কি করে বোঝাই ভালবাসি পর্ব -০১+২+৩

#কি_করে_বোঝাই_ভালবাসি (১,২,৩)

১.

বিয়ে বাড়ির হইচই থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষন হল। অল্প কিছু মানুষের কথা এখনও শোনা যাচ্ছে। নীল নিয়ন আলোয় চারপাশটা অন্যরকম লাগছে। চিলেকোঠার ঘর থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ায় তিথি। নীচে এখনও দুএক জনকে হাঁটাহাটি করতে দেখা যাচ্ছে। বাঁধানো বকুল গাছের নীচে আগুনের বেশ কিছু ফুলকি। শান্ত আর তার বন্ধুরা বুঝি এখনও ঘুমোয়নি। সে অন্ধকারে সরে আসে।

জীবনের হিসাবটা আসলেই আলাদা। কি ভেবেছিল আর কি হচ্ছে? শান্তর খুনশুটি, সারাক্ষন পেছনে লেগে থাকা এইসবে সে কখন যে ভালবেসে ফেলেছিল তা বুঝতেই পারেনি। আর সেই ভালবাসা যখন অনেকটা প্রবল হয়ে মনের ভেতরে ঝড় তুললো তখনি তার ভুলটা ভাঙ্গলো। শান্তর মত বড়লোকের ছেলেরা তার মত কেয়ারটেকারের মেয়ের সাথে মজা করতে পারে, ভালবাসার ছলে দুষ্টামি করতে পারে কিন্তু আসলে ভালবাসতে পারে না।

সে এতটা বোকা কেন? কেন বুঝতে পারলো না যে তাকে আসলে ভালবাসার নামে করুনা করেছে সবাই। শান্তর বাবাও তাই করেছেন তবে মা নয়। সে কেয়ারটেকার এর মেয়ে। যখন বাবা তাকে এ বাড়িতে নিয়ে এল তখন চাচী তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। শান্তর আর ভাই বোন না থাকায় সে এ বাড়ির মানুষ হয়ে উঠেছিল কিছু দিনের মাঝেই। তাকে ভাল স্কুলেও ভর্তি করা হয়েছিল। শান্ত অবশ্য ক্যাডেট কলেজে পড়তো। তবে ছুটিতে বাড়ি আসলে বাড়িটা যেন জেগে উঠতো। দিনগুলি কত তাড়াতাড়ি কেটে গেছে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিন।

সেবার এইচএসসি দিয়ে শান্ত বাড়ি এল। কেমন যেন উদভ্রান্ত। রাতের খাবার দিতে তিথি চাচীকে সাহায্য করছিল। শান্তর পাশে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে শান্তর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো। কেননা শান্ত তার পা দিয়ে তিথির পা চেপে ধরেছে। অনড় হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন সে । প্রথম কোন পুরুষের স্পর্শ। ভয় আর ভালোলাগায় সে স্হবির হয়ে যায়। তারপর ইচ্ছা করেই কিছুটা পানি ঢেলে দেয় শান্তর পায়ে। পালিয়ে আসে নিজের ঘরে।

এ বাড়িতে অবশ্য তার একটা ঘর আছে। তার বাবা নীচেরতলায় অন্য সবার সাথে থাকলেও তার পড়ালেখার কথা চিন্তা করে চাচী তাকে থাকতে দিয়েছিলেন এই চিলেকোঠার ঘরটায়। ঘরটা অবশ্য তার খুব পছন্দ। পুরো ছাদটাই তার দখলে বলা চলে। যখন খুশি তখন ছাদে আসা যায়। সে আর চাচী মিলে সুন্দর একটা বাগান করেছে ছাদে।

তার মত একটা মেয়েকে যে এরা নিজের মেয়ের মত রেখেছে এটাই তো অনেক বেশী। সে কি কখনও চিন্তা করেছিল এমন ভাবে থাকবে? তাই বলে কি বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াবে সে?

২.

-তোদের ছাদে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
কৌশিকের কথায় শান্ত ছাদের দিকে তাকায়। ছায়ামূর্তি সরে গেলেও ওর বুঝতে বাকি থাকে না তিথি দাঁড়িয়ে.
-কে বলতো মেয়েটা? এসে থেকেই দেখছি তোদের বাসায়? তোর কাজিন?
-নাহ্। সালাম চাচার মেয়ে।
-তাই নাকি। দেখে তো মনে হয় না। বেশ স্মার্ট।
– তা হবে না। ও তো আমাদের বাসার মেয়ের মতই মানুষ হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। বাসায় থাকে আবার মাঝে মাঝে হলেও থাকে। আমার বিয়ে উপলক্ষেই এসেছে।
রনি বলে ওঠে,
-তোর প্রেমে টেমে পড়ে নাই তো আবার? লক্ষ্য করছিলাম তেমন কাছে না আসলেও ছায়ার মত লেগে আছে।
-ধুর কি যে বলিস। বাদ দে।
সিগারেট ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় শান্ত।
-চল নদীর পাড়ের দিকে যাই।
কৌশিক বলে,
-তোরা যা। আমি যাব না। কাল আবার বরযাত্রী যেতে হবে। কতটা রাস্তা। আমার এত জার্নি ভাল লাগে না।
সে তাদের ঘরের দিকে রওনা হয়। ওরা সব হই হই করে বেরিয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কৌশিক ভাবে, তাদের ব্যাচ মেটদের মাঝে শান্তর বিয়ে হচ্ছে সবার আগে। তাও আবার শান্তর অফিসের বসের মেয়ের সাথে। ইউনিভার্সিটি থেকেই শান্ত অনেকটা উচ্ছৃঙ্খল। আজ এই মেয়ে তো কাল সেই মেয়ে। নিশ্চই এখানেও কোন ব্যাপার আছে। হয়তো এই মেয়েটাকেও ভাল লাগার কথা বলেছে।

