কাকতাড়ুয়া পর্ব -০৯

#কাকতাড়ুয়া
#পর্ব_৯
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা
_____–
হন্যে হয়ে চালাচ্ছি এক রিং বিশিষ্ট একটি চাবির খোঁজ।চাবিটা একটা পুরাতন সিন্ধুকের।যাবতীয় দামী সম্পদ জমানো রয়েছে তাতে।সেখানে স্থান পেয়েছে আমার মায়ের প্রথম বিয়ের গহনা।দাদু এবং নানুর মিলিত টাকায় মোটে তিন ভড়ি স্বর্নের গহনা দেওয়া হয়েছিলো আম্মুকে।আব্বু আম্মুর বিচ্ছেদের সময় সেগুলো আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।যেহেতু নানু বাড়ি থাকি তাই নানির কাছে জমা করে রাখা হয়েছিল।এতোদিন গহনার প্রয়োজন পড়েনি।আজ সেগুলো পড়ব বলে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।কিন্তু চাবি না পাওয়ায় ঘটেছে বিপত্তি।চাবিটা নানির কোমড়ে থাকত সবসময়।তার দুনিয়া ত্যাগের পরে চাবির খোঁজ কেউ চালায়নি।হয়তো মস্তিষ্কেও কাজ করেনি কারো।অনেক খোঁজ চালিয়েও না পেয়ে অগত্যা আকাশকে ডাকতে গেলাম তালা ভেঙে দিতে।হটাৎ সামনে পড়ল নিশান ভাই।অপ্রস্তুত হলাম আমি।এতোদিন ওনার সান্নিধ্য সাচ্ছন্দপূর্ণ হলেও আজ ভীষন অসস্তি হচ্ছে আমার।ভুল বললাম।শুধু আজকে না।যেদিন থেকে নিজের বিয়ের কথা পাকা হল সেদিন থেকেই এমন অনুভুত হয়।আড়ম্বরপূর্ন বিয়ের আয়োজন না হলেও ক্ষুদ্র লোকসমাগমেই ভরে গেছে বাড়ি।তাদের আপ্যায়নের আয়োজন করতে ব্যস্ত বাড়ির সবাই।নিশান ভাইও তার জায়গা থেকে যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছেন।আমাকে দেখে একটা শুষ্ক কাশি দিয়ে বললেন,

“এমন হন্যে হয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”

“আকাশকে ডাকতে।তালা ভাঙতে হবে।”

“চাবি পেলি না?”

“সর্বত্র খুজেছি।কোথাও নেই।”

“আচ্ছা চল আমি ভেঙে দেই।আকাশ ছোট মানুষ।ও পাড়বে না।”

আকাশের বয়স বারো বছর।বয়স অল্প হলেও প্রচুর গাম্ভীর্যপুর্ন সে।কথার মাঝে গভীরতাও প্রচুর।যা এতো অল্প বয়সেই রপ্ত করেছে সে।সবাই বলে ও নাকি ওর বাবার মতো হয়েছে।সব সময় বাবার কাছে থাকে বলেই হয়ত বাবার গুন রপ্ত করা ওর।আম্মুর বিয়ের পরের বছরেই ওর জন্ম।সে হিসেবে তেরো বছর হল এই গহনা বাক্স বন্দি হয়ে আছে।নিশান ভাইয়ের হাতে একটা লোহার রড।যার তৃতীয়তম আঘাতে ভেঙে গেলো মরিচা ধরা ছোট্ট তালা।সিন্দুক খুলে দেখতে পেলাম অনেক গুলো স্বর্ন মুদ্রা।লাইটের আলোয় ঝকঝক করছে সেগুলো।জীবনের প্রথম স্বর্ন মুদ্রা দেখার সৌভাগ্য হল আমার।তার উপরেই পরে রয়েছে আমার গহনার বাক্স।নিশান ভাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন।

“তুই এই মুদ্রার ব্যপারে কিছু জানতি?”

মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালাম আমি।কিছু একটা ভেবে নতুন একটা ছোট তালা লাগিয়ে সিন্দুকটা আগের জায়গায়ই রেখে দিলেন নিশান ভাই।আমাকে গহনাগুলো নিয়ে আম্মুর কাছে জমা দিতে বললেন।কথা বলি না আমি আম্মুর সাথে জানেন তিনি।তবুও এইটা ওইটা আম্মুর কাছে পাঠিয়ে দেন আমার দ্বারা।হয়তো মুখ ফুটে না বললেও সে সুবাদে একটু কথা বলি আম্মুর সাথে এটা তিনিও চান।কিন্তু কাজটা সম্পন্ন করলেও আম্মুর সাথে কখলোই কথা বলি না আমি।মাথা নিচু করে গহনা নিয়ে আম্মুর কাছে জমা দিলাম।

__________
আম্মু,মামি,নিসা সবাই কাজে ব্যস্ত।তিনজন মিলেও রান্নার কাজ সামলাতে পারছেন না তারা।আমি সাহায্য করতে গেলেও বাধা দেওয়া হচ্ছে আমাকে।বিয়ের দিন নাকি মেয়েদের কাজ করতে নেই।এ নিয়ম কোথা থেকে আবিষ্কার করেছে তারা জানা নেই।এখনো মাটির বাড়ি আমাদের।দক্ষিণ দিকের ঘরে জানালার পাশে বসে সবার কার্যক্রম দেখছি।হটাৎ দেখলাম মামি এক জগ পানি আনতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছেন।দৌড়ে গিয়ে পানির জগটা হাতে নিলাম আমি।মামি আবারও চোখ রাঙিয়ে বললেন,

“তোকে না বলেছি এরিন বিয়ের দিন কোন কাজ করবি না।”

“আপনারা তো সামলে উঠতে পারছেন না মামি।আমি সাহায্য করলে কি এমন হবে?”

“অনেক কিছু হবে।লোকে বলবে বিয়ের জন্য তুই উতলা হয়ে গেছিস।তাই নিজের বিয়েতে নিজেই কাজ করছিস।এটা শুনতে না চাইলে জগটা দে এবার।”

