পুকুরের সেই আতংঙ্ক পর্ব -০৪+৫+৬+৭ ও শেষ

#পুকুরের_সেই_আতংঙ্ক
৪র্থ পর্ব

আফসারপুরের প্রাচীন পুকুর ঘিরে যে আতঙ্ক এতদিন বিরাজ করছিল মানুষের মাঝে, একসাথে সেখান থেকে ৪টি মাথাবিহীন কিশোরীর লাশ ভেসে ওঠায় তা মহা আতঙ্কে রূপ নিল। সন্ধ্যার পরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। পুকুরের পাড়ে কেউ এসে দাঁড়ালেই ফকফকে চাঁদের আলোয় পুকুরের মাঝামাঝি পাশাপাশি চারটি লাশ দেখতে পাচ্ছে। পুকুরের পানিও আজ অদ্ভুত রকম ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। কেউই পুকুরে নামার সাহস পাচ্ছে না। পুলিশের লোকগুলোও পুকুরের কিছুটা দূরে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিখোঁজ যাওয়া কিশোরীর পরিবারের লোকেরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। সকলেই দিশেহারা বোধ করছে। কিন্তু সকালের আগে কিইবা করার আছে তাদের! সময় পেরিয়ে যেতে থাকে, এই বীভৎস দৃশ্য দেখার জন্য মানুষের ভিড় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একবার লাশগুলোকে দেখেই অবশ্য ভয়ে ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছে।

হঠাৎ একটা সি.এন.জি এসে থামলো পুকুরের কাছাকাছি ভিড়ের কাছে। ওটা থেকে দুজন আরোহী নেমে এলো। দুজনেরই গায়ে গেরুয়া পোশাক, মাথায় লম্বা চুল, শরীরে অসংখ্য সুতোর মতো কিছু বাধা। আশেপাশের লোকজন সব কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসলো এদিকে। সি.এন.জির ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ওটা চলে গেল। পুলিশের অফিসার এগিয়ে গেলেন লোক গুলোর কাছে। এরা নিশ্চই তান্ত্রিক!

জালালুদ্দিন মাতবর এবং রশিদ দুজনেই ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে আছেন। এত মানুষের ভিড় পুকুরটার দিকে বাড়ছে দেখেই অনুমান করতে পারছিলেন পুকুরে আবার কিছু একটা ঘটেছে। তারমধ্যে কিছু মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া লাশ শব্দ তাদের কানে পৌঁছেছে। নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারা পুকুরের দিকে এগিয়ে চললেন। প্রতি মুহূর্তে দুজনেই অনুভব করলেন পুকুর থেকে কিছু একটা চাইছে না তারা সামনে বাড়ুক। পায়ে কেমন একটা জড়তা!

চারদিকে কোনো বাতাস নেই। অথচ পুকুরের পানি কোনো একটা উত্তাল নদীর পানির মতোই কাঁপছে। পুকুরের মাঝামাঝি চারটি বাচ্চা মেয়ের লাশ অভাবে দেখে দুজনেরই দম বন্ধ হয়ে এলো যেন। দূর থেকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে ওদের মাথা দাঁড়ালো দাঁত দিয়ে কামড়ে কেউ আলাদা করে ছিড়েছে। রাশেদ জালালুদ্দিন মাতবরের মুখের দিকে তাকালো। ওটা শক্ত হয়ে গেছে। কী একটা ক্রোধে যেন কাঁপছে। তার চোখ দুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে পুকুরের ভেতরে থাকা এমন কিছু যা কারও চোখেই ধরা পড়ছে না। সেও অস্বাভাবিক কিছু একটা যে এই পুকুরে আছে তা অনুধাবন করতে পারছে। হঠাৎ তার মনে হলো লাশগুলোর পাশ থেকে কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন আৎকে উঠল সে।

দুজনেই ঘুরে এলাকার লোকগুলোর কাছে গেল। জালালুদ্দিন বললেন, লাশগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব তুলে ফেলা উচিত। সকলেই কেমন আমতা-আমতা করতে লাগলো। এটাই স্বাভাবিক, সকলে ভয় পেয়ে আছে। পুকুরে যেই অশুভ শক্তিই থাকুক ওটা লাশ গুলোকে নিয়ে কোনো একটা খেলা খেলছে। লাশ যতক্ষণ পুকুরে থাকবে ওটারই লাভ। কেউ পুকুরে এই মুহূর্তে নামতে রাজি নয় বুঝতে পেরে তিনি বললেন আমরা দুজন নামবো। সকলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তান্ত্রিক লোক এরা সাহসী তো হবেই। তবুও কিছুটা আতঙ্কে সকলেরই মন চঞ্চল হয়ে উঠল। এদের কিছু হয়ে গেলে তাদের এই আতঙ্ক থেকে উদ্ধার পাওয়ার ভরসা করার আর কিছুই রইবে না।

গেরুয়া পাঞ্জাবি খুলে এখন তাদের পরনে শুধু লুঙ্গি। নেমে পড়লো দুজনে পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে। গলা-হাত আর কোমরে জড়িয়ে আছে রক্ষা কবজ। রশিদকে সতর্ক করে দিলেন ওস্তাদ, পানির নিচ থেকে কোনো হাতের স্পর্শ বা টান অনুভব করলে উত্তেজিত হবে না। মন্ত্রই রক্ষা করবে তোমাকে। জানে সে। তবুও কিছুটা উত্তেজনা মনে চেপেই রয়েছে।

সাঁতরে পুকুরের মাঝামাঝি চলে গেলো দুজনে লাশ চারটির পাশে। লাশ গুলোর শরীর কাছ থেকে দেখতে আরও ভয়ঙ্কর। শরীর স্পর্শ করতেই রশিদ অনুভব করলো কোনো কারণে শরীরগুলো একটু বেশিই পিচ্ছিল হয়ে আছে। ওস্তাদের দিকে তাকালো, তিনি চোখ ইশারা করে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে পানিতে ডুব দিলেন। বুক ধক করে উঠল তার। প্রায় দুই মিনিট পর জালালুদ্দিন মাতবর পানির উপর ভেসে উঠল। তার কণ্ঠ কাঁপছে, রশিদ দ্রুত লাশগুলোকে নিয়ে পাড়ের দিকে চলো। সঙ্গে দড়ি দিয়ে ছিল লোকগুলো। ওগুলো দিয়েই লাশ চারটির শরীর আটকে দিল তারা দুজন। এরপর একজন সামনে থেকে আরেকজন পেছন থেকে ভেলার মতো করে লাশগুলোকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো পাড়ের দিকে।

পুকুরের কম্পিত পানির স্রোতে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না তাদের। তাদের এমন কাজ দেখে অনেকের মনেই সাহস ফিরে এসেছে। ওরা পাড় থেকে লাশগুলো টেনে উপরে তুলতে সাহায্য করলো। পাড়ে তুলে দ্রুত কলা পাতা দিয়ে নগ্ন লাশগুলোকে ঢেকে দেয়া হলো।

ভিজে চুপসে গেছে দুজনেই। সঙ্গে আনা পুটলি থেকে গামছা বের করে গা মুছে পোশাক পাল্টে নিল। উত্তেজিত মানুষের একটা অংশ লাশগুলোকে ঘিরে ভিড় করছে। আর বাকিরা দুই নবাগত সাহসী তান্ত্রিককে। এদের এই কাজটুকুই তারা যে ভণ্ড তান্ত্রিক নয় তার দলিল হিসেবে প্রকাশ পেল সকলের কাছে। জালালুদ্দিন মাতবর বললেন, ‘আমরা দুজন খুবই ক্লান্ত, একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেন। আর লাশ গুলোকে দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করেন।’

তান্ত্রিকদের মুখে লেগে থাকা আতংক সকলেই খেয়াল করলেন। পুলিশ জানালেন ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো নিয়ে যাবেন তারা। জালালুদ্দিন নিষেধ করলেন, বললেন, কোনোই লাভ নেই। আর নিয়ে গেলেও সকালের আগে লাশ গুলোকে যাতে কোথাও না নিয়ে যাওয়া হয়। দাফন করে ফেলাই ভালো। রাতের আঁধারে ওরা বিপদজনক। কিন্তু পুলিশের লোকেরা কিছুতেই তার কথা শুনলেন না। এমনিতেই এই কেসটায় তারা অসংখ্য ব্যর্থতার নমুনা দেখিয়েছেন। তার উপর ভুতের ভয়ে সারারাত লাশ ফেলে রেখেছে দেখলে সকলের কাছে অপদার্থ খ্যাতি পেতে হবে তাদের। দুই তান্ত্রিককে এলাকার মেম্বারের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় দিয়ে লাশগুলোকে শাড়ি কাপড়ে মুড়িয়ে পুলিশ ভ্যানে তোলা হলো। দুজন কনস্টেবল, ভ্যান ড্রাইভার এবং অফিসার চারজন। প্রায় মধ্যরাতে চারটি লাশ নিয়ে রওনা দিলেন থানার উদ্দেশ্যে।

দুই কনস্টেবল পা জড়সড় করে বসে আছেন পাশাপাশি গা লাগিয়ে। এতটা ভয় তারা এই জীবনে আর পায়নি। লাশ চারটিকে পুকুরে ভেসে থাকতে দেখেই তাদের কলজে শুকিয়ে গিয়েছিল। তার উপরে যখন অফিসার বললেন, পুকুরে নেমে লাশগুলোকে তুলে আনতে তখন দুজন প্রায় কেঁদেই দিয়েছিল। হাত জোড় করে অনুনয় করে বলেছিল তাদের ছেলে-মেয়ে আছে বাসায়। এখন পানিতে নামলে নিশ্চিত মৃত্যু হবে। অফিসার বিরক্ত হলেও জোরাজুরি করেনি। ভাগ্যিস তান্ত্রিক দুজন সময় মতো এসেছিল। কিন্তু ভাগ্য কী আর এত ভালো!

