কোনো_এক_বসন্তে পর্ব ৭

#কোনো_এক_বসন্তে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৭

মনের ভিতর কেমন একটা করুণ সুর বাজতে লাগলো।বুকটা খালিখালি লাগছে….খুব খালি খালি।হঠাৎ করেই বুকের কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে আমার।
আলতো করে দরজাটা খুলে দিলাম আমি।

দরজা খোলামাত্রই সামনে কে আছে সেটা লক্ষ্য না করেই ঝড়ে বেগে ঘরে ঢোকার জন্য ডান পা’টা বাড়িয়ে দিলেন আহিল ভাই।
আমি দিশেহারা হয়ে এই ঝড়কে আটকানোর জন্য কি করবো বুঝতে না পেরে আহিল ভাইয়ার পেটে ২ হাত রেখে সজোরে একটা ধাক্কা দিলাম পিছনের দিকে।

হঠাৎ বাঁধা পাওয়ায় যেনো কোনো একটা ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছেন এভাবে করে আৎকে উঠে সামনে থাকা মানুষটির দিকে চোখ তুলে তাকালেন আহিল ভাই।।

আমার চোখে চোখ পড়তেই তিনি স্থির হয়ে আটকে গেলেন এই চোখের দৃষ্টিতে।
দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমি একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে একপ্রকার ফিসফিস করে বললাম,

–আপনি কেন এখানে এসেছেন তা আমি জানি।
প্লিজ আহিল ভাই,খালামনিকে নিয়ে যাবেন না।আপনি কতটা শুনেছেন,আমি জানি না।কিন্তু যাই-ই হয়েছে এখানে,তা ঠিক হয়নি।এটা উচিত হয়নি।আর সবটাই হয়েছে আমাকে কেন্দ্র করে।
আমার কারণে আমাদের দুই পরিবারের এতোদিনের সম্পর্ক ভেঙে গেলে সেই গ্লানির বোঝা আমি নিতে পারবো না আহিল ভাই।
যা হয়েছে,সেটাকে আরও বাড়তে না দিয়ে আমরা নাহয় সমাধান করার চেষ্টা করি?আব্বু আর খালামনির মধ্যকার মনমালিন্য দূর করতে চেষ্টা করি প্লিজ?

এতোক্ষণ আহিল চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আমার কথা।কথা শেষ হতেই তিনি বললেন,

–আমি আমার অপমান সহ্য করতে পারি তনু।কিন্তু আমার মায়েরটা পারি না,একদম না….

বলতে বলতে আহিল ভাইয়ের নিষ্প্রাণ চোখ আবারও জ্বলজ্বল করে উঠলো।আবার এগিয়ে আসলে। বাসায় ঢোকার জন্য।
আমি দুহাত প্রসারিত করে দরজা আটকে দাঁড়ালাম।

–নাহ্,আপনি ভিতরে যেতে পারবেন না আহিল ভাই।আপনি গেলে ব্যাপারটা আরও বড় হয়ে যাবে।
আপনাকে আজ এখান থেকেই ব্যাক করতে হবে বাসায়,এটাই আমার শেষ কথা।আর এটাই কল্যাণকর হবে আমাদের পরিবারের জন্য।

–দরজা থেকে সরে দাঁড়া তনু,আমাকে ভিতরে ঢুকতে দে।আমি দেখি কি করা যায়।

আমি অনঢ় হয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম দরজা জুড়ে।যে করেই হোক আজ এখান থেকেই বিদায় করতে হবে আহিল ভাইকে।ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না একদম।

আমার কোনোরকম হেলদোল না দেখে আহিল ভাইয়ের মুখে এবার স্পষ্টতঃই বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো।তিন কড়া চোখে আমার দিকে চেয়ে কিছু বলতে গিয়েও আবার কি মনে করে চোখ নামিয়ে নিলেন।অস্থির হয়ে পায়চারী করতে লাগলেন,দরজার সামনে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,যত যাইহোক আমি আজ আপনাকে বিদায় না করে নড়ছি না এখান থেকে।
কিন্তু ঠিক এই সময়েই বড় ফুপুর আগমনে একদম ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিল সবকিছুতে।

–কি রে তনয়া?কে এসেছে এতো রাতে?এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কেন?

