#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব২
(কপি করা নিষেধ)
রাত আনুমানিক ১১ টা।নীলা বেঘুরে ঘুমাচ্ছে।ছায়া বেলকনিতে বসে আছে।হাতে একখানা বেশ পুরোনো ডায়েরি আর অন্য এক হাতে চা।একটু পর পর চায়ের কাপে চুমোক দিচ্ছে।আর হাতের ডায়েরিটি উলটে পালটে দেখছে।কিন্ত খুলে দেখার সাহস পাচ্ছে না।যে পাতাগুলার ভিতর তার বিষাক্ত অতীতকে বন্দী করে রেখেছে সেটা আর খুলে দেখতে চায় না। কিন্তু তবুও এর ভিতর কিছু সুমধুর স্মৃতিও আছে বটে।হাতের ডায়েরিটা নিয়ে সে উঠল আর গুটি গুটি পায়ে হেটে একটা ড্রয়ারের সামনে গেলো। সেটা খুলে ডায়েরিটা তালাবদ্ধ করে রাখলো যাতে কারো হাতে না পড়ে।নীলা জানতে পারলে আর রক্ষে নেই।যদিও মেয়েটা খুবই চঞ্চল কিন্ত খুব ভালো, মায়াবী, প্রাণবন্ত। আজ তিনটে বছর ধরে আছে নীলা আর সে একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে।নীলা তার দুঃখের সংগী।তার জীবনের এক টুকরো সুখ।মেয়েটা না থাকলে যে কি হতো।এইসব ভাবতে ভাবতে গিয়ে পুনরায় বেলকনিতে গিয়ে একটা চেয়ারে বসল।আকাশের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রাতের এই আধারে আকাশের বুকের এক ফালি চাঁদ আলোর যোগান দিচ্ছে।আচ্ছা তার এই আধারিয়া অম্বরে কবে চাঁদ উঠবে কে জানে?ভিতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। ঠিক সেই সময় ছায়ার মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম আম্মু।মোবাইলটি কিছুক্ষণ বেজে থেমে গেলো। সাথে সাথেই আবার কল আসলো। ছায়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কলটি আবার কেটে না যাওয়া অবধি।
…..
-অরণ্য ফিউচার নিয়ে কি ভাবছিস?
স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো এক তগবগে তাগড়া যুবক।
যুবকটি কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকে অরন্যের দিকে।পুনরায় বলে,
-আর কতকাল এইভাবে থাকবি।যে তোর না তাকে মনে রেখে কি লাভ দোস্ত?এইবার মুভ অন করা উচিত।
অরণ্য শুনলো নাকি কে জানে। সে এখন মহা ব্যস্ত ফাইল দেখায়।আজ ৬ টা অবধি ডিউটি ছিলো।এখন ৭ টা বাজে। একটা কাজে আটকে গেলো। জলদি কাজটা সেরে বেরোবে সে।খুবই দায়িত্ব সচেতন সে।সেই সাথে রগচটা আর গম্ভীরও বটে।
এতক্ষণ অভিক এর বকবক শুধু শুনেই যাচ্ছিলো সে।এইবার একটু ভ্রু কুচকে তাকায় অভিক এর দিকে।যেন অরণ্যের সন্ন্যাস ব্রত ভাঙাই অভিক এর মেইন কাজ।অরণ্যের এই চাহনি দেখে অভিক আর কিছু বলার সাহস পেলো না।চুপ করেই বসে থাকলো।
অরণ্য কাজ সেরে বেরিয়ে পড়লো হসপিটাল থেকে। গাড়িতে উঠে আপন মনে ড্রাইভ করছে তখনই তার বাবা আজমির চৌধুরী ফোন করলেন।ফোনটা পকেটে ভাইব্রেট করছে দেখে অরন্য ফোনটি হাতে নিয়ে দেখলো তার বাবা।সে ফোনটি রিসিভ করলো কানে ব্লুটুথ অন করে।
তখনই কানে আজমির চৌধুরীর ম্লান কন্ঠস্বর।
-কেমন আছিস ইয়াং ম্যান?
অরন্য হাত স্টেয়ারিঙে রেখে চোখ সামনের রাস্তার দিকে চোখ স্থির রাখে।দেখতে থাকে এই গতিশীল রাস্তা যেনো পিছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
-আ’ম ফিট এন্ড ফাইন পাপা। হাউ আর ইউ?
