কুঞ্জছায়া পর্ব ৩২+৪৩+৪৪

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪২
(কপি করা নিষেধ)
…..
-এতোক্ষণ কই ছিলি? বাসায় আসতে না আসতেই শুরু করে দিলি রঙ্গলীলা সেই আগের মতোন?কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।চরিত্রে যার সমস্যা ছোট থেকে তার চরিত্র ভালা হইবো না জানা কথা।একদিন বাড়ি এসেই ভোরবেলা উইঠা ১০টার সময় বাড়ি আসিস।৫ ঘন্টা ধইরা কই আছিলি?কোন পোলার সাথে ছিলিস?
রোওশানা বেগমের কথায় ছায়ার শরীর রাগে ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছে। ছায়া হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রোওশানা বেগমের চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

-আসলেই ফুপি কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না যেমন আপনার চুগলখোরির স্বভাব কোন দিন যাবে না।আপনি নিজের পরিবার রেখে অন্যের পরিবারের ব্যক্তিগত বিষয়ে কেনো নিজের বাম হাত ঢুকান?নিজের ছেলে কি করে বেড়াচ্ছে তার খবর রাখেন?ঠিকই তো ভাইয়ের বাসায় এসে পড়ে থাকেন।নিজের পরিবার সামলাতে পারেন না ভালো কথা অন্যের পরিবার আপনার সামলাতে হবে না। আর আমি প্রাপ্ত বয়স্ক নিজের বুঝ জ্ঞান আছে আমার।আপনার জ্ঞানের অভাব।এইরম আকথা বলে নিজের ছোট মন মানসিকতার পরিচয় দিবেন না।

ছায়া জবাব এর অপেক্ষা না করেই হনহন করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
রোওশানারা বেগমের গা পিত্তি যেনো জ্বলে গেলো।একরত্তি মেয়ে তাকে এতোগুলা কথা শুনালো?।রোওশানারা বেগম কান্নাজুড়ে দেয়।কমরে গুজা উড়না খুলে মাথায় দিয়ে মুখ চেপে দরজার হাতল ধরে সেইখানেই বসে পড়ে।
হাউমাউ করে ন্যাকা কান্না জুড়ে দেয়।রেজাউল সাহেব আর মীরা বেগম দৌঁড়ে আসেন।হামিদা বানু আস্তে ধীরে এগিয়ে আসেন।এসে মেয়ের দিকে ভালো করে তাকায়।
-ও ভাই আমি কি আপনাদের পরিবারে নিজের বাম হাত ঢুকাই?আমি কি আপনাদের পরিবারে এসে পড়ে থাকি খালি।ঝগড়া বাধাই?তবে এই একরত্তি মেয়ে আমাকে অপমান করে কীভাবে?

মীরা বেগম একবার স্বামীর দিকে তাকালেন।মুখটা শুকিয়ে রয়েছে,মুখে চিন্তার ভাজ।এমনিতেই একটা অ্যাটাক হয়েছে হার্টে আবার হলে বাঁচানো মুশকিল হবে তাই নিজের স্বামীকে চিন্তামুক্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।
মীরা বেগম এইবার রোওশানারা বেগমের দিকে তাকায়।
-কি হয়েছে আপা?কাঁদছেন কেনো?

-ভাবী আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন কিভাবে আমাকে অপমান করেছে।যুবতী মেয়ে কোথায় গেলো সকাল সকাল চিন্তা হচ্ছিলো তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় গিয়েছে।কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করলে আমাকে উত্তর তো দিলো না উলটা আমাকে বাজেভাবে অপমান করলো।আমি নাকি মূর্খ,আমার জ্ঞান নেই,নিজের পরিবার সামলাতে জানি না।কতো বড় বেয়াদব হয়েছে।আরো ঢাকা পাঠান মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করতে।মেয়েদের কাজ হেসেল সামলানো অথচ মেয়েকে নাকি ডাক্তার বানাবে।

মীরা বেগমের মুখটা চুপসে যায়।

-আপা ছায়া তো শুধু শুধু কাউকে কিছু বলে না।

রোওশানারা বেগম ঝামটা মেরে উঠে এসে মীরা বেগমের সামনে আসে।

-তো আপা আপনি কি আমাকে বলতাছেন যে আমি কিছু করছি?

