কুঞ্জছায়া পর্ব ৫৩ ও শেষ

#কুঞ্জছায়া
#কুঞ্জা_কাবেরী
#পর্ব৫৩_(অন্তিম পর্ব)
(কপি করা নিষেধ)
বাড়িতে বিয়ের আমেজ।লাল নীল মরিচাবাতি আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো বাড়ি। আত্মীয়স্বজনদের হৈ হল্লোরে কল্লোলিত আজ বাড়ি।ছোটরা ফুল স্প্রিডে গান চালাচ্ছে।বড়রা যেনো কাজ করতে করতে আর মেহমানদারি করতে করতে ক্লান্ত।বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা।বাড়ির গেইট সাজানো হয়েছে হরেক রকমের রঙিন ফুল দিয়ে।কোন কমতিই যেনো রাখলেন না রেজাউল সাহেব মেয়ের বিয়েতে।
ছায়া ঘরের এক কোনায় চুপটি মেরে বসে আছে।সে যেনো পলক ফেলতেই ভুলে গিয়েছে।আজ রাতে তার বিয়ে!ভাবতেই অবাক লাগছে।তার আজ দুটো প্রিয় মানুষের কথা খুব মনে পড়লো অরূপদা আর অরন্য।দুইটা মানুষই তার জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে।অরূপদা থাকলে আজ খুব ভালো হতো।কিন্তু সে আজ নেই তাদের মধ্যে।আচ্ছা অরূপদা কি তাকে উপর থেকে দেখছে!
তখনই ধীর পায়ে রেজাউল সাহেব মেয়ের কাছে আসলেন।নরম দৃষ্টি ফেললেন মেয়ের দিকে।মেয়ে তার কষ্টে আছেন বুঝতে পারছেন।মেয়ের জন্যই তো তার এতো কিছু আয়োজন করা।তার নিজের সিদ্ধন্তের উপর বেশ ভরসা আছে।এখন থেকে যা হবে খুব ভালো হবে।তিনি মেয়ের কাছে বসলেন।আজ তার মেয়ে চলে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে ভাবতেই বুক ভারী হয়।চোখ উপচে পানি পড়ে।তার জীবনে পিতৃসত্তা জাগানো প্রথম কন্যা সন্তান।মেয়েকে যখন প্রথম তার কোলে দেওয়া হয়েছিলো তখন ছোট ছোট আদুরে হাত পা মেলে সেই কি কান্না!রেজাউল সাহেব সেইদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে খুশির অশ্রু বহিয়ে ছিলেন।এই মেয়ে আজ কতো বড় হয়ে গেলো।এই মেয়ের বিয়ে।তার হৃদয়ের টুকরার!মেয়েদের যদি সারাজীবন বাবার বাড়ি থাকার নিয়ম থাকতো তাহলে মেয়েকে কখনো কাছ ছাড়া করতেন না তিনি।মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলালেন।আলোগোছে চোখের জল মুছলেন।এই জল কাউকে দেখানো যাবে না যে।
ছায়ার মনটা যেনো ভেঙেই গেলো বাবাকে দেখে।বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।কাঁদলো আজ বাবার বুকে চিৎকার করে।তার মন প্রাণ ভিজে গেলো নিগুঢ় যন্ত্রণায়।রেজাউল সাহেব মেয়ের কান্না আর সইতে পারলেন না মেয়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেলেন।মীরা বেগমকে পাঠালেন মেয়েকে সামলাতে।মীরা বেগম আসলেন মেকাপ যারা করবে তাদের নিয়ে। ঘরে ঢুকে দেখলেন মেয়ে কাঁদছে। মীরা বেগমের মাতৃসত্তা উথলে উঠলো নোনা জলে।ছায়া মাকে দেখেই কান্না আটাকলো।একটা মেকি হাসি দিলো।কষ্ট লুকানোর নিদারুণ প্রয়াস।মীরা বেগম মেয়ের পাশে বসে বললেন মমতা মাখানো কন্ঠে,

