#কান্তা_মনি
#পর্ব_৫
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
পরদিন সকাল সকালই কান্তা মনি পালকি চোড়ে পুনরায় নিজের নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ক্ষানিক বাদে বাদে ডুকরে ডুকরে কেদে উঠছে কান্তা মনি। মেয়েদের জীবন কতটা কষ্টের। জন্মের পর বাবার বাড়িকে নিজের বাড়ি হিসেবে চিনে বড় হতে থাকে, বিয়ের পর নতুন ঠিকানায় স্থানান্তর হওয়ার পর সে উপলব্ধি করে আসলে মেয়েদের নিজের কোনো বাড়ি নেই। জন্ম হয় বাবার বাড়িতে আর মৃত্যু হয় শশুড়বাড়িতে। কথাগুলো ভাবতেই আবারও ডুকরে কেদে ওঠে কান্তা মনি। বাবা-মা, আদরের ভাই-বোন কে ছেড়ে আসতে যে কতটা কষ্ট হয় তা একমাত্র মেয়েরাই জানে।
জমিদার বাড়িতে পা রাখতেই কান্তা আর নিয়াজের কানে আসে দাদী নূর নাহারের হঠাত ভিষণ শরীর খারাপের কথা। দুজনেই ছুটে যায় নূর নাহারের কক্ষের সামনে। রক্ষী দ্বার খুলে দিতেই হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে নিয়াজ ও কান্তা।
-দাদীজান! (নিয়াজ মির্জা)
যন্ত্রণায় ছটফট করছেন নূর নাহার। নূর নাহারের কাতরানো দেখে কান্তার চোখ ভরে অশ্রু জমা হতে শুরু করেছে। কখন যেন টুপ করে একফোটা আশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এ বাড়িতে যে এই আরেকটা মানুষকে তার ভরসার মনে হয়েছে।
-কবিরাজ কি বলেছে? (নিয়াজ মির্জা)
-বেশি কিছু বলেন নি । শুধু এটুকুই বলেছেন যে, অবস্থা বেশি ভালো না হয়ত অল্প দিনের মেহমান হয়েই আছেন। (দাসী রহিমা)
-ওহ। (অসহায় দৃষ্টিতে প্রিয় দাদীজানের দিকে তাকায় নিয়াজ মির্জা)
-এখন থেকে তুমি দাদীজানের কাছে বেশি বেশি থাকো । তার যত্ন নাও কান্তা মনি। (নিয়াজ মির্জা)
-আচ্ছা। (কান্তা মনি)
দাদীজানের হাত দুখানা নিয়াজ নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অধরোষ্ঠ ছুয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। কান্তা মনি সন্তপর্ণে দাদীজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
-কিছু কি খাওয়াতে পেরেছেন দাদীজানকে? (কান্তা মনি)
-না কিছুই খাচ্ছেন না । শুধু কিছুক্ষণ পর পর ছটফট করে উঠছেন। (দাসী রহিমা)
-আচ্ছা আপনি একটু থাকুন আমি দাদীজানের জন্য তরল কোনো খাবার নিয়ে আসছি। (কান্তা মনি)
-আচ্ছা বেগম। (দাসী রহিমা)
-জঙ্গলের ওই দক্ষিণ দিকটায় একবার তল্লাশি চালান আপনারা। গতকাল রাতে জঙ্গলের দক্ষিণ দিকটার ওই নদীর পাড়ে বসে কেউ আমার ওপর এবং আপনাদের বেগম সাহেবা কান্তা মনির ওপর আক্রমণ করতে চেয়েছিল। জঙ্গল ছাড়া তো পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না সেখানে। খুজে বের করুন কার এত বড় দুঃসাহস।
-যথা আজ্ঞা বাবু মশাই। (পাইক-পেয়াদা)
নূর নাহারের কক্ষে প্রবেশ করার সময় নিয়াজ মির্জার ফুফু মেহেরুন্নেছাকে হুড়মুড় করে কক্ষ হতে বের হতে দেখে কান্তা মনির মনে একরাশ প্রশ্নের সমাহার ঘুরপাক খেতে থাকে। হঠাত মেহেরুন্নেছা এমন হুড়মুড় করে কক্ষ থেকে বের হলো কেন?
