কান্তা মনি পর্ব -০৯

#কান্তা_মনি
#পর্ব_৯
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

-চাচীজান হার পেয়েছি। (যোহরা)
-বিশ্বাস করেন আম্মা আমি এই হার চুরি করিনি। আমি জানিও না এই হার কিভাবে এখানে এলো। সত্যিই আমি জানিনা। (কাঁদতে কাঁদতে করুণ সুরে বলে ওঠে কান্তা মনি)

-এই মেয়ে একদম একটা কথা বলবিনা। আজকেই তোর বাপ-মাকে খবর পাঠাচ্ছি। তারা এসে তাদের এই লোভী মেয়ে নিয়ে যাক। (নূর জাহান)
-আম্মা ব্যাস অনেক হয়েছে এবার এখানেই থেমে যাও। পরিকল্পনাটা একটু কাচা হয়ে গেল। জমিদার পুত্রের বেগমের গহনার কমতি পড়েছে যে সে অন্যের গহনার লোভ করবে? এটা তোমাদের অন্যতম একটা ভুল। তোমরা চাপাতে চেয়েছো যে সে গহনা চুরি করে তার বাপের বাড়িতে দেবে? না মা সে পারলে তো নিজের গহনাও দিতে পারবে। কান্তা মনি এতোটাও নীচ নয় আম্মা। (হেতিজা)
-তোকে বলেছিনা বড়দের মাঝে কথা বলবিনা। (নূর জাহান)
-আম্মা এই বড়রাই যদি ঘোরতর অন্যায় করে তাহলে আমি প্রতিবাদ করতে বাধ্য। কান্তামনি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে বলেই কি তার দোষ? তাকে কি নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার সুযোগ দিয়েছো তোমরা? যখন পেরেছো শুধু ষড়যন্ত্র আর যেখানে সেখানে হেনস্তা করেছো। আম্মা গতকাল রাতে মেহরিন আপা যখন তোমাদের নিয়ে পরিকল্পনা করছিল তখন আমি তোমাদের পাশের কক্ষেই ছিলাম। কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় জানালার কাছ থেকে তোমাদের এই পরিকল্পনা আমার কানে আসে।পরিকল্পনা যখন করবেই একটু শক্ত পোক্ত পরিকল্পনা করতে বা জানালাটাও একটু বন্ধ করে নিতে। (হেসে ওঠে হেতিজা) রাতে যে মেহরিন রক্ষীদের পয়সা ধরিয়ে দিয়ে কক্ষে ঢুকে হারটা আলমারিটতে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিল্ম তখনও কিন্তু আমি জাগ্রতই ছিলাম। সকালে উঠেই রক্ষীকে হুমকি দিয়ে ভাইজানের কথা বলে সব কথা বের করেছি যে, মেহরিন তাকে পয়সার লোভ দেখিয়ে রাতে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। আম্মা তুমি বড্ড চালাক কিন্তু এটুকু ভুলো না আমিও কিন্তু তোমার মেহে। (তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় হেতিজা)

নূর জাহান সহ উপস্থিত রেহানা ,যোহরা ও মেহরিন থতমত খেয়ে যায়।

-ভাইজান ফিরলেই এর বিচার হবে আম্মা। আমি ছেড়ে কথা বলব না। এই বেচারির ওপর এমন অন্যায় করা ঠিক না। (হেতিজা)
-খবরদার হেতিজা সাবধান তোর ভাইজানের কানে কিছু দিবিনা। তুমি আমার মেয়েনা? মায়ের সাথে এমন করবি? (নূর জাহান)
-আব্বা বলেছেন, অন্যায় করলে কাউকে ছাড় দিতে নেই আম্মা। (হেতিজা)

