#কোনো_এক_বসন্তে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৮
ড্রয়িং রুমের হাসিখুশি এই পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের অগোচরে একটি অন্ধকার রুমে, বুকে পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো এই পরিবারেরই সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটি…..।
—————————–
পরদিন যখন জ্ঞান ফিরলো, নিজেকে আবিষ্কার করলাম কোনো এক হসপিটালের অপরিচিত একটা কেবিনে।
সময়টা হয়তো মধ্য দুপুর।
আমার জ্ঞান ফিরতে দেখেই একজন নার্স গিয়ে বাহিরে খবর দিল।ডাক্তার এসে চেক-আপ করে গেলেন একবার।
ডাক্তার যাওয়ার পরপরই একে একে আব্বু,তিন্নি আপু,বড় ফুপি,রনি ভাইয়ার,ছোট ফুপা এসে আমার সাথে দেখা করে আবার বাহিরে চলে গেলেন।
শুধুমাত্র আম্মু একাই কেবিনের ভিতরে আমার পাশে থেকে গেলেন।একই সাথে অনেক মানুষের উপস্থিতি আ্যলাউ করছেন না নার্স।
সবশেষে আয়রাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন আহিল ভাই!আহিল ভাইকে দেখেই আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো।
একই সাথে অসম্ভব রকম ভালো লাগা,অন্যদিকে আহিল ভাইয়ের প্রতি বুক ভর্তি অভিমান জমা হওয়ায় মনের ভিতর অদ্ভুত একটা মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হলো তাকে দেখে।
ভিতরে ঢুকতেই আয়রা দৌড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমার কাছে,
–আপ্পি,আপ্পি তোমার কি হয়েছে?তুমি সেন্সলেস কেন হয়ে গিয়েছিলে?তুমি কি অনেক অসুস্থ? তুমি কবে আবার সুস্থ হবে?
আমি আয়রার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না।শুধু একটু মুচকি হেসে আমার দূর্বল হাতটা টেনে টেনে তুলে আলতো করে আয়রার গালটা ছুয়ে দিলাম।
আমার সাড়া পেয়ে আয়রা আবারও বলে যায়,
–আপ্পি জানো,আর কিছুদিন পরে যে আমার ভাইয়ার বিয়ে!তুমি কি বিয়েতে থাকবে না?তুমি বলেছিলে না,তুমি আমার ভাবী না হলেও আরেকটা ভালো ভাবী আসবে আমার?
রাইসা ভাবী অন্নেক ভালো,আমাকে অনেক আদর করে!
আমি খুব কষ্ট করে আবারও মুচকি হাসলাম,তারপর হাতটা আলগোছে সরিয়ে নিলাম আয়রার উপর থেকে।
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আহিল ভাইয়ের চোখে চোখ পড়তে উনি উনার দৃষ্টি নত করে নিলেন সাথে সাথেই।
আম্মু আয়রাকে সাথে করে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই আহিল ভাই এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন।কিছুটা এগিয়ে এসে পকেট থেকে হাতটা বের করে নির্দ্বিধায় সেই হাত আমার কপালে ছুয়িয়ে দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা অনুভব করলেন।
–এখন কেমন লাগছে?
–ঠিক আছি,আহিল ভাই।
–শরীরের এই হাল করলি কিভাবে?পরশুদিনও তো সব ঠিকঠাক ই ছিল দেখলাম।
আমি কোনো জবাব দিলাম না আহিল ভাইয়ের প্রশ্নের।নীরবে ঘাড়টা কাত করে অন্য পাশের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম।
আমি কি-ই বা জবাব দিতে পারি,আহিল ভাইকে!আসলেই তো আমার শরীরের এই হাল হলো কেন!কিসের জন্য আমি মানসিক ভাবে এতোটা ভেঙে পড়েছি?কেন?কোনো উত্তরই তো জানা নেই আমার।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আহিল ভাইই আবার কথা বললেন,
–তুই খুশি তো, তনু?