মামির কথায় আড়ষ্ট হলাম আমি।মামি জগটা নিয়ে চলে গেলেন।যাত্রাপথে দুইবার বসে বিশ্রাম নিলেন।
মামির মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি ইদানীং।শরীরটা রোগা হয়ে গেছে অনেক।চেহারার উজ্জলতা নেই বললেই চলে।প্রায় সময়ই চিন্তাক্লিষ্ট থাকেন।তার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে বুকটা ধক করে উঠলো আমার।কি সুন্দর চেহারা ছিলো ওনার।এখন চোখের নিচে কালি জমে গেছে।কতরাত মানুষটা ঠিকভাবে ঘুমায় না কে জানে।আচ্ছা কি হয়েছে ওনার?একদিন সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করতে হবে।তার চেহারার পাশাপাশি ব্যবহারেও বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।তাকে যতই দেখছি অবাক হচ্ছি আমি।সেদিন বাড়ি ফেরার পর গ্রামের কয়েকজন লোক নিয়ে লিমন ভাই বিভিন্ন নোংরা মন্তব্য ছুড়ে দিতে এসেছিলো।লিমন ছেলেটা আমাকে ছোট থেকেই সুযোগ পেলে রাস্তা ঘাটে উত্যক্ত করত।অনেক বার নিষেধ করেছিলেন মামা।কোনবারই পরোয়া করেনি।অতিষ্ট হয়ে মামা বিচার দিয়েছিলেন গ্রাম্য চেয়ারম্যানের কাছে।বিচার শেষে আড়ালে আমাকে হুমকি দিয়েছিলো সে।তখন থেকেই ভয়ে থাকতাম আমি।স্কুলে যাইনি অনেকদিন।তখন নানু রেগুলার আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন আবার স্কুল থেকে নিয়ে আসতেন।তারপরই তো হটাৎ একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সড়ক দূর্ঘটনায় নানু প্রান হারালেন।একটা চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে গিয়েছিলেন তিনি।আমি দুরে দাড়িয়ে থাকায় অক্ষতই ছিলাম।সব দোষ চাপানো হল আমার ঘাড়ে।সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেন নানী ও নিশান ভাই বাদে।নানী নানুর শোকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে গেলেন।দুই বছর পেরুতেই তিনিও পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।আমার কষ্টের জীবনে সংগ্রাম যুক্ত হল।লিমন ভাই আমাকে আবার উত্যক্ত শুরু করল।মামা আর এর প্রতিবাদ করেনি।নিশান ভাই ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন এস এস সি পাস করেই।গ্রামবাসী যেচে এর বিচার করলেন।দমে গেলেন তিনি।কবে আমাকে এর জবাব দিতে পারেন বসে বসে এই ছক আকছিলেন।সুযোগও পেয়ে গেলেন এখন।তাই আমার নামে কুৎসা রটিয়ে লোক জড়ো করলেন তিনি।তাদের কাউকেই পাত্তা দেন নি মামি।বরং সমুচিত জবাব দেন এবং আমার এক্সিডেন্টের কথা জানিয়ে দেন। মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে এবং কোন প্রমান না পেয়ে গ্রামবাসী বিশ্বাসও করে নেয়।যেই মানুষটা নিশান ভায়িয়ের সান্নিধ্যে আমাকে সহ্য করতে পারতেন না।ঠিক সেই মানুষটাই নিজে আব্বু আম্মুর কাছে আমাকে নিশান ভাইয়ের বউ হিসেবে দাবী করলেন।হ্যাঁ ব্যপারটা অবাক করার মতো হলেও সত্যি।তিনি নিজে আমাকে পুত্রবধূ রুপে দেখতে চেয়েছেন।যেদিন ওই চিরকুটটা হাতে পেলেন ঠিক সেদিন থেকেই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার নিরাপত্তা নিয়ে।সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের বিয়ে দিতে।সেদিন রাতেই আব্বু আম্মুকে ফোনে তলব করলেন আসতে।অন্যান্য সময়ে না আসলেও আব্বু এসেছিলো সেদিন।প্রায় বারো বছর পর তার দেখা পাই আমি।অভিমানের মেঘ জমিয়ে কথা বলিনি।তবে খুব ইচ্ছে ছিলো আব্বু আম্মু একে অপরের মুখোমুখি হলে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় দেখার।

একসময় একে অপরের সবচেয়ে নিকটতম মানুষ ছিলো তারা।দুজনের মাঝে গোপনীয় কিছু ছিলো না।হাজারো সুখ,দুঃখের সাথী ছিলেন একসময়।এতগুলো বছর পর আবারও দেখা হয়ে কি একবারও সেসব স্মৃতি হয়ে জেগে উঠবে না?আচ্ছা তাদের কি পুরাতন স্মৃতি অন্য সময়ও কখনো জাগে না?কে জানে জাগে হয়ত।পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ আলাদা।তাদের সবার মাঝেই কিছু বিশেষ গুনাবলি থাকে।হয়ত কখনো জীবনসঙ্গীর দ্বারা কষ্ট পেলে তাদের বর্তমান পার্টনার এর সাথে আগের পার্টনারকে মিলিয়ে নেয়।ক্ষনস্থায়ী সময়ের জন্য মষ্তিস্ক জানায় আগেরজন এই বিষয়ে বেটার ছিলো।পরবর্তীতে সব মুছে ফেলে বর্তমানকে আকড়ে ধরে বাঁচে।আব্বু আম্মুর মুখের অভিব্যক্তি জানান দিচ্ছে তাদের ভীষন অসস্তি হচ্ছে।একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার উপর থেকে যখন সকল অধিকার ছিন্ন হয় সেই বিচ্ছেদের সময়ের অনুভুতির চেয়েও বহুদিন পর হটাৎ মুখোমুখি হওয়াটা বেশি বেদনাদায়ক।তাদের আশেপাশে অবস্থান করে এটাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।মামা-মামির আগমন হয়।মামিই বিয়ের প্রস্তাবটা উপস্থাপন করেন।ভীষন অবাক হয়েছিলাম আমি।নিজের হাতেই চিমটি কেটে পরীক্ষা করছিলাম এটা দিবা স্বপ্ন নয় তো?নাহ স্বপ্ন নয় বাস্তব ছিলো ওটা।প্রতিউত্তরে আব্বু ইতস্তত করে বলে,

