কালো মেঘে রোদ্দুর পর্ব ৭

#কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব:৭)

♡আরশিয়া জান্নাত

জীবনে পঁচিশটা বসন্ত কেটে গেছে মোহনার। তার বাবা মারা যাওয়ার সাত বছর পূর্ণ হলো। এই সাতটা বছর এই কঠিন পৃথিবীতে টিকে থাকার পথ সহজ ছিল না। আজ যদি তার বাবা বেঁচে থাকতো এতোদিনে সে নিশ্চয়ই কারো ঘরণী হয়ে সংসার সামলাতো কোল জুড়ে থাকতো তার আদরের সন্তান। বিয়ে নিয়ে তার ফ্যান্টাসি নেই তা ভুল। সেও একসময় স্বপ্ন দেখতো তার একটা ভরা সংসার হবে। ভাসুর/দেবর-ননদ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে বড় সংসার। সারাদিন হৈ হৈ রৈ রৈ ভাব থাকবে। বিকালে চা খেতে বসে আড্ডা, কোথাও যেতে ইচ্ছে হলে দল বেঁধে যাওয়ার জন্য বাইরের কাউকে প্রয়োজন হবে না; আরো কত কি বেনিফিট! আর সবচেয়ে মজার হলো অনেক মানুষের ভীড়ে বরের সঙ্গে লুকোচুরির প্রেম! হাহাহা কত কি ভাবতো সেই মোহনাটা।
এখন আর এসব নিয়ে ভাবার ফুরসত হয় না। জীবনটা যে বড্ড কঠিন। নিজের চাচাদের বেইমানি দেখে বুঝে গেছে রক্তের সবাই আপন হয় না। সত্যি বলতে সে এখন কাউকেই মন থেকে ভরসা করতে পারেনা। সে ঠিকই জানে তার ভাবনাজগতে যে সুন্দর একটা কাঠামো আছে,সুন্দর একটা সংসার আছে তা কখনোই সত্যি হবে না। এই পৃথিবীতে কোনোকিছুই মসৃণ নয়। সম্পর্কে টানাপোড়ন আছে, তিক্ততা আছে, অভাব অনাটন আছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বরের ভালবাসা পাওয়াটা। সেই সৌভাগ্য সবার হয় না। পরিপক্ব মোহনা সবটা বুঝেও রাইয়্যানের ক্ষেত্রে কেমন অবুঝ হয়ে যায়। সে ঠিকই স্বপ্ন বুনে যায় রাইয়্যান তাকে খুব ভালোবাসবে। আদরে আগলে রাখবে, সম্মান করবে। পাশে দাঁড়িয়ে বলবে, চিন্তা করোনা আমিতো আছি।
সেদিন মাইশার ভাই কতো কথা বললো অথচ একটাবার বললো না তোমার পরিবার মানেই আমার পরিবার হবে তাদের দায়িত্ব আমি নেবো! কিংবা তাদের নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে কেন আমি তো আছি!
মোহনা জানে এমন প্রত্যাশা করা ঠিক না তবুও তো। তার জীবনে এই সান্ত্বনার বাণী আজ পর্যন্ত কেউ আওড়ায়নি।মাঝেমধ্যে মনে হয় কি এমন হয় মিছেমিছি কেউ একটু সান্ত্বনা দিলে? তার কালো মেঘে ঢাকা জীবনটাতে রোদ্দুর হয়ে কেউ এসে আলোকিত করলে? ইশ বড্ড বেশি চাহিদা তার।


একটা কথা বলি মা?

বল

তুমি আপুকে কতখানি ভরসা করো?

যতখানি করা উচিত ততখানি

এটা কোনো উত্তর হলো?

তো আর কিভাবে বলতাম?

মা তুমি কি জানো আমার ট্রিটমেন্টের টাকা কিভাবে ম্যানেজ হয়েছে?

না জানার কি আছে? আল্লাহ মানুষরূপী একজন ফেরেশতা পাঠাইছে। নাহয় এখনের যুগে কেউ এতোটাকা দান করে?

এখনের দিনে মানুষ আরো বেশি দান করে। পার্থক্য সেসব খবর ছড়ায় না। তবে মা তুমি কিভাবে বিশ্বাস করলে আপুকে। এমনো তো হতে পারে আপু অসৎ উপায়ে টাকা ম্যানেজ করেছে কিংবা কোনো কিছুর বিনিময়ে? মানে শর্তসাপেক্ষে?

