।ওদের বাবাদের মতো তুমি কেনো আসো না আব্বু?ওদের বাবারা যখন ওদের আদর করে তখন আমার তোমার কথা ভেবে কষ্ট হয়।তুমি কি বোঝো না?তুমি কবে আসবে বল।”
নার্সারিতে পড়াকালীন একদিন ফোনে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেছিলাম আমি।প্রতিউত্তরে আব্বু আশ্বাস দিয়ে বলেছিলে,
“আমি আসব আম্মু।আগামী শুক্রবার আমি তোমাকে আদর করতে আসব।”
তার এই আশ্বাস ভীষণ খুশি করেছিলো আমাকে।আব্বু আসবে বলে আনন্দিত ছিলাম সেই কয়েকটা দিন।আব্বু এসেছিলো ঠিকই।ফুলের মতো আমাকে আদরও করেছিলে ভীষণ।পাঁচ বছরের ছোট্ট আমিটা কি আর জানতাম যে আমার বাবা জীবনের শেষ আদরটা করতে আসবে।সেদিন যাওয়ার সময় আম্মুকে দিয়ে গিয়েছিলো ডিভোর্স পেপার।হয়ে যায় তাদের বিচ্ছেদ।বাবার অনুপস্থিতির যন্ত্রণাটা ধুকে ধুকে অনুভব করলেও আম্মুর সাথে ভালোই ছিলাম।এই ভালো থাকাটাও স্থায়ী হয়নি।চার মাস তেরো দিন ইদ্দত পালনের পর বিয়ে করে অন্যের বাড়িতে পাড়ি জমায় আম্মু।সেই পাঁচ বছরেই বাবা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হই আমি।যেই পাষান বাবা আর কখনো দেখতে আসেনি আমাকে।তার হাত ধরে আজ বেড়িয়ে যাচ্ছি এতোদিন পরিচিত নীড় ছেড়ে।কিছু জিনিসে সত্যিকার অধিকার না থাকলেও অধিকার বোধটা জন্ম হয়।এই বাড়িটাও আমার তেমন জায়গা।ওই যে কেবলমাত্র জন্মানো অধিকার বলেই চাইলেও আর থাকতে পারব না।সদর দরজার বাইরে বেড়িয়ে আবারও এক পলক তাকালাম বাড়িটার পানে।শেষ বারের মতো মস্তিষ্কে গেথে নিলাম বাড়ির নকশাটা।হয়তো কোন এক নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় সঠিকভাবে স্মৃতি চারণ করতে।দক্ষিণ দিকে তাকাতেই অক্ষিগোচর হল চিরচেনা সেই শিউলি গাছ।যে গাছের সাথে হাজারে স্মৃতি মিশ্রিত রয়েছে।নিশান ভাইয়ের সাথে হাজার হাজার চাঁদনী রাত কাটিয়েছি এই গাছের নিচে।দুজনের অপ্রকাশ্য শত প্রনয়ের সাক্ষী এই গাছ।নিশান ভাই আর আমি কাল রাতেও এর নিচে দাড়িয়ে রাতের কিয়দংশ কাটিয়েছি।পূর্ন চাঁদ ছিলো আকাশে।শীতের কুয়াশা ভেদ করে রুপালি আলো ঠিকড়ে পরেছিলো আমাদের উপর।নিশান ভাই পুর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে।আড়ষ্ট হয়েছিলাম আমি।নিশান ভাই আমাকে বলেছিলো,
“তোর মনে আছে এরিন?আমরা যখন ছোট ছিলাম।দুইজন বর বউ খেলতাম।নিসা আমাদের বিয়ে পরিয়ে দিত।তুই রান্নার জন্য আমাকে বাজার করতে বলতি।আমি বিভিন্ন আগাছা তুলে এনে তোকে দিতাম।আর তুই সেসব সুন্দর করে সাজিয়ে বিভিন্ন আইটেম বানিয়ে আমাকে খেতে বলতি।বড় কাঠাল পাতা দিয়ে বাতাস করতি আর বলতি কেমন হয়েছে খেতে?”