সে কেন এসব ভাবছে? মেয়েটার চোখ দুটো মনের আয়নায় ভেসে উঠছে বারবার। নাহ্ সে কিছুতেই শান্তর কোন ব্যাপারে জড়াবে না। একবার তো এক মেয়ের ভাই এসে শান্তকে প্রায় মারেই। পরে সে আর রনি বাঁধা দিয়েছিল বলে ব্যাপারটা বেশী দূর গড়ায়নি।

কৌশিক বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। গাছের নীচে বসে। ছাদের দিকে নজর চলে যায়। এখনো দাঁড়ানো মেয়েটা। শান্তরা ফেরে কিছুক্ষন পরেই । সবাই মিলে আবার ঘরের ভেতরে আড্ডা বসে। আজ আর কারও ঘুম হবে না বোধহয়। তবে আড্ডা দিতে দিতেই অনেকে ঘুমিয়ে পড়ে। শান্ত উঠে চলে যায়। বাতি গুলো সব নিভে যায়। শুধু নীল আলোয় মায়াময় চারদিক। অপরিচিত জায়গায় ঠিক ঘুম আসে না তার। উঠে বারান্দায় আসে। এখন ছাদে দুজন। শান্তকে চিনতে তার ভুল হয়না।

৩.

শান্তকে চলে আসতে দেখলেও সে যে ছাদে চলে আসবে তা তিথির কল্পনাতেও ছিল না। তাই নিশব্দে ছাদে আসা শান্ত যখন তার পেছনে এসে কথা বলে উঠেছিল, সে চমকে গিয়েছিল।
-কিরে ছায়ার মত লেগে আছিস কেন? সবাই কি মনে করছে? কমনসেন্স বলেও তো কিছু থাকে। নাকি সেটাও নেই।
-আচ্ছা আর যাব না।
-হ্যাঁ অবশ্যই আসবি না। আর আমার বউ আসলে তো আরও না। আর এখন তো হলে থাকলেই পারিস। আর চাচাও তো নিজেদের জন্য বাড়ি বানিয়েছে। ছুটিতে ওখানে চলে যাবি। পরের বাড়িতে আশ্রিত থাকলে কি আর চলবে। ভাল বিয়ে হবে না।
তিথি চুপ করে শোনে। কত নির্দিধায় কথাগুলো বলছে শান্ত। তাই আর দাড়িয়ে না থেকে নিজের ঘরে চলে আসে। কালকেই চলে যাবে এখান থেকে। কেন যে মরতে এসেছিল। ব্যাগটা টেনে নিয়ে নিজের জিনিস গুছাতে থাকে সে। আসলেই তো সে এ বাড়ির কাজের লোকদের থেকে বেশী কিছু না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে।

ভোর বেলাতেই বেরিয়ে পড়ে সে। সামনের অটো স্ট্যান্ডে অটো পাওয়া গেলেই হয় এখন। ব্যাগটা রেখে চায়ের দোকানে রাখা টুলে বসে সে। ঘড়ি দেখে, সাড়ে ছয়টা বাজে। সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখনও তেমন আলো ফোটেনি। বাবাকে নিয়ে এলেই হত। ভয় ভয় লাগে।
-কোথায় যাচ্ছেন?
পাশে দাঁড়ানো ছেলটাকে চিনতে পারে সে। শান্তর বন্ধু।
-আমাদের বাসায়। আপনি এত সকালে এখানে?
-আপনাকে বাহির হতে দেখেই এলাম।
খুব অবাক হয় তিথি।
-আমাকে?
-হ্যাঁ। কেমন লুকিয়ে বেরিয়ে এলেন। এত সকালে একা আসা উচিত হয়নি আপনার। বিপদ হতে পারতো।
-এটা তো আমার নিজের শহর।
হেসে ওঠে কৌশিক।
-আপনি বেশ বোকা। বিপদের কি আর আপন পর আছে। পরিচয় হয়নি আপনার সাথে আমার। আমি কৌশিক। শান্তর বন্ধু।
-তিথি।
এতক্ষনে একটা অটো এসে থামে। তিথি অটো ঠিক করে উঠতেই কৌশিক ড্রাইভারের পাশে বসে পড়ে।
-আরে আপনি কোথায় যাচ্ছেন।
-আপনাকে দিয়ে আসি। একা একা যাবেন নাকি?
-কি বলছেন। আপনি তো বরযাত্রীর সাথে যাবেন।
-ভয় নেই আপনাকে নামিয়ে দিয়ে এই অটোতেই চলে আসবো। বেশিক্ষণ তো লাগবে না।
কি গায়ে পড়া মানুষরে বাবা। তিথি চুপ করে যায়।
-কোথায় পড়েন আপনি?
-হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
-ও বাবা ইউনিভার্সিটি নাকি? আমি তো ভেবেছি স্কুলে। কিছু মনে করবেন না। মজা করছিলাম।
আর অবশ্য কোন কথা হয় না সারা রাস্তা। তিথি নেমে যেতেই সে পেছনে সিটে এসে বসে।
-বাসায় আসবেন না?
-সে কথা তো ছিল না।
-সেটা না। এতদূর এলেন। চা খেয়ে যান এক কাপ।
-আজ তো নিজে নিজে এসেছি। যেদিন আপনি নিজে থেকে ডাকবেন সেদিন চা খেয়ে যাব। আজ এমনিতেই দেরি হয়ে যাবে। আসি।
চলেন মামা.. এবার একটু তাড়াতাড়ি টানেন গাড়ি।
তিথি রাস্তায় কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকলো । এ আবার কেমন মানুষ।

চলবে…
(রিপোস্ট)

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here