কুয়াশার মতো, পর্ব:৭

0
732

#গল্পঃকুয়াশার_মতো।
#পর্বঃ- ০৭

হাসপাতালে সবার সামনে শাকিলা কেঁদে কেঁদে বললো ” আমি সাজ্জাদকে খুব ভালোবাসি, তাকে কেন মারতে চাইবো বলেন? ”

” ওসি সাহেব বললেন, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে কিংবা সাক্ষী হিসেবে যেন বেঁচে না থাকে সেজন্য। ”

শাকিলার কান্না বাড়তে লাগলো, কান্নার জন্য সে কথা বলতে পারছে না। চারিদিকে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে, সাজু ভাই রামিশা ওসি সাহেব সুমনা ফেরদৌস আরও অনেকে৷ কিছু অপরিচিত মুখ আছে এরা হয়তো আশেপাশের কোন রোগীর স্বজন হতে পারে।

অসহায়ের মতো কান্না করতে করতে সাজুর দিকে চোখ পড়তেই দু’পা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে সাজুর ডান হাতটা ধরে কেঁদে কেঁদে,

” সাজু ভাই আপনি অন্তত বিশ্বাস করুন আমার স্বামী সাজ্জাদকে আমি অনেক ভালোবাসি। ওর কোনো ক্ষতি হোক সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি, মা-বাবা চাইতো না বিধায় মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন সাজু ভাই, ওকে যতটা কষ্ট দিয়েছি তারচেয়ে বেশী কষ্ট আমি ভোগ করেছি, হ্যাঁ আমি। ”

” সাজু বললো, কিন্তু আপনার খাবার খেয়ে তো সাজ্জাদ অসুস্থ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস এক চুমুক জুস খাবার সঙ্গে সঙ্গে নার্স নিষেধ করেছে। কারণ সাজ্জাদের এসব খাওয়া ঠিক না, নাহলে তো পুরোটা খাইয়ে দিতেন। ”

শাকিলা পূর্বের ন্যায় আরও অসহায় বোধ করতে লাগলো নিজেকে। সে সাজুর হাতটা চেপে ধরে শুধু বললো,

” আমি সত্যিই জানি না জুসের মধ্যে এসব কোই থেকে এসেছে? যদি জানতাম তাহলে নিজে খেয়ে মরে যেতাম তবুও ওকে দিতাম না। ”

” ওসি সাহেব বললো, আপনার স্বামীর বন্ধুর মতো আপনাকেও হাসপাতাল থেকে বের করে দিচ্ছি। ”

” আমি আমার সাজ্জাদকে রেখে কোথাও যাবো না, মেরে ফেললেও না। আপনারা আমার কথা একটু বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিছু করিনি। ”

এবার সাজু কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর হাত দিয়ে শাকিলাকে দাঁড় করিয়ে বললো,

” থানায় তোমাকে আনতে কে কে গেছিল? ”

” মা সুমনা আর ফেরদৌস। মামলা তুলে নিয়ে মা সেখান থেকে বাসায় চলে গেছে, আর আমরা তিনজনে চলে এসেছি হাসপাতালে। ”

” খাবার গুলো কখন কিনেছেন? ”

” সিএনজি করে আসার সময় আমি হঠাৎ করে ফেরদৌস বললো কিছু কিনে নিয়ে যাই। তারপর রাস্তার পাশে সিএনজি থামিয়ে আমি আর সুমনা বসে ছিলাম আর ফেরদৌস কিনে এনেছে। ”

” ওহ্ আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, তারমানে কেনার সময় ফেরদৌস সাহেব ওই বিষাক্ত ওষুধটা মিশিয়ে দিয়েছে। ”

” কিন্তু বোতল নতুন ছিল, আমি নিজের হাতে সেটা খুলেছি। ”

” যদি পূর্ব পরিকল্পিত হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ইঞ্জেকশন করার সিরিঞ্জের মধ্যে আগেই বিষাক্ত ওষুধ ছিল। সেটাই বোতলে পুশ করছে। ”

এবার উৎসুক জনতা ফেরদৌসের দিকে তাকিয়ে রইল, ফেরদৌস যেন আকাশ থেকে পরে একদম স্থির হয়ে গেল। নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না যে ‘ সাজু ভাই তাকে সন্দেহ করে বিষাক্ত ওষুধ মেশানোর কাহিনি গড়গড় করে বলে দিচ্ছে। ‘

” ফেরদৌস বললো, এসব কি বলছেন আপনি? আমি কেন করতে যাবো? আমি তো চাই তাদের সবার ভালো হোক, নিজের দৈনিক ব্যস্ততা রেখে আমি আপুর সঙ্গে আছি। নিজের বোনের মতো সম্মান করি বলে এতকিছু করলাম আর সেখানে আমাকেই ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে? ”

” ওসি সাহেব বললেন, তোমাকে ফাঁসানো হচ্ছে না বরং তুমি নিজে ফেঁসে যাবার কাজ করছো। তাই যা যা করেছো সত্যি সত্যি বলো, থানায় গিয়ে যদি রিমান্ডের দরকার হয় তাহলে তো…! ”