লজ্জায় নুইয়ে গিয়েছিলাম।আমার লজ্জাকে দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন,
“সেই আমরাই এখন সত্যিকার বর বউ হব।তুই সত্যি সত্যি আমার বউ হবি বিশ্বাসই হচ্ছে না।সেই সেদিনের পিচ্চি এরিন যার গাল টিপে দৌড়ে পালাতাম সেই গালেই কি না…।”
কথা শেষ করতে দেই নি আমি।দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম।নিশান ভাই স্বজোড়ে হেসেছিলেন।সেসব সুখস্মৃতি এখন বেদনাদায়ক হয়ে গেছে।
দৌড়ে গিয়ে আকড়ে ধরি সেই গাছটাকে।অসংখ্য বার এটাতে ক্ষত সৃষ্টি করে নিশান+এরিন লিখে রেখেছি আমি।কেউ দেখার আগেই যে ক্ষত শুকিয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছে।আবারও ক্ষত করেছি।বারবারই বিলীন হয়ে গিয়েছে।আর কখনো লেখা হবে না এখানে।লেখা হলেও অন্য কারো নাম যুক্ত হবে নিশানের পাশে।একটা চুমু দিয়ে কান্না করতে থাকি আমি।বিড়বিড় করে উচ্চারণ করি,
“হে গাছ, প্রকৃতির নিয়মে প্রতিদিন ফুল ঝড়াবে তুমি।যার উদ্দেশ্যে সে ফুল আমি রোজ কুড়াতাম তা ভবিষ্যতে ঠিক তার জন্যই অন্য কেউ কুড়াবে তার প্রিয়তমা হয়ে।সে যেমন মুগ্ধ নয়নে দেখতো আমাকে ঠিক তেমনি মুগ্ধ দৃষ্টি পতিত হবে অন্য কারো উপর।আমার স্মৃতিজুড়ে তুমি থাকলেও তে তোমার মাঝে আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।রোজ পানি দিতাম তোমাকে।তোমার আঙিনা পরিষ্কার করতাম ঝাড়ু দিয়ে।বিনিময়ে আমার লুকানো অভিযোগ, কষ্ট, ভালোলাগা-ভালোবাসার অনুভূতি গুলো লুকিয়ে রেখো।”
বাড়ির প্রতিটা জায়গায়,প্রতিটা প্রান ও বস্তুতে আমার স্পর্শ লেগে আছে।নিজের স্থান পরিবর্তন টা খুব যন্ত্রণাদায়ক।এখানে আমার আর কোন অধিকার নেই ভাবতেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ছেড়ে যেতে।কোন লাভ নেই চলে যেতেই হবে সকল মায়ার বাঁধন ছেড়ে।নিজের চিরচেনা সবকিছু ছেড়ে পা বাড়ালাম পুরো অচেনা সৎ মায়ের সংসার নামক আমার নতুন সংগ্রামে।
________________
পাঁচ বছর পর
রিসেন্ট অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে আজ।আমি রেকর্ড মার্ক গড়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছি।একদম অপরিচিত আমি নিমিষেই পপুলার হয়ে গিয়েছি।অনলাইনে এসে দেখি আমার ক্ষুদ্র আইডিটার ফলোয়ার সংখ্যা কয়েক ঘন্টায়ই অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।একের পর এক নোটিফিকেশনের চাপে ফোন হ্যাং করছে।প্রাপ্তির আনন্দটা বিরক্ত দিচ্ছে এখন।মিনিট পাঁচেক পর নটিফিকেশনের গতি ধীর হল।হটাৎ চোখ আটকে গেল একটা নোটিফিকেশনে।
মেহেরুন নিসা ওয়ান্টস টু সেন্ট ইউ এ মেসেজ।লক দেওয়া প্রোফাইলের ক্ষুদ্র পিক দেখেও শনাক্ত করতে অসুবিধা হয়নি সে আমার মামাতো বোন।তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম আমি।যারা একসময় ছুড়ে ফেলেছিলো আমাকে।আমার প্রাপ্তিতে তারাই এখন প্রায়োরিটি দিচ্ছে।অথচ সেখান থেকে প্রস্থানের পর খোজ অবধি নেয় নি।ভুল বললাম নিয়েছিলো একদিন।সে ঘটনার পর বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেই আমি।দাদির ভালোবাসা কেমন তা বুঝতে পারিনি কখনো।আমার জন্মের আগেই তিনি গত হয়েছেন।আর দাদুর দুনিয়া ত্যাগ যখন আমার বয়স দশ।দাদু অনেক ভালোবাসত আমাকে।জন্মদাতা পিতা কখনো দেখা না করলেও দাদু বিভিন্ন খাবার,জামাকাপড়, টাকা পয়সা নিয়ে দেখা করতেন আমার সাথে।সে বাড়ি গিয়ে দাদুকে মিস করছিলাম খুব।সে থাকলে হয়তো কিছুটা সাপোর্ট পেতাম।কিন্তু তা হয়নি।সৎ মায়ের আচরন কেমন হয় তা আমাকে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি।এভাবেই চলছিলো আমার দিন।হটাৎ একদিন নিশান ভাই আসেন আমার সাথে দেখা করতে।আমার হাত ধরে ক্ষমা চাইলেন।তিনি বললেন,
“তুই ঠিকই বলেছিলি এরিন।আমরা বিশ্বাস করিনি।সেই ছেলে এসে সব স্বীকার করেছে।মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সে তোর অজ্ঞানের সুযোগ নিয়ে ওভাবে কয়েকটা পিক তুলে দিয়েছিলো।কিন্তু পুরো টাকা তো সে পায়ই নি।উপরন্তু তার বউ,পরিবার ভুল বুঝে তাকে ত্যাগ করেছে।সে তোর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিল।”
“তো এখন কি তাকে ক্ষমা করে দিতে বলতে এসেছেন?”