কান্তা কক্ষে প্রবেশ করে দেখে নূর নাহার কেমন ছটফট করছেন। কান্তাকে দেখে কি যেন বলার জন্য মুখ আওড়াচ্ছেন কিন্তু মুখ থেকে বুলি ফুটছেনা। সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে তার। কান্তা দৌড়ে গিয়ে নূর নাহারের নিকট গিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। নূর নাহার কি যেন বলতে চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ।
-দাদীজান এমন কেন করছেন? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলুন আমাকে? এমন ছটফট করবেন না তাতে আরও কষ্ট হবে। দোহায় লাগে দাদীজান একটু শান্ত হন।(কান্তা মনি)
নূর নাহারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে পালঙ্কের পাশে থাকা চৌপায়ার ওপর থেকে তেলের শিশি থেকে তেল নিয়ে নূর নাহারের হাত-পায়ে মালিশ করতে শুরু করে কান্তা।
ভোজন শালার বিশাল খাবার টেবিলে হরেক রকম খাবার সাজাতে ব্যস্ত দাসীরা। একে একে সকলে আহার শুরু করে দেয়। ভোজন শালায় কান্তা মনি উপস্থিত হতেই হেতিজা তাকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। কান্তা মনিকে দেখেই বেগম নূর জাহান ছ্যাত করে ওঠেন।
-এই মেয়ে এখানে কি করে? আমি আর এক মুহূর্ত ও এখানে থাকব না। (বলেই খাবার থালা কিছুটা জোরেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ান বেগম নূর জাহান)
বেগম নূর জাহানের এহেন কান্ডে সকলে হতবম্ভ হয়ে পড়ে।
-নূর জাহান এ কেমন ব্যবহার? কান্তা মনি তোমার একমাত্র পুত্রের বেগম। এমন ব্যবহার আমি কখনো তোমার থেকে আশা করিনি। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-ক্ষমা করবেন স্বামী। এই মেয়েকে আমি একদন্ড মেনে নিতে পারছিনা। (বেগম নূর জাহান)
-আম্মা শান্ত হোন। এমন করবেন না। (নিয়াজ মির্জা)
-খবরদার তুমি এই মেয়ের হয়ে আমাকে কোনো কথা বলতে আসবেনা নিয়াজ। (বেগম নূর জাহান)
-নূর জাহান এখানেই থেমে যাও। আমি আদেশ করছি চুপচাপ আহার শেষ করে তারপরই এখান থেকে উঠবে।
বেগম নূর জাহান রাগে ছ্যাত ছ্যাত করতে করতে পুনরায় চেয়ার টেনে বসেন।
কান্তা মনি মাথা নিচু করে চোখ থেকে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে ভেবে নিয়েছে প্রতিনিয়তই তাকে অপমানিত হতে হবে, অত্যাচারিত হতে হবে, ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হবে। তাকে যে এবার শক্ত হতে হবে। আস্তে করে চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে মাথা উচু করে সকলের দিকে দৃষ্টিনিপাত করে কান্তা মনি।
-আম্মাজানের শরীরের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। আমাদের মাঝে অল্প দিনের মেহমান মাত্র। সকলে একটু আম্মাজানের সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করবে। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-জ্বি ভাইজান আমিও এটাই বলতে চাইছিলাম। (শাহ সুলতান মির্জা)
ভোজনশালা থেকে বের হওয়ার সময় নিয়াজ লক্ষ্য করে চাচা সুলতান মির্জা কিছুটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছেন।
-চাচাজান আপনার পায়ে কি হয়েছে? এমন খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছেন কেন? (ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে ওঠে নিয়াজ)
-হয়ত কোনো বিশেষ কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে কিছুর সাথে বেধে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। (কান্তা মনি)
-না না তেমন কিছুনা। সিড়ি থেকে নামার সময় পায়ের শিরায় টান লেগেছে। (থতমত খেয়ে বলে ওঠেন সুলতান মির্জা)