হামিদা বেগম মেয়েকে খুব ভালো চিনে তাই নিজেই মেয়েকে চুপ করায়।

-আরেকটা কথা কবি না কইলাম রোশো।তিল রে তাল বানানোর স্বভাব তোর গেলো না।যা ঘরে যা।আমি আমার নাতিনের লগে কথা কমু নে।
রোওশানারা বেগমের ভেতরে জ্বলা আগুন যেনো মিইয়ে গেলো।যত যাই করুক মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারে না একটা ঘটনার পর থেকে।সেইদিন ছিলো কালবৈশাখীর ঝড়ের রাত।বাসায় কেউ ছিলো না।মা,বাবা ভাইয়েরা সবাই একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলো। কিশোরী ছিলো তখন সে।সবে এস এস সি পাশ করেছে।তখনই তার মনে একজনকে খুব ভালো লেগে যায়।কিন্তু ছেলেটা ছিলো গরীব। স্কুলে আসা যাওয়ার সময় চোখে চোখ যখন পড়তো তখনই চোখ নামিয়ে নিতো।এরপরেই ভালো লাগার পাখি মনে উড়াল দেয়।সেই দিন রাতে সে সেই ছেলেকে জরুরি ভিত্তিতে তলব পাঠায়।ছেলেটা আসতেই তাকে ফুঁসলে ফাঁসলে নিজের ঘরে যেতে বলে।যেই না নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করবে ঠিক তখনই কারো গর্জন কানে আসে।সে ঘাবড়ে যায় এখন কি করবে।সে একবার পিছনে তাকিয়ে ছেলেটিকে দেখে নেয়।লুঙি পড়া শ্বেত বর্নের এই ছেলেটি অতিমাত্রায় গবেট তাকে ফাসালেও কিছু করতে পারবে না তার উপর সে নিচু শ্রেনীর গরীব।রোওশানারা বেগম নিজের জামাটা কিঞ্চিৎ টান দিয়ে ছিড়ে ফেলে।ছেলেটি দৌঁড়ে আসে আর অবাক হতবাক হয়ে যায়।বিপদের আশংকা করতে পারে। তখনই রোশো জোড়ে চিৎকার করতে থাকে। হামিদা বানু যেনো নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলেন মেয়ের কাজে। জলদি বিষয়টা কারো কানে যাবার আগে নিজে রুমের ভিতর ঢুকে পড়ে। সেই দিন হামিদা বানুর সন্দেহ তৈরি হয় মেয়ের উপর। অনুষ্ঠানে খারাপ লাগায় মিজান তাকে বাড়ি নিয়ে আসে এরপর সে চলে যায় আবার।হামিদা বানু নিজের মেয়েকে দেখলেন একটা ছেলেকে নিয়ে স্বেচ্ছায় ঘরে যাচ্ছে আর করিম ছেলেটা অতিমাত্রায় সরল। ছোট থেকে চোখের সামনেই বড় হয়েছে।।সে এমন গর্হিত কাজ করতে পারে তা কল্পনার বাইরে।এরপর মেয়েকে ভালোভাবে চেপে ধরলে সব সত্য বেরিয়ে আসে। হামিদা বানু সেই দিনের ঘটনা সবার থেকে চেপে যায়। এরপর থেকেই আর মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারেন না রোওশানারা বেগম।
রোওশানারা বেগম দপাদপ পা ফেলে ঘরে চলে যায়।আজই চলে যাবে সে।যে বাড়িতে তার সম্মান নেই সেই বাড়িতে সে থাকবে না।ঘরে গিয়ে ব্যাগ গোছানো শুরু করে।কিয়ারা যেতে রাজি না হলে সপাটে চড় মারে মেয়েকে।মীরা বেগম ত্রস্ত পায়ে রোওশানারা বেগমের ঘরে যায়।

-আপা না গেলে হয় না?কিয়ারা কে মারছেন কেনো?মেয়েটা কি করেছে?
মীরা বেগম স্নেহের হাত বুলায় কিয়ারার মাথায়।কিয়ারা মেয়েটা মায়ের মতো হয়নি। একদম বাবার মতো সহজ সরল আর মিশুক হয়েছে। কিয়ারা বিছানার একপাশে বসে নাক টেনে কাঁদছে। মীরা বেগম কিয়ারার পাশে বসে।

-কাঁদিস না তো।আমি যেতে দিচ্ছি না তোকে।

কিয়ারা মামীকে ঝাপটে ধরে।মানুষ যার কাছে স্নেহ পায় তাকেই আঁকড়ে ধরতে চায়।

-মামী তুমি খুব ভালো।ছায়া আপু এসেছে কতোদিন পর।আপুর সাথে থাকবো আমি।রোজের সাথেও আড্ডা দিবো।অন্য সময় পরীক্ষা থাকে।মাত্রই শেষ হলো।
মীরা বেগম আলতো হাসে।অন্যদিকে রোওশানারা বেগম ফুস ফুস করছে।মোবাইল হাতে নিয়ে রবিনকে জানিয়ে দেয় তাকে এসে নিয়ে যেতে।এই মেয়ে থাকলে থাক। সঠিক সময়ে এসে ঘাপটি মারা যাবে।

পুরোটা সময় রেজাউল সাহেব নীরব ভূমিকা পালন করলেন।নরম পায়ে হেটে মেয়ের ঘরের দিকে যান।গিয়ে কয়েকটা ধাক্কা দেন।ছায়া তখন মাত্রই হাত মুখ ধুয়ে বসে ছিলো বিছানায়।দরজায় এমন কয়েকটা টুকা শুনতে পেয়ে হাসে ছায়া।কারণ তার বাবাই গুনে গুনে তিনটা টুকা দেয়।এরপর চুপ করে কোন সাড়া শব্দ না করে দাঁড়িয়ে থাকে।ছায়া গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
রেজাউল সাহেব গিয়ে মেয়ের বিছানায় বসলেন।
ছায়া গুটি গুটি পায়ে বাবার পায়ের কাছে বসলেন।আজ যে তার বাবার সাথে অনেক কথা বাকি যা না বললেই নয়।পূর্বেই না বলে যে ভুল করেছে এইবার সেই ভুল আর করতে চায় না।
ছায়া বাবার দিকে নির্মল দৃষ্টিতে চায়।রেহজাউল সাহেব মেয়ের মাথায় স্নেহের পরশ দেয়।

-কিছু বলবে মা?

-বাবা তোমাকে যে অনেক কিছু বলার বাকি।আমি তোমার কাছে কিছু চাইবো।দিবে আমাকে?