“উহু।আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।আমাকে কি মাফ করে দেওয়া যায় না?চল সব নতুন করে শুরু করি আবার।তোকে ছাড়া আমাদের দুনিয়া অসহায়।পুরো বাড়িজুড়ে তোর ছায়া লেগে আছে।বাড়ির প্রতিটা আঙিনা তোর শূন্যতা জানান দিচ্ছে।আম্মু,আব্বু, নিসা সবার উপস্থিতিও আাড়িকে মাতিয়ে রাখতে পারছে না।থমকে গিয়েছে সব।প্লিজ সচল করে দে সেগুলো।আমার কষ্টা কমিয়ে দে এরিন।প্রত্যেকটা রাত নির্ঘুম কাটে আমার।তোকে ছাড়া মাথায় কিছু ঢুকে না।আমার পড়াশোনা হচ্ছে না।ডিপার্টমেন্ট টপার আমিও এই সেমিস্টারে ফেইল করেছি।আমি আর এই কষ্ট নিতে পারছি না।প্লিজ ফিরে চল তুই।আমাকে ক্ষমা কর প্লিজ।..”
আমার কানে বাজতে লাগল,
“তুই দুশ্চরিত্রা মেয়ে।আমার অযোগ্য তুই।আমি ইন্টেলিজেন্ট,ডিসেন্ট ও ব্রাইট ফিউচারের একটা ছেলে।আর তুই পুরোই তার বিপরীত।নিজের থাকার জায়গা পর্যন্ত নেই।আমার জীবনে তের ছায়াও যেন না দেখি।”
চোখে ভাসছিলো বধুবেশে এক রমনীর এর ওর পায়ে পড়ে আকুতি মিনতি করার দৃশ্য।নিশ্চিত সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে হাস্যজ্জল ফুলটির হটাৎ ব্যর্থতার কষ্ট।গগন বিদারী আর্তনাদে অনুনয় করছিলাম আমি।বার বার বোঝাতে চাচ্ছিলাম আমাকে ভুল বুঝছে সবাই।উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম কষ্টে।আমার আহাজারি কেউ দেখেনি।যে মেয়েটির মাথার চুল অবধি কেউ দেখেনি সেই মেয়েটির মাথায় কাপড় নেই সে খেয়ালই ছিলো না।হ্যা এমন পরিস্থিতির জন্যই প্রথম পর পুরুষ আমার চুল দেখেছিলো।কেউ সাহায্য করেনি আমাকে।বরং দুর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো।ভীষন কেদেছিলাম আমি।সেটাই জীবনের শেষ কান্না ছিলো আমার।আম্মু,মামি ও নিসা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে ছিলো।তারাও সাহায্য করেনি।মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে যাচ্ছিলো।কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সচল মস্তিষ্ক বলল,
সবকিছুর পরও ওরা তোকে বড় করেছে।নিশান সর্বোচ্চ ভালোবেসেছে তোকে।নিজের চেয়েও বেশি তোর সুবিধার কথা মাথায় রেখেছে।ভালোবাসার ব্যক্তির পাশে অন্য ব্যক্তিকে সহ্য করা কঠিন।সেও পারেনি।রেগে গিয়েছিল সে।তাই অমন আচরণ করেছে।এটা মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসার ফল।ক্ষমা করে দিলাম নিয়ান ভাইকে।কিন্তু তার জীবনের সাথে নিজের জীবন জড়ালাম না।বৈবাহিক সম্পর্কে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি ভরসা, সম্মান ও বিশ্বাস থাকা জরুরি।তাছাড়া হাজার ভালোবাসার পরও সংসারে সুখ শান্তি থাকে না।নিশান ভাই আমাকে যতটা ভালোবাসে আমিও ঠিক ততটাই বাসি।তাকে কাছে পেতে মন প্রান ব্যকুল আমার।