“আপনারাই ওকে পেলে পুষে বড় করেছেন।ওর প্রতি আমাদের চেয়ে আপনাদের অধিকার বেশি।বিয়েটা ওর।তাই ওর মতামতের গুরুত্ব বেশি।নিশান ও ওর যদি অমত না থাকে তো আপনাদের যা ভালো মনে হয় তাই করবেন।আমার আপত্তি করার কিছু নেই।”

জীবনে একসাথে চলাকালীন আম্মু আব্বুর নেওয়া প্রতিটা সিদ্ধান্তঃ বিপরীত হলেও এই একটা সিদ্ধান্তে একমত পোষন করেন তারা।আমাকে জিজ্ঞেস করলে আড়ষ্ট হই আমি।জীবনের প্রথম আবেগ,
ভালোলাগা থেকে ধীরে ধীরে ভালোবাসা যাকে ঘিরে তাকে কি আর অস্বীকার করব?তাকে পাওয়ার প্রস্তাব তো আমার জন্য আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।লজ্জা পেয়ে কোনোমতো পালিয়ে এসেছিলাম সেদিন।তারা বুঝে নিয়েছিলো আমার অভিমত।বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করা হলো।দ্রুত সময়েই বিবাহের কার্য সমাপ্তি দিতে চেয়েছিলেন মামি।কিন্তু আমার শরীরের অবস্থা বিচারে এক মাস পর বিয়ের ডেট ফিক্স করা হয়।অতঃপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত আজকের দিন।

_______
“তোকে যা লাগছে না এরিন!ভাইয়া এমনিতেই তোর প্রতি ফিদা।আজকে তো নিজের মাঝে থাকতেই পারবে না।”

খোঁপায় ফুল গুঁজতে গুঁজতে বলল নিসা।মেয়েটাকে আমি বুঝে উঠতে পারি না।একদম মামির স্বভাবের সে।মামি যখন আমার সাথে যেমন আচরণ দেয় নিসাও ঠিক তেমন আচরণ দেয়।মামি এখন আমার অনুকুলে রয়েছে।সেও বান্ধবীর মতো আমার সাথে দিব্যি হারে মজা নিচ্ছে।নিশ্চুপ রইলাম আমি।সে আবারও বলল,

“জানিস এরিন তোকে তো আমার হিংসা হচ্ছে।মনে হচ্ছে কেন এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম।আমার হিংসুটে মন তোর সাজটা বিকৃত করে দিতে ইচ্ছে করছে।”

বলেই হা হা করে হাসল সে।ডাগড় চোখদুটো গোল গোল করে তাকালাম আমি।বলে কি মেয়ে।

“মাথা ঠিক আছে তো তোর?আমি কি তোর সতীন যে আমার সৌন্দর্যে হিংসা হবে?বরং প্রাউড ফিল কর।তোর ভাইয়ের বউ সুন্দরী এইটা বলতে পারবি।”