রেজাউল সাহেবের চোখের কোণে জল চলে আসলো।মেয়ে প্রায় ৫/৬ বছর পর কিছু চাইবে মুখ ফুটে সে কি না দিয়ে পারে?
স্নেহের কন্ঠে শুধায়,

-কি চাও মামনি?

-বাবা আমার যে অনেক কিছু জানার বাকি।অরূপদা আত্মহত্যা করেনি।খুন হয়েছে।
রেজাউল সাহেব কিছু মুহুর্তের জন্য স্তব্দ হয়ে যায়।এতো ভালো আর সভ্য ছেলেটা খুন হয়েছে?তার শত্রু ছিলো?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেয়ের পানে চায়।
ছায়া আহানের করা বিশ্বাসঘাতকতা, তার সাথে করা অন্যায় সেই দিন তাকে রেপ করার কথা সব খুলে বলে বাবাকে।এরপর গিয়ে সেই পেন রেকর্ডারটা এনে বাবাকে শোনায় সব।
রেজাউল সাহেব বিমূর্ত হয়ে যায়।তার বুকে চাপ অনুভব করছে।এতো কিছু হয়ে গেলো আর সে এতো বছর জানতে পারলো?ভিতরটা অনুশোচনায় ছেয়ে গেলো।আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হতে লাগলো।মেয়েকে বলা প্রতিটি কথা স্মরণ হলো।মেয়ের উপর যাওয়া এতো বছরের ঝড় টের পেলো।রেজাউল সাহেব বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো ছায়ার হাত ধরে।কান্নারত কন্ঠে বললো,

-মারে ভুল হয়ে গিয়েছে আমার।মাফ করে দিও তোমার অধম পিতাকে।সে তোমাকে রক্ষা করতে পারনি।আমি আদর্শ পিতা হতে পারিনি।আজীবনের জন্য নিজের চোখে ছোট হয়ে গেলাম।আমার সোনার টুকরা মেয়েকে আগুনে ঠেলে দিলাম।

ছায়া বাবার বুকে আছড়ে পড়ে।
-এইভাবে বলো না বাবা।বাবা আমার যে সব জানতে হবে।অরূপদাকে ন্যায্য বিচার পাইয়ে দিতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে।এইসব কাউকে বলো না।মাকেও না।মা জানলে আমাকে বাসা থেকে বের হতে দিবে না ভয়ে।বাবা যে তোমার মেয়েকে বাঁচিয়েছে,নতুন জীবন দিয়েছে,সব সময় ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে, নিস্বার্থভাবে ভালোবেসে গিয়েছে তুমি চাইবে না তার খুনিরা শাস্তি পাক?

রেজাউল সাহেব ময়েকে বুকে জড়িয়ে বলে,
-আমাকে তোমার পাশে সবসময় পাবে মামনি।আমি তোমাকে তোমার মায়ের মতো আটকে রাখবো না।তুমি মুক্ত স্বাধীন।কে কি বলে সেটা তোমার অধম পিতা দেখে নিবে।
ছায়ার ঠোঁটের কার্নিশ ঘেসে হাসি ফুটে উঠে।#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪৩
(কপি করা নিষেধ)
এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?
এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনাতো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ?
নীলা ঐ বিশাল আকাশের ধূসর মেঘেদের পানে তাকিয়ে গান গাচ্ছে।হঠাৎই তার মুঠো ফোনটি বিপ বিপ করে বেজে উঠে।নীলা মোবাইলটা নিয়ে দেখলো নাম্বারটা পরিচিত নয়।ধরবে নাকি ধরবে না অপু দশ বিশ করতে করতেই ফোনটা গেলো কেটে।আবারও মোবাইল কাপিয়ে ফোন আসলে নীলা চট করে ধরে ফেলে।ঐ পাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠে,

-হেই মিস ঝগড়াওয়ালি।কেমন আছো?

নীলা আবারও নাম্বারটা দেখে নিলো।কিন্তু না নাম্বারটা তার কোন বন্ধুর নয়।
-এই ছেলে কে আপনি হু?আবার তুমি তুমি করে বলছেন?

-আমি তো তোমাকে চিনি। সেই যে রাস্তায় পড়ে গেলে।
আমি আকাশ।

নীলা এইবার নিজের ভাবমূর্তির পরিবর্তন করলো।ঝগড়ার প্রস্তুতি যেই না নিলো ঐ পাশ থেকে ভেসে আসলো,
-আমার মনের শরতের নীল আকাশে স্বচ্ছ পেজা তুলার মতো কেন উড়াউড়ি করছো মেয়ে?এই বেনামি আকাশটাকে নিজের করার পায়তারা করছো বুঝি ?

নীলা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।ঠোঁটের কোণায় চিকন হাসির রেখা ফুটে উঠলো।নাহ ছেলেটাকে যত খারাপ ভেবেছি ততোটা না।সাচ এ কুল ম্যান।নীলা এইবার গলা ঝেড়ে একটা শুকনো কাশি দিয়ে বললো,
-এই যে মিস্টার আকাশ ফাকাশ শুনোন আমি সেই তিন বছর আগেই একটা জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছি?

-কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?দেখো বিয়ে শাদির ব্যাপারে কিছু হলে কিন্তু..

-কিন্তু কি?কচু গাছে গলায় দড়ি দিবেন?

আকাশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
-ইয়ে মানে কচু গাছে কেনো বট গাছেও দিতে পারি।

নীলা খিল খিল করে উঠে।আকাশ নীলার হাসির শব্দ শুনে নিজেও হেসে দেয়।

-আমি ঠিক করেছি যে আমার বেস্টু ছায়ার ভাবী হবো।কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে ছায়ার ভাই নেই।তাই ঠিক করেছি ছায়ার ভাসুর অথবা দেবরকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলবো।
আকাশ যেনো আরেকটা ধাক্কা খায়।আকাশ টেবিলে নিজের হাতে মুখে ভর দিয়ে কথা বলছিলো।হাতটা চট করেই সরে যায় আর আকাশের মুখ গিয়ে টেবিলে বারি লাগে।আর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে আহহহহ।

-কি ম্যা ম্যা করছেন হু?

-আর যদি দেবর বা ভাসুর না থাকে?

-তবে ছায়ার সতীন হয়ে যাবো।

এইবার আকাশ খুক খুক করে কেশে উঠে।মনে মনে বলে অরন্য ভাইয়ের ঘাড়ে না চেপে বসে এই মেয়ে।অরন্য ভাই একদম জানে মেরে ফেলবে।এতোক্ষণ তো লাইনেই ছিলো।হায়রে দুনিয়া।এই ছটি ছি বাচ্চা কি দিল না টুট যায়ে। হায়! মে মারজাবান।

-মেয়ে তোমার কথা শুনে আমার হার্ট না ফেইল করে বসে।বিয়ের আগেই বিধবা হবে।

-অ্যাহ!

-অ্যাহ না হ্যাঁ।
মোবাইলের দুইপাশ থেকেই অট্টহাসির আওয়াজ শুনা যায়।

-এই ভাই কার সাথে প্রেম করিছস?
আকাশ এইবার জিভে কামড় দেয়।মোবাইলটা চট করে কেটে দেয়।আর মনে মনে বলে এই ডাইনির বাচ্চাটার জন্য সারাজীবন সিংগেল থাকতে হবে।আমার প্রেমটা হয়ে হয়েও হলো না।এক আকাশ সমান আফসোস। হাহ!
অনন্যা চোখদুটো ছোট ছোট করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

-হে হে বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম।

-ওমা তাই নাকি।”আমার মনের আকাশে স্বচ্ছ পেজা তুলার মতো কেন উড়াউড়ি করছো মেয়ে?এই বেনামি আকাশটাকে নিজের করার পায়তারা বুঝি করছো মেয়ে?”কে বলেছে?কোন ছেলেকে বলছিলে বুঝি?এই ভাই তোমার সব ঠিক ঠাক আছে তো।

আকাশ হকচকিয়ে যায়।কতোক্ষণ বিড়বিড় করলো।

-এই তোর কতো টাকা চাই?

লাল জামা পড়া সুশ্রী কন্যার মুখে উঠলো কোন কিছু প্রাপ্তির হাসি।যাক বাবা এতোক্ষণে লাইনে এসেছে।জামাটা কলারের ন্যায় টেনে ভাব নিয়ে ঠোঁট বাকালো।আর স্মিত হাসি রূপ নিলো অট্টহাসির।
অন্যদিকে আকাশ খালি ফুস ফুস করলো।আর হিস হিসিয়ে বললো,
-এই দিনতো দিন নয় আরো দিন আছে এই দিনেরে নিয়ে ঐ দিনেরই কাছে।

অনন্যা মুখ ভেংচি দিয়ে ভাগলো।
ইশ ভাইবোনদের খুনশুটির মাঝেও কতো তৃপ্তি আছে।এই দুষ্ট মিষ্টি মধুর সম্পর্কগুলো বেঁচে থাক আজীবন।
…..

-ফোন দিয়েছেন কেনো ডাক্তার সাহেব?

-একটু বারান্দায় আসবেন?

ছায়া হকচকিয়ে যায়।বিছানা থেকে নেমে গায়ে উড়নাটা নিয়ে ত্রস্ত পায়ে বারান্দায় গেলো।গিয়ে দেখলো অরন্য একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ছায়া একবার পিছনে তাকিয়ে দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলালো।রাত দশটা বাজে।ছায়ার ভিতর ভয়ে ঢিপ ঢিপ করলো।একবার ঢুক গিলে অরন্যের দিকে চাইলো।একটা ধুসর রঙের ট্রাউজার আর একটা কালো কালারের টি-শার্ট পড়েছে।এক হাত ট্রাউজারের পকেটে গুজে রেখেছে।ছায়া ফোনটা কানে ধরলো,

-এতো রাতে কেনো এলেন?কেউ দেখে ফেললে কি হবে?চলে যাচ্ছেন না কেনো?

-এই ইহ জনমে আপনার পিছু ছাড়ছি না আমি ছায়াকরী। এমনকি পরকালেও না।যে ঝড়ের তান্ডব সৃষ্টি করেছেন আপনি আমার হৃদয়ে সেই ঝড় আপনাকেও লণ্ডভণ্ড করে দিবে।এতো দুরত্ব বাড়াবেন না যতটুকু দূরে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।

ছায়া নীরব থাকলো।তার মনেও যেনো অনুভূতিরা বাসা বাঁধছে ধীরে ধীরে।ছায়া হাসফাস করলো।ছায়া উড়না খিচে চেপে ধরে।চেয়ে থাকে অনিমেষ সেই সুদর্শন যুবকের দিকে।ইশ কি মায়া সেই মুখটায়।এতো মায়া তুচ্ছ জ্ঞান করা যায় বুঝি?

-রাতে খেয়েছেন ডাক্তার সাহেব?