মোরশেদা বেগম রাগাশ্রিত চেহারা করে তাকালেন ছোটমেয়ের দিকে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
তোর চিন্তাভাবনা দেইখা আমি অবাক হইতাছি। মাইয়াডা তোর লাইগা দিনরাত এক কইরা খাটছে, কতজনের দুয়ারে গেছে সাহায্যের আশায়, আর তুই কি না কি সব ভাবতাছোস? শোন পিহু তোর বোইন খাইট্টা খাইতে রাজী আছে কিন্তু নিজেরে বিলাইয়া কিছু করার দিকে নাই। যদি থাকতো তাইলে ওরে এতো কষ্ট কইরা সংসার চালাইতে হইতোনা। পায়ের উপর পা তুইলা বইসা খাইতে পারতো। আমি আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া জানাই আমার গর্বে এমন রত্ন জন্মাইছে।

মা তুমি চেতো কিজন্য আমিতো কথার কথা বলছি তোমার মনের খবর জানতে। তুমি ভুল বুঝিওনা।

আজ বলছোস বলছোস আমি যাতে আর কোনোদিন এই কথা না শুনি। শোন পিহু তোর বোইনরে কোনোদিন কষ্ট দিবি না। তুই যদি তোর শরীরের চামড়া দিয়াও জুতা বানাই দেস তোর বোইনের ঋণ শোধ করতে পারবিনা মা। বড় বোইনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিস বেইমানি করিস না কোনোদিন। আমার কাছে ওয়াদা কর কোনোদিন মোহনার মনে কষ্ট দিবি না।

উফফ মা তুমিও না কিসব যে বলো। আমি জানিতো আমার বোন কি কি করছে আমি ওরে কোনোদিন কষ্ট দিমুনা প্রমিজ।

তোদের রক্ত খারাপ রে মা। তোর চাচাগোরে দেখ কেমন কইরা সব ভুইলা গেছে। তোদের বাপে সংসার সংসার কইরা আজীবন খাইট্টা গেছে। ভাইগোর জন্য জানপরাণ আছিল। তোর বড় চাচার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না যখন তখন তার সংসারের অর্ধেক খরচ তোর বাপে টানছে। সেই ভাইয়ে তার পরিবারের খোঁজ নেয়না সম্পত্তির ভাগ দিতে হইবো ভাইব্বা!
তুই এমন হইস না মা। বিপদের দিনে যে সাহায্য করে তার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবি। মুরুব্বিরা বলতো কারো সাহায্য কইরা ভুইলা যাইও কিন্তু কারো সাহায্য লইয়া ভুলিও না।

মায়ের চোখে পানি দেখে পিহুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সে মোটেও মোহনাকে খারাপ বোঝাতে কথাগুলো বলেনি। সে আসলে জানতে চেয়েছিল তার মায়ের বিশ্বাস আছে কিনা। কারণ এই পৃথিবীতে একমাত্র মায়ের ভরসাই আসল তাদের জন্য। অন্যরা যা ইচ্ছে বলুক।
________

উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মায়াবী মুখ। চেহারায় আহামরি সৌন্দর্য না থাকলেও তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগছে। কেমন চক্ষু শীতল করার মতো মোহনীয় মুখ। চোখ দুটোর ঘন পাঁপড়ি যে কারোরই নজর কাড়বে প্রথমে।

“এমন মিষ্টি একটা মেয়ের খোঁজ পেলে কি করে?” আনমনেই বলে ফেললেন মিসেস রেহানা।
আজাদ সাহেব বিজয়ের হাসি হেসে বললেন, পছন্দ হয়েছে?

অপছন্দ হবার মতো না তবে চেহারা দেখলেই তো হবে না। মেয়েটা কেমন তার পরিবার কেমন বংশমর্যাদা আছে কি না, এসব সম্পর্কেও তো জানতে হবে।

মেয়েটা সংগ্রামী বলতে পারো। একা হাতে সংসার সামলায়। জানো রেহানা ওকে দেখে আমার বড় আপার কথা মনে পড়ে যায়। তুমি তো জানো আমার বড় আপা কিভাবে আমাদের ভাইবোনদের মানুষ করেছিলেন। মা মারা যাওয়ার পরো আমরা মায়ের অভাব বুঝিনি। বড় আপা আমাদের পুরো সংসারটাকে একা আগলে রেখেছিলেন। বাবাতো ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিলেন মায়ের শোকে শোকে। কোনোরকম ক’টা টাকা দিয়েই দায়িত্ব ঘোচাতেন। আমি এই মেয়েটার মাঝে আপার সেই রূপটাই দেখেছি। যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি চাই ও আমাদের সংসারে আসুক।

তুমি যখন এমন করে পছন্দ করেছ আমার আর আপত্তি নেই। রাইয়্যানকে বলে দেখো ও কি বলে। ওর পছন্দ হলে বিয়ের ব্যাপারে আর দেরি করবোনা।

তুমি সরাসরি দেখতে যাবে না?

তোমার পছন্দের উপর আমার আস্থা আছে। তবে আমরা সবাই যাবো সরাসরি বাগদানের জন্য।

আজাদ সাহেবের মনটা ভরে গেল।


রাইয়্যানকে যখন বলা হলো তার জন্য মেয়ে পছন্দ করা হয়ে গেছে খুব শীঘ্রই তাদের বিয়ের কথাবার্তা এগোবে। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারলো না। এই দিনটারই ভয় পাচ্ছিল সে। ফারিনের সাথে সব শেষ হবার পর নিজেকে সামলে তোলার সময়টাও পাচ্ছেনা তার উপর বিয়ের কথাবার্তা! এটা তার জন্য মরার উপর ঘা এর মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু সে বাবা-মায়ের সামনে কিছুই বলতে পারলো না, যদিও ফারিন থাকলে অন্য বিষয়। মন খারাপের রেশ কাউকে বুঝতে না দিয়ে নিরবে রুমে এসে বসলো।
ইসরাত ভাইয়ের মুখে দেখে বললো,ভাইয়া তোর পছন্দ না হলে বলে দিবি। সংসার তুই করবি আমরা না। তাই আমাদের কারোর পছন্দ অপছন্দে তোর কিছু হবেনা। তুই আদর্শ সন্তান হতে গিয়ে মনের বিরুদ্ধে কিছু করিস না।

রাইয়্যান হেসে বললো, নিজের পছন্দ করা একজনের জন্য পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার পাশে রইলোনা। এখন আর নিছের পছন্দের উপর ভরসা নেই আমার। মা বাবা যাকে বলবে তাকেই বিয়ে করবো। অন্তত বলতে পারবো নিজের পছন্দে হারিনি আর!!
ইসরাত কিছু বললো না আর। চুপ করে ভাইয়ের পাশে বসে রইলো।

অফিস থেকে ফিরে বাসায় কিছু অচেনা মানুষ দেখে ভড়কে গেল মোহনা। সেদিন মাকে এতো কিছু বলার পরো তিনি আবার বিয়ের সমন্ধ এনেছেন ভাবতেই রাগ লাগছে তার। রাগে গজগজ করতে করতে পেছনের দরজা দিয়ে বাসায় ঢুকতেই পিহু বলল, খবরদার আপু মাকে বকাবকি করবি না। এনাদেরকে মা ডাকেন নি। ইনফ্যাক্ট আমরা কেউই তাদেরকে ডাকিনি। উনারা নিজেই এসেছেন। আর ভদ্রলোক আসার পর থেকেই বলছে আমার মোহনা মা কোথায় সে কি এখনো ফিরেনি! কখন ফিরবে ইত্যাদি! কত কি নিয়ে এসেছে দেখলে তুই অবাক হবি। মা তো আধমরা হয়ে গেছেন তাদের কর্মকাণ্ডে।

একদল মানুষ এসে আমার খোঁজ করতেই তোরা তাদের ঘরে বসিয়ে দিলি। আমায় ফোন করলি না কেন? উনারা কারা পরিচয় কি জানিস কিছু? কেন এসেছেন?

আরেহ আজব দেখে কি তাদের ডাকাত মনে হচ্ছে তোর? এমন ভদ্র মানুষদের সাথে কে বেয়াদবি করবে বলতো? তাছাড়া মা তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেছেন।

তোরা আসলেই অদ্ভুত! যা তোদের ভদ্রতা বজায় রাখ আমি গিয়ে দেখি এনারা কে।

আপু অন্তত ফ্রেশ হয়ে যা…

মোহনা কোনো কথা না শুনেই ফুঁসতে ফুঁসতে সামনের রুমে চলে গেল। সবার দৃষ্টি তার দিকে আবদ্ধ। না চাইতেই ভদ্রতার সহিত সবাইকে সালাম দিতেই চোখ পড়লো সামনে বসা ছেলেটার দিকে। মুহূর্তেই তার সব রাগ উবে গেল বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। এ কাকে দেখলো সে? এই মানুষটা এখানে কেন? কি ঘটছে তার সঙ্গে??

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here