কুঞ্জছায়া পর্ব ৪৫+৪৬+৪৭

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪৫
(কপি করা নিষেধ)
উচ্ছ্বসিত কিশোরী একটা নদীর পাড়ে নীল রঙা শাড়িতে নিজেকে আবৃত করে হাতে লাল গোলাপ নিয়ে তার প্রাণ পুরুষের জন্য অপেক্ষা করছে।কাঙ্ক্ষিত পুরুষ আসতেই অনন্যার চোখ দুটো চিক চিক করে উঠে।বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে হৃদয়ের ধুক পুক ধ্বনিটা পরোখ করে নিলো।আজ তার প্রাণপুরুষকে বলেই দিবে হৃদয়ে কতোটা প্রেম তার জন্য জমিয়ে রেখেছে।সব আজ উজার করে দিবে তার চরণে।নদী তীরের বাতাসে চুলগুলো উড়ছে।আউলা ঝাউলা করে দিচ্ছে।অনন্যা চুলগুলো ঠিক করে নিলো।কিন্তু আবার বাতাসের ঝাপটায় এলো হয়ে গেলো।মুখটা একটু কুচকে ফেললো।কিন্তু সাথে সাথেই সব ভুলে অনন্যা ঝলমলে কন্ঠে বললো,

-প্রাণ ভাইয়া তুমি এসেছো?আমি জানতাম তুমি আসবে।জানো তোমাকে দেখলে না আমার মনটা কেমন কেমন করে।মনটাকে নিজের আয়ত্তে রাখতেই পারি না।খালি প্রাণ ভাইয়া প্রান ভাইয়া করে।বলোতো কি অবাধ্য মন আমার কথা শুনে না।বার বার তোমার কাছে যেতে চায়।তাই ঠিক করলাম এই অবাধ্য মনটাকে তোমাকেই দিয়ে দিবো।রাখবো না আমার কাছে।তাই একদিন কোন জাঁকজমক ছাড়াই মনটাকে তোমার নামে করে দিলাম।দিয়ে দিলাম মালিকানা।এখন শুধু তোমার সম্মতি প্রয়োজন।কাগজে কলমে সই করে আনুষ্ঠানিক ভাবে তুমি নিয়ে নাও।
অনন্যা এইবার জিভ দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে গোলাপটা প্রাণের দিকে এগিয়ে দেয়।
প্রাণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নিষ্প্রাণ চোখে এই চঞ্চলা কিশোরীর দিকে।আজ প্রাণের বুকে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে।বড় অবেলায় এই আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিবে?প্রাণ এইবার নিজেকে শক্ত করলো।

-আমি একজনকে ভালোবাসি অনু।তুই বড্ড ছোট।সবে ইন্টারে পড়ছিস। সামনে আরো অনেক সময় বাকি।এখন নতুন দুনিয়া দেখছিস।তাই চোখে সব রঙিন লাগছে।যখন বিশ পার করবি তখনই দেখবি দুনিয়া বদলাতে শুরু করবে।তখন বুঝবি দুনিয়ার বাস্তবতা।এখন এইসব আবেগ ছাড়া কিছুই না।বড় হলে বুঝবি এইসব আবেগ কি মূল্যহীন ছিলো।এইসব মনে করে নিজের উপরই হাসবি।

অনন্যার চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো।বুকের ভেতর যেনো ছলাৎছলাৎ শব্দ হচ্ছে। হাত থেকে ফুলটা পড়ে যায়।
প্রাণ আবারো বলে,
-এমন বাচ্চা মেয়েদের আমি পছন্দ করি না।এরা কিছুই বুঝে না।অর্ধেক জীবন পার হয়ে যায় ওদের সাথে মানিয়ে নিতে নিতেই।আমি ম্যাচিউর মেয়ে পছন্দ করি।আমার মনে একজনই আছে।আর সে আজীবন থাকবে।তাকে আমি খুব খুব ভালোবাসি। তার সাথে কাটানো মিষ্টি মুহুর্তগুলো আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।সে আমার অনুভবে মিশে আছে।তাকে ছাড়া আর কাউকে এই বুকে জায়গা দেওয়া সম্ভব না।
তাই তুই এইসব ভুলে যা।পড়াশুনোয় মনোযোগ দে।

এই বলেই প্রাণ সেইখান থেকে চলে যায়।আর পিছু ফিরে তাকায় না।অক্ষিপল্লব ভিজিয়ে এক ফোটা অশ্রুজল টুপ করে পড়ে ঠোঁটের উপর।

দম দম করছে অনন্যার হৃদপিন্ড।মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় যেনো ঝি ঝি পোকারা ভন ভন করছে।বিবশ হয়ে আসছে শরীর।নিনির্মেষ তার চাহনি। অক্ষিযুগলে ভর করলো ভারি বর্ষণ।যেই বর্ষণের কোন ছন্দপতন নেই। ঝড় যেমন গাছের শিকড় উপড়ে ফেলে দেয় মাটিতে আর অনন্যাও যেনো আজ সেই ঝড়ের শিকার। ঢলে পড়লো মাটিতে।
অদূর হতে গাড়ির ড্রাইভার দৌঁড়ে এলো অনুমা করতে করতে।ভয়ের চটে ড্রাইভারের ঘাম ছুটলো।কোনমতে অনন্যাকে নিয়ে উঠালো গাড়িতে।বাড়িতে পৌঁছাতে হবেতো।৪০ মিনিটের রাস্তা পৌছালো ২০ মিনিটে।যেই না বাসায় গিয়ে ড্রাইভার পৌছালো জলদি অনন্যার মা আর আকাশকে তলব করলো।জেসমিন বেগম মেয়ের এই হাল দেখে দিলো এক চিৎকার।আকাশ এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।হুশ আসতেই কোলে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে জলদি পায়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুয়ালো।জেসমিন বেগম কাঁদতে লাগলেন। মেয়ের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারছেন না।বুকের ভেতর ভয়ে ঢিপ ঢিপ করছে।দুচোখ অশ্রুতে ভরে আসছে।কান্নারত অবস্থায় অরন্যকে ফোন করলেন।বললেন এখনই বাসায় আসতে।আজমির চৌধুরীকে ফোন দিয়েও মেয়ের কথা জানালেন।
……
অরন্য আহানের কাছে এসেছে।আহানকে বেধে রাখা হয়েছে শক্ত স্টিলের চেয়ারের সাথে।মাথার মতো সাইজের একটা ক্যাপ যা অসংখ্য তার দিয়ে ভরা।কারেন্ট শক দেওয়া হচ্ছে।আহান যেনো পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে।মুখ দিয়ে লালা বেরোচ্ছে।অরন্য আশিকের দিকে তাকালো।

