কুঞ্জছায়া পর্ব ৩৯+৪০+৪১

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৩৯
(কপি করা নিষেধ)

সুখ রাতের তারার ঝলকানির মতো জীবনে উঁকি দেয়, এবং ভোরের পরে অন্য রাতের জন্য অপেক্ষা করে; আমি দিনের কষ্টগুলি তারার মতো অস্পষ্ট সুখের জন্য অপেক্ষা করে ব্যয় করি। সূর্যের আলো নিয়ে মুখে হাসি নিয়ে খেলি। মেঘ এসে হঠাৎ মনে করিয়ে দেয় যে, মেয়ে তুমি ভালো নেই । কানে কানে চুপি চুপি বলে, শুনো মেয়ে তোমাকে যে সূর্যের সাথে সুখের অভিনয় করে বাকি জীবন কাটাতে হবে, অন্যথায় এই অভাগিনীর কোথাও স্থান হবে না যে।
আবারও মেঘ শুধায়, বলো তো মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ কে? যে পাথরের প্রলেপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে অভিনয় করতে শিখেছে সে। সেই মানুষটা যে খুব খুশি তা কিন্তু শুধু তার হাসি মুখ দেখে ভেবে নিও না।জেনে রেখো সে খুব ভাল অভিনেতা।
ছায়া রাতের আকাশের সাথে খুব গোপন আলাপন সারে।সেই সময় কানে আসে কারো নির্মম আর্তনাদ।

-ছায়াকরী!
ছায়ার বুকটা হুহু করে উঠে।
নীলা এসে পাশে দাঁড়ায়।

-ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসে।কেন মেনে নিচ্ছিস না?

-সব জেনেও বলছিস কেনো মেনে নিচ্ছি না?

-আদৌ অরূপদাই মেইন কারণ তো?কখনো ভালোবেসেছিস নাকি শুধুই দায়বদ্ধতা?

ছায়া থমকায়,

-নীললললা!

-মিথ্যে বলেছি?

-হ্যাঁ হ্যাঁ তুই মিথ্যে বলছিস।

– অভীক ভাইয়া আর প্রাণ ভাইয়া আমাকে আর মেঘাকে ডেকেছিল।অভীক ভাইয়ার সাথে মেঘার কথা কাটাকাটি হলেও তাদের আলাদা একটা টান আছে লক্ষ্য করেছি।আমার মনে হয় তারা একজন আরেকজনকে পছন্দ করে।প্রাণ ভাইয়া আমাকে তোর বিষয়ে সব জিজ্ঞেস করেছিল।কিন্তু তুই আমাদের ওয়াদা দিয়ে রেখেছিস তাই চাইলে কিছু বলতে পারিনি।শুধু এইটুকু বলেছি কেউ ছিলো তোর জীবনে।

ছায়া অবাক নয়নে চায় নীলার সাথে।তারা চাইছেটা কি?

-ভাইয়ার সাথে অন্যায় হচ্ছে ছায়া।আমি আর মেঘা তোর ভালো চাই।তুই অনেক কিছু জানিস না।তোর মনে আছে একবার কতোগুলো বখাটে তোকে দেখে সিটি বাজিয়েছিলো।তারা কিন্তু থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট ছিলো।ভাইয়া ওদের কিন্তু মেরেছিলো অনেক।তারা আর আমাদের সামনে কখনো পড়েনি।দিন নেই রাত নেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো ভাইয়া।ঝড় ঝাপটা উপেক্ষা করে তোর অপেক্ষায় থাকতো।তোর খেয়াল রাখতো।ক্যান্টিনে ভালো খাবারটা যাতে তোকে দেওয়া হয় সেটাও ভাইয়া নির্দেশ দিয়েছিলো।
এইরকম অহরহ ঘটনা আছে যা তোর অজানা।

ছায়া মাথা চেপে ধরে।তার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।বুকের ভিতরের যন্ত্রণারা ক্রমশ যেনো মস্তিষ্ক দখল করে ফেলছে।ছায়ার চোখের অশ্রুরা বাঁধ ভাঙে।আজ সে শেষ করবে এই ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা।গায়ে উড়না জড়িয়ে সে যায় তার বাড়ির বাইরে। তার বাড়ির নিচে কেউ অপেক্ষা করছে।তার সাথে আজ বোঝাপড়া আছে অনেক।

-আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম ছায়াকরী।

-মানে?

-আপনি আপনার পুরনো প্রেম ভুলতে পারেন নি তাই না?

-কি সব বলছেন?

অরন্য কিছু ছবি ছায়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়।ছায়া অরন্যের হাত থেকে ছবি গুলো নিয়ে যা দেখে তাতে তার উপর যেনো বজ্রপাত ঘটে।ছায়া হতবাক হয়ে যায়।সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
হাত থেকে ছবি গুলো পড়ে যায় নিমিষেই।তার মনে তৈরী হয় ঘৃণা।

-আপনার বিষয়ে জানতে গিয়েছিলাম আশুগঞ্জ। আপনার পুরানো প্রেমিক আমাকে এইগুলো উপহার দিলো।

ছায়া ভিতর থেকে যেনো সব উল্টে আসছে।নাকে আসছে বিশ্রী উটকো এক গন্ধ।অরন্য কি নেশা করেছে?ছায়া অরন্যের দিকে তাকায় ভালো করে।অরন্য টলছে শুধু।তার চোখ দুটো খুব লাল।অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি।চুলগুলো উশকো খুশকো।শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খোলা।শার্টের অর্ধেক ইন খোলা।চোখদুটি ঘোলা ঘোলা নিভু নিভু । সে কি কেঁদেছে? পুরুষরাও বুঝি কাঁদে?