-উহু।হোটেলের খাবার খেতে ইচ্ছে করছিলো না।

ছায়া মুখ দিয়ে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।

-আপনি দাঁড়ান। আমি আসছি।

ছায়া দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্না ঘরে যায়।গিয়ে একটা বক্সে ভাত নেয়।আরেকটা বক্সে বেঁচে যাওয়া মাছের তরকারি,আলু ভাজি,বেগুন ভাজি নিয়ে নেয়।এরপর নীরবে আস্তে আস্তে কদম ফেলে সদর দরজা দিয়ে বের হয়।বাড়ির পিছনে যায়।

সোডিয়াম আলোয় অরন্যের মুখটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।কেমন ঝিলমিল ঝিলমিল করছে।যেনো বহু প্রতিক্ষীত এক প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করছে।ছায়ার বুক চিরে বের হয় এক দীর্ঘশ্বাস।আদৌ কি সম্ভব কিছু?ছায়া চোখ সরিয়ে নেয়।এগিয়ে যায় অরনের কাছে।এক হাত ব্যবধান দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে হাতের বক্সগুলো অরন্যের দিকে বাড়িয়ে দেয়।অরন্য যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না।সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বক্স গুলো নিয়ে খুলে দেখে খাবার।এইটা কি প্রিয়তামার থেকে পাওয়া প্রথম উপহার?এতো আনন্দ লাগছে কেনো?অরন্যের ঠোঁট জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে এক হৃদয় বিগলিত হাসি।

-আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আবার খুব খুশি খুশি লাগছে।আমার মনের সুবিশাল জমিনে যেনো ফুলে ফুলে ভ্রমররা নেঁচে বেড়াচ্ছে।তারা তাদের বহু অপেক্ষিত মধু পেয়ে গেছে।

অরন্য একগাল হাসে।
-ছায়াকরী একটা অন্যায় আবদার করলে রাখবেন?

ছায়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে যায় অরন্যের পানে।

-আমি আজ দুপুরেও খাইনি।আমাকে একটু খাইয়ে দিবেন?আপনার হাতে খাবার লোভটা সামলাতে পারছি না।
ছায়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়।সে কি করবে বুঝতে পারছে না। না না এতো প্রশ্রয় দিলে হবে না যে।ফিচেল গলায় বলে,
-আপনাদের এই এক সমস্যা খেতে দিলে বসতে চান। আর বসতে দিলে শুতে চান।
অরন্য ঠোঁট কামড়ে হাসে।এই মেয়েটা এতো কথা জানে অথচ সব সময় মুখে তালা দিয়ে থাকে।মনে হয় এই আজই একটু ভালো করে কথা বলছে।তাই আর রাগানো ঠিক হবে না।

-আচ্ছা এই আবদারটা না হয় তোলা থাক।একসময় পুষিয়ে নিয়ে যাবো।

ছায়া আর দাঁড়ায় না।পিছু ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হয়।কিন্তু যায় না আবারও পিছু ফিরে অরন্যকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আমি কিছু প্রমাণ পেয়েছি।আশা করছি এইটা দিয়ে কিছু বের করা যাবে।আমি আপনাকে হুয়াটস অ্যাপে একটা রেকর্ড পাঠিয়ে দিবো।

ছায়া আর দাঁড়ায় না।চলে যায় নিজের গন্তব্যে চপল পায়ে।ছায়া যেই না মেইন গেইট লাগিয়ে ভিতরে পা দিবে তখনই কানে আসে,

-দেহ ব্যবসা করছিস ভালো কথা আমাকে একবার সুযোগ দিলে কি হয়?কিশোরী বয়সের নারী দেহের স্বাদ নাকি সুস্বাদু হয়।কিন্তু আমি তোর যৌবনা দেহের স্বাদটাই পেতে চাই।কতো বললাম চল বিয়ে করি কিন্তু মানলি না।এইবার তাহলে বিয়ে ছাড়াই চল করি।

বিশ্রীভাবে হাসে রবিন।ছায়া চমকে উঠে।কানের ভিতর ঝি ঝি করে উঠে।ভিতরে জ্বলে উঠে অগ্নিশিখা।ছায়ার পা দুটো মৃদু কাঁপছে, মুখ থমথমে।তার মনে পড়ে সেইবার নাইনে পড়ে যখন তখন সে,রিয়া,কিয়ারা,রোজ,অরূপদা,আর রবিন ভাই মেলায় যায়।ছায়া ওদের থেকে একটু পিছিয়ে গেলে রবিন ভাই তাকে টেনে নিয়ে যায় মেলার পাশের খালি জায়গায়।নিয়ে গিয়ে বাজে ভাবে ছুঁতে গেলেই অরূপদা এসে রবিনের গালে থাপ্পর মারে।এরপর থেকেই রবিনের থেকে দূরত্ব রেখে চলতো। কিন্ত রবিন যেনো সুযোগ খুঁজছিলো।আর পেয়েও গেলো আজ।