-কিছু বলেছে?

-মুখ খুলছে না। শুধু এইটুকু বলছে যে তাকে টাকা দিয়েছলো একজন যাকে সে চিনে না।আর বলেছে ছায়াকে রেপ করতে।কিন্তু সে পারেনি অরূপের জন্য।এরপর ছায়া বাড়ি থেকে খুব একটা বের হতো না।অলরেডি আহানের নাম পুলিশের খাতায় চলে গিয়েছিলো তাই ঠিক করলো এইবার অন্য কাউকে দিয়ে করাবে।ছায়া এরপর ঢাকা চলে গেলে তুই সব সময় সাথে থাকতি তাই কিছু করতে পারছিলো না কড়া সিকিউরিটির মাঝে।তাই রবিনকে বেছে নেওয়া হলো।কথায় আছে না ঘরের শত্রু বিভীষণ সেটাই হলো।রবিনকে লোভ দেখানো হলো টাকার।কিন্তু রবিন মানতে না চাইলে তাকে একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার লোভ দেখানো হলো সাথে টাকাও।নারী নেশা সবচাইতে বড় নেশা।রবিন রাজি হয়ে গেলো।

ঠিক তখনই বদ্ধঘরে মোবাইল কাপিয়ে ফোন আসে অরন্যের।মায়ের ফোন পেয়ে অরন্য চিন্তায় পড়ে যায়।একদিকে বোন অন্যদিকে প্রেয়সী।
কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।ঢাকায় পৌঁছাতেই দেখে গাড়ির ফুয়েল শেষ।বাড়ির পথ আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি।অরন্য গাড়ি সাইড করে একটা ফুয়েলের দোকানের সামনে দাঁড়ায়।ঠিক তখনই অকস্মাৎ একটা গুলি তার বাম হাতের কিনারায় লাগে।অরন্য ঠিক সময়ে সরে যাওয়াতে তা বুকে লাগেনি।গুলির আওয়াজে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যায়।বিপর্যস্ত হয় জনমানব।দৌঁড়া দৌঁড়ি লাগায়।মানুষ জড়ো হতে থাকে।অরন্যের বাম হাত দিয়ে গলগল করে লাল রক্ত পড়েতে থাকে।ভিজে যায় শার্ট।মুখ চিরে বেরিয়ে আসে হালকা আঁহ সূচক শব্দ।অরন্য আশেপাশে তাকালো যে গুলি করেছে তাকে পাওয়া গেলো না।এইবার মাথার ডানপাশের সিসি ক্যামেরাতে তাকিয়ে একটা বাকা হাসি দেয়।মাছ তবে জালে আটকা পড়লোই।অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিল কেউ তাকে ফলো করছে।গাড়ি বুলেটপ্রুফ থাকায় কিছু করতে পারেনি।সুযোগ বুঝে অরন্য মানুষটাকে দেখার জন্য গাড়ি থেকে বেরিয়ে সিসি ক্যামেরা যেইখানটায় আছে সেইখানটায় যায় আর গাড়িতে তেল ভরার নাটক করে।তবে এর আগেই আশিককে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দেয় সব।ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছে মনে হয় এতোক্ষণে।তখনই মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ আসে।অরন্য ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই ঢলে পড়ে।ততোক্ষণে প্রাণ এসে অরন্যকে ধরে ফেলে।প্রাণ ভীতসন্ত্রস্ত হলো।

-শিট শিট। এই অরন্য উঠ উঠ।কেনো এতো রিস্ক নিলি?আমাকে আশিক ফোন করে না জানালে জানতেই পারতাম না।নিজের এতো ক্ষতি কেনো করছিস।
প্রাণ অরন্যকে কোনমতে তুলে দাঁড় করায়।একজনের সহায়তায় গাড়িতে তুলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
….
অরন্যের গুলি লাগার কথা শুনেই ছায়ার হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ে।ধীরে বিবশ হয়ে আসতে লাগলো শরীর।অক্ষিকোটর অশ্রু দ্বারা প্লাবিত হলো।মনে হচ্ছে যেনো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে।বুক চিরে বেরিয়ে আসলো করুন আর্তনাদ।জেঁকে বসলো মনে অজানা ভয়। কিসের ভয়?কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয়?ভয় তাকে গ্রাস করলো।হৃদপিন্ড যেনো তার কম্পন থামিয়ে দিলো।ঢলে পড়তে নিলেই ছায়া জানালার পর্দা খিচে ধরে। কান্নাগুলো গলায় জমাট বাধে।আচমকাই মস্তিষ্কের নিউওরন গুলোতে ঢেউ খেলে একটি কথাই নাহ তাকে এখনই যেতে হবে।লম্বা লম্বা পা ফেলে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলো।