আহিল ভাইয়ের প্রশ্নে এবারে ঘাড় ফিরিয়ে সরাসরি তাকালাম উনার দিকে।
একবার অবাক হয়ে বলতে ইচ্ছে হলো,
‘কি ব্যাপারে খুশি হবো?’
কিন্তু প্রশ্নটা করতে গিয়েও করতে পারলাম না।কোনো একটা অব্যক্ত কষ্ট যেনো আমার গলা চেপে ধরলো।আহিল ভাই কি প্রসঙ্গ ইঙ্গিত করে প্রশ্নটা করেছেন তা বুঝেও না বুঝার ভান করার মতো এই ন্যাকামিটা করতে মন সায় দিল না।
শুধু বললাম,
–হুম খুশি!
আহিল ভাইয়ার দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছিলাম,তিনি আমার দিকেই চেয়ে ছিলেন একটানা, আম্মু আসার আগে পর্যন্ত যতটা সময় রুমে ছিলেন।
আর আমি চেয়েছিলাম অন্যদিক।
আমার বারবার মনে হচ্ছিল,উনার চোখে চোখ পড়লেই বুঝি উনি আমার ভিতরটা পড়ে ফেলবেন!আমার মনে জন্ম নেওয়া সদ্য কোনো দূর্বলতা উনার চোখে পড়ে যাবে!
সেই ভয়েই অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে উনার দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করছিলাম।
——————————
হঠাৎ করেই যেমন অসুস্থ হয়ে গেছিলাম আবার হঠাৎ করেই যেনো সুস্থ হয়ে উঠলাম।
জ্বর ছেড়ে গেছে আরও আগেই,শরীরটাও বেশ ঝরঝরে লাগছে।
সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে,হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দিয়েছে আমাকে।বাসায় নিয়ে শুধু রোগীকে একটু প্রোপ্রার কেয়ারে রাখতে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার সাহেব।
এই মুহুর্তে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় আছি আমি,আম্মু,সোহেলী খালামনি আর আয়রা।
সোহেলী খালামনিও শেষের দিকে চলে এসেছেন হাসপাতালে আমাকে দেখতে। আদরের তনয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে,এই খবর তাকে আর বেঁধে রাখতে পারেনি বাসায়।
এদিকে আসার পরে আম্মুর সাথেও অনেকটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে তার।দুই বান্ধবী মিলে দিব্যি গল্প করছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েএতো অল্প সময়েই সব রাগ অভিমান ভুলে,তাদের মধ্যে আগের মতোই আন্তরিকতা দেখতে পাচ্ছি।দেখে বেশ ভালোই লাগলো।
আহিল ভাই গেছেন পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে।আমরা উনার জন্যই অপেক্ষা করছি এখন।
বাসার অন্য সবাই একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন হাসপাতাল থেকে,ডেকোরেশনের লোকেদের কল পেয়ে।
আজ রাত থেকেই ঘরবাড়ি সব সাজানো হবে যে।
পরশু হলুদের অনুষ্ঠান আর তার পরদিন বিয়ে!
মাঝখানে হাতে সময় আর মাত্র একদিন।
একই আসরে দুই দুইটা বিয়ে বলে কথা!ইতিমধ্যে সবার এক্সাইটমেন্ট যেনো অনেক অনেক বেড়ে গেছে।
————————–
কথা ছিল হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পথে আহিল ভাইয়া তার আম্মু আর আয়রাকে নিজেদের বাসায় ড্রপ করে দিবে।তারপর আমাকে আর আম্মুকে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়্র সেখানে থেকে আবার নিজের বাসায় ব্যাক করবেন।
কিন্তু আহিল ভাইয়াদের বাসা আসার আগেই আম্মু,খালামনি আর আয়রা একটা মার্কেটের সামনে নেমে গেলেন।
তারা বিয়ের জন্য কিছু শপিং আজ রাতেই করে রাখতে চাইছেন,হাতে মাঝখানে আর একদিন সময় আছে কি না তাই।
আমি শুধু নীরব দর্শকের মতো চুপচাপ দেখে যাচ্ছি এই আড়ম্বর।
খালামনিরা নেমে যেতেই কিছুটা দূরে গিয়ে হার্ড ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ফেলেন আহিল ভাই।পিছনে ফিরে বললেন,
–সামনে চলে আয় তনু।
–না,আমি এখানেই ঠিক আছি।
–আরেহ্ আয়।চিন্তার কারণ নেই,তোর রাইসা আপু তো আর দেখছে না!