তবুও একে অপরের পাশে থেকে অসম্মানজনক সম্পর্কের চেয়ে দুরত্ব বজায় রেখে সম্মান ধরে রাখা শ্রেয়।যেন হাজার বছর পর দেখা হলেও শ্রদ্ধাটা বিরাজ করে।বদমেজাজি উনি।রেগে গেলে মাথা ঠিক থাকে না।যে ফুলে কীটের বাস সে ফুল প্রিয় হলেও তার সংস্পর্শ ভয়াবহ।দুর থেকে দেখেই চোখ শীতল করতে হয়।নিশান ভাই অনেক কান্না করলেন।আকুতি মিনতি করলেন।মন গলল আমার।কিন্তু সম্মান রক্ষার্থে ফিরে গেলাম না তার সাথে।তিনিই তো শিখিয়েছেন নিজের সম্মানটা নিজের রক্ষা করতে হয়।যাওয়ার সময় তিনি বললেন,
“আমি তোকে চাইতে আবারও আসব।ছোট থেকে তোকে নিজের ভেবে এসেছি।তোর দাবি সারাজীবন থাকবে।পরকালেও তোর দাবি ছাড়ব না আমি।যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।নিজের ক্যারিয়ার গড়তে সর্বোচ্চ চেষ্টা করিস।”
আমিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স হয়নি আমার।অনার্সে ন্যাশনালে ভর্তি হই আমি।নিশান ভাই চলে গিয়েছিলো সেদিন।তারপর আর আসেনি।আসলেও জানি না।আব্বু আমার সৎ মায়ের সুখের জন্য সব করতেন।ওনার ইচ্ছায় আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেন।হাত খরচটাও বন্ধ করে দেন।নেশা করার অভ্যেস ছিলো ওনার।নেশার টাকা যোগাতে বাড়ি,ভিটা সব বিক্রি করে দেওলিয়া হয়ে যান।পুরাতন সিম বন্ধ করে দিয়েছেন সৎ মা।যেন আমার সাথে যোগাযোগ না চলে।অনেকের কাছে ঋন ছিলো যেগুলো পরিশোধ করতে পারছেন না।ছোটখাটো সরকারী চাকরীর বেতন দিয়ে বাসা ভাড়া করে নিজেদের খাওয়া পড়া চালাচ্ছেন।আমি টিউশনি করে নিজের লেখাপড়া চালিয়েছি।অনেক সংগ্রামের জীবন ছিলো আমার।যখন কেউ পাশে থাকেনি।নিশান ভাইয়ের কথাটা বার বার মনে হত।সত্যিই বলতেন তিনি।মানুষ একা।মাঝে মাঝে সাহায্যের হাত বাড়ালেও সবসময় পাশে কেউ থাকে না।নিজের বিপদ থেকে নিজেকেই মুক্ত হতে হয়।কথাগুলোর গভীরতা বার বার পর্যবেক্ষণ করেছি আমি।জীবনটা মোটেও অনুকূলপ ছিলো না।
কি একটা ভেবে নিসার মেসেজটা সিন করলাম।মামিকে মনে পড়ে ভীষণ।তার হটাৎ করে পরিবর্তন,রোগা শরীর সব কিছু মনে পরত।একটু খোজ নেওয়া যাক।মেসেজটি দেখে কেঁপে উঠল আমার অন্তরআত্মা।অনেক সাংবাদিক,বন্ধু বান্ধব সবাইকে উপেক্ষা করে দ্রুত চললাম সেই চিরচেনা বাড়ি উদ্দেশ্যে।
________
স্নেহের এরিন,
জানিনা কখনো এই লেখাটা তুই পড়তে পারবি কিনা।যদি কখনো পড়িস এই ভেবে লিখে যাচ্ছি।আমি অনেক অন্যায় করেছি তোর সাথে।অনেক বাজে পরিকল্পনা করেছি তোর জীবন নিয়ে।কিন্তু প্রতিবারই ভেস্তে যেত সব।হয় নিশান আসতো না হয় অন্য কোন ভাবে।নিসা তোর মামা সবাই আমার সাপোর্ট এ থাকার পরও কিভাবে এমন হত বুঝতে পারতাম না।নিশানই বা সব খবর পায় কি করে তাও বুঝতাম না।কিন্তু এক সময় সব পরিষ্কার হয়ে যায় আমার সামনে।রক্তের একটা টান থাকে জানিস তো।
