#কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব:৮)
♡আরশিয়া জান্নাত
রুদ্রমূর্তি ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া মানুষটার সাড়াশব্দ না পাওয়াটা হজম করতে না পেরে পিহু সামনের রুমে উঁকি দিয়ে দেখে মোহনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ওদিকে ইসরাত উঠে এসে বললো: কেমন আছ মোহনা আপি? কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি!
না মানে আপনারা এখানে আপনাদের তো চিনি না আপনারা আসবেন তাও জানিনা মানে কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিনা
বোনের এমন মিইয়ে যাওয়া বোকা বোকা কথা শুনে পিহু আর হাসি থামাতে পারলো না। খিলখিল করে হেসে উঠলো। সবার দৃষ্টি গিয়ে পিহুর উপর নিবদ্ধ! আজাদ সাহেব হেসে বললেন, মোহনা আসলে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেনা। আমিই সব ক্লিয়ার করি। আমরা রাইয়্যানের ফ্যামিলির লোক। আমি ওর বাবা আর এরা ওর ভাই বোন আর মা। হুট করে না বলে আসার জন্য দুঃখিত।
মোহনা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো, ওমা ছি ছি দুঃখিত বলছেন কেন? আস্সালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আস্সালামু আলাইকুম আন্টি।আপনারা ভালো আছেন? পিহু ওনাদেরকে কিছু দেওয়া হয়নি?
রেহানা:এতো ব্যস্ত হয়ো না, তোমার মা তো একটার পর একটা দিয়েই যাচ্ছেন বললাম একটু এসে বসতে। যাই হোক তুমি অন্তত বসো।
পিহু: আন্টি আপনারা একটু বসেন আপু ফ্রেশ হয়ে আসুক। আসলে অফিস থেকে ফিরেই এখানে এসেছে তাই,,
রেহানা: হ্যাঁ যাও সমস্যা নেই। পিহু তোমার মাকে ডাকো তো। আমরা যে কাজে এসেছি তা নিয়ে কথা বলাই তো হচ্ছে না।
রাইয়্যান অতি শোকে পাথর হয়ে বসে রইলো। কি ঘটছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছেনা। মোহনার জন্য তার পরিবারের সবাই এতো আগ্রহী কিভাবে হলো সেটা আসলেই রহস্য! ইলহাম ও দেখি বারবার তার দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিচ্ছে। ভাবখানা এমন যে রাইয়্যান তার পছন্দের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে করতে যাচ্ছে!
পিহু তার মাকে ডাক দিতেই তিনি বললেন, হ্যাঁ রে পিহু মোহনা কিছু বলছে? চিনে ওগোরে? আমি তো কিছুই বুঝতাছিনা। ও তো ভাববো আমি ওগোরে আনছি!
মা টেনশন নিও না। মনে হইতাছে এবার তোমার বড় মাইয়ার বিয়া কনফার্ম। তুমি যাও দেখো উনারা কি কইতে চায়।
মোরশেদা বেগমের মুখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
।
মোহনা ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো কি হলো এটা! রাইয়্যান সাহেব হুট করে পরিবার নিয়ে তার বাসায় কেন এসেছে? তাদের ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে বিয়ের আলাপ,,,, কিহ সত্যিই তাই? ওনারা বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছেন?? এটা কি আসলেই সত্যি সে স্বপ্ন দেখছে না তো? যদি স্বপ্ন ও হয় এই স্বপ্ন সে আজীবন দেখতে চায় ঘুম না ভাঙুক ভোর না হোক।
আপু আর কতক্ষণ ওয়াশরুমে থাকবি তাড়াতাড়ি বের হ।
মোহনা বের হয়েই পিহুকে জড়িয়ে ধরলো।
পিহু আমি স্বপ্ন দেখছি? উনি এখানে কিভাবে? আমার কেমন বুক ধড়ফড় করছে দেখ!
যা ভেবেছিলাম তাই। এই সেই ছেলে তাই না? তুই তো বলিস নি তোদের মাঝে এতোকিছু হয়ে গেছে যে সরাসরি বিয়ের প্রপোজাল?!