বলতে বলতে বড় ফুপু এসে দাঁড়ালানে আমার পিছনে।বড় ফুপুকে আসতে দেখে আমি ইতিমধ্যে দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়েছি।এই ফাঁকে আহিল ভাইও ভিতরে চলে আসলেন।

আহিলকে দেখে, বড় ফুপুও কিছুটা মিহিয়ে গেলেন।ঘোর আরেকটা অনর্থ যে হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই,বড় ফুপুও তা ঠাওর করতে পেরেই যেনো থমকে গিয়েছেন।

—————————-
টানা একঘন্টা বাক-বিতন্ডার পর একটু আগেই আহিল ভাই আয়রা আর খালামনিকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন।

শেষের দিকে এসে সবার মাঝে বনিবনা তো হয়েই গেল;ছোট ফুপি আম্মুর কাছে ক্ষমা চাইলেন,বাবাও অনেক করে ক্ষমা চাইলেন সোহেলী খালামনির কাছে।সবাই সবাইকে ক্ষমাও করে দিলেন।

সবার মুখই হাসিহাসি ছিল শেষ পর্যায়ে এসে,কিন্তু এই হাসিতে কোন প্রাণ ছিল না।বেহালার একটা সুর যে কেটে গেছে আগেই।

ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়া স্বত্তেও খালামনি আর এখানে থাকতে চাইলেন না।বিশেষ করে আহিল ভাইয়াই রাখতে চাইলেন না খালামনিকে এখানে।

বলে গেলেন,’তিন্নি আপুর বিয়ের আগেরদিনই তারা আবার চলে আসবেন।
এই কয়েকদিন নিজের বাসায় গিয়ে গোছগাছ করতে চান।কারণ তিন্নি আপুর বিয়ের পরপরই ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাতে চান তারা।’

আহিল ভাইয়ারা চলে যেতেই আমি ভীষণ কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম সবার সামনেই।যতটা জোরে পারা যায় চিৎকার করে কেঁদেছি শুধু।আমার এরকম কান্ড দেখে সবাইই হতবাক!ঐ পরিবারের জন্য যে আমার এতো টান, সেটা আগে হয়তো কেউ বুঝতে পারেনি।কারণ তারা তো বরাবরই তনয়ার অনীহাটাই দেখে এসেছে আহিলদের পরিবারের সদস্য হওয়ার ব্যাপারে!

কেনো কাঁদছি এতোটা,কিসের টানে কাঁদছি কিছুই জানতাম না আমি নিজেও।শুধু মনে হচ্ছিল,আমার বুকের ভিতরটা বিশাল কোনো ঝড়ে একদম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।আর কোনোভাবেই কোনো কিছুই ঠিক হবার নয়!

আমাকে ধরে সাইফা,তিন্নি আপু আর চাচী মিলে রুমে নিয়ে এসে শান্ত করে দিয়ে গেলেন।অনেকক্ষণ পর্যন্ত তারা আমার সাথে ছিলেন।
এদিকে আমাকে নিয়ে আসার পরপরই ড্রয়িং রুমের আসর ভেঙে যে যার মতোন করে বিমর্ষ বদনে রুমে চলে গিয়েছেন।

——————————
অনেক আগেই ফজরের আজান পড়ে গেছে। আকাশে দিনের আলো ফুটছে আস্তে আস্তে।এই কনকনে শীতেও আমি ব্যালকনির মধ্যে ইজি চেয়ারে বসে আছি একটা পাতলা শল গায়ে দিয়ে।
সত্যি বলতে শীত,গরম কিছুই আমার মধ্যে অনুভূত হচ্ছে না।পারিবারিক এই কলহে মনটা ভেঙে গেছে একদম।

আমি আমার শলের ভিতর থেকে আহিল ভাইয়ের সেই ফটোটা বের করলাম,যেট একটু আগেই আমি আহিল ভাইয়ের রুমের সাইড টেবিল থেকে নিয়ে এসেছি।

আমি কথা বলতে চাই এই ছবিটির সাথে,অনেক অভিযোগ জমা হয়ে গেছে এই অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই এই ছবির লোকটির উপর।
বাস্তবে তো আর এখন সম্ভব না,তাই ছবির সাথেই আমার মনের সব ক্ষোভ ঝাড়লাম।
অন্ধকারে ছবিটির উপর হাতড়ে হাতড়ে মানুষটিকে অনুভব করতে থাকলাম।

‘এতো করে বলার পরেও আপনি নিয়ে চলে গেলেন খালামনিকে!আমার কথা একটাবারও শুনলেন না যে!আজ সন্ধ্যায়ই তো খুব করে বললেন,আমাকে নাকি ভালোবাসেন আপনি!তো এটা বুঝলেন না,পারিবারিক সম্পর্কটা ছিন্ন করে দিলে তো আমাকে পাওয়ার যেটুকু ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল সেটাও এখন একদম শেষ হয়ে যাবে।কেন করলেন এটা আহিল ভাই!কেন?কেন?কেন?’