আজমির চৌধুরীর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো।ছেলে দেশ ছাড়লো কতোগুলো বছর।একবারও কি মনে পড়ে না তার কথা।মনে যেনো আষাঢ়ে মেঘেরা হানা দিলো।
-আমি কেমন আছি দেশে এসেই নাহয় দেখিস। দেশে ফেরার কোন প্লেন টেন আছে নাকি তোর? নাকি ওইখানে সেটেল হতে চাচ্ছিস? তোর মা তোর চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।সেই খবর রাখিস?
অরন্য কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে বললো আমি বাসাই ফিরে কল দিচ্ছি। আমি ড্রাইভ করছি পাপা।
আজমির চৌধুরী যেন আগে থেকেই জানতেন এমনটা হবে।কিছুটা হতাশ কিন্তু সিরিয়াস ভংগিতে বললেন,
– বাসাই গিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কল দিস।কথা আছে হসপিটালের বিষয়ে আরও একটি বিষয় আছে।
এই বার বোধ হয় অরন্য কিছুটা আচ করতে পারলো। কিছুটা তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিলো,
-আচ্ছা।
বাসাই ফিরে পাসওয়ার্ড দিয়ে ডোর লকটি খুললো সে।দ্রুত পায়ে ভিতরে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। বাইরের ধুলাবালি তার সহ্য হয় না।শরীর কেমন জানি খচখচ করে।তাই সবার আগেই পরিষ্কার হবার প্রয়োজন। গোসল সেরে বাথরোবটা পড়েই হেলানো চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করেই পড়ে থাকলো কিছুক্ষণ।এই একাকীত্বের জীবন আর কয়দিন?ভেতর থেকে পালটা প্রশ্ন আসে না।সে যেন কোন এক উপত্যকার পরিত্যক্ত স্থানে আটকা পড়েছে।এইখান থেকে তার মুক্তি নেই।
কিছু একটা ভেবে চট করে চোখটা খুলেই কাউকে ফোন লাগালো।
-হ্যালো কেমন আছিস?
– ওই তুই অরণ্য তো নাকি অরন্যের ভূত বাপ? তরে কল দিতে দিতে হয়রান আমি এর পরেও তোর কোন খবর নাই।
অরন্য কিঞ্চিৎ হাসলো প্রানের কথায়।তার জানে জিগার দোস্ত।স্কুল কলেজে এমনকি মেডিকেল এ একসাথে পড়লেও অরন্য কিছু ব্যক্তিগত কারণে পড়ার মধ্যেই স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনে ট্রান্সফার হয়ে গিয়ে ছিল।
আনমনে হাসে অরন্য।
– খুবই ব্যাস্ত ছিলাম তাই রিসিভ করতে পারিনি।ওইখানে সিরিয়াস কিছু হয়েছে?
এতোক্ষণের প্রফুল্লতা যেনো হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো কোথাও প্রাণের।কুয়াশা যেমন সূর্যের তপ্ত অংশুতে মিলিয়ে যায় ঠিক তেমন।মলিন কন্ঠে বলে,
– প্রফেসর নিজামউদ্দিন স্যার হঠাৎই হার্টফেইল করেন ক্লাসে থাকাকালীন আজ।স্যার আমাদের খুব ভালোবাসতেন।বিশেষ করে তোকে।স্যার এর খুবি প্রিয় ছিলিস তুই। কাল জানাযা।অন্তত এই সুবাদে দেশে ফিরে আয়।এইখানেই জয়েন কর।আর কতদিন?আড়াই বছরেরর বেশি সময় হতে চললো।কারো জন্য কেন নিজেকে দূরে রাখবি?