ওদের নিষেধ সত্যেও গোয়ার্তুমি করে অফিসার এই রাতে মেয়েগুলোর পরিবারের লোক, গ্রামের মানুষের সাথে ঝগড়া করে পুলিশ ভ্যানে তুলেছে লাশগুলো। আর ওগুলোর পাহাড়া দিচ্ছে তারা দুজন! গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে অফিসার বেটা কী আরামে বসে আছে। চোখ পড়েই যাচ্ছে লাশগুলোর দিকে। শাড়ির পেচের ভেতর থেকেও স্পষ্ট শরীরের আকৃতি বোঝা যাচ্ছে ছোট মেয়েগুলোর। চারটি লাশের একটিরও মাথা নেই ভাবতেই গা গুলিয়ে যাচ্ছে দুজনের। গাড়ি যত এগোচ্ছে তত তাদের আতংক বেড়েই চলেছে। এই মনে হচ্ছে লাশগুলো নড়ে উঠবে। বাইরে থেকে আসা বাতাসে কাঁপছে সত্যিই কাপড়ের খোলা অংশগুলো। ওগুলোর হাত চেপে ধরবে যেন তাদের পা। তারপর! ভাবতেই গা রিরি করে উঠছে।

দুজনে ওরা বাচ্চা ছেলের মতো একে ওপরের হাত চেপে রয়েছে। হঠাৎ ১ম কনস্টেবল আৎকে উঠলেন। তার মনে হলো একটা ঠাণ্ডা হাত তার ঘাড় স্পর্শ করলো। ২য় জনও ঘাড়ের কাছে একটা শীতল স্পর্শে চমকে উঠলেন। এরপরেই তাদের কানে ভেসে এলো কয়েকজন মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে হাসির শব্দটাও তাদের সঙ্গে চলছে। চমকে পেছনে তাকালো দুজনে। ভ্যানের পাশের দিকটা কাপড়হীন। গিরিলের রেলিং এর ওপাশে তাদের প্রায় মুখোমুখি তিনটা মেয়ের মুখ। তিনজনই খিলখিল করে হাসছে। কিছু দস্যি মেয়ে যেন চলন্ত গাড়িতে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু সময়টা যে এখন রাত। ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলো ওগুলো স্রেফ মাথা। মাথার নীচে কোনো শরীর নেই।

আৎকে প্রায় লাফিয়ে পিছিয়ে গেল দুজনে আর্তনাদ করে। মুহূর্তেই তাল হারিয়ে পড়ে গেল লাশ গুলোর উপরে। এবার উল্টো দিকের গিরিলের ওপাশে উদয় হলো আরও তিনজন অপরিচিত মেয়ের মাথা। দুপাশ থেকে ৬জন কিশোরী মেয়ে খিলখিল করে হাসছে। শরীরে রক্ত পানি হয়ে গেল। হঠাৎ অনুধাবন করলো মাথা বিহীন লাশগুলো নড়ে উঠছে তাদের শরীরের নীচে। দ্রুত তারা উঠে পিছিয়ে গেল বাইরের দিকে। ভয়ঙ্কর ভাবে নড়ছে লাশগুলো। একি! তারা কল্পনায় দেখছে নাকি! মাথাবিহীন ৪টি লাশ ধীরে ধীরে উঠে বসে পড়েছে। ওগুলোর শরীর থেকে সরে গেছে কাপড়। ৪টি লাশই তাদের হাত গুলো বাড়িয়ে দিয়েছে কনস্টেবল দুজনের দিকে। প্রথমে মনে হলো ডাকছে তাদের। পরে আবার মনে হলো ঝাঁপিয়ে পড়বে লাশ গুলো ওদের উপর। ভয়ংকর এই পরিস্থিতির সাথে তাদের কান নষ্ট করে দিচ্ছে গাড়ির বাইরের দুপাশ থেকে ভেসে আসা মেয়েগুলোর হাসির শব্দ। গাড়ি চলছে তার গতিতেই। চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে কনস্টেবল দুজন। গাড়ি থামাচ্ছে না কেন! আর কোনো উপায় আরেকটু ঘুরে পেছনে গিয়ে দুজনেই লাফিয়ে নেমে গেল চলন্ত গাড়ি থেকে।

পুলিশ অফিসার আর ড্রাইভার দুজনেই চমকে একে অপরের দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে কেউ পেছন থেকে চিৎকার করছে। ইশারা পেয়ে গাড়ি ব্রেক কসলেন ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় ছুটে গাড়ির পেছনে চলে এলেন। যা তারা দেখলেন এই পরিবেশে গভীর রাতে, গাছ-গাছালি ঢাকা পথের মাঝখানে কেউ দেখতে চাইবে না। কনস্টেবল দুজন কোথায়! গাড়ির পেছনে মাথাবিহীন চারটি মেয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। ওদের হাতদুটো সামনের দিকে তাক করা। অন্ধকার হাতড়ে এগিয়ে আসছে যেন এদিকে। অফিসার এবং ড্রাইভার আর্তনাদ তুলে উল্টো ঘুরে আফসারপুরের দিকে ছুটতে লাগলেন পেছনের দিকে যতক্ষণ পর্যন্ত না পেছনের খিলখিল হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল।

মেম্বার বাড়ির একটা ঘরেই ঘুমোতে দেয়া হয়েছে তান্ত্রিক ওস্তাদ আর শীর্ষকে। ঘুম নেই কারো চোখেই। জালালুদ্দিন মাতবর তাকে যা বললেন এরপর আর ঘুমানো যায় না। রশিদ অবাক কণ্ঠে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো, ‘আমরা কালই চলে যাব মানে কী! আপনিইতো বলেছিলেন এটি কোনো প্রাচীন ভয়ঙ্কর ‘দেও’ এর কাজ। তাহলে! এখন আপনার ভাষায় এই ৬টি কিশোরীর হত্যা যদি কোনো ভূত-প্রেত, পিশাচ কিংবা পুকুরের দেও এর না হয়, তাহলে কার? কোনো মানুষের? তা কী করে হয়? আপনি এত ভয় পেয়ে আছেন কেন? দুই মিনিট পুকুরের ভেতর ডুব দিয়ে কী এমন বুঝলেন যে এমনটা বলছেন?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জালালুদ্দিন মাতবর।…….
……………………………………………………..
.#পুকুরের_সেই_আতঙ্ক
৫ম পর্ব

মধ্যরাতে গ্রামের মানুষ আর তান্ত্রিক বুড়োর নিষেধ না মেনে চারটা মেয়ের লাশ পুলিশ ভ্যানে তুলে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার আগে পুলিশের দলটা কল্পনাও করতে পারেনি মাঝপথে মাথাবিহীন এই চার কিশোরীর লাশ জীবিত হয়ে উঠবে। কিন্তু যখন তা ঘটলো তখন ভয়ঙ্কর আতঙ্কে শিহরিত হয়ে পালানো ছাড়া আর কোনো চিন্তা তার মাথায় এলো না। এমন একটা দৃশ্য যে তারা দেখেছে তা শুনে অন্য মানুষ কী বিশ্বাস করবে পুলিশের দলের লোকেরাই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে দুজন কনস্টেবল লাশগুলোকে জেগে উঠতে দেখে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েছিল তারা বেশ আহত হয়েছে। ড্রাইভার আর অফিসার দম থাকা পর্যন্ত দৌড়েছে।

একসাথেই তারা চারজন সকাল হওয়ার অপেক্ষায় এক জায়গায় আশ্রয় নিল। ভোরের আলো ফুটলেই গাড়ির কাছে পৌঁছে স্থির হলো তারা। দিনের আলোয় ভয় কেটে গেছে অনেকটাই। মৃত মানুষের ভয়ে পালানোর জন্য উল্টো লজ্জাই লাগছে তাদের এখন। গাড়ি, আশেপাশের পথ তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাশগুলোর চিহ্ন মাত্রও তাদের নজর কারলো না। মানে কী এর! পুকুরে মেয়েগুলোর মৃত্যু যে অস্বাভাবিক, অলৌকিক কিছুর প্রভাবে ঘটেছে এটা এর মধ্যে তারা বিশ্বাস করছে। কিন্তু চারটা মেয়ের লাশ গাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে নেমে চলে গেছে এটা তাদের মাথাতেই ঢুকছে না। লাশগুলোকে পেলে অন্তত রাতের ঘটনাটা ভুলে যাওয়া যেত। একেবারেই স্তম্ভিত হয়ে গেল তারা। হতাশ হয়ে গাড়ি নিয়ে আবার ফিরতে লাগলো আফসারপুরের দিকে।

রশিদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রাচীন পুকুরটারর পানির দিকে। ভোরের হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৃদু বাতাস বইছে চারদিকে। এত সুন্দর লাগছে জায়গাটা! এই পুকুরে যে অশুভ কিছু থাকতে পারে তা কল্পনাও যেন করা যায় না। কিন্তু পুকুরে যেই অশুভ শক্তিই থাকুক না কেন ওটা যে ভয়ঙ্কর কোনো ক্ষমতাবান শক্তিমান আতঙ্ক এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে গত রাতে জালালুদ্দিন মাতবর তাকে যা বললেন তারপর সেও কিছুটা আতঙ্ক অনুভব করছে। গতরাতে চারটি মেয়ের লাশ যখন তারা উদ্ধার করতে নেমেছিল পুকুরে তখন জালালুদ্দিন তার পায়ে একটা শক্ত হাতের স্পর্শ পান। আতঙ্কিত না হয়ে উল্টো পুকুরের পানিতে ডুব দেন তিনি। এরপর তিনি দেখেন অদ্ভুত একটা জন্তুকে। জন্তুটার শারিরীক বর্ণনা তার বিন্দুমাত্র মনে নেই। এর কারণ ওটার অদ্ভুত চোখ।

ঘোলা পানিতেও জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল ওগুলো। কেমন এক বীভৎস তুচ্ছ হিংস্রতা বিরাজ করছিল দৃষ্টিতে। কিলবিল করে ভাসছে ওটার মাথার চুল। ভয়ে দম আটকে মারা যাবেন যেন তিনি। পরমুহূর্তেই চোখদুটো অদৃশ্য হয়ে গেল। ওখানে উদয় হলো ৬টি ছোট মেয়ের মুখ। মেয়েগুলোকে এই প্রথম দেখলেও বুড়ো তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন ওরাই সেই সব কিশোরী যারা এই পুকুরে মারা গিয়েছে। করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। কী একটা সাহায্য চাইতে এসেছে যেন। পানির ভেতরেও কী সাবলীল কণ্ঠে একটা মেয়ে মায়া ভরা কণ্ঠে অনুনয় করলো, ‘আমাদের বাঁচাও দাদু, ওই রাক্ষসটা আমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে চলো নীচে, ওটাকে মারার উপায় আমরা বলে দিচ্ছি! তার আগে তোমার শরীরের ওসব নোংরা জিনিস খুলে ফেল।’