হাহাহা!
আহিল ভাইয়ার মুখে রাইসা আপুর নাম শুনে মনটা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেও নিজেকে সংযত রাখলাম যতটা পারা যায়।কথা না বাড়িয়ে সামনে গিয়ে বসতেই আহিল ভাইয়া গাড়ি স্ট্রার্ট দিলেন।
সন্ধ্যা প্রায় পার হয়ে গেছে আরও আগেই।তবুও আকাশে যথেষ্ট আলো রয়েছে,রক্তিম আকাশ।জানালার কাঁচটা নামানো,ঝিরিঝিরি মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।
ফাঁকা হাইওয়ে,ক্যাসেট প্লেয়ারে পুরনো ধাঁচের একটা হিন্দি গান চলছে অল্প সাউন্ডে।সব মিলিয়ে চমৎকার একটা আবহাওয়া।
হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম,জায়গাটা যেনো কতকটা শুনশান।শহরের অলিগলি,ট্রাফিক লাইট,গাড়ির হুইসেল কিছুই টের পাচ্ছি না।
আসলেই তো!ভালো করে চারপাশটা চেয়ে দেখলাম,এটা তো সম্পূর্ণই অপরিচিত একটা রাস্তা।
আহিল ভাই আবার কখন শহরের মেইন রাস্তা রেখে এই শাখা পথে নেমে এলো,খেয়ালই করলাম না!
অবাক হয়ে আহিল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই,উনি সামনের রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ড্রাইভিং করতে করতেই জবাব দিলেন,
–ঘুরে আসি কিছুটা দূর…কি বলিস?
এবার চলে গেলে,আবার কবে দেশে ফিরি তার তো কোনো ঠিক নেই!
আমি আনমনেই দূর্বল একটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম,
–বাসার সবাই চিন্তা করবে।
–তুই আহিল এর সাথে আছিস,এটা সবাই জানে।আর আহিল সাথে থাকতে তোর কোনো ক্ষতি হবে না সেটাও সবাই জানে, তনু।
এতো চিন্তা না করে ওয়েদারটা এনজয় কর,তোর শরীরের জন্য ভালো হবে।
দীর্ঘক্ষণ নীরবতা…
গভীর মনোযোগ সহকারে স্লো স্পীডে একটানা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন আহিল ভাই।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে,গাড়ি চালানো ব্যতীত এই মুহুর্তে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই বুঝি পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই।
বরাবরের মতোই উনার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই,মনে কি চলছে।
কিন্তু আমি এদিকে ভাবছি,আহিল ভাইয়ের এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ কি!সেদিন সন্ধ্যায় আমার প্রতি উনার যে অনুভূতি,তা যতটা আবেগ দিয়ে বর্ণনা করেছিলেন আমার একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না সেই আবেগে কোনো খাদ ছিল।তবে?
তবে কি মানুষ এতো সহজেই পরিবর্তন হয়ে যায়!১৫বছরের সুপ্ত ভালোবাসাকে ভুলতে ১৫ঘন্টাও লাগে না!এটাকে কি আদৌ ভালোবাসা বলে?আহিল ভাই কি সত্যিই ভালোবেসেছিলেন আমায়?যদি বা বেসেই থাকেন তাহলে কিভাবে অন্য একটা মেয়েকে এতো সহজেই মেনে নেন!