“সতীন হওয়া লাগে না।মেয়েরা অন্য মেয়েকে নিজের চেয়ে সুন্দর দেখলে জেলাস হয়।এটা স্বাভাবিক ভাবেই আসে।প্রত্যেকটা মেয়েই নিজেকে সেরা সৌন্দর্যের অধিকারী দেখতে চায়।”

কিছু সময় নিশ্চুপ রইলাম উভয়ে।ভাবলাম কথা মন্দ বলেনি।এটা সব মেয়েরই সুপ্ত বাসনা।অনেক সুন্দর মেয়েও অন্যের সৌন্দর্যে হিংসা করে।যেমন নিসা এখন বলছে।সেও যথেষ্ট সুন্দরী।আমার কোন অংশে কম নয়।নিরাবতা ভেঙে এক চোখ টিপ দিয়ে নিসা বলল,

“যাই বলিস আমার মাথা সত্যিই গেছে।ভাইয়ার যে কি হবে তাই ভাবছি।দেখিস তোর বেশি লোড পড়ে যায় না আবার।”

বলেই উচ্চশব্দে হাসল নিসা।কন্ঠে ওর স্পষ্ট বদমাইশি।গ্রামে পার্লার না থাকায় সাজানোর দ্বায়িত্ব নিসার উপরেই বর্তেছিল।দীর্ঘদিন ঢাকা থেকে সাজ সজ্জা ভালোভাবেই রপ্ত করেছে সে।আয়নায় দাড়িয়ে নিজেকে দেখলাম একবার।হালকা ঢেউ খেলানো চুলে করা খোঁপার একপাশে কাচা লাল এবং কালো গোলাপ মিশ্র করে গুজে দিয়েছে।সামনের দিকের ঢেউ খেলানো ছোট ছোট কিছু চুল আচড়ে মুখের দুপাশে ঝুলিয়ে দিয়েছে থুতনির নিচ অবধি।।বিয়ে উপলক্ষে এই প্রথম মাথার চুল বের করে সেজেছি আমি।অন্যথায় সবসময় মাথায় ঘোমটা টেনে চুল ঢেকে রাখি।শ্যাডো,ব্লাশ,কনটোর,হাইলাইটার সহ যাবতীয় কৃত্রিম সামগ্রী মুখে ব্যবহারের সঠিকমাত্রা সৌন্দর্য বাড়িয়েছে কয়েকগুন।গায়ে লাল বেনারসি জড়ানো।হাত, কান ও গলায় আম্মুর ছোয়া লেগে আছে।কিছু এন্টিক্সের অর্নামেন্টস ও ঝুলছে হাতে গলায় সিঁথিতে।সব মিলিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার।হটাৎ নিশান ভাইয়ের কথা ভেবে লজ্জায় নুইয়ে গেলাম।সত্যি নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি।তার অবস্থাটা কেমন হবে।স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তিনি ঘোড় লাগা নয়নে তাকিয়ে আছেন।আমার হাতে হাত রেখে বলছেন,

“আল্লাহকে ধন্যবাদ মন ও শরীর উভয় দিকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমনীকে আমার করে দেওয়ার জন্য।আমি যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি এরিন।অপরাধ হয়ে যাবে আজ।ভয়ংকর অপরাধ।যদি সীমালঙ্ঘন করেই ফেলি তুই কি সম্মতি দিবি না?”

কিন্তু নাহ এমন কিছুই হল না।যেই গাছের ফুলের ঘ্রান নিব ভাবছিলাম।সে গাছ চারা অবস্থায়ই মুষড়ে গেল।বাইরে প্রচুর হট্টগোল বেধেছে।লিমন সারা গ্রামের লোক এনে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।প্রমান হিসেবে কয়েকটা পিকচার নিয়ে এসেছে।নিশান ভাই প্রথমে তাদের বিরুদ্ধে গেলেও পিকচার দেখার পর দমে গেলেন।সেখানে দেখা যাচ্ছে একটা বেডে ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছি আমি।পাশেই আরেকটা পুরুষ কায়া আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।এসবের কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।এটা কি দেখছি আমি।আমি তো এমন কিছু করিনি।আর এই ছবিই বা কিভাবে উঠানো হল।পরক্ষণেই মস্তিষ্ক জানাল এটা সেই পুরুষ কায়া যে হসপিটালাইজড করেছিলো আমাকে।আমার অজ্ঞানের সুযোগ নিয়ে এসব তারই কাজ হবে হয়তো।জানালাম নিশান ভাইকে।তিনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,