এক মুহূর্তে সম্মহিত হয়ে গেল তান্ত্রিক। সম্মোহিত হওয়ার পর হাজার বছরের সাধনা, হাজার বছর ধরে নিজের মস্তিষ্কে জমা করা জ্ঞানও কোনো কাজে আসে না। তখন সে হয়ে যায় দাস। জালালুদ্দিন মাতবর ধীরে ধীরে খুলে ফেলল তার সব রক্ষা কবজ। মেয়েগুলোর করুণ মুখগুলো হঠাৎ করে বদলে বিদ্রুপ হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলতে লাগলো। এক মুহূর্তের জন্য সম্মোহন ছুটে গেল তার। সবগুলো মেয়ের আলোকোজ্জ্বল মুখের উপর দিয়ে চোখ ঘোরালেন তিনি। বিস্মিত হয়ে দেখলেন সবার চোখ দেখতে একই রকম, শুধু মুখায়ব গুলো ভিন্ন। চোখটা সেই প্রথম দেখা অদ্ভুত জন্তুর! এক মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল আবার ৬টি মেয়ের মুখ সেখানে উদয় হলো সেই হিংস্র দৃষ্টির জন্তুটি।

এক মুহূর্ত কিছু না ভেবেই তিনি শরীর বাকিয়ে মন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে মাথা উঠিয়ে দিলেন পানির উপর। শক্ত করে চেপে ধরলেন রশিদের শরীর। থরথর কাঁপছেন তিনি। আতঙ্ক নিয়ে রশিদের সাহায্যে লাশগুলোকে বেঁধে পাড়ে তুললেন।

হতভম্ব হয়ে জালালুদ্দিন মাতবর থেকে ঘটনাটা শুনলো রশিদ। মেম্বার বাড়ির ঘরটির মধ্যে মৃদু আলো জ্বলছিল। সেই আলোতে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে প্রথম খেয়াল করলো আসলেই তার শরীরে কোনো কবজ নেই। ‘পিশাচ’ ‘দেও’ ‘প্রেত’ এদের অসংখ্য শক্তি থাকলেও মানুষকে সম্মোহন করে কিছু করানোর শক্তি এদের থাকে না। হয়তো সর্বোচ্চ মোহে আটকে ফেলতে পারে। কিন্তু প্রাচীন পুকুরের এই শক্তির এই ক্ষমতা আছে। সে নিশ্চই সম্মোহিত করেই পুকুরের কাছে টেনে নিয়ে গেছে পরের ৫জন। কিশোরী মেয়েকে। এবং তান্ত্রিক মাতবরের মতো সম্মোহন করে হত্যা করে ফেলতে পারবে যে কাউকে। কিন্তু ওটার উদ্দেশ্য কী! তান্ত্রিক জালালুদ্দিন মাতবরেরইবা উদ্দেশ্য কী!

এতটুকুই শুধু ওস্তাদ তাকে বলেছে। এইটুকুতেই যে বড় তান্ত্রিক ভয় পেয়ে এই আফসারপুর ছেড়ে চলে যেতে চায় এটা বিশ্বাস হয় না রশিদের। হয়তো আরও কিছু আছে যা তাকে বলেনি ওস্তাদ। এরপর আধো ঘুম আর জাগরণের মধ্যেই কেটে গেছে সময়। তাই ভোরে সেই রহস্যময় পুকুরপাড়ে এসে হাজির হয়েছে রশিদ। দিনের আলোয় হয়তো ওটার শক্তি থাকে না। আবার হয়তো থাকে। ওটার আকর্ষণ হয়তো কেবল কিশোরী মেয়েদের মাথা। আবার ওটার শিকারের পথে কেউ বাধা দিলে তারাও যে ওটার শিকার হতে পারে এও অসম্ভব কিছু নয়।

হঠাৎ পেছনে পদধ্বনি শুনে ঘুরে তাকালো রশিদ। মেম্বার বাড়ি থেকে পুকুরটা বেশ তফাতে। ওস্তাদ ঘুমিয়ে ছিল বলে ডেকে বলে আসেনি সে। জালালুদ্দিন মাতবর তাকে দেখতে না পেয়ে অনুমান করেই হয়তো এখানে চলে এসেছেন। রশিদের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। অনেকটা ফুরফুরে মেজাজের লাগছে তাকে। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘সাহস দেখছি তোমার খুব বেশি! একা একাই চলে এসেছ!’

মুচকি হাসলো রশিদও। মাতবর বললেন, ‘আমার গতরাতের ধারণা অতিরঞ্জিত ছিল রশিদ। পানির ভেতরে আমি যা দেখেছি পুরোটাই আমার কল্পনা ছিল। কল্পনার মোহে পরেই কবজ গুলো খুলে ফেলেছিলাম। রাতে মাথা গিট মেরে ছিল, তাই নিজেও ভয় পেয়ে ছিলাম আর তোমাকেও ভয় দেখাচ্ছিলাম। এখন সব পরিস্কার লাগছে। ওটা একটা পিশাচই।’

কিছুটা অবাক হলো রশিদ। তারপর বলল, ‘এখন কী করবেন?’

‘মেম্বারের কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি যে ৬জন মেয়ে মারা গেছে ওরা নাকি খেলার সাথী ছিল। এবং প্রতিটা মেয়েই নিখোঁজের আগের রাতে নাকি তাদের মৃত সাথীদের ঘরের আশেপাশে দেখেছে। আর ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। তারা নাকি তাকে পুকুরের দিকে আহ্বান করেছিল।’

‘মানে কী! তাহলে ওদের পরিবারের লোকেরা কেন কাউকে সতর্ক করে দেয়নি! তাহলে হয়তো বাকি মেয়েগুলোকে পাহারায় রাখা যেত!’

‘ সেটাই! তারা কেউই প্রতিটা মেয়ের নিখোঁজের পেছনে যে তাদের অন্য মৃত মেয়েরা দায়ী তার মিল করতে পারেনি এবং বিষয়টাকে হালকা করে নিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে পিশাচটার লক্ষ্যই ছিল ওই ৬জন মেয়ে। তার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এবং ওটা এখন অনেকদিন আর নতুন কাউকে শিকার করবে না। অর্থাৎ পুকুরে আর ওই পিশাচটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। ওটা আবার কখন তার শিকার বানায়। তখনই বোঝা যাবে ওটা কেন এতগুলো মেয়েকে খুন করেছে। আমরা আজই চলে যাব। ‘

‘কিন্তু আপনি অনুমান করে এত নিশ্চিত ভাবে কথাগুলো কিভাবে বলছেন? আমার মনে হয় না গত রাতে আপনি যা কিছু বলেছেন তা সব আপনার কল্পনা। বরং এখন যা কিছু বলছেন তাই উদ্ভট লাগছে আমার কাছে!’

রশিদের কথাটা শুনে কেমন একটা ক্রোধ ভর করলো জালালুদ্দিন মাতবরের দৃষ্টিতে। এক মুহূর্তের জন্য রশিদের মনে হলো তার সামনে মাতবর নয়। অন্য কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো জালালুদ্দিন মাতবর পুকুরের দিকে। বিস্ময়ের সীমা রইলো না রশিদের। ওস্তাদের মুখে কেমন একটা ক্রুর পৈশাচিক হাসি। এখন ভোর, মিনিটে মিনিটে প্রকৃতি আলোকিত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে পুরো চারপাশটা আঁধারে ডুবে গেল। আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত সামান্য আলো ছাড়া আর কিছুই নেই। মানে এখনো আধার রাত্রি। তার মানে এই সমস্ত কিছুই তার মায়া ছিল! অন্ধকার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো জালালুদ্দিন মাতবর। একি! মুহুর্তে পানির নিচে তলিয়ে গেলেন তিনি।

চোখ-কপালে উঠে এলো রশিদের দৃশ্যটা দেখে। পানি ফুঁড়ে উঠে এসেছে ৬জন কিশোরী মেয়ে। রশিদের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পা জমে গেছে তার। এরমধ্যেই দেখল মেয়েগুলোর পেছনে আরেকটা মাথা উঠে এসেছে। এই জগতের কোনো প্রাণ ওটা নয় যেন! ওটার চোখই বলে দিচ্ছে এটাকেই ওস্তাদ পানির নিচে ডুব দিয়ে দেখেছিলেন। একটা হাতকে শুধু পানি থেকে উপরে উঠতে দেখল সে। কী বীভৎস দেখতে তা!