আহিল ভাইয়ের এই পরিবর্তন আমি মেনে নিতে পারছি না।নাহ্ একদম মেনে নিতে পারছি না।
আচ্ছা আমি কি চাই?আমি এখন ঠিক চাই?ভেবে দেখলাম,আমি কি চাই তা তো আমি নিজেও এখনো জানি না।
অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে যেনো হুহু করে শীতও বেড়ে চলেছে।একটা সময় আহিল ভাই গাড়ির কাঁচ দুটোও তুলে দেন।
এক পলক আমার দিকে চেয়ে আবার হেডলাইটের আলোয় সামনের পিচঢালা রাস্তার দিকে নজর দেন তিনি।একটু পরেই ইতস্তত করে বললেন,
–তনু,তুই কি কিছু বলতে চাস আমাকে?
আহিল ভাইয়ার কথায় আমার ভাবনাগুলো কিছু সময়ের জন্য থমকালো।পরক্ষণেই আবার আমার একান্ত নিজস্ব এই ভাবনাগুলো মনের ভিতর উথাল-পাতাল ঝড় শুরু করে দিল,মন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।
আহিল ভাইয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রকার উত্তেজিত হয়েই যেনো বলে বসলাম,
–মানুষ এতো দ্রুত চেঞ্জ হয়ে যায় আহিল ভাই!যা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে এই দুই একদিনের মধ্যে এটাও কি সম্ভব?
আহিল ভাই আমার কথার মর্মার্থ বুঝেই যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।শান্ত কণ্ঠে বললেন,
–যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলাই কি শ্রেয় না তনু?
আরেকটা কথা কি জানিস?আমার মায়ের কোনো কথা না আমি ফেলতে পারি না।মা চেয়েছিলেন তোকে তার ছেলের বউ করে ঘরে আনতে।এটা তার এক কিংবা দুই দিনের শখ ছিল না রে তনু,অনেক বছরের ইচ্ছে ছিল।কিন্তু সেটা তো উনার কপালে ছিল না।
আমিও আমার মায়ের জন্য কিছুই করতে পারলাম না।
সেই ধাক্কা আমি বা আমরা কিভাবে কাটিয়েছি বা এখনো কাটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি সেইদিকে না হয় নাই বা গেলাম।
মা এখন চাইছেন,যেনো আমি রাইসাকে বিয়ে করি।
এইটুকু বলেই থেমে গেলেন আহিল ভাই।আর একটা কথাও বললেন না তিনি এই ব্যাপারে।
শুধু ছোট্ট করে একটা ‘ওহ্’ বলে থেমে গেলাম আমিও।
মনের মধ্যে অনেক কথাই যেনো আঁকুপাঁকু করছে এই মুহুর্তে আহিল ভাইকে বলার জন্য;কিন্তু বলতে পারছি না কিছুই।
শুনেছিলাম,ছোটদের আত্মসম্মানবোধটা নাকি একটু বেশিই তীক্ষ্ণ হয়ে,আজ তা হারে হারে টের পাচ্ছি আমি।
কিছুদিন আগেই যাকে বিয়ে করবো না বলে এতোসব কান্ড করলাম।দুইদিন পরই তার অন্য কারো সাথে বিয়ে হবে শুনে এই মুহুর্তে কি তোকে কষ্ট পেলে মানায় তনয়া?
নাহ্,মানায় না।
মনকে শান্তনা দিলাম,
“আমি ঠিক আছি,একদম ঠিক আছি।হুম,একদম পারফেক্ট।”
কিন্তু তবুও অনুভব করলাম,অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানেই একটু আগের রোমান্টিক পরিবেশটা যেনো একটা বিষাক্ত বেড়াজালে পরিণত হয়েছে আমার জন্য।যেখান থেকে বের হতে না পারলে আমার মনে হচ্ছে, আমি এখনি দম আটকে মারা যাব।
দৃঢ় কন্ঠে আহিলকে আদেশ দিলাম,”গাড়ি ঘুরান,আমি বাসায় যাব!”
এই অসম্ভব শীতল ও কঠিন আদেশ অমান্য করার সাহস হয়তো হতভম্ব আহিলের ছিল না;সে সাথে সাথে গাড়ি ঘুরালো।
বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামার আগে কি মনে করে আরও একবার অত্যন্ত শীতল কন্ঠে এই মানুষ আমার কাছে জানতে চাইলো,
–কিছু বলতে চাও আমাকে তনু?
