কুয়াশার মতো পর্ব -১২ ও শেষ

#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

সোহাগ ওসি সাহেব সঙ্গে বেরিয়ে গেল। রাতুল আমায় উদ্দেশ্য করে বললো, ” পিয়াসী, সোহাগের সঙ্গে সাংসারিক ঝামেলাগুলো মিটিয়ে নিও। আমার জন্যই তোমাদের সুখের সংসারে চিড় ধরেছে। শেষ পর্যন্ত এমনটা হবে কখনো বুঝতে পারিনি।”

” আপনি নিজেকে দো’ষারোপ করছেন কেন? সোহাগ নিশ্চয়ই অবুঝ শিশু নয়। ভালো-মন্দ বিচার-বিবেচনা সবকিছুই তার আছে। আপনার যেমন ভালো মনে হয়েছে আপনি বলেছেন। এতে দোষের কিছু নেই।”

” না রে বোন। চাইলেও সবসময় বিবেচনা করা যায় না। আমার কষ্টগুলো কি তুমি বুঝতে পারছো না? কয়েক মিনিটের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। সবকিছুই জানো, নতুন করে বলার কিছু নেই। একটাই অনুরোধ, সোহাগের সাথে পারিবারিক ঝামেলাগুলো মিটিয়ে নিও। ”

” আপনার কথাগুলো মাথায় রাখবো। ”

প্রতিত্তোরে রাতুল কিছু বললো না, মলিন মুখে চেয়ারে বসে পড়লো। তড়িঘড়ি করে থা’না থেকে বেরিয়ে এলাম। ওরা দু’জন আবার অপেক্ষা করছে। থা’নার বাইরে ওসি সাহেব কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে সোহাগের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে ব্যস্ত হয়ে বললো, ” পিয়াসী দেবী গাড়িতে উঠুন। আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। ”

মাথা নাড়িয়ে সোহাগের পাশে বসে পড়লাম। সোহাগ আগ বাড়িয়ে ডান হাতটা চেপে ধরলো। চাপা গলায় বললো, ” হাতটা ধরে থাকলে কি অনেক সমস্যা হবে?”

” না, সমস্যা হবে কেন? ”

” এমনই বললাম। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে তা-ই। ”

” কোনকিছু এলোমেলো হয়ে যায়নি। বরং চৈতীকে ভুল বুঝেছি। যে মেয়েটাকে সবসময় দোষী ভেবেছি, দিনশেষে সে-ই মেয়েটাই একদম নির্দোষ ছিল। তুমিও রাতুলের সঙ্গে মিলে ওকে ফাঁ’দে ফেলতে চেয়েছো। ”

” নির্দোষ মানুষগুলো দিন শেষে শা’স্তি পায়! রাতুলের কারণগুলো তো জানোই। অনেক অনুরোধ করেছে আমায়, বন্ধুত্বের খাতিরে না করতে পারিনি। ”

” এসব ঘটনায় তুমি নিজেকে কেমন দেখছো?”

” পিয়াসী, এই ঘটনার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। রাতুলের অনুরোধে চৈতীর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে গেছিলাম। ব্যাস! এতটুকুই! এখন তুমি যদি চৈতীর সঙ্গে আমার পরকীয়ার দো’ষ চাপাতে চাও তাহলে কিছু বলার নেই। তোমার এমন ভাবার কারণ ছিল ঠিকই। কিন্তু এখন তো সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। ”

” তুমি নিজের দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারো না। চৈতীকে মানসিকভাবে ভেঙে দিতে তোমারও হাত ছিল। আমার কথা না হয় না-ই বা বললাম। ”

” তুমি আমায় যেভাবে খুশি দোষারোপ করতে পারো। কারণ তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছি। ”

” কি অন্যায় করেছো? ”

” চৈতীর ব্যাপারে তোমার অনুমতির প্রয়োজন ছিল। যা হয়ে গেছে তা তো পরিবর্তন করতে পারবো না, তবে এখন ক্ষমা চাইছি। পারলে আমাকে মাফ করে দিও। ”