জালালুদ্দিন মাতবর আৎকে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলেন। তার মনে হলো এতক্ষণ যেন তার বুকের উপর ভারী কিছু চেপে বসেছিল। বাইরে তাকিয়ে দেখল এখনো অনেক রাত। মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়েছিল রশিদ। সেখানে ওকে দেখতে না পেয়ে খোলা দরজার দিকে চোখ গেল তার। অশুভ এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল । ভালো করে রশিদের শোয়ার জায়গায় চোখ বোলাতেই আশঙ্কার কারণটা অনুভব করতে পারলেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সেখানে রশিদের রক্ষা কবজগুলো। সজ্ঞানে ও ওগুলো খুলবে না কখনোই। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ঐতো রশিদ অনেকটা দূরে চলে গেছে, এত রাতে দ্রুত হেটে কোথায় যাচ্ছে সে! দ্রুত হেঁটে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন বুড়ো তান্ত্রিক। যতই দ্রুত হাঁটছেন নাগাল পাচ্ছেন না ওর।……………….
………………………………………….#পুকুরের_সেই_আতঙ্ক
৬ষ্ঠ পর্ব

জালালুদ্দিন মাতবর বিস্ময় নিয়েই রশিদের পিছু নিয়েছিলেন। এতরাতে কোথায় চলেছে ছেলেটা তার রক্ষা কবজগুলো খুলে! চাঁদের মিহি আলো, মধ্যরাতের স্নিগ্ধ বাতাস, গাছ ঢাকা এই পথ শুন-শান নীরবতার মধ্যে দিয়েও যেন এক আতঙ্কের আভাস দিচ্ছে। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো এগিয়ে যাচ্ছে এখনো রশিদ। ভারী কণ্ঠে তাকে কয়েকবার ডেকেও সাড়া পাননি জালালুদ্দিন মাতবর। অথচ রশিদ অতটাও দূরে নয় যে তার ডাক শুনবে না। আবার তিনি যত দ্রুত রশিদের দিকে এগোচ্ছে তত সে বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। চিন্তার গাঢ় ছায়া পড়েছে বুড়ো তান্ত্রিকের মনে। তার গায়েও কোনো রক্ষা কবজ নেই। তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ায় পরা হয়নি। কী একটা যেন তার অজানায় ঘটে চলেছে! থমকে দাঁড়ালেন তিনি।

হঠাৎ করে হাঁটা থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে রশিদ। ঘুরে তাকালো বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে। দূর থেকে দেখেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে রশিদের চেহারায়। এ যেন ভেলকি! সামান্য সময়ের মধ্যে রশিদের চেহারা বদলে হয়ে গেল একটা কিশোরী মেয়ের শরীর। শূন্য থেকেই যেন মেয়েটার পাশে উদয় হলো আরও ৫জন কিশোরী। এরা যে কারা তা চিনতে সময় লাগলো না তান্ত্রিকের। তার মানে এতক্ষণ তিনি রশিদকে নয় অনুসরণ করছিলেন ভয়ঙ্কর সেই পিশাচটার সৃষ্টি করা ভ্রমকে। তার মনে খটকা লাগছিল আগে থেকেই। তিনি কী কোনো ফাঁদে পড়েছেন! রশিদ কোথায়! সেও নিশ্চই ভ্রমের শিকার হয়েছে। তাদের দুজনের যদি কোনো ক্ষতি করে ওটা, তাহলে ওটার দ্বারা অসম্ভব আর কিছু নেই। এটার ভ্রম সৃষ্টি এবং সম্মোহনী ক্ষমতা অনুভব করেই রশিদকে বলেছিল তাদের এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। এমন আরও কয়েকজন তান্ত্রিককে খবর দেয়া দরকার যাতে তাদের কোনো ক্ষতি হলে আফসারপুরের মানুষদের ওই পিশাচটার হাত থেকে রক্ষা করতে আসে। ওটার লক্ষ্য শুধু ৬জন মেয়ে নয় আরও বড় কিছু তা তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আর যাওয়া হলো না বুঝি!

৬টি মেয়েই মুচকি মুচকি হাসছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। বুড়ো তান্ত্রিক খেয়াল করলেন প্রাচীন সেই পুকুরটার দিকেই ভ্রমটা তাকে টেনে এনেছে। আর দুই মিনিট হাঁটলেই হয়তো ওটার পাড়ে পৌঁছে যাবেন তিনি। কিন্তু মেয়েগুলো তাকে পুরো স্বাধীন করে দিয়ে রাস্তার পাশের কয়েক সারি গাছের ফাঁকা অংশ দিয়ে অন্য পথ ধরলো। এটা পুকুরের দিকে যায় না। এই প্রথম এতটা দিশেহারা অনুভব করলেন জালালুদ্দিন। তিনি কী মেম্বার বাড়িতে ফিরে গিয়ে রশিদ আছে কিনা খোঁজ করবেন, নাকি পুকুর পাড়ে যাবেন। নাকি অনুসরণ করবেন কিশোরীর দলটাকে! কিশোরীর দল না বলে ভ্রমও বলা যায় ওদেরকে। কিন্তু ওটাই সবচেয়ে বেশি টানছে তাকে। এ যেন ভ্রমটা তাকে পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়ে তার চোখের সামনে কেবল একটি সুন্দর পথ খুলে সেদিকে তাকে চলতে ত্বরান্বিত করছে!

মেয়েগুলোর পিছুই নিলেন তিনি। ওরা হাঁটছে আর বার বার আড়চোখে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। হাসিটা যেন তার বুকে আঘাত করছে। বিশেষ করে ওদের চোখ গুলোর দিকে তাকাতেই শরীর ঝাড়া দিয়ে ওঠে যেন। কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করতে চাইছে তার মনের ঘুমন্ত দিক। কিন্তু জিহ্বা সাহায্য করছে না। পা দুটো শুধু চলছে সামনের দিকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা তাকে! একি! মেয়েগুলো কোথায় গেল! তিনি উত্তেজিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন। না, পুরোই শূন্যে মিলিয়ে গেছে। মুহূর্তেই যেন তার মধ্যে সমস্ত চেতনা ফিরে এলো। কেন তিনি ভয় পাচ্ছেন! কেন ওটাকে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে দিচ্ছেন!

ছুটতে লাগলেন তিনি সামনের দিকে। তিনি যেই পথ ধরে ছুটে এসেছেন সেই পথ ধরে কোনো ভাবেই পুকুরের কাছে তার পৌঁছনোর কথা না। কিন্তু তিনি স্পষ্ট তার সামনে পুকুরটাকে দেখতে পাচ্ছেন। পুকুরের উল্টো পাশে তিনি আধো অন্ধকারেও একটা লোককে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পাচ্ছেন। রশিদ! পুকুরের পানিতে রশিদের দিকে মুখ ফিরে সেই ৬টি মেয়ে ভেসে রয়েছে। জালালুদ্দিন মাতবরের দৃষ্টি আটকে গেল মেয়েগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অদ্ভুত আকৃতির অবয়বটার দিকে। স্বয়ং শয়তান যেন দাঁড়িয়ে আছে। মহা বিপদ অপেক্ষা করছে রশিদের ভাগ্যে। চিৎকার করে রশিদকে ডাকতে যাবেন হঠাৎ পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলেন। শরীর মুচড়ে উঠলো তার। ৬টা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে বড়জোর ৫ ফুট দূরে। ভন করে ঘুরে পুকুরের দিকে তাকালেন আবার। সেখানেও ৬টি মেয়ে ওই শয়তানটার সাথে রয়েছে। মানে ১২টি মেয়ে কী করে হলো!

তবে মেয়েগুলো আর হাসছে না। কেমন করুন মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু ওদের চোখগুলোর দিকে তাকাতেই আতঙ্কের শিহরণ অনুভব করলেন তিনি। মেয়েগুলো একসাথে তাদের বাম হাত তুলে বুড়ো তান্ত্রিকের পায়ের দিকে নির্দেশ করলো। জালালুদ্দিন অজানা ভয় নিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। গতরাতে পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল যে রক্ষা কবজগুলো ওগুলো তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। কী করে! ওরা কী তাকে সাহায্য করতে চাইছে! ভাববার সময় নেই!

দ্রুত ওগুলো নিজের শরীরে জড়িয়ে নিয়ে চেচাতে চেচাতে লাফিয়ে পড়লেন তিনি পুকুরে!

রশিদ অনুভব করলো তার শরীরে কোনো রক্ষা কবজ নেই,মন্ত্র উচ্চারণ করার জন্য জিহ্বা নড়তে রাজি নয়, পাও জেদ ধরেছে একটু এদিক সেদিক। যাবে না। সেই কুৎসিত হাতটা এগিয়ে আসছে ওটার শরীরকে দূরে রেখেই বাহু প্রসারিত করে, মেয়েগুলো যেন তাকে চিবিয়ে খাবার জন্য দাঁত কটমট করছে। কী আছে ওই চোখগুলোতে! একটা শক্ত হাত চেপে ধরলো তার পা। শেষ বুঝি সব! এমন সময় একটা পরিচিত কণ্ঠের চিৎকার ধ্বনি শুনে কলজে লাফিয়ে উঠল তার। ওস্তাদ! পুকুরের ওপার থেকে লাফিয়ে পড়লো পুকুরে কেউ! ঐতো সাঁতরে এদিকে আসছে! হ্যা, তার বুড়ো তান্ত্রিকই। শক্ত হাতটা ছেড়ে দিল তার পা। মেয়েগুলোর হাসিও থেমে গেল। ডুব দিল একসাথে তারা পানিতে। সেই জন্তুটার মুখ শুধু ঘুরে গেছে জালালুদ্দিন মাতবরের দিকে। নিঃশব্দে ওটায় ডুব মারলো পানিতে। বুড়ো তান্ত্রিক সাঁতরে এগিয়ে আসছেন।

ওরা যে তান্ত্রিককে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়নি তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো রশিদ। গভীর রাতে এই পুকুরের সমস্ত রাজত্বই শয়তান পিশাচটার। ওস্তাদের কপালে ভয়ানক খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। আর কিছু ভাববার নেই। যেসব মন্ত্র, উপকরণ ছাড়া শরীর রক্ষা করার নিয়ম শিখেছিল সব আওরাল কয়েক মুহূর্ত। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরে সেও। মেঘ চাঁদকে ঢেকে দিয়ে নিজের অলিখিত সীমানা দখল করে নিল সেই মুহূর্তেই। পুরো চারপাশ অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে গেল। শুধু দুজন লোকের সাঁতার কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের চিৎকার আর কথাগুলো অস্পষ্ট!