তোর মামা,নিসা তোকে নিশানের মতোই খুব ভালোবাসে।নিশানকে ওরাই খোজ দিত।আমার পরিকল্পনা অপ্রকাশ্য ভাবে ওরাই ভেস্তে দিতো।যখন এসব বুঝলাম তখন ওদের প্রতি ভীষণ রাগ হওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু আমি রাগতে পারিনি।কারন তার আগেই জানতে পারি আমি ক্যান্সার আক্রান্ত।আমার নিশান তোকে খুব ভালোবাসে।আর নিসাও তোর কাছে আদরে থাকবে।এটা ভেবেই বিয়ে ঠিক করি তোদের।মায়ের মন বুঝিসই।দুনিয়া ত্যাগের আগে সন্তানদের একটা স্থায়ী ভবিষ্যৎ দেখে যেতে চেয়েছিলাম।তোদের বিয়েটা ভেঙে গেল।আমি জানতাম তুই নিষ্পাপ।কিন্তু কিছু করতে পারিনি সেদিন।তুই চলে গেলি।বিষাদ নেমে এলো আমার সংসারে।নিসার বিয়ে দিয়ে দিলাম।ছেলে ভালো।বিয়ের পরই ওকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেছে।কিন্তু আমার নিশানের কোন গতি করতে পারলাম না।ও তোকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না।পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে ও।হাজার বুঝিয়েও আর ঢাকা যায়নি।সারাদিন তোর শিউলি গাছের নিচে বসে থাকত।ঠিকঠাক খেত না।আমার পরিপাটি ছেলেটাও কেমন উষ্কখুষ্ক হয়ে গেছিলো।চেহারার দিকে তাকানো যেত না ওর।ভাবলাম তোর কাছে গিয়ে নিজে পায়ে পড়ব।কিন্তু তার আগেই ঘটল বিপত্তি।নিশানকে কারা যেন রাস্তায় মেরে ফেলে রেখে গেছিলো।হাসপাতালে ভর্তি করলাম।প্রতিটা আঘাত মাথায় লাগায় জীবন নিয়ে আশংকা ছিলো।চিকিৎসা করতে প্রচুর টাকার দরকার।আমার শাশুড়ীর জমানো স্বর্নমুদ্রাসহ কয়েক বিঘা জমি বিক্রি করে দিলাম।নিজের চিকিৎসার টাকা দিয়ে ছেলেকে চিকিৎসা করলাম।পুলিশ ধরে ফেলল সেই আক্রমণকারীদের।বেরিয়ে এল সব সত্য।টাকার বিনিময়ে যাদের কাছে তোকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম সে বিয়ে ভেঙে দেওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ ছিলো।তাদের সম্মান নিয়ে কথা বলায় তোর সম্মান নষ্ট করতে চেয়েছিলো।কিন্তু এক্সিডেন্ট হল তোর।তোকে যে ছেলে হসপিটালাইজ করেছিলো তার প্রচুর টাকার দরকার ছিলো।বাবা অসুস্থ।বেকার অবস্থায় বিয়ে করেছে।একটা চাকরির দরকার।ঘুষ ছাড়া এ যুগে চাকরি পাওয়া কঠিন।সেই ঘুষের টাকার বিনিময়ে তোর সাথে কয়েকটা ছবি তুলে দেওয়ার আবদার করা হল।গ্রামে আমাদের বদনাম রটাতেই ওই বুদ্ধি আটে তারা।সফলও হল ভালোভাবেই।আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশে গেলো।কিছুদিন পরই আল্লাহ সদয় হলেন।সেই ছেলে এসে সব স্বীকার করল।গ্রামে ছি ছি ধ্বনি উঠল।আমার ছেলে তোর কাছে গেলে তুই ফিরিয়ে দিলি।ও কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।কিন্তু দমে যায় নি সেই হায়েনার দল।