#কান্তা_মনি
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
ভোরে কিছু পথিক পথের পাশের ঝোপের মধ্যে থেকে ছুরির আঘাতে থেতলে থেতলে যাওয়া রমিজ হাওলাদারের প্রাণহীন নিথর দেহ উদ্ধার করে। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে উন্মাদ হয়ে পড়ে কান্তা মনি।
ছটফটাতে ছটফটাতে এলোমেলো হয়ে ছুটছে কান্তা মনি। পেছনে তাকে দৌড়ে ধরার জন্য ছুটছে নিয়াজ মির্জা।
-কান্তা মনি থামো বলছি। এভাবে দৌড়াতে থাকলে পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে তো। (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজ কান্তা মনিকে দুহাত দিয়ে আষ্টে পৃষ্টে ধরতেই কান্না করে করে ছটফট করতে শুরু করে সে।
-ছাড়ুন আমাকে। আমি আমার আব্বার কাছে যাব।
-শান্ত হও তুমি। এভাবে দৌড়ে কখনো তুমি তাড়াতাড়ি পৌছাতে পারবে আমাকে বল? (নিয়াজ মির্জা)
-কি করব বলুন? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। (বলেই নিয়াজের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্তা মনি)
-শান্ত হও বেগম। (মাথায় হাত বুলিয়ে ওঠে কান্তা মনি)
বাতাসের গতিতে পর্দা তাল মিলিয়ে উড়ছে। ঘোড়ার ছুটে যাওয়ার টগবগ টগবগ শব্দকে সাথে করে নিয়েই যুবতী দুঃখী ভারাক্রান্ত মনে ছুটে চলছে তার প্রাণের স্বামীর সাথে।
হাওলাদার বাড়ির সামনে মানুষের সমাগম দেখে পুনরায় যুবতীর চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুজল উপচে পড়তে লাগল। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে এক মুহূর্তও দেরি না করে উন্মাদের মতো দৌড়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল কান্তা মনি।
-ও আব্বা চোখ খোলো। দেখো তোমার কান্তা মনি এসেছে। দেখো না একবার চোখ খুলে তোমার মেয়েকে। ও আব্বা শুনছো? ও আব্বা! (গগন বিদারী চিৎকার করে কান্না করে উঠে রমিজ হাওলাদারের ক্ষত-বিক্ষত বুকের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে কান্তা মনি)
আশপাশ থেকে মহিলারা শত বুঝিয়েও কান্তা মনিকে ঠান্ডা করতে ব্যর্থ। মেয়েকে বাবার বুকের ওপর থেকে বিন্দুমাত্র পরিমাণ সরিয়ে আনতে সক্ষম হয় না কেউ। রাহেলা বারবার হাহাকার করে উঠে কিছুক্ষণ বাদে বাদে জ্ঞান হারাচ্ছেন। স্বামীর গুরুত্ব এতদিন না বুঝলে আজ যেন তার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মানুষ যে সময় থাকতে সবকিছুর গুরুত্ব বোঝে না। রজনী ঘোলাঘোলা চোখে বারবার মায়ের জ্ঞান হারানোর দৃশ্য দেখে যাচ্ছে।
নির্বাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কান্তা মনি। ঠোট কামড়ে কান্নাত থামিয়ে অবুঝ শিশুর মতো শরীরের বল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে সে। আশেপাশের বিভিন্ন মানুষের একটা কথা বারবার এসে কানে বাজছে কান্তা মনির।
-সরদার বাড়ির কর্মচারী হলেও এত সৎ একটা মানুষ এই গ্রামে নাই। এরাম একটা খাটি ভালো মানুষটারে কেডায় মাইরা ফালাইলো? (আশেপাশের মানুষের মুখে এই একটা কথাই লেগে আছে)