অরন্য যেন ভড়কালো প্রিয় স্যারের মৃত্যুর খবর শুনে। ব্যথিত হলো।মৃত্যু কাউকেই ছাড় দেয় না।কেউ আগে নয়তো পরে মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতে হয়।কিন্ত শরীরের মৃত্যু দেখা যায় আত্মার মৃত্যু দেখা যায় না।এই যে সেও তো মৃত কই কেউ তো দেখল না জানলো না।ভিতর থেকে হতাশার কালো দীর্ঘশ্বাদ বেরিয়ে আসে।
অরন্য কিছু না বলেই কল কেটে দিলো।তার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্রান আবারো কয়েকটা কল দিলো কিন্তু অরন্য ধরলো না।সে হয়তো বুঝতে পারলো অরন্যের মনের অবস্থা।নিজামুদ্দিম স্যার শুধু তার শিক্ষক না অরন্যের বাবার বন্ধুও বটে।সেই বাচ্চা কাল থেকে দেখে আসছে।খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।অরন্য একটা ট্রাউজার আর টি শার্ট পড়ে নিলো। ডিনার করার প্রয়োজন কিন্ত এখন আর করতে ইচ্ছা করছে না।ঝটপট এক কাপ ব্লাক কফি বানিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। গ্যাস লাইটার দিয়ে একটা সিগারেট জ্বালালো।আগে অভ্যাস ছিল না ধূমপান এর কিন্তু এখন নিয়মিত সংগী।হঠাৎই বুকের বাম পাশে দাফন করা স্মৃতি গুলো মাথা চারা দিয়ে উঠলো। সিগারেট টান দিয়ে ধুয়া গুলা উপরের দিকে বাতাসে উড়িয়ে দিলো। ভিতরের দুঃখ গুলা এইভাবে ধোয়ার মতো উড়িয়ে দিতে পারলে ভালো হতো।সে ভাবলো আচ্ছা সে কেমন আছে? ভালো আছে?তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে পারবো তো? এখন আমার যোগ্যতা,খ্যাতি,সম্মান,অর্থ সব আছে।কিসের ভয় আমার?আমি কেন ভয় পাবো? হুয়াই?
বাইরে হালকা বাতাসে তার কপালে পড়ে থাকা চুল গুলা উড়ছে।নির্বাক দৃষ্টি,দগ্ধ মস্তিষ্ক, ক্ষত বিক্ষত হৃদয়।এত সৌন্দর্য দিয়ে হবেটা কি সে তো আমায় চাইলো না।ঠোঁটে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্য।
আবারো মোবাইল কাপিয়ে এলো প্রানের কল।সে এইবার রিসিভ করলো।
প্রাণ নিরুদ্বেগ অথচ শান্ত, শক্ত গলায় বললো,
-এইবার নিজের খুটি শক্ত করে ধর।পারছিস থাকতে তাকে ছাড়া? সব কিছুই তো ট্রাই করা শেষ।সোজা আংগুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়।
নিশ্চল, বিবশ গলায় অরন্য বললো,
-আমার মনে কারো জন্য কোন অনুভূতি নেই।একসময় ছিল। এখন কেবলই শুন্য।
প্রান মনে মনে হাসলো এ যেন ফানি জোকস ছিলো। তার মনে কতটা ভালোবাসা জমে আছে সে খুব ভালোভাবেই জানে।তাকে এটা যেকোন উপায়ে জাগাতে হবে।এইবার হবে আসল খেলা।
প্রাণ চটপটে গলায় বললো,
-ফ্লাইট এর টিকেট ইমারজেন্সিতে বুক করে চলে আয়।কাল জানাযা।আসলে জানাস আমাকে।
অরন্য কিছুক্ষণ ভাবলো। পরে কিছুটা দ্বিধা মিশ্রিতস্বরে বললো,
– আমি আসছি।
অরন্য বাবাকে কথা দিয়েছিল ফোন দিবে।তার বাবা যে এটা জানাতেই কল দিয়েছিল সেটা বুঝতে পারছে।
সে ফোন দিলো। তার বাবা সাথেই সাথেই কল রিসিভ করলো যেন তার অপেক্ষাতেই ছিলো।তার বাবার সাথেই সব প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে শুয়ে পড়লো।
কাল ফ্লাইটেই ব্যাক করছে বাংলাদেশ ।মনের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে।কিসের জন্য সেই অস্থিরতা?মনের মধ্যে এতো অস্থিরতা থাকলে ঘুমানো যায়?যায় না।পানি যেমন ফুটলে যেমন বুদবুদ উঠে ঠিক তেমন অস্থিরতাগুলো বুদবুদ করছে তার ভিতরে।
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব৫
(কপি করা নিষেধ)
…….
