কুয়াশার মতো পর্ব -১১

#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১১

রাতুলের চোখ কোণা ভিজে উঠেছে, হয়তো নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু এখন অনুশোচনা করে কি লাভ! ফুল গাছ থেকে ছেঁড়ার আগে চিন্তা করতে হয়।
ওসি সাহেব রাতুলের কাঁধের উপর হাত রাখলেন। কোমল গলায় বললেন, ” নিজেকে শান্ত করো। এভাবে ভেঙে পড়লে হবে?’

রাতুল চোখ মুছে তরল গলায় বললো, ” কিভাবে নিজেকে শান্ত করবো? নিজের হাতে নিজের সুখের সংসার নষ্ট করে ফেলেছি। আমি কি পারতাম না কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে? চৈতীর কথা শুনতে?”

“না, পারতে না। পিয়াসী দেবী পড়া শুরু করেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছে।”

ডাইরির এই পৃষ্ঠায় কাজল গলা অশ্রুবিন্দুর দাগ। এ পৃষ্ঠা লেখার সময় চৈতীর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। দেরি না করতে পড়তে শুরু করলাম,

আজকাল সোহাগ ভাইয়ের আচরণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। লোকটা কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে, যেন প্রতিটি কথায় ভালোবাসা মিশে রয়েছে। আচ্ছা উনি আমাকে অন্য নজরে দেখছেন না তো? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব, যতদূর জানি পিয়াসীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন, আজও পরিবারের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। সত্যিই কি ভালোবাসার রং বদলায়?

আচ্ছা রাতুল বদলে যায়নি তো? ও কি আমার ব্যবহারে বদলে যাবে? অন্যকারে প্রতি আসক্ত হয়ে যাবে তো? এমন হলে আমি সহ্য করতে পারবো না। কখনোই না!”

রাতুল প্রতি চৈতীর ভালোবাসা দেখে বড্ড অবাক হচ্ছি। ডাইরির পাতায় নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা সাজিয়ে রাখবে না। এই মেয়েকে নিয়ে কত বাজে ধারনা করেছি, সোহাগের প্রতি আগ্রহ দেখে অসংখ্য গা”লি দিয়েছি। অবশ্য এতে আমার কি দোষ? আমি তো সোহাগের সঙ্গে চৈতীর ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারিনি। কোন মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। কিন্তু সোহাগের সঙ্গে চৈতীর ঘনিষ্ঠতার কারণ কি ছিল? আমি নিজের চোখে দেখেছি চৈতী সোহাগের সাথে কেমন ব্যবহার করছে। আগ বাড়িয়ে চা করে দেওয়া থেকে শুরু করে বাহু ধরে গল্প করা পর্যন্ত। নাহ্! এসব ভাবতে চাই না। ওসি সাহেব বিরক্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। পাতা উল্টে পরের পৃষ্ঠা বের করলাম।

পরের পৃষ্ঠা,

সোহাগ ভাইয়ের ব্যবহারে প্রেম নিবেদন নিশ্চিত হয়ে গেছে। উনার কথা ভাবতেই ঘৃ’ণা হচ্ছে, বউ থাকতে কি করে অন্য মেয়ের প্রতি এমন ধারণা পোষণ করতে পারে? তা-ও নিজের বন্ধুর বউকে! পিয়াসীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা প্রয়োজন। আমি পরকীয়া নামক নর্দমায় পড়তে চাই না। একজনের সঙ্গে থাকার মাঝে আলাদা তৃপ্তি আছে।

আজ বিকেলে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লোকটা আমায় ডেকে নিয়ে শাসিয়ে গেছে, রাতের ভিতর উনার কথায় জবাব দিতে বলেছেন। কি করবো বুঝতে পারছি না, গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। লোকটা আমার পিছু ছাড়বে না। তাছাড়া ওমন চরিত্রের লোককে বিশ্বাস নেই, ভিডিও ভাইরাল করে দিতে দুইবার ভাববে না।
*
রাতের বেলা রাতুলের সঙ্গে অনেক্ক্ষণ কথা হলো, সোহাগ ভাইয়ের ব্যাপারে বললাম। ও এই ব্যাপারটা একদম হালকা ভাবে নিলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ” আরে ওসব কিছু না। বাদ দেও তো। ”
এরপর কল কেটে দিলো। রাতুল আমায় অবিশ্বাস করলো নাকি? ঠিক বুঝতে পারছি না।