-ও আব্বা তোমার মেয়েটা যে এবার সত্যি সত্যি একা হয়ে গেল আব্বা। আম্মাও ফাকি দিছে আমাকে আর তুমিও আজকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলা। কে আমার আব্বাকে মারছিস? একবার সামনে আয়। একবার সামনে আয় দোহায় লাগে। আমাকেও মেরে ফেল।(চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলে ওঠে কান্তা মনি)
নিয়াজ কান্তা মনিকে শান্ত করার জন্য তার পাশে এসে বসে ঘাড়ে হাত রাখতেই তার বুকের ওপর ঢলে পড়ে কান্তা মনি। কান্তা মনিকে কোলে তুলে নিয়ে তার কক্ষে গিয়ে পালঙ্কের ওপর শুইয়ে দেয় নিয়াজ মির্জা। তার প্রিয়তমার এত কষ্ট যে একদম সহ্য হচ্ছে না।
চোখ খুলতেই অনুভব করে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। উঠে বসতেই লক্ষ্য করে তার মাথার কাছে বসে আছে হেতিজা আর তার পাশেই বসে আছে মেহেরুন্নেছা। দুজনেই ভারাক্রান্ত মুখ নিয়ে বসে আছে।
মেহেরুন্নেছা তার শীতল হাত জোড়া দিয়ে কান্তা মনির মুখ আলতো করে ছুয়ে বলে ওঠেন,
-মা নিজেকে শান্ত করো। দুনিয়ায় চিরকাল সকলে থাকেনা। কিন্তু তোমার আব্বার সাথে যা হয়েছে তা অবশ্যই অন্যায় হয়েছে।
-ও ফুফুমনি! ওনাকে একটু বলেন না আমার আব্বার হত্যাকারীকে একটু খুজে দিতে। আমি তাকে নিজের হাতে হত্যা করতে চাই। আমার যে আর সহ্য হচ্ছেনা। আমি কিভাবে থাকব ফুফুমনি? (কান্না করতে করতে বলে কান্তা মনি)
-কান্না থামাও কান্তা মনি। যদি সত্যিই হত্যাকারীকে শাস্তি দিতে চাও তো আজ থেকে নিজের চোখের পানি মুছে নাও। শেষ বারের মতো তোমার আব্বাকে দেখবেনা? তোমার জ্ঞান ফিরছিল না বলে এতক্ষণ সকলে অপেক্ষা করে আছে। চলো শেষ বারের মতো তোমার আব্বা দেখে নাও। (মেহেরুন্নেছা)
হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কান্না করে দেয় কান্তা মনি।
বাবার নিথর দেহখানার দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে আছে কান্তা মনি। মন ভরে দেখে নিচ্ছে তার আব্বার নিষ্পাপ মুখখানা। লাশের খাটিয়া উঠিয়ে নেওয়ার সময় মাটিতে ছটফটাতে ছটফটাতে লুটোপুটি খেতে থাকে কান্তা মনি। নির্বাক হয়ে স্বামীর লাশের খাটিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে রাহেলা।
-আমার আব্বাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমার আব্বা একা কিভাবে থাকবে? আমার আব্বার কষ্ট হবে খুব। নিয়ে যেয়োনা আমার আব্বাকে। (কান্তা মনি)
নিয়াজ পাজকোলা করে কান্তা মনিকে তার কক্ষে নিয়ে পালঙ্কের ওপর বসিয়ে দেয়। তার পাশে বসে থরথর করে কাপতে থাকা কান্তা মনির শরীরটাকে আগলে নেয় নিজের বুকে। মুখ থেকে আর কোনো বুলি আওড়াচ্ছে না সে। নিস্তব্দ হয়ে গেছে সে। আজকের কান্নাই হয়ত তার শেষকান্না হতে চলেছে। নিরবতা দিয়েই সে ধ্বংস করবে সে প্রতিটা অন্যায়কে। শাস্তি দেবে সে তার প্রাণের আব্বাজানের হত্যাকারীকে।
নিরবতা ভেঙ্গে কান্তা মনি ভাঙ্গা গলায় বলে ওঠে,
-আমার আব্বার হত্যাকারীদের খুজে এনে দেবেন আপনি?
