#কাঠপুতুল
#লেখনীতে-তানভীন শিলা
#পর্ব-১৯
.
রুশানা বেগম তার স্বামীকে দেখে ভূত দেখার মতো দাড়িয়ে আছে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তারা। বড় বোনের দেবর হওয়ায় খুব দ্রুতই তাদের সম্পর্কটা গভীর হয়ে যায়। যেই স্বামী আজ পর্যন্ত তাকে সামান্য জোড় গলায় কথা বলেনি সে কিনা তাকে ধমকিয়েছে। রুশানা বেগমের মৃদুর প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে দিতে তার স্বামীর দেয়া ধমকই যথেষ্ট। মৃদু রুশানা বেগমকে আদেশের সূরে কফি দিতে বলেছে সেটা পরশের বাবাকে বলতেই তিনি রেগে যান। সামান্য এককাপ কফি নিয়ে এতো মাথাব্যথা কেন হবে? নাকি রুশানা বেগমের ইগোতে কথাটা লেগেছে বিধায় এতো প্যানপ্যানানি বুঝতে সক্ষম হওয়ায় আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তার স্বামী।
“তুমি আমাকে বকা দিলে তো। ঠিক আছে ঠিক আছে এর শোধ আমি নিবো তোমার আদরের বউ মায়ের থেকে।”
রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হন রুশানা বেগম। মৃদু পরশের জন্য নাস্তা বানিয়ে কিচেন থেকে বের হতেই দুজনে মুখোমুখি হয়ে যায়। রুশানা বেগমের চোখ দেখেই ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকে মুদু। রুশানা বেগম মৃদুর হাতের ট্রে টেনে ছুড়ে ফেলে দেয়। গ্লাসের কফিটা পুরোটাই রুশানা বেগমের হাতে পরে যায়। যেহেতু কফিটা গরম ছিল রুশানা বেগমের চিৎকারে পুরো বাড়িটাতেই যেনো জোড়ে সোড়ে ঠাডা পরে। মৃদু তো চিৎকারেই ভয়ে কাঁপুনির লেভেল বাড়িয়ে দিয়েছে। পরশ উপর থেকে দেখে মৃদু গুটিশুটি মেরে দাড়িয়ে আছে। পরশের বাবা রুশানা বেগমের হাত ধরতেই তিনি বলেন-
“দেখেছো তুমি এই মেয়ের জন্য আমাকে বকা দিলে আর এই মেয়েটা আমার হাতের কি করলো?”
“নিশ্চই মৃদু ইচ্ছে করে করেনি।”
“না ও ইচ্ছে করেই করছে।”
“না কাকু আমি ইচ্ছে করে করিনি।”
“আরেহ্ বাহ্ মৃদু! তুই তো দেখছি ভালোই মিথ্যা বলতেও শিখে গেছিস।”
“কাকিমা…”-মৃদুকে বলতে না দিয়ে পরশ বলে-
“মৃদপাখি আসো আমার সাথে।”
“পরশ আমি কিছু করিনি।”
“চুপ থাকো আর আসো আমার সাথে।”
.
.
“পরশ আমি কিছু-মৃদুকে কিছু বলার সুযোগ না অধরযুগলে মায়ের করা নাটক থেকে মুক্তি পেতে শান্তি খুঁজে।”
“উমমমম উমমম।”
“হুম এবার বল।”
“তুমি একটা খারাপ পরশ।”
“ভালোবাসি মৃদপাখি।”
“পরশ আমি কাকিমায়ের হাতে…..”
“আমি জানি পাখি, তোমাকে বলেছি না টেনশন করবে না। আমি প্রমিস করতেছি মৃদপাখি মা তোমাকেও ভালোবাসে মেনে নিবে খুব শীঘ্রই।”
“আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
“খুব তাড়াতাড়ি তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটাবো। কিন্তু আমার অপেক্ষার কি হবে মৃদপাখি?”
“তোমার অপেক্ষা কিসের?”
“তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি মৃদপাখি। যেদিন ভালোবাসি বলবে সেদিন আমি পূর্ণতা পাবো।”
.
.
