কান্তা মনি পর্ব -১০

#কান্তা_মনি
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

-চুপ থাকি তাই দূর্বল ভাবিস না। মেয়ে মানুষ বলে শুধু তাকে কোমল ভেবে নিজের মধ্যে ললুপতা জাগিয়ে তুলিস না। তোর প্রতিটা কর্মের হিসাব রাখছি। আবার শোন তোর প্রতিটা কর্মের হিসাব রাখছি আমি। একবার চিন্তা করে দেখ ঠিক কি কি মহৎ কর্ম তুই করেছিস। তোর প্রাপ্য কর্মফল গুলো সুন্দর করে মস্তিষ্কের ভেতর গেথে রাখছি। সময় বুঝে দিয়ে দেব। (আবার একটা থাপ্পড় দিয়ে কক্ষ থেকে হন হন করে বের হয়ে যায় কান্তা মনি)

নওশাদ গালে হাত বুলাতে বুলাতে কান্তা মনির যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে।

কক্ষে প্রবেশ করেই মেঝেতে বসে রাগে ফোস ফোস করতে করতে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে কান্তা মনি। চোখ খিচে বন্ধ করে পালঙ্কের নরম বিছানা খামচে ধরে রাগ নিবারণ বৃথা চেষ্টা করতে থাকে। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাগ কিছুটা কমে আসতেই আচমকা মনে একটা ঝটকা মেরে ওঠে। হঠাত এতটা সাহস তার মাঝে এলো কিভাবে? এত বড় হুমকি তো সে দিলোই তার ওপর দুই দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে সে নওশাদের গালে। হ্যা তাকে যে এভাবে শক্ত থেকে নিজেকে আগলে রাখতে হবে। সবসময় কি আর তার সাথে নিয়াজ,হেতিজা বা মেহেরুন্নেছা থাকবেন? তাকে তো একা চলতে শিখতেই হবে। তবুও কোথায় যেন সে নিয়াজকে ছাড়া একদম অচল। এতোটা টান কিভাবে তার ওপর? এই টান ঠিক এমনভাবেই কান্তার মাঝে জেঁকে বসেছে যে তার সম্পূর্ণ শক্তিই যেন শুধুই নিয়াজ।

নিজেকে ঠিকঠাক করে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে আসতেই কান্তা মনি দেখতে পেলো রেহানা তার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে রোদেলাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। খাওয়াতে না পেরে কখনো বকাবকি করছেন তো কখনো ধরাম ধরাম করে মাওছেন মেয়েকে।

-আরে আরে ভাবিজান মেয়েটাকে মারছো কেন? (দুহাতে রোদেলাকে আগলে ধরে বলে উঠল কান্তা মনি)
রেহানা বেগম আড়চোখে তাকান কান্তা ম্নির দিকে। মুখ থেকে কোনো না বের করেই পুনরায় নিজের কাজে মন দেয় রেহানা।
-চাচীমা চাচীমা আমালে শুধু মালে । আমি থাবো না। (রোদেলা)
-ঠিক মতো পেট ভরে খেলে তো মা মারবেনা। সব খেয়ে নাও আগে। (কান্তা মনি)
-আমি থাবোইনা। মা পচা আমালে মালে শুধু। (রোদেলা)
পিটপিট করে চোখের পলক ফেলে রোদেলার বলা প্রতিটা অস্পষ্ট কথাকে বেশ উপভোগ করছে কান্তা। মিটমিটিয়ে হেসে কান্তা মনি বলে উঠল,
-চাচীমা যদি খাইয়ে দেয় তাহলে খাবে রোদেলা?
-সত্যি তুমি থাইয়ে দেবে চাচীমা? (রোদেলা)
-হুম সত্যি চাচীমা তোমাকে খাইয়ে দেবে। আসো এখানে। (মুচকি হেসে বলল কান্তা মনি)
-ভাবিজান থালাটা আমাকে দিন আমি খাইয়ে দিচ্ছি। (কান্তা মনি)
আড়চোখে কান্তা মনির দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে থাকেন রেহানা। রেহানার হাত থেকে খাবারের থালা নিয়েই পাশে থাকা গদিতে বসে রোদেলাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে হয়ে পড়ে কান্তা মনি। রেহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবনার জগতে হারিয়ে যান।

