গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে ২ পর্ব ২০+২১

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০ (২য় খণ্ড)

অশ্রুতে টইটম্বুর হলো রাগিনীর দুটো চোখ। তা গাল বেয়ে থুঁতনিতে গিয়ে থেমে ফট করেই গিয়ে পড়ে রিও-এর গায়ে। রিও মাথা উঠিয়ে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে উঠে তার সামনের এক পায়ের দ্বারা রাগিনীর গালে হাত রাখল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রাগিনী রিওকে জড়িয়ে। এই কান্না সুখের, আনন্দের। বহুল প্রতীক্ষিত ছিল এই মূহুর্ত। নিচ থেকে কোহিনূর তার প্রেয়সীকে এমন অশ্রু নিবারণ করতে দেখে কালো সেই বিড়ালকে একহাতে জড়িয়ে অন্যহাত দুটো গালে ঠেকিয়ে ইশারায় কাঁদতে মানা করল। অতঃপর হাত দিয়ে ইশারাতেই ডাকল রাগিনীকে তার নিকট। কান্নারত রাগিনী সেই অবস্থাতেই হেসে দিয়ে কোনো বিলম্ব না করে বারান্দা থেকে ছুট লাগায়। আর কোনো বাঁধা মানবে না সে।

দরজা খুলে একপ্রকার দৌড়েই গার্ডেন পেরিয়ে সোজা বাহিরে চলে আসে রাগিনী। মাঝখান থেকে দারোয়ান সায়েদুল রাগিনীকে এভাবে বের হতে দেখে থতমত খেয়ে যান। বাহিরে তাকিয়ে দেখেন কোহিনূরের সামনে রাগিনীকে দাঁড়াতে। তাই তিনি আর কিছু বললেন না। প্রাচীরের আড়ালে গিয়ে টুলে বসে রইলেন। কোহিনূরের সামনে গিয়ে হাঁপাতে লাগল রাগিনী। তারপর নিষ্পলক তাকিয়ে রইল মানুষটির দিকে। এখনো গাল ভেজা মেয়েটার। তা খেয়াল করে কোহিনূর তার বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে ছুঁইয়ে দেয় রাগিনীর গাল। আদুরে গলায় বলে,
“একি! আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ের কথা বললে আমার রাগের রানি খুশিতে নাচতে শুরু করবে। কিন্তু এখন তো দেখছি সে কেঁদেই ভাসিয়ে দিচ্ছে।”

“উঁহু! আপনি বুঝবেন না আমার খুশির কান্না।”

নিজের চোখ কচলে বলে রাগিনী। তৎক্ষনাৎ খানিকটা নিকটে এসে কোহিনূর গলায় প্রতিত্তোর করে,
“তাই বুঝি? আমি না বুঝলে কে বুঝবে?”

“জানি না।”

মিনমিনে গলায় কথাগুলো বলতেই রাগিনী আর কোহিনূর উভয়ই খেয়াল করে তাদের হাতে থাকা দুটো বিড়ালই দুজনকে দেখে মিও মিও করে উঠছে। রাগিনী ও কোহিনূর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে এসে তারা নিচে নামিয়ে দিলো দুটো বিড়ালকেই। রিও ধীর পায়ে প্রথমে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল মেয়ে বিড়ালটির পাশে। অতঃপর একটা পা তুলে আস্তে করে ধা/ক্কা দেওয়ার চেষ্টা করল তাকে। মেয়ে বিড়ালটি ক্ষে/পে উঠে কোহিনূরের পায়ের আড়ালে সরে আসে। এরপর রিও আবারও বিড়ালটির কাছে যায় আর আস্তে করে জড়িয়ে ধরতেই শব্দ করে হেসে দেয় রাগিনী। কোহিনূর বলে ওঠে,
“সিরিয়াসলি! প্রমাণ পেলে তোমার এই বিড়াল ছানা আসলেই পাঁ/জি। নয়ত এত সুন্দর একটা বউ এনে দিলাম। প্রথমে এমন কেউ করে?”