সকাল নয়টা। নীলা আর ছায়া ক্লাসরুমে বসে আছে।ক্লাসরুমে সবাই কিছু না কিছু নিয়ে কথা বলছে।কেউ কেউ কানে এয়ারফোন চেপে গানে মগ্ন,কেউ বইয়ের পৃষ্ঠায় নিজেকে বন্দী করে ফেলেছে।যেনো বইয়ের ভেতরের জাদুকরী অক্ষরগুলি তাদের হিপনোটাইজড করে ফেলেছে।কেউ হাসি ঠাট্টায় ব্যাস্ত।
এক বেঞ্চে ছায়া, নীলা আর মেঘা বসেছে।মেঘা অনবরত তার বয়ফ্রেন্ডের প্রশংসায় গলা শুকাচ্ছে। নীলা আর ছায়া তা শুনে ঢোক গিলছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।তার প্রেমিক আপাতত লন্ডনে কিছুদিন পরই আসবে।সেই খুশিতে সে আত্মহারা।একবার হাসে তো আরেকবার তার গলায় রাগ প্রকাশ পায় আবার কখনো লজ্জায় মুখ রাঙা হয়।
-এই তোরা জানিস আমি তোদের দুলাভাইকে কতো ভালোবাসি?
এইটা বলে একটু লাজুক হাসি হাসলো।যদিও লজ্জা নাম শব্দটা তার ডিকশনারিতে নেই।
নীলা মজার স্বরে বললো,
– কতোটা?
মেঘা দুইহাত প্রসারিত করলো।যেনো প্রসারতা তার ভালোবাসার পরিমাপক এই মুহুর্তে।
– এত্তো গুলা।
এইটা বলেই আবার মুখ লুকালো নিজের উড়নায়।ছায়ার এইসব ন্যাকামি অসহ্য লাগছে।তাই ধুম করে মেঘার পিঠে ঝট করে একটা কিল বসিয়ে দিলো।
– ইশশ ঢং দেখো মেয়ের।এমনভাব করে যে প্রেম দুনিয়াতে একমাত্র সেই করে।
মুখটা ভেংচি দিয়ে পুনরায় বললো,
-ন্যাকার ষষ্টি।
মেঘা কাঁদোকাঁদো মুখ করে ফেললো।সে নাহয় একটু বেশিই ভালোবাসে তাই বলে তাকে নিয়ে এইভাবে মজা করবে?বান্ধবীদের বলবে না তো কাকে বলবে?কন্ঠে অতীব মাত্রার কষ্ট যোগ করে এইবার মেঘা বললো,
-এমন করিস কেনো ছায়ু?তোদের না বললে কাদের বলবো?পাশের বাড়ির অদু,মদু,কদুকে?এই নীলা আমার পিঠটা জ্বলে গেলোরে দেখ কি জোরে দিয়েছে।কি খাস রে ছায়ু? এতো জোর কই পাস?
ছায়া বিরক্তিকে চোখ মুখ কুচকে ফেললো।তার কপালে গুনে গুনে তিনটা ভাজ পড়লো,
-আরেকবার এইসব ফালতু কথা বললে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে আসবো। এখনই ক্লাস শুরু হবে তাই চুপ কর।
মেঘা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই স্যার ক্লাসে আসে তার সাথে আরো একজন ঢুকে প্রফেশনাল লুকে।কালো প্যান্ট,সাদা শার্ট,কালো কোর্ট।মুখে খোচা দাড়ি,ব্রাউন চুল কপালে পড়ে আছে,কালো শো,ব্রান্ডেড ওয়াচ। সব মেয়েদের শ্বাস মনে হয় কিছুক্ষনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতো সুদর্শন আর সুঠাম দেহি।
ব্যস্ততম ক্লাসের কোলাহল যেনো থেমে হলো হঠাৎ করেই।রহমান স্যার এইবার গলা ঝেড়ে কাশি দিলেন সবার মনযোগ আকর্ষণ করার জন্য। সবার সাথে পরিচিত করালেন অতি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে।
-তোমরা হয়তো সবাই চিনেই থাকবে।এতোক্ষণে হয়তো চিনে ফেলেছো আশা করছি।
রহমান স্যার পুনরায় গলা খাকারি দিলেন।
– সবাই কেমন আছো?আশা করছি ভালো আছো।তিনি হচ্ছেন অরন্য চৌধুরী।লন্ডন থেকে এম.বি.বিএস কমপ্লিট করেছেন।তিনি এই মেডিকেল কলেজেই অধ্যয়নরত ছিলেন সবাই চিনে গেছো এতোক্ষণে।কিছু বিশেষ কারণে স্কলারশিপ নিয়ে তিনি লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন আর সেইখানেই বাকি পড়া শেষ করেন।আজ থেকে ডক্টর অরন্য চৌধুরী তোমাদের ক্লাস নিবেন।
পুরো ক্লাস জুড়ে হৈ হৈ শুরু হয়। এ যেনো কোন উৎসবের আমেজ।সবাই অলরেডি ডক্টর অরন্যকে নিয়ে ফুসুরফাসুর করতে থাকে।
এইবার ছায়া,নীলা আর মেঘা অরন্যের নাম শুনেই চমকে উঠে।অস্ফুটভাবে মুখ চিরে বেরিয়ে আসে
অরন্য ভাইয়া!