-কি ভাবছেন?আমি মদ খেয়েছি নাকি?হ্যাঁ খেয়েছি আমি মদ।কিন্তু মদের নেশা আমাকে নেশাক্ত করতে পারেনি যতোটা না আপনি করেছেন নেশাময়ী মানবী।কি অপরাধ ছিলো আমার?

-আপনি কোন অপরাধ করেন নি।এই ছবিগুলো আপনি সত্য ধরে নিয়েছেন?

-মিথ্যে ধরতে বলছেন?দেখুন তো আহান আপনার বুকে মাথা দিয়ে রেখেছে। আপনি তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।আহা কতো ভালোবাসা!

ছায়ার মনে পড়ে এটা সেই দিনের তোলা।তবে কি কেউ ষড়যন্ত্র করছে?এর পিছনে আহান ছাড়াও আরো কেউ আছে যে এই ছবিগুলো তুলেছে।আর এমনভাবে তুলেছে যা একবারে বাস্তব মনে হচ্ছে।মনে হচ্ছে তাদের খুব ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি।ছায়ার মাথায় ব্যাথা হয়।চোখ হয় ঘোলাটে।মনে পড়ে সেই দিনের গায়ে কাটা দেওয়া মুহুর্তের কথা।ছায়ার কানে ভাসে এই বিশী শব্দগুলো।ছায়া যে আবারো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।ছায়া হাত কামড়ে ধরে নিজের।চুল টেনে ধরে নিজের।
ফিকে গলায় ক্ষীণস্বরে বলে,

-আগ্রহ হারালে আমিও হারিয়ে যাবো একদিন যেমন করে তেল ফুরিয়ে গেলে প্রদীপ নিভে যায় ঠিক তেমন।

-নিজেকে কেনো প্রদীপের সাথে তুলনা করছেন ছায়াকরী? আপনি যে আমার আধারিয়া অম্বরের বুকে এক রূপোর থালার মতো চাঁদ।সূর্য চাঁদকে এতটাই ভালবাসে যে সে প্রতি রাতে তাকে শ্বাস নিতে দেওয়ার জন্য মারা যায় এবং বিনিময়ে চাঁদ তার সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে।

অরন্য যেনো আজ নিজের হুশ হারিয়েছে।নিজের প্যান্টের পকেট থেকে হাতড়ে একটা ছুড়ি বের করে অপ্রকৃতস্থের ন্যায়।ছুড়িটা এগিয়ে দেয় ছায়ার পানে।ছায়া সেই ছুড়ির দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

-হয় আমি চলে যাবো চিরতরে নয়তো আজীবন আপনি আমার হয়েই থাকবেন?বেছে নিন আপনি নিজের হাতে।বেলা ফুরিয়ে যাবার আগে ফিরিয়ে নিন নয়তো ফিরিয়ে দিন।
ছায়া তাকিয়ে রয় সেইদিকে।কি করবে সে বুঝতে পারছে না।

-আপনাকে মুখে কিছু বলতে হবে না এই ছুড়িটা দিয়ে আপনাকে উৎসর্গ করা এই হৃদয়ে আগলে রাখা সমস্ত ভালোবাসা নিজের হাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিন।

ছায়া নিথর শরীর জুড়ে বয় হিমশীতল বাতাস।অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে।উৎকন্ঠতায় চোখ মুখ ফুলে উঠছে।মস্তিষ্কে ঢেউ তুলে কয়েকটা শব্দ কোমল!কোমল!ছায়া মাথা চেপে ধরে।শ্বাস হয় ঘনতর। দৃষ্টি হয় ঝাপসা।চোখের উপর কেউ যেনো কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দেয়।ছায়া জ্ঞানশুণ্য হয়ে যায়।ছায়া বাঁচতে চায়।কোন মায়ার বেড়াজালে নিজেকে আটাকাতে চায় না।মুক্তি চাই তার।আচমকাই ছায়া কাঁপা কাঁপা হাতে ছুড়িটা হাতে নিয়ে অরন্যের বুকের বাম পাশে আঘাত করে ঢলে পড়ে মাটিতে।
অরন্য মৃদু হাসে।অরন্যের বুকের তীক্ষ্ণ সুক্ষ্ম সুচালো অনুভূতি তিরতির করে বাড়ছে।সেই সাথে বাড়ছে বুকের বাম পাশের ক্ষতের যন্ত্রণাটা। বুকের কষ্টগুলো বিক্ষিপ্ত হতে থাকে পুরো দেহে। কষ্ট ভারাক্রান্ত হয়ে ছায়ার মাথার কাছে বসে।ছায়ার মাথায় আদুরে হাত বুলায়।বুক চিরে বেরিয়ে আসছে লাল রক্তের নহর।কাতর তেজোহীন গলায় বলে,

-আপনি আমাকে মারেন নি ছায়াকরী? এইটাকে কি ধরে নিবো বলুন তো?করুণা নাকি ভালোবাসা? এমন সূক্ষ্ম আচড় দিতে তো আমি বলিনি?বলেছিলাম এই হৃদয়টাকে নিজের হাতে খন্ড বিখন্ড করে ফেলতে।তবে তাই হউক আপনি যা চেয়েছেন।
আমি চলে যাচ্ছি সব ছেড়ে আমাকে বিদায় দিবেন না?