আমার পক্ষ থেকে তদুপেক্ষা শীতল কন্ঠে উত্তর এলো,
–কই নাহ্ তো!
———————————-
রাত এখন কত হবে,২টা কি ৩টা!
টেবিল ঘড়িটার ব্যাটারি ডেড হয়েছে আরও বেশ কিছুদিন আগে,এখনো নতুন ব্যাটারি লাগানো হয়নি।
আমার ফোনটা এই মুহুর্তে কোথায় আছে তাও আমার জানা নেই।হাসপাতালে থেকে বাসায় ফেরার পর ফোনের খোঁজ নেওয়া হয়নি আর।
অবসন্ন দেহ নিয়ে পড়ে আছি বিছানার সাথে গা মিলিয়ে;চোখে এক ফোটাও ঘুম নেই।
সময়রা কত দ্রুতই না চলে যায়!এই তো এই রাতটা পার হলেই আর একটা রাত!তারপর গায়ে হলুদ,পরদিন বিয়ে।
আর এরপর থেকেই আমি হারিয়ে ফেলবো এমন একজনকে যাকে আপন করার আগেই দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম।
রাতের নির্জনতাকে ভেদ করে ডেকোরেশনের লোকেদের খুটখাট আওয়াজ কানে ভেসে আসছে।মাঝেমাঝে রনি ভাইয়ের দুই-একটা হাঁকডাকও শোনা যাচ্ছে।
বাড়ির প্রতিটা প্রানীই হয়তো আসন্ন দুই-দুইটা বিয়ের উত্তেজনায় ঘুমাতে না পেরে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে, এক আমি বাদে!
আচ্ছা আহিল ভাই এখন কি করছে?
এইতো ড্রয়িং রুমটা পার করলেই তো আহিল ভাইয়ের রুম!আমি কি গিয়ে একবার দেখে আসবো আহিল ভাইকে!
আহিল নামক মানুষটাকে দেখার তৃষ্ণাটা যেনো হঠাৎ করেই খুব করে পেয়ে বসলো আমাকে।যেনো এই মুহুর্তে মানুষটাকে না দেখলেই নয়।
উঠে গিয়ে আগে খুঁজলাম,আহিল ভাইয়ের ফটোটা যেটা আমি দুইদিন আগেই চুপিসারে নিয়ে এসেছিলাম
আমার কাছে।
ফটোটা কোথাও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে পা বাড়ালাম জলজ্যান্ত মানুষটাকেই দেখার উদ্দেশ্যে।
রাতে যখন আহিল ভাইয়ের সাথে বাড়ি ফিরে এলাম,তখন আম্মু আর খালামনি অলরেডি শপিং করে চলে এসেছিলেন।মার্কেট থেকে রনি ভাই উনাদের পিক করে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাসায়।
খালামনি অপেক্ষা করছিলেন,আহিল ভাই আসলে একসাথে নিজেদের বাসায় ফিরবেন।
কিন্তু শেষমেশ আর তাদের বাসাত ফেরা হলো না সবার জোড়াজুড়িতে।
এমনিতেও একদিন পরে হলেও তো এই বাসায় আসাই হতো,নাহয় একরাত আগেই থেকে গেলেন।
———————————
বাহিরের রুমের সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে একপ্রকার চুপিসারে দ্রুত পায়ে এসে হাজির হলাম আহিল ভাইয়ের রুমের সামনে।
রুমে যাব কি যাব না,ভাবতে ভাবতেই কেউ আমাকে দেখে নেওয়ার আশঙ্কায় দরজায় একটা ধাক্কা দিয়েই বসলাম।
দরজাটা ভেজানো ছিল,ধাক্কা দিতেই হালকা শব্দ করে আলগোছে খুলে গেল।
রুমে ঢুকে দরজাটা ভিতর থেকে চাপিয়ে দিয়ে রুমের সমস্তটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম একবার।এই রুমটা তার কিছুদিনের অস্থায়ী সেই মালিককে ফিরে পেয়ে যেনো আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে আজ।
সবুজ ডীম লাইটের আলোতে বেশ উজ্জ্বল লাগছে ঘরটা।
কিন্তু রুমের কোথাও তো আহিল ভাই নেই,ওয়াশরুমেও লাইট জ্বলছে না।নিশ্চয়ই তাহলে ব্যালকনিতে!