সিরিয়াসলি? উনারা বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছে? কে বলছে তোকে? আর কার জন্য!
আঙ্কেল বললো। উনারা তো মাকে বলছে আজকেই আংটি পড়িয়ে যাবে। তোকে নাকি তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
ছেলে কোনটা বুঝেছিস তো? ঐ যে ব্লু শার্ট পড়ে ছিল ঐটা তো?
হ্যাঁ ঐটাই।
আল্লাহ আমার সাথে কি হচ্ছে এসব! আমি এতো ভালো ভালো ঘটনা হজম করবো কিভাবে পিহু??
ইশ আপু সবসময় এভাবে বলিস না তো। চটজলদি ঐ সবুজ শাড়িটা পড়ে ফেল তো। ঐটা পড়লে তোকে অনেক সুন্দর লাগে।
মোহনা দুচোখ ভর্তি জল নিয়েও অনবরত হেসেই যাচ্ছে। এতো আনন্দ কোথায় রাখবে সে?
।
।
দেখুন মিস মোহনা আমি আসলেই জানিনা কিভাবে কি বলে শুরু করবো। ঘটনাটা এতোটাই কাকতালীয় যে আমি নিজেই হতবাক। আমি জানি আপনি আমাকে অনেকদিন ধরেই পছন্দ করেন। আপনার জন্য এই ঘটনাটা অনেক সুখকর বটে। কিন্তু আমি জানি না আমি কীভাবে রিয়েক্ট করবো। শুধু এইটুকুই বলবো I’ll need time. প্লিজ আমাকে কোনোকিছুর জন্য জোর করবেন না। আমার বাবা মায়ের পছন্দে আমি বিয়েতে মত দিলেও মন থেকে মেনে নিতে সময় লাগবে। আশা করি আপনি বিষয়টি সহজভাবে নেবেন।
মোহনা হেসে বললো, আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে তাই না? দেখুন আমি ট্রায়াঙ্গেল প্রেমে থার্ড পার্সন হতে ইচ্ছুক নই। আপনার যদি কেউ থাকে তবে এখনই ক্লিয়ার করেন। আর বাবা মায়ের জন্য স্যাক্রিফাইজ করতে গিয়ে অন্য একটা মেয়ের জীবন বরবাদ করবেন না। আমি আপনাকে পছন্দ করি কি করিনা সেটা ফ্যাক্ট না। আমি অনেকদিশ আপনাকে ফলো করি, আপনি বরাবরই আমাকে ইগ্নোর করেছেন। এখানে কষ্ট পেলেও সেই কষ্টের দায়ভার আপনার ছিল না। কারণ আপনি আমার কেউ না। কিন্তু বিয়ের পর দায়ভার থাকবে। আপনার ছোটখাটো ব্যাপারও আমার জন্য ম্যাটার করবে। তাই আমি বলবো এখনই সব ক্লিয়ার করুন।
আপনি এতোটা স্ট্যাট ফরওয়ার্ড আমি জানতাম না। আমি অবশ্য কিছুই জানিনা আপনার সম্পর্কে। যাই হোক যেহেতু আপনার সঙ্গে আমার ফ্যামিলি কমিটমেন্ট করতে চাইছে তাই আপনার জিজ্ঞাসা করার এবং জানার রাইট আছে। আমি একজনকে ভালোবাসতাম তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ ছয় বছরের সম্পর্ক। সেই ইন্টার লাইফ থেকেই আমরা একসঙ্গে ছিলাম। সে এখন বাংলাদেশের টপ মডেল।খুব শীঘ্রই তার মুভি লঞ্চ হবে। সেই রুপালি জগতে আমি আসলে টিকে থাকতে পারিনি। কিছুদিন আগেই সে অফিশিয়ালি ব্রেকাপ করেছে। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আমি তার ফেরার অপেক্ষা করছি।
মোহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,ফেরার অপেক্ষা করছেন তার মানে তাকে ফেরানোর প্রচেষ্টা আছে! আপনি এক্সপেক্ট করছেন সে ফিরবে তাহলে এখনই বিয়ে কেন? এখানে আমাকে না ভেবে অন্য একটা মেয়েকে ভাবুন। তখন কি করতেন? তাকে বিয়ে করে নিতেন পরিবারের পছন্দে? দ্যান আপনার এক্স ফিরলে? ডিভোর্স?