নিশান ওদের সাথে বেয়াদবি করায় নিশানকে সড়িয়ে দিতে চাইল।আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়েছে আমার ছেলে।কিন্তু তোর বা তোর পরিবারের কোন খোঁজ পাচ্ছি না।ফোনও বন্ধ।দিশেহারা হয়ে গেলাম আমরা।শোন এরিন, যদি কখনো এই লেখা দেখিস আমার ছেলে মেয়েকে ভালো রাখিস।এই সংসারের সবকিছু তোর জানা।আমার ছেলের পছন্দ অপছন্দ সব জানা।তুই সব ভালোভাবেই সামলাতে পারবি।আমি জানি না এসব কেন লিখছি।আমি হয়তো আর বেশি দিন দুনিয়ার বুকে থাকব না।মনে হল এসব তোর জানা দরকার।তোর জীবনের সাথে জড়িত।আমাকে ক্ষমা করিস এরিন।আমি আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ইহজগৎ এই পেয়ে যাচ্ছি।পরকালে আমাকে আর আটকাস না।ভালো থাকিস।আমার দোয়া তোদের প্রতি সবসময় থাকবে।
ইতি
তোর মামি
চোখের কার্নিশ ভিজে গেল আমার।পাঁচ বছর পর আবারও আবেগি হলাম আমি।নিসা,মামা সবাই ভালো মানুষ ছিলেন।বুঝতে পারিনি আমি।মামির মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আসলেই একটা ভুল সিদ্ধান্ত মানুষের সাজানো জীবন পাল্টে দিতে পারে।মামি গত হয়েছেন তিন বছর হল।মামা অথর্ব হয়ে গেছেন।আমার দিকে একজোড়া স্বর্নের বালা দিয়ে বললেন,
“এটা তোর মামি তোকে দিতে বলে গেছে।অবশিষ্ট বলতে কানের দুল আর এই বালাই রেখেছিলো।কানের দুলটা নিসাকে দিয়েছে।আর এই বালা তোর জন্য রেখে গেছে।এটা তুই নিলেই আমি দ্বায়মুক্ত।”
চোখের পানি মুছে প্রশ্ন করলাম,
“নিশান ভাই কোথায় মামা?”
“শিউলি তলায়।”
দৌড়ে গেলাম দক্ষিণ পাশে।শিউলি গাছের চারিদিকে টিন দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন তিনি।একটি ফলক ঝুলানো সামনে।তাতে লেখা,
“এটা এরিনের গাছ।দয়া করে এই গাছের ফুল পাতা কেউ কুড়াবেন না।ও ভীষন রাগ করবে জানলে।”
ভিতরে ফুল,পাতা পড়ে স্তুপ হয়ে আছে।নিচের পচা অংশ ভ্যাবসা গন্ধ ছড়াচ্ছে।টিনের বাহিরে মাটিতে বসে রয়েছেন নিশান ভাই।ওনাকে দেখে শিউরে উঠলাম আমি।একি অবস্থা ওনার!যেই মানুষটার পোষাকে একটু ময়লা লাগতে দিতো না।শুচিবায়ু প্রকৃতির ছিলো।সে কিনা মাটিতে বসে।সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তিটিও এখন জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেছে।ফর্সা চামড়া ময়লা হয়ে গেছে।চেহার সৌন্দর্যে পূর্ণ ভাটা পরেছে।আমাকে দেখে চোখের মনি ছোট করে ফেললেন তিনি।হয়তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না।আমি কাছে যেতেই ধরফরিয়ে উঠতে নিলেন।দূর্বল শরীরে পড়ে গেলেন তিনি।আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম।উনি আকড়ে ধরলেন আমার হাত।উচ্ছ্বাসে কাপছেন তিনি।নিজে নিজেই বিরবির করছেন,