আকাশে আজ চাঁদ নেই।ঘন কালো মেঘেরা আজ আকাশ জুড়ে বিরাজ করছে।বাতাসে না পাওয়া না পাওয়া একটা গন্ধ।অরন্য ফিরফিরে গলায় গায়,

“আমার পথে তোমার ছায়া পড়লে আড়াল করে
থমকে সে যাবে জীবন গতি, সে কি তোমার অজানা?
রয়েছো তুমি বহুদূরে আমাকে রেখে ছলনায়
এ হৃদয় ভেঙ্গে গেলে জানো কি তা
লাগে না, লাগে না জোড়া
লাগে না, লাগে না জোড়া”

মাটিতে পড়ে থাকে ছায়ার অসাড়শুণ্য দেহ।অরন্য দূর্বল হাতে ছায়াকে উঠায়।কোলে নিয়ে দূর্বলচিত্তে ছায়ার ফ্লাটের দিকে পা বাড়ায়।নীলা দৌঁড়ে আসে।এসে ছায়াকে অজ্ঞান দেখে।নীলা কি করবে বুঝতে পারছে না।নীলার চোখের টলমল জলগুলো কপোল বেয়ে পড়ে।নীলার নজর যায় ছায়ার কপালে রক্ত লেগে আছে।নীলা ভড়কালো। ভীতসন্ত্রস্ত হলো।নীলা ভাবলো ছায়া কপালে আঘাত পেয়েছে।কিন্তু কপাল চেক করে দেখলো কপালে আঘাত নেই।তবে রক্ত কোথা থেকে এলো?নীলার চোখ যায় অরন্যের বুকের দিকে।নীলা আতকে উঠে এক চিৎকার দেয়।

-ভাইয়া!এইসব কি করে হলো?ছায়া?

-কিছু হয়নি।ছায়ার খেয়াল রেখো।আমি প্রাণকে রেখে যাবো তোমাদের খেয়াল রাখার জন্য।ছায়ার মানসিক অবস্থা ঠিক নেই।সি নিডস ট্রিটমেন্ট।

-কোথায় যাবেন আপনি ভাইয়া?

নীলা হতভম্ব হয়ে যায়।এইসব কি হচ্ছে?নতুন কোন ঝড়ের আগমন?এইটাই কি শেষ নাকি মাত্র শুরু?

#চলবে#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪০
(কপি করা নিষেধ)
….
-মানুষ যখন শরীরে আঘাত পায় তখন সেইখানে রক্তক্ষরণ হয়, অনেক ব্যথা হয়।সেইটা চর্ম চোখে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর শরীরের অণুচক্রিকারা রক্ত জমাট বেধে ফেলে।ধীরে ধীরে ক্ষত সারতে থাকে।সেইজায়গায় ওষুধ লাগালে তা পুরোপুরিভাবে সেরে যায়।অর্থাৎ শরীরের ব্যথার প্রতিষেধক আছে।কিন্তু হৃদয়ের ব্যথার কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি।মনের ব্যথার কোন ওষুধ নেই।চর্মচক্ষু দিয়ে তা দেখা যায় না। কিন্তু একটা জিনিষ আছে যা আমাদের হৃদয়ের ব্যথা উপশম করতে পারে।জানো সেইটা কি?ভালোবাসা।

ছায়া ম্লান নয়নে তাকায় প্রাণের দিকে।

-ভালোবাসা?

-ইয়েস ভালোবাসা। এই যেমন ধরো সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ভালোবাসে তাই তোমাকে প্রতিমুহূর্তে অক্সিজেন দিচ্ছে,রিজিক দিচ্ছে।এইটা বান্দার প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসা। এই যে তোমার কিছু হলে নীলা কেঁদে কেটে বুক ভাসায়,বিপদে সবার আগে এগিয়ে আসে সেইটা বন্ধুত্বের ভালোবাসা। তোমার মা কতো কষ্ট করে তোমাকে বড় করলো।এমনও হয়েছে যে রাতের বেলা তুমি কাঁদতে তোমার মা নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে তোমাকে কোলে নিয়ে গান গাইতেন,আদর করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন।অসুখ বিসুখ হলে পুরো রাত মাথার কাছে বসে থেকে সেবা শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করতেন।তোমার বাবা কতো কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করেন।কার জন্য করে?তোমাদের সুখের জন্য।যার বাবা নেই সে জানে কতো কষ্ট। প্রতিনিয়ত নির্মম বাস্তবতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়।

-কিন্তু বাবা মা যদি মনে খুব বেশি কষ্ট দেয়?অবিশ্বাসের সুঁতোয় বেধে ফেলে? তাদের জন্য যদি সবচাইতে মূল্যবান কিছু হারাতে হয়? যেই সময়টাতে মাথায় তাদের স্নেহের হাতটা খুব বেশি দরকার হয় সেইসময় তারা যদি না থাকে?তবে?দিনের পর দিন যদি কাঁদিয়ে যায়?মানসিক রোগীতে পরিণত করে?লাঞ্চনা সহ্য করে থাকতে হয়?তবে?অপবিত্রার অপবাদ দেয়? মায়েরা তো সন্তানকে সবচাইতে ভালো চিনে।আমার মা কেনো আমাকে বুঝলো না?কেন আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলো না?কেনো?