পাহারাদার হারুন অপলক দৃষ্টিতে সাপটার দিকে তাকিয়ে আছে। কী সাপ এটা! প্রায় রাতেই গোরস্থানের পাশে এটার দেখা পায় সে। কেমন অদ্ভুত দেখতে সাপটা। টর্চের আলো সরাসরি ওটার উপর ফেলল সে। তার বিশ্বাস কোনো একটা কবরের ভেতর ওটার বাসা। বিরক্ত করছে ওটাকে যাতে ওটা ওর আবাসে ফিরে যায় আর সে দেখতে পায় কার কবরে বাসা বেঁধেছে ওটা। হঠাৎ তার গা টা শিরশির করে উঠল। মেঘের আড়ালে চাঁদটা চলে যাওয়ায় হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল যেন! সাপটা গোরস্থানে ঢুকে পড়েছে। কৌতূহলতা নিয়ে টর্চের আলো ফেলে ওটার পিছু পিছু এগিয়ে চললো হারুন। ঠিকই আন্দাজ করেছিল সে। একটা কবরের উপরে সৃষ্ট হওয়া গর্তে ঢুকে গেল ওটা। কবরটা চিনতে পেরে বুকটা আবার ধক করে উঠল তার। নুপুরের কবর ওটা। ওর মাথাবিহীন লাশটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। কী বীভৎস! হঠাৎ মনে হলো কবরটা কেঁপে উঠল যেন। না, এত জোরে সাপের পক্ষে মাটি কাঁপানো সম্ভব! আবার কেঁপে উঠল কবরের মাটি। আৎকে উঠে পিছিয়ে গেল সে। ভয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর আতংক নিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। একটু দূরে আরেকটা কবরের মাটি কেঁপে উঠল। টর্চ দ্রুত সেদিকে ঘোরালো হারুন। ওটা তুলির কবর! নুপুরের পরে ওর মাথাবিহীন লাশই পুকুরে ভেসে উঠেছিল! একি! কবর ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এলো কিছু! একটা হাত!

চিৎকার করে উল্টো ছুটতে গিয়েই পা হড়কে পরে গেল সে। টর্চটা ছিটকে গিয়ে পড়লো কবর দুটির মাঝখানে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নুপুরের কবর ফুঁড়েও বেরিয়ে এসেছে এক জোড়া হাত। তুলির কবর ফুরেও এরমধ্যে বেরিয়ে এসেছে ওপর হাত। দুটো হাত খাবলে সরিয়ে ফেলছে কবরের উপরের মাটি। পাথর হয়ে পড়ে রইলো হারুন যতক্ষণ পর্যন্ত না কবর দুটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো দুটি মাথাবিহীন মেয়ের শরীর। এক ফোটাও পচন ধরেনি ওগুলোয়। কোনোমতে উঠে উল্টো ঘুরে পাগলের মতো ছুটতে থাকলো সে। অনুভব করছে প্রতি মুহূর্তে তার পিছে রয়েছে মাথা বিহীন দুটো মেয়ের কবর ফুঁড়ে ওঠা লাশ! ……………#পুকুরের_সেই_আতঙ্ক
৭ম পর্ব

রশিদ আর জালালুদ্দিন মাতবর ঘন অন্ধকারের মধ্যেও সাঁতরে এক জায়গায় পৌঁছালেন পানির মধ্যে। রশিদ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘হচ্ছেটা কী এসব?

মাতবরও হাপাচ্ছেন, ‘পিশাচটা ভ্রম সৃষ্টি করে তোমাকে হত্যার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাকে পিশাচ শক্তি এখানে নিয়ে এসেছে নাকি কোনো শুভ শক্তি তোমাকে বাঁচাতে ভ্রম সৃষ্টি করে আমাকে এখানে এনেছে বুঝতে পারছি না।’

‘মানে, ওস্তাদ!’

‘আমাকে এই পুকুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ৬টি কিশোরী মেয়ের অবয়ব। ওরা আমাকে না নিয়ে এলে তোমাকে একা ওই শয়তান শক্তিটার সঙ্গে লড়াই করতে হতো। তাছাড়া পুকুরে হারিয়ে যাওয়া রক্ষা কবজ গুলোও ওরা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পানিতে যে ৬টি মেয়ে পিশাচটার সাথে ছিল ওদের চেহারা একই রকম হলেও এদেরকে ভিন্ন সত্তা মনে হলো! ওরা আমাদের সাহায্য করতে চায়!’

‘আমার গায়ে কোনো কবজ নেই! এখন আমরা কী করবো। পুকুর থেকে উঠে যাব? শয়তানটা মনে হচ্ছে পানির নিচেই আছে এখনো।’

অন্ধকারে রশিদ অনুভব করলো তার শরীরে কিছু বেঁধে দিচ্ছে বুড়ো তান্ত্রিক। স্পর্শ করে বুঝতে পারলো ওস্তাদ তার শরীরের কবজগুলো খুলে তাকে পরিয়ে দিচ্ছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘একি করছেন? আপনি বিপদে পড়বেন!’

‘আমরা একসঙ্গে থাকলে কোনো বিপদ নেই। এখানেই আমরা ভেসে থাকবো কিছুক্ষণ। দেখি শয়তানটার কী ফন্দি আছে! শুধু ওটাকে তোমার ভেতরে ভ্রম সৃষ্টি করতে দেবে না। ভ্রম সৃষ্টি হয় বিশ্বাস থেকে। এখন থেকে যা কিছু দেখবে সবই সন্দিহান হয়ে দেখবে। তবেই ওটা সম্মোহন করতে পারবে না। চিন্তাগুলোকে বিক্ষিপ্ত রাখবে। মন্ত্রগুলোর শক্তি ভুলে যেও না। ওগুলোর সামনে দুনিয়ার কোনো অশুভ শক্তির দাঁড়ানোর স্পর্ধা নেই এটা বিশ্বাস করবে।’

এমন সময়েই চাঁদের সামনে থেকে ভেসে চলে গেল মেঘ। জোৎস্নার আলোয় দৃষ্টিগোচর হয়ে আসতে লাগলো সবকিছু। পুকুরের সামনের দিকের পাড়ের দিকে তাকাতেই তাদের দুজনের শরীর ঝুরে একটা কাঁপুনি বয়ে গেল। ওখানে মাথাবিহীন ৬টি কিশোরী মেয়ে অন্ধের মতো দুটো হাত সামনে নিয়ে বাতাস হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে আসছে পুকুরের দিকে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে না ওরা অশরীরী! কারণ ওদের ছায়া মাটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জোৎস্নার সোনালী প্রতিবিম্বও তাদের নগ্ন শরীরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। ওদের শরীর এভাবে হেঁটে আসছে বিশ্বাস হচ্ছে না রশিদের। নিখোঁজ ৬টি মেয়ের মধ্যে ২টি মেয়ের লাশ গোরস্থানে দাফন করা হয়েছিল আর এই রাতে উদ্ধার হওয়া বাকি ৪টি লাশকে তো পুলিশ থানায়ই নিয়ে গেছে। জালালুদ্দিন মাতবর শক্ত করে চেপে ধরলেন রশিদের হাত। বললেন, ‘ওগুলো অশরীরী নয়! এগুলো ওই মেয়েগুলোর আসল শরীর! কিন্তু ওরা আবার এই অভিশপ্ত পুকুরে ফিরে আসছে কেন! ওরা মৃত, তারমানে ওদেরকে কোনো শক্তি আবার জীবিত করে এখানে পাঠিয়েছে।’

রশিদ আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের কী থামানো উচিত ওদের? হয়তো পিশাচটাই কোনো উদ্দেশ্যে আবার ওদেরকে ডেকে এনেছে এখানে।’

‘আমার মনে হয়…..’

থমকে গেল দুজনেই।মাথাবিহীন ৬টি শরীর প্রায় পুকুরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এমন সময়ই হঠাৎ তাদের চারপাশের পানি অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল। যেন তাদের ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে কিছু। উত্তেজনা অনুভব করলো দুই তান্ত্রিকই। উত্তেজিত হয়ে একে অপরের হাত ধরে এদিক,সেদিক মাথা ঘুরাতে লাগলো দুজনেই। একে একে ৬টি প্রাণহীন মাথা ভেসে উঠল তাদেরকে ঘিরে। কেবল মাথাই ওগুলো, সংযুক্ত শরীর নেই কোনো। চোখ মুদিত এই মাথাগুলোই ওই পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরগুলোর। রশিদ এবং জালালুদ্দিন মাতবর দুজনেই বিশ্বাস করতে চাইছেন এগুলো তাদের ভ্রম। কিন্তু অশুভ শক্তির কোনো আভাস তারা পাচ্ছেন না আর আশেপাশে এখন। পিশাচটা কী খেলা খেলছে তাদের সাথে!

জালালুদ্দিন মাতবর বললেন,’পিশাচটা মেয়েগুলোর মাথাও খায়নি দেখছি। শুধুই শরীর থেকে এগুলো আলাদা করে নিজের কাছে রেখেছিল। এখন আবার ভাসিয়ে দিয়েছে ওগুলো!’

পুকুরের পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো পানিতে মেয়েগুলোর শরীর। রশিদকে ইশারা করে উল্টো পাশের পাড়ে সাঁতরাতে লাগলো বুড়ো তান্ত্রিক। রশিদ বিভ্রান্ত ভাবে তাকে অনুসরণ করে পাড়ে উঠে এলো! কোনো কিছুই তাদের বাধা দিল না।
দুজনেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে পুকুরের দিকে তাকালেন। কিছুমাত্র অস্বাভাবিকতার চিহ্ন নেই আর ওখানে। একদম শান্ত একটা পুকুর মনে হচ্ছে ওটাকে। মেয়েগুলোর শরীর বা মাথা কোথায় গেল কিছুই বোঝা গেল না! ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করলেন তারা। এরপর ধীরে ধীরে হেটে পথ ধরলেন মেম্বার বাড়ির পথে।

সকাল গাঢ় হতেই তুলি আর নুপুরের কবর ফুঁড়ে উঠে যাওয়া আর পুলিশের ভ্যান থেকে ৪টি মেয়ের লাশ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা পুরো আফসারপুরে ছড়িয়ে পড়লো। আতঙ্কিত মানুষ আরও বেশি আতঙ্ক অনুভব করলো। রশিদ বা জালালুদ্দিন মাতবর তাদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিতে না চাওয়ায় রাতে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুমাত্র কাউকে বললো না। শুধু দুই তান্ত্রিকই জানে তারা ভেতরে ভেতরে কতটা দিশেহারা বোধ করছে।