-মায়ের উপর শেষবার বিশ্বাস করে দেখ ঠকবি না।

ছায়া মায়ের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ চোখে হাসে।
মীরা বেগম চলে যায়।
ছায়াকে সাজানো হলো ভারী লাল টকটকা বেনরসি শাড়ি দিয়ে।সেই সাথে স্বর্নের ভারী গয়না।হাতে বালা,গলায় শিতি হার,চন্দ্রহার,মাথায় টিকলি,নাকে নথ,হাতে কয়েক ডিজাইনের আংটি।মাথায় খোপা করে সেই খোপায় দেওয়া হলো স্বর্নের খোপার কাটা,কানে কানবালা,কোমরে কিঞ্চিনি।ঠোঁটে লাল টকটকে লাল লিপস্টিক,মুখে মেকাপ। ছায়ার মাথায় একটা লাল পাথরে জড়োয়া ঘোমটা দিয়ে অর্ধমাথা ঢেকে দেওয়া হলো।ছায়াকে যেনো অচিনপুরের রানী লাগছে।তখনই রিয়া আসে ছায়ার ঘরে।ছায়া রিয়ার পানে চায়।রিয়ার মলিন মুখ।এসে বসে ছায়ার পাশে।ছায়ার হাতে একজোড়া নূপুর দেয়।ছায়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিয়ার পানে চায়।

-এইটা অরূপদার আলমারি থেকে পেয়েছি।অরূপদা তোর জন্য রেখেছিলো।মনে রাখিস ছায়া তুই নিজেকে কষ্ট দিতে পারিস না।তোর ভেতর আমার ভাইয়ের প্রাণ।মরতে মরতেও দাভাই তোর সুখের কথা ভেবেছে।

ছায়ার বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠে।বুকটা শূন্যতায় খা খা করে উঠে।তার অন্তরিন্দ্রিয় পিষে যেতে থাকলো নির্মম বেদনা আর আত্মগ্লানিতে।রিয়া আর দাঁড়ায় না।চলে যায় রুম থেকে।ছায়া নূপুরটা পড়ে নেয় পায়ে।এই নুপূর সে আর কোনদিন খুলবে না।নিস্তব্ধ ঘরে বাজতে থাকে তার কানে, মস্তিষ্কে অরূপের ব্যথিত,মলিন কন্ঠস্বর,

-কোমল!

ছায়া বাকরুদ্ধ হয়।শ্বাস আটকে আসে।অপ্রকিতস্থের ন্যায় অরূপকে পুরো রুম জুড়ে খুঁজতে থাকে।তার কানে অরূপের কন্ঠ পুনরায় ভেসে আসে।

-কোমল!আমাকে কোথায় খুঁজছিস?তোর ভেতরে যে আমার বাস।নিজেকে ভালো রাখ।তুই ভালো না থাকলে যে আমি কষ্টে থাকবো।আমি যে সুখ পাবো না।ভালোবাসা যে নিয়ামত। সেই ভালোবাসা পায়ে ঠেলতে হয় না।যে তোর অপেক্ষা করছে তার কাছে ফিরে যা।তার সত্তার সাথে নাহয় আমাকে মিলিয়ে নিস।আমি আছি, আমি থাকবো।এই ব্যর্থ প্রেমিক কি তার প্রিয়তমা কে ছেড়ে যেতে পারে?আমি চলে গেলেও আমার সত্তা রয়ে গেছে তার মাঝে।তুই নাহয় অল্প বিস্তর আমাকে খুঁজে নিস তার হৃদয়ের মধ্যেখানে।

ছায়া হতবাক হয়।তার দৃষ্টি হয় ঘোলাটে।তার চোখ হয় নিমিঝিমি। অর্ধ চোখ খোলা অবস্থায় ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে কিছু বলে।সে যেনো বিরাজ করছে কোন এক অন্য দুনিয়ায়।তখনই তার দরজায় টুকা পড়ে।ছায়া চোখ খুলে চায়।তার সারা ঘরজুড়ে অরূপকে খুঁজে। পায় না।সব খালি,সব বিরান মরুভূমি। হায়!