-হুম। তার আগে প্রতিজ্ঞা করো একদম ভেঙ্গে পড়বেনা? দুজন একসাথে এই অন্যায়ের শেকড়কে খুজে উপড়ে ফেলব একদম। (নিয়াজ মির্জা)
চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কান্তা মনির। আস্তে করে নিয়াজের বুকে মাথা এলিয়ে দেয় কান্তা মনি।
দিন যে কিভাবে কেটে যায় কেউ বলতে পারেনা। দুদিন হয়েছে গেছে রমিজ হাওলাদারের মৃত্যুর। আজ তার অনুপস্থিতিতে খা খা করছে হাওলাদার বাড়ি।
নির্জন রাত, জানালার সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে বাইরের আকাশপানে তাকিয়ে আছে কান্তা মনি। আজ সন্ধ্যায়ই জরুরি তলবে নিয়াজ মির্জা রওনা হয় জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। হঠাত দ্বারে ঠক ঠক আওয়াজ হতেই নড়েচড়ে বসে কান্তা মনি। দ্বার খুলে মৃদু পায়ে কক্ষে প্রবেশ করেন রাহেলা। কান্তা মনির পাশে বসে সন্তপর্ণে তার মুখের দিকে তাকান রাহেলা।
-ঘুমাও না এই কয়েকদিন তাইনা? (রাহেলা)
রাহেলার মুখে ‘তুমি’ সম্বোধন শুনেই চমকে ওঠে কান্তা মনি। অবাক চোখে রাহেলার মুখপানে তাকায় সে।
হঠাত কান্তা মনির দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেন রাহেলা। অস্ফুটো স্বরে বলে ওঠেন,
-আমা্রে ক্ষমা কইরে দাও মা। আমি অনেক অন্যায় করছি তোমার সাথে আর তোমার আব্বার সাথে। আমি সময় থাকতে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটার মূল্যই দেইনাই কখনো। আমি লোভে পইড়ে অন্ধ হুইয়া গেছিলাম। আমি কোনোদিন তোমারে একটু আপন ভাবিনাই। একবার কি আমারে তোমার মা হওয়ার সুযোগ দেবা মা? আমি একটুও খাটতি দেব না মায়ের কর্তব্যতে। কথা দিলাম।
কান্তা মনি টলমল চোখে তাকায় রাহেলার দিকে। চোখের কোণ বেয়ে উপচে জল পড়ার আগেই তা হাতের উল্ট পাশ দিয়ে মুছে নেয় কান্তা মনি। ঝাপিয়ে পড়ে রাহেলার বুকে। এতদিনের কষ্টের বোঝা যেন বেশ হালকা হয়েছে তার। তাকে রাহেলা বেগম নিজের মেয়ে না ভাবলেও সে যে এতদিন তাকে মা ভেবে এসেছে। সেই মা যখন নিজে স্বগ্রাহে তাকে মেয়ে হিসেবে মানতে চায় তখন কোন মেয়ে পারে তা প্রত্যাহার করতে? হ্যা তার যে এখন খুব করে মায়ের স্নেহ দরকার। মায়েদের ভুল কি কখনো ধরে বসে রাখা যায়? এক মাকে হারিয়ে অন্য মাকে কিভাবে সে একা ঠেলে দিতে পারবে? বিবেক যে খুব করে তাকে নাড়া দিচ্ছে। রাহেলা মৃদু হাতে কান্তা মনির মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।
হাওলাদার বাড়ি থেকে আজ জমিদার বাড়ি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে উঠোনে আসতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় কান্তা মনির। ঘোড়ারগাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন ও মারজান সরদারের বেগম। তাদের উপস্থিতি খানিকটা বিচলিত করে তোলে কান্তা মনিকে। সে নিজেও জানে না কেন যেন সরদার পরিবারের সদস্যদের দেখে তার বুক দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। তার আব্বা যে শেষ সরদার বাড়িতেই গিয়েছিল কাজের জন্য। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। তারপর ও তার আব্বা নাকি বাড়ি ফেরেনি সেদিন। ভোর হতেই একদল পথিক ঝোপের মাঝে তার আব্বার নিথর দেহ খুজে পায়। ঠোট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে কান্তা মনি।
চলবে…