রাগিনী ওমনি দুম করে বলে ওঠে,
“আমার তো মনে হচ্ছে ও আপনার থেকেই সব শিখেছে। মানতেই হবে দিনশেষে ও একটা ছেলে বিড়াল। সে আপনাকে সহ্য করতে না পারলেও ঠিকই আপনার অভ্যেসগুলো রপ্ত করে ফেলেছে। আপনি যেমন প্রথমে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখেন তারপর কাছে টানেন ঠিক ওমনি তৈরি হয়েছে রিও।”

কোহিনূর এবার নিঃশব্দে হাসে। রাগিনীর ডানহাতটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে নিজের বুকে ঠেকিয়ে শীতল গলায় বলে উঠল,
“কথা দিলাম, দূরে সরিয়ে রাখব না কখনো। নিজের হৃদয়স্থলে যত্ন করে সাজিয়ে রাখব। মাঝে মাঝে বের করব। ইচ্ছেমতো ভালোবাসব! আবারও হৃদয়বাসে লুকিয়ে রাখব।”

মাথা নুইয়ে ফেলে রাগিনী। হয়ত কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা খুশিতে। শহুরে বিলাসবহুল মহল্লায় এখনো কয়েকটা গাড়ি চলছে। তাই নিজের কোলে কালো বিড়ালটিকে তুলে নিলো রাগিনীকে। আর কোহিনূরের উদ্দেশ্যে বলল,
“রিওকে আপনি নিন!”

কোহিনূর তৎক্ষনাৎ আশ্চর্য হয়ে বলল,
“মাথা খা/রাপ? আমার কাছে নিলে আমার আ/স্ত রাখবে? এমনি সেদিন গালে যা খামচে দিয়েছিল! তুমি কি চাও বিয়ের আগে তোমার হবু বরের ফেসটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাক?”

“আপনাকে তো ওকে সামলানোর অভ্যেস করতেই হবে। আফটার ওল বিয়ের পরেও সে আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তাই দেরি না করে জলদি কোলে তুলে নিন। গাড়ি চলছে এখনো। কখন কোথায় দৌড়ে যাবে ঠিক নেই।”

ঢক গিলে এবার সাহস করে রিওকে দুহাতে তুলেই নিলো কোহিনূর। রিও প্রথমে কোহিনূরের দিকে একটু রাগি রাগি ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলেও পরবর্তীতে যেন মিইয়ে যায়। কোহিনূর নিজেও হতবাক এমন কাণ্ডে। অন্তত একটা আঁচড় আশা করেছিল সে রিও-এর কাছ থেকে। হতবাক হয়ে সে বলল,
“এটা কী হলো? আজকে চাঁদ ঠিকদিকে উঠেছিল তো?”

আকাশের দিকে উঁকিঝুঁকি দিলো কোহিনূর চাঁদ দেখার আশায়। রাগিনী ফিক করে হাসতে গিয়ে বলল,
“আমার মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে আপনিই ওর জন্য সঙ্গী খুঁজে এনেছেন। তাই আপনাকে মেনে নিয়েছে আর আজকে ক্ষমা করে দিয়েছে।”

“তাই হবে হয়ত।”

“এই ব্ল্যাক প্রিন্সেস এর কোনো নাম রেখেছেন? গায়ে তো ভীষণ ময়লা! কোথায় পেলেন তাকে?”

“আমি আসছিলাম তোমার কাছেই। একটা হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলাম। খিদে পেয়েছিল ভীষণ। নিজের খাওয়া শেষ করে বের হতে গিয়ে দেখলাম সে হোটেলের কাছে বসে আছে। বারবার খাবারের দিকে তাকাচ্ছিল। তাই ওকে একটু খাইয়ে ভাবলাম নিয়ে চলেই আসি। তাই নিয়ে এলাম। নামটা রেখেছি ফিওনা। ভালো হয়েছে নাকি খারাপ।”

রাগিনী ফিওনাকে জড়িয়ে নম্র সুরে বলল,
“খারাপ হবে কেন? নামটা বেশ মানিয়েছে তাকে।”

কোহিনূর এবার উৎসুক হয়ে বলে,
“তবে পাত্র এবং পাত্রী দুটোই পছন্দ হয়েছে আপনার? অপেক্ষা কীসের তাহলে শুভ কাজ সারতে?”

রাগিনী কিছু বলতে গিয়েও থামে এবার। কিছু একটা মনে আসায় মুখের উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফ্যাকাসে হয়। মূহুর্তেই বিষণ্ণতায় অস্ফুটস্বরে বলে,
“বাবা! ওই মানুষটার বিরুদ্ধে আমি যেতে পারব না কোহিনূর!”

কোহিনূর মোটেও অস্থির হলো না। আগের ন্যায় শান্তই রইল। ধীর গলায় বলল,
“কে বলেছে উনার বিরুদ্ধে যেতে?”

