পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব -০৩

#পুকুরের_সেই_আতঙ্ক
৩য় পর্ব

পুকুরের একদম পাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা-মা। আঁখি ভয়ে ভয়ে ডাকতে লাগলো তাদের।
একি! চমকে উঠতে হলো তাকে। ওখানে বাবা-মা কই! তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তুলি আর নুপুর। ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পুকুরের মাঝামাঝি কী একটা যেন ভেসে উঠলো। চুক চুক একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কানে। কী একটা ভয়ানক মুখ ভেসে উঠল পানির উপরে। জ্ঞান হারালো সে। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু দেখতে পেল বিদ্যুৎ গতিতে নুপুর আর তুলি ছুটে এসে তার দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।

পরদিন তুলি আর নুপুরের নিখোঁজের পর যেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল আঁখিকে খুঁজে না পেয়ে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটলো গ্রামে। প্রথমে কেউই বুঝতে পারলো না মেয়েটা কোথায় গেল! আঁখির বাবা একটা পায়ের ছাপ খুঁজে পায়। ওটা গেছে পুকুরের দিকে। তারমানে রাতে পুকুরের দিকে গিয়েছে আঁখি। এরমানে যে কী কারও বুঝতে বাকি রইল না। কী এমন জিনিস যা অমন ভয়ের একটা পুকুরেও একটা মেয়েকে অমন রাতে টেনে নিয়ে যায়! অভাবনীয় বিষয় সকলের কাছে। আঁখির পরিণতি যে নুপুর আর তুলির ব্যাতিক্রম নয় তা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল সারাদিন ভরে তাকে খুঁজেও কোথাও না পেয়ে। পুকুরে নেমেও কয়েকজন খোঁজ চালালো তার লাশের। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

গ্রামের সকলে আতঙ্ক নিয়ে আঁখির মাথাবিহীন লাশটি পুকুরে ভেসে ওঠার জন্য ৩ দিন অপেক্ষা করতে লাগলো। তিন দিন, এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। আঁখির লাশের কোনো হদিসই মিলল না। লাশ ভেসে উঠল না দেখে সকলে অবাকই হলো। সে কী মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে তাও কেউ অনুমান করতে পারছে না। এরপর আরও বেশ কিছুদিন কেটে গেল আঁখির কোনো খোঁজ আর পাওয়া গেল না।

পুকুর থেকে দুটো কিশোরীর মেয়ের নিখোঁজ হওয়াটা গ্রামের মানুষের কাছে যেমন বিস্ময়কর। তারচেয়ে বিস্ময়কর তিনদিন পর তাদের মাথাবিহীন লাশ পুকুরে ভেসে ওঠা। এখন আরেকটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে আঁখির উধাও হওয়ার মধ্য দিয়ে। এর পেছনে কে বা কী আছে তা কেউই অনুমান পর্যন্ত করতে পারছে না এখন পর্যন্ত। পুকুরে সেদিন শেষ দুপুরে যে ৬জন কিশোরী মেয়ে গোসল করতে নেমেছিল তারা সবাই যে একে একে পুকুর থেকে নিখোঁজ হচ্ছে এই সূত্রটাও কেউ ধরতে পারছিল না। ধরতে পারলে হয়তো তাদের উপর নজরদারি করে এই রহস্যের সামান্য কিনারা হলেও খুঁজে পেত। ৬জন কিশোরীর বাড়িই এই প্রাচীন পুকুরটাকে ঘিরে খানিকটা তফাতে। এরমধ্যেই তাদের তিনজন পুকুরের অজানা আতঙ্কের শিকার হয়েছে। দুজনের লাশ খুঁজে পেলেও আঁখিরটা পাওয়া যায়নি।

এরপর কেটে গেছে ৭ মাস। আফসারপুর গ্রাম এখন আতঙ্কের গ্রাম। প্রাচীন সেই পুকুরের আশেপাশে যাওয়া সবার জন্য নিষিদ্ধ। নুপুর, তুলি, আখি এর পর তাদের বাকি তিন খেলার সঙ্গী আসমা, রেখা, মুক্তাও নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে এক মাস, দেড় মাস বিরতিতে। বলাই যায় তুলি আর আঁখির সংঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে তাদের সাথেও। হয়তো আপন চেহারার রূপ নিয়ে আসা কিছুই ওদের পুকুরে নিয়ে গিয়েছিল গভীর রাতে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তার আঁচও করতে পারেনি। নিখোঁজ হওয়ার পর পুলিশ, স্থানীয়রা বাড়ি থেকে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে নিশ্চিত হয়েছে যে মেয়েটা পুকুরের দিকেই গেছে রাতে। খুঁজে পাবে না জেনেও পুকুরে অনুসন্ধান চালানো হয়। গ্রামে গ্রামে খোঁজ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করে থাকে পুকুর থেকে যেকোনো এক অবস্থাতে লাশটা ভেসে উঠবে। কিন্তু দিনের পর দিন চলে যায়। আঁখির পর বাকি তিনজন মেয়েও উধাও হয়ে যায় কিন্তু তাদের লাশ আর কেউ খুঁজে পায় না।