-খালি চোখে যা দেখা যায় তা অনেক সময় সত্যি হয় না।

ছায়া আর প্রাণ মুখোমুখি বসে আছে একটা রুমে।কেবিনও বলা যায়। রুমটাতে একটা টেবিল, ২টা চেয়ার আর ফ্যান ছাড়া আর কিছুই নেই।রুমটাতে একটা জানালা।সেই জানালা দিয়ে অল্পবিস্তর রোদ আসছে তেরছাভাবে ।আর আসছে মৃদুমন্দ হালকা হাওয়া।রুমজুড়ে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। ফ্যানের ভন ভন আওয়াজ কানে এসে লাগছে তীক্ষ্ণভাবে।গরম বাড়ছে ধীরে ধীরে।ছায়া যেই চেয়ারটায় বসেছে তার সামনে একটা টেবিল আর টেবিলের অপরপাশে বসেছে প্রাণ।

-কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাও আমি অরন্যের বন্ধু।আমাকে নিজের বড় ভাই ভাবো।তোমার মনে অনেক অভিযোগ আর অভিমান জমে আছে।জানো তো সময় সবচাইতে বড় প্রতিষেধক। সব সময়ের উপর ছেড়ে দাও।তুমি ঠিক তোমার উত্তর খুঁজে পাবে।

-আপনার বন্ধু কোথায় চলে গিয়েছে?

-জানি না।

ছায়ার ব্যাথাতুর দৃষ্টি।প্রানের অটল দৃষ্টি তাকে যেনো অপরাধী বানিয়ে দিচ্ছে।সে কি আসলেই ভুল করেছে?
এতো আত্মগ্লানি নিয়ে বাঁচা যায়?

-আমাকে অপরাধী ভাবছেন ভাইয়া?আমি যে তাকে আঘাত করেছি।
প্রাণ ফুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

-সব ভুলে যাও।কাউকেই অপরাধী ভাবছি না।সবাই পরিস্থিতির স্বীকার। তোমার এখন নিজের দিকে ফোকাস করা উচিত। নিজেকে হিল করো।নিজেকে নিজে সাহায্য করো।নিজের উপর আর কতো জুলুম করবে?আমি তোমাকে কিছু মেডিসিন দিবো যখনই হ্যালোসিনেসন হবে, মাথায় যন্ত্রণা হবে খেয়ে নিবে।ওষুধ দিয়েও অনেক সময় উপশম হয় না মানুষ যতক্ষণ না সে নিজে ভালো হতে চায়।নিজের মনোবল বাড়াও।

ছায়া মাথা নাড়ায়।প্রাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও স্নিগ্ধ গলায় বলে,

-শরীরের সাথে মনের গভীর যোগসূত্র আছে।উভয় একে অপরের পরিপূরক। মন ভালো না থাকলে শরীর ভালো থাকবে না।আবার শরীর ভালো না থাকলেও মন ভালো থাকবে না।তাই নিজেকে ভালো রাখো,নিজের প্রিয়জনদেরও ভালো রাখো।
……….
এইভাবেই চলতে থাকে দিন।সময় তার রাজত্ব চালায় মানুষের জীবনে।কেটে গেলো বহু বছর। কতো বছর? আনুমানিক আড়াই বছর।অরন্য যেনো আবার ফিরে এলো নতুনভাবে, নতুনরূপে।এইবার তাকে দমায় কে?

-গভীর যামিনীর তমরার অতল গহীনে লুকানো সেই দিশেহারা তরূনীর দুর্বোধ্যতার জাল ভাঙিলো এই বুঝি এই বুঝি।

ছায়ার সম্বিৎ ফিরে।আচমকাই এক পরিচিত গলার আওয়াজে তার হুশ ফিরে।অতীতের কালো স্রোতে যেনো কিছু মুহুর্তের জন্য যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো।
ছায়া অবাক হয়।ফিরে আসে বর্তমানে।ছায়া অরূপের কবর থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে অরন্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়।

-ঢাকা কেনো ফিরে গেলেন না?

-অরূপ কি আসলেই আত্মহত্যা করেছিলো নাকি সেইটা খুন ছিলো?

অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে ছায়ার পুরো শরীর যেনো কম্পিত হলো।ছায়া তড়িৎ গতিতে চাইলো অরন্যের পানে।

-আপনি কীভাবে জানলেন এতো কিছু?

-কতোদিন লুকিয়ে রাখতেন?সব জানারই ছিলো।

ছায়ার মনে অজানা আশংকারা জন্ম নিলো।চিন্তার পোকারা কিলবিল করলো পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে।

-খুন?

-আমার তাই মনে হলো।নয়তো আদৌ আপনার অরূপদা এমন কাপুরুষের মতো নিজের জীবন দিয়ে দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন বুঝি?