অবাক পানে তাকাল রাগিনী। একহাতে রাগিনীর হাতটা ধরল কোহিনূর। বেশ অবিচলভাবে তারা প্রবেশ করল বাড়ির অভ্যন্তরে। রাগিনী হতবিহ্বল হয়ে হাঁটতে থাকল। কোহিনূরকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পেরে উঠল না। বুঝতে পারল না লোকটি কী করতে চাইছে। সদর দরজা পেরিয়েই যখন হলরুমে তারা ঢুকল সোফায় দেখা গেল স্বয়ং রাশেদ সাহেবকে। সোজা হয়ে দরজার পানেই তাকিয়ে ছিলেন ভদ্রলোকটি। যেন অপেক্ষায় ছিলেন তাদের দুজনেরই। পাশে দাঁড়িয়ে আছে অভিরূপ। সেও যেন তাদেরই জন্য অধীর আগ্রহে ছিল। রাগিনী তার বাবাকে দেখামাত্র ভড়কে গেল প্রথমেই। নিশ্চয় কোহিনূরকে তার সঙ্গে দেখে বেশ রে/গে গিয়েছেন তিনি! এই ভেবেই দ্রুত তার বাবার কাছে গিয়েই ফ্লোরেই হাঁটু গেঁড়ে বসল রাগিনী। কাঁপা সুরে অনুনয়ের সঙ্গে বলল,
“বাবা…”

রাশেদ সাহেব হাতটা তুলে ইশারা করে মেয়েকে থামালেন। চুপ করিয়ে দিলেন। ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইল রাগিনী। রাশেদ সাহেব নিজের আদরের মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করলেন দীর্ঘ সময় ধরে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোহিনূরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তিনি। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন,
“ভালোবাসাকে ছাড়তে পারলেই না?”

রাগিনী মাথা নিচু করে বসেই রইল নীরবে। তার বাবা কী কষ্ট পাচ্ছে? ভাবনার মাঝে একরাশ আশার আলো জাগিয়ে রাশেদ সাহেব আবারও বললেন,
“আমরা সাইকোলজিস্টরাও এটা মানি ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। পৃথিবীতে সবার প্রতি সবার ভালোবাসা থাকা উচিৎ। সেটা যেকোনো সম্পর্কের ভালোবাসা হতে পারে। ভিন্ন সম্পর্কে ভালোবাসা ভিন্ন সংজ্ঞার হয়। একটা মেন্টাল পেশেন্টকে নরমাল বানাতেও ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রণয় মানেই জীবনের দুঃখী মূহুর্তগুলোও সুখী করে তোলা।”

রাগিনী বাকরুদ্ধ! তার বাবা কেন এসব বলছে তা মাথায় ঠিক করে না এলেই জেগেছে সূক্ষ্ম ভরসা। রাশেদ সাহেব আবারও বলেন,
“তবে আজকাল মানুষ ভালোবাসা, ভালো লাগার মাঝে তফাৎ বুঝতে পারে না। বিশেষ করে তোমার বয়সী ছেলেমেয়েরা। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আগে আমি নিজে পর্যবেক্ষণ করে দেখব। বিষয়টা আগে নিশ্চিত হবো এবং আজ আমি নিশ্চিত হয়েছি। আজ নয় অবশ্য! বেশ কয়দিন আগেই নিশ্চিত হয়েছি। যেদিন তুমি চট্টগ্রাম যেতে গিয়েও ফিরে এসেছিলে।”

মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগে রাগিনীর। তার বোকার মতো তাকিয়ে থাকা দেখে রাশেদ সাহেব এবার কোহিনূকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“কী হলো? এখনো কিছুই বলো নি মেয়েটাকে?”

কোহিনূর মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে বলেনি। রাশেদ সাহেব এবার রাগিনীর মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেন,
“বুঝতেই পারছি। বিয়ে দেওয়ার পর আমার মেয়েটাকে শুধু রহস্যের বেড়াজালে রেখে দেবে। এখনি সব লুকিয়ে যাচ্ছে।”

রাগিনী তবুও কিছুই বুঝল না। কী-ই বা বুঝবে? তাদের কারোর কথার আগামাথা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। উঠে দাঁড়ায় রাগিনী। কথার মাঝে অভিরূপ বলল,
“আঙ্কেল! এবার আপনার মেয়েটা মাথা ঘুরে পড়েই যাবে। এত সাসপেন্স না রেখে সত্যিটা বলেই দিন।”

রাশেদ সাহেব মাথা দুলিয়ে বলতে শুরু করেন,
“তোমায় আমি যেদিন চট্টগ্রাম চলে যেতে বলেছিলাম সেদিন রাতেই কোহিনূর আমার কাছে এসেছিল। আমি প্রথমে খুবই রা/গ করি তার উপর। পরক্ষণেই সে আমায় মানিয়ে ফেলে। যাকে বলে বউ পটানোর আগে শ্বশুরকে পটানো। আমিও তাকে শর্ত দিই সে যদি রাগিনীকে আটকাতে পারে তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তোমাদের মাঝে বোঝাপড়া কেমন এবং আমি সন্তুষ্ট! আমার আর কোনো অভিযোগ নেই।”