রবিন আবারও কর্কশ কন্ঠে মুখের চাপা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে ,
-আজ কি হবে রে তোর?কে বাঁচাবে? আজকের পর তোকে বিয়ে কে করবে?আমাকে নয়তো আহানকেই করতে হবে।দুইজনের একজনকে করলেই হবে।মনে হয় না আমি করবো।আমার পাখি রেডি করে রাখছি।বাসি খাবার না হয় আহানই খাক।
ছায়া যেই না চিৎকার করতে যাবে তখনই রবিন ছায়ার মুখ বেধে দেয় একটা গামছা দিয়ে যাতে শব্দ করতে না পারে।
ছায়া আজ ভয় পেলো না।মাথায় দপ করে আগুন স্ফুলিঙ্গ ঘটলো।মনে পড়ে গেলো সেইদিনের আহানের কথা।ছায়ার রগগুলো ফুলে ফেঁপে উঠলো।শিরা উপশিরার ভিতর ঘোড়ার বেগে রক্ত দৌঁড়ালো।ছায়া চোখ বন্ধ করে একবার অরূপদার মুখটা স্মরণ করলো।কিন্তু একি আজ অরন্যের মুখটা ভেসে উঠলো।ছায়া চকিতে চোখটা খুলে ফেললো।সে আশে পাশে নজর বুলালো।তার পায়ের কাছে তিনটা আস্ত ইট আছে আর কিছু বালু।ছায়া তড়িৎ গতিতে এক হাতে ইট আর অন্য হাতে বালু নিয়ে নিলো।রবিনের চোখের পলকেই তা রবিনের চোখের দিকে ছুড়লো।রবিনের চোখ ধড়ে কাতড়ে উঠে।যেনো সব ঝাপসা দেখছে।রবিন চোখ বন্ধ করেই অশ্রাব্য গালি দিলো ছায়াকে।কিন্তু ছায়া ঘাবড়ালো না।ঘাবড়ালে চলবে না।তাকে নিজেকে বাঁচাতে হবে।সে আজ তার রক্তে দিয়েই না হয় পবিত্র হবে যে কলঙ্কের দাগ তার গায়ে লাগানো হয়েছিলো।ছায়া এগিয়ে গিয়ে হাতের ইট দিয়ে মাথায় সজোড়ে বারি দেয়।এরপর সাথে সাথেই পা দিয়ে পুরুষাঙ্গে লাথি মারে গায়ের জোড় দিয়ে।রবিন সাথে সাথেই দেয় এক গগণবিদারি চিৎকার।ছায়া এগিয়ে গিয়ে রবিনের মাথায় আর মুখে মারলো ইচ্ছেমত। গায়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে গলগল করে রক্ত বের হলো।কিছু রক্ত ছায়ার গায়েও লাগলো।রবিন ব্যাথায় কাতড়াতে লাগলো, ছটফট করলো আর চিল্লাতে লাগলো গলা ফাটা মুরগির ন্যায়।
তখনই পেছন থেকে এক মেয়েলি চিৎকার যেনো কান ঝাঝরা করে দিলো।ছায়ার চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে ফেলে দিলো।সাথে এলো আরো কারো ধমক।

-এই রোশো আমার মেয়েকে ছাড় বলছি।
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪৪
(কপি করা নিষেধ)

রবিনের চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই এসে উঠোনে জমা হয়।মীরা বেগমের সব দেখে যেনো সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেলো।তার গা শিউরে উঠলো।ভয়ংকর কিছুর আশংকায় গলা শুকিয়ে গেলো। সেইদিন তার মেয়ে ক্ষতবিক্ষত ছিলো আর আজ অপরাধী। রোওশানারা বেগম ছায়ার চুলের মুঠি ধরে চিৎকার করে ক্ষ্যাপা বাঘের ন্যায় বলা শুরু করলো,

-এই মেয়ে একটা ডাইনি।আমার ছেলেকে মেরে ফেললো রে।কেউ আমার রবিনকে ধরো।এই মেয়ে সবাইকে ধ্বংস করে ফেলবে।
রেজাউল সাহেব সহ্য করতে না পেরে বোনকে তেড়ে এসে এক থাপ্পর দিলেন।যা আজ অবধি কখনো করেন নি।যদি আরো আগেই করতেন তবে এইদিন দেখতে হতো না।নেহাতই বাবাকে মৃত্যুর সময় কথা দিয়েছিলেন যে ভাই বোনদের আগলে রাখবেন।কিন্তু আজ যেনো সেই কথা রাখতে পারলেন না।আজ তিনি হবেন বজ্রকঠোর।
-আমার মেয়েকে ছাড় রোশো।কোন সাহসে তার গায়ে হাত দিস?

রোওশানারা বেগম হাউমাউ করে কাঁদা শুরু করলেন।
রোওশানারা বেগম লেপ্টে মাটির সাথে বসে রবিনের মাথা নিজের কোলে নিলেন।সন্তান যতোই খারাপ হোক মা কি ফেলে দিতে পারে?
ছায়া এইবার নিজের ঠোঁটে হাসি ফুটায়।রক্তের ছিটা তার মুখেও এসে পড়েছে।রক্তরঞ্জিত সেই হাসি কি ভয়ানক যেনো দুনিয়ার সব মায়া ধ্বংস করলো।সে আজ নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছে তাকে কলুষিত করার শাস্তি।ইশ কি শান্তি!এতো তৃপ্ততা!