আমাকে দেখে আহিল ভাইয়ের রিয়েকশন কি হবে?খুশি হবেন?নাকি আমার অপ্রত্যাশিত আগমনে বিরক্ত হবেন!
একপা দু’পা করে ব্যালকনির দিকে এগুতেই আহিল ভাইয়ের দেহটা আমার চোখের সামনে প্রতীয়মান হয়ে উঠলো।
একটা চেয়ারে বসে আছেন তিনি;কিন্তু তিনি একা নন,মনে হচ্ছে সাথে কেউ আছে।
কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরেই আরেকটু এগিয়ে উঁকি দিলাম,রাইসা আপু!রাইসা আপু বসে আছেন আহিল ভাইয়ের মুখোমুখি একটা চেয়ারে।
এই নির্জন রাত্রিরে রাইসা আপু আর আহিল ভাইয়া দুই হবু দম্পতি যেনো একান্তই নিজেদের একাকী সময় কাটাচ্ছিলেন। আর আমি বড় অসময়েই অস্থানে যেনো আগমন করে ফেলেছি,এভাবেই চমকে উঠলাম তাদের দুজনকে একসাথে দেখে।
একপা দুপা করে আবার পিছনে সরে আসলাম।মনের মধ্যেকার থাকা সকল দুর্বোধ্য কষ্টগুলোকে একযোগে দলা পাকিয়ে গলার কাছ পর্যন্ত আটকে আছে যেন!
আমি পিছনে ফিরলাম,নাহ্ এখানে থাকা যাবে না।এখনিএখান থেকে ফিরে যেতে হবে।
কিন্তু বড্ড তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি যে কৌতুহলের বশে!উঁকি দিয়ে রাইসা আপুকে দেখতে গিয়ে আমার শরীরের ছায়া যে রাইসা আপুর বিপরীত দিকের মানুষটার উপরে গিয়ে কখন পড়েছে তা খেয়াল করিনি।
ঝড়ের বেগে আহিল ভাইয়ের রুম থেকে বের হবার সময় রনি ভাইয়ের সাথে ধাক্কা খেলাম।রনি ভাইও মাত্রই আহিল ভাইয়ের রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলেন।আমাকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে বের হতে দেখে প্রথমে তিনি চমকালেন।তারপর খপ করে আমার হাতটা ধরে জানতে চাইলেন,
–কি হয়েছে তনয়া?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই পিছু পিছু সেখানে হাজির হয়ে গেলেন আহিল ভাই।
আহিল ভাইয়ের উপস্থিতিতে আমি জোর করে রনি ভাইয়ের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলাম সেখান থেকে আমার রুমের উদ্দেশ্য ।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রনি ভাইয়ের কাঁধে একটা চাপ দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে আহিল ভাইও ছুটে আসছেন আমার পিছু পিছু,
–তনু শোন,তনু আমার কথাটা তো শোন।
তনু ভুল বুঝিস না….
রুমে এসে দরজাটা আটকানোরও সুযোগ পেলাম না,আহিল ভাই এসে ঢুকে গেছেন রুমে।
রাইসা আপু আর আহিল ভাইকে একসাথে দেখে আমার বুকের ভিতরটা এতক্ষণে সমুদ্রের চরম ঢেউয়ের মতো আছড়ে আছড়ে ভেঙে চূরমার হয়ে যাচ্ছিল।
হয়তো আমার মন আস্তে আস্তে মেনে নিত,রাইসার সাথে আহিলের বিয়ে,টান,ভালোবাসা!
