#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৬( শেষাংশ)
সিঁড়ি গোড়ায় দাঁড়িয়ে গ-ম্ভী-র মুখ করে আছে নোরা৷ মাত্রই সে নেমে এসেছে মৈত্রীর ঘর থেকে। একটু আগেই মৈত্রীর ইমেইল বক্সে চমৎকার একটি ছেলের বায়ো এসেছে। ছেলেটি খুব ধনবান এক পরিবারের ব্যবসায়ী ছেলে । মানে পৈতৃক সুত্রে ছেলে ধনবান সাথে নিজের যোগ্যতায় সফল ব্যবসায়ীও। নোরা ছবি দেখেছে ছেলের বলা যায় শ’য়ে আশি ছেলেটা। এমন ছেলে যাচ্ছেতাই ভাবে কোন পরিবারই হাতছাড়া করতে চাইবে না। অন্তত মৈত্রীর মত মেয়ের জন্য যে কিনা লাইফটাকে বড় কোন মোড়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেই রাখে না। গড়পরতা বাঙালি সংসারী টাইপ মেয়ের জন্য এমন পাত্রই উপরের সারিতে থাকে। কিন্তু নোরা অনেক চেষ্টা করেছে বোঝার জন্য তখন মৈত্রীর মনে কি চলে। কিন্তু আফসোস মেয়েটি ছিল নির্বিকার অথচ নোরা স্পষ্ট দেখেছিল সে রাতে মৈত্রীর চোখের পরিবর্তনীয় ভাষা। কোথাও না কোথাও তার মৃ-ত দৃষ্টি ইরশাদের খোঁজে ছিল। নোরার মনে হলো মেয়েটি একটু অস্বাভাবিক তাই সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক দু দিনের মধ্যে মৈত্রীকে তার চিরচেনা রূপ থেকে বের করে আনার। কোথাও তো আ-ঘা-ত লাগলেই খোলস পাল্টাবে। লোহাকে পি-টি-য়ে তবেই না ধাতব তৈরি করে! তার মনটাকেও এখন পে-টা-তে হবে সুন্দর একটা রূ-পে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু কি করা যায়! মৈত্রীকে স্ত-ব্ধ হয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ানো দেখে শিপলুর মা ডেকে উঠলো, “আরেহ নোরা এভাবে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো?”
“ওহ নাথিং বৌদি!”
“তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।”
অরুণিমার হাতে একটা ঢাকনাসহ বাটি। সে নিচ তলায় ইরশাদদের ঘরেই যাচ্ছিলো কাঁচকলার তরকারি নিয়ে। নোরার সাথে তার সখ্যতা হয়েছে দিন কয়েক ধরেই। ময়ূখ খুব দুষ্টুমি করে বৌদি ডাকে নোরাও তা দেখে বৌদি ডাকা শুরু করেছে। অরুণিমা চতুর স্বভাবের হওয়ায় আর নোরা উন্মুক্তমনা হওয়াতেই হয়তোবা সে টের পেয়ে গেছে নোরার মনোভাব। এ কারণেই আরও অনেকটা বেড়ে গেছে তাদের খু-ন-সু-টিময় আচরণ। নোরার একবার মনে হলো বৌদির সাথে কথাটা শেয়ার করলে ভালো হয় কিন্তু নিজের আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে তাকে জানানোটা কি ঠিক হবে! আপাতত মাথা থেকে এই ভাবনা সরিয়ে সে অরুণিমার সাথে পা বাড়ালো ঘরের দিকে। ময়ূখ আজ আবার ঢাকায় যাবে তার বিসিএস পরীক্ষার ডেট পড়ায়। নিজ ঘরে ঢুকে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গোছাতে ব্যস্ত সে। অরুণিমা তরকারির বাটি এগিয়ে দিতেই ইরিন আপত্তি জানিয়ে বললেন, “কি করেছো অরু এত তরকারি কেন এনেছো?”