মেয়েটার সম্পর্কে সে যে ধারণা নিয়ে এসেছে এতো দিন ধরে মেয়েটা তেমন না। যথেষ্ট ভালো। কান্তা মনির সাথে করা প্রতিটা অন্যায় আর ব্যবহারের জন্য তীব্র অনুশোচনাবোধ হানা দিয়ে ওঠে রেহানার মনে।

ভোজনশালায় দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত সকলে। কান্তা মনিকে খাবারের থালায় শুধু আঙুল দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করতে দেখে মেহেরুন্নেছা বলে ওঠেন,

-কি হয়েছে মা? খাচ্ছো না কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
-উহু। এমনিই খেতে মন চাইছেনা ফুফুমনি। (কান্তা মনি)
হেতিজা মিটমিটিয়ে হেসে দেয়। সে যে কান্তা মনির অবস্থা বুঝতে পেরেছে। নিয়াজের অনুপস্থিতিতে যে কান্তা মনির মন আকুপাকু করছে। হেতিজাকে হাসতে দেখে জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা বলে ওঠেন,
-কি হয়েছে আম্মাজান? হাসছো কেন এভাবে?
হঠাত হেতিজা তার আব্বাজানের মুখে এহেন প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে ওঠে।
-না আব্বা তেমন কিছুনা। এমনিই আরকি। (হেতিজা)
-খাওয়ার সময় কোনো প্রকার হাসাহাসি চলবেনা। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-আমার খাওয়া শেষ। (কথাটা বলেই ফুরুত করে দৌড়ে ভোজনশালা থেকে বের হয়ে যায় হেতিজা)
হেতিজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে জমিদার মুচকি হাসেন।
-আমার পাগলী মেয়েটা। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)

-এই মেয়ে দাড়াও। (শাহ সুলতান মির্জা)
হাটা থামিয়ে দিয়ে পুরুষালী কন্ঠ অনুসরণ করে পেছনে ফিরে তাকায় কান্তা মনি।
-জ্বি চাচাজান বলুন কি বলবেন? (কান্তা মনি)
-আমাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে দেখে সেদিন নিয়াজ আমাকে ‘পায়ে কি হয়েছে’ জিজ্ঞাসা করায় তুমি যে কথা বলেছিলে তার তার আমার একটু খটকা লেগেছিল। কথাটা বলার ধরণ একটু অস্বাভাবিক ছিল। আসলে ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিলে তুমি? (শাহ সুলতান মির্জা)
-কেন চাচাজান এখানে খটকা লাগার কি এমন হয়েছে? আমিতো অযৌক্তিক কোনো উদাহরণ দেইনি সেদিন। আপনার হঠাত এমন মনে হওয়ার কারণ? (বাকা হেসে বলে কান্তা মনি)
-ন…না তেমন কিছু না এমনি। (শাহ সুলতান মির্জা)
কথাগুলো বলেই স্থান ত্যাগ করতে পা বাড়াতেই কান্তা মনি বলে উঠল,
-সেদিন আপনি আমার কথায় যে ব্যাপারটা ধরতে পেরে আতকে উঠেছিলেন আমি সত্যিই সেটাই আমার কথার দ্বারা বোঝাতে চেয়েছিলাম।

বিস্ফোরিত নয়নে শাহ সুলতান মির্জা কান্তা মনির দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাকে পাশ কাটিয়ে কক্ষের দিকে পা বাড়ায় কান্তা মনি।