নিঃশব্দে চোখের পানি ঝরছে আমার গাল বেয়ে।
এই কলহ নিয়ে কেউ আমাকে এখন পর্যন্ত সরাসরি দোষারোপ করেনি ঠিকই,কিন্তু একবার যদি মন দিয়ে ভাবে তাহলে যে কেউই বুঝতে পারবে সবকিছুর মূলে তো তনয়াই!

ইশ সেদিন যদি নাটক করতে গিয়ে আসলেই মরে যেতাম,সেটাই বুঝি ভালো হতো।এই দিন আর দেখতে হতো না……!

————————-
শরীরে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে ঘুম ভাঙলো আমার।জ্বরে যেনো গা,হাত-পা পুড়ে যাচ্ছে।

পাশে তাকাতেই দেখি হাতের উপর মাথা ভর করে আম্মু আধবোঝা চোখ নিয়ে শুয়ে আছেন আমার পাশে।আমাকে নড়াচড়া করতে দেখেই তিনি সচকিত হয়ে উঠে বসলেন।

কি বিষন্নই না দেখাচ্ছে আম্মুর মুখ!এক রাতেই চোখের নিচটা কালশিটে হয়ে গেছে!
উনি উঠে বসে অর্ধ সমাপ্ত জলপট্টি দেওয়ায় কাজটা আবারও করে যেতে লাগলেন নীরব ও ক্লানহীন ভাবে।

আমিও কোনো কথা বললাম না,আস্তে করে আবার চোখটা বন্ধ করে নিলাম।ডান চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
ঘুম থেকে জাগতেই রাতের ঘটনাগুলো আবারও পীড়া দেওয়া শুরু করেছে।ইশ যদি ঘুমটা না ভাঙতো।

খুব সকালে আম্মু আমাকে দেখতে আমার রুমে এসে
দেখেছিলেন আমি বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ঘুমিয়ে আছি।
আম্মু গিয়ে আব্বুকে ডেকে আনেন।পরবর্তীতে দুজনে মিলে আমাকে বিছানায় নিয়ে আসেন।আর তার একটু পর থেকেই নাকি আমার গায়ের তাপমাত্রা তরতর করে বেড়ে চলেছে।

দুপরের দিকে ডাক্তার এসে দেখে গেলেন।কিছু মেডিসিনও দিয়ে গেলেন। আর বললেন এতে কাজ না হলে ইমারজেন্সি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে রোগীকে।এতো অল্প সময়ে এতো জ্বর উঠা মোটেও ভালো লক্ষ্মণ না।

সারাদিন বিছানাতেই পড়ে রইলাম।পরিবারের একজনের পর একজন এসে শুকনো মুখে আমাকে দেখে দেখে যাচ্ছেন।এক রাতে আগেই একটা ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেল এই বাড়িতে,এখন আবার এই বাড়ির সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটি অসুস্থ হয়ে মুখ থুবড়ে বিছানায় পড়ে আছে!
এমতাবস্থায় কারো মনেই নিশ্চয়ই শান্তি থাকার কথা নয়!

এদিকে আজ সকাল থেকেই ছোট ফুপি ড্রয়িং রুমে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে শুধু কেঁদেই যাচ্ছেন।
প্রথমে নিজের রুমে বসেই কাঁদছিলেন,উনার ন্যাকা কান্না বেশিক্ষণ সহ্য না করতে পেরে ছোট ফুপা নাকি উনাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন।

কাল রাতের এই কেলেঙ্কারির মূল হোতা যে তার আদরের বউ এটা বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করেছেন ছোট ফুপা।তাই ছোট ফুপার মতো এমন কাঠখোট্টা মানুষটা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে আছেন নিজের বউয়ের প্রতি !