সোহাগের সাথে কোন কথা বললাম না। আপাতত কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইছি না। অশান্ত মস্তিষ্কে কোন প্রকার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।
গাড়ি চলছে নিজের মতো, চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। ওসি সাহেব ড্রাইভারের পাশে বসেছে। পিছন দিকে গলা বাড়িয়ে সোহাগের সঙ্গে গল্প করছে। উনার ছেলে কিভাবে নিজের জীবন নষ্ট করছে সেসব বর্ণনা করছে। রাতুলের সাথে উনার ছেলের বড্ড মিল, যদিও দু’জন আলাদা মানুষ।

বাড়ির সামনে ভীড় জমেছে। বাড়িওয়ালার খু”নের ব্যাপারে কানাঘুঁষা চলছে। এসব ব্যাপারে জড়াতে ইচ্ছে হলো না, সোজা হেঁটে নিজেদের ঘরে চলে এলাম। ওসি সাহেব সোহাগকে উনার সঙ্গে থাকতে বলেছে।

চৈতীর খু”নের সমাধান হয়ে গেলেও কিছু ভালো লাগছে না। খু”নি হিসাবে রাতুলকে মানতে পারছি না। ছেলেটা বউ পরিবার রেখে বিদেশবিভুঁইয়ে টাকা রোজগারের জন্য ঘুরে বেড়ায়, কত স্বপ্ন ভালোবাসা বুকে আগলে রাখে। দেশে ফিরবে, সুন্দর সাজানো সংসার হবে। বাড়িওয়ালা লোকটা উপর বড্ড রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে খু”ন করে ফেলি। রাতুল ওঁকে না মা”র”লে আমিই মে”রে ফেলতাম। বেয়াদব একটা!

ভোরের আলোয় পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠেছে। রাতের বেলা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। সোহাগ কখন ফিরেছে তা-ও বলতে পারবো না। আশেপাশে সোহাগকে দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো কোন কাজের জন্য বাইরে গেছে।

অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যতদূর জানতে পেরেছি চৈতীর সঙ্গে সোহাগের অবৈধ সম্পর্ক ছিল না। চৈতী কিম্বা সোহাগ কেউই দু’জনকে পাওয়ার আশা করেনি। এখানে কাউকে দোষারোপ করতে পারছি না। তবে সোহাগের সঙ্গে চৈতীর ঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট। যে কারণ-ই হোক না কেন, কোন স্ত্রী চাইবে না তার স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে গল্প করে সময় পার করুক। আবার এই তুচ্ছ কারণে সংসার ভেঙে চলে যাওয়ার মানে হয় না। জীবনে চলার পথে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই বলে হুটহাট বিয়ে ডিভোর্সের কোন মানে নেই।
আপাতত সোহাগের সাথেই থাকবো। নতুন করে সংসার সাজানোর চেষ্টা করবো। কতদূর সফল হবো জানা নেই, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!

চুলায় চায়ের পানি বসিয়েছি, সকালের নাস্তা রেডি করতে হবে। এমন সময় সোহিনী দৌড়ে এলো। এত সকালে ওকে দেখে চমকে উঠলাম। সোহিনী ব্যস্ত হয়ে বললো, ” ভাবী দেখো ভাইয়া কিসব বলছে। ”

” কি বলছে তোমার ভাইয়া? তাছাড়া সে কোথায়? কাল সন্ধ্যার পর আর দেখা হয়নি।”

” ভাইয়া বাড়িতে গেছিলো। এতো সকালে মা-বাবা ওকে দেখে অবাক। কি হয়েছে জানতে চাইলো। সে বলেছে আমি তোমায় কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা করেছিলাম। এখন আমায় পুলিশে দিবে। ”

” কি বলছো? সোহাগ তো আমায় এসবের কিছু বলেনি। ”

” ঠিকই বলছি। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি একথা সত্য। ভুল নয় অন্যায় করেছি, কিন্তু তাই বলে এখন জে’লে যেতে হবে?”