তখন গ্রামের মানুষ এবং পুলিশ একটি সূত্র অনুধাবন করে বিস্মিত হয়ে পড়েন। যে ৬জন সেদিন দুপুরে গোসল করতে নেমেছিল তারাই কেবল এই কয়দিনে নিখোঁজ হয়েছে। গ্রামের অন্য আর কেউ এই আতঙ্কের শিকার হয়নি। তাছাড়া এই ৬জনই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল একে অপরের। সকলেই প্রায় সমান বয়সের। গ্রামের কারো সন্দেহ নেই যে কোনো পিশাচ কিংবা অশুভ শক্তির কাজ এটি। যার বাস ওই পুকুরে। পুলিশের লোকেরা মুখে বলতে না পারলেও হাবভাবে তাদের সাথে একমত প্রকাশ করছেন। কোনো মানুষের পক্ষেই প্রথম দুটো খুন করা অসম্ভব। এটার সমাধান করা যে তাদের পক্ষে সম্ভব না তাও বুঝতে পারছেন।

এর সমাধান করবার জন্য গ্রামের লোকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা ডাকবেন কোনো তান্ত্রিককে। যে এইসব অশুভ শক্তি থেকে বাঁচাতে পারবে তাদের সকলকে। ভেদ করতে পারবে এই হত্যা আর নিখোঁজের রহস্য।দেখা যাক তিনি এই পুকুরে অশুভ কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পায় কিনা! আজকাল এইসব অঞ্চলে জালালুদ্দিন মাতবর নামের একজনের নাম বেশ শোনা যায়। লোকটা নাকি এক প্রকার পিশাচ বিশেষজ্ঞ। তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই এই অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে কাটিয়েছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেশ কষ্ট করতে হলেও যোগাযোগ করা গেছে।

পুকুরে শেষ যে মেয়েটি মারা গিয়েছে তারপর ২ মাস কেটে গেছে। এরমধ্যে না পাওয়া গেছে শেষ নিখোঁজ হওয়া ৪জন মেয়ের লাশ আর না ঘটেছে নতুন আর কোনো দুর্ঘটনা। আফসারপুরের মানুষ পুরোপুরি আতঙ্কিত হওয়ায় এবং একজন নিযুক্ত চৌকিদার এর পাহারার কারণে প্রাচীন পুকুরটি এখন প্রায় পরিত্যাক্ত। কেউই এদিকে খুব একটা আসে না।

সন্ধ্যার প্রায় কাছাকাছি। চৌকিদার আলম মিয়া পুকুরটার আশেপাশের জায়গা চক্কর দিচ্ছেন। নুপুর আর তুলির লাশ যখন পুকুর থেকে তোলা হয় তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন। পুকুরের যেই দানবটারই কাজটা হোক না কেন ওটার ভয়াবহতা বুঝতে তার বাকি নেই। পরের ৪জন মেয়েও যে দানবটার খাবারের শিকার হয়েছে তা নিয়েও তার মনে সন্দেহ নেই। বাচ্চা ৬টি মেয়ের জন্য তার মন খুবই খারাপ হয়েছিল। আর পিশাচটার জন্য রাগ আর ক্ষোভ।

তারও একটা ১৫ বছরের মেয়ে পুকুরে নেমে সাপের কামড় খায়, এরপর বাড়িতে ছটফট করতে করতে মারা যায় অনেক বছর আগে। সে নিজ থেকেই তাই সুপারিশ করে পুকুরের এই পাহারাদারীর কাজটা নেয়। ৬জনের পর আর একজনকেও নিখোঁজ হতে দেবে না সে। দিন-রাত নজর রাখে পুকুরটার দিকে। কোনো অল্প বয়সী মেয়ে আশেপাশে আসলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। আজ রাতটা চাঁদের রাত হবে। বিকেলের শেষ আলোয় পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন আলম মিয়া। চারদিকে এত গাছ তবুও বাতাস নেই।