“মাসিমা আমার শ্বাশুড়ি মা রান্না করেছে। ওই যে সেদিন আপনি এই তরকারির কথা বললেম তাই আজ ইলিশ মাছ দেখে বেশি করে রাঁধলেন। রোকসানা মাসি আপনার জন্য শ্বাশুড়িমা নিজেই আলাদা করে দিলেন এগুলো।”
“তুমি বোসো অরু আমি একটু ময়ূখকে পিঠার বক্সটা দিয়ে দেই ছেলেটা ঢাকা যাচ্ছে আজ।” মেহেরের জন্য দু রকম পিঠা বানিয়ে বক্সে ভরে দিয়েছে ইরিন৷ অরুণিমা খেয়াল করল এখানে আসার পর সে যখন ইরিনের সামনে তখন নোরা চলে গেছে ময়ূখের কামরায়। মেয়েটা যে ওই পা-গ-লা-টে ছেলের প্রেমে পাগল তা সে খুব ভালো করেই বুঝেছে কিন্তু ছেলেটার চোখের দৃষ্টি অন্য কোথাও ধাবমান সেটাও তো দেখেছে সে৷ মনে মনে রবকে ডেকে ময়ূখ, নোরা দুজনেরই মঙ্গল কামনা করে নিলো অরুণিমা। ইরিনের সাথে সেও ঢুকলো ময়ূখের ঘরে। নোরা খাটে বসে গালে হাত রেখে তাকিয়ে আছে ময়ূখের দিকে। আর ময়ূখ তার ছোট্ট ওয়্যারড্রোব থেকে একটা দুটো করে কিছু কাগজ বের করে ফাইলে ভরছে। সেও বোধহয় অ-স্বস্তি বোধ করছে নোরার চাহনিতে। কাগজের দিকে তাকিয়ে থেকেই সে বিরক্তির স্বরে বলে বসল, “এমন হ্যাংলার মত কেন দেখছো? অন্যদিকে তাকাও।”
“কেন? তুমি লজ্জা পাচ্ছো!”
“কে কাকে এত লজ্জা পাচ্ছে ভাই!” অরুণিমা ঘরে ঢোকার সময়ই বলে উঠলো কথাটা। অরুণিমার কথার পর নোরা, ময়ূখ দুজনেই আরও কিছু কথা বলল হাসি ঠাট্টা করে। ময়ূখ আজ বিকেলের বাসেই রওনা হবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।নোরারও খুব করে মন চাইছিলো সেও যায়। হয়তো বললেই ফুপি ময়ূখকে রাজী করিয়ে নিবে কিন্তু এখন চলে গেলে মৈত্রীর মনের খবর কি করে নেবে! তারওপর ফুপি তো শাদ ব্রো’র জন্য কত কাঁদেন লুকিয়ে সে খবর তো তার অজানা নয়। এই ভাড়াটে জীবনেও তো শুধু মাত্র সায়রা আর ব্রো’র ভেতরকার ভগ্নহৃদয়ের জন্যই। কে জানে এই অস্বাভাবিক মেয়েটার সত্যিকার ভালোবাসা লুকিয়ে আছে তার মনে যা চাইলে ব্রোকে তার দূর্বিষহ অতীত থেকে বের করে আনতে সহায়ক হবে। এ কাজটা হয়তো যে কোন নতুন নারীর সঙ্গেই সম্ভব কিন্তু ব্রোকে নতুন কারো দিকে ভিড়িয়ে দেওয়াটাই তো মুশকিল। চোখের সামনে যখন একজনকে পাওয়া গেল এবং ব্রো’র মনে যখন এই মেয়েটির জন্য সহমর্মিতার অনুভূতি তখন না হয় এই মেয়েকেই বেছে নেওয়া যাক। তার সাইলোলজি বলে এখানে কিছু একটা সম্ভব শুধু ময়ূখের ভাষায় তার একটু কূ-টনৈ-তিক বুদ্ধি খাটাতে হবে।
ময়ূখ চলে যেতেই ইরিনের ঘর কেমন খালি খালি হয়ে গেল। আবারও ছেলেটা চার পাঁচ দিন থাকবে না এতে তার মন খা-রা-প থাকবে এ ক’দিন। প্রতিবার তো এমনই হয়। সন্ধ্যার পর ইরশাদ বাড়ি এসে প্রথমেই মুখ হাত ধুয়ে মায়ের কাছে গেল। আজ সারাদিন সে শহর থেকে একটু দূরে এক জায়গায় ছিল। দারুণ একটা চাকরির সন্ধান পেয়েছে সেখানেই ইন্টারভিউ ছিল। যাতায়াতেই তার প্রায় পাঁচ ঘন্টার বেশি লেগে গেছে৷ এখন বাড়ি ফিরে বড্ড ক্লান্ত লাগছিলো কিন্তু এই মুহুর্তে কফি খেলে তা আর থাকবে না৷ এমনটা ভেবেই আগে মাকে জিজ্ঞেস করলো চা, কফি কোনটা খাবে? ইরিনের মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে মাত্রই, নোরাকেও বসিয়েছেন নামাজ শিক্ষা বই হাতে কিছু সূরা শেখার জন্য । ইরশাদের কথা শুনে নোরাই বলল, ব্রো আমি বানাই কফি! ফুপি তুমি কি খাবে?