অনেক চেষ্টা করে ছোট ফুপির কান্নার বিষয়বস্তু যেটুকু উদ্ধার করা গেলো তা হলো,
‘দুইদিনের জন্য এই বাড়িতে বেড়াতে এসে যে তিনি এমন একটা গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলবেন,আগে সেটা ভাবেননি।
সে আসলে এমনটা করতে চায়নি।কিন্তু হয়ে গেছে আর কি!সে এখন খুবই অনুতপ্ত হেনতেন!”

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো,বিছানায় শুয়ে শুয়ে একদম বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।শরীরে তত জোরও নেই যে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবো।
বালিশের পাশে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে একবার মনে হলো,
‘আচ্ছা,আহিল ভাই কি জানে আমি যে অসুস্থ!জানলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে দৌঁড়ে চলে আসতো পারিবারিক সব ঝগড়া-কলহ ভুলে।
আমি কি জানাবো আহিল ভাইকে?ফোনটা একবার হাতে নিয়েও আবার রেখে দিলাম,’নাহ্,থাক।
জানালেই কি আর না জানালেই কি!’

————————–
পড়ন্ত বিকালে শরীরটা কিছুটা ভালো লাগায়,রনি ভাই আর রাইসা আপু দু’জন মিলে আমাকে জোর করে ছাদের নিয়ে আসলেন।
এখানে গানের আসর বসেছে একটু আগেই।বাসার ছোট বড় সবাই-ই কমবেশি উপস্থিত আছেন এই আসরে।

বিয়ে বাড়ি অথচ সবারই কেমন মনমরা ভাব;এই মনমরা ভাবটা কাটাতেই বাসার ছোটরা মিলে খোলা আকাশের নিচে এই গানের আসরের আয়োজনটা করেছে।

রুমে একা একা শুয়ে থেকে থেকে আমি বোর হবো,তাই রনি ভাইয়ের উদ্যোগই আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।।

তবে একটা জিনিস এবার আমি লক্ষ্য করলাম,বাসার বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই হোক বা অন্য কিছুর জন্য;রাইসা আপু ব্যাবহার আগের চেয়ে অনেক অনেক পরিবর্তন হয়েছে।এখন আর তিনি আগের মতো প্যানপ্যান করছেন না যেকোনো ব্যাপার নিয়ে।উলটো আমাদের সাথে যথেষ্ট মেলামেশা করছেন।
কে জানে হয়তো এবারে উনার মা একটু বেশি বাড় বেড়েছে বলেই উনি হয়তো একটু গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে!

গানের আসর আস্তে আস্তে জমে উঠলো।পারুক বা না পারুক সবাই চেষ্টা করলো তালে তাল মিলিয়ে সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে।
শেষের দিকে রাইসা আপুর একটা গান তো সবাইকে একদম মুগ্ধ করে দিল।রাইসা আপুকে আমরা কখনো গাইতে দেখিনি,উনার মাঝে যে এমন চমৎকার গানে গলা লুকিয়ে ছিল তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।রাইসা আপু চমৎকার করে গাইলেন,

“ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি

আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি

সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে

সেই সুরে বাজে মনে অকারনে
ভুলে যাওয়া গানের বাণী
ভোলা দিনের কাঁদন
কাঁদন হাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি!!

এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি।।”

রাইসা আপুর একক গানটা শেষ হতেই,সবার অনুরোধ আরেকটা গান ধরলেন।
এবারে রনি ভাইও রাইসা আপুর সাথে সুরে সুর মিলালেন।দুজন যখন এক তাল আর লয়ে গান গাইছিলেন,চমৎকার লাগছিল।আকাশে বাতাসে এমন মোহনীয় গানের সুর ভেসে ভেসে বেড়ালো আর আমরা কতগুলো নীরব শ্রোতা চোখ বন্ধ করে উপভোগ করে যাচ্ছিলাম।

অনেকদিন পর চমৎকার একটা সন্ধ্যা পার করলাম আজ।
গানের আসর শেষ হতে হতে রাত প্রায় ৮বেজে গেল।
আমরা শরীরের অবস্থা খুব বেশি ভালো না হলেও মনটা বেশ হালকা লাগছিল।আমার মনে হলো,পরিবারের সকলেরই মনটা আগের চেয়ে কিছুটা ফুরফুরে হয়েছে।
খুশি খুশি মনে সবাই নিচে নেমে এলাম।কিন্তু আমি তখনও জানতাম না সামনে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে!