ছায়া দরদর করে ঘামলো এই ভোরবেলায়।কপাল বেয়ে সূক্ষ্ম চিকন ঘাম বেয়ে পড়লো চিবুক বেয়ে।
তার মাথায় আগে কেনো আসেনি এইসব?কেনো আসেনি? সে তো তখন যথেষ্ট ছোট ছিলো।বুঝার বয়স হয়নি এতো কিছু।কিন্তু এখন সে তো অনেক বড় হয়েছে।সব বুঝে।ছায়া নিজের উড়নাটা খামছে ধরে।চঞ্চল চোখজোড়া অরন্যের মুখে নিক্ষেপ করে।
ছায়া আর দেরি করলো না।আজ বহুবছর পর সেই বাড়িতে পা দিবে যেই বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায় নি অরূপদা চলে যাওয়ার পর।

-ভুলে যাবেন না ছায়াকরী আমি আছি সাথে।

অরন্য চিৎকার করে জানায়।

ছায়া অরন্যের কথা শুনে একটু শান্তিবোধ করে।মনের মধ্যে ভালোলাগার প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটালো।সে একা না যাক কেউতো সাথে আছে তার সাথে এই যাত্রায়।
…..
– ছায়া!

-কেমন আছিস?

-ভালো আছি।তুই কেমন আছিস? কেনো যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি?

রিয়া ঝাপটে ধরে ছায়াকে এতোবছর পর প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে কাছে পেয়ে।
ছায়া নীরবে হাসে।তার আত্মাও যেনো শান্তি পেলো।তারও তো ভালো লাগতো না এই মেয়েটার থেকে দূরে থাকতে।ছায়ার যে নিজের অপরাধবোধ কাজ করতো রিয়ার সামনে তাই সে সামনে আসতো না।অরূপদাকে মনে পড়ে যেতো।সে কি করতো?একটু ভালো থাকার জন্য নাহয় একটু স্বার্থপর হলো।

-আমিও ভালো আছি।রিয়া আমার যে অনেক কিছু জানার বাকি।আমার তোর সাহায্য প্রয়োজন।

রিয়া অবাক হয়।হাজারো প্রশ্ন মনে নিয়ে ছায়ার দিকে তাকায়।

-কি জানতে চাস?আর কিসের সাহায্য প্রয়োজন?আমি সব সময় আছি তোর পাশে।নির্দ্বিধায় বল আমাকে।
ছায়া কিছুটা আশ্বস্ত হলো।সময় অনেক সময় কাছের মানুষকে পর করে দেয় আবার পরকে আপন।আবার কিছু কিছু সম্পর্ক কখনোই পরিবর্তন হয় না।আজীবন একই থাকে।ছায়ার অধরে স্মিত হাসির ধারা ফুটে উঠে।

-আন্টি আর আংকেল কোথায়?

-বাবা ব্যবসার কাজে সিলেট গিয়েছে।আর মা সেই সাত সকালে মন্দিরে গিয়েছে।আসতে অনেক দেরি।

ছায়া আশেপাশে চোখ বুলায়।এরপর সতকর্তার সাথে বাড়িতে ঢুকে।

-আমি যে এসেছিলাম কাউকে বলিস না।আর আমাকে একটু অরূপদার রুমটাতে নিয়ে যা।

-দাদাভাইয়ের রুমতো লক করা।সেইদিনের পর আর খোলা হয়নি।চাবি বোধ হয় মায়ের ঘরে।তুই একটু দাঁড়া আমি খুঁজে আনছি।

রিয়া চলে যেতে নিলেই ছায়া অরূপদার ঘরের দরজার দিকে তাকায়।মনে দোলা দেয় পুরানো কিছু মধুর স্মৃতি।কতো কান ধরে এই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো।পড়া না পারলেই শাস্তি পেতে হতো।আর অরূপদা কপাল কুচকে তাকে আর রিয়াকে শাসন করতো।

-এই ছায়া পেয়েছি।

ছায়াকে অন্যমনস্ক দেখে রিয়া ধাক্কা দেয়।ছায়ার হুশ ফিরে।

-আমি খুলছি।দে আমাকে।

ছায়া তালা খোলে ভিতরে ঢুকে।একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এলো।বহুদিন দরজা জানালা বন্ধ থাকায় এইরকম ভ্যাপসা গন্ধ হয় ঘরে।ছায়া রুমে ঢুকে ঘরটা ভালো করে দেখে নিলো।পুরো রুমের আনাচে কানাচে সব তার পরিচিত। পরিচিত ঘরে শুধু পরিচিত মানুষটাই নেই।ছায়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়।সে এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে।গুটিকয়েক বই, খাতা আর কলম।টেবিলের পাশেই একটা বুকশেলফ। খুব পড়ুয়া ছিলো তা টেবিল আর বুকশেলফ দেখলেই বুঝা যায়।ছায়া কয়েকটা বই হাত দিয়ে ছুয়ে দেয়।ধুলোবালির আস্তরণ পড়ে আছে।ছায়া উড়না দিয়ে বইগুলো পরিষ্কার করলো।একটা বই হাতে নিয়ে তা উলটে পালটে দেখলো।তখনই একটা শুকনো ফুল বইয়ের ভাজ থেকে নিচে পড়ে যায়।ছায়া সেই ফুলটা হাতে নিয়ে দেখে গোলাপ ফুল।শুকিয়ে গিয়েছে একদম।ছায়া ফুলটা নিজের উড়নার এক কোণায় বেধে নেয়।এরপর যায় আলমারির কাছে।আলমারিটা খুলে দেখে জামা কাপড় দিয়ে ভরতি।কি অদ্ভুত মানুষ চলে যায় অথচ রয়ে যায় তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র। তার রেখে যাওয়া স্মৃতি।একটা পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে ছায়া ঘ্রাণ নেয়।আহা এই যে তার অরূপদার গায়ের সুবাস।ছায়া নাক ভরে সেই সুঘ্রাণ নেয়।রিয়া গিয়ে বারান্দার দরজাটা আর ঘরের জানালা খুলে দেয়।