পরের পৃষ্ঠা,
সোহাগ ভাই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। একদিকে বাড়িওয়ালা অন্যদিকে সোহাগ। কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না। নিজের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করছি, আজ-কাল সোহাগ ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে বেশ ভালো লাগে। রাতুল চলে যাওয়ার পর কেউ কখনো এতোটা যত্ন করেনি। সোহাগ ভাইয়ের প্রতি দূর্বলতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক নয়, তাছাড়া এই দুর্বলতাকে প্রস্রয় দেওয়া চরম অন্যায়। নিজেকে ন’র্দ’মা’র মতো মনে হচ্ছে। স্বামী থাকার পরেও কি করে অন্য পুরুষের প্রতি দূর্বলতা সৃষ্টি হলো? তা-ও যখন রাতুলকে ভালোবাসি দাবী করছি। অতিরিক্ত চিন্তায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে। সোহাগ ভাই এবং দুজনের থেকে বাঁ’চতে হবে।

পরের পৃষ্ঠা,

অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম সোহাগ ভাইয়ের সঙ্গে প্রেমের নাটক করবো। পিয়াসী ভাবীর সামনে উনার আসল চরিত্র তুলে ধরবো। বউ থাকতে অন্য মেয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকবে কেন? নিজেকেও কড়া ভাবে শা’সিয়ে দিয়েছি রাতুল ব্যতীত কারো প্রতি প্রেমের অনুভূতি মূল্যহীন। বাড়িওয়ালাকেও ম্যানেজ করে নিয়েছি। সকালে দেখা করে বলেছি আমি একটু অসুস্থ, পিরিয়ড সপ্তাহ চলছে। আপনাকে পরে জানাবো। লোকটা দেখি আমায় বিশ্বাস করে নিয়েছে। হাতে এক সপ্তাহ সময় আছে, এর মধ্যে বাড়িওয়ালার থেকে ওই ভিডিও হাতিয়ে নিতে হবে। এই কাজে ব্যবহার করবো সোহাগ কে।

পড়ার মাঝে ওসি সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ” সরি, সরি, আসলে চৈতী দেবীর বুদ্ধি দেখে হাসি আসলো। মেয়েটা দারুণ পরিকল্পনা করেছে। সোহাগের সাথে প্রেমের নাটক করে, সোহাগকে দিয়ে বাড়িওয়ালার মোবাইল চুরি করবে। দারুণ বুদ্ধি। পিয়াসী দেবী চালিয়ে যান। রোমাঞ্চকর গল্পের মতো লাগছে যদিও শেষ পরিনতি অজানা নয়। ”

চৈতী মেয়েটাকে অদ্ভুত চরিত্রের মনে হচ্ছে। ডাইরি জুড়ে এলোমেলো কথা লিখে রেখেছে। সোহাগের প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছিল একথা নিজেই স্বীকার করেছে তা-ও উল্টো সোহাগকে দোষারোপ করছে। এদিকে সোহাগ রাতুলের কথামতো চৈতীর সঙ্গে প্রেমের নাটক করার চেষ্টা করছে। কি অদ্ভুত সমীকরণ!

এই মুহুর্তে বাড়িওয়ালা ব্যতিত অন্য কাউকে দোষারোপ করতে পারছি না। রাতুল চৈতীর থেকে অনেক দূরে থাকতো, বউয়ের অদ্ভুত আচরণ দেখে মনে সন্দেহ জেগেছে। কি করবে বুঝতে না পেরে বন্ধুর কাছে উদ্ভট আবদার করে বসেছে। অন্যদিকে সোহাগ বন্ধুর কথা মেনে নিয়ে চৈতীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে গেছিলো। সবাই নিজের জায়গায় ঠিক ছিল, রাতুল সোহাগের কাছে থেকে চৈতীর খরব পাচ্ছে। সোহাগ রাতুলের কথা মতো অতিরিক্ত দরদ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়িওয়ালা চৈতীকে ব্লা’ক’মে’ল করে শরীর ভোগ করতে চাইছে। সবাই নিজ নিজ জায়গায় ঠিক, শুধু চৈতী বাদে।

মেয়েটার উপর দিয়ে অনেক বড় ঝড় যাচ্ছিল। একদিকে বাড়িওয়ালার চিন্তা, অন্যদিকে সোহাগ। আবার রাতুলকেও সবকিছু খুলে বলতে পারছে না, সেজন্য কষ্ট পাচ্ছিল। আবার সোহাগ চৈতীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার চেষ্টা করছে।
সবকিছু মিলিয়ে কোন দিকে কি করবে?