” তোমার ভাই কোথায়? ”

” বাড়িতে। ও যখন বললো তুমি কিছু জানো না তখনই তোমার কাছে ছুটে এসেছি। মা বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে।”

” আচ্ছা অপেক্ষা করো। আমি রেডি হয়ে আসছি। ”

” ঠিক আছে। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে এসো। ভাইয়া কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ”

” তোমার ভাইয়াকে এসব ঝামেলা করতে নিষেধ করবো। কিন্তু সত্যি কথা কি জানো সোহিনী, তুমি আমায় ব্যবহার করেছো। একবারও আমার কথা চিন্তা করনি। সেদিন ছোট-বড় অনেক কিছুই হতে পারতো। তুমি এতো টাও অবুঝ না। ”

সোহিনী উত্তরে কিছুই বললো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সোহাগ এমন বাড়াবাড়ি করবে বুঝতে পারিনি। সোহিনী বিরুদ্ধে কোন প্রকার পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চাই না। সোহিনীর কাজ ক্ষমার অযোগ্য হলেও কিডন্যাপার লোকগুলো বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে ওস্তাদ লোকটা। বিপদে পড়ে অন্যায় করতে রাজি হয়ে গেছিলো, তবে শেষ পর্যন্ত উনার জন্য সম্মান নিয়ে ঘরে ফিরেছি। উনি না থাকলে রিকশাওয়ালা সাজা লোকটা অনেক কিছু করে ফেলতে পারতো। পুলিশ কে”স করলে ওদেরও এ ব্যাপারে টানা-হেঁচড়া করা হবে। যা আমি একদমই চাচ্ছি না।

সারাপথ সোহিনী সঙ্গে কোন কথা হয়নি। সোহিনী মেয়েটা ভীতু চোখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। হয়তো কিছু বলতে চাইছে কিন্তু অজানা বাঁধার কারণে বলতে পারছে না।

শশুরবাড়ি গিয়ে সোহাগকে বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলাম। আমার এমন উদারতা দেখে ও বাড়ির কেউ খুশি হয়নি। বরং সবাই বেশ বিরক্ত। সকলের মাঝে শশুর আব্বুকে দেখলাম সোহাগকে সাপোর্ট করতে, মেয়ের এমন কাজ কোনভাবে মেনে নিতে পারছে না। সোহাগও আমার উপর প্রচন্ড বিরক্ত, আমি নাকি সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো নেকামো করছি। সকলের কাছে ভালো সাজার চেষ্টা করছি। কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়, সোহাগ সোহিনী ভাই-বোন। ওদের ভিতর যতটুকু ঝামেলা হয়েছে তা-ই যথেষ্ট।
তাছাড়া আমি স্বভাবত খুব অলস প্রকৃতির। কোর্ট কাচারির ঝামেলা সহ্য হবে না। আমার মতো লোকের জন্যই সমাজের ছোট ছোট অন্যায়গুলো চাপা পড়ে যায়।

গত সাতদিন সোহাগের সঙ্গে তেমন কথা হয়নি। মান-অভিমান চলছে। সোহিনী ব্যাপার নিয়ে সোহাগের সাথে কয়েকবার ঝগড়া হয়েছে। ছেলেটা ঠিক কি চাইছে বুঝতে পারছি না। বাড়ি নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। বাড়িওয়ালার মেয়ে এসেছিল। আমরা আগের মতোই থাকতে পারবো।

গভীর রাত। চারদিকে নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। চায়ের কাপ হাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। অনেকদিন পর আজ খুব ভালো লাগছে। অজানা আনন্দে মন ভরে আছে। সময়টা উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। এ বয়সে লাফালাফি মানানসই নয় বিধায় চায়ের কাপ হাতে সময় কাটাচ্ছি। সোহাগ বিছানায় শুয়ে আছে।