“আমাকে কি তোর বোকা মনে হয় এরিন?একটা অপরিচিত ছেলে তোকে সাহায্য করল আবার তোকে কালার করতে এভাবে পিক তুলে সেইফলি তোকে গ্রামে পাঠিয়ে দিলো।যে কিনা তোকে ভালোভাবে চেনেও না।সেই মানুষটার তোর সাথে কিসের শত্রুতা যে এসব নোংরা কাজ করবে?বিষয়টা হাস্যকর নয় কি?”

“বিশ্বাস করেন নিশান ভাই আমি এর থেকে বেশি কিছু অনুমান করতে পারি না।”

“অনুমান করিস আর না করিস কেউ তো তোকে ছুয়েছে।এখন আর আমাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিস না।এসব অপকর্ম করে এসে আম্মুকে পটিয়েছিস।এত্তো ধুরন্দর তুই?সত্যি তারিফ না করে পারছি না।”

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালাম আমি।তিনি আমার হাত ধরে টেনে আব্বুর দিকে ছুড়ে দিলেন।রাগে ঘাড়ের রগ ফুলে উঠেছে ওনার।চোখ দুটো ধারন করেছে রক্তবর্ণ।গর্জে উঠলেন তিনি,

“তুই বের হ এই বাড়ি থেকে।আমাদের সম্মান নষ্ট করার পর এখানে কোন ঠাই হবে না তোর।”

মামা আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“পরিবেশ মানুষকে প্রভাবিত করে এটা সর্বক্ষেত্রে সত্যি নয় আবারও প্রমান পেলাম।জেনেটিক একটা ব্যাপার আছে না?লুচ্চা বাবার মেয়ে ভালো চরিত্রের হবে এটা ভাবাও বিলাসিতা।তোমার মেয়েকে অনেক পেলেছি।আর না।ওকে নিয়ে বিদায় হও আমাদের সামনে থেকে।আল্লাহ বাঁচিয়েছে আগেই সব জানতে পেরেছি।না হলে ওই নোংরা রক্ত আমাদের বংশে ঢুকে যেত।”

ক্রমাগত কেদে চলেছি আমি।যখনই একটু সুখের আশা করি জীবনে আরও দুঃখ ভর করে।আমার বিয়ে উপলক্ষে আব্বু এসেছিলো আজ।হয়তো ভেবেছিলো চিরতরে আমার থেকে দায়মুক্ত হবে।কিন্তু দায়মুক্ত হতে এসে দায়বদ্ধ হয়ে যাবে কে জানত।উপস্থিত সবাই ছি ছি করতে লাগলো।মামি নিষ্কম্প হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।প্রতিক্রিয়া শূন্য তিনি।আব্বুর চোখে অপমানবোধ দেখতে পেলাম।লিমন ভাইয়ের চেহারা প্রাপ্তু্ির উল্লাসে হকচকিয়ে উঠল।আবারও তাকালাম নিশান ভাইয়ের পানে।যেই চোখে এতোদিন ভালোবাসা দেখেছি সেই চোখে তীব্র ঘৃনা দেখতে পেলাম।বুকটা হু হু করে উঠল আমার।নিষ্পেষিত হচ্ছে ভীষন।দম রুদ্ধকর অবস্থা।নিমিষেই সব সপ্ন চুরমার হয়ে গেল।পাল্টে গেল আমার সকল চেনা পথ।এখন কি করব আমি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here