দিনের বাকিটা সময় জালালুদ্দিন মাতবর ঘরের ভেতরেই বন্ধি হয়ে রইলেন। সাধনার সমস্ত উপকরণই তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। তাই নিয়েই ধ্যানে বসে পড়েছেন তিনি। তন্ত্র-মন্ত্রের শব্দ, উৎকট গন্ধ আর ধুয়োয় ভরে আছে ঘরটা। রশিদ তান্ত্রিকতা কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে পুরোনো সেই শখ গোয়েন্দাগিরির দিকে এগিয়ে গেল। গ্রামে ঘুরে ঘুরে পুকুরে পিশাচটার শিকার ৬টি মেয়ে সম্পর্কেই খোঁজ খবর নিতে লাগলো। তার বিশ্বাস পিশাচটার ওই প্রাচীন পুকুরে উদয় হওয়ার পেছনে এই মেয়েগুলোরই হাত আছে। মেয়েগুলোর সমবয়সী অন্যান্য মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে ওদের সম্পর্কে টুকটাক তথ্য নিতে লাগলেন। অবাক হওয়ার মতো বা নতুন কিছুই তারা বলল না।

শেষ বিকেলে গ্রামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে রশিদ জানতে পারে মেয়ে ৬টিকে নাকি গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরেরই একটি জঙ্গল থেকে বের হতে দেখেছিলেন তিনি। জঙ্গলটা তেমন গহীন নয়। জন্তু জানোয়ার বলতে শেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। আরও অনেক মানুষই ফল-ফুল, গাছের ডাল আনতে ওখানে যায় মাঝেমধ্যে। জঙ্গলটা দেখেছিল রশিদ। দূর থেকে ওটাকে গভীর কোনো জঙ্গলই মনে হয়েছিলো। ওখানে যে কেউ যেতে পারে অনুমান। করা যায় না। সে মেম্বার বাড়িতে ফিরে এলো। জালালুদ্দিন মাতবরকে জঙ্গলের কথাটি বলল।

বুড়ো তান্ত্রিক বললেন, বেশ কিছু শক্তির সন্ধ্যান তিনি পেয়েছেন ধ্যান ধরে। তাদের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করেছে প্রাচীন পুকুরটার পিশাচটা সম্পর্কে। ওরাও যা ইশারা করেছে পিশাচটার উৎপত্তি, শিকড় ওই জঙ্গলের ভেতরেই। ওই জঙ্গলে ঢুকে কিছু একটা করে নিজেদের মৃত্যু নিজেরাই ডেকে এনেছে মেয়েগুলো। রাত নামতে আর বেশি দেরি নেই। সন্ধ্যা নামার পরই পিশাচটার শক্তি বেড়ে যাবে। ওটা যে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে মেয়েগুলোর খণ্ডিত শরীর আবার পুকুরে এনেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কী উদ্দেশ্য! রশিদ জালালুদ্দিন মাতবরকে একবার বলেছিল দিনের বেলাতেই পুরো পুকুরটা তারা দুজন মিলে ভালো ভাবে তল্লাশি করবে। হয়তো মেয়েগুলোর শরীর এবং মাথা খুঁজে পাওয়া যাবে। ওগুলো তুলে আনলেই হয়তো ওটার শক্তি কমে যাবে। কিন্তু ওস্তাদ নিষেধ করেছে।

ওটার নিশ্চই ওগুলো লুকোনোর জন্য নিজস্ব কোনো জায়গা আছে। ওটাকে নরখাদকও মনে হচ্ছে না। এর আগেও অনেকে অনুসন্ধান করে মেয়েগুলোর শরীর পায়নি। একটা সময় পর আপনা-আপনিই ওগুলো ভেসে উঠছে।

জঙ্গলটা সম্পর্কে মেম্বার এবং বয়স্ক মানুষদের কাছে জিজ্ঞেস করে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করলো তারা। বয়োবৃদ্ধরা জন্মের পর থেকেই ওটাকে সাধারণ একটা জঙ্গল হিসেবে চেনে। আগে যদিও অনেক গাছ আর জন্তু জানোয়ার ছিল। এই গ্রামের মানুষদের তেমন একটা ওই জঙ্গলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কিছু দস্যি ছেলে মেয়ে প্রায়ই সঙ্গী সাথী নিয়ে ওখানে যায়।

দুই তান্ত্রিকই সিদ্ধান্ত নিল জঙ্গলে ঢুকবে এখন তারা। সন্ধ্যা নেমে আসবে কিছুক্ষণ পরেই। টর্চ জোগাড় করে গ্রামের মানুষকে না জানিয়েই জঙ্গলে প্রবেশ করলো তারা দুজন। গা জুড়ে বাধা আছে রক্ষা কবজ। মনে প্রচণ্ড বিশ্বাস যে করেই হোক পিশাচটাকে ধ্বংস করতেই হবে তাদের। ওটা যে সুযোগ পেলে কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তা তারা বুঝে ফেলেছে।

জঙ্গলটা আসলেই গহীন না। বাইরের দিকে ঘন হলেও যত ভেতরে এগোনো যায় তত উজাড় হয়ে গেছে গাছ-পালা। হাঁটার পথ আছে। দুজনেই শব্দহীন ভাবে জঙ্গলের ভেতরের দিকে এগিয়ে চললো। ……..
……………………………………
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

আমার লেখা ৭০টির উপরে ছোট-বড় গল্প পেজটিতে পোস্ট করা আছে। পেজের পিন পোস্ট থেকে সুচিপত্র দেখে পড়ে ফেলতে পারেন ওগুলো। অধিকাংশই ভৌতিক গল্প। আমার লেখা নিয়মিত পেতে পেজটিতে লাইক করে যুক্ত থাকুন।

পেজ লিংক: Masud Rana – মাসুদ রানা ( টাচ করুন নামে)………………………..
……………#পুকুরের_সেই_আতঙ্ক
৮ম এবং শেষ পর্ব

জালালুদ্দিন মাতবর আর রশিদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ডোবাটার দিকে। এই জঙ্গলের ভেতরে এমন অদ্ভুত একটা ডোবা থাকতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ডোবাটাকে ঘিরে আছে উঁচু ঝোপ আর ঘন গাছের সারি। তাই পথ থেকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না ওগুলোর পরে একটা ডোবা আছে। রশিদ চারদিকে চোখ বুলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে। জালালুদ্দিন মাতবর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন ঝোপটা দেখে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন একটা মন্ত্র। তারপর এগিয়ে যেতে লাগলেন ঝোপটার দিকে। রশিদ লক্ষ্য করলো ওদিকে গাছের সারি বেশ ঘন। সেও ওস্তাদকে অনুসরণ করলো। দুজনে অনেকটা ঠেলে-ঠুলেই ঝোপটা পার হলো। এরপরই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ডোবাটা। আয়তনে ১৫ ফুট লম্বা, ১০ ফুট পাশের হবে। কিন্তু গভীরতা অনুমান করা যাচ্ছে না।

ডোবার পানির রঙের কারণেই এটাকে অদ্ভুত ডোবা মনে হচ্ছে রশিদের কাছে। এত কালো পানি সে আর কখনো দেখেনি। এটাকে পঁচা পানিও বলা চলে না। কোনো দুর্গন্ধ নেই। উল্টো অদ্ভুত একটা সুভাষ ভাসছে নাকের কাছে দিয়ে। সে কৌতূহলতা নিয়ে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকালো। তার মুখও সন্দিহান। মুখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে যাচ্ছে কিছু। রশিদের মনে পড়লো অশুভ শক্তির সম্মোহনের প্রভাব থেকে বাঁচতে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে বা অনুভব করলে মন্ত্রটা উচ্চারণ করে বলেছিলেন তিনি। সেও শব্দহীন ভাবে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়াতে লাগলো ওটা। নাকের সামনে থেকে সুভাষটা উবে গেল মুহূর্তেই। উৎকট একটা পঁচা গন্ধ অনুভব করে নাক কুঁচকে ফেলল সে। ডোবাটার চারদিকে ঘুরে এটার খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতে লাগলো দুজনেই। ডোবাটার পাড় সামান্য ঢালু হয়ে এরপর কুয়োর মতো সোজাসুজি নীচে নেমে গেছে। ঢালু পাড় থেকে পানি অন্তত ৬ ফুট নীচে। তাই ভালোমতো ডোবার কিনার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে না।

কেউ কোনো কথা না বললেও দুজনেই মনে মনে বিশ্বাস করছে এই ডোবাটার সঙ্গে প্রাচীন সেই পুকুর, পুকুরের পিশাচ, ৬টি কিশোরী মেয়ের মৃত্যু জড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। এক অশুভ শক্তির তীব্র অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে দুজনেই। কিনার ঘেষে বসে উঁকিঝুঁকি মেরে ডোবার নিচু অংশটা দেখছিল রশিদ। হঠাৎ তার চোখ কিছু একটায় আটকে গেল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওদিকে তাকান ওস্তাদ!’ টর্চটা জ্বেলে ডোবার পানি থেকে সামান্য উপরের একটা জায়গায় আলো ফেলল সে। জায়গাটা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। সেগুলো বেয়ে নীচে নেমে মিশে যাচ্ছে ডোবার পানির সাথে। অবাক হলো দুজনেই।

এখন বৃষ্টির মৌসুম নয়। পানি আসছে কোথা থেকে! একবার অনুমান করলো, সেই প্রাচীন পুকুরটা থেকে আসছে। না, এটা অসম্ভব! পুকুরটা কত , কত দূরে। মাইলের উপরতো হবেই। কোনো সুরঙ্গপথ এতদূর মাটির ভেতর দিয়ে পানি আনতে পারবে না। জালালুদ্দিন মাতবর বললেন ‘পানির পিশাচ ওটা। একবার যদি ওটা পুরো ক্ষমতা পায় তাহলে তার পক্ষে কিছুই করা অসম্ভব নয়।’

রশিদ অবাক হয়ে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকালো। দুজনের চিন্তার দ্বারা যে একই পথে প্রবাহিত হচ্ছে সন্দেহ নেই। সে বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘সেই প্রাচীন পুকুরটার সঙ্গে এটার পানির সংযোগ আছে বলতে চাইছেন?’

