কালো মেঘে রোদ্দুর পর্ব -০১

” আমার এখন চিল্লাইয়া কানতে মন চাইতাছে মা। ইচ্ছা করতেছে সবাইরে কই আমারে কয়ডা টাকা দাও আমার কিচ্ছু নাই!”
“এমন কইরা কইস না মনা। আল্লাহর কাছে চাহ। মাইনষের কাছে হাত পাতন জায়েজ হইলেও নবীজি স. এইডা পছন্দ করতো না। আল্লাহ তো পুরা জাহানের বাদশাহ তাইনের কাছেই চাহ”
মায়ের এমন কথা শুনে খানিকটা বিরক্তই লাগলো মোহনার। তার মা তো আল্লাহর কাছেই সব চেয়েছে এতোদিন। এতো ধার্মিক আল্লাহভীরু মহিলার জীবনে সুখ বলতে কি কিছু আছে? আজ পর্যন্ত বিনা কারণে যিনি নামাযটা কাযা করেনি, অভাবেও দুই হাত উজাড় করে দান খয়রাত করেছেন। সেই মানুষটার জীবনে কি একটুখানি সুখ দেওয়া খুব কঠিন ছিল? আজকাল নিজেকে কেমন নাস্তিক মনে হয়। আল্লাহর উপর রাগ নাকি অভিমান বুঝেনা সে। শুধু বুঝে তার জীবনটা একটু বেশিই কঠিন। সব পরীক্ষা যেন সে একাই দিচ্ছে!
ছোট বোনটার না জানি কত বড় অসুখ নাহয় ডাক্তার কি বলতো “হাতে টাকাপয়সা রাখেন সামনে খরচ আছে” ?
এই অভাবের দিনে সংসারের যাবতীয় সবকিছুর খরচ এমন দ্রুতগতিতে বাড়ছে যে শত চেষ্টা করেও তাল মেলাতে পারছেনা মোহনা। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন সংসারে অসুখ বিসুখ মরার উপর ঘা বলা চলে।
মোহনার বাবা যতদিন বেঁচে ছিল কোনোকিছুরই অভাব ছিল না সংসারে। কিন্তু যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন সবাই তাদের সঙ্গ ছেড়ে দিলো। বড় চাচা অনায়াসে বাড়ির জায়গা সম্পত্তি নিজের নামে করে নিলেন। অবশ্য এর জন্য মোহনার বাবার অবহেলা দায়ী। বেঁচে থাকতে তিনি এসব বিষয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি বলেই আজ তার পরিবারের এই দশা। সারাটাদিন গাধার খাটুনি শেষে রাতে বইটা মেলে বসতেই রাজ্যের ঘুম ভর করে মোহনার উপর। এবারো বোধহয় রিটেক দিতে হবে পড়াশোনার যে ছিরি পাশ করা সম্ভব না!
মাঝেমাঝে তার ইচ্ছে করে এই সবকিছু ছেড়ে মরে যেতে। জীবনটা অসহনীয় লাগে। এতো অভাবে বাঁচা যায়? সংসার একটা রাক্ষুসে উনুনের মতো, যতোই টাকা দাও গিলে খায়। তবুও ক্ষুধা মেটে না।
সৃষ্টিকর্তা যাকে দেয় একদম ঢেলে দেয়। এই যেমন অর্পা,সোহেলি, দিলরুবা! দুদিন পরপর শপিং করা বান্ধবীদেরকে দেখলে বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। কতবার ওকে বলেছে ওদের সাথে ঘুরতে কিংবা রেস্টুরেন্টে যেতে, নানা ছালছুতোয় এড়িয়ে আসে বলে সবাই তাকে এখন অগ্রাহ্যই করে বলা যায়। তাই তো কলেজের কোনো ইভেন্ট সম্পর্কে জানানোর প্রয়োজনটুকু বোধ করেনা। সেদিন অফিস থেকে বহুকষ্টে ছুটি ম্যানেজ করে ক্লাসে উপস্থিত হতেই টের পেলো আজ ক্লাস নেই নবীনবরণ চলে। এমনই তার ভাগ্য!
সেই এক ঝাঁক স্মার্ট সুন্দরীদের ভীড়ে নিজের দিকে তাকাতেও বেশ লজ্জা লাগছিল তার।
এই যে এতো পার্থক্য এসব কি তার চোখে পড়ে না? তাদের পরীক্ষা নিতে মন চায় না? তিনি তো চাইলেই তাকে অঢেল সম্পদ দিতে পারতেন, এতো কষ্ট করে চলতে হতো?
পরশ্রীকাতরতা এমনি এমনি তো আর জন্মায় না।