———————————

রাত ১০টা
একটানা কলিং বেল বেজে যাচ্ছে।আমি আমার রুমে বসেই শুনতেই পাচ্ছি একঘেয়ে এই শব্দ।কিন্তু কি আশ্চর্য!কেউ এখনো দরজা খুলছে না কেন?

শরীর ভালো থাকলে এতক্ষণে আমিই হয়তো উঠে যেতাম।কিন্তু এই মুহুর্তে শরীরটা সায় দিচ্ছে না,উঠে গিয়ে দরজা খোলার।তাই কলিং বেলের শব্দকে ইগ্নোর করে চোখ বন্ধ করে মরার মতোই পড়ে রইলাম।

কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে এভাবে শুয়ে ছিলাম,জানি না।হয়তো ১০/১৫ মিনিট।
হন্তদন্ত করে কেউ আমার রুমে প্রবেশ করেছে বুঝতে পেরেই চোখটা খুললাম।

সাইকা দাঁড়িয়ে আছে;খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে ওকে।
যেনো কিছু বলতে চাইছে আমাকে,আবার ভিতর থেকে বাঁধাও খাচ্ছে;এমনই একটা দুনোমনো ভাব নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে ও আমার দিকে।

আমি কিছু না বলে শুধু অপেক্ষা করতে লাগলাম,কখন ও দ্বিধাবোধ কাটিয়ে উঠে আমাকে বলবে যে কি হয়েছে।
কিন্তু দেখলাম ও কিছু না বলেই আবার চলে যাচ্ছে রুম ছেড়ে।

–সাইকা?

ক্ষীণ স্বরে এবারে ডাক দিলাম আমি।উঠতে চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না।শরীরটা বেশ দূর্বল লাগছে।
সাইকা আমার ডাক শুনে পেছনে তাকিয়ে দৌড়ে আসলো আমার কাছে।আমাকে ধরে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ইআমাকে আধশোয়া করে দিয়ে, তারপর আমার পাশে বসলো।
সাইকার চোখে তাকিয়ে দেখলাম,সেখানে স্পষ্টতঃই এখনো দ্বিধা-দ্বন্ধরা খেলা চলছে।আমি ওর হাতটা ধরে একটা চাপ দিয়ে কিছুটা আশ্বস্ত করলাম ওকে।

–তুই কি কিছু বলতে চাস সাইকা?আমি জানি,তুই ইম্পোর্ট্যান্ট কিছু বলতে চাইছিস। আবার কি ভেবে না বলেই চলে যেতে চাইছিস।
তোর হাবভাব আমি বেশ ভালো করেই বুঝি।এবার ভণিতা না করে সরাসরি বলে ফেল কি বলতে আসছিলি?

সাইকা আমার দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে বললো,

–আহিল ভাইয়ারা এসেছে!বিয়ের সমন্ধ নিয়ে।

–আহিল ভাইয়ারা এসেছে!বিয়ের সমন্ধ নিয়ে!
কিন্তু আমি তো বিয়ে ক্যান্সেল করে দিয়েছিলাম।

এই বিয়েতে আমি এতোভাবে নিষেধ করার পরেও ‘আহিল ভাইরা আবার এসেছে আমার বিয়ের সমন্ধ নিয়ে’ এই কথাটা সাইকার মুখ থেকে শুনে এবার আর কেনো জানি আমার একদম রাগ লাগলো না।
বরং মনের ভিতর কেমন একটা অনুভূতি দোল খেয়ে গেল,যেনো আমি এটাই চাইছিলাম বহুকাল ধরে!

কিন্তু আমার সমস্ত চিন্তা-চেতনাকে একদম গুড়িয়ে দিয়ে সাইকা আগের মতাই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,

–তোর জন্য না তনয়া!রাইসা আপুর জন্য!

–কিহ্!