অন্যদিকে অরন্যের গুলি লাগা অন্য দিকে অনন্যার জ্ঞান হারানো।জেসমিন বেগমের অবস্থা পাগলপ্রায়।উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আচরণ শুরু করলেন।কাঁদলেন বিলাপ করে। মেয়ের চোখে মুখে পানির ছিটা দিলেন।অনন্যা পিট পিট করে চোখ খুলতে জেসমিন বেগম হামলে পড়ে তার বুকের উপর।হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

-অনুমা আমার সুখের পরিবারে কার অশুভ নজর লাগলো রে।আমার অরন্য হসপিটালে।হাতে নাকি গুলি লেগেছে।রক্ত গিয়েছে অনেক।তোর বাবা আর আকাশ আমাকে নিয়ে গেলো না।

অনন্যা যেনো বিমূর্ত হয়ে গেলো কিছু মুহুর্তের জন্য।একদিকে হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা অন্যদিকে ভাইয়ের দূর্ঘটনা।এ কেমন নিয়তির খেলা?
কথায় আছে বিপদ আসলে সব দিক থেকেই আসে।সেটাই যেনো সত্যি হলো।কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে সবার জীবনে।সব তছনছ হয়ে যাবে।কবে আকাশের কালো মেঘ সরিয়ে সূর্য উঠবে কে জানে?
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪৬
(কপি করা নিষেধ)
আনুমানিক রাত ৮ টা।
নিস্তব্ধ রুমে ভন ভন আওয়াজ করে ফ্যান চলছে।বাতাসে সাদা পর্দাগুলো উড়ছে।কাঁচের জানালা দিয়ে পথচারীদের দেখা যাচ্ছে।সেই সাথে গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।নাকে ফিনাইলের গন্ধ এসে বারি খাচ্ছে।ভ্যাপসা গরমে গায়ে বিন্দু বিন্দু স্বেদজলের অবস্থান টের পাওয়া যাচ্ছে।
বিগত আধাঘণ্টা ধরে ছায়া ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে যাচ্ছে।
কেবিনের বেডে শুয়ে অরন্য দূর্বল চোখে তাকিয়ে আছে ছায়ার দিকে।চোখগুলো কেমন যেনো হালকা হলুদ হয়ে আছে।হাতে ব্যান্ডেজ করা যা গলার সাথে বেধে বুকের উপর রাখা হয়েছে।
অরন্য এইবার কন্ঠে নমনীয়তা এনে ফিচেল গলায় বললো,
-আর কতোক্ষণ কাঁদবেন ছায়াকরী? হঠাৎ করে আপনি এমন ছিঁচকাঁদুনে কীভাবে হয়ে গেলেন?আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

ছায়া নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলে,

-আপনি ঠিক আছেন ডাক্তার সাহেব?কেনো জীবনের ঝুঁকি নিতে গেলেন বলুন তো?আজ আমার ভুলের শাস্তি আপনি পাচ্ছেন।আমি যদি আপনাকে অডিওটা না পাঠাতাম তাহলে হয়তো এমন কিছুই হতো না।

-নিজেকে দোষারোপ করা কবে ছাড়বেন বলুন তো?মানুষ দোষ স্বীকার করতে চায় না আর আপনি নিজে যা করেন নি সেই দোষের বোঝা স্বেচ্ছায় কাধে চাপিয়ে চলছেন।কেনো?আপনার কি একটু শান্তিতে বাঁচতে ইচ্ছে করে না প্রিয় মানুষের সাথে?কোন এক অপরাহ্নে তার কাধে মাথা রেখে পশ্চিমে অস্ত যাওয়া সূর্য দেখতে ইচ্ছে করে না?এক বৃষ্টি ভেজা রাতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বৃষ্টি বিলাস করতে ইচ্ছে করে না ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে?কাশফুলের শুভ্রতায় হারাতে ইচ্ছে করে না?

ছায়া বিবশ চাহনি নিক্ষেপ করে।তার ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসছে।হৃদগভীরে তোলপাড় শুরু হয়েছে।সেওতো চায় কারও হাত ধরে কোন এক রাতে সোডিয়াম লাইটের আলোয় নিজেকে হারাতে কারো হাত ধরে।কদম প্রত্যাহারে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।কাশফুলের মায়াতে জড়াতে।এক কুঁড়েঘরে দুজন মিলে লাল নীল সংসার পাততে।কিন্ত এইসব কি আসলেই হওয়ার? বিধাতা তার অদৃষ্টে আদৌ রেখেছে এইসব?জীবন্ত প্রায় মৃত মানবী সে।
ছায়া উত্তর দেয় না অরন্যকে।ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে ফোলা ফোলা চোখ আর ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে নিয়ে অরন্যের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অমায়িকভাবে জিজ্ঞেস করে,

-খেয়েছেন ডাক্তার সাহেব?

-আমি উত্তর পাইনি ছায়াকরী।

ছায়া আলতো হাসে।
-সব প্রশ্নের কি উত্তর আছে ডাক্তার সাহেব?

ছায়া একটা নার্সকে ডাকে মৃদুকন্ঠে।ঠিক তখনই অল্প বয়সী এক রমনী হাতে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকে মৃদুছন্দে।

-খাবারটা এই টেবিলে রাখুন।

-ওকে ম্যাম।

-আমাকে ম্যাম বলবেন না।ছায়া বলবেন।

এর পরিবর্তে নার্স ছায়াকে একটি আন্তরিক হাসি উপহার দেয়।

-আমার খেতে ইচ্ছে করছে না ছায়াকরী।

ছায়া চোখ ছোট ছোট করে আদুরে বিড়ালের ন্যায় তাকায়।

-আমি খাইয়ে দেই?

