কান্তা মনি পর্ব -০৮

#কান্তা_মনি
#পর্ব_৮
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

হঠাত মাথায় কিছু প্রশ্ন চাড়া দিয়ে ওঠে।
নিয়াজ মির্জার এবং জমিদার বাড়ি সম্পর্কে খবরদারী করতে গুপ্তচর পাঠানো, নিয়াজ এবং তাকে আক্রমণ করার চেষ্টা, প্রজাদের লুট করার ষড়যন্ত্র, সেদিনের পত্র লিখে পাঠানো হুমকি, দাদীজানের মৃত্যু সব কি একই সূত্রে বাধা?

-এখনো ঘুমাও নি তুমি? (ঘুম ঘুম মাখা কন্ঠে বলে উঠল নিয়াজ)
হঠাত নিয়াজের কন্ঠ কানে বাজতেই হালকা কেঁপে উঠল কান্তা মনি।
-না মানে ঘুম আসছে না। আপনি ঘুমাননি এখনো? (কান্তা মনি)
-আমার তো এক দফা ঘুম হয়ে গেছে। হঠাত ঘুম ভেঙে গেল। দেখি তুমি এপাশ ওপাশ করছো। (নিয়াজ মির্জা)
-কিছুই ভালো লাগছেনা। সবকিছু কেমন যেন গুমট বেধে আছে। (কান্তা মনি)
-যেমন? (নিয়াজ মির্জা)
-এমনিই কারণ নেই কোনো। ঘুমিয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাবো এখন নাহলে ভোরে উঠতে পারব না। (কান্তা মনি)

ভোজন শালায় সকলে দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত।

-নিয়াজ! (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-জ্বি আব্বা। (নিয়াজ)
সকলেই দুজনের কথোপকথন শ্রবণের জন্য কান খাড়া করে।

-কাল মহাশিনদের সাথে তুমিও কিছুদিনের জন্য শহরে যাবে। ব্যবসার হিসাব-নিকাশে নাকি কি সমস্যা হয়েছে। তুমি যত দ্রুত পারো সব হিসাবের গড়মিল বের করবে। (জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-জ্বি আব্বা। আমি কালই মহাশিনদের সাথে রওনা হবো। (মাথা নুয়ে নিয়ে বলে নিয়াজ মির্জা)
জমিদার মুচকি হেসে আবার খাওয়ায় মনযোগ দেন। কান্তা মনি অবাক চোখে জমিদারের মুখপানে চায়। সে এর আগে কখনো এই মানুষটাকে হাসতে দেখেনি।

-ভাইজান বলি কি আমি যাই বরং। হিসাব-নিকাশের ব্যাপারটা তো সবসময়ই আমি দেখি। নিয়াজ কষ্ট করতে যাবে কেন। ও এই দিকটা সামাল দিক। (শাহ সুলতান মির্জা)
-না চাচাজান। আমিই যাব। আপনার বয়স হচ্ছে অত দূর কষ্ট করে যেতে হবে না মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য। (নিয়াজ মির্জা)
-না না কষ্ট হবেনা আমার। (শাহ সুলতান মির্জা)
-আমি যখন বলেছি নিয়াজ যাবে তো নিয়াজই যাবে। (গম্ভির কন্ঠে বলে ওঠেন জমিদার শাহ জাহাঙ্গীর মির্জা)
-আচ্ছা। (শাহ সুলতান মির্জা)

নিয়াজের কিছুদিনের জন্য শহরে যাওয়ার কথা কানে বাজতেই কান্তা মনির বুকটা ছ্যাত করে উঠল। চোখের পলক পড়লেই যেন এখনই টুপ করে এক ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়বে। পাশে বসে থাকায় হেতিজা বিষয়টা লক্ষ্য করে। কান্তা মনির বাম হাতটাকে নিজের বাম হাতের মধ্যে নিয়ে ভরসার ইঙ্গিত দেয় হেতিজা।

জানালার পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে অনবরত করে যাচ্ছে কান্তা মনি।
-আমি কি সারাজীবনের জন্য কোথাও যাচ্ছি নাকি তোমাকে ছেড়ে? এভাবে কাদছো কেন পাগলী মেয়ে? (হঠাত কক্ষে প্রবেশ করে নিয়াজ মির্জা)
কান্তা মনি কিছু না বলেই চোখের পানি ফেলতে থাকে ঠোট কামড়ে ধরে। কান্তার হাত টেনে নিয়ে পালঙ্কের ওপর বসিয়ে দেয় নিয়াজ মির্জা। কান্তার পাশে বসে তার হাত দুখানা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে চুমু খায় নিয়াজ।

-আমাকে কিন্তু প্রায়ই এখানে ওখানে যেতে হয়। অনেক দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। আমিতো খুব বেশি সময় দিতে পারব না তোমাকে কান্তা মনি। দুদিন পর আমি জমিদারের দায়িত্ব পাবো। তখন তো আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তোমাকে তো মানিয়ে নিয়ে হবে কান্তা মনি। এভাবে কাদতে তো চলবেনা একদম। (কথাগুলো বলেই কান্তা মনির চোখের পানি উছে দেয় নিয়াজ মির্জা)

-আমিতো একা হয়ে যাব। (বোকা বোকা মুখ করে নিয়াজের দিকে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-তাই বুঝি? হেতিজা আছে, ফুফুমনি আছে। এদের কাছাকাছি থাকবে। কিন্তু অন্যদের কাছ থেকে একটু সাবধানে থাকবে বুঝেছো? আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে একদম হাত ছাড়া করবেনা তারা। তা একটা সত্যি কথা বলোতো। এই শাহ নিয়াজ মির্জার ভালোবাসায় ফেসে গেলে নাকি! (দুষ্টু হাসে নিয়াজ মির্জা)
লজ্জায় কান্তা মনির নাকের ডগা লাগ হয়ে গেছে। দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।
কান্তা মনির এহেন কান্ডে হো হো করে হেসে ওঠে নিয়াজ মির্জা)

-কান্তা মনি ছাড়ো। এভাবে কেউ কান্না করে নাকি? আমরা তো আসব কিছুদিন পর পর। (মুর্শিদা)
-আমার ভালো লাগছে একদম। (কান্তা মনি)
-চলো তাহলে আমাদের সাথে। আমরা একসাথে থাকব। (মুর্শিদা)
কান্তা মনি চোখের পানি মুছে মৃদু হাসে।
-নাহ ভাবি। কথা দাও আসবে কিছুদিন পর পর। (কান্তা মনি)
-কথা দিলাম। (হালকা হেসে দিয়ে বলে ওঠে মুর্শিদা)

সুটকেস হাতে ধীর পায়ে সিংদ্বারের নিকট এসে দাঁড়ায় নিয়াজ মির্জা। নিয়াজকে দেখা মাত্রই কান্তার চোখ বেয়ে অশ্রুজল টুপটুপ করে পড়তে থাকে।
সকলকে বিদায় জানিয়ে সিংহদ্বার হতে কিছুটা এগিয়ে যায় নিয়াজ,মহাশিন,মুর্শিদা। সকলে বাড়ির ভেতর চলে গেলেও কান্তা মনি চোখ বুঝে সিংহদ্বারের নিকট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাত গালে কারো অধরোষ্ঠের ছোঁয়া পেতেই চমকে চোখ মেলে তাকায় সামনে থাকা ব্যক্তির দিকে।
নিয়াজ মুচকি হেসে তার দিকেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।
-আসি। (নিয়াজ মির্জা)
ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থেকেই মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয় কান্তা মনি।

-আমার ভাইজানকে এতই ভালোবাসো তুমি ভাবিজান? তা কয়বার বলেছো “ভালোবাসি”। (মুচকি মুচকি হেসে বলে ওঠে হেতিজা)
লজ্জায় মাথা নুয়ে নেয় কান্তা মনি।
-থাক মেয়েটাকে আর লজ্জা দিস নাতো। সে কখন থেকে চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছে ফেলেই যাচ্ছে। (মিটিমিটি হেসে বলে ওঠেন মেহেরুন্নেছা)

-বাব্বাহ! এখানে তো বেশ গল্পগুজব হচ্ছে। (মেহরিন)
মেহরিনকে দেখে সকলেরই চোখ-মুখ কুচকে আসে।
-তা মেয়ের দেখি স্বামীর জন্য দরদ উতলে উতলে পড়ছে। ভালো ভালো। (মেহরিন)
-ভাবিজান আসো তো। খোচা দেওয়া কথা শুনে গা জ্বালানোর কোনো দরকার নেই একদম। (হেতিজা)
কান্তা মনির হাত টেনে নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় হেতিজা ও মেহেরুন্নেছা

জমিদার তার অতি ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধদের দুপুরের খাবারের দাওয়াত পাঠানোয় জমিদার বাড়ি অতিথিতে গমগম করছে। এই সুবাদেই সরদার পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত হয়েছেন।

-আচ্ছা আপা আমি মেহরুনকে আমার কাছে কিছুদিন রেখে দেই। আপনি কিন্তু নিয়ে যাওয়ার কোনো বাহানা দেখাতে পারবেন না একদম। (ডান হাতে মেহরুনকে আকড়ে ধরে বলে ওঠেন বেগম নূর জাহান)
-আচ্ছা আপা রাখেন। মেহরুন তো আপনাদেরও মেয়ে। (রুকসানা খাতুন)

হেতিজার কাছে তার মায়ের হাভভাব কেমন যেন সুবিধার লাগছেনা। তাই সে কান্তা মনির সাথেই রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নিল।

পরদিন সকালেই জমিদার বাড়িতে হট্টগোল লেগে গেছে। চেচামেচি শুনে কান্তা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। রেহানাকে কাদতে দেখে তার কাছে গিছে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
-কি হয়েছে ভাবিজান?
-আলমারি থেকে রেহানা ভাবিজানের ভারী সোনার হারটা চুরি হয়ে গেছে। (মেহরিন)
-কে নেবে? কার এত সাহস? (মেহেরুন্নেছা)
-এই বাড়িতে কি ছোটলোকের কমতি পড়েছে নাকি। কোথার না কোথার থেকে উঠে এসেছে। কখনো যেসব চোখেও দেখেনি তা হঠাত দেখলেতো লোভ জন্মাবেই। (মেহরিন)
কান্তা মনি ভ্রু কুচকে তাকায় মেহরিনের দিকে।
-আপনি কি এই কথার দ্বারা আমাকেই ইঙ্গিত করছেন মেহরিন বুবু? (কান্তা মনি)
-বাহ বুঝে গেছো দেখছি! খালা আমি শতভাগ নিশ্চিত এই মেয়েই রেহানা ভাবিজানের হার চুরি করেছে। এর কক্ষের আনাচে কানাচে খুজে দেখুন নিশ্চয়ই পাবেন।(মেহরিন)
-মেহরিন আপা মুখ সামলে কথা বলো। তুমি কাকে কি বলছো এসব? (হেতিজা)
-এই মেয়ে তুই চুপ করে থাক। এই মেয়ের পিছনে পিছনে ঘুরাঘুরি বাদ দে। ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে হবে না তোকে। আমরা বড়রা বুঝব। (নূর জাহান)

-চাচীজান আমি খুজে দেখতেছি এই মেয়ে কক্ষ। আমিও শতভাগ নিশ্চিত এই মেয়েই চুরি করেছে ভাবিজানের হার। (যোহরা)

কান্তা মনির কক্ষ তন্নতন্ন করে খোজাখুজির অভিজান চলতে থাকে। এক পর্যায়ে আলমারির একটা তাকের ওপরে হারটা পেতেই যোহরা হাক দিয়ে ওঠে।

-চাচীজান হার পেয়েছি। (যোহরা)
-বিশ্বাস করেন আম্মা আমি এই হার চুরি করিনি। আমি জানিও না এই হার কিভাবে এখানে এলো। সত্যিই আমি জানিনা। (কাঁদতে কাঁদতে করুণ সুরে বলে ওঠে কান্তা মনি)

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here