ছায়া পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।সেই বারান্দায় কতো কতো ফুল ছিলো।কয়েকটা ফুলতো ছায়া নিজে লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো।সেইবার হাসনা হেনা ফুল লাগিয়ে দিয়েছিলো।অরূপদা প্রতিদিন প্রতিদিন খুব যত্ন নিতো।নিজে বাসায় না থাকলে রিয়াকে দিয়ে পানি দেওয়াতো।আর রিয়াটা হয়েছে সেই পাজি।ডেইলি ডেইলি চিল্লা চিল্লি করতো এই নিয়ে।ঘুষও নিতে চাইতো।তখন ছায়া নিজে এসেই পানি দিয়ে দিতো।অথচ এখন গাছটা মরে গিয়েছে।কেউ যত্ন নেয় না।

-এতো অযত্ন কেনো গাছগুলোর প্রতি ?

-এই ঘরে আসা নিষেধ আমার আর মায়ের।বাবার আদেশ।
ছায়ার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।আকাশের দিকে তাকায়।আকাশে আজ মেঘ নেই।পাখিরা উড়াউড়ি করছে।সূর্যের তেজও নেই বললেই চলে।
সেইদিনের পুরো ঘটনাটা খুলে বল আমাকে রিয়া।
রিয়া কিছুটা সময় নেয়।বান্ধবীর মনের অবস্থাটা সে বুঝতে পারছে।ভাইয়ের জন্য তার নিজেরও মন পুড়ে।কতো আদরই না করতো ভাইটা।বাবা মায়ের কাছে আবদার করে যা পেতো না ভাই সেইটা তাকে এনে দিতো।কতো যত্ন করে আগলে রাখতো।আজ বুঝি এইসব কিছুই রইলো না।ভাবতেই অবাক লাগে আজ দাদাভাই তাদের মাঝে নেই।ওই দূর আকাশের তারা হয়ে গিয়েছে।আসলেই কি মানুষ মারা গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়?কই সেতো কতো কথা বলে তারাদের সাথে।তারারা তো তার সাথে কথা বলে না।খালি ওই দূরে থেকে মিটমিট করে জ্বলে।আচ্ছা তারা কি নিজের আলো দ্বারা শুধু তাদের অস্তিত্বের জানান দেয় আর বলে, এতো দুঃখ কিসের মেয়ে আমি আছি তো।
#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব_৪১
(কপি করা নিষেধ)
….
-সেইদিন রাতে দাদাভাইকে বাবা থাপ্পর মারে আর তেজ্যপুত্র করে।দাদাভাই সেইদিন মনে খুব আঘাত পেয়েছিলো।নিজের জাত,কূল ত্যাগ করা কি খুব সহজ কথা?খুবই কঠিন।কিন্তু দাভাই করেছিলো।সে তো ভালোবেসেছিলো।ভালোবাসার মানুষকে রক্ষা করতে চেয়েছিলো এই নিষ্ঠুর সমাজ থেকে।মনে একরাশ কষ্ট নিয়ে দাদাভাই সেইদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।আমরা কেউ জানতাম না দাদাভাই কোথায়।বাবার কড়া আদেশ ছিলো দাদাভাইয়ের সাথে যোগাযোগ না রাখা।মা একবারে ভেঙে পড়েছিলো। মা লুকিয়ে লুকিয়ে দাদাভাইকে ফোন দেয়।দাদাভাই জানায় সে আর বাড়ি ফিরবে না।মা অনেক আকুতি মিনতি করে দাদাভাইকে রাজি করায়।দাদাভাই মায়ের সাথে না পেরে বলে যে আসবে।বাবা চলে গিয়েছিলো সিলেট এক সপ্তাহের জন্য।ভাইয়া ঠিক ছয়দিন পর বাসায় আসে সন্ধ্যায়।মা পূজো দিচ্ছিলো।ভাইয়া ধীরে ধীরে বাড়িতে আসে।
ভাইয়ার কাপড়ে ধুলাবালি ছিলো।মাথার চুলেও ধুলাবালি লেগে ছিলো।মা দাদাভাইকে এই অবস্থায় দেখে দৌঁড়ে গিয়ে ধরে।দাদাভাই খালি একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলেছিলো আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।মা সেইদিন দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো।সেই দিন রাতে মা দাদাভাইকে আর আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়।পরের দিন দাদাভাই আর নিজের রুম থেকে বের হয়নি।দাদাভাই খুব চিন্তায় ছিলো কিছু একটা নিয়ে। দাদাভাইয়ের মুখ একবারে শুকিয়ে গিয়েছিলো।আমাকে ডেকে বলেছিলো আমার কিছু হয়ে গেলে কোমলের পাশে থাকিস।আমি কিছুই বুঝতে পারিনি সেইদিন।বিকেলে আমি আর মা একটু মন্দিরে গিয়েছিলাম সন্তুষি মায়ের পূজো দিতে।আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়।এসে দেখি দাদার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।দাদাভাইকে মা প্রসাদ দিতে গিয়ে ডাকলো অনেকবার কোন শব্দ নেই।মা জোড়ে জোড়ে ডাকলেন কিন্তু সাড়াশব্দ পেলেন না।মা অনেক ভয় পেয়ে যায় খারাপ কিছুর ভয়ে।মা কাঁদা শুরু করলেন।আমি দৌঁড়ে গিয়ে মানুষ নিয়ে আসলাম। রঞ্জিত দা আর কালু দা এসে দরজা ভাঙলো।ভিতর থেকে লাইট বন্ধ ছিলো। আবছা আবছা দেখা যাচ্ছিলো যে ফ্যানের সাথে কিছু একটা ঝুলছে।মা গিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরে দাভাইকে।রঞ্জিত আর কালুদা দাদাভাইকে নামায়।দাদা কেন আত্মহত্যা করলো আমরা কেউ জানি না।মা এটাই ধরে নেয় কারণটা তুই।বাবা তো থানায় কেইস করেছিলো।কিন্তু ওসি কেইস ফাইল করেনি।বলেছে আত্মহত্যার কেইস তারা ফাইল করবে না।এরপর জানিসই তো সব।