–হ্যাঁ, সোহেলী খালামনি আর ছোট ফুপি-ফুপা নিজেদের মধ্যে ফোনে কথা বলে সব কিছু ফাইনাল করে ফেলেছেন আজকেই।তিন্নি আপুর বিয়ে যেদিন,সেদিনই আহিল ভাইয়া আর রাইসার আপুর বিয়ে হবে।এখন মিষ্টি নিয়ে এসেছেন,সবাইকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন।
রাইসা আপুও খুব খুশি। আর বাসার সবাইও খুশি।যাক আহিল ভাইয়া তাহলে তোর পিছু ছেড়েছে ।
আবার এদিকে আহিল ভাইয়া আর রাইসা আপুর বিয়ে হলে,আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটাও আগের মতো হয়ে যাবে।
সবাই খুব খুশি….

সাইকার শেষের দিকের কথাগুলো একটাও আমার কানে ঢুকেনি।কানটা যেনো তালা লেগে গেছে আমার।

খুশির সংবাদটা শুনিয়ে সাইকা চলে যেতেই আমি রুমের লাইটটা অফ করে দূর্বল শরীর নিয়ে দরজার পর্দার আড়ালে থেকে ড্রয়িং রুমের দিকে নজর দিলাম।
একদম কোণাকুণি যে সোফাটা দেখা যাচ্ছে,ঠিক সেটাতেই আহিল ভাইয়া আর রাইসা আপু পাশাপাশি বসে আছেন।কি সুন্দর লাগছে তাদের!রাইসা আপু একদম বউয়ের মতো করে সেজেছেন।
পাশে আহিল ভাইয়া,কালো প্যান্টের সাথে মেরুন রঙের স্ট্রাইপ করা শার্ট ইন করে পড়েছেন।হাতে সিলভার রঙের বাহারী ঘড়িটা চকচক করছে।ফ্যানের বাতাসে উনার সামনের ঘন লম্বা চুলগুলো তিরতির করে উড়ছে।

কিন্তু…
কিন্তু আমার এমন লাগছে কেন!আমার মনে এতো অশান্তি লাগছে কেন!আমার তো সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা কারণ আহিল ভাই যে আমার পিছু ছেড়েছে।

কিন্তু আমি আমি মেনে নিতে পারছি না,একদম মেনে নিতে পারছি না আহিলের পাশে রাইসাকে!আহিলের পাশে তো আমিও থাকতে পারতাম আজকে!

কাল সন্ধ্যায়ও যে মানুষটা পইপই করে বলে যাচ্ছিল,সে আমায় ভালোবাসে!একরাতের ব্যবধানেই সেই মানুষটা কীভাবে নিজের পাশে আরেকটা মেয়েকে বসিয়ে ফেলতে পারে!আমাকে কি তাহলে নিজের জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে আহিল ভাই!আসলেই কি রোবটের চেয়েও বেশী রোবটে পরিণত হয়ে গেছেন তিনি এই একরাত্রে!

এই প্রথমবারের মতো আহিল ভাইয়ের জন্য আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।এক অন্যরকম টান আমি অনুভব করছি।আহিল ভাইয়ের পাশে অন্য মেয়েকে দেখে একটা বোবা কষ্ট অনুভূত হচ্ছে বুকে।
তবে কি আমিও ভালোবাসি আহিল ভাইকে!

কিন্তু এখন কি হবে!বিয়ে যে ঠিক হয়ে গেছে তার অন্য কারো সাথে।ঐ তো সবাইকে কত হাশিখুশি দেখাচ্ছে।এই বিয়েতে তো সবাই খুশি!

ঐ তো দেখতে পাচ্ছি পাকা কথা শেষ করে সবাই উঠে দাঁড়াচ্ছে হাসিমুখে।আহিল ভাই আব্বুর সাথে করমর্দন করছেন,একটু পরেই হয়তো বেরিয়ে যাবেন।

আচ্ছে উনি এদিক সেদিক তাকিয়ে কাকে খুঁজছেন?আমাকে খুঁজছেন?আমার কথা কি আদৌ মনে আছে তার?নাকি রাইসাকে নিয়ে মনের শহরে ঘর বেঁধে ফেলেছেন!রাইসা আপুই আজ থেকে আহিল ভাইয়ার সব তাহলে…….!

আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক মুহুর্তের মধ্যে এতসব এলোমেলো চিন্তাগুলো আর নিতে পারলো না।

এই মুহুর্তে ড্রয়িং রুমে থাকা হাসিখুশি এই পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের অগোচরে, একটি অন্ধকার রুমে, বুকে পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো এই পরিবারেরই সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটি…..।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here