কিন্তু সদ্য আমার মনে জন্ম নেওয়া আহিল ভাইয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ,এতো অল্প সময়েই আমার মনকে এই দৃশ্যটা নিতে প্রস্তুত করেনি করেনি।
দুজন ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে গল্প করা, এটা হয়তো কোনো অস্বাভাবিক সীনারি নয়।
কিন্তু রাত্রির এই প্রহরে জোৎস্নার আলোয় দুজন নর-নারী পাশাপাশি বসা, যাদের আর দুদিন পরেই বিয়ে,তারা একে অপরের সাথে মধুর আলাপ ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারে।
কিন্তু তাতে আমার কি!আমার এতো লাগছে কেন?আমার হৃদয়টা এমন পুড়ছে কেন।
আহিল ভাই তো বলেছিল,সে আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমাকে ইগ্নোর করে যখন রাইসা আপুর সাথে বসে গল্প করছে,সেটা আমি নিতে পারছি না কেন?কেন?কেন?
আহিল ভাইয়ের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচার একটা বৃথা চেষ্টা করতেই হয়তো আমার রুমের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিটাতে চলে যাই এক দৌঁড়ে।
আর পারছি না,আর পারছি না নিজেকে শক্ত রাখতে।রেলিঙ ধরে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে হুহু শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি।
তনয়ার অল্পবয়সী চঞ্চল এই হৃদয়ের জমে থাকা কষ্টের বরফ পাহাড় গুলো যেনো অবশেষে গলে গলে পড়তে শুরু করলো এই কান্নার সাথে।
কান্নার দমক আরও বেড়ে গেল যখন অনুভব করলাম গত দুইদিনে যে মানুষটির জন্য অন্যরকম একটা টান অনুভব হয়েছে হৃদয়ে, সেই মানুষটিই রেলিঙের উপর রাখা আমার হাতের উপর নিজের দুহাত রেখে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে!
কান্নার মাঝেই আহিল ভাইয়ের দেহের এতো গভীর আর এতো বাস্তব স্পর্শে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল আমার দেহের মেরুদণ্ড বেয়ে।
কি আছে এই স্পর্শে!আগে কেন অনুভব করতে চাইনি আমি এই স্পর্শ! ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে যে খুব….।
আস্তে আস্তে গায়ের ভর পিছনে থাকা মানুষটির উপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতেই এবার আহিল ভাই রেলিঙের উপরে থাকা নিজের হাত দুটো সরিয়ে নিজেকে স্ট্রং করে দাঁড় করিয়ে অবশেষে আমাকে সামলে নিল।
আমাকে ঘুরিয়ে আমার দুই বাহুতে হাত রে মুখোমুখি দাঁড় করালো…
কোনাকুনি হয়ে রুমের আলো এসে পড়ছে আমার মুখে।আমার দৃষ্টি নত হয়ে আসলো,চেয়ে দেখতে পারলাম না আহিল ভাইয়ের মুখ পানে।
আহিল ভাইয়ের একদম সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রতিটা মুহুর্তে মুহূর্তে আমার দু’চোখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে নোনাজলে।এলোমেলো হাতে সেগুলো মুছে যাচ্ছি বারবার আর দাঁতে ঠোঁট চেপে কান্নাগুলোর শব্দ রোধ করে যাচ্ছি।
এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে একই দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় খুব জোড়ে একটা ঝাঁকুনি দেয় আহিল ভাই আমাকে।
আমি চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হই এবার মানুষটির দিকে।
তৃষ্ণার্ত কাক যেভাবে দূর্লভ শেষ এক ফোঁটা পানির দিকে চেয়ে করুণ কন্ঠে কা কা করে উঠে, আহিল ভাইও তেমিন তৃষ্ণার্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে করুন কণ্ঠে বলে উঠেন,
–তনু,কিছু বলতে চাস আমাকে?
–……………..
–তনু!
–“ভালোবাসি আহিল ভাই আপনাকে!”
আমার সকল দম্ভ,অহংকার,দ্বিধা-দ্বন্দ,জড়তা,আত্মমর্যাদাবোধকে গুড়িয়ে দিয়েই আমার ভিতরকার একটা লুকায়িত মন কথাটা বলে ফেললো।
মন বলছিল,এটাই শেষ সুযোগ!আজ না বললে আর কোনোদিনই কিছু হবার নয়!