“কেন এমন করিস এরিন?ফিরবিই না যখন।কল্পনা থেকে মুছে যাস না কেন?আমার অপরাধ কি এতোটাই বেশি যে লোক সমাজে অস্বাভাবিক প্রমান করতে চাস?তাহলে তুই সাকসেস।দেখ আমি স্পষ্ট অনুভব করছি তোর হাতের উষ্ণতা।দুনিয়ার স্বাভাবিক সব বুঝতে পারলেও তোর উপস্থিতি অস্বাভাবিক এটা এখনো বুঝি না আমি।”
চোখের পানি ছেড়ে দিলাম আমি।সব বাধা অমান্য করে জাপটে ধরলাম তাকে।মানুষটার এমন পরিবর্তন নিতে পারছি না কোন ক্রমেই।হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।
“আমি কল্পনা না নিশান ভাই।আমি সত্যিই এসেছি।আপনার এরিন হয়ে।”
হেসে দিলেন তিনি।
“একটু পরই তো হারিয়ে যাবি।আমার মাথা ব্যা’থা করছে এরিন।তুই চলে যা এখন।আর থাকিস না।যাহ চলে যা।মানুষ আমাকে মজনু বলবে।তুই তো লায়লা না।…কেউ আসে না কেন?আব্বু ও আব্বু।”
চিৎকার করতে থাকেন নিশান ভাই।দৌড়ে আসেন মামা।চোখের পানি ফেলছেন তিনি।নিশান ভাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“বাবা এই যে আমি।এরিন সত্যি এসেছে আব্বা।”
নিশান ভাই তাও বিশ্বাস করছেন না।অস্বাভাবিক আচরন করছেন।বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলে তিনি বুঝতে পারলেন আমার উপস্থিতি সত্যি।আমিও বেশি বেশি কথা বলে তাকে বুঝালাম আমি সত্যি।শান্ত হলেন তিনি।তাকে নিয়ে এলাম বাড়ির ভিতর।নিশান ভাই সবসময় শিউলি তলায় থাকেন যেন কেউ লুকিয়ে ফুল না কুড়ায়।বুঝলাম সে পুরোটা স্বাভাবিক নেই।ডাক্তার দেখানো দরকার।
_______
“দ্যাখেন তো কেমন লাগছে আমাকে?লাইভ প্রোগ্রামে যাব বলে কথা।”
“মাশআল্লাহ আমার বউকে অনেক সুন্দর লাগছে।”
“কই আপনি তো দেখলেনই না?এখন আর দেখতে ইচ্ছে করে না তাই না?”
“তোমাকে সারাজীবন দেখলেও দেখার আকাঙ্খা কোনদিন শেষ হবে না।কিন্তু একটা জায়গায় যাওয়ার আগে এভাবে দেখতে বলো না এরিন।পরে আর যাওয়া হবে না।তখন আবার আমাকে দোষ দিতে পারবে না কিন্তু।দেখব এইবার?”
ঠোটে দুষ্টুমির রেখা ঝুলিয়ে বললেন নিশান।আড়ষ্ঠ হয়ে চলে এলাম আমি।সে এখন পুর্ন সুস্থ একটা মানুষ।হালকা চিকিৎসার পাশাপাশি প্রচুর সময় দিতে হয়েছে ওনাকে।সুস্থ হলে বিয়ে করি আমরা।বর্তমানে একটা ছোট ব্যবসা শুরু করেছে।এতিম বাচ্চাদের জন্য একটা এতিমখানা দিয়েছি আমরা।অনেক বাচ্চার সমাগম সেখানে।তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করেছি।নিজেদের টাকায় কুলানো সম্ভব নয় বলে বিভিন্ন ফান্ড কালেক্ট করেছি।সে উপলক্ষেই একটা লাইভ প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছে।প্রোগ্রামের শেষের দিকে হোস্ট হাস্যজ্জল মুখে প্রশ্ন করলেন,
“আপনার পারসোনাল লাইফ সম্পর্কে বরাবরই এড়িয়ে যান আপনি।কিন্তু তারপরও কৌতুহলের কমতি নেই।নিজের পজিশনের চেয়ে নিচু অবস্থানের কাউকে কেন বিয়ে করলেন?”