‘পানির সংযোগ নয় শুধু, আমার মনে হচ্ছে এমন একটা পথ আছে যেই পথ দিয়ে স্বয়ং সেই পিশাচটা চলাচল করতে পারে।’ গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন তান্ত্রিক মাতবর।’

‘মানে পিশাচটা কিশোরী মেয়েগুলোর লাশগুলো সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে এখানে নিয়ে আসতো! তাই পুরো পুকুর তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেয়েগুলোকে পাওয়া যেত না! সবই আমাদের অনুমান। কিন্তু মনে হচ্ছে এটাই যুক্তিযুক্ত ঘটনা।’

‘পুরোটা অনুমান নয় রশিদ, ভালো করে জায়গাটা দেখ।’

রশিদ আরেকটু ঝুকে গেল সামনে, টর্চের আলোয় যেখান থেকে পানি চুইয়ে নামছে সেখানে একটা হাতের ছাপ লক্ষ্য করলো। বুকটা ধড়ফড় করে উঠল তার। এমন সময়েই ভূমিকম্প অনুভূত হলো। তার পায়ের নিচ থেকে সামান্য মাটি সরে গেল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পড়ে গেল ডোবার পানিতে। বুড়ো তান্ত্রিক দ্রুত ছুটে এলো কিনারে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়ে রাতের আধারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। আর ডোবার চারপাশে ঝোপ থাকায় জায়গাটা আরও অন্ধকার।

রশিদ প্রায় ডুবে গেল বিচ্ছিরি গন্ধ যুক্ত পানির ভেতর। নাক-মুখ দিয়ে কাঁদা ঢুকে গেছে। কোনোরকম করে মাথাটা পানির উপর তুলে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। পুরোপুরি সোজা হতেই দেখল পানি তার কোমর পর্যন্ত। ডোবাটা বেশি গভীর নয় তাহলে! তার টর্চ আর খুঁজে পেল না। জালালুদ্দিন মাতবর উৎকণ্ঠা নিয়ে তার লাইটের আলো রশিদের উপর ফেলে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময়, হঠাৎ পানির কুলকুল শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। রশিদ একটু এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের যে অংশ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে সেদিকে এগিয়ে গেল। একটা ধাক্কার মতো খেল পানির তীব্র স্রোতে সে। মাটি সরে গিয়ে জায়গাটা ফুঁড়ে নলমুখ সৃষ্টি করে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে লাগলো পানি। কোথা থেকে আসছে! দেখতে দেখতে তার পাশের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। নড়তে গিয়ে রশিদ অনুভব করলো কাঁদা মাটির সঙ্গে শক্তভাবে আটকে আছে তার পা। তীব্র টানে কিছু একটা আটকে রেখেছে যেন ওকে।

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতে হলো তাকে। পানি প্রায় গলার কাছাকাছি উঠে এসেছে। সে যদি সাঁতরাতে না পারে কতক্ষণ আর দম বন্ধ করে পানির নিচে থাকতে পারবে! আর যে ভয়ানক পানি! জালালুদ্দিন মাতবরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন রশিদকে অভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তবে তার কৌতূহলতা জুড়ে ঝাপাঝাঁপি করছে পানির তোর আসছে কোত্থেকে! সে রশিদকে ওখানে আধারে রেখেই ঝোপ পেরিয়ে মাটিতে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলেন পানির চলার কম্পন। অবাক হতে হলো তাকে। যেখান দিয়ে ডোবাটিতে পানি ঢুকছে। সেই বরাবর লম্বা একটি পথ মাটিতে কান পাতলেই পানির চলার শব্দ আর কম্পন শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ মাটির সামান্য তোলা দিয়ে একটি নালার মাধ্যমে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কিসের নালা, কিভাবে সৃষ্টি হলো এটা, পানির উৎসই বা কোথায়! আর এগোলেন না তিনি। ফিরে এলেন ডোবার কাছে। ওটা প্রায় ভরে এসেছে। কিন্তু রশিদ এখনো উঠতে পারেনি! পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে বেগ পেতে হলো না তাকে। ডুব দিলেন মুহূর্তেই। টর্চটা ডাঙায় রেখে এসেছেন।

আধারেও রশিদকে খুঁজেস3 পেতে কষ্ট হলো না তার। সে দম বন্ধ করে ঝুকে নিজের পা ছোটানোর চেষ্টা করছে। বুড়ো তান্ত্রিক আর তার চেষ্টায় অবশেষে মুক্ত হলো পা। দুজনেই ভেসে উঠল পানির উপরে। ভেজা কাপড় আর টর্চ নিয়ে দুজনেই এবার মাটিতে কান পেতে পেতে এগিয়ে যেতে লাগলো নালার উৎস মুখের সন্ধানে।

আসতে আসতে থমকে দাঁড়ালেন আরেকটা ঝোপের সামনে। একবার তাদের মনে হলো আগের জায়গায় ফিরে এসেছেন কিনা! কিন্তু ঝোপ বেদ করে এগিয়ে যেতেই আবিস্কার করলেন একটা বেদীবিহীন কুয়ো। কুয়োর মুখটা খুবই ছোট, মাটির সঙ্গে মিশে আছে। আনমনে কেউ ঝোপে ঢুকলেই পড়ে যাবে ওটার ভেতর। ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল রশিদের। কুয়োয় উকি দিলে অন্তত ৫-১০ ফুট নীচে পানি আছে ভেবেই তাকায় সবাই। তবে এটার পানি প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই!

‘এটার কথাই আমাকে ওরা বলেছিল, এটার খোঁজই আমাদের দরকার ছিল।’ বুড়ো তান্ত্রিকের কণ্ঠে উত্তেজনা।

‘একটি ডোবা, একটি কুয়ো, একটি পুকুর ও একটি দাও পিশাচের সম্পর্ক , রশিদ! সারাদিনে সাধনা করে আমি বিভিন্ন শক্তির কাছে পুকুরের ওই পিশাচটা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। ওরা নিজেদের প্রজাতি সম্পর্কে খোলাসা করে কিছুই বলে না। শুধু এটুকু বলেছিল জঙ্গল, ডোবা, কুয়ো, পুকুর আর পিশাচ। তখন কিছু না বুঝলেও এখন সব পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। আগেকার সময়ের জলে, স্থলে দুই জায়গাতেই সমান শক্তিশালী আর ভয়ঙ্কর পিশাচ ছিল এই দাও পিশাচরা। এরা পুকুরের দেও থেকে ভিন্ন। মানুষের কাছে না গিয়েও তাকে ধোকায় ফেলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এটার। ওটার ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিতই জেনে গেছি এতদিনে। মূলত সেই পিশাচগুলোকে বন্ধি করার একমাত্র উপায় ছিল তাদেরই কৌশল ছল এবং ভ্রম।

একটা ডোবা এবং কুয়ো তৈরি করে তন্ত্র বলে, অনেক সময় পিশাচ চলাচলের পথে ডোবা তৈরি করে মৃত মানুষের শরীর ডোবায় ভাসিয়ে ওদেরকে আহ্বান করা হতো। পিশাচ ডোবায় উপস্থিত হলেই পবিত্র পানি, ফল, পাতা ফেলে মন্ত্র উচ্চারিত করা হতো। ডোবার পানি আতঙ্কে পরিণত হতো পিশাচটার। ওটার শরীর যেন আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। ডোবার চারপাশে সুরক্ষা সৃষ্টির কারণে ওটা ডোবা থেকে বাইরে যেতে পারে না। তখন সাধকদের পরিকল্পনা মতো পিশাচটা ঢুকে পড়ে সুড়ঙ্গে। পৌঁছে যায় কুয়োয়। কুয়োর মুখ আগে থেকেই বন্ধ থাকে। এরমধ্যে ডোবা থেকে সুড়ঙ্গটাও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সাধকের দল মাটি ফেলে।

ফলে আটকে পড়তো পিশাচটা চিরদিনের জন্য। এই পিশাচটা সম্পর্কে আমার সাধনা জীবনের শুরুতে অনেক শুনতাম। কিন্তু এটাই যে সেই পিশাচ তা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেললাম। বুঝতেই পারছো রশিদ পিশাচটার জন্য কুয়ো আর ডোবা এমন জায়গায় এমন ভাবে সাধকরা তৈরি করতো যাতে কোনো সাধারণ মানুষ ওটার কাছে গিয়ে শয়তানটাকে মুক্ত করতে পারে। কিন্তু দেখ হয়তো অনেক যুগ কেটে গেছে পিশাচটা এখানে বন্ধি, সাধকেরা আর এটার খোঁজ রাখেননি। বন জঙ্গল উজাড় হতে হতে এটা মানুষের অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে।

দীর্ঘদিন শয়তানটা বন্ধি থাকায় ওটার প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। হয়তো কিশোরী মেয়ের দল জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই ওটা দূর থেকে কোনো এক ইশারা , ছলের আশ্রয় নিয়ে টেনে এনেছে মেয়েগুলোকে এই কুয়ো মুখের কাছে। মেয়েগুলো কৌতূহল হয়ে পুরোনো কুয়োর মুখ খুলে দিয়েছে। আর মুক্ত হয়ে শয়তানটা নিজের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য নরবলি দিতে থাকে। এই কুয়ো আর ডোবা যেমন পিশাচটাকে বন্ধি করতে পারে। আবার স্বাধীন অবস্থায় এই দুটোই ওটাকে শক্তিও দিতে পারে। কুয়ো এবং ডোবায় পানির স্রোত সৃষ্টি করে একটা অদ্ভুত মায়ার সুড়ঙ্গ ওটা সৃষ্টি করতে পারে যা কিনা শয়তানটাকে সরাসরি এই কুয়ো থেকে কয়েক সেকেণ্ডে সেই প্রাচীন পুকুরে নিয়ে যেতে পারে। এই কুয়ো থেকে ঐ পুকুর পর্যন্ত কিন্তু দীর্ঘ মাটির নিচে দিয়ে সুড়ঙ্গ নেই। এটা স্রেফ এক অলৌকিক পথ বলা যায়। পিশাচটা মেয়েগুলোর লাশ প্রথম এই কুয়োয় এবং পরে ওই ডোবায় এনে রাখতো।’

বিস্ময় নিয়ে জালালুদ্দিন মাতবরের দীর্ঘ বক্তব্য শুনলো রশিদ। অবিশ্বাস্য লাগছে সব কিছু। কিন্তু এই মৃত্যু রহস্যের এর চাইতে আর ভালো ব্যাখ্যা তার নিজের কাছে নেই। বুড়ো তান্ত্রিক যে আন্দাজে এসব কথা বলছে না, তা সে জানে। লোকটা তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছে পিশাচ জগৎ নিয়ে। ভালো করে কুয়ো মুখ খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েই লক্ষ্য করলো রশিদ আসলেই ওটার উপরে একটা ঢাকনা ছিল। কিছুক্ষণ চারপাশে খোঁজ করার পর একটা বড় গাছের গোড়ার কাছে সত্যিই একটা ঢাকনা খুঁজে পেল তারা। লোহা কিংবা স্টিলের ওটা! জং ধরে গেলেও অদ্ভুত ভাষায় ওটার উপর যে কিছু লেখা রয়েছে তা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত , অচেনা কিছু চিহ্নও আঁকা রয়েছে ওটার উপর। জালালুদ্দিন মাতব্বর বললেন, ‘আমাদের দুজনকেই কাজটা শেষ করতে হবে, এবং আজ রাতের মধ্যেই। যত সময় যাবে তত ওটার ক্ষমতা বাড়বে। আমার মনে হয় ৬টি মেয়ের লাশ ওই ডোবাতেই আছে। পানির স্রোত ওটা পাঠিয়েছে লাশগুলোকে নিয়ে যেতে। লাশগুলোকে আমাদের আটকাতেই হবে ডোবার ভেতরে!’

