কুয়াশার মতো পর্ব -১০

#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৯

চায়ের কাপ হাতে দোকানের বাইরে বেঞ্চের উপর বসে আছি, ওসি সাহেব তৃপ্তি সহকারে চা পান করছে। সোহাগ বিরক্ত হচ্ছে, চায়ের কাপ বেঞ্চে উপর ফেলে রেখেছে। গরম চা দিয়ে ক্রমাগত ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

” সোহাগ সাহেব বোধহয় চা-কফি পছন্দ করেন না। ”

” পছন্দ-অপছন্দ অনেক সময় মেজাজের উপর নির্ভর করে। আপনি হঠাৎ করে আমাদের থানায় ডাকলেন কেন?”

” এমন সুন্দর উপভোগ্য মুহূর্তে এসব কথা না বললেও তো পারতেন। ঠিক বলিনি পিয়াসী দেবী?”

” মুহূর্তগুলো আপনার জন্য সুন্দর হলেও আমাদের জন্য সুন্দর নয়। রাতুলের ব্যাপারটা কয়েক মুহুর্ত পরপর মস্তিষ্কের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। যে কোন কিছু উপভোগ করার জন্য শান্ত মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয়।”

ওসি সাহবে ঠোঁট থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে মুখের সামনে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ” আপনার কথায় সঙ্গে একমত হতে পারছি না। ”

সোহাগ এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিল, হঠাৎ করে ওসি সাহবের উপর চটে গেল। কর্কশ গলায় বললো, ” আমাদের সঙ্গে মসকারা করছেন নাকি? আপনার সাথে শেষ বিকেল উপভোগ করতে আসিনি। চৈতীর খু’ন রাতুল করেছে, এখানে আমাদের কেন ডেকেছেন? ”

” দুইটা প্রশ্ন একসাথে! আপনারা বোধহয় বিরক্ত হচ্ছেন, আচ্ছা চলুন। থানায় ফিরে যাই। ”

থানার পরিবেশ একদম শান্ত। রাতুল স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে। ওসি সাহেব এমন শান্ত পরিবেশ দেখে মুচকি হাসলেন। তারপর রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” শেষ করেছিলেন যেন? আমরা ফিরে এসেছি এখন সবটা বলতে পারেন। ”

রাতুল নড়েচড়ে বসলো। ওসি সাহেব ইশারায় আমাদের বসতে বললেন।

” চৈতীর খু”নের দিন দুপুরে দেশে ফিরি। বাড়িতে কেউ জানত না বিধায় সোজাসুজি চৈতীর কাছে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। রাস্তায় সমস্যা হওয়ার কারণে এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। এ বাসায় আগেও এসেছি বিধায় চিনতে তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না। কতদিন পর চৈতীর সঙ্গে দেখা হবে, ভাবতেই খুশি খুশি লাগছিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে চৈতীর দরজার সামনে দাড়ালাম। কলিংবেল বাজাতে যাব এমন সময় ভিতর থেকে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসলো। সন্দেহের বশে দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে পেলাম ভিতর দিয়ে কারো গোঙ্গানির আওয়াজ আসছে। বিবাহিত হওয়ার এ আওয়াজের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচয় ছিল। তবুও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, চৈতী আমায় এভাবে ঠকাতে পারে না। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে, ইচ্ছে করছিল দরজা ভেঙে সবকিছু শেষ করে দিতে কিন্তু শান্ত হয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।

মিনিট বিশেক পর দরজা খোলার শব্দ হলো। ঘরের ভিতর দিয়ে একজন পুরুষ মানুষ বেরিয়ে গেল। আবছা আলোয় তার মুখটা চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল। আমিও লোকটা পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলাম। ”

” লোকটা কে ছিল? কি হলো রাতুল বলছেন না কেন? লোকটা কে ছিল?”

” ভাবি অনেক উত্তেজিত হয়ে গেছেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, লোকটা সোহাগ নয়। আপনাদের বাড়িওয়ালা। ”

হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তাহলে সোহাগ এমন কিছু করেনি। এতোক্ষণ কতটা অস্থির লাগছিল ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। রাতুল কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর নিজের মতো বলতে শুরু করলো।

” লোকটা হাতেনাতে ধরতে পারলে কিছু বলতে পারতাম কিন্তু এখন কিছু বললে হিতে বিপরীত হবে। এই ভাবনা থেকে উনাকে কিছু বললাম না, বরং চৈতীর কাছে গেলাম। মেয়েটা দরজা খোলা রেখে বিছানায় শুয়ে আছে। ঘরে ডিম লাইট জ্বলছে, সামান্য আলোয় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে চৈতীর শরীরের কাপড়চোপড় এলোমেলো, চুলগুলো মুখের উপর পড়ে আছে। আমি শান্ত ভঙ্গিতে লাইট জ্বালালাম। আমায় দেখে চৈতী চমকে উঠলো, ভীতু গলায় বললো, ” তুমি এখানে কি করে? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?”