ফেরদৌস শাকিলার দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বললো ” আপু আমাকে কেন দোষারোপ করছেন বলেন, আমি কি এমন করেছি? ”

” সাজু বললো, একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি অতিরিক্ত এই আপ্যায়ন আমাদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে ফেরদৌস ভাই। ”

” সাজু ভাই আপনাকে কিন্তু আমি নিজেই এনেছি এই মামলার রহস্য সমাধান করতে। যদি আমার কোন অপরাধ থাকতো তাহলে আমি আপনাকে কেন আনবো? আমি তো জানি আপনি এলে খুনি বের হবেই হবে, আপনি বুদ্ধিমান। ”

” ওই যে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, তুমি বেশি ভালো হতে গিয়ে সমস্যা পাকিয়ে গেছে। লেবু কচলালে তেতো হয়ে যায়, সবকিছুই পরিমাণ মতো করতে হয় নাহলে বিপদ। ”

” আমি এখন বুঝতে পারছি সেটা, যদি জানতাম এভাবে ফেঁসে যাবো তাহলে কিছুতেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম না। আর আপনাকে ডাকার কোন প্রশ্নই আসতো না সাজু ভাই। ”

এমন সময় ডাক্তার এসে বললো ” সাজ্জাদ এখন মোটামুটি বিপদ মুক্ত, সে নাকি তার স্ত্রী শাকিলার সঙ্গে কথা বলতে চায়। সবাই শাকিলাকে সন্দেহ করেছে শুনে সে মন খারাপ করেছে। ”

সুতরাং আপাতত আলোচনা এখানেই স্থগিত করা হয়েছে, সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সাজু ভাই রামিশা ওসি সাহেব ও শাকিলা সবাই সাজ্জাদের কেবিনে প্রবেশ করলো।

শাকিলা কেবিনে প্রবেশ করেই আবার কান্না শুরু করে দিল, তারপর বেডের কাছে গিয়ে সাজ্জাদের মাথা বরাবর ফ্লোরে বসে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো,

” তুমি বিশ্বাস করো তোমাকে আমি মারতে চাই নাই, এরা সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। ”

” সাজ্জাদ আস্তে আস্তে বললো, আমি জানি তুমি এমনটা করতে পারো না। ওসি সাহেব আপনি ওকে কিছু বলবেন না, আপনারা আসল খুনি বের করতে চেষ্টা করুন। ”

সাজু বললো ” আমি যদি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই তাহলে উত্তর দিতে পারবেন? ”

” জ্বি চেষ্টা করবো। ”

সাজু তখন নিজের মোবাইলের স্ক্রিন সাজ্জাদের দিকে তাক করে ধরলো।

বললো ” দেখুন তো এই প্রকৃতির পিকচারটা কেমন লাগে? ”

সাজ্জাদ তাকিয়ে দেখে মোবাইলের স্ক্রিনে কোন প্রকৃতির পিকচার নেই। সেখানে মাত্র কয়েকটি লাইন লেখা আছে ” ডায়েরি ” সফটওয়্যারে।

সাজ্জাদ বিড়বিড় করে পড়ছে সেখানে লেখা,

” সাজ্জাদ ভাই আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো তারপর আপনি হুট করে বলবেন আপনার বাসায় ড্রইং রুমে একটা লুকানো ছোট্ট ক্যামেরা আছে। সেদিন রাতে কি কি হয়েছে সেটা সেই ক্যামেরা পেলেই জানা যাবে। আমি জানি ক্যামেরা নেই কিন্তু তবুও আপনাকে এটা বলতে হবে কারণ সেই কথা পুলিশসহ সবাই জানতে পারবে। আর খুনির কানে পৌঁছে যেতে পারে। ”

সাজ্জাদ অবাক হয়ে গেল, সাজুর দিকে তাকিয়ে বললো ” বাহহ অনেক সুন্দর লাগছে। ”

” আপনার মানসিকতা সুন্দর করার জন্য ছবিটি দেখালাম এবার বলেন, সেদিন রাতে আপনার বাসায় ড্রইং রুমে কি হয়েছিল? ”

” আমি রাত আড়াইটার দিকে বাসায় গেলাম, দরজা খোলা দেখে অবাক হলাম। কারণ আমি জানতাম শাকিলা নোয়াখালী চলে গেছে আমার সন্ধান করতে। ”

” তারপর? ”

” আমি ভিতরে প্রবেশ করতেই কেউ একজন আমার মাথায় সজোরে আঘাত করে। কে ছিল সেটা বোঝার ক্ষমতা ছিল না, মুহূর্তের মধ্যে আমি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ি। ”

” আপনি কি দেখেছিলেন যে আপনার শশুরের লাশ পরে আছে? ”

” না দেখতে পাইনি কারণ বাতি বন্ধ ছিল, আর আমি মোবাইল বের করতে করতে আঘাত এসে লেগেছিল। ”

” শাকিলা তার মায়ের কাছে কল দিয়ে বাবাকে খুন করার হুমকি দেয়, জানেন আপনি? ”

” জ্বি না। ”