তিন জনের চোখে মুখে বিস্ময় আর শঙ্কা।ভাইয়া ফিরে এলো এতো বছর পর?কোন বিশেষ কারনে নয়তো?
ওরা ছায়ার দিকে তাকালো।ওর মুখে আধার নেমে এলো সাথে ব্যথাতুর দৃষ্টি।ছায়া ধীরে ধীরে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।আর একবারও ফিরে তাকালো না।
অরন্য সবাইকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলো।যদিও তাকে সবাই আগে থেকেই চিনে।শুধু মধ্যে দিয়ে কয়টা বছর ছিলো না।কেউ জানতোও না সে কোথায়।সবার চোখে মুখে প্রফুল্লতা,হাসি।এইবার অরন্য একে একে সবার পরিচয় জানতে চাইলো।সবাই যার যার পরিচয় দিলো।এইবার ছায়াদের সারি অবধি এসে থেমে গেলো।নীলা আর মেঘা নিজেদের পরিচয় বললেও ছায়া উঠলোও না আর কিছু বললো না।কিছুক্ষণ পর নীলা বললো উঠে দাঁড়াতে। ছায়া দাড়ালো কিন্তু দৃষ্টি নিচের দিকে।কথা গলায় আটকে গেছে যেমন।কোন শব্দই যেনো মুখ দিয়ে।স্বরনালী কাঁপছে। বুকের গহীনে নামহীন অজানা ব্যথার অস্তিত্ব টের পেলো।
অরন্য এইবার সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।কন্ঠে তীক্ষ্ণতা আনলো,
-হুয়াট হেপেন্ড? হুয়াটস ইউর নেইম মিস?
ছায়া চমকালো, ভড়কালো।আর বিদ্যুৎ গতিতে অরন্যের মুখের দিকে তাকালো।দুজনের দৃষ্টি এক হতেই বুকে ঝটাকা লাগে।ছায়া দ্রুত গতিতে চোখ সরিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-কমলীনি ছায়া।
আর কিছু বলার সাহস হলো না।তার পুরো শরীরের কম্পন ধরেছে।এক খন্ড পাথরের টুকরা নদীর পানিতে ঢিল মারলে তা যেমন তরঙ্গ তৈরী করে কম্পিত হতে থাকে ঠিক তেমন তার শরীরেও যেনো কম্পন ধরেছে।ধপ করে বসে পড়লো সিটে।
অরন্য আর কিছু বললো না।চোখ সরিয়ে নিলো।সামনে গিয়ে নিজের মনকে পড়ানোতে মনোনিবেশ করলো।
একটাও অপ্রয়োজনীয় কথা বলেনি।কারো দিকে তাকায়নি।তাকালে বুঝতো কতো মেয়ে তাকে চোখ দিয়ে গিলছে।
অরন্যের ক্লাস শেষ হতেই অরন্য বিদায় নিয়ে চলে যায়।একবার ফিরেও তাকায় না।ফিরে তাকালে দেখতো ভয়ে জড়োসরো হয়ে আড়ষ্ট এক তরুণীকে।অরন্য চলে যেতেই মেয়েদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয় অরন্যকে নিয়ে।
এর মধ্যেই এক সুন্দরী মেয়ে তার সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার দুইহাত বুকে গুঁজে স্থিরচিত্তে বলে উঠে,
-আপনাকে তবে পেয়েই গেলাম।
ইশ কি লজ্জা!এই বলেই মুখ ঢাকে হাত দিয়ে।
মেয়রের মেয়ে বলে কথা বেশ ভালো ছাত্রী হলেও অনেক অহংকারী। তার কাছে অহরহ ছেলের প্রপোজাল আসলেও বিশেষ একজনের অপেক্ষায় ছিলো।আজ হয়তো পেয়েও গেলো।মেয়েটিকে তার বান্ধবী সীমা ডেকে বললো,
-অহনা কি তবে প্রেমে পড়লো।হুম সামথিং সামথিং?