প্রথমেই তারা অপশক্তির বিরুদ্ধে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে ঢাকনাটা কুয়ো মুখের উপর পুনরায় স্থাপন করলো। গাছের ডাল দিয়ে এমন ভাবে ঢাকনাটা চাপা দিল যাতে সহজে না খোলে। এরপর হাজির হলো ডোবাটার কাছে। পুরোপুরি পানিতে ভরে গেছে ওটা। কিন্তু ডোবার মাঝে যে প্রাণীটি ভেসে রয়েছে টর্চের আলোতে ওটার দিকে তাকাতেই দম বন্ধ হয়ে এলো দুজনের। পিশাচটা মাথা বের করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের দুজনের আসার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। কুৎসিত জিহ্বা নড়ে উঠছে ওটার মুখ থেকে। চুকচুক শব্দ ভেসে আসছে ওখান থেকে। দিশেহারা বোধ করলো রশিদ। হঠাৎ পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনতেই আতঙ্কে নিয়ে দুজনেই ঘুরে তাকালো পেছনে। ৬টা মেয়ে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে, ওদের সবার হাতেই ধারালো দা। ওগুলোর গায়ে লেগে আছে রক্ত। যেন সাক্ষী দিচ্ছে অস্ত্রগুলো কারো প্রাণ নেয়ার। মেয়েগুলোর গলার কাছাকাছি কালো দাগের রেখাগুলো ফুটে আছে যেই স্থান থেকে তাদের মাথাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। পিশাচটা পুনরস্থাপন করেছে ওগুলো!

ধারালো অস্ত্রধারী মেয়েগুলো যে অশরীরী নয় তা বুঝতে পেরেই গা হীম হয়ে গেল দুজনের। জ্বলে আর স্থলে দুই দিকেই আতঙ্ক। মেয়েগুলো ভয়ানক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো তাদের দিকে। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখল তারা,, পিশাচটাও এগিয়ে আসছে সমানতালে।

দুজনেই সম্মিলিত ভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করে যেতে লাগলো কিন্তু কোনো লাভই হলো না। হঠাৎ থমকে গেল মেয়েগুলো, পিশাচটাও অনেক গুলো মানুষের হাঁটার শব্দ আর কথা বলার শব্দ কানে আসছে। অসম্ভব! গ্রামের লোকেরা তাদের উদ্ধার করতে এসেছে! কাউকেই দেখা যাচ্ছে না যদিও। রশিদ আর জালালুদ্দিন মাতবর দুজনেই চিৎকার করে নিজেদের উপস্থিতির জায়গাটা জানান দিলেন। মেয়েগুলো উল্টোঘুরে মানুষ গুলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নিশ্চিত বিপদের মুখে পড়তে চলেছে সবাই। বুড়ো তান্ত্রিক রশিদের হাত চেপে ধরলো, ‘গ্রামের লোকগুলোর ভয়ানক ক্ষতি করতে পারবে এই মেয়ে ৬জন, ডাঙায় পিশাচটার ক্ষমতা এখন পুরোপুরি ফিরে আসেনি। এই কারণে এতদিন ধরে মেয়েগুলোকে একে একে খুন করে ওদের নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ওটা। যাতে ওটার ক্ষমতা লাভের পথে কেউ বাঁধা দিলে ক্ষতি করতে পারে ওরা! আর সময় নেই। পিশাচটাকে বন্ধি করতে হবে। তুমি ডোবার সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে যাও, ওটা তোমাকে কুয়োটায় নিয়ে যাবে। পিশাচটা তোমাকে অনুসরণ করে কুয়োয় পৌঁছুবে আর তখন তুমি ৩য় অলৌকিক সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রাচীন সেই পুকুরে পৌঁছে ওটার মুখে এই কবজগুলো বেঁধে দেবে তাহলে আর ওটা মুখ দিয়ে বের হতে পারবে না।’ এই বলে রশিদের শরীরে সুতোর সঙ্গে বাধা কবজগুলো দেখালেন।

এক মুহূর্ত না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লো রশিদ ডোবার পানিতে। পিশাচটাকে পাশ কাটিয়ে হাতড়ে হাজির হলো সুরঙ্গটার মুখে। বেশ প্রস্তুত পথ সুরঙ্গটার কুয়ো পর্যন্ত। পানিতে ভরে আছে এটি। এতটা পথ এক নিঃশ্বাসে পাড় হওয়া অসম্ভব। কিন্তু একটা অলৌকিক শক্তিই যেন সাহায্য করলো তাকে দ্রুত কুয়ো পর্যন্ত পৌঁছুতে। জালালুদ্দিন মাতবর দেখলেন পিশাচটাও যেন রশিদের কাজে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। ওকে অনুসরণ করে পানির নিচে ডুব দিল শয়তানটাও।

ভাগ্যের জোর আর দৈব কোনো শক্তিই যেন রাতটাতে সাহায্য করলো তান্ত্রিক দুজনকে। কুয়ো থেকে অন্ধকারেও পানির ঘূর্ণি অনুভব করে অলৌকিক সুড়ঙ্গ ধরে প্রাচীন পুকুরে পৌঁছে গেল রশিদ এবং বন্ধ করে দিল সুড়ঙ্গ পথটা। পিশাচটা সুড়ঙ্গে ঢুকে যেতেই দ্রুত কমতে লাগলো আবার ডোবার পানি। পানির স্তর সুড়ঙ্গ মুখের নীচে নেমে গেল দেখতে দেখতেই। এমন সময় ঝোপ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো পুলিশের দলটা। তান্ত্রিক বিস্মিত হলেন। কিন্তু সময় নষ্ট করলেন না। দ্রূত নেমে পড়লেন ডোবায় এবং নিজের শরীরের সব কবজ খুলে তা সুড়ঙ্গ পথে বেঁধে বন্ধ করে দিলেন ওটার ডোবায় ঢোকার পথটাও।

পিশাচটা কুয়োয় বন্ধি হয়ে যাওয়ার পরেই ৬টি মেয়ের শরীরই নিষ্প্রাণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয় লোক আর পুলিশের কাছে পরে তারা জানতে পেরেছিল সন্ধ্যার পরই ধারালো অস্ত্রগুলো হাতে মেম্বার বাড়িতে হাজির হয় মৃত মেয়েগুলো। তারা যেন খুঁজছিল কাউকে। সকলে আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি শুরূ করে দেয়। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই আঘাত করেছে দা দিয়ে। তুলিকে জীবিত দেখে তুলির মা ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। কিন্তু ৬জন মিলে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তাকে।। এরপর মেয়েগুলো জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুলিশ এবং গ্রামের লোকেরা অনুমান করে দুই তান্ত্রিক জঙ্গলেই রয়েছে। তাদের হত্যা করতেই মেয়েগুলো মেম্বার বাড়িতে এসেছিল। তারপর তারা সদলবলে জঙ্গলে প্রবেশ করে।

এরপরের কয়েকদিনে মেয়েগুলোকে আবার দাফন করার ব্যবস্থা করা হলো। প্রাচীন পুকুরটা থেকে কুয়োর সুড়ঙ্গ এবং ডোবা থেকে কুয়োর সুড়ঙ্গ শক্ত উপাদান দিয়ে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো। কুয়োর মুখটা আরও শক্ত লোহার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে তার উপর সিমেন্ট, খোয়ার ঘন প্রলেপ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো। জঙ্গলের ঐদিকটায় প্রবেশ নিষেধ করে সতর্ক করে দেয়া হলো সবাইকে।

তিনদিন পর:
আফসারপুর গ্রাম এখন পিশাচটা থেকে নিরাপদ। রশিদ জালালুদ্দিন মাতবরকে বলল, ‘পিশাচটাকে ধ্বংস করা গেল না। আগে সাধকরা যে কাজ করেছে আমরা তাই করলাম শুধু। তারা যদি ডোবাটা মাটি দিয়ে পূর্ণ করে দিত। তাহলে তো পিশাচটার পক্ষে মুক্ত হয়ে অলৌকিক সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করে প্রাচীন পুকুরে ফিরে যাওয়া সম্ভব হতো না। আমরাও একই কাজ করলাম। সব কিছু বন্ধ করলেও ডোবাটাকে মাটি দিয়ে ভরে ফেলছিনা কেন?’

মুচকি হাসলেন বুড়ো তান্ত্রিক, ‘ওই ডোবাটাই কেবল পিশাচটার স্বাধীনতার পেছনের প্রধান বাধা। ওটা না থাকলে আজ এত সহজে ওটাকে আটকে ফেলতে পারতাম না। আমার বিশ্বাস ওটা যদি আর কোনোদিন মুক্ত হয়, নিজের ক্ষমতা জাহির করার আগে ও এই ডোবাটা বন্ধ করার চেষ্টা করবে!’

• * * * সমাপ্ত * * *

)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here