“শোনো মা তোমাদের অবস্থা বুঝি বলেই এতোদিন সময় দিয়েছি। মাসের পাঁচ তারিখেই ভাড়া দেওয়ার নিয়ম হলেও তোমাদের বেলা বিশ তারিখ পর্যন্ত কিছু বলিনা। কিন্তু এবার এখনো ভাড়া দিচ্ছোনা যে কিভাবে চলে বলোতো। পরে তো তোমারই কষ্ট হবে।”

“আসলে আঙ্কেল ছোটবোনটার খুব অসুখ, ওর টেস্ট করাতেই এই মাসে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এই মাসের ভাড়াটা বাকি রেখে দেন। আগামী মাসে ইনশাআল্লাহ আমি নিশ্চয়ই শোধ করবো।”

নাহিদ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। মেয়েটা বা কিই করবে এইটুকু বয়সে এতো পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছে এও যে ঢের। কিন্তু তার স্ত্রী তো আর মানবেনা। এমনিতেই উৎপেতে আছে এদের তাড়াতে।

“আপু একটা কথা বলি?”

ছোটবোনের দিকে না তাকিয়েই বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে মোহনা বললো,বল

“কতদিন মাটন বিরিয়ানি খাই না। খাওয়াবি?”

“তোর এখন এটা খাইতে ইচ্ছা করে! দেখোস না টাকার কত সমস্যা?”

“দেখ আপু আমি বোধহয় বাঁচমুনা। খালিখালি এতো টাকা নষ্ট করিস না। তার চেয়ে ভালো যে কয়দিন আছি ভালোমন্দ খেয়ে বাঁচি। তুইও শান্তি পাবি।”

মোহনার ইচ্ছে হলো পিহুর গালে ঠাটিয়ে একটা চড় বসাতে। বহুকষ্টে সেটা দমিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কি ভাগ্য- বাংলা সিনেমার মতো লটারি জিতে না, ভুলক্রমে টাকার ব্যাগ ও মিলেনা। এতো হতাশা এতো অশান্তি এই ছোট্ট জীবনটায়?
নাহ এভাবে বসে থাকলে তো হবেনা টাকা ইনকামের সোর্স বাড়াতে হবে। কিন্তু কিভাবে?



“সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি করে বাসায় ফিরতে তো আপনার নিম্নে সাতটা বাজে তাইনা?”

“আটটা বাজে বেশিরভাগ। এই সময়ে যানজট থাকে বেশি,,,”

“তোহ এতো ক্লান্তিতে স্টুডেন্ট পড়ানোর মতো অবস্থায় থাকবেন?”

“হ্যাঁ অবশ্যই পারবো। কোনো সমস্যা নেই।”

“আপনার রেজাল্ট তো মাশাআল্লাহ ভালোই, ব্যাকগ্রাউন্ডও দারুণ ভালো স্যালারির জব পাওয়ার এভিলিটি আছে সেসবে ট্রাই করলেই তো হতো,,”

“চেষ্টা করছি। না পাওয়া অবধি তো বসে থাকা যায় না তাই আর কি!”

“ওহ আচ্ছা। আপনার পরিবারে কে কে আছেন? আর গ্রামের বাড়ি কোথায়?”

