কুঞ্জছায়া পর্ব ৫০+৫১

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৫১
(কপি করা নিষেধ)
…..
বর্ষার প্রায় শেষের দিকে।রোদের ভারী তেজ দুপুরের দিকে।একফোটা বাতাসও নেই।ভ্যাপসা গরম বিদ্যমান।মীরা বেগম হাতে একটা পিয়াজ কালারের শাড়ি নিয়ে ছায়ার রুমে ঢুকতে চাচ্ছেন কিন্ত দুনোমনা করে আবার ফিরে আসছেন।কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছেন না।মেয়েদের আজীবন নিজের সিদ্ধান্তের মান্য করতে শেখালেও আজ কেমন যেনো জড়তা কাজ করছে নিজের মধ্যে।দুবার ভাবতে হচ্ছে মেয়ের মনের উপর কিরূপ প্রভাব পড়বে। ঠিক তখনই ছায়ার বাবা রেজাউল সাহেব মীরা বেগমের কাধে হাত রেখে ভরসা দেয়।মীরা বেগম কিছুটা স্বস্তি নিয়ে মেয়ের রুমে ঢুকলেন।ছায়া মোবাইলে কিছু একটা করছিলো বিছানায় শুয়ে।ছায়া মাকে দেখে বিছানা থেকে উঠে আসলো।মায়ের হাতে শাড়ি দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে মীরা বেগম এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে বসে। মেয়েকে কাছে টেনে কোলের উপর শুয়ায়।মেয়ের মাথায় আদুরে বিলি কেটে দেয়।মীরা বেগম জড়তা নিয়েই নরম গলায় বলে,

-ছায়া মা কি আজীবন থাকবে?একদিন না একদিন তো সবাইরই মরতে হবে।

ছায়ার বুকের ভিতর ধক করে উঠে।মাকে হারানোর কথা শুনে মনে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হলো।এ যে সে কল্পনাতেও ভাবতে পারে না।ছায়া মাকে শক্ত করে ধরে।
মীরা বেগম যেনো বুঝতে পারলেন মেয়ের মনের ভাবনা।মীরা বেগম মনে মনে শান্তি পায়।মেয়েকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে।

-মারে একদিন না একদিন আমাদের সবাইকে দুনিয়া ছাড়তে হবে।হয় আগে নয়তো পরে।হয়তো এই মৃত্যুটা কিছুটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে যদি মেয়েদের জীবনটা নিশ্চিত করে যেতে পারি।তাদের সুখের সংসার দেখে যেতে পারি।একটা মা তার নিজের মৃত্যুর আগে ভাবে তার সন্তান্দের কথা যে তার মৃত্যুর পরে তার সন্তানদের কি হবে।মা তোর উপর সেই ছোট থেকে অনেক ঝড় গিয়েছে।আমিও দায়ী সেই কালঝড়ের জন্য।যদি এতোটা কড়া শাসনে না রেখে কাছে টেনে এনে বান্ধবীর মতো সব জেনে নিতে পারতাম আজ মা তোর এতো কষ্ট বেদনার মধ্যে যেতে হতো না।আমার যে তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নেই।আমি চাইব আমার মৃত্যুর আগে তোর বিয়ে দেখে যেতে।ঢাকা একা থাকিস তুই।কি না কি হয়ে যায়।যুগ ভালো না যে।মানুষের উপর বিশ্বাস উঠে গিয়েছে।আমাদের অনুপস্থিতে যাতে তোকে আগলে রাখার মানুষ থাকে আমরা সেটাই চাই।তোর বাবার বয়স হয়েছে।অলরেডি একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।কখন কি হয় আমরা জানিনা।

ছায়ার অজানা আশংকায় বুকের ভিতর ছ্যাঁত ছ্যাঁত করছে। মায়ের কোল থেকে উঠে মায়ের মুখোমুখি বসে।মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাপাকাপা গলায় বলে,

-মা তোমাদের কিচ্ছু হবে না দেখে নিও।আমিও ভালো থাকবো।আমি একা কোথায় নীলা আর মেঘা আছেতো।তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো।তোমার মেয়ে এখন লড়াই করতে জানে যে।

মীরা বেগম বেগম এইবার চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
ঝট করেই মেয়ের হাত দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

-মারে আমি আজ তোর কাছে কিছু চাইবো দিবি?আমাকে আজ খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না।

ছায়া যেনো সব বুঝেও বুঝতে চাইছে না।ছায়ার মনের মধ্য দিয়ে যেনো বালুঝড় বয়ে যাচ্ছে।সব কিছু পরিষ্কার থেকেও যেনো সব ঝাপসা।
তখনই দেখে ছায়ার বাবা রেজাউল সাহেব আসেন ধীর পায়ে মেয়ের ঘরে।এসে ছায়ার পাশে বসেন।ছায়া এইবার বাবার মুখের দিকে চায়।ছায়ার চোখে কৌতুহলের ভীর জমেছে।
রেজাউল সাহেবের মনও যেনো চট করেই ধরতে পারে মেয়ের দৃষ্টির মানে।
ছায়ার বাবা এইবার গাঢ় গলায় বললেন,