” না চৈতী সোনা। তুমি স্বপ্ন দেখছো না। আমি সত্যিই ফিরে এসেছি এবং তোমার সমস্ত কীর্তি ধরে ফেলেছি। ”

” তুমি ভুল করছো। ”

” না, আমি ভুল করছি না। আমি বেশ আগে থেকেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তোমার আনন্দমাখা চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি, তাছাড়া নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো। তোমায় দেখলে স্পষ্ট বুঝতে পারবে আমি ভুল বুঝিনি। ”

” সবসময় চোখের দেখা সত্যি হয় না। বিশ্বাস করো। ”

” কি বিশ্বাস করবো? সোহাগের সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা নাকি বাড়িওয়ালার সঙ্গে তোমার লীলাখেলা?”

” আমাকে একটু বলার সুযোগ দাও। ”

” অনেক বলেছ জীবনে, নিজের উপার্জনের সবকিছু তোমার নামে লিখে দিয়েছি। সবটা দিয়ে ভালোবেসেছি কিন্তু কি পেলাম আমি?”

” আমি তোমাকেই ভালোবাসি। সোহাগ ভাই আমার ভালো বন্ধু, আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক নেই। ”

” হ্যাঁ বুঝতে পারছি। সোহাগ তোমার বন্ধু এবং বাড়িওয়ালা তোমার বিছানা সঙ্গী। তাই তো?”

” না, তাই না। আমাকে বিশ্বাস করো। ”

” আচ্ছা। কয়েক মিমিট আগে বাড়িওয়ালার সঙ্গে তোমার শারিরীক স”ম্প”র্ক হয়নি?”

” হ্যাঁ, হয়েছে। ”

” জীবনের শেষ মুহূর্তে সত্যটা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ”

” কি বলতে চাইছো তুমি? ”

” কিছু বলতে চাইছি না। তোমাকে শে’ষ ক’র’তে চাচ্ছি।”

” রাতুল এমন করো না, আমাকে বিশ্বাস করো। আমি….”

সেদিন চৈতী ওর কথা শেষ করতে পারেনি। তার আগেই ওর মুখের উপর বালিশ চে”পে ধরেছিলাম। আমাকে আটকানো অনেক চেষ্টা করছিলো, কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু সুযোগ পায়নি। ”

ওসি সাহেব নিরব হয়ে আছে। আমি যেন স্তব্ধ হয়ে গেছি, রাতুলের সহজ স্বীকারোক্তি মেনে নিতে পারছি না। অপরাধী কখনো নিজের দোষ স্বীকার করে না। ওসি সাহেব রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” তার মানে চৈতীর শেষ কথাগুলো তুমি শোনোনি। কিন্তু এখন দোষ স্বীকার করলে কেন? এছাড়া বাড়িওয়ালার খু”ন করলে কেন? তাকে আইনের মাধ্যমে শা’স্তি দিতে পারতে। ”

” কোন আইনে শাস্তি দিতাম? তাছাড়া আমি নিজেই তো খু”ন করেছি। খু”নির সাক্ষী কি গ্রহণ করা হতো? ”

ওসি সাহেব প্রতিত্তোরে হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” রাতুল সাহেব আপনাদের সামনে সবকিছু বলতে চাইছিলেন। তাই আপনাদের এভাবে ডেকে এনেছি। সবকিছু তো শুনলেন, এখন আসতে পারেন। ”

” না সবকিছু বলা হয়নি। এখনও অনেক কথা বাকি। দুইটা খু”ন করেছি, আমার ফাঁ”সির আদেশ হতে পারে। সেজন্য সবকিছু ওদের বলে যেতে চাই। ”

” কি বলতে চান? ”