” আপনার বাসায় আপনার শশুর খুন হয়েছে, এ বিষয়ে আপনার কি ধরনের ধারণা হচ্ছে? কারা বা কি কারণে এটা করতে পারে? যদি আপনার শশুর তাদের টার্গেট হতো তাহলে কিন্তু যেকোনো স্থানে অনায়সে মারতে পারতো। কিন্তু তা না করে তাকে আপনার বাসায় ড্রইং রুমে মারা হয়েছে। ”

” আমার বাসার ড্রইং রুমে একটা লুকানো ছোট্ট ক্যামেরা আছে, আমি সেটা শাকিলার জন্য সেট করেছিলাম। ”

” যেমন? ”

” আমি সেদিন অভিমান করে চলে আসার পর আমার বিশ্বাস ছিল শাকিলা আসবে। কিন্তু সে আসার পরে তার কতটা খারাপ লাগে সেটা নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিলাম। ”

” তারমানে আমরা যদি সেই ক্যামেরা উদ্ধার করতে পারি তাহলে তো জানতে পারবো আসলে কি ঘটেছিল সেই রাতে। ”

” হ্যাঁ, যদি খুনিরা সেই ক্যামেরা নষ্ট না করে তবে অবশ্যই পাবেন। ”

সাজু মনে মনে বললো, বাহ কত সুন্দর করে সাজিয়ে কথা বলে দিল। যদিও এটা মিথ্যা তবুও যদি সামান্য মিথ্যা দিয়ে কিছু বের করা যায়।

এই সময়ে ওসি সাহেব একটা প্যাঁচ লাগিয়ে প্রশ্ন করে বসলো, ” আপনি যদি জানতেন বাসায় কি হচ্ছে তাহলে তো আগেই দেখার কথা। কারণ মনে হয় আপনি আপনার মোবাইলে কানেক্ট করে রেখেছেন তাই না? ”

ওসি সাহেবের এরূপ প্রশ্নের জবাবে সাজ্জাদ বললো,

” জ্বি, কিন্তু শাকিলা নোয়াখালী রওনা দেবার পরে আমি আর বাসার ক্যামেরা চেক করিনি। ”

ওসি সাহেব হয়তো আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়, সাজ্জাদ ভ্যাবাচেকা হয়ে সাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। সাজু তখন ওসি সাহেবকে নিয়ে বের হবার তাড়া দিল, ওসি সাহেব বিমর্ষ মনে বের হয়ে গেল।

বাহিরে বেরিয়ে ওসি সাহেব ফেরদৌসকে সেখানে থাকতে বললেন। সাজুে উদ্দেশ্য ছিল ওসি সাহেব নিজে সবটা বলুক তারা কোথায় যাচ্ছে?

শাকিলা কেবিন থেকে বের হয়ে এসে বললো,
আমিও আপনাদের সঙ্গে যাবো৷

” কিন্তু কেন? ”

” আমিও সবটা দেখতে চাই সাজু ভাই, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন। ”

ওসি সাহেব ও সাজু দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সোজা হলেন। তারপর চারজন মিলে রওনা দিল বাসায়।

বাসায় ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে সাজু তার বন্ধু রামিশাকে বললো,

” তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। ”

” রামিশা বললো, কি কাজ? ”

” আমরা যখন ড্রইং রুমে ক্যামেরা খুঁজে বের করার ভান করবো তখন তুমি পাশের রুমে গিয়ে কিছু একটা ফেলে দেবে। তারপর আমরা দৌড়ে সেখানে যাবো, এবং সেই ১ মিনিটের মধ্যে আমি একটা ক্যামেরা সেট করে দেবো। ”

” তারমানে কি কোন ক্যামেরা নেই? ”

” না নেই, ওটা সাজ্জাদ মিথ্যা বলেছে, কারণ আমি তাকে বলতে বলেছি৷ ”

সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সাজুে মোবাইল বেজে উঠল, সাজু মোবাইল বের করে দেখে শাকিলার বোন সুমনা কল করেছে। সাজু রিসিভ করে বলে,

” হ্যাঁ সুমনা বলো। ”

” সাজু ভাই আপনারা কোথায়? ”

” আমরা তোমার আপুর বাসায়, সাজ্জাদ নাকি ড্রইং রুমে একটা ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিল অন্য কারনে। আজ হয়তো সেটা খুনি ধরার কাজে অনেক সাহায্য করবে। ”

” মানে? ”

” চমকে গেলে কেন সুমনা? ”

” কোই না তো, কেন চমকাবো? ”

” চমকানোর কারণ তো অবশ্যই আছে, বড়আপুর চাবির গোছা থেকে চাবি সরিয়ে রাখা। তারপর সেই চাবি অন্য কারো কাছে দেওয়া, এতগুলো টাকার সই করা চেকবই। ”

” কি বলছেন এসব? ”

” সাজ্জাদের জুসের বোতলে বিষাক্ত ওষুধ মেশানোর কাজটা খুনি খুব ভালো করে করেছে। মানতে হবে তার অনেক বুদ্ধি আছে, কারণ এমন নিখুঁত কাজ সহজে করা যায় না। ”

” সাজু ভাই…! আমি কিছু করিনি। ”

.
.
.

চলবে…

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here