“তুমি তো শুধু আমাকেই দোষ দিবে। কত লাল হয়ে গেছে হাতটা আমার। মৃদু ইচ্ছে করেই করেছে এটা।”
“রুশু প্লিজ এইসব নাটক করোনা তো। আমি খুব ভালো করেই জানি এটা মৃদুর নয় তোমার কাজ। বিয়ের আগেও আমাদের সম্পর্ক ছিল, বিয়ের পরে তো তুমি পুরোটাই আমার হয়ে গেছো। তোমাকে খুব ভালো করে চিনি আমি। তুমি মিথ্যা বললেই আমি বুঝে যাই রুশু।”
স্বামীর কথায় চুপ হয়ে যান রুশানা বেগম। বলবেই বা কি? সত্যিই তো বলতেছে। ভাবতে থাকেন পরশের নজরে মৃদুকে কীভাবে খারাপ করা যেতে পারে। পরশের নজরে মৃদু একবার খারাপ হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
.
.
“নাহ্ মৃদপাখি এতো রাতে কোনোভাবেই এটা সম্ভব না।”
“প্লিজ পরশ না করো না প্লিজ।”
“রাত ১টায় তোমাকে নিয়ে কিভাবে বাহিরে যাই বলোতো? ৮-৯টায় হলেও হতো কিন্তু এখন আমি তোমাকে নিয়ে কোনো রিস্ক নিতে পারবোনা। তুমি আমার লাইফ লাইন মৃদপাখি। প্লিজ জিদ করোনা।”
“আমি জিদ করি? এই তোমার ভালোবাসা? ঠিক আছে লাগবে না নিয়ে যেতে, আমি একাই যেতে পারবো। আর হ্যাঁ আমি বাহিরে যাবো মানে যাবোই।”
“উফ্ এতো জিদ করো কেন? কিছু করতে মানা করলেই ভালোবাসার দোহাই দেয়া করে বন্ধ করবে? আরেহ্ পাখি থামো।”
ড্রইংরুমের কাছে আসতেই মৃদু দেখে রুশানা বেগম পায়চারী করছেন। এতো রাতে নিজের রুমে না থেকে ড্রইংরুমে কেন থাকতে হবে? মৃদুর জন্যই কিছু হয়নি তো? এইসব যখন ভাবছিল মৃদু, পিছন থেকে প্রথমে তাকে জড়িয়ে ধরে পরশ। ঘাড়ে মাথা রেখে বলে-
“ভালোবাসি মৃদপাখি। ঠিক আছে যাবো চলো।”
পরশ মৃদুকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। রুশানা বেগমকে পরশ না দেখলেও মৃদুকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে রুশানা বেগম ঠিকই দেখেছে। মৃদুর প্রতি ভালোবাসা সহ্য হচ্ছেনা রুশানা বেগমের।
.
“এটা কি করলে মৃদপাখি?”
“কেন ভালোবাসা দিলাম।”
মৃদুর কথা শুনে স্নিগ্ধ চাহনী নিক্ষেপ করে পরশ। তার মৃদপাখি নিজে থেকে যে বুকে ভালোবাসা এঁকে দিয়েছে এটাই বা কম কিসে? কোলে তুলে নিয়েই হাঁটতেছিল পরশ হুট করে তার বুকে ছোট করে কামড় দেয় মৃদু। প্রথম তো তাই পেয়ার কা ঝাটকা হায় জোড়ছে লাগছে তারপর পরশ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মৃদুকে নামায়নি।
“তুমি এভাবেই থাকবে মৃদপাখি।”
“আমার অসস্তি হচ্ছে পরশ। কেউ দেখলে কি ভাববে?”
“রাত ১:১৫মিনিটে বুঝি তোমাকে আর আমাকে দেখার জন্য মানুষের হুরাহুরি লাগবে।”
.
আরো প্রায় ২৫মিনিট হাঁটার পর মৃদু জোড় করে নেমে পরে। কিছুদূর যেতেই কিছু বাইকের আওয়াজ কানে আসে পরশের। বাইকের আওয়াজ যতো কাছে আসতেছে পরশের মনে কেন জানি ভয় কাজ করতেছে। কিন্তু মৃদু ভাবলেশহীন ভাবেই হেঁটে যাচ্ছে। পরশ মৃদুর সামনে খুব জোড়ে ব্রেক করে একটর বাইক, সাথে সাথে বাকীগুলো ঘিরে ধরে পরশ মৃদুকে।
“এতো রাতে রাস্তায় কেন আপনারা?”
পরশ মৃদুরে সামনে থাকা বাইকের ছেলেটি প্রশ্ন করে। মৃদু খুব ভালো করে বাইকের ছেলেটিকে ও পিছনে থাকা মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করে পাল্টা প্রশ্ন করে।
“সেটা আপনাকে কেন বলতে হবে?”