থমথমে মুখ নিয়েই নূর জাহান,যোহরা,রেহানা ও মেহরিন কক্ষ ত্যাগ করে।

-ভাবিজান এবার অভিনয় থামাও ।(হেতিজা)
কান্তা মনি চোখের পানি মুছে নেয়। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়েই স্বশব্দে হেসে দেয়।
-জানি আম্মা আমার ওপর কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে পেরেই আমি রক্ষীকে বলে দেই কিভাবে কি করবে। রক্ষী কিছু পয়সা নিয়েই মেহরিনকে ঢুকতে দেয়। কিন্তু বেচারি জানতই না দু’জোড়া চোখ যে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিল আধারে। এবার আম্মাসহ সবাই বেশ জব্দ হবে। মেহরিন ডাইনির আমার ভাইজানের বেগম হও্যার সখ মিটিয়ে ছাড়ব আমি। এই ঘটনার পর দেখবে আর এই বাড়ির ধারে কাছেও আসবেনা লজ্জায়। (হেতিজা)
-আচ্ছা তোমার ভাইজানকে বলার কি খুব দরকার? আম্মাজানকে সে ভুল বুঝুক আমি চাইনা। (কান্তা মনি)
-ভাইজান জানে আম্মা কিছু একটা ঘটাবেন। তাইন আমাকে বলেছিল যেন খেয়াল রাখি তোমার। আর ভাইজানকে বলে দেব যেন ে নিয়ে কোনো কথা না বাড়ায়। শুধু মুখখানা ভার করে থাকবে সবার সামনে। তাতেই কেল্লাফতে ভাবিজান। নিজেদের জালে নিজেরাই ফেসে গেল । (বলেই আবারো হাসিতে ফেটে পড়ল হেতিজা)

আচমকা কান্তা মনি শক্ত করে হেতিজাকে জড়িয়ে ধরল।
-এতো ভালো কেন গো তুমি? এতো ভালোবাসো কেন আমাকে? (কান্তা মনি)
-এমন একটা মিষ্টি ভাবিজানকে কি না ভালোবেসে পারা যায়? শোনো ভাবিজান এখন থেকে পদে পদে বুদ্ধি খাটিয়ে চলাফেরা করবে। (হেতিজা)
-জ্বি। তুমি পাশে থেকো। (কান্তা মনি)
-তা তো সবসময়ই আছি ভাবিজান। ভাবিজান একটা গোপন সংবাদ দেই তীমাকে শোনো। (হেতিজা)
-বলো? বলো ? (উৎসুক দৃষ্টিতে হেতিজার দিকে তাকায় কান্তা মনি)
-ভাইজান শহরে কাজ শেষ করে শাহতাজ মানে আমার ভালোবাসার মানুষটার পরিবারের সাথে আমাদের বিয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে আসবেন। শাহতাজ এর আগের পত্রে বলেছিল সে তার আব্বা-আম্মাকে রাজি করেছে। শাহতাজের আব্বা হলো আমার আব্বার ছোট্টবেলার বন্ধু। কিন্তু আব্বাকে যদি বলি যে আমি শাহতাজকে ভালোবাসি তাহলে হয়ত মেনে নেবেনা। তাই ভাইজানকে বলেছি। ভাইজান আশ্বাস দিয়েছেন শাহতাজের সাথেই আমার বিয়ে হবে। ইশ ভাবিজান গো আমার যে কি খুশি লাগছে বলে বোঝাতে পারব না। (হেতিজা)
-পরিচয় কিভাবে? কতদিন ধরে চলে হুম? (কান্তা মনি)
-দাওয়াতের সুবাদে আমাদের বাড়িতে তারা এসেছে অনেকবার। সেখান থেকেই পরিচয়। এই দু’বছর ধরে লোকটাকে ভালোবাসি। এক দাসীর স্বামী কাজের সুবাদে শহরে যাওয়া-আসা করে। তাকে দিয়েই পত্র আদান-প্রদান করি আমরা। (চেহারায় লজ্জার আভাস ফুটে উঠেছে হেতিজার)
-বাব্বাহ! আমাকে আগে তো বলোনি কখনো। যাই হোক তোমার তো তাহলে তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে। আমিতো অনেকটা একা হয়ে যাব। কে আমাকে এভাবে আশ্বাস দিয়ে পাশে দাঁড়াবে? (ঠোট উলটে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-আমার ভাইজান থাকতে তোমার আর কাউকে লাগবে নাকি হুম? (মুচকি হেসে)
-যাহ দুষ্টু মেয়ে। (কান্তা মনি)