হঠাৎ দুইটা লোমশ হাত আমায় জড়িয়ে ধরলো। চির পরিচয় স্পর্শ! কানের পাশে লেপ্টে থাকা চুলে মুখ লুকিয়ে বললো, ” সবকিছু কি মিটিয়ে নেওয়া যায়? মা বলেছিল নাতি-নাতনির মুখ দেখলে আমায় ও বাড়িতে থাকতে দেবে।”

” তোমার কি এখানে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে? ”

” ঠিক তা নয়! প্রেয়সীকে কাছে পাওয়া ব্যাকুলতা ছড়িয়ে পড়েছে, শরীরে, হৃদয়ে। সবকিছু ভুলে কারো মায়ায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে। জানি এ প্রেমিক বড্ড অন্যায় করে ফেলেছে। তবুও এ আকুলতা মিথ্যে নয়। ”

” কবি সাহিত্যিক হয়েছেন বুঝি?”

” না গো পিয়াসী, তোমার প্রেমিক হতে ইচ্ছে করছে। যার সামান্য কথায় তুমি হেসে কুটিকুটি হবে। লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নেবে। ”

” লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নিতে হবে? আচ্ছা। তা কোথায় মুখ লুকাতে হবে?”

” আমার বুকের মাঝে!”

” ধ্যাত!”

” ইসস বউ আমার লজ্জা পাচ্ছে। ইউরেকা! কাজ হয়েছে। ”

সোহাগের বাঁধন থেকে সরে আসতে চাইলাম কিন্তু তা সম্ভব নয়। ছেলেটা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। এ বাঁধন খুলে আসার ইচ্ছে নিজেরও নেই। এভাবে যুগ কেটে গেলেই বা কি ক্ষতি! হুট করে উনি আমায় কোলে তুলে নিলেন। এক পা দু পা করে ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে, এ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি!

* * *
বাইরে বৃষ্টির শব্দ। থেমে থেমে মেঘের গর্জন। সোহাগ পিয়াসী নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। যেন তাদের কখনো সমস্যা হয়নি, পৃথিবীর সব থেকে সুখী দম্পতি।
রাতুল জে”লের কোণে পড়ে আছে, আধোঘুমে চৈতীর কথা চিন্তা করছে। কেমন অদ্ভুত হয়ে গেল জীবনটা। সবার জীবনকে কি সুখ ধরা দিতে নেই?

এই কাহিনীতে দোষী কে? বাড়িওয়ালা? যে নিজের লালসায় গোটা একটা পরিবার ধ্বং’স করে দিয়েছে। কামনার কাছে নত হয়ে একজনের জীবনকে ন’র’কের মাঝে ঠেলে দিয়েছে।

নাকি চৈতী? যে নিজের সমস্যার কথা স্বামীর কাছে খুলে বলতে পারেনি। সে তো চাইলে আইনের সাহায্য নিতে পারতো। তার সমস্যার কথা কাউকে খুলে বলতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। নিজের মাঝে সবকিছু চেপে রাখতে গিয়ে জীবনকে হারিয়ে ফেলেছে।

নাকি রাতুল? ছেলেটা কি পারতো না কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে চৈতীর কথা শুনতে? যাকে এতোটা ভালোবেসেছে শেষ মুহূর্তে তার উপর বিশ্বাস ধরে রাখতে। রাগের বশবর্তী হয়ে যে কাজ করে বসেছে, তার শেষ কোথায়? ফাঁ’সিতে? রাতুলের মৃ’ত্যুে কি তার পরিবারে ধস নামবে না। তার বৃদ্ধ মা কষ্টের যাতনায় গুমরে গুমরে ম’র’বে না?

নাকি সোহাগ? যে বন্ধুর কথায় চৈতীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। পিয়াসীকে ছেড়ে চৈতীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। যদিও কারণে তবুও কি এ ঘনিষ্ঠতায় কোন অপরাধ নেই?

নাকি পিয়াসী? যে সবকিছু ভুলে স্বামীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে!

সোহিনীও কি দোষী হতে পারে না? সে-ও তো কিছু কম করেনি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here