ছায়া এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে দরজার কাছে গিয়ে দেখে প্রাণ।প্রাণ একটা মুচকি হাসি দেয়।ছায়া কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,
-আমাকে নিয়ে চলুন প্রাণ ভাইয়া।
…….
অরন্য এক নদীর তীরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।নদীর পানিতে ঢেউ অল্পবিস্তর। আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারারা।আকাশের বুক জুড়ে এক মস্ত বড় রূপোর থালার ন্যায় চাঁদ।তারারা যেনো এই চাঁদকে প্রহরীর ন্যায় পাহাড়া দিচ্ছে।আকাশের বুকে আজ কতো শতো প্রহরী।অরন্য চায় না চাঁদের দিকে।তার যে নিষেধ এই চাঁদের দিকে তাকানো।

এই পৃথিবীতে দুইশ্রেনীর মানুষ আছে।এক শ্রেনীর মানুষ হলো অপেক্ষাকারী।অর্থাৎ হলো যারা অপেক্ষা করে।
আর দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষ হলো যার জন্য অপেক্ষা, এই যার জন্য অপেক্ষা করা হয়, সে মানুষটা হয়তো জানেও না নিজের অজান্তেই তার জন্য কাউকে অসম্ভব মানসিক প্রহসন সহ্য করে যেতে হচ্ছে। আর এই দুই শ্রেণির বাইরেও কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে না। অদৃশ্য, ব্রাত্য এই মানুষগুলোকে কখনো কোনো শ্রেণিভুক্ত করা হয়না। তারা জানে, তাদের জন্য কেউ পথ চেয়ে থাকে না; তাদের অস্তিত্ব অস্তিত্বহীনতারই আরেক নাম। তখনই অরন্যের কানে আসে কারো নূপুরের ঝন ঝন আওয়াজ।অরন্য ফিরে চায় না।আবারও কানে আসে কারও চুরির রিন ঝিন আওয়াজ যা বাতাসের শো শো আওয়াজ আর নদীর কল্লোলময় শব্দের সাথে মিশে একাকার হয়ে হৃদয়ে, মস্তিষ্কে ঝংকার তুলছে।অরন্যের কানে আসে,

-ডাক্তার সাহেব।

অরন্য হাসফাস করে।তার কানে কি ভুল শুনেছে?নাকি সব সত্যিই?তার মন প্রবল উত্তেজনায় যেনো হিতাহিত জ্ঞান হারালো।
সে চকিতে চায় পেছনে।এই আধারে চাঁদের আলোয় ছায়ার মুখটা জ্বলজ্বল করছে।এ যেনো কোন এক সম্রাজ্যের লাল রানী।লালের আভায় যেনো তার পুরো সত্তা মিশ্রিত।অরন্য কাঁপাকাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ায়।গলা শুকিয়ে কাঠ।এক ফোটা পানির জন্য হাসফাস করলো।ছায়া এগিয়ে এসে অরন্যের সামনে দাঁড়ায়।আদ্র কন্ঠে বলে,

-শুধু ভালোবাসতে মন থাকা লাগে তা না, ভালোবাসা বুঝতেও উপযুক্ত মন থাকা লাগে।কত কত মায়া জড়ানো ভালোবাসা নীরবে হারিয়ে গেছে শুধুমাত্র সঠিক মূল্যায়নের অভাবে!কারো কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়াকে নিজের যোগ্যতা বা পাওনা না ভেবে আল্লাহর নেয়ামত ভাবতে হয়,সেই নেয়ামতের কদর করতে হয়।না হলে এই নেয়ামত খুব শক্ত ভাবেই কেড়ে নেওয়া হয় !যেমন অরূপদা চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে।
আর অকৃতজ্ঞ মানুষের সাথে এমন হওয়াই উচিত নয় কি?!আমি যে অকৃতজ্ঞ ডাক্তারসাহেব।আমাকে কি একটু ভালোবাসবেন?আমি যে ক্লান্ত।খুব ক্লান্ত।আমি যে আর পারছি না।আমি এইবার শান্তি চাই।শান্তিতে বাঁচতে চাই আপনার বুকে মাথা রেখে।আমার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।আপনার বুকে একটু আমার মাথাটা শক্ত করে ধরবেন।এই মন আজ প্রণয়ের দহনে দগ্ধ।আপনার ভালোবাসার এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে তাতে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন?