অহনা লাজুক হাসলো।
…..
-ডাক্তার অরন্য চৌধুরী আপনি অবশেষে গুহা থেকে বের হলেন এইটা বলেই দাঁত বের করে কেবলা মার্কা একটা হাসি দিলো প্রাণ।সেও একজন ডাক্তার।তবে সে সাইকিয়াট্রিস্ট।
অরন্য তার হাতের ফাইল দিয়ে প্রানের পিঠে এক বারি দিলো আর বললো,
-গিভ মি সাম রেসপেক্ট ব্রো।
প্রান তার চোখ প্রসারিত করে হাতটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে বললো,
– একটা চুম্মা দিলে কি রেসপেক্ট করা হইব?
অরন্য মুখটাকে বিকৃত করে বললো,
ছিহ! কিসব কথা বার্তা।আম নট এ গে।গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার।
প্রান হোহোহো করে হেসে ফেললো।হাসতে হাসতে যেনো পেটে খিল লাগলো।মুখে হাসি বজায় রেখেই হাপাতে হাপাতে জিজ্ঞেস করলো,
-অভিক শালার কি খবর।হেয় কি অইখানেই পইড়া থাকবো নাকি দেশেও আসবো?
অরন্য এইবার মুখটাকে সিরিয়াস করে তুলে।
-অভিক তো আমি আসার সময়ই আসতে চাইছিলো।কিন্তু কিছু কাজে আটকে গেলো।আমি বলছি সব শেষ করে আস্তে ধীরেই আসতে।
প্রাণও এইবার হাসিঠাট্টা বাদ দিয়ে সিরিয়াস হলো।সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অরন্যের মুখের দিকে তাকালো।বুঝার চেষ্টা করলো অরন্যের অভিব্যক্তি।
-যাক ভালো।তবে এইভাবে কতোদিন? বিয়ে করছিস না কেনো? আন্টি তোকে নিয়ে কতোটা চিন্তা করে জানিস? যেই সময়টা নাতি নাতনি নিয়ে কাটানোর সময় সেই সময়টা তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে হায় হুতাশ করে কাটাচ্ছে।
অরন্য কিছু বললো না বরাবরের মতোই চুপ থাকলো।
প্রান বরাবরের মতোই হতাশ হলো।
….
ছায়া ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে মুখে শীতল পানির ঝাপটা দিচ্ছে বারবার।এটা সম্ভব না।কোনদিন না।তার একটু শান্তির প্রয়োজন।আচ্ছা শান্তি কোথায় পাওয়া যায়?অতীত যে বারবার তার সামনে আসছে।সে কি পারবে ট্যাকেল দিতে?
তার মনে পড়লো কতোদিন বাড়ি যায় না।কয়েকদিন বাড়ি গিয়ে থেকে আসলে কেমন হয়? কতোদিন বাবা মায়ের সাথে কথা হয় না? পুরানো কিছু মান অভিমানের জন্য আজ সে পরিবার থেকে এতো দূরে।এখন সে ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে চায়।
অন্তত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হলেও কিছুদিন থেকে আসা দরকার।
ছায়ার বাবা রেজাউল হক একজন ব্যাংক ম্যানেজার।মা মীরা বেগম গৃহিনী,ছোট বোন আয়িশা রোজ।এইবার ক্লাস নাইনে পড়ে বিজ্ঞান বিভাগে।বেশ চটপটে মেয়ে আর বেশ ভালো ছাত্রী।কিন্তু রাগটা নাকে আগায় থাকে।চঞ্চলা এই কিশোরীর লতানো দেহ,সুদীর্ঘ কেশ,হলুদ ফর্শা গায়ের রঙ।বেশ নজরে নজরেই রাখে মেয়েদের মা মিরা বেগম।
#চলবে
(সবাই লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার করবেন।
ধন্যবাদ)
#চলবে
…..
(