মৃদুর দেয়া জবাবে খুব বেশি খুশি হয় পরশ। এভাবে সাহস সঞ্চার করে মৃদু কথা বলতে পারায় পরশ যেন নিজের বাকশক্তি হারিয়েছে।
“এইযে ম্যাডাম যেটা প্রশ্ন করা হয়েছে সেটার উত্তর দিন।”
“আপনি উত্তর দিলে আমরাও উত্তর দিবো।”
“আপনাকে বলতে বাধ্য নই।”
“রাইট। আমরাও আপনাদের বলতে বাধ্য নই।”
পরশের টনক নড়ে। মৃদু এভাবেই কথা বলতে থাকলে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। সামাল দিতে হবে ভেবেই পরশ বলে-
“লিসেন ব্রো। শি ইজ মাই ওয়াইফ। প্লিজ ডোন্ট..-পরশকে বলতে না দিয়ে মৃদু বলে-
“তুমি চুপ থাকো তো। তোমার কি মনে হয় একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে রাস্তায় হাঁটতেছে দেখে ওরা প্রশ্ন করতেছে? মোটেই না। ভালো করে দেখো এই প্রশ্নকর্তার পিঠেও মানে পিছনেও একটা মেয়ে-ই বসে আছে।”
মৃদুর কথা শুনে শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় পরশ। মৃদু এতোকিছু লক্ষ্য করেছে দেখে ভালো লাগে পরশের। সে নিজেও কোনো এক আশঙ্কায় খেয়াল করেনি কিছুই। পরশের মনে হয় এই লোকগুলো অন্য কোনো মতলবে এসেছে। মৃদুর কোনো ক্ষতি করবে নাতো? ভয় শুরু হয় পরশের। ছেলেটির পিছনে থাকা মেয়েটি নেমে এসে মৃদুর হাত ধরে পরশের থেকে দূরে নিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় মৃদু কিংবা পরশ কিছুই বুঝতে পারেনা। হুট করে পিছন থেকে কেউ একজন হকি স্টিক দিয়ে পরশের মাথায় আঘাত করে। মৃদু শকড্! এটা কি হলো? হুট করে এসে এসব কি করতেছে?
“পরশশশশশশ। আপনার এমন কেন করতেছেন? আমার পরশের কিছু হলে আমি আপনাদের কেউকে ছাড়বোনা।”
মৃদুর হাত ধরে রাখা মেয়েটি মৃদুর গালে খুব জোড়ে থাপ্পড় দেয়। মৃদু ছিটকে পরে যায়। কোনোরকম নিজেকে সামলিয়ে উঠে এসে মেয়েটিকেও থাপ্পড় দেয়। মেয়েটি আবারো কিছু করার আগেই মেয়েটির কোমড়ে রাখা চাকুটা মৃদু টান দিয়ে নেয়ার সময় কিছুটা কেটে যায়। মেয়েটি কোমড়ে হাত দিয়ে চেপে ধরতেই মৃদু মেয়েটির গলায় চাকু ধরে।
কেউ নিজের স্থান থেকে বিন্দু পরিমাণ নড়তেছেনা। সাধারণ শাড়ি পরা আর বোকা বোকা টাইপ চেহারার মেয়েটা হুট করে ঝাসির রানি কিভাবে হয়ে গেলো?
“আপনার এখান থেকে যাবেন নাকি এই রূপসীকে মেরে দেবো?”
“ছেড়ে দাও ওকে।”
“আপনারা ছেড়েছিলেন আমার পরশকে? আমিও ছাড়বোনা এই রূপসীকে।”
“আমরা চলে যাবো ছাড়ো এখন ওকে।”
মৃদু কিছুক্ষণভাবে মেয়েটাকে ছেড়ে দিলে তো আবারো ওরা হামলা করতেই পারে। নাহ্ একে ছাড়া যাবেনা। অন্য কিছু ভাবতে হবে। মৃদুর ভাবনার মধ্যেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পায় সবাই। হয়তো টহল দিচ্ছে। সবাই বাইকে উঠে বসে সাথে মেয়েটিকেও ছাড়তে বলে, কিন্তু মৃদু ছাড়েনা। পুলিশের গাড়িটাও চলে আসে, সবকিছু দেখে প্রশ্ন করতেই মৃদু সব বলে দেয়। পুলিশেরা বাইকারগুলোকে অন্য একটা গাড়ি আনিয়ে নিয়ে যায়। পরশের মাথায় চোট লাগার কারণে সে অচেতন অবস্থায় পরে আছে। পুলিশেরাই মৃদু আর পরশকে হসপিটালে নিয়ে যায়।
.
চলবে-
.