অরন্য যেনো আজ শীতল,শান্ত,বিকারহীন।মুহুর্তেই যেনো তা চঞ্চল হলো।বহু বছরের সাধনা বাস্তব হলো।সে কম্পিত পায়ে এগিয়ে এসে ছায়ার মাথটা শক্ত করে তার বুকের বাম পাশে চেপে ধরলো। আজ যেনো অরন্যের অক্ষিকোটরে ঢল নামলো প্রণয় অশ্রু।এতো তার প্রণয় প্রাপ্তি।তার মনে মধুমাসের প্রেমের পবন অবশেষে বইলো।আহা!কি প্রশান্তি।
ছায়া চুপ করে অরন্যের বুকের বাম পাশের নরম মাংসপিণ্ডের দামামার ন্যায় দ্রিম দ্রিম আওয়াজ কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো।

-ফুল হীন এক বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি ফুল ফুটার অপেক্ষা করেছি ছায়াকরী।কিন্তু তার প্রকৃতিকে দেবার সময় তখনো শুরুই হয়নি।অপেক্ষা করেছি সে ফুল ফুটবে, সে ফুল কে ঘিরে পাখিরা গাইবে গান,ফুরিয়ে যাবে সেদিন আপনার জন্য আমার অভিমান। আজ আমার অভিমান ফুরিয়ে গিয়েছে।আজ সেই বহু অপেক্ষিত ফুল ফুটেছে।এই প্রস্ফুটিত ফুল যে আমার।

ছায়া নীরবে হাসে।তখনই কানে আসে কারো খুকখুক কাশির আওয়াজ।ছায়া ছিটকে দূরে সরে যায়।
অরন্যের বিরক্ত হলো।এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে।

তখনই প্রাণ এসে মধ্যে দাঁড়ায় বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো।বুকটা টান টান করে হাত পিছনে নিয়ে গলা ঝেড়ে ভাব নেয় কিছু বলার জন্য,

-হাহ তগোর প্রেমে পিরীত শেষ হইলে বিয়া বাড়ি চল।এই বাচ্চা পোলা জীবনের এতো বড় ঝুকি নিয়া বউ নিয়া পালাইলো সেই খেয়াল কি আছে?

এইবার ছায়ার সম্বিৎ ফিয়ে।ভয়ে আড়ষ্ট হয়।তার বাবার সম্মান যে ধূলোয় মিশে যাবে।এইবার কি হবে?
অরন্য বুঝতে পারে ছায়ার মনোভাব। এগিয়ে এসে ছায়াকে এক হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।

-চিন্তা করবেন না।চলুন আমার সাথে।আমি আছি আপনার সাথে।
….
ছায়া,অরন্য আর প্রাণ বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখে থমথমে পরিবেশ।তারা আসতেই দেখে বরযাত্রি এসেছে।বাট বরের জায়গা খালি। এইবার অরন্য ভ্র‍ু কুঁচকায়। ছায়া অরন্যের থেকে দূরে সরে যায়।একবার বাবা আর মায়ের দিকে তাকাতেই ছায়ার আত্মা শুকিয়ে যায়।ঠিক তখনই আতশবাজি ফুটার তীব্র আওয়াজ হয়।সেই আওয়াজে কেঁপে উঠে ছায়া।সবাই খিল খিল ধ্বনিতে হেসে দেয়।ছায়া অবাকের চূড়ান্ত সীমায়।তখনই আকাশ আর অনন্যা সানাই হাতে নিয়ে পে পু করে তা বাজাতে থাকে আর কোমর ঝুলিয়ে নাচতে থাকে।অরন্য নিজের ভাই, বোন,বাবা মাকে দেখে হতবাক হয়ে যায়।চিন্ততার পোকারা কিলবিল করছে তার মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে।তখনই জেসমিন বেগম এগিয়ে এসে ছেলের কান ধরে ঠোঁটে দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে তুলে বসে,