ইরিন বললেন কফিই খাবেন তিনিও। নোরা তিন মগ কফি করে ফুপির রুমেই নিয়ে এলো। তিনজনে কফি খেতে খেতে টুকটাক গল্প শুরু করতেই নোরা বিয়ের কথা তুলল ইরশাদের। ইরিনও যেন সুযোগ খুঁজছিল এ বিষয়ে কথা বলার। নোরাই বলল, “ব্রো আমি তো মাস দুয়েকের মধ্যেই চলে যাব বিয়েটা করে ফেলো এবার।”
“আমিও তো তাই বলি কিন্তু মেয়ে তো দেখতেই দিচ্ছে না।”
অভিযোগ ছিল যেন ইরিনের কণ্ঠে।
“কে দেখতে দেয় না ফুপি?”
“আর কে এই যে যার বিয়ে করাতে চাই সেই তো দেয় নারে মা। এইতো গত সপ্তাহে তোর ফুপা এক ঘটকের মাধ্যমে সুন্দরী এক মেয়ের খোঁজ দিলো সে দেখতে যেতেই দিলো না। এখনও দেখ আমার ড্রেসিংটেবিল এ খামটাতে ছবি আছে।”
নোরা খেয়াল করে দেখলো ফুপির ড্রেসিংটেবিল এর ওপর একটা খাকি রঙের খাম। সে উঠে সেটা হাতে নিয়ে দেখলো ভেতরে একটা ছবি আর জীবন বৃত্তান্ত। মিনিট দুয়েক খুঁটিয়ে দেখে সে বলে উঠলো, “এই মেয়ের চেয়ে তো তোমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর। কি দেখছো ফুপি তারচেয়ে ভালো মৈত্রীর জন্যই প্রস্তাব পাঠিয়ে দাও।”
নোরার কথা শুনে বদ্ধ ঘরটাতে যেন ব-জ্র-পাত ঘটে গেল। মা ছেলে দুজনেই হ-ক-চ-কি-য়ে গেছে নোরার কথায়। সে রাতে নোরা আরও অনেকবার এ নিয়ে কথা তুলেছিল কিন্তু কোন প্রকার রেসপন্স পায়নি সে। তবে কাজ তার অর্ধেক সে রাতেই হয়ে গিয়েছিল। ইরশাদের ভা-ঙা-চোরা মনে আবারও বেজেছে নতুন করে মৈত্রী নামক ঘন্টা। সে ভেবেছিল নোরার কারসাজিতে তার মস্তিষ্ক ভুলভাল বুঝেছে কিন্তু না আবারও মন নড়েচড়ে বসেছে। মন বলছে ওই মেয়েটার মাঝে কিছু তো আছে! সত্যি বলতে মৈত্রীকে ভালো লাগার মত কিছু না পেলেও মৈত্রীকে জানার কৌতূহল তার গভীর। মৈত্রীর নিস্পন্দতা, মেয়েটার অস্বাভাবিক চাহনি আর তার নির্লিপ্ত আচরণের পেছনের মূল রহস্য জানার আগ্রহ ইরশাদের বহুদিনের। নোরার কথায় কথায় মৈত্রীকে নিয়ে ইঙ্গিত তার কৌতূহলকে যেন উ-স-কে দিচ্ছে দিনে দিনে। ময়ূখ ঢাকায় যাওয়ার পর কথায় কথায় নোরাকেই সে কয়েকবার মৈত্রী সম্পর্কে কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করতে লাগল। ময়ূখের সেই জিজ্ঞাসা নোরার ভেতরে নীরব ঘা-তকের মত আঘাত করে বসলো যেন। তবে সেতো ইমোশনের বেড়াজালে আটকে পড়ার মত মেয়ে নয়। সে তার চতুরতাকেই জারি রেখে ইরশাদকে আরও জাগিয়ে দিল সেদিন সন্ধ্যায়। যেদিন মৈত্রীকে দেখতে পাত্রপক্ষ এলো সেই সাথে এলো মৈত্রীর মামা-মামীও। পরের ঘটনাটুকু ঠিক এরকম….!
চলবে
(কমেন্ট না পাইলে আরও দেরি করে গল্প দিব 🥱)