ছায়া জহুরি চোখে পুরো রুমটা পর্যবেক্ষণ করলো।ছায়া বারান্দায় গিয়ে চেক করে সেইখানে গ্রিল নেই যে কেউ দেয়াল টপকে উঠতে পারে।বাইরেটাও দেখে নিলো।সিসি ক্যামেরা আছে দুইটা।এইবার ছায়া টেবিলে গিয়ে কোন চিঠি আছে কিনা সেইটা খুজলো।বলা যায় সুইসাইড নোট।ছায়া এইবার হতাশ হয়।ছায়ার হাত লেগে একটা বই টেবিলের নিচে পড়ে যায় চট করে।ছায়া বইটা নিচে থেকে তুলতে গেলে দেখে একটা কলমও পড়ে আছে।ছায়া কলম আর বইটা তুলে টেবিলে রাখে।ঠিক তখনই রিয়া এসে সেই কলমটা হাতে তুলে নেয়।

-আরে এই কলমটা আমি কতো খুঁজেছি। আমার জন্য একটা এনেছিলো আর ভাইয়ার কাছে একটা ছিলো।লাবিব ভাইয়া দাভাইয়ের বন্ধু সে ইংল্যান্ড থেকে পাঠিয়েছিলো।এইটায় অডিও রেকর্ডিং সিস্টেম আছে।এটির একটি অভ্যন্তরীণ মেমোরি রয়েছে যা একটানা ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত অডিও রেকর্ড করতে পারে।পেন অডিও রেকর্ডার ডিভাইসটার তো চার্জ নেই রে। কম্পিউটারের USB পোর্টে এটি চার্জ করতে হয়।অডিও রেকর্ডিং শুনতে কম্পিউটারে সংযোগ করতে হবে।তুই অপেক্ষা কর চার্জ হয়ে নিক আগে।রিয়া নিজের ঘরে গিয়ে চার্জ দিয়ে দিলো।
ছায়ার কেন জানি খুব চিন্তা হচ্ছে।সে পুরো ঘরজুড়ে পায়চারি করলো।কিন্তু টেনশন দূর হচ্ছে না।এইখান থেকে কিছু না পেলে যে রহস্যের জাল ভেদ হবে না।
……
রিয়া যেই না কলমের রেকর্ডিং গুলো অন করলো ছায়া ঝটপট বসা থেকে উঠে আসে।আর একটার পর একটা ক্লু খুঁজতে থাকে যদি এইখানটায় কিছু থাকে।
কলমটায় একটার পর একটা রেকর্ডিং চলছে,
এর মধ্যে একটা অন হতেই ছায়া আর রিয়া যেনো থমকে যায়।একটি গান।

“আমি তোমায় ভালোবাসি জগতে হইয়াছি দোষী
আমি তোমায় ভালোবাসি জগতে হইয়াছি দোষী
না পাইয়া তবু খুশি
না পাইয়া তবু খুশি
তোমার ছবি আঁকলাম অন্তরায়।”

ছায়ার চোখের জল ছল ছল করছে।এখনই যেনো টুপ করে পড়বে।রিয়া ছায়ার চোখের জল দেখেই ঝট করে রেকর্ডিংটা পালটে দিলো।এর মধ্যে আরো একটা রেকর্ডিং আসতেই তারা হয় ভীতসন্ত্রস্ত। ছায়া উঠে চট করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়।কাঁপা কাঁপা পায়ে এসে ছায়া আর রিয়া একসাথে বসে।রিয়া ঢোক গিলে ।মুখে হাত চেপে কান্না থামায়।স্বরনালী কাঁপছে বেগতিক হারে। কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।

“কোমলের কিছু হলে আমি তোদের ছেড়ে দিতাম?ভাবলি কি করে?তোরা যে ঐ পবিত্রার গায়ে তোদের নোংরা হাতের ছুঁয়া লাগাতে চেয়েছিস সেইটাই তোদের কাল হলো।তোদের খেলায় কোমলকে সামিল করে খুব বড় ভুল করে ফেলেছিস। নিজের গর্ত নিজে খুঁড়েছিস।সত্য চাপা থাকে না কোনদিন।সত্য দিনের আলোর ন্যায় সত্য।”