-বাবা তোমার মেয়ে আজ নিজেকে অপবিত্রা করার প্রতিবাদ করেছে।সে যে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তে চেয়েছিলো।কেড়ে নিতে চাইছিলো আমার সর্বস্ব।আমি ওকে শাস্তি দিয়েছি।

রেজাউল সাহেব তর্জনী আঙুল দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে এক হাটুর উপর ভর দিয়ে মাটিতে বসে মেয়ের মাথায় আশ্বস্ততার হাত বুলায়।মেয়েটা এইটুকু জীবনে কতো কি সহ্য করছে।বাবা হয়ে মেয়েকে সুরক্ষা দিতে না পারার তীব্র অপরাধবোধ যেনো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।বুকটা হু হু করে উঠে।মেয়েকে নিজের পাঞ্জাবি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়।মাথাটা এনে বুকে চেপে ধরে।ছায়া যেনো আজ কাঁদতে ভুলে গেলো।চুপচাপ বাবার বুকে ঘাপটি মেরে রইলো।ঠিক তখনই মেইন গেইট দিয়ে পুলিশ প্রবেশ করে।
সবাই যেনো হতবাক হলো।অকস্মাৎ এমন কিছু কল্পনা করেনি।তাদের সুখের পরিবারে এ কোন ঝড়ের আগমন?
রোওশানারা বেগম দৌঁড়ে গিয়ে পুলিশের কাছে নালিশ জানায়।গড়গড় করে বলতে থাকে,
-এই মেয়ে,এই মেয়ে আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো।আপনারা ওকে জেলে ঢুকিয়ে দিন।

মীরা বেগম হতবিহ্বল হলো।মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়েকে বুকে ঝাপটে ধরলো। নিজের চোখের জলগুলো মুছে নেয়।কন্ঠে তেজ আনলেন।কেনো তার মেয়ে অন্যায়ের শিকার হবে?মা হিসেবে তার দায়িত্ব ছিলো মেয়ের বন্ধু হয়ে উঠা।সে তা পারেনি।মা হিসেবে ব্যর্থ।অনুশোচনা হচ্ছে তীব্রভাবে।

-আপা আমার মেয়েটা আপনার কি ক্ষতি করেছে?সে যে আপনার রক্ত।আপনারই তো ভাইঝি।একটুও মায়া হয় না?একটা মেয়ে হিসেবে নিজেকে বিবেচনা করে দেখুন তো আপনার অন্তর কাঁপে না?আপনার ছেলে কেমন তা আপনার থেকে ভালো কেউ জানে না।সে আজ কতো বড় সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলো আমার মেয়ের। এর পরেও নিজের ছেলের সাফাই গাইছেন?নিজের মেয়ের সাথে এমন হলে মানতে পারতেন?

রোওশানারা বেগম যেনো পুত্রশোকে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।তার মনুষত্ব যেনো ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিলো।ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসতো।কোন কিছু চাওয়ার আগেই এনে দিতো।ছেলের সব দোষ নজর আন্দাজ করতো।
ছেলে একদিন বলেছিলো মা ছায়াকে বউ করে নিয়ে এসো।এরপর নিজের ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলো।কিন্তু ভাই নাকচ করে দেয়।মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিতা বানাবে।
মেয়েদের কেনো এতো পড়াতে হবে?সেই প্রত্যাখ্যান পাবার রাগ যেনো দিন দিন মনের ভিতর বেড়েই যাচ্ছিলো।তাই ঠিক ভুল বিবেচনা না করেই প্রতি পদে পদে কটাক্ষ করা শুরু করেছিলো ভাইঝির।আহারে কি কোমলমতী তার ভাইঝি।রোওশানারা বেগমের মনও যেনো অপরাধবোধের আগুনে দগ্ধ হতে লাগলো।মনে হতে লাগলো একের পর এক করা অন্যায়গুলো।দাঁতে দাঁত কামড়ে সেই ব্যাথা সহ্য করে নেয় তিনি।পিছু হটে যায়।এতো আদর না দিয়ে যদি ছেলেকে শাসন করতো তবে হয়তো এইদিন দেখতে হতো না।যেইটা এতোদিন করেনি সেইটা আজ করবে সে।
কিন্তু তৎক্ষণাৎ পুলিশের মধ্যে একজন গাঢ় কন্ঠে বললেন,
-আমরা আপনার ছেলেকে ধর্ষণের চেষ্টা করার দায়ে গ্রেফতার করতে এসেছি উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে।

সবাই কিছু মুহুর্তের জন্য চমকায়।পুলিশকে তো তারা ইনফর্ম করেনি?তবে কে করলো?
ছায়া নিজেও বিস্মিত হয়।তার মনে একটা নামই বাজতে থাকে অরন্য অরন্য!
রোওশানারা বেগম পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকলেন।আধমরা ছেলেটাকে একবার দেখে নিয়ে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-নিয়ে যান এই কুলাঙ্গারকে।নিজেকে এই নরপশুটার মা দাবি করতেও লজ্জা করছে।ছেলেকে সুশিক্ষা দিতে পারলে আজ এইদিন দেখতে হতো না।আমার চোখ খুলে গিয়েছে।খারাপ কিছু হবার আগেই ধরা পড়েছে ভালো হয়েছে।এতোদিন ভুলের মাঝে সমাহিত ছিলাম।আমার ভুল ভেঙ্গেছে।আর পিছু ফিরবো না আমি।

মীরা বেগম আর রেজাউল সাহেব যেনো বিস্মিত হলেন।রেজাউল সাহেব বোনকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন।আজ বোনকে ন্যায়ের দিকে চলতে দেখে যেনো খুবই খুশি হলেন।মনে কিছুটা শান্তি পেয়েছে।নয়তো পরিবার ভাঙ্গার আভাস তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো।