অরন্য কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে নড়েচড়ে উঠলো।তার মনে হচ্ছে ওষুধের সাইড ইফেক্টের জন্য সে ভুলভাল শুনছে।কানটা পেতে রাখে পুনরায় শুনার জন্য

-কি হলো আমার হাতে খাবেন না ডাক্তার সাহেব?

অরন্য এইবার তার পলক গুটিকয়েকবার ঝাপটালো।আর তৎক্ষণাৎ মুখে হাসি ফুটিয়ে হাঁ সুচক মাথা নাড়ালো।

ছায়া আদুরে হাতে একটা একটা লোকমা করে খাইয়ে দিলো।অরন্য যেনো কোন এক অন্য এক দুনিয়ায় পদার্পণ করছে।সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।এই একটা মেয়ের জন্য সে কতো পথ পাড়ি দিলো।আজ সেই প্রেয়সী তার সামনে।তাকে খাইয়ে দিচ্ছে।অরন্যের হৃদয় জুড়ে বয়ে যায় প্রশান্তির হাওয়া।আজ সে খুশি।খুব খুশি।ছায়ার ওই স্থির চোখজোড়ায় নিজেকে মত্ত রাখে অরন্য।
….
অরন্যের গুলি লাগার কথা শুনে অহনার ভিতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।হসপিটালে দেখতে আসার জন্য মনটা আকুপাকু করছিলো।তাই সে দেরি না করে রজনীগন্ধা ফুল কিনে হসপিটালে আসে।ভালোবাসা মানুষকে কতোটা পালটে দেয়।এই যে আজ সে নিজেকে কতোটা পরিবর্তন করেছে।তার মনের কথা আজ বলেই দিবে।না বলে আফসোস করার চেয়ে বলে দেওয়াই ভালো।অহনা আজ হলুদ পাড়ের সাদা শাড়ি পড়েছে।কালার করা চুলগুলো আজ খোপা করে রেখেছে।সেইসব মর্ডাণ ড্রেস তার আর ভালো লাগে না।তার মনে ভালোবাসার ছোয়া লেগেছে যে।যেই না কেবিনের সামনের এসে দাঁড়ালো ঠিক তখনই একটা নার্স তাকে আটকে ফেলে।
কন্ঠে নয়নীয়তা এনে অহনা কারণ জানতে চাইলে নার্সটি জানায়,

-ম্যাম ভিতরে ঢুকা নিষেধ স্যারের।

-কেনো?

-ম্যাডাম এসেছে তাই।

-ম্যাডাম?

অহনা ভাবলো অরন্যের মা হবে হয়তো।তাই পর্দা ঠেলে একটু উকি দিতেই ছায়াকে দেখে অহনার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায় অজানা আশংকায় মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
-ছায়া!ছায়া স্যারকে খাইয়ে দিচ্ছে?
অহনার চোখে টলমটল করে অশ্রুরা।অবশেষে শ্রাবনের ধারা বয় সেই টানা টানা অক্ষি জুড়ে।বুক থেকে বেরিয়ে আসে হাহাকার।তবে কি খুব দেরি হয়ে গেলো?অহনা আর ভিতরে ঢুকে না।ধীর পায়ে হেঁটে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে।ভিতরটা কেমন যেনো ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে।হাতের রজনীগন্ধা ফুলগুলো নাকে কাছে এনে ঘ্রাণ নেয়।আজ এই ফুলের গন্ধটাও যেনো বিষাক্ত লাগছে।কি করে সে বাঁচবে বাকিটা জীবন?সে তো বেশ ছিলো। বন্ধুদের সাথে মাস্তি,টাকা উড়ানো,পার্টি,পড়াশুনা।ভেবেছিলো কোন ফরেইনারকে বিয়ে করে ইংল্যান্ড সেটেল হয়ে যাবে।কিন্তু অরন্য আসার পর যেনো সব পালটে গেলো।প্রথম যখন মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলো তখন থেকেই একটু একটু ভালোলাগা ছিলো।এরপর যখন হঠাৎ করেই অরন্য গায়েব হয়ে যায় এরপর আর মনে পড়েনি তাকে।কিন্ত এইবার তার নতুন রূপে আগমন যেনো তাকেও ডুবিয়ে দেয় এক অনন্ত মায়ায়।
……

-পেট ভরেছে?এখন ওষুধগুলো খেয়ে নিন কেমন?আমি আজ যাই।কাল আবার আসবো।

ছায়া উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে পুনরায় এসে উড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলে।

অরন্য একটু উঠার চেষ্টা করে।কিন্তু পারে না।বাম হাতটা যেমন একদম নিস্তেজ হয়ে আছে।একদমই শক্তি নেই।ছায়া এগিয়ে গিয়ে ধরে।অরন্যকে হেলান দিয়ে পিঠের পিছনে বালিশ দিয়ে বসিয়ে দেয়।

-এখন অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে।একা যেতে পারবেন না।আকাশ আপনাকে দিয়ে আসবে।

-আকাশ?