বিরক্তভাব লুকিয়ে মোহনা বললো, মা-বোন। আর গ্রামের বাড়ি নেই! এখানের লোক্যাল।

“ওহ আচ্ছা। আপনার পরিবারের ইনকাম সোর্স কেবল আপনি তাহলে।”

“আপনি কি আপনার বোনকে পড়াবেন? নাহয় আমি উঠি আমার কাজ আছে।”

“রেগে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে। আসলে এখন যা দিনকাল পড়েছে খোঁজখবর না নিয়ে তো হুট করে কারো কাছে পড়তে দিতে পারিনা! আপনি প্লিজ রাগ করবেন না।”

মোহনাকে নিরব থাকতে দেখে লোকটি ফের বললো, আমার বোন খুব দুষ্ট বয়সে বড় হলেও স্বভাব এখনো বাচ্চাসুলভ। কড়া শাসনে না রাখলে কিছুই হবেনা। আপনি ওকে সপ্তাহে চারদিন পড়াবেন সম্মানি নিয়ে চিন্তা করবেন না ওটা মাসের শুরুতেই পেয়ে যাবেন। আরেকটা কথা ও ম্যাথে খুব উইক এই বিষয়ে একটু নজর দিবেন।”
কথাবার্তা শেষ করে মোহনা বাসায় ফেরার পথে একশো টাকার টুকটাক সবজি কিনে নিলো। ক্লাস নাইনের মেয়েকে পড়ানোর স্যালারি কত দিবে আইডিয়া নেই তার। 3/4 হাজার তো নিম্নে তাই না?
যদি হয় তাহলে তো ভালোই হবে। পিহুর জন্য হাজী কাচ্চিঘর থেকে মাটন বিরিয়ানি নেওয়া যাবে। বাবা থাকতে সেই কবে খাওয়া হয়েছে! পিহুর ভাগ্যটাই খারাপ আসলে। বেচারি সুখ বুঝবার আগেই সংসারে কেমন দুঃখ নেমে এসেছে। তবে এই দুঃখের কালো মেঘ বেশিদিন থাকবে না। আমি ঠিকই ওর ট্রিটমেন্ট করিয়ে সুস্থ করে তুলবো। এখনো যে অনেক পথ চলা বাকি। আল্লাহ শুধু ওকে বাঁচিয়ে রাখলেই হলো!
মনে মনে কত কি ভাবনা তার। তার আর কিছু থাকুক না থাকুক স্বপ্নের অভাব নেই। কত কি প্ল্যান কত কি ইচ্ছে! মধ্যবিত্তদের তো এটাই সম্বল। সাধ অনেক সাধ্য নাই।

“ওহ হ্যালো মিস! কানে শুনতে পান না নাকি?? কখন থেকে হর্ন দিচ্ছি! মনের আনন্দে এভাবে হেলেদুলে রাস্তা দখল করে চলতে থাকলে কোনদিন যে উপরে পৌঁছে যাবেন টেরও পাবেন না!”
মোহনা লোকটার দিকে তাকাতেই থমকে গেল। বাদামি রঙের চোখবিশিষ্ট মানুষের প্রতি তার ছোটবেলা থেকেই দারুণ আকর্ষণ। তার উপর এমন হ্যান্ডসাম ছেলেকে চোখের সামনে দেখলে যে কেউই ক্রাশ নামক অখাদ্য খেয়ে ফেলবে। সে যেন ভুলেই গেল একটু আগে তার ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিল। কে এই মানুষটা যাকে দেখেই মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল? সে কি কোনো ম্যাজিকম্যান? তার হাতে বুঝি জাদুর কাঠি আছে? তুড়ি বাজিয়ে কথা বলতেই সব দুঃখ হতাশা ভ্যানিশড!

“ওহ গড আপনি দেখি আসলেই কালা! কানে একদমই শুনতে পান না।”
বিরক্ত হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো সে। ওদিকে মোহনা তখনো হা করে চেয়ে রইলো মনের মাঝে মুহূর্তে তান্ডব বাজিয়ে লন্ডভন্ড করে যাওয়া মানুষটার দিকে যতদূর দৃষ্টিতে দেখা যায়,,,,,
বুকের বাঁপাশে নতুন এক যন্ত্রণার গল্প বুঝি শুরু হয়েই গেল????

চলবে,,,,,,
#কালো মেঘে রোদ্দুর

♡আরশিয়া জান্নাত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here