-আজ তোমাকে দেখতে আসবে মামনি।আমি ছেলের বিষয়ে অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি। ঢাকা থাকে ছেলের পরিবার।ছেলেও খুব শিক্ষিত।ছেলের পরিবারও যথেষ্ট অমায়িক।তারা তোমাকে আমাদের অভাব বুঝতেই দিবে না।নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবে।কোন বাবা মা চাইবে মেয়ের এমন বিয়ে ফিরিয়ে দিতে?
ছেলের দেখতে খুব সুদর্শন আর সবচাইতে বড় কথা ছেলে খুব ভালো মনের আর চরিত্রের।এই যুগে ভালো ছেলে পাওয়া খুব মুশকিল।আমিও চাইছিলাম তোমার পড়াশুনাটা শেষ হউক তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাববো।কিন্তু এতোকিছু হয়ে গেলো তোমাকে একা ছাড়তে ভয় করছে।আমার বয়স হয়েছে কখন কি হয়ে যায় কে জানে?তাই তোমার একটা শক্ত খুঁটির খুব প্রয়োজন।আমার শেষ আবদারটা তুমি রাখো।

ছায়া বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।কি করে ফেলবে তার বাবা মায়ের এই আবদার?তার যে পাপ লাগবে।ছায়ার মনের নদীতে পদ্ম পাতার ন্যায় ভাসতে থাকলো অরন্য।অরন্যের কি হবে?সে যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।আচ্ছা সে নিজে পারবে তো সেই মানুষটাকে ছাড়া?মনের মধ্য থেকে দামামার ন্যায় শব্দ ভেসে আসে না ছায়া তুই পারবি না, পারবি না।ছায়ার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে।এ কোন ঝড়ের আগমন?ছায়া কি না করে দেবে।অবশ্যই না করবে।ছায়া বাবাকে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে গেলেই দেখে বাবার চোখজোড়া। এই দুচোখ যেনো ছায়ার থেকে হ্যাঁ শুনার অপেক্ষাতে।ছায়ার বুক হুহু করে উঠে।ছায়ার মা ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-ছায়া তোর বাবার একটা সম্মান আছে।তোর বাবা কথা দিয়ে দিয়েছে।তারা আজকে চলেই আসছে।হয়তো রাস্তায়।এই মুহুর্তে না করা মানে তোর বাবার সম্মান নষ্ট হওয়া।

ছায়া পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে থাকে। সকাল থেকেই বাসায় পোলাও,কোর্মা,রোস্ট,গরুর মাংস, সেমাই,পায়েস রান্নার গন্ধ পাচ্ছিলো।সে ভেবেছিলো হয়তো এমনিতেই এখন বুঝতে পারছে কেনো।ছায়া কোনমতে উঠে দাঁড়ায়।বাবা মায়ের প্রতি আবারও তার মনে অভিমান জমেছে।তারা শুধু সেই প্রথম থেকে তাকে তাদের সিদ্ধান্তের দাস বানিয়ে রেখেছে।ছায়া কান্না আটকায় ঠোঁট চেপে।ভেজা কন্ঠে জানায়,

-আমি রেডি হবো।তোমরা এখন যাও।

মীরা বেগম মেয়ের অভিমান টের পেলেও চুপ থাকলেন।মেয়ের সুখের জন্য তিনি এইটুকু করতেই পারেন।তাই তিনি রেজাউল সাহেবকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন।
ছায়া পা টেনে টেনে ধীরে ধীরে দরজার কাছে গেলো।
দরজা লাগিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে।তীব্র ব্যাথায় সমগ্র দেহে আলোড়ন তৈরি হলো।মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে প্রতিটি নিউরন অরন্যের নাম জপ করছে।মনের এক কোণায় এক করুণাহীনা, বিধ্বংসী ঝড় যেনো সব নিঃশেষ করে দিচ্ছে।চোখের আবেশে ফোটে উঠে অরন্যের চেহারাটা।ছায়ার নাজেহাল অবস্থা হয়।ছায়া অরূপকে ডাকে,

-জানো অরূপদা তুমি তো আমার ম্যাজিক ম্যান ছিলে।জানো তুমি থাকতে কোন চিন্তারাই আমাকে ছুঁতে পারতো না।নিজের ভাইয়ের স্থানটা অনায়েষেই তুমি নিয়ে নিয়েছিলে।কিন্তু শেষ পর্যায়ে আমি কেনো সব লুকালাম তোমার থেকে আমি যে ভুল করেছিলাম।জানো অরূপদা তুমি চলে যাওয়ার পর আমি বুঝলাম ভালোবাসা কি।তোমার অনুপস্থিতিতে আমি তোমাকে অনুভব করতে শিখলাম নতুনভাবে।কিন্তু দেখো এক দমকা হাওয়া সব উলট পালট করে দিলো।কেনো দিলো?আমাকে এই অকূলপাথারে কেনো ফেলে গেলে?জানো ডাক্তারসাহেব আমার মনে ঠিক তোমার মতো জায়গা নিয়ে নিয়েছে।যেই অন্যায় তোমার সাথে হয়েছে তার সাথে আমি কিভাবে এই অন্যায় করি।কিন্ত আমি যে বাস্তবতার নির্মম বেড়াজালে প্রতিনিয়ত পিষে মরছি।বাবা যে শেষ আবদার করলো আমার কাছে।কিভাবে তাকে খালি হাতে ফিরাই?আমার জীবনের ২৩ বছরের ভালোবাসা আমার বাবা।এতোগুলো বছরের ভালোবাসা কে আমি কিভাবে কষ্ট দেই ডাক্তার সাহেবের জন্য!
তখনই রোজ দরজায় খট খট করে আওয়াজ করে।ছায়া নিজের চোখের পানিগুলো মুছে ফেলে।উঠে গিয়ে শাড়িটা গায়ে জড়ায়।
…..
ড্রয়িংরুমে বসে আছেন শাড়ি পরিহিতা একজন ভদ্রমহিলা।বয়স বেশি হলেও তার রেশমাত্র নেই চেহারায়।তার সাথে বসে আছে এক চঞ্চলা কিশোরী। রোজের সাথে যেনো তার খুব ভাব হয়ে গিয়েছে মাত্র এইটুকু সময়েই।ছায়ার বাবা মা তাদের বিপরীত পাশে বসে আছেন।ছায়া বসে আছে তাদের মাঝে।
ভদ্র মহিলা এইবার স্নিগ্ধ হাসলেন ছায়াকে দেখে।একগাল হেসে ছায়াকে বললেন,

-দেখেছো মেয়ের কান্ড! আমাকে দেখে এতো লজ্জা পেতে হবে না।আমিতো তোমার আরেকটা মা।এইদিকে আসো। আমার পাশে বসো তো।

ছায়ার ডাসা ডাসা চোখদুটো স্থির,নিষ্কম্প।সেই চোখে কি যে অহসাহয়তা।অতিরিক্ত কান্নার ফলে চোখদুটো লাল হয়ে আছে।ভদ্রমহিলা সব খেয়াল করলেন।ছায়াকে আদুরের সহিত নিজের পাশে বসার জন্য বললেন।ছায়া নিরবে তার পাশে গিয়ে বসলো।
এইবার ভদ্রমহিলা ছায়াকে আলতো করে নিজের সাথে চেপে ধরে বিনয়ী অথচ শান্ত কন্ঠে বললেন,

-একি আমার মেয়েটার মন খারাপ বুঝি!আমি কিন্তু তোমার আরেকটা মা হতে যাচ্ছি।তাই আমার থেকে কিছু লুকিও না। তোমার কিন্তু আরেকটা বাবা আছে।তিনি আসতে পারেননি একটা কাজে আটকে গিয়েছেন তাই।মা আমার ছেলেটা খুব ভালো।তোমাকে খুব সুখে রাখবে।তুমি খালি আমার ছেলেটাকে ভালোবেসো।তুমি আমার বাড়িতে বউ হয়ে না মেয়ে হয়ে যাবে।

ঠিক তখনই কিশোরীটি চঞ্চল পায়ে এসে ছায়ার পাশে বসে তাকে তাকে একহাতে পেচিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।নীলাভ অম্বরের ন্যায় হাসলো।হাসির তোড়ে তার অক্ষিপল্লবগুলো যেনো নেচে উঠছে।চিরল দাতগুলো বের করে হাসতে হাসতেই বললো,

-এই বুঝি আমার ভাবী হবে।ওমা তুমি কি সুন্দর গো।আমার চোখ যেনো ধাধিয়ে যাচ্ছে।আমার ভাইয়ের সাথে তোমাকে খুব মানাবে।আমার ভাইয়ও ঠিক তোমার মতো সুন্দর।
এইটা বলেই কিশোরী হাসে।যেনো জানালা দিয়ে আসা সূর্যের কিরণে ঝকঝক করছে সেই হাসি।এইবার ভদ্রমহিলা স্নিগ্ধ হাসির নহর নিয়ে প্রস্তাব রাখলেন ছায়ার বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে,

-ভাই আর ভাবী আপনাদের নিকট আমাদের বিনীত আবেদন আপনাদের মেয়েকে আমি এই শুক্রবারেই আমার বাড়িতে তুলতে চাইছি।কোন না কিন্ত আমি শুনবো না।আমার সাহেব আসতে পারেনি জরুরি কাজে।কিন্তু তিনি নিজেও ছেলের বিয়ে নিয়ে খুব উত্তেজিত। খুবই আফসোস তার না আসতে পেরে।তাই তিনি নিজেই বলেছে বিয়ের এই ডেইট রাখতে।

এইবার ছায়ার বাবা কিছুটা ইতস্ততভাবে বললেন,

-দেখুন আপা মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা হয়েছে।কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? আজই তো রবিবার।শুক্রবারে বিয়ে হলে হাতে মাত্র সময় আজ বাদে আর মাত্র চারদিন।এইটুকু সময়ে কিভাবে কি হবে?আত্মীয়স্বজন দাওয়াতের একটা বিষয় আছে।আমার বড় মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করে হবে।কিন্তু আয়োজনের জন্য হলেও সময় প্রয়োজন।

এইবার যেনো ভদ্র মহিলা বুঝলেন।কিন্তু তিনি নিজের কথায় স্থির থাকলেন,

-ভাই মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।এই চারদিনে যতটুকু করা যায় ততোটুকুই করুন।আজকাল যুগ খুব উন্নত হয়ে গিয়েছে।অনলাইনে সব করা যায়।তাই এতো টেনশন করবেন না।আর একা ভাববেন না নিজেদের আমরা সবাই আছি আপনার সাথে।তাহলে সে কথাই রইলো। আজ আমরা উঠি।

এইবার মীরা বেগম বাধ সাধলেন,

-এমা না খাইয়ে কাউকে ছাড়ছিনা।হাত মুখ ধুয়ে আসুন তো।

ভদ্রমহিলা সম্মতি জানায়।
….
রাতের ঠিক ১১ টা।
ছায়ার চোখে ঘুম নেই।বারান্দায় বসে আছে।মনের ভিতর অপরাধবোধ।আচ্ছা অরন্য জানতে পারলে তার মনের অবস্থা কেমন হবে?সে কি খুব কষ্ট পাবে?হয়তো খুব পাবে।আচ্ছা ডাক্তারসাহেব কি কখনো বিয়ে করবে?ছায়ার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথার অস্তিত্ব অনুভব করে।চোখের পাল্লা হয় অবনত। তখনই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠে।ছায়ার হৃদয়ে যেনো এক পশলা শান্তির আবির্ভাব ঘটে।

-আপনি যে এতোদিনের জন্য চলে গেলেন ছায়াকরী। আমার যে মন টিকছে না।কি করি বলুন তো?তাই চিন্তা করছি তিন দিনের ছুটি নিয়ে আশুগঞ্জে চলে আসবো।ভালো লাগছে না।

ছায়া যেনো পিষ্ট হলো অপরাধবোধের যাতাকলে।এই মানুষটাকে কি করে বিয়ের কথা বলবে।ঠিক থাকবে তো সে সব শুনে?সব বলতে গিয়েও যেনো কিছু বলা হলো না।

-কেমন আছেন ডাক্তারসাহেব?

-আপনি যেমন রেখেছেন।

-আমি যে ভালো রাখিনি।

-বুঝতে পারছেন বুঝি!এইবার বোধহয় ভালোই থাকবো আমি।

ছায়ার মন কেঁদে উঠে। মুখে আধার নেমে আসে।এই মানুষটার সাথে কথা বললে সে আরো ভেঙে পড়বে।

-আমি চাই আপনি ভালো থাকুন ডাক্তারসাহেব।

-আমার ভালো থাকার জন্য যে আপনাকে প্রয়োজন।

ছায়া আর কথা বলে না।নীরব থেকে অনুভব করতে থাকে একজন আরেজনের নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তা। বেপরোয়া, লাগামহীন সেই নিঃশ্বাস যেনো তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে তুলছে।তার মনে তুললো এক ভয়াল গর্জন।শান্ত পরিবেশ যনো মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে উঠলো।থেমে থেমে কেঁপে উঠছে লতানো সেই দেহ।গাল বেয়ে পড়লো উষ্ণ জলের নহর।
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৫২
(কপি করা নিষেধ)

বাসায় চলছে বিয়ের তোড়জোড়। এ যেনো খুশির আমেজ।সবাই মান অভিমান সব ভুলে নিজেরা নিজেরা সব কাজ করছে।বাড়িতে গিজগিজ করছে মেহমানরা।দূরের আত্মীয়স্বজনরা এখনও এসে পৌঁছায়নি। কাছের আত্মীয়রাই এসেছে বাড়িতে।কাল গায়ে হলুদ।গায়ে হালুদের স্টেজ সাজাতে সবাই ব্যস্ত।হরেক পদের রান্নার গন্ধে পুরো বাড়ি মো মো করছে।

দাওয়াত পেয়ে নীলা আর মেঘা ছায়াদের বাড়ি এসে হাজির।মীরা বেগম বেশ স্নেহের সাথে তাদের আপ্যায়ন করলেন।রোজকে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন তাদের ছায়ার ঘরে পৌঁছে দিতে। তার হাতে এখন অনেক কাজ।নীলা আর মেঘা যেনো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারলো না ছায়ার বিয়ে।এ যেনো এক অবিশ্বাস্য কথা।তারা যেনো এই বিয়ে মানতেই পারছে না।চোখে মুখে কিঞ্চিৎ আক্রোশ ফুটিয়ে ছায়ার ঘরের দিকে যায় রোজ আর কিয়ারার সাথে।
তারা গিয়ে দেখে ছায়া ঘরে নেই।রোজ আর কিয়ারাতো ওদের ঘরে পৌঁছে দিয়েই ফুড়ুৎ। বাইরে বাচ্চা পার্টিরা নাচে গানে মশগুল।
নীলা আর মেঘা একবার একে অপরের মুখের দিকে তাকায়।ঘরে এসে ব্যাগপত্র গুলো রুমের একসাইডে রেখে ফ্যানের সুইচ টিপে ফ্যানটা চালু করে।ভ্যাপসা গরমে এই ফ্যানের বাতাসও যেনো গরম হয়ে আছে।নীলা আর মেঘা ছায়াকে কতকবার ডাকে।কোন সাড়া আসে না।এইবার নীলা আর মেঘার বারান্দার দিকে চোখ যায়।ছায়া বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে আছে।বিয়ের আমেজ যেনো তাকে ছুঁতেই পারেনি। মলিন তার চেহারা।শীতের সময় গাছের পাতারা যেমন কুঁকড়ে যায় শীতের রিক্ততায় ছায়াও যেনো কুঁকড়ে গিয়েছে।নীলা আর মেঘা যে আক্রোশ নিয়ে এসেছিলো তা যেনো মুহুর্তেই কর্পূরের ন্যায় উবে গেলো। ব্যস্ততম ভঙ্গীতে ছায়ার পাশে গিয়ে বসলো ধপ করে।কিন্তু ছায়ার কোন হেলদুল নেই।এ যেনো এক জীবন্ত কাঠপুতুলে রূপান্তরিত হয়েছে।নীলা গিয়ে ছায়ার মাথায় হাত বুলায়।মৃদুকন্ঠে বলে,

-অরন্য ভাইয়াকে ভালোবাসলে কেনো বিয়েটা করছিস?

ছায়া নিশ্চুপ রয়।

মেঘা রয়ে সয়ে এইবার বলে,

-ভাইয়া তোকে ভালোবাসে।ভাইয়া জানলে কি হবে ভাবতে পারছিস?

ছায়া বরাবরের মতোই নিশ্চুপ।চোখগুলো মুহুর্তেই সিক্ত হয়ে যায়।সিক্ত নয়নযুগল পানিতে টইটুম্বুর। অধর উল্টে ফেললো ছায়া।নীলা একহাত ছায়ার পিঠ আকড়ে ধরে বলে,

-আমরা তোর ভালো চাই ছায়া।তুই যা চাইবি তাই হবে।যদি বলিস বিয়েটা হবে তবে তাই হবে।যদি বলিস ভাইয়ার কাছে যাবি তবে আমরা তাও করে দিতে পারবো।সব তোর ইচ্ছামতো হবে।শুধু তুই কাঁদিস না।আমার খুব কষ্ট হয় ছায়া।তুই কাঁদলে আমিও কেঁদে দিবো বলে দিলাম।

ছায়া এইবার নীলাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।ঝকঝকে অক্ষিকোটর বেয়ের উষ্ণ জলের স্রোতস্বিনী বইতে থাকে।ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,

-আমার যে কিছুই করার থাকলো না।বাবা মাকে খালি হাতে ফেরাতে পারিনি।আমার ২৩ বছরের ভালোবাসার কাছে ডাক্তারসাহেবের ভালোবাসা হার মানলো।

ছায়া নীলাকে রেখে উঠে দাঁড়ালো। অস্বাভাবিক গতিতে দৌঁড়ে রুমে গেলো।গুছানো বিছানা মুহুর্তেই অগোছালো করলো।বিছানা হাতড়ে অপ্রকিতস্থের ন্যায় মোবাইল খুঁজলো।নাম্বার টিপে এই প্রথমবার কল লাগালো অরন্যের কাছে।ফোন রিং হতে হতে রিসিভ হতেই ছায়া ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,

-আজ রাতে একবার আসবেন ডাক্তারসাহেব।আপনাকে যে অনেক কিছু বলার বাকি।

অরন্য কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রয়।ছায়া নিজে তাকে আহবান জানাচ্ছে।এ কি সেই বহু প্রতিক্ষীত প্রেমের আহ্বান? অরন্যের মন পুলকিত হয়।

অথচ এই প্রেমিক জানলোই না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।
…..
রাতের আকাশ মেঘে ঢাকা।মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।যে কোন সময় আছড়ে পড়তে পারে মাটিতে।সেই সাথে বইছে শীতল বাতাস।গাছের ডাল পালা সেই বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে মেতে উঠলো যেনো।
ছায়া দাঁড়িয়ে রয় বাড়ির পেছনের সেই দীঘি পাড়ে।শান বাঁধানো সেই ঘাটে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে পানিতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে।তখনই কানে আসে কারো পদযুগলের আওয়াজ।ছায়া বুঝতে পারে কে হতে পারে।সে নীরবে এসে ছায়ার পাশে বসে।ছায়া পানিতে তারা দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে।অরন্য এইবার ছায়ার পানে চায় মায়া, আর অতলস্পর্শী আবেগ নিয়ে।তার মনে বয়ে যাচ্ছে সুখের পবন।তখনই ছায়া উচ্চারণ করে পৃথিবীর সবচাইতে নিদারুণ কষ্টের হৃদয় ঝাঝরা করা বানী,

-আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে ডাক্তারসাহেব।শুক্রবারে আমার বিয়ে।কাল গায়ে হলুদ।

এই বিষ মেশানো বাক্য যেনো অরন্যের হৃদপিন্ডে গিয়ে লাগলো।তার কর্ণকুহর এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেলো।যেনো তার কানে কেউ গলিত লোহা ঢেলে দিয়েছে।অরন্য অবিশাস্যের কন্ঠে বলে,

-এইসব কি সব বলছেন ছায়াকরী? আপনি মজা করছেন তাই না?

ছায়া বিবশ চাহনি নিক্ষেপ করে অরন্যের পানে।নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলে,

-আমার বাড়ির দিকে ভালো করে একবার তাকিয়ে দেখলে বুঝতে পারতেন।

অরন্য এইবার এলোমেলো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছায়াদের বাড়ির দিকে।সে আসার সময় দেখেছিলো গেইট লাগানো হয়েছে।কিন্তু অতিরিক্ত উত্তেজনায় সেইসব কিছুতেই আমলে নেয় নি।অরন্যের বুকের ভেতর ধক করে উঠে।বুকের ভিতর রক্তচোষা বিষাক্ত জোক যেনো কামড়ে ধরে।তার সমস্ত রক্ত যেনো চুষে খেয়ে ফেলছে।অরন্যের মাথা বিভৎস ঘূর্ণিপাকে যেনো ঘুরে উঠে।অস্বাভাবিক করুণ স্বরে বলে,

-ছায়াকরী কেন করলেন এমন?আমাকে একটু ভালোবাসা যেতো না?অপ্রেমের কি ভীষণ শক্তি ছায়াকরী এতো প্রেমকেও সংশয়ে ফেলে দেয়!

অরন্য হাসে নির্জীব হাসি।সেই হাসিতে হাজারো দুঃখ, না পাওয়া মিশে আছে।ইশ কি গভীর আকুলতা সেই চোখের গভীর চাহনীতে।ছায়া নিশ্চল,শান্ত গলায় বলে,

-আচ্ছা ডাক্তারসাহেব নদীতে তুফান এলে কূল ভাঙে।বলুন তো দেখি মনে তুফান এলে কি হয়?মনে তুফান এলে বুক ভাঙে।আমার যে ভাঙা বুক।ভাঙা বুক নিয়ে বুঝি ভালোবাসা যায়!

অরন্য প্রিয়তমার মুখের দিকে গভীর আকুলতা,নিরন্তর, গুঢ় প্রেম নিয়ে তাকায়।ছায়ার বুকের ভেতর ছলাৎছলাৎ শব্দ হয়।এ যেনো জলোচ্ছ্বাসের বানে তাকে আবারও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।সেই চাহনিতে তার অন্তরাত্মা কেপে উঠে।সে যে ভুল করছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

অরন্য সরু,শানিত দৃষ্টি ফেলে নিগুঢ় ভালোবাসাময় ব্যাথিত কন্ঠে বলে,

-খুব ইচ্ছে ছিলো আপনাকে নিয়ে পাড়ি জমাতে আষাঢ়ের ঘন ঘন জমাট বাঁধা মেঘের দলে।
জানেন? অবেলার গোধুলী লগ্নে পশ্চিম আকাশে ডুবু ডুবু সূর্য্যের অমায়িক লাল রঙ্গের মাঝে আপনাকে নিয়ে একটু পায়চারি করতে বড্ড ইচ্ছে করে।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসলে নদীর পাড়ে বাঁকা চাঁদের আবছায়া আলোয় বসে আপনার হাতে হাত রেখে জোঁনাকির আলোয় রাঙ্গা মৃদু বাতাসে ঘুঘড়ি পোকার ডাকে হৃদয়ের সংলাপ শোনাতে।
মন খুব করে চায় নিমগ্ন হয়ে হৃদয়ের ব্যকুলতা নিয়ে আপনার খোলা চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে।কিন্তু জানেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কিছুই হলো না।আমি আপনাকে জোর করবো না।জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না।আমি অপেক্ষা করবো আপনার।

অরন্য আর দাঁড়ায় না এক মুহুর্তও।হনহন করে চলে যায় তার নিজ গন্তব্যে।আসলেই কি তাই?নাকি নিজ গন্তব্যটাকেই ফেলে রেখে সে চলছে ক্রমশ ধ্বংশের মুখে।
……

গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে বিশাল বড় করে।কৃত্রিম সফেদ আলোয় ঝকঝক ফকফক করছে স্টেজ। ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছু ধাপে সারি সারি মোমবাতি যেনো মোহময় আবহ তৈরি করেছে।মোমবাতির হলুদ দ্যোতিতে যেনো সব আধার কেটে যাবে। আবার একটু দূরে মাঝখানে কৃত্রিম ঝর্ণারও বানানো হয়েছে। পানির ফোয়ারার মতো যেনো মানুষের হাসিচ্ছটার বিচ্ছুরণ হচ্ছে মানুষের মুখ থেকে।

ছায়াকে পড়ানো হয়েছে কাচা হলুদ রঙ্গের শাড়ি।সাজানো হয়ে ফুলের গয়না দিয়ে।এ যেনো কোন এক
হলুদ রাজ্যের হলুদ রাজকন্যা।হলুদের মাঝে লাল লিপস্টিক আর টিপ যেনো হলুদ ফুলের মাঝে কোন এক লাল কলিকা।যেনো কোন এক রাজপুত্র এখনই এলো তাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে তার রাজ্যের রানী করে নিয়ে যেতে।
ছায়াকে বসানো হয়ে স্টেজের মাঝখানে।ছায়া একবার নিষ্প্রাণচোখে আশেপাশে চোখ বুলায়।সে দেখে তারা
বাবা মা কি হাসিখুশি,তার বোন রোজ হলুদ শাড়ি পরে কিয়ারার সাথে নেচেকুদে বেড়াচ্ছে,মিম ঝিম আর ছোট্ট সদস্য রোহানতো তার কাছ ছাড়া হচ্ছে না।আঠার মতো লেগে আছে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে,তার ফুফু রোওশানারা বেগমও ওদের সাথে তাল মেলাচ্ছে পুরানো সব অভিমান ভুলে যেনো নিজেকে তাদের মধ্যে সামিল করেছে।চাচী মালা বেগম,চাচা মিজান সাহেব সবার মুখের দিকে তাকালো।হামিদা বানুতো পান খেয়ে খেয়ে ঠোঁট লাল বানিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে খোশ আলাপে মজেছেন।ছায়া সবার মাঝে নিজের খুশি খুঁজে খালি হাতে নিজের কাছে ফেরে।তারা বুকের ভেতর হুহু করছে।আগুন জ্বলছে দপদপ করে।নীলা,মেঘাও ছায়ার পাশে এসে বসে নিজেদের সাজসজ্জা পুরো করে।
তখনই ছায়া দেখে যে অরন্য,প্রাণ,অভিক,আনফাল, শান্ত আর স্নেহারাও আসে।ছায়া আতকে উঠে।ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে।দৃষ্টি হয় ঘোলা।
ছায়া আত্মগ্লানিতে পুড়তে থাকে।
তখনই ছায়ার বাবা একটা সাদা শুভ্র কালারের পাঞ্জাবী আর মীরা বেগম একটা বাসন্তী কালারের শাড়ি পড়ে তার দুইপাশে বসে হলুদ ছোঁয়ায়।ছায়া সাথে সাথেই চোখের পানি ছেড়ে দেয়।মীরা গভীর মমতায় সেই চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।ভাবতেই অবাক লাগে মেয়ের বিয়ে! মেয়ে নাকি শ্বশুরঘর যাবে।মেয়েকে শাসনে শাসনে বড় করেছেন যাতে ন্যায়,নিষ্ঠা,নিয়মনীতির মধ্যে থাকে।আজ তিনি সফল।কিন্তু মেয়ে তার সুখ,দুঃখের অনুভূতি প্রকাশই ভুলে গিয়েছে।আজ তিনি সফল হয়েও ব্যর্থ মা।ছায়ার মা মেয়েকে কাছে টানে।ছায়া সিক্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়।মীরা বেগম আদুরে গলায় বলে,

-মাঝে মাঝে মায়েরাও চোখের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হয়,মায়েদের চোখের জ্যোতি কমে যায় তখন মেয়েদের মুখ ফুটে বলতে শিখতে হয়।আমার মেয়ে এতো বড় হয়ে গেলো শ্বশুরবাড়ি যাবে আজ বাদে কাল।কীভাবে থাকবো আমি মেয়ে দিয়ে!
বলতে বলতেই যেনো মীরা বেগমের গলা ধরে। এই সুদিনে তিনি কাঁদবেন না,একদমই কাঁদবেন না।

ছায়ার বাবা ছায়াকে হলুদ ছোঁয়ায়।

-আমার মেয়ে যাতে ধরণীর বুকের সর্বসুখ পায়।দোয়া রইলো এই বাবার।

ছায়া কিঞ্চিৎ হাসে।রোজ, কিয়ারা,মিম,ঝিম আর রোহান আসে হুড়মুড়িয়ে।তারা একজোট হয়ে বসে ছায়াকে হলুদ ছোঁয়ায়।সেই সাথে চুমুতে ভরিয়ে দেয় ছায়ার মুখ।হামিদা বানু পান খাওয়া লাল ঠোঁট নিয়ে নাতিনির পাশে বসেন আরাম করে।এর পর লাল দাঁতগুলো বের করে হাসে খিকখিক করে আর বলে,

-আমার নাতনি স্বামী সোহাগি হোক।জামাই যাতে বউ ছাড়া কিছু না বুঝে।আদুরে আদুরে আমার নাতনিরে ভারাইয়া রাখে।
ছায়া বেশ লজ্জা পেলো দাদীর এইসব কথা শুনে।ইশ কি লজ্জা! এইসব বুঝি বলতে হয়।নাতনির লজ্জা পাওয়া মুখ দেখে এইবার হামিদা বানু উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।
এইবার রোওশানারা বেগম এসে ছায়ার পাশে বসলেন,

-ছায়া আমি তোকে ছোট থেকেই খুব পছন্দ করতাম।কোল ছাড়া করতাম না।সেই ছোট্ট বেলা যখন আধোআধো বুলিতে পুপি পুপি ডাকতি আমার মনটা নেচে উঠতো।বারবার সেই ডাক শুনার বায়না করতাম।আজ তোর গায়ে হলুদ।বিয়ের প্রথম ধাপ।আমি ক্ষমা চাইবো না কিন্তু ভালোবাসা আর দোয়া দিবো।

ছায়া সেই পুরানো ফুপিকে পেয়ে যেনো আবেগময় হলো।কান্নারা এসে গলায় বারি খেলো।আঘাতে আঘাতে যেই মানুষটা তাকে জর্জরিত করেছিলো সেই মানুষটা আজ আচঁল পেতে তাকে ভালোবাসা কুড়াতে বলছে।সে কি ফিরিয়ে দিতে পারে?পারে না।সে যে ভালোবাসার কাঙালিনী।
নীলা, মেঘা আর স্নেহা আসে একসাথে।ছায়াকে একবার ভালো করে দেখে।এই সুন্দর চাকচিক্যময় চেহারার আড়ালে ভাঙা মলিন মুখটা যেনো তারা ধরতে পারলো।নীলা ছায়ার গালে হলুদ ছুঁয়িয়ে কানে কানে বলে,

-এখনও সময় আছে। ছায়া নিজেকে বলি দিস না।ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিস।

ছায়া নীরব রয়।সে কি পারবে এই ভরা মজলিশ থেকে উঠে যেতে?

প্রাণ আসে মুখে হাসি নিয়ে।এসেই বলে,

-আমার বোনকে গায়ে হলুদের শুভেচ্ছা।

ছায়া চেয়ে রয় প্রাণের দিকে।প্রাণ হাসে ঠোঁট এলিয়ে।
সবাই হলুদ ছোয়ায় ছায়াকে একে একে।

এইবার অরন্য নিজেও আসে হলুদ ছোঁয়াতে। ছায়া আড়ষ্ট হয় জড়তায়।অরন্য একবার ছায়ার পুরো গায়ে চোখ বুলায়।এই সাজ তো অন্য কারো জন্যে।এই সাজতো তার নিজের জন্য সাজার কথা ছিলো।প্রাণ জোর না করলে সে কখনোই আসতো না।আবার ছায়াকে হলুদের সাজে দেখার লোভটাও সামলাতে পারলো না।বেহায়ার মতো চলেই এলো।তার বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।এক হাতে হলুদ নিয়ে ছায়ার গালে ছোঁয়ায়।শীতল হাতের স্পর্শে ছায়ার পুরো তনু ঝংকার দিয়ে উঠে।তড়িৎ বেগে বিদ্যুৎ ঝলাকানি তা পুরো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।অরন্য একটা ফু দেয় ছায়ার কানের কাছে আর জড়ানো গলায় বলে,

-আলবিদা।

ছায়ার শরীর শিরশির করে উঠে।অপ্রস্তুত হয়।বুকের ভেতর যেনো বৈশাখের বাণ ছুটে।অরন্য আর বসে না।সে চলে যায় হনহন করে ক্ষণপ্রভার ন্যায় এই অনুষ্ঠান ছেড়ে ।আর একমুহুর্ত থাকলে নিঃশাস আটকে এখনই মারা যাবে।পিছু ফেরে না আর।পেছনে ফেলে যায় এক জীর্ন,শীর্ণ ভগ্ন রমনীকে।
ছায়া নিনির্মেষ তাকিয়ে রয় অরন্যের যাওয়ার পানে।কাতর তার দৃষ্টি।ছলছল করছে অক্ষি।
প্রাণ একবার ছায়ার দিকে চায়।এরপর আর কিছুই বলে না।সে সবার কাজে সাহায্য করতে থাকে ব্যস্তভঙ্গিতে।

#চলবে
(সবাই ধৈর্য ধরুন তো)
#চলবে
(দেরি করে দিচ্ছি বলে কেউ রাগবেন না।আমার পরীক্ষা। পড়তে হয়।ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here