কথার মাঝে একটু থামেন রাশেদ সাহেব। তারপর আবার বলতে লাগলেন,
“কোহিনূর, আমি তোমার চেয়ে যোগ্য ছেলে আর কোথাও পাবো না। তুমি সেই মানুষ যে আমার পর মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারবে। আমার অনুপস্থিতিতে আমার আদরের এই মেয়েটাকে মাথায় তুলে রাখবে।”

কোহিনূর মাথা নুইয়ে বাধ্য ছেলের মতো বলে,
“ভরসা রাখতে পারেন। ভাঙবে না এই ভরসা।”

উঠে দাঁড়ান রাশেদ সাহেব। কোহিনূরের দিকে এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে প্রসন্ন হয়ে বলেন,
“ঠিকই বলেছিলে তুমি। জন্ম, মৃ/ত্যু কোনোটাই কোনো মানুষের উপর নির্ভর করে না। তুমি এমন জব করো সেকারণে আমার মেয়েকে আমি হারিয়ে ফেলব এমন ভুল ধারণা নিয়ে আমি বেঁচে ছিলাম। তুমি আমায় সেই ভুল ধারণা ভাঙিয়েছ। ইউ আর ইন্টেলিজেন্ট ম্যান!”

রাগিনীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে এবার। বাবার কাছে এসে বাবার আদুরে ছোট্ট মেয়ের মতো জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বলে,
“তোমরা আমাকে এসব আগে তো জানাও নি বাবা। কেন?”

রাগিনীকে একহাতে আগলে ধরে রাশেদ সাহেব শান্ত সুরে বললেন,
“সেটা তোমার হবু বরের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নাও। আমি এই বিষয়ে নির্দোষ। সে আমায় বলেছে সময় দিতে। বলেছিল, সঠিক সময় এলে নিজেই সব জানিয়ে দেবে।”

চোখ ছোটো-ছোটো করে কোহিনূরের দিকে তাকাল রাগিনী। কোহিনূর তখন জিহ্বা বের করে একটা কান ধরেছে সরি বলতে। তখনি চোখ সরাল রাগিনী। কোহিনূর বলল,
“আর সময়ের দোহাই দিতে চাইনা স্যার। আপনি যেদিনই বলবেন সেদিনই আমি প্রস্তুত।”

“যদি বলি কালকে তাহলে?”

কোহিনূর ভণিতা ছাড়াই জবাব দিলো,
“তাহলে কালকের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিতে চাই আমি যদি আপনার আদরের রাজকন্যার কোনো আপত্তি না থাকে!”

রাশেদ সাহেব এবার উৎসুক হয়ে তাকালেন রাগিনীর পানে। রাগিনী তখন লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত। এই কোহিনূর লোকটি একেবারে যা-তা! এভাবে কোনো মেয়েকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে সে কী করে বলবে বাবার সামনে? সে এবার হলরুম ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় কোনোরকম কথা ছাড়াই। সে যেতেই বাকি সকলে হেসে ওঠে। অভিরূপ হাসতে হাসতে বলে,
“হেই ম্যান! এভাবে কোনো মেয়েকে প্রশ্ন করতে আছে নাকি? ফেলে দিলে তো তাকে লজ্জায়!”

মাথা চুলকাতে লাগল কোহিনূর। অভিরূপ এবার হাসিটা থামাল। কোথাও যেন দেখতে পেল তার ভবিষ্যৎ। সেও মনে মনে ভেবে রাখল তারও কখনো এই সুন্দর মূহুর্তটা আসবে। সেও কখনো এই মূহুর্তের সামান্য ভাগিদার না হয়ে বরং সেই অপরূপ সময়ের প্রধান হবে!

এই রাতের সময়ে অফিসে প্রবেশ করছে কোহিনূর। মাথায় এখন অনেক চিন্তা! সে বলে তো দিয়েছে সে কালকের জন্য প্রস্তুত। তবে কী করে এত অল্প সময়ের মাঝে এত কিছু আয়োজন করবে সেটা ভেবেই কূলকিনারা পাচ্ছে না সে। নয়নতাঁরা মেয়েটাকেও এখন প্রেশার দিতে পারবে না সে। সে থাকলে কোহিনূরকক এত চিন্তা হয়ত করতেই হতো না। নয়ন কাল হসপিটাল থেকে রিলিজ পাবে। অলরেডি সে নিজের ভাইয়ের বিয়ের খবর শুনে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। শপিং করার জেদও নাকি ধরেছিল সে। অবশেষে ডক্টরের কথায় ঘুমের ঔষধে কাবু করা হয়েছে তাকে। হয়ত এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন মেয়েটা।

কোহিনূরের শেষ ভরসা মেহরাজ! এই ছেলