কালো মেঘে রোদ্দুর পর্ব -০২

গল্পের নাম: কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব-2)
লেখিকা:আরশিয়া জান্নাত

“আপু তুই সিরিয়াসলি বলছিস? আজ পর্যন্ত তোর মুখে কোনো ছেলের সম্পর্কে এতো কথা শুনিনি আমি। মাত্র কয়েক মিনিটে তুই এমন ডুবে গেলি!”

“কয়েক মিনিট মানে কি, চোখের দেখায় ভালো লাগতে পারেনা? আর যে ছেলে বকা দেওয়ার সময় এতো কিউট লাগে চিন্তা কর ভালো কথা বললে কেমন কিউট লাগবে!”

পিহু চোখ গোল করে তার বড়বোনের মুখে চেয়ে রইলো। মোহনার চোখেমুখে উপছে পড়া আনন্দই বলে দিচ্ছে সে এবার ভীষণভাবেই ক্র্যাশড। ষোড়শী মেয়েদের মতো একটু পরপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে আর বলছে, পিহু দেখেছিস মুখটা কেমন মরামরা হয়ে গেছে। চেহারার যত্ন নিতে হবে, কাঁচা হলুদ আনতে হবে! হ্যাঁ রে ঘরে ভেসন আছে?
পিহু মনে মনে বললো, যাক তাও ভালো হতাশ হতাশ ভাবটা কিছুদিন হলেও দূরে থাকবে। উড়ুক না কিছুদিন রঙিন এই স্বপ্নে।

“আচ্ছা পিহু পৃথিবীটা খুব ছোট তাই না? উনার সাথে আবার দেখা হবে?”

“হলেও হতে পারে। যদি তোর সাথে কানেকশন থাকে আরো কয়েকবার নিশ্চয়ই দেখা হবে।”

“যদি না হয়?”

” Hum hain raahi peyaar ke phir milenge chalte chalte…”

“তুই কত্ত ভালো রে পিহু, উম্মাহ। এভাবে সাপোর্ট করার জন্য হলেও তোকে দীর্ঘদিন বাঁচতে হবে। আমার জন্য তোকে লাগবে। সো এখনই মরার চিন্তা করিস না!”

পিহু ম্লান করে হেসে মাথা ঝাঁকালো।
_______

সকাল থেকেই মেজাজ গরম হয়ে আছে আজাদ সাহেবের। এই পরিবারে এখন তার দাম নেই বললেই চলে! সারাজীবন ব্যস্ততায় খেয়ালই করেনি তার পরিবারের সবাই তাকে এতোটা অবহেলা করে! এই যে সেই কখন চা দিতে বলেছিল তার স্ত্রী রেহানাকে। রেহানা চা দেওয়া তো দূর এই সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে আসছে এখন পর্যন্ত এদিকে পা মারায় নি। আর মেয়ে দুটো তো মনের ভুলেও বাবার খবর নিতে আসেনা। অবশ্য আগেও নিতো না, নেওয়ার জন্য তাকে সামনে থাকতে হবে তো। সে তো তাদের সামনেই ছিল না ছুটির দিন ছাড়া। এজন্যই গুরুজনেরা বলে সময় গেলে সাধন হবে না। টাকা পয়সার পিছে ছুটতে ছুটতে পরিবারের সবার সাথে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা এই বয়সে এসে কতখানিই বা কমাতে পারবে? তাছাড়া গাম্ভীর্য ধরে রাখার সামান্য আত্মঅহং ও আছে বটে। তাই চাইলেও চার ছেলেমেয়ের কাউকে নিজ থেকে কাছে ডেকে গল্প করতে পারেন না।
তার ছোট ছেলে ইলহাম অবশ্য এসবের ধার ধারে না। সে ঠিকই সুযোগ পেলেই বাবার কাছে এসে বসে নিত্যনতুন বিজনেস আইডিয়া নিয়ে শলাপরামর্শ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোটাতেই সে তুষ্ট হয় না। উপসংহারে দাঁড়ায়, বাবা আমি বরং আয়েশ করেই জীবন পার করি। তোমরা যে সম্পত্তি গড়িয়েছ তাতে আমার দুই প্রজন্ম আরামছে খেয়ে পড়ে চলে যাবে। আমি লাইফটা ইনজয় ই করি।
প্রথম প্রথম ছেলের এমন কথায় রাগ উঠলেও এখন মনে হয় ও ঠিকই ভেবেছে। সবাই টাকা আয় করলে খরচ করবে কে? তাছাড়া দিনশেষে এমন একাকীত্বের চেয়ে সবার সাথে ভালো সময় কাটিয়ে মরে যাওয়াই উত্তম।
ইলহাম হাসিহাসি মুখ করে আজাদ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার কুঁচকে থাকা ভ্রুজোড়া সোজা হয়ে এলো চেহারায় আগের মতো রাগ আর বিরক্তির রেশ মুছে যেতে সময় নিলো না।
ইলহাম বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো, বাবা তোমার জন্য একটা দারুণ আইডিয়া নিয়ে এসেছি। তোমার উপর রিসার্চ করে আমি তোমার সমস্যা চিহ্নিত করতে পেরেছি আর এর সমাধানও বের করেছি। আই হোপ আমি তোমাকে ডিসাপয়েন্ট করবো না।

“শুরু করার আগে তোর মা-কে বল চা দিয়ে যেতে। সেই কখন চা চেয়েছি কারো খবরই নেই! চায়ের পিপাসায় মরে গেলেও তো কেউ খবর পেতো না দেখছি।”