-এই মেয়ের কাচা পরিকল্পনা খাটিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজেদের জালে নিজেরাই ফেসে গেলাম। এখন নিয়াজ এসে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করবে তখন কি করব আমরা? ওই মেয়েকে আর এই বাড়ি থেকে তাড়াতে পারব না। মেহরিন তুমি এবার নিয়াজের বেগম হওয়ার সখ ছেড়েই দাও। (নূর জাহান)
-খালা আমি এবার বাড়ি যাই। নিয়াজ এসে পড়লে আমি ওর সামনে দাড়াতেও পারব না। আমি আর এই বাড়ির ধারে কাছেও আসব না। (হাত কচলাতে কচলাতে বলে উঠল মেহরিন)

হঠাত মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে গেল কান্তার। নিজেকে খুব শূণ্য শূণ্য আগছে তার। নিয়াজ শহরে গিয়েছে দুদিন হয়েছে। বড্ড মনে পড়ছে তার কথা। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নূর নাহারের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো কান্তা মনি। দাদীজানের কক্ষে যেতে আজকে ভিষণ মন চাইছে।

নূর নাহারের কক্ষে প্রবেশ করে পালঙ্কের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশটা চোখ বুলাতে লাগল কান্তা মনি। হঠাত আলমারির পাশে নজর আটকে যায় কান্তা মনির। ধীর পায়ে আলমারির পাশে গিয়ে খানিকটা নিচু হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা কাচের শিশিটা হাতে নেয় কান্তা মনি। শিশির ভেতরে কিছুটা তরল জাতীয় কিছু দৃশ্যমান। শাড়ির আচলে বেধে নিয়ে উঠে দাড়াতেই কোমরে কারও স্পর্শ পেয়ে আতকে উঠে পেছনে ফিরে তাকায় কান্তা মনি। নওশাদ তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
-গায়ে হাত দিয়েছেন কেন আপনি? (কান্তা মনি)
-ইচ্ছা করছিল তাই। কি আছে তোমার মধ্যে বলো তো? নিজেকে সামলাতেই পারিনা। (নওশাদ)
-মুখ সামলে কথা বলুন। ভুলে যাবেন না আমি কে। (কান্তা মনি)
-ভুলিনি তো তুমি কে। তুমিতো ভাবি লাগো। (কান্তা মনির কোমর আকড়ে ধরে বলে উঠল নওশাদ)
ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠছে কান্তা মনির। এক ঝটকায় ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয় নওশাদকে। নিজেকে কিছুটা শক্ত করে নিয়ে নওশাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে গালে জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় কান্তা মনি।

-চুপ থাকি তাই দূর্বল ভাবিস না। মেয়ে মানুষ বলে শুধু তাকে কোমল ভেবে নিজের মধ্যে ললুপতা জাগিয়ে তুলিস না। তোর প্রতিটা কর্মের হিসাব রাখছি। আবার শোন তোর প্রতিটা কর্মের হিসাব রাখছি আমি। একবার চিন্তা করে দেখ ঠিক কি কি মহৎ কর্ম তুই করেছিস। তোর প্রাপ্য কর্মফল গুলো সুন্দর করে মস্তিষ্কের ভেতর গেথে রাখছি। সময় বুঝে দিয়ে দেব। (আবার একটা থাপ্পড় দিয়ে কক্ষ থেকে হন হন করে বের হয়ে যায় কান্তা মনি)

নওশাদ গালে হাত বুলাতে বুলাতে কান্তা মনির যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here