আলমারি খুলে প্রিয় স্বামীর দেওয়া উপহার গুলো নেড়েচেড়ে দেখছে কান্তা মনি। চোখ থেকে একফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে। হঠাত কারো হাতের বন্ধনী দ্বারা তার কোমর চেপে ধরতে দেখে কেঁপে ওঠে কান্তা মনি। সারা শরীরে শীতল স্রোত বয়ে যায় তার। কানের কাছে এসে কেউ ফিসফিসিয়ে ‘কি করছো’ বলে উঠতেই পুরো দমে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েই পেছন ফিরে মানুষটাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে কান্তা মনি।

-এতো দিনে আশার সময় হয়েছে আপনার? বোঝেন না কত কষ্ট হচ্ছিল আমার? (কান্তা মনি)
-কষ্ট কেন হচ্ছিল শুনি? ভালোবাসা বা কোনো প্রকার টান না থাকলে তো কারও অনুপস্থিতির জন্য কষ্ঠ হয় না। কিন্তু তুমি তো আমাকে…

পুরো কথা বলতে না দিয়েই কান্তা মনি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,
-কে বলেছে আপনাকে হ্যা? আমি আপনাকে ভালোবাসি বুঝেছেন? আবার শুনবেন? ভালোবাসি ,ভালোবাসি ভালোবাসি। (বলেই আরও শক্ত করে নিয়াজকে জড়িয়ে ধরে কান্তা মনি)
একটা প্রশান্তির নিশ্বাস নেয় নিয়াজ।
-আমিও যে খুব ভালোবাসি আমার প্রিয়তমা।

-হাত বাড়িয়ে খাওয়ার পানি এগিয়ে দিয়ে কান্তা মনি নিয়াজকে বলে ওঠে,

-আচ্ছা আপনি কি শাহতাজ ভাইজানের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলেছেন?
ভ্রু কুচকে তাকায় নিয়াজ মির্জা।
-তুমি কিভাবে জানলে এই ব্যাপার? হেতিজা বলেছে? (নিয়াজ মির্জা)
-হুম। তারা কবে আসবে বলেছে? (কান্তা মনি)
-দুদিন পরেই আসবে। আমি তাদের দাওয়াত দিয়ে এসেছি। (নিয়াজ মির্জা)
-আচ্ছা আব্বা রাজি হবেন তো? (কান্তা মনি)
-হ্যা অবশ্যই হবে। রাতে আব্বার সাথে এই বিষয় নিয়ে বসব। (নিয়াজ মির্জা)
-ইশ আপনি এতো ভালো কেন হুম? (কান্তা মনি)
-সত্যিই আমি ভালো? (কান্তা মনির দিকে কিছুটা ঝুকে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-না মানে। (কান্তা মনি)
-না মানে কি? (কথাগুলো বলে কান্তা মনির দিকে এক পা এক পা করে এগোতে লাগল নিয়াজ মির্জা)

নিয়াজ মির্জাকে এগিয়ে আসতে দেখে একটা শুকনো ঢোক গিলে পেছনে সরে যেতে থাকে কান্তা মনি।
-আমি সত্যিই ভালো? (নিয়াজ মির্জা)
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যেতেই আতকে ওঠে কান্তা মনি।
– ওখানেই থামুন বলছি। আমি ভয় পাচ্ছি তো। (কান্তা মনি)
-ভয় কেন পাচ্ছো? আমি কি রূপকথার সেই রাক্ষস নাকি যে আমাকে ভয় পাচ্ছো? অবশ্য তুমি যদি সেই রূপকথার রাজকুমার হও তাহলে কিন্তু আমার রাক্ষস হতে কোনো সমস্যা নেই কান্তা মনি। (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে কান্তা মনি।
-বেসরম লোক একটা। (কান্তা মনি)

ভোরে কিছু পথিক পথের পাশের ঝোপের মধ্যে ছুরির আঘাতে থেতলে থেতলে যাওয়া রমিজ হাওলাদারের প্রাণহীন নিথর দেহ উদ্ধার করে। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে উন্মাদ হয়ে পড়ে কান্তা মনি।

ছটফটাতে ছটফটাতে এলোমেলো হয়ে ছুটছে কান্তা মনি। পেছনে তাকে দৌড়ে ধরার জন্য ছুটছে নিয়াজ মির্জা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here