হঠাৎ খেয়াল করলেন পুকুরের মাঝখানের এক স্থানের পানি বেশ জোরে কেঁপে পুরো পুকুরে ছড়িয়ে পড়ছে, জায়গাটা থেকে এবার পানির বুদবুদ উঠছে। পুরোই অস্বাভাবিক ঘটনা। পুরো পুকুরের পানিতে ভয়ানক তাণ্ডব শুরু হলো। পানি ফুলে ফুলে উঠছে।পাড়ে পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। পুকুরের মাঝামাঝি জায়গায় পানি চক্রাকারে ঘুরছে। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। অথচ পুকুর! হঠাৎই শান্ত হয়ে উঠল আবার পানি। পুকুরের পানি ভেদ করে পুকুরের মাঝামাঝি জায়গায় ভেসে উঠল ৪টা মেয়ের লাশ। মাথাবিহীন লাশ! কয়েক মুহূর্ত মাথা ঝিম মেরে রইলো আলম মিয়ার। এরপরই চিৎকার করে ছুটতে লাগলেন গ্রামের দিকে। আফসারপুরকে গিলতে শুরু করলো পুকুরের সেই আতঙ্ক। রাত নেমে আসছি।

রাত ৯টার কিছু বেশি হবে। একটা সি.এন.জি এসে থামলো আফসারপুরের শেষ মাথায়। সি.এন.জির ড্রাইভার তর্ক করছেন দুজন আরোহীর সঙ্গে। ড্রাইভার লোকটা রাগে ফুঁসছে আর বলছে আর ভেতরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। এদিকে কিছুই চেনে না সে। রাতে ফিরতে ঝামেলা হবে তার। সি.এন.জির ভেতরে বসা কিছুটা বয়স্ক যাত্রী বার বার বলছেন আর ১০ মিনিটের পথ কেবল। তিনি চেনেন। এখানে নামিয়ে দিলে হেঁটে যেতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে তাদের। ড্রাইভার কিছুতেই যাবে না। তর্ক থামছেই না। লোকটা ভাবছে, লোক দুটোকে দেখেই পাগল মনে হয়েছিল তার। কেন যে গাড়িতে তুলতে গেল। চেলা-গুরু মনে ওরা। কেমন তান্ত্রিকের মতো গেরুয়া পোশাক পরা অদ্ভুত সাজ-সজ্জার লোক দুজনেই। কথা-বার্তার ধরনও উল্টা-পাল্টা।

যাত্রীর ২য় জন বয়সে কম, লোকটা এবার খেঁকিয়ে উঠল, ‘যা বেটা, নেমে যাচ্ছি। এই নে তোর ভাড়ার টাকা! আমাদের তুই চিনতে পারিসনি, দেখবি কেমন ভূত লেলিয়ে দেই তোর পেছনে! চলেন নেমে যাই ওস্তাদ।’ এমন পরিবেশে এমন কথা শুনে ভয়ে মুষড়ে গেল ড্রাইভার। ফিরতে হলেও দীর্ঘ নির্জন একটা পথ দিয়ে ফিরতে হবে তাকে। ‘নামতে হইবো না, যাইতাছি!’ আর তর্ক না করে এগিয়ে চললো সে সামনের দিকে। মনে মনে বংশ উদ্ধার করে দিচ্ছে দুজন যাত্রীর।

জালালুদ্দিন মাতবর বিরক্ত হয়ে রশিদের দিকে তাকালো। তান্ত্রিকের কাজ হচ্ছে মানুষের মন থেকে ভূত-প্রেত, পিশাচের ভয় দূর করা। রশিদকে এতদিন শেখানো তন্ত্র শিক্ষার কোনই ফল নেই। ও তান্ত্রিক হয়ে উল্টো মানুষকে ভূত লেলিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়! অবশ্য এটা করা ছাড়া ড্রাইভারও আর এগোত কিনা সন্দেহ।

এসব চিন্তার চাইতে বড় চিন্তা তারা যে কারণে আফসারপুরে এসেছেন সেটা। প্রাচীন একটা পুকুরে ৬জন কিশোরী নিখোঁজ হয়েছে গত এক বছরে। সাধারণ কারো কাজ হলে নিশ্চই তাদের ডাকা হতো না। অশুভ শক্তি! কিন্তু একটা প্রাচীন পুকুরে এটা হঠাৎ উদয় হলো কেন! আর কিশোরী বয়সের মেয়েদেরই নিয়ম মেনে নিজের শিকার বানাচ্ছে কেন! ৬জনের ৪জনের লাশ নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি! গ্রামের দিকে যতই গাড়ি এগোচ্ছে তাদের চোখে ভিড় আর লোকের চঞ্চলতা ধরা পড়লো। আজ আবার কিছু হয়েছে নাকি! ………………………………………………
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here