-কি হ্যাঁ?কেমন লাগে?মাকে না জানিয়ে প্রেমের সমুদ্র বানিয়ে ফেলেছিস। অথচ আমাদের জানালিই না?প্রাণ না জানালে জানতেই পারতাম না।
তাই আমি আর তোর বাবা ছায়া মায়ের বাবা মায়ের সাথে আলাপ করে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললাম।কেমন হলো এইবার!

অনন্যা খিলখিল করে হাসে,

-ভাইয়ু ভাবীমনি বাবাকে চেনে। আমাকে আর মাম্মামকে চেনে না তাই আমি আর মাম্মাম গিয়ে ভাবীমণিকে দেখে আসি।ভাবী সেইদিন কেঁদে কেটে একবারে চোখ মুখ লাল বানিয়ে ফেলেছিলো।ইশ!তুমি যদি দেখতে।

ছায়ার এইবার টনক নড়ে।বাবা আর মায়ের দিকে চায়।ছায়ার বাবা মায়ের মুখে মিটিমিটি হাসি।ছায়া যেনো অবিশ্বাস্যের সমুদ্রে সাতার কাটছে।এইসব বিশ্বাস করতে পারছে না।নীলা আর মেঘার দিকে তাকালে তারা মাথা নাড়িয়ে না জানায় যে তারা কিছু জানতো না।ছায়ার বাবা এইবার অমায়িক স্নেহ নিয়ে বলেন,

-কি মামনি আদালতে যে কথা বলেছো অরন্যের সাথে আমরা কিন্তু দেখে নিয়েছিলাম।আমার কিন্তু তখনই খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো।অরন্যের বাবা প্রস্তাব রাখলে আমিও খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম ছেলে লাখে এক।আমার মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসে।এমন ছেলে ফিরিয়ে দেবার সাধ্যি যে নেই আমার।তোমার কাছ থেকে লুকিয়া রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ বিষয়টা কারণ তুমি তোমার মনকে বুঝতে পারছিলে না।তুমি সামনে এগোতে পারছিলে না আবার পিছও দিতে পারছি না।সেই মুহুর্তেই অরন্যের কথা বললে হয়তো তুমি সেইটা ঠিকভাবে নিতে না।আর তুমি নিজেও ছেলে দেখতে চাওনি।এমনকি ছেলের নামও জানতে চাওনি।তাই বিষয়টা আরও সহজ হয়ে গেলো।আমরা তোমার খারাপ চাইনা মা।

অরন্য সব শুনে যেনো ঝটকা খেলো।আজমীর সাহেব তখন ফিচেল গলায় বললেন,

-বাবা জীবন বাড়ি ছেড়ে এতো দূরে এসে পড়ে থাকলে বাড়িতে বিয়ে বাড়ির আয়োজন হচ্ছে নাকি শ্রাদ্ধের সেইটা টের পাবে কীভাবে?

এইটা বলেই হুহু করে হেসে উঠলো।অরন্য যারপরনাই বিস্মিত হলো।তাকে নিয়ে এতো বড় প্ল্যান। অরন্য প্রাণের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায়।এগিয়ে গেলেই প্রাণ চোরাদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আশেপাশে। যেইনা না পালাবে সেই মুহুর্তে খপ করে তাকে অরন্য ধরে ফেলে।প্রাণ অতিকষ্টে হাসি ফুটিয়ে তুললো মুখে।অরন্য সময় ব্যায় না করেই দাবাং মার্কা এক চাপড় বসায় তার পিঠে।প্রাণ মুখটা কাঁদোকাঁদো করে ফেলে।অরন্যের কাছ থেকে বাঁচতে অরন্যের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