” বলবো ভাবি। আপনার এসব কথা জানার প্রয়োজন আছে। চৈতীর সঙ্গে সোহাগের ঘনিষ্ঠতা আপনার মনের মাঝে দাগ কেটেছে। সে-ই দাগ মুছে ফেলা অসম্ভব, তবুও কিছুটা দাগ দূর করার চেষ্টা করা যায়। চৈতীর সঙ্গে সোহাগের বন্ধুত্ব আমার কথায় শুরু হয়েছিল। সোহাগ কখনোই রাজি হতে চায়নি, শেষ পর্যন্ত ওর হাতে-পায়ে ধরে রাজি করিয়েছি। ”

সোহাগ কিছুই বলছে না, পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রাতুল জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করলো,

” মিনিট বিশেক ধস্তাধস্তি করার পর চৈতী শান্ত হয়ে গেল। বালিশ সরিয়ে দেখলাম ওর আর বেঁ”চে নেই। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি লেগে থাকলেও কলিজা ছিঁ”ড়ে যাচ্ছিল। চিৎকার করে কাঁদতে পারছিলাম না পাছে কেউ শুনে ফেললে। জীবনে শেষবারের মতো চৈতীকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। গালে গলায় অসংখ্য চুমু এঁকে দিতে দিতে পাগলের প্রলাপ বলতে শুরু করলাম। তবে চৈতী আমার ডাকে সাড়া দেয়নি। ভালোবাসার এমন সমাপ্তি হবে ভাবতে পারিনি। যাকে নিজের সবকিছু দিয়ে ভালোবেসেছি তাকে এভাবে হারিয়ে ফেললাম।

কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে আসলো। কি করেছি আমি, এখানে বেশিক্ষণ থাকলে ধরা পড়ে যাবে। উঠে দাঁড়ালাম পরক্ষণেই চোখ পড়লো চৈতীর শান্ত মুখের দিকে। নিষ্পাপের মতো ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ কি মনে করে চৈতীর শেষ স্মৃতি হিসাবে ওর ডাইরিটা নিয়ে এলাম। শেষবার দেশে ফিরে ওই ডাইরিটা ওকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলাম। এতে নিজের মনের কথা লিখে রাখতো। কখনো কখনো আমাকে দু’এক পৃষ্ঠার ছবি তুলে দিতো। আমার প্রতি ওর ভালোবাসা ভরা অনুভূতিগুলো পড়ে আবেগে আপ্লূত হয়ে যেতাম। ”

” ডাইরিটা কি আপনার কাছে আছে? ”

” হ্যাঁ স্যার আমার কাছে আছে। শেষ দিকের কয়েক পৃষ্ঠা পড়েছি। সবটা পড়তে পারিনি। ”

” কেন পড়তে পারেননি?”

” সাহস হয়নি! ”

এতক্ষণে সোহাগ মুখ খুললো। বিস্মিত গলায় বললো, ” ডাইরি পড়তে আবার সাহস লাগে নাকি?”

” হ্যাঁ রে বন্ধু। অনেক সাহস লাগে। তুই এ অনুভূতি বুঝতে পারবি না। ”

সোহাগ বিষন্ন স্বরে বললো, ” আমিও বুঝতে পারি। তোর কি মনে শুধুমাত্র তুই নিজের ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছিস? না রে ভাই। শুধুমাত্র তুইই তোর ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলিসনি। আমিও হারিয়েছি। ”

” তুমি কাকে হারিয়েছ? তুমিও কি চৈতীকে ভালোবাসতে?”

” না পিয়াসী, আমি চৈতীকে ভালোবাসিনি। আমি তোমায় ভালোবেসেছি। তুমিও আমাকে ভালোবেসেছ, আফসোস নিজের কাজের মাধ্যমে সে-ই ভালোবাসার রং মলিন করে দিয়েছি। তোমাকে দোষ দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত। ”

ভ্রু কুঁচকে সোহাগের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও কিসব বলছে হঠাৎ করে। আমাকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সোহাগ বললো, ” এভাবে তাকিয়ে রইলে যে? আমি কি কিছু ভুল বলেছি? তুমি কি আমায় আগের মতো বিশ্বাস করো? ভালোবাসো?”

ওর কথার জবাবে কিছু বললাম না। সত্যিই সোহাগকে আগের মতো বিশ্বাস করি না, ভালোবাসি বলে দাবী করতে ইচ্ছে করে না। ওসি সাহেব এতো সময় চুপ ছিলেন। একটু কেশে আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বললেন, ” আপনারা থানায় আছেন। একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here