কান্তা মনির এমন কথা শুনে তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় নিয়াজ মির্জা।
-হঠাত চাচাজানকে অমন কথা বললে কেন কান্তা মনি? (নিয়াজ মির্জা)
পানি পান করা শেষ করে পাত্রটা চৌপায়ার ওপর রেখে নিয়াজ মির্জার পাশে পালঙ্কের ওপর বসে কান্তা মনি।
-এমনিই মনে হয়েছিল তাই বলেছি। ওনার ওপর তো অনেক দায়িত্ব থাকে। হয়তবা কোনো কাজ করতে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। অস্বাভাবিক কিছু তো না তাইনা? (কান্তা মনি)
-হুম ঠিক। তুমি যে ভঙ্গিতে বলেছিলে আমিতো অন্যকিছু ভেবেছিলাম। (নিয়াজ মির্জা)
-হতেও পারে যা ভেবেছেন তাই বলেছি। (কথাটা বলেই নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয় কান্তা মনি)
নিয়াজ অবাক চোখে কান্তা মনির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফজরের নামাজ পড়ে কান্তামনি কিছুক্ষণ হাটাহাটির জন্য কক্ষ থেকে বের হয়ে সিড়ি থেকে নিচে নেমে যাওয়ার সময় খেয়াল করে যোহরা্র কক্ষে যোহরা,রেহানা এবং মুর্শিদা গল্পে মশগুল। তাদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো যাবে ভেবে কক্ষে প্রবেশ করতেই রেহানা তাকে দেখে মুখে ভেংচি কেটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। রেহানার এমন কান্ড দেখে কান্তার মুখটা মলিন হয়ে যায়।
-ওর ব্যবহারে কিছু মনে করো না কান্তা মনি। এদিকে আসো বসো আমাদের সাথে গল্প করো।(মুর্শিদা)
পুনরায় মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে যোহরা ও মুর্শিদার নিকট এগিয়ে যায় কান্তা।
বাগানের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখল এক কোণে মেহেরুন্নেছা একজন পঁচিস/ছাব্বিশ বছর বয়সী এক যুবকের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তাদের কথোপকথন কান্তা মনির কান অব্দি এসে পৌছালো না। কান্তা মনিকে দেখেই মেহেরুন্নেছা থতমত খেয়ে যায়। মাথায় বড়সড় ঘোমটা টেনে নিয়ে মেহেরুন্নেছার দিকে অগ্রসর হয় কান্তা মনি। কান্তা মনিকে এগিয়ে আসতে দেখে ঠোটে জোরপূর্বক স্বভাবসুলভ হাসিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন মেহেরুন্নেছা।
-এনাকে তো চিনলাম না! আগে তো দেখিনি কখনো। (কান্তা মনি)
-পরিচিত হও এই হলো আমার একমাত্র পুত্র নওশাদ। নওশাদ এই হলো তোর নিয়াজ ভাইজানের বেগম কান্তা মনি।ব্যবসার কাজে শহরে গিয়েছিল। গতকাল রাতে এসে পৌছেছে নওশাদ তাই দেখোনি।(মেহেরুন্নেছা)
দুজনে সালাম আদান-প্রদান করে নেয়। বারবার আড়চোখে নওশাদকে তাকাতে দেখে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে কান্তা মনি। বাহান দেখিয়ে স্থান ত্যাগ করে সে।
-আম্মা নিয়াজ ভাইজান এই কাকে বিয়ে করে নিয়ে আসছে? এতো পুরো আগুনের দলা! (নওশাদ)
-সাবধান এই আগুনের দলার তাপে যেন ঝলসে না যাস। (মেহেরুন্নেছা)
সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে নিতেই শোরগোল শুনে পুনরায় নিচে নেমে এসে বাইরের দিকে উঁকি দেয় কান্তা মনি। সাধারণ প্রজাদের ভিড়ের মধ্যে চেচামেচি শুনে ভ্রু কুচকায় কান্তা। একটুবাদেই শুনতে পায় দুই-তিনদিন ধরে নাকি প্রজাদের বাড়ি-ঘরে রাতে লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। মুখ ঢেকে এসে অস্ত্র বের করে ভয় দেখিয়ে সব লুটপাট করে নিচ্ছে। লুটপাটকারীদের গায়ে নাকি জমিদারবাড়ির রক্ষীদের পোশাক থাকে। প্রজাগণ তাই ঝাপিয়ে পড়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে জমিদার বাড়ি থেকেই নাকি লোক পাঠিয়ে তাদের সব লুটপাট করা হচ্ছে।
চলবে…