-আমি কিন্তু তোর বইনের হবু বর।আমার কিছু হইলে হেতির কি হইবো?দেখ তোর বইনার কথা ভাইব্বা মোরে ছাড়ি দে।আর তুই আমার এতো কাছে আইসছ কেন?দূরে সর।তোর না আইজজা বিয়া?আমারে নিয়া টানাটানি করস কেন?লজ্জা করে না।দূরে যাহ।তোর বউ দেখলে তোর জেন্ডারে সন্দেহ করবো।

অরন্য সাথে সাথেই প্রাণকে ফট করেই ছেড়ে দিলো।সেই সাথে হলো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভাবা যায়!কোথাকার জলকে এই ছেলে কোথায় টেনে নিয়েছে।

তখনই অভীক,শান্ত,আনফাল আর স্নেহারা আসে হাতে জামাইয়ের শেরওয়ানী, পাগড়ী, জুতা আর মালা নিয়ে।
সাথে সমস্বরে বলে উঠলো,

-দেবদাস মশাই বিয়ে রেখে বন বাদাড়ে ঘুরলে চলবে?এইবার তাহলে বিয়েটা হয়েই যাক।

অরন্য হতবাক। এই বিচ্ছুগুলাও জানতো অথচ সে জানতো না!

সেই মুহুর্তেই কিয়ারা আর রোজ সেই জুতোজোড়া নিয়ে ভূ দৌঁড়।কথা হচ্ছে তারা গেইট ধরতে পারেনি তাই জুতোর জন্য টাকা না দিলে তারা জুতো দিবে না।
…..
ছায়ার সব অবাক লাগছে।এ যেনো এক স্বপ্ননগরী।তখনই ছায়াকে কবুল বলতে বলা হয়।নীলা আর মেঘা কনুই দিয়ে তার পেটে খুচা দেয় কবুল বলার জন্য।ছায়া একবার পর্দার পাশে থাকা অরন্যের দিকে তাকায়।ছায়া দুরুদুরু বুক নিয়ে বলেই দেয় কবুল।
হাসি ঠাট্টার মাঝেই অরন্য আর ছায়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায় কবুল বলার মাধ্যমে।সবার মুখে আনন্দের সাথে উচ্চারিত হয় আলহামদুলিল্লাহ। আজ সবাই আনন্দে ছন্দোহিন্দল।চারিপাশ আজ আনন্দের ধারায় মুখোরিত।
…..
গভীর নিস্তব্ধ যামিনী। আশেপাশে ঝিঝি পোকার ডাক।চাঁদেরকণার হাট বসেছে আজ।ছায়া পায়ে নূপুর পড়ে তার নূপুরধ্বনি আশেপাশে ছড়িয়ে দিয়ে ভারী বিয়ের সাজ নিয়ে গিয়ে বসে অরূপদার কবরে।তার আঁচল থেকে বকুল ফুলগুলো নিয়ে ভারী যত্নে তা বিছিয়ে দেয় কবরে।কবরের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

-অরূপদা শুনতে পাচ্ছো?এই অরূপদা!আমি আজ খুশি,খুব খুশি।আমি যে ভালো থাকবো তুমিও ভালো থেকো।
তখনই তার গায়ে লাগে বাতাসের ঝাপটা।কানে ভেসে আসে মৃদু, নরম,শান্ত ফিসফিসানো কণ্ঠস্বর,

-কোমল তুই আমাকে ভালো রেখেছিস।আমি ভালো আছি,খুব ভালো আছি।

সেই মুহুর্তেই হাতে পদ্মফুল নিয়ে অরন্য এসে দাঁড়ায় ছায়ার পাশে।ছায়া ঝমঝমিয়ে হাসে।সেই হাসিতে যেনো জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে।অরন্য অনিমেষ চেয়ে রয় সেই হাসিতে।প্রিয়তমাকে গভীর আলিঙ্গন করে।কপালে একে দেয় গভীর চুম্বন।সেই চুম্বনের সাক্ষী থাকলো এই জ্যোৎস্না ভরা রাত।
(সমাপ্ত)

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here