আমার সেই মহাবাক্যটা শেষ হতেই আহিল ভাইয়ের অবিশ্বাস্য কন্ঠ আমার কানে আসে,
–কি বললি তনু?আবার বল?বল?আবার বল!
–“ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি আহিল ভাই আমি আপনাকে!”
বলতে বলতে বাঁধ ভাঙা কান্নারা যেনো উপচে পড়ে আমার দুচোখ বেয়ে।
জোয়ারের সেই ধাক্কা সামলাতেই যেনো আচমকা আমাকে খুব শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আহিল ভাই!উনার বুকের হৃদস্পন্দন পর্যন্ত স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম যেনো আমি।
রাইসার পরবর্তী এই মুহুর্তে আমি আহিল ভাইয়ের সামনে!আমি আহিল ভাইকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে খোলা আকাশের নিচে রাত্রির শেষ প্রহরে প্রেমের মধু আস্বাদন করছি!পাছে স্বপ্ন নয়তো!
কানের কাছে কারো ফিসফিস আওয়াজ ভেসে আসতে বুঝলাম,নাহ্ যা ঘটছে তা বাস্তব;কোনো স্বপ্ন নয়।
আহিল ভাই খুবই মৃদু সুরে অনুরোধ করছেন আমায় আরেকবার ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলার জন্য!
এরই মাঝে আমি কিছুটা স্থির করে নিয়েছি নিজেকে,।মাথাটা উনার বুকের কাছ থেকে একটু সরিয়ে উনাকে দেখার চেষ্টা করতেই আহিল ভাইয়ের গালের নিচের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো কপালে অনুভব করলাম।
আমার নড়াচড়া অনুভব করতেই আহিল ভাই নিজেই এবার উনার মুখটা একটু পিছনে সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন।সেই সাথে আমাকেও সুযোগ করে দিলেন উনার চোখে চোখ রাখার ।
চোখের নিচে সদ্য শুকানো নোনাজলের আঠার সাথে আটকানো দুইচারটা অবাধ্য চুল গাল থেকে সরাতে সরাতে আহিল ভাই আবারও বলে উঠেন,
–কি হলো?বলো আরেকবার!
–কিন্তু…কিন্তু এখন তো কিছুই ঠিক হবার নয় আহিল ভা…!
–সশশ
নিজের ঠোঁটে নিজেই আঙুল তুলে ইশারায় আমাকে থামিয়ে দেয় আহিল ভাই।
প্রথমে উনার ঠোঁট আর আঙুলের দিকে চেয়ে পরে প্রশ্নবোধ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাতেই। উনি বলেন,
–ভাই না!শুধু আহিল…..!
–কিন্তু আহিল ভাই,এখন তো আর কিছু করার নাই।আমি যে বড্ড দেরী করে ফেলেছে……!
–সশশ…
চুপ,বাকীটা আমি দেখবো!
আবারও থামিয়ে দেন আমাকে আহিল ভাই।একটাও বাড়তি কথাও বলতে দিতে চাইলেই না আমাকে একদমই।যেনো কথা বললেই এই মধুর মুহূর্তটা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে!
আগের মতো অত আষ্টেপৃষ্টে না থাকলেও খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে মুহুর্তের পর মুহূর্ত নিঃশব্দে পার করে দিতে লাগলাম দু’জন ।
খুব কাছ থেকে আজ লক্ষ্য করলাম,আয়রার মতো আহিল ভাইয়ের ঠোঁটের নিচেও লালচে একটা ছোট্ট তিল আছে।এই তিলটাই আমি সমুদ্রের পাড়ে তোলা ছবির আহিলের ঠোঁটের নিচে প্রথম বারের মতো আবিষ্কার করেছিলাম।
নাকে আসছে আহিলের শরীরের অন্যরকম একটা মাদকময় পুরুষালী স্মেল,যা আমাকে মাতাল করে তুলতে চাইছে ক্ষণে ক্ষণে।
ফজরের আজানের সুর কানে আসছে।
ইশশ মুহুর্তগুলো এতো দ্রুত চলে যায় কেন….!
#চলবে