অট্টহাসির আওয়াজ আসছে কর্কশ কন্ঠের বুঝা যাচ্ছে না কে।

“আচ্ছা তাই?কিভাবে বাঁচাবি? তুই নিজে বেঁচে থাকলে তো।আমার ভাইয়েদের গায়ে হাত দেওয়া তোর সব চাইতে বড় ভুল।আহান তো গুটি মাত্র।”

কাউকে শ্বাসরুদ্ধ করার শব্দ আসছে।কেউ যেনো গোঙাচ্ছে।যেনো গলা মুখ নাক চেপে ধরা হয়েছে।কয়েকটা জিনিসছুড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো।ঘরের কিছু একটা যেনো পড়লো ফ্লোরে।ঝংকার তৈরি হলো।কয়েকজনের দৌঁড়ে গিয়ে আটকানোর শব্দও পাওয়া গেলো।
“শালার তেজ এরপরেও কমে না।ওরে ধর।খুব লাগলো না একটা মাইয়ারে এমনে কইছি দেইখা।কয়বার শুইছস তার লগে এতো যে টান?”

অরূপ যেনো কিছু একটা দিয়ে সেই লোকের মাথায় বাড়ি মারে।
সবাই সেইদিকে দৌঁড়ে যায়।বিশ্রী সব গালাগালি উচ্চারণ করছে।এইবার যেনো আবারো চেপে ধরে।ছটফটানোর আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দই পাওয়া গেলো না।তৈরি হলো এক গুমোট পরিবেশ।হাওয়া যেনো ভারী হলো।
অনেক তড়পানোর পরে হঠাৎ করেই থেমে যায় সব।চঞ্চল সমীরণ যেনো হঠাৎই তার প্রবাহ বন্ধ করে দেয়।

“একে ঝুলিয়ে দিয়ে বের হ সব”
দুই তিনটা পায়ের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।যেনো পুরো ঘরময় পায়চারি করছে।
পরে আর কিছুই নেই।রিয়া রেকর্ডিং অফ করে দেয়।

ছায়া আর রিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে।দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেললো যেনো।
ছায়া নিজেকে শক্ত করলো।মনোবল হারালে চলবে না।তাকে শক্ত থেকে এখন সব বের করতে হবে।চোখ থেকে বের হওয়া অবাধ্য অশ্রুগুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছলো।
ছায়া রিয়াকে উদ্দেশ্য করে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,

-এইসব যাতে পাঁচ কান না হয়।সব বের না হওয়া অবধি এটা তোর আর আমার মধ্যে থাকবে।

রিয়া মাথা নাড়ায়।হিচকি তুলে কাঁদে রিয়া।

-দাদাভাই আত্মহত্যা করে নি ছায়া।খুন হয়েছে?

ছায়া রিয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়।রিয়া লেপ্টে রইলো ছায়ার সাথে নিবিড়ভাবে।ক্ষনে ক্ষনে ইষৎ কাপুনি দিয়ে উঠছে শরীর।

-আমি এখন যাচ্ছি।এই পেনটা আমার কাছেই থাক।তুই নিজেকে শক্ত রাখ রিয়া।আমাদের নিয়ে খেলা হয়েছে আর আমরা বুঝলামই না।আগে কেনো খুঁজলাম না সব।অরূপদার সাথে ওদের কিসের শত্রুতা ছিলো?ওরা জানতে পারলে আমাদেরও শেষ করে দেওয়া হবে।সামনে আমাদের অনেক কিছু ফেইস করতে হবে।এই রেকর্ডারই হবে আমাদের চাবি।তারা হয়তো জানে না। জানলে এইটা আমাদের হাতে এখন থাকতো না।তাই এইটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

-ছায়া পুলিশকে ইনফর্ম করে দেই?

-একদম না।পুলিশ এইখানে কিছু করবে না।তারা উপযুক্ত প্রমাণ চাইবে।যেহেতু প্রথমেই তারা কেইস নেয়নি তার মানে ঘাপলা কিছু একটা আছে।উপরের কারো হাত আছে।তাই তাদের কিছু জানানো যাবে না।

রিয়া সম্মতি জানায়।

-আমি এখন যাচ্ছি রিয়া।কোন দরকারে আমাকে ফোন দিবি।বাসায় যাস।আসছি।

ছায়া প্রস্থান করে।তার যে অনেক কিছু জানার বাকি।এর পিছনের মাস্টারমাইন্ড কে সেটা বের করতেই হবে। ছায়ার একটা কথা স্মরণ হয় আহান তো গুটি মাত্র।তবে কি আহানও জড়িয়ে আছে এর সাথে?আর আহান সেইবার জেল থেকে একদিনের ব্যবধানে ছাড়া পায় কিভাবে?মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে সব।অরন্য কিভাবে জানলো সব?ছায়ার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।কার কাছে পাবে সব জবাব?তবে এর আগে বাড়ি ফেরা উচিত।সবাই হয়তো খুঁজছে। কি বলবে বাড়ি গিয়ে?অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।একবার অরন্যের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।একমাত্র সেই পারে সমস্যার সমাধান দিতে।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here