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আর্কষণ স্বাভাবিক ব্যাপার। যে কোন ব্যক্তির অতিরিক্ত কেয়ার, সময় দেওয়া মনের মাঝে অন্য রকম ভালো লাগা সৃষ্টি করে, এই ভালো লাগা থেকে মায়ায় সৃষ্টি। মায়া বড্ড খারাপ জিনিস!

” পিয়াসী দেবী নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু চিন্তা করছেন। ”

” জ্বি, না। আমি পড়ছি। ”

পরের পৃষ্ঠা,

আজ ছাদে কোণায় সোহাগ ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিলাম। আকাশে ঘন কালো মেঘ ভীড় করছে। ছাঁদে টানিয়ে রাখা দঁড়িতে পিয়াসী ভাবির শাড়ি ঝুলছে। মনে হচ্ছিল পিয়াসী কাপড় তুলতে ছাঁদে আসবে, এজন্য সোহাগ ভাইয়ের কাছাকাছি এগিয়ে বসলাম। সাহস করে বাহুর উপর হাত রেখে পিয়াসীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার অনুমান সঠিক ছিল। পিয়াসী আমাদের ওভাবে দেখে ফেলেছে, হয়তো অনেক কিছু বুঝতে পেরেছে।
পিয়াসী যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সোহাগ ভাইও ছাঁদ থেকে নেমে গেল। উনার নাকি মাথা যন্ত্রণা করছে। তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে এক কাপ চা বানালাম। আজকেই পিয়াসীর সামনে সোহাগের কাজকর্ম স্পষ্ট হয়ে যাবে।

এরপর আর কিছু লেখা নেই। ওসি সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাতুলের দিকে তাকালেন। মলিন গলায় বললেন, ” বাড়িওয়ালা সম্পর্কে কি জানেন আপনি?”

” কিছুই জানতাম না। চৈতীর খু”নের পর এমনিতেই ওকেও সহ্য হতো না। চৈতীর দা’ফ’নের রাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কি করবো বুঝতে না পেরে ওর ডাইরিটা বের করতে পড়তে আরম্ভ করলাম। আমায় নিয়ে কত-শত প্রেমের কবিতা লিখেছে, সবকিছু পড়ে বড্ড হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাসি ধরে রাখতে পারিনি। একদম স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম।

সিদ্ধান্ত নিলাম, যে আমার সুখে সংসার নষ্ট করছে তাঁকে বাঁ’চতে দে’বো না। পরিকল্পনা অনুযায়ী রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভালো-মন্দ খাবার কিনলাম, তারপর তাতে বি”ষ মিশিয়ে বাড়িওয়ালা ফ্লাটের দিকে রওনা দিলাম। বাড়িওয়ালা বুঝতেও পারেনি ওর আসল রূপ আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। হাসিমুখে ঘরে ঢুকতে দিলো, আমার ভাগ্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। দু’জনে মিলে খাবার খেলাম, তারপর সব শেষ। এখন খুব ভালো লাগছে। নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না, আদালত আমায় যে শাস্তিই দিক না কেন আমার কাছে কম মনে হবে। আমার ভালোবাসাকে সন্দেহ করেছি। সুখটা ধরে রাখতে পারিনি। ”

রাতুলের কপল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ওর কান্না দেখে আমার গলা ধরে আসছে, সোহাগের চোখের কোণে অশ্রুর ভীড়। অবাক করার ব্যাপার হলো ওসি সাহেব কাঁদছে। একদম বাচ্চাদের মতো। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ” আজ আবারও মনে হচ্ছে নিজের ছেলেকে জে”লে পাঠাচ্ছি। তোমার মতো আমার ছেলেটাও এমন ভুল করে ফেলেছিলো। ”

রাতুল এগিয়ে গিয়ে ওসি সাহেবকে জড়িয়ে ধরলেন। অপরাধীর সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর এমন দৃশ্য খুব কমই নজরে পড়ে। সবকিছু বাইরে আমরা মানুষ, নিজেদের পরিচয় টিকিয়ে রাখতে গিয়ে না জানি কত অনুভূতি চাপিয়ে রাখতে হয়। কয়েক মুহূর্ত পরে ওসি সাহেব স্বাভাবিক হলেন। রাতুলের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোহাগের উদ্দেশ্য বললো, ” চলুন। আমাকেও আপনাদের বাড়িতে যেতে হবে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here