-আমার ভাই।আমার বালিশের পাশে আমার মোবাইল টা দিনতো।

ছায়া বালিশ হাতড়ে মোবাইলটা পেলো।এরপর এগিয়ে দেয় অরন্যের দিকে।
অরন্য ফোনটা এক হাতে নিয়ে আকাশকে ফোন দিয়ে বলে ছায়াকে দিয়ে আসতে।আকাশ রুমে প্রবেশ করতেই ছায়া বিস্মিত হয়।এই আকাশকেতো ছায়া চেনে।
আকাশ মুচকি হাসে।ছায়াকে সে চেনে।ভাইয়ের ফোনে দেখেছিলো একবার।আর সেই জন্যই রাস্তায় চেহারাটা চেনা চেনা লাগছিলো।
আকাশ ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে নম্রভাবে ছায়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-ভাবী আসুন আমার সাথে।

ছায়া যেনো যারপরনাই অবাক হলো আবারও,

-ভাবী?

ছায়া পিছনের ফিরে একবার অরন্যকে দেখে নিলো।অরন্য ঠোঁট চেপে হাসছে।ছায়া আর কিছু না বলে আকাশের সাথে পা বাড়ায়।।ছায়া গাড়ির কাছে যেতেই আকাশ ঝরঝরে গলায় বলে,

-ভাবী আপনার সাথে কিন্তু আমার দুটো সম্পর্ক আছে।

ছায়া এইবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে আকাশ বলে যে,

-আপনি আমার ভাবীও আবার শালিকাও।

ছায়ার চক্ষুচড়ক গাছ।মুখটা হা হয়ে গেলো।অচিরেই ভ্রু কুঞ্চিত করলো।

-শালিকা?

-ইয়েস।সেইকথা নীলাকেই না হয় জিজ্ঞেস করবেন।

এইবার ছায়া অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভ্রু বাঁকালো। নাক মুখ কুচকে অসহনীয় অথচ বিস্ফোরিত গলায় বললো,

-কিহ!

আকাশ একগাল হাসে।লাজুকভঙ্গিতে মাথা চুলকালো।
ছায়া যেনো বিশ্বাসই করতে পারেছে না নীলা তাকে না জানিয়ে কারো সাথে সম্পর্কে জড়াবে।
……
অন্ধকার নিস্তব্ধ রাত।আকাশে তারকারাজির মেলা নেই।মেঘে ঢাকা আকাশ।শো শো করে বাতাস বইছে। প্রাণ সেই নদী তীরে এসে বসেছে হাত পা ছেড়ে দিয়ে।সুবিশাল সবুজ মাঠ।নদীতীর যেনো গাছগাছালিতে ভরা।এই আধারে এক একটা গাছকে মনে হচ্ছে রূপকথার দৈত্য। দৈত্যগুলো যেনো প্রানের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির ন্যায়। বাতাসের ঝাপয়ায় যখন গাছের পাতাগুলো নড়ে উঠে তখন মনে হয় যেনো সেই দৈত্যদের মাথার চুলগুলো উড়ছে।
প্রাণ আজ ধ্বংসাবশেষ নিয়ে সেই পাড়ে। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে অনন্যার সেই ফুলটা খুঁজে বের করে।হাতে নিয়ে শুষ্ক ঠোঁটে একটা দুঃখমিশ্রিত হাসি দেয়।আজ অবধি যেই আশাটা মনে বাঁচিয়ে রেখেছিলো সেই আশাটা নিজের হাতে আজ গলাটিপে মেরে দিয়েছে।তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে কীভাবে কাউকে জড়াবে?তার বাবা মা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো তার জীবনটা অন্যরকম হতো।আজ সেই ছোট্ট অনুকে নিয়ে একটা ছোট্ট সংসার বাধতে পারতো।বুক চিরে বেরিয়ে আসে হতাশারা।হাতে একটা পাথর নিয়ে অদূরে এই নদীর পানিতে ঢিল ছুড়ে।টং করে একটা শব্দ হয়।পানিগুলো গোল করে তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে।ঠিক সেই সময় কেউ তার কাধে হাত রাখে।প্রাণ পিছু ফিরে না।নিনির্মেষ তাকিয়ে রয় ওই নদীর পানির পানে।কানে আসে এক পুরুষালি কন্ঠ,

-খুব ভালোবাসিস?তবে ফিরিয়ে দিলি কেনো?

স্থির হয়ে বসে থাকে প্রাণ।কিছুক্ষণ পর নিস্তেজ গলায় বলে,
-তার সাথে কি আমার যায়?

অভীক খলবলিয়ে উঠলো যেনো।প্রানের দুই হাতের কনুই চেপে তপ্ত গলায় বললো,

-কিসের কম তোর?সব আছে তোর।এমন একটা ভদ্র প্রতিষ্ঠিত সুদর্শন ছেলে কয়টা আছে তোর মতো?মেয়ের বাবারা মেয়ে দিতে এক পায়ে খাড়া।