“মা তোমার জন্য ফ্ল্যাক্সে চা রেখে গেছে বাবা। ঐ দেখো টি-টেবিলে সব রাখা। তুমি বলবার আগেই সব রেডি থাকে। কিন্তু তুমি এখন এতোটাই খিটখিটে থাকো পজিটিভ কিছু চোখেই পড়ছে না। আর এই সবকিছুর মেইন কারণ হলো তুমি সবসময় কাজের মধ্যে ছিলে, তাই আমাদের কারো রুটিন সম্পর্কে তোমার আইডিয়া নেই। সবে রিটায়ার্ড নিয়ে তুমি একেবারে কাজশূন্য হওয়ায় অন্যদের ব্যস্ততা তোমার মনে খারাপ প্রভাব ফেলছে। যাই হোক আমি এর দারুণ সমাধান বের করেছি। তুমি চাইলেই এটা করে অবসরটা ইনজয় করতে পারো।”

আজাদ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বল শুনি কি সমাধান।

“বাবা বড় বড় সব ব্যক্তিরা শেষ বয়সের অবসরে ক্রিয়েটিভ কাজ করে গেছেন। তুমিও তেমন কিছু করতে পারো। এমন কোনো শখের কাজ কিংবা এমন কোনো ইচ্ছে যা তুমি ইয়াং বয়সে টাকার অভাবে বা সুযোগের অভাবে করতে পারোনি তা এখন করো! আমি দাদীপুর কাছে শুনেছি তোমার নাকি লেখালেখির ঝোঁক ছিল, বিভিন্ন পত্রিকায় ও নাকি লেখে ছাপিয়েছিলে। কিন্তু দাদাজানের ভয়ে সেটা ছেড়েছ! এখন সেটা নতুন করে শুরু করতে পারো তো??”

“এই বয়সে লেখালেখি? এখন কি আর আগের মতো লেখার জো আছে? শব্দশৈলী ভুলে গেছি, কথার সৌন্দর্য হাতের লেখা সবই তো বদলে গেছে।”

“শুরু করতে দোষ কি। এ তো তোমার মাঝের প্রতিভা। প্রতিভা কি আর চলে যায়? এই নাও তোমার জন্য আমি খাতা কলম নিয়ে এসেছি তুমি লেখা শুরু করো। আর কোনো ইনফরমেশন লাগলে আমাকে বলবে। এতো ভালো আইডিয়া দিয়েছি আমায় খুশি করবে না?”

“কত টাকা লাগবে?”

“হাহা আমার বাবা শুধু টাকাই চিনলো। পিতামহারাজ আমার আপাতত টাকা লাগবে না। পারমিশন লাগবে সেন্টমার্টিন যাওয়ার।”

“ঠিক আছে যা দিলাম পারমিশন। তবে সাবধানে থাকবি, ঔদিকে তো দুদিন পরপরই দূর্ঘটনার খবর পাই।”

“চিন্তা করোনা আমরা বিশ পঁচিশ জন একসঙ্গে যাবো। থ্যাঙ্ক ইউ বাবা লাভ ইউ।”

ইলহাম বেরিয়ে যেতেই আজাদ সাহেব খাতা খুলে জানালার ধারে বসে গেলেন।

রাইয়্যান টং দোকানে বসে উদাসী ভঙ্গিতে বেশ আয়েশ করে রং চা খাচ্ছে। ফারিনকে বিয়ের কথা বলতেই সে যেভাবে রিয়েক্ট করেছে তা আসলেই অবাক হবার মতোই। কোথায় সে ভেবেছিল ফারিন খুশিতে আটখানা হবে তা না বরং কেমন অদ্ভুত সব লজিক দিয়ে এখনই বিয়ে না করা বেটার বুঝিয়ে গেল। রাইয়্যানের মাথায় আসছে না এমন করার কারণ কি? তবে কি সত্যিই বিয়ে করাটা ব্যাকডেটেড? ভাবনার ইতি টেনে বিল শোধ করে সামনে তাকাতেই দেখে একটা মেয়ে তার দিকে হা করে চেয়ে আছে। রাইয়্যান প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে গেল তখনই মেয়ে বললো, এই যে শুনুন।
রাইয়্যান কিছুটা অবাক হয়ে বললো, আমাকে বলছেন?
মেয়েটি লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বললো, আমি মোহনা। ঐ যে সেদিন দেখা হয়েছিল? আপনি কতগুলো বকা দিয়েছিলেন কালা বলে? মনে আছে?
রাইয়্যান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, স্যরি?

“ওমা এতো জলদি ভুলে গেলেন? আচ্ছা সমস্যা নেই, সবার স্মরণশক্তি তো এক না। আচ্ছা আপনি কি রোজ এদিক দিয়ে যান? কিংবা এখানে চা খেতে আসেন?”

রাইয়্যান কথাটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গাড়িতে গিয়ে বসলো। চেনা নেই জানা নেই অপরিচিত একটা মেয়ে এসে এমন প্রশ্ন করলে উত্তর না দেওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মোহনা দমে যাওয়ার মতো মেয়ে না। সে গাড়ির জানালায় এসে বললো, দেখুন একটা মানুষের সাথে একবার দেখা হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু দ্বিতীয়বার দেখা হওয়া লাকি চান্স। এই চান্স আমি হাতছাড়া করবো না। প্লিজ কিছু একটা বলে যান যেন আরেকবার দেখা হবার সুযোগ থাকে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা।।।।
মোহনা চট করে গাড়ির নম্বর টুকে নিলো।
“সে কি আমায় ছ্যাচড়া ভাবলো? ভাবলে ভাবুক,প্রেমে পড়লে মানুষ কত কি করে। এসময় ইগোস্টিক সেজে লাভ নাই। হোয়াইট শার্টে ছেলেটাকে একদম রাজপুত্তুর লাগে হায়য়য়ইইইই ইশ নামটাও বললো না বদরাগী একটা”

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here