রোওশানারা বেগম এইবার ভাই ভাবীকে উদ্দেশ্য করে নিগুঢ়, নিষ্প্রাণ গলায় বললেন,
-আমাকে ক্ষমা করে দিবেন ভাই ভাবী।ছেলের কথা ভেবে আমি আমার ফুলের মতো পবিত্র মেয়ে সমতুল্য ভাইঝিকে যা নয় তা বলে অপমান করেছি।আজ তার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নেই।
এই বলে গটগট পায়ে বাড়ির ভিতর গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।
রবিন কথা বলার অবস্থায় নেই। কিন্তু সবগুলো কথাই কানে গিয়েছে।মুখ ফুটে অস্পষ্ট স্বরে বলে, মা!
চোখ চিরে বেরিয়ে আসে পানি।
জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা সবাই নিজের ভুল বুঝতে পারি। সময় থাকতে শুধরে গিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি।কিন্তু অনেক সময় আমরা এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারি যে নিজেকে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য হয়।তখন প্রকৃতি আমাদের ছেড়ে দেয় না।ন্যায্য বিচার করে।
………
রাত ১২ টা বেজে ৪০ মিনিট।
ডিবির একজন লোক একটা বাড়ির দরজায় কড়া নারে।
এক ব্যক্তি মদের নেশায় ঢুলু ঢুলু হয়ে খালি গায়ে বিছানায় পড়ে ছিলো।দরজায় আওয়াজ পেয়ে তার ঘুমের ব্যঘাত ঘটে।মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা অশ্রাব্য গালি।গায়ে কাপড় জড়িয়ে হাই ফেলতে ফেলতে এগিয়ে এসে দরজা খুলে।দরজা খুলতেই যেনো মদের নেশা কেটে গেলো।চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেলো।বুকের ভিতর থরথর করলো।দরদর করে ঘামলো।শ্বাস হলো ঘনতর।হাটু মৃদু কাঁপা শুরু করলো।

-ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট আহান হক।উই হ্যাভ উইটনেস অ্যাগেইনস্ট ইউ।
আহান দরজাটা ঝট করে বন্ধ করে ফেলতে নিলেই ডিবি খপ করে আহানের হাত ধরে ফেলে আর কপালে বন্দুক ঠেকায়।
……

-হ্যালো অরন্য?

-হ্যাঁ আশিক বল।

-দোস্ত আহানকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।সেই সাথে রবিনকেও।বাট রবিন এখন হসপিটালাইজড।কথা বলার অবস্থায় নেই।তুই যেই ভিডিও পাঠিয়েছিস সেইটা দেখে বুঝলাম আহানের সাথে রবিনের কানেকশন আছে।

-এক্সেক্টলি।রবিনকে রেপ করতে বলেছিলো আহান যা আহান পূর্বে পারেনি।রবিন রেপ করলে ছায়ার বিয়ে হতো না।আর সেই সুযোগে আহান ছায়াকে বিয়ে করে ভালো মানুষি করতো।

-ঠিক বলেছিস। তুই গেইটের বাইরেই ছিলিস আজ।তবে ভাবীকে বাঁচাতে যাসনি কেনো?

-তোর ভাবি এতোটাও দূর্বল না।আমি অনেকটুকু পথ চলে গিয়েছিলাম।কিন্তু ছায়ার বাড়ির ভিতর কারো চিৎকার শুনে গেইটে দাঁড়াতেই দেখি রবিন মাটিতে কাতরাচ্ছে।পরিস্থিতি অনুকূলে ছিলো না। আমি আগাতেই নিচ্ছিলাম কিন্তু ছায়াকরী ইট দিয়ে রবিনকে আঘাত করছিলো বারবার।তার ফাইটিং স্কিল দেখে আমি ফিদা।বুকে হাত দিয়ে ওইখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।কিন্তু ছায়ার বাবা মা চলে আসায় আর ভিতরে যায়নি।
আমি আগে একটা সিসি ক্যামেরা ফিট করে রেখেছিলাম ওদের বকুল গাছের সাথে যা আমার ফোনের সাথে কানেক্ট করা ছিলো।পরে ওইখান থেকে ভিডিও চেক করি।রবিনের কথা শুনে যা বুঝলাম আহানের সাথে যোগসূত্র আছে।সেইটা পুলিশকে পাঠাই আর এক কপি তোকেও।এই অফিসার আমার এক বন্ধুর ভাই।তাই একশন নিতে দেরি করেনি।

-ভাই তুই জিনিয়াস। ডাক্তার যে কেনো হলি?

-আমি এই লাইনে গেলে তোর ভাত মারলে খুশি হতি?

-না ভাই থাক থাক।আমি আহানের কেইসটা নিজে হ্যান্ডেল করবো।তুই একটু ভাবীর দিকে খেয়াল রাখ।আর আহানের মুখ খোলাবার দায়িত্ব আমার।আহান হলো চুনোপুঁটি। মেইন কালপ্রিট অন্য কেউ।সাবধানে থাকিস। আল্লাহ হাফেজ।

-আল্লাহ হাফেজ।

অরন্য ফোনটা রেখেই চিন্তিত হয়ে চেয়ারে হেলান দিলো।রকিং চেয়ারে হেলতে লাগলো।কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।ছায়ার কাছে ওরা কি চায়?ছায়া অরন্যকে হুয়াটস অ্যাপে অডিওটা পাঠালেই সেইটা শুনতে থাকে বারবার।কার ভাইকে মেরেছিলো অরূপ?
তবে কি এর মাঝেই লুকিয়ে আছে সব?
অরন্য ছায়াকে ফোন দেয়।কিন্তু ছায়া ফোনটা ধরছে না।অরন্য বিরক্ত হয়েই ফোনটা বিছানায় ঢিল মারলো।

#চলবে
#চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here