প্রাণ নিজের অশ্রুমিশ্রিত চোখ লুকায় অভীকের থেকে।

-অনু এখন অনেক ছোট।সতেরো বয়স মাত্র।এখন হচ্ছে আবেগের বয়স।চোখে কতো কিছুই ভালো লাগবে।কিন্তু একটা সময় গিয়ে বুঝতে পারবে এইসব তার বোকামি।তখন?আমার আটাশ বছর বয়স।তার সাথে আমার প্রায় এগারো বৎসরের ডিফারেন্স। অনুর পরিবার নিশ্চয় এইটা মানবে না।তারা আমাকে অনেক স্নেহ করে নিজের ছেলের মতো।আমি এই ভালোবাসাটা হারাতে চাই না।ওদের বিশ্বাস ভাঙ্গতে চাই না।আর অরন্য?সে যদি জানতে পারে তার বন্ধু হয়ে তারই বোনকে ভালোবাসি সে কি আমাকে ঘৃণা করবে না?আমাকে যে ঘৃণার চোখে দেখবে। আমি এইটা মানতে পারবো না।আমি ভালোবাসার আগে আমাদের বন্ধুত্বকে প্রাধান্য দিবো।ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে পারবো।কিন্তু বন্ধুত্ব ছাড়া বাঁচতে পারবো না।অরন্য আমার একলা একা নিঃসঙ্গ জীবনে এক চিলতে আলো হয়ে এসেছিলো যে।আমার বাবা মা নেই।সেই ছোটবেলায় মারা গিয়েছে।অরন্যের বাবা মা আমাকে বাবা মায়ের ভালোবাসা দিয়েছে।ছোটবেলায় মায়ের একটা ডাকের জন্য যখন তড়পাতাম তখন অরন্যের মা আমাকে বাবা বলে ডাক দিতো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো,খাইয়ে দিতো।আমি কিভাবে ভুলে যাই সব?অনুর পরিবারের মা,বাবা,ভাইদের সাথে বড় হয়েছে।এতো মানুষের ভীরে একাকীত্ব কি সেটা সে জানে না।সে কি আমার সাথে একা সুখী হতে পারবে? পারবে না।অনুও হয়তো কিছু বছর পর আমাকে ভুলে যাবে।

অভীক আজ নির্বিকার।এই হাসিখুশি ছেলেটার বুকে জমানো এতো দুঃখ যেনো আজ প্রথম টের পেলো।

প্রান আবারো বলে,

-জানিস আমার বাবা মাকে খুব মনে পড়ে।তারা থাকলে আজ অনু আমার হতো।আজ অরন্যের মা যখন অরন্যের গুলি লাগার কথা শুনে দৌঁড়ে হসপিটাল এলো, বুকে জড়িয়ে ধরে উন্মাদের ন্যায় কাঁদলো,চোখে মুখে স্নেহের পরশে ভরিয়ে দিলো,আংকেল অরন্যের মাথায় হাত বুলিয়ে নিকের শক্তের কাঠামো ভেদ করে কাঁদলো আমার তখন নিজের বাবা মায়ের কথা মনে পড়েছিলো খুব।তারা থাকলে আজ আমাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরে আদর দিয়ে ভরাতো।ব্যাথারা আমাকে ছুঁতো কই।
প্রাণ হাসে দুঃখমিশ্রিত হাসি।তার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।বাতাসের দাপটে চুলগুলো উড়ছে।আজ বৃষ্টি আসবে যে।
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪৭
(কপি করা নিষেধ)

একাকী রাত।ছায়া বারান্দায় সেই নিকষ কালো আকাশের দিকে নীরব নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।বাতাসের দাপট বাড়ছে। ছায়ার উড়না, চুল সেই বাতাসে দোদুল্যমান। বাতাসের সাথে ধূলোবালিও উড়ছে।হঠাৎই কিছু একটা ছায়ার চোখে চলে যায়।ছায়া নিজের মুখটা বিকৃত করে ফেলে।এর থেকে বিরক্তিকর আর কিছু হতেই পারে না।আজ যেনো নীলার কাজটা ধূলোবালি করে দিলো।নীলা থাকলে নিশ্চয় এখন তার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো।সে কি এই ভাবে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো?না পারতো না।উদ্ভট উদ্ভট সব কথা বলে তাকে হাসিতে মারতো।ছায়া বেসিনের কাছে গিয়ে চোখেমুখে শীতল পানির ঝাপটা দেয়।চোখ থেকে ময়লা বের হতেই যেনো ছায়া স্বস্তি পায়।এতোক্ষণ চোখের ভেতর খচখচ করছিলো।এখন শান্তি।ছায়া তোয়ালে দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে নেয়।তখনই দরজায় কেউ নক করে।ছায়া দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা পরোখ করে।এগারোটা বাজে।এখন কে আসবে এতো রাতে?ছায়া দরজা খুলে না।তখনই কানে ভেসে আসে এক মেয়েলী কণ্ঠস্বর।

-এই ছায়ু দরজা খোল।ব্যাগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাত ব্যথা হয়ে গেলো রে।

ছায়া চমকায়।গুটিকয়েকবার পলক ঝাপটায়।তার কাছে আশ্চর্য লাগছে।সে হসপিটালে পৌঁছে নীলাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছলো সে এসেছে ঢাকা।তখন প্রায় সন্ধ্যা। এই মেয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে না জানিয়ে চলেও এসেছে!ভাবা যায়?বাইরে তো মনে হয় ঝড় আসবে।ঝড়ো বাতাস চালিয়েছে।এই মেয়েটার কি দরকার ছিলো এমন একটা বৈরী আবহাওয়াতে বের হবার।সে একা থাকতে পারতো।একটা রাতেরইতো ব্যাপার। ছায়া কপাল চাপড়ায়।নীলা বেল বাজিয়েই যাচ্ছে।ছায়া দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।গিয়ে দেখে নীলা আর নীলার বাবা জয়নাল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন।ছায়াকে দেখেই মধ্যবয়সী সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত জয়নাল সাহেব বিগলিত হাসেন।মেয়েকে তিনি বড্ড আদর করেন।মেয়ের বান্ধবী ছায়া আর মেঘাকেও নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন।ছায়া আসার খবর শুনেই এই রাত করে মেয়ে আসার বায়না ধরে।মেয়েকে তো রাতে একা ছাড়তে পারেন না তাই তিনিই নিয়ে এসেছেন।নীলা হবার পর আর কোন সন্তানের মুখ তিনি দেখেননি তাই এই মেয়ে বলতেই তার প্রাণ।

-আসসালামু আলাইকুম আংকেল।কেমন আছেন?ভিতরে আসুন।
জয়নাল সাহেব মুখে হাসি ফুটিয়ে ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-ওয়ালাইকুম সালাম মা।আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?