আমি স্মিত হেসে বললাম,
“শুধুমাত্র পজিশন দিয়ে কি বিয়ের সম্পর্ক হওয়া উচিত?আর পজিশন বলতে আপনারা কি বুঝান আমার জানা নেই।আমার দিক থেকে সে আমার পজিশনেরই।বা তার চেয়েও উপরের কেউ।”
দর্শকের মাঝে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কমেন্ট আসতে লাগল।”গাঞ্জা খেয়েছেন নাকি?”.. এমন কাউকে বিয়ে করলে ব্রেনের এমন অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক। ইত্যাদি ইত্যাদি।প্রতিউত্তরে একটা ছোট বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রোগ্রাম শেষ করে ফেললাম।
“দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে বিয়ে সাদীর ব্যাপারে প্রায় মানুষই গাঞ্জা খেয়ে থাকে।তারা সোস্যাল স্ট্যাটাস, ক্যারিয়ার এসব প্রাধান্য দিয়ে থাকে।ফলাফল কি হয়?বর্তমান সমাজে বিচ্ছেদ বৃদ্ধির মুল কারনই হল এই পজিশন দেখে বিয়ে দেওয়া।আর বিচ্ছেদ না হলেও ম্যাক্সিমাম মানুষ সমাজের কথা ভেবে মনের বিরুদ্ধে লোক দেখানো সংসার করে।এটা কি আদোও সংসার হয়?যদি মানসিক প্রশান্তিই না পান পজিশন দেখে কি হবে?
পজিশনের দিকটা যদি দেখতেই হয় তাহলে ক্যারিয়ার না,মেন্টালিটির পজিশনটা দেখা উচিৎ।যদি উভয়ের মানসিকতা একই হয় তাহলেই তারা সুখী।মানুষটা ভালো হইতেই হবে তা বলছি না।যেমন একটা নেশা খোর মেয়ে একটা নেশা খোর ছেলের সাথে ইজিলি মানিয়ে নিতে পারবে।কিন্তু একটা ধার্মিক বা ঘরোয়া মেয়ে কখনোই এসব মেনে নিবে না।সে অবশ্যই বাধা দিবে।তখনই শুরু হবে ঝামেলা।একইভাবে একটা ধার্মিক ছেলের কোন আধুনিক মেয়ের সাথে বিয়ে হলেও কিন্তু কেউ মানিয়ে নিতে পারবে না।সেম প্রফেশনের হলেও মানসিকতা যদি সেম না হয় তাহলে কখনোই কেউ সুখী হতে পারবে না।তাই আমার মতে পজিশন বলতে মানসিক পজিশন দেখা উচিত।কিন্তু আমাদের নোংরা সমাজ ব্যবস্থা কখনোই তা করবে না।তারা সংসারে ঝামেলা হলে বলবে বাচ্চা নেও সব ঠিক হয়ে যাবে।ম্যাক্সিমাম মানুষই সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনতে বাচ্চা নেয়।আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই একটা বাচ্চা কি আপনাদের সংসারের দীর্ঘস্থায়ী শান্তির কারন হয়েছে?একটা বাচ্চা কি কখনো কারো ক্যারেকটার চেঞ্জ করেছে?নাকি কাউকে নেশা মুক্ত করেছে?একটা বাচ্চা কখনোই এসবের সমাধান হতে পারে না।তাই যদি হত তাহলে সংসারে সন্তান থাকার পর বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটত না।কাকতাড়ুয়া চেনেন না?মানুষ পাখি তাড়াতে শস্য খেতে কাকতাড়ুয়া পুঁতে রাখে।হয়তো কিছুদিন পাখি ভয়ও পায়।কিন্তু কিছুদিন পর কাকতাড়ুয়া হয়ে ওঠে পাখির বসার জায়গা।তেমনি আপনারা যেই দুঃখ তাড়াতে সন্তান নেন বাই এনি চান্স বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সেই দুঃখ এসে ভর করে আপনাদের নেয়া সন্তানের উপর।তাদের বাকি জীবন বিষিয়ে ওঠে।আচ্ছা যদি কখনো আপনাদের সন্তান বড় হয়ে জিজ্ঞেস করে তাদের দোষটা কি ছিলো?তারা কেন বাবা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হল কি উত্তর দিবেন?নিজেদের চিন্তার পরিধি পাল্টান।আপনাদের এইসব ধরা বাঁধা নিয়মের জন্যই সমাজে হাজারো কাকতাড়ুয়ার জন্ম হয়।তাদের কেউ সংগ্রাম করে আমার মতো প্রতিষ্ঠিত এরিন হয় আমার কেউ ঝরে পরে।তারা যেন এরিন হতে পারে সে জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।বর্তমানে পাবলিক ফিগার হলেও আমিও যে একজন কাকতাড়ুয়া।
সমাপ্ত
(