আমাকে এমন ভাববেন না মিস মোহনা!
আপনার কথার পিঠে তো এমন কথাই আসছে রাইয়্যান সাহেব!
আমার ফ্যামিলিতে ডিভোর্স বলে কোনো শব্দ নেই। আমি মানছি আমার দোষ আছে আমি পরিবারকে শক্ত গলায় কিছু বলিনি। আসলে কি বলবো এমন একজনের কথা কিভাবে বলবো যে আমার জীবনে আছে কি নাই তাও জানিনা! ছয় বছরের অভ্যাস ভোলা এতো সহজ না আসলে।
বেশ তবে আপনাকে কিছু বলতে হবেনা আমিই বলে দিচ্ছি এই বিয়ে হবেনা। আপনি আপনার মানুষটার অপেক্ষা করুন। যদি কখনো মনে হয় অভ্যাস ভুলতে পেরেছেন কিংবা আপনি মুভ অন করতে চাইছেন তখন নাহয় আমার কথা মনে করবেন। যদি ইচ্ছে হয় আর কি!
আপনি আমায় ভুল বুঝছেন আমি হয়তো আপনাকে বোঝাতে পারিনি। আমার কথায় হার্ট হবেন না প্লিজ।
মোহনা মুচকি হেসে বললো, আপনি হার্ট হবার মতো কিছু বলেননি বরং আপনাকে ধন্যবাদ আগেই সবটা বলেছেন। আমি খুব হিংসুটে রাইয়্যান সাহেব। আমি যাকে ভালোবাসি তার মনের সবটুকু অংশে কেবল নিজেকেই দেখতে চাই। সেখানে অন্য কারো বসতি আমার সহ্য হবেনা। ভালোবাসার ক্ষেত্রে বোধহয় প্রতিটা মেয়েই খুব হিংসুটে হয়। আমি আপনার স্বপ্নে বিভোর এটা সত্যি, আপনাদের প্রপোজালটা আমার জন্য মেঘ না চাইতেই জলের মতোই। আমার বহুদিনের সুপ্ত বাসনার এমন বাস্তবচিত্র দেখবো এ আমি কল্পনাও করিনি। এইটুকু সুখ ক্ষণস্থায়ী হলেও আজীবন ভালো স্মৃতি হয়ে থাকবে। কিন্তু আজ যদি আমি লোভীর মতো আপনাকে চেয়ে বসি ভবিষ্যতে আপনি ছেড়ে গেলে আমার সেদিন টিকে থাকা সম্ভব হবেনা। তাই এখনই সবটা শেষ হওয়াই উত্তম। ভালো থাকবেন।
মোহনা দ্রুত গতিতে স্থান ত্যাগ করলো। রাইয়্যান একটিবারো দেখলো না সবুজ রঙের শাড়িটায় মোহনাকে কেমন প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি মনে হয়। কাজল কালো চোখ দুটো কেমন মায়ায় ঘেরা, হাতের ক’গাছি কাঁচের চুড়ি কি দারুণ সুর তুলে ঝনঝনিয়ে উঠে। অবাধ্য চুলগুলো মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে যায়। হয়তো খেয়াল করলে নিশ্চিত প্রেমে পড়তো এই পাথররূপী নরম মনের মেয়েটার। যে তাকে ভালোবেসে কত রাত বালিশ ভিজিয়েছে, প্রার্থনায় চেয়েছে একটা অলৌকিক ঘটনা। তার প্রার্থনা ঠিকই কবুল হয়েছে কিন্তু অপ্রাপ্তির পয়গাম নিয়ে! কেউ কি জানবে মেয়েটার আজ মন ভেঙে খানখান হয়ে যাবে পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রণায়??
চলবে,,,,