-জ্বি ভালো আছি আমি।

-দেখোতো মা মেয়ের কান্ড এই রাত বিরাতে একা একা রওনা দিচ্ছিলো।মেয়েটার সাহস বড্ড বেড়ে গিয়েছে।কিছু একটা হয়ে গেলে?আজকাল রাস্তাঘাটের যেই অবস্থা।যেকোন দূর্ঘটনা ঘটে গেলে?

নীলা এইবার ঠোঁট উল্টায়।মুখ ফুলিয়ে চোখগুলো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে সরু কন্ঠে বলে,

-আমার নামে এতো বদনাম করা হচ্ছে।থাকবোই না আমি।এখনই চলে যাবো।

ছায়া এইবার হেসে দেয়।

-কোথায় যাবি?শ্বশুর বাড়ি?

এইবার ছায়া আর জয়নাল সাহেব হেসে দেয় ফিক করে।
….
-দেখুন মেয়ে একা একা কাউকে না জানিয়ে এতোদূরে চলে গেলো। আপনি কিছু বলেন নি কেনো?
মীরা বেগম খলবলিয়ে উঠে।
রেজাউল সাহেব চেয়ারে বসে কিছু ভেবে চলেছে।আপাতত স্ত্রীর কথা তার কাছে অযৌক্তিক লাগছে না।মায়েরা চিন্তা করবে না মেয়ের তো কে করবে।কিন্তু রেজাউল সাহেবের মেয়ের উপর বিশ্বাস থাকলেও মন থেকে ভয়টা সরাতে পারছে না।মীরা বেগম পুনরায় ককিয়ে উঠলেন,

-আপনি চুপ করে আছেন কেনো?মেয়েটার উপর একটার পর একটা বিপদ আসছে।মেয়েটাকে নিয়ে আমার বড্ড চিন্তা হয়।কিছু হয়ে গেলে?মেয়েটা বড় হয়েছে।এইবারতো বিয়ের কথা ভাবা উচিত।আমরা আর কয়দিনই বা বেঁচে থাকবো?মরার আগে মেয়েটাকে সুখী দেখতে চাই আমি।মৃত্যুর আগে মেয়েটাকে সংসারী দেখে যেতে চাই যাতে নিশ্চিন্তে মরতে পারি।
রেজাউল সাহেব এইবার মুখ খুললেন।

-আহ মীরা কি বলছো?এইভাবে উত্তেজিত হলে শরীর খারাপ করবে।মেয়ের বুঝ জ্ঞান হয়েছে।মেয়ে যদি বিয়ে করতে চায় তো করবে।মেয়েটাকে জোর করা উচিত হবে না।

এইবার মীরা বেগমের চোখে অশ্রুরা এসে হানা দিলো।মেয়ের চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে সেইটা কি কেউ বুঝবে?বুঝবে না।তার মুখের কয়েকটা শক্ত কথা শুনিয়েই মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে সবাই।অভিমান করে দূরে ঠেলে দেয়।স্ত্রীর চোখে পানি দেখে রেজাউল সাহেব ঘাবড়ে গেলেন।তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন।

-একি মীরা কাঁদছ কেন?মেয়ের চিন্তা আমারো হয়।কিন্তু তাই বলে এইভাবে কাঁদবে? দেখে নিয়ো ছায়ার কিচ্ছু হবে না।আমাদের দোয়া সাথে আছে।

মীরা বেগম নরম অথচ বিধুর চাহনি নিক্ষেপ করলেন স্বামীর দিকে।মায়ের মন কি কেউ বুঝে?

-আপনি বুঝতে পারছেন না।আহান এর পর রবিন আমাদের মেয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছে।আমার ভালো লাগছে না।এমন বিপদ আবারো আসলে?এই দুনিয়া বড্ড পাষাণ। মানুষ যেনো নিজের মনুষত্ব্য হারিয়ে বর্বর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।আমরা তো মেয়ের সাথে থাকি না। এই পরিস্থিতে কেউ আমার মেয়ের পাশে থাকুক, ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়াক সবসময় আমাদের অনুপস্থিতিতে সেটা আপনি চান না?আপনি একটু ভেবে দেখুন।আপনি দয়া করে ছায়াকে রাজি করান বিয়ের জন্য আমার কসম।

মীরা বেগম স্বামীর হাত টেনে মাথায় ধরলেন।রেজাউল সাহেব নিজেও ভাবলেন মীরা ভুল কিছু বলছে না।তারও বয়স হয়ে গিয়েছে।হায়েনাদের কাছে মেয়েকে একা ছেড়ে দিতে পারেন না।
রেজাউল সাহেব সম্মতি জানায়।

-ছায়ার জন্য অনেক ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে।আপনি ছেলেটা সম্পর্কে খুঁজ লাগান।আপনি চাইলে মেয়ের বিয়ে আমি এই বাড়িতেই দিতে চাই।ছেলে অনেক ভালো আর ফ্যামিলিও মাশাল্লাহ।

রেজাউল সাহেব স্ত্রীর দিকে চাইলেন ভালো করে।তিনি এইবার আর না করবেন না।মেয়ের চিন্তায় তার নিজেরও রাতে ঘুম কম হয়।চিন্তা হচ্ছে মেয়ের জন্য।বুকে ব্যথাটা আজকাল বেড়েছে।হায়াতের নিশ্চায়তা কি কেউ দিতে পারে উপরওয়ালা ছাড়া।
…..
অনন্যা ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে।বাতাসের দরুণ গাছের পাতাগুলো দুলছে।সেই সাথে দুলছে অনন্যার মন।আকাশটা আজ বেশ বিবর্ণ তার মনের মতো।রঙেরা যে বিদায় নিয়েছে তার জীবন থেকে।শত ডাকলেও আর ফিরে আসবে না। যে চলে যেতে চায় তাকে কি কোন উদ্দেশ্যে আটকে রাখা যায়?উহু যায় না।সেই প্রাণপুরুষ তার জীবনের সমস্ত রঙ শুষে নিয়েছে।আজ সে ধরণীর বুকে ভগ্ন হৃদয়ের রঙহীনা কন্যা।অনন্যা গুমড়ে কেটে উঠে।আশেপাশে যেনো আজ আকাশ বাতাসও তার সাথে দুঃখবিলাসে মেতে উঠেছে।তারকারাজি আজ মেঘের বুকে ঠায় নিয়েছে।মেঘেরাও আজ কাঁদবে তার সাথে।এই যে আকাশের বুক চিরে গর্জন কানে এসে লাগছে।কান্নার পূর্ব মুহুর্ত।বৃষ্টির গুড়ি গুড়ি ফুটা তার গায়ে এসে পড়লো।এতো আকাশের অশ্রু।অনন্যার চোখেও যেনো আজ বাঁধ ভাঙে।ইশ ভালোবাসা কি কষ্টের।এই যাতনা যে আর প্রাণে সয় না।

কেউ কেউ দুঃখবিলাসে মেতে উঠেছে এই বৃষ্টির রাতে আবার কেউ প্রিয়জনের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বুক বাঁধছে। কি বিচিত্র এই দুনিয়া।
আকাশ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।তার মুখে বৃষ্টির ছাট এসে বারি খাচ্ছে।আকাশ চেয়ে রয় এই বাদলের দিকে।তার বুকে তৈরি হয় উন্মাদনা।প্রিয়জনকে নিজের করার উন্মাদনা।
….
নীলা ছায়ার কাধে মাথা রেখে বারান্দায় বসে আছে।আজ যেনো এতো চঞ্চল মেয়েটাও ভারী নিশ্চুপ।বাতাসের ঝাপটার সাথে বৃষ্টির ছাট আসছে যা হালকা ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। আকাশের কথাগুলো তাকে ভাবাচ্ছে।ছেলেটার কথায় যেনো কি মায়া!যেনো তাকে টানে খুব গভীরভাবে।সে বিচরণ করে এক নামহীন অজানা রাজ্যে।তার কি আগানো উচিত? সে উত্তর পায় না।
ছায়াও যেনো আজ নিজেকে ভুলে গেলো।ভুলে গেলো তার অতীত।সে আজ বর্তমানে হারাবে এই বৃষ্টিতে।এই বৃষ্টি তাকে যতোদূর এগিয়ে নিয়ে যায় সে যাবে।ঠিক তখনই গগন চিরে বেরিয়ে আসে এক গা হিম করা গর্জন।ছায়া আতকে উঠে।তবে কি সে প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ কিছু চেয়ে ফেলেছে?

সেই নদীতীরে অভীক আর প্রাণ বৃষ্টিবিলাস করছে।বাকা করে পড়া বৃষ্টিগুলো তাদের পুরো গা ভিজিয়ে দিচ্ছে।চুল, মুখ বেয়ে পানি পড়ছে টল টল করে।আজ তারা নিশ্চুপ।শব্দ ছাড়াও মনের ভাব প্রকাশ করা যায়।তারা যেনো চুপ থেকেও কতো কথা বলছে।ঠিক তখনই অভীকের কল আসে।মেঘার ফোন।অভীক ফোনটা নিয়ে একটা ছাউনির ভিতর চলে যায়।প্রাণ একা বসে রয়। সে একা না।একা না।আজ তার মন খারাপের সঙ্গী এই মন কেমন করা বৃষ্টি।
….
ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে অরন্যকে। সে ঘুমিয়ে আছে দিন দুনিয়া ভুলে।বাইরে কি হচ্ছে সে জানে না।যদি এই বৃষ্টি তাকে ছুঁতে পারতো তবে তার মনেও আজ তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মাতো প্রেয়সীকে কাছে পাবার।ঠিক তখনই শাড়ি পরিহিতা সেই রমনী হাতের সেই শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলো নিয়ে কেবিনে ঢুকে।নীরবে পা ফেলে এগিয়ে এসে একটা টুলে বসে।ইশ মেয়েটার চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ।আজ যে অহনারও দুঃখবিলাসের
দিন।উদাস হয়ে চেয়ে রইলো সেই মায়া মায়া মুখটার দিকে।জানালায় বাতাসের সাথে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে।অহনা গিয়ে সেই জানালার পাশে দাঁড়ায়।জানালাটা হালকা খুলে দেয়।সাথে সাথেই বাতাসের সাথে বৃষ্টির আগমনে তার চোখ মুখ চুল সিক্ত হলো।শুধু ছুঁতে পারলো না তার মন।এই মন যে একজন ছুয়ে ফেলেছে।আর কিছু কি সেই মন ছুঁয়ার যোগ্যতা রাখে?
না পারে না।বাতাসের দরূন ভিজলো তার হাতের সেই নির্জীব ফুলগুলো।বৃষ্টির ছুঁয়ায় তো ফুলেরও সজীব হওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু হলো না।সেই ফুলেরও হয়তো কোন অজানা ব্যথা আছে।কে জানে?
মানুষের মনের খবরই বা কয়জন রাখে?ফুলের মনের খবর রাখার সময় কই?

#চলবে
(ভালো কিছু হয় না। Failure is a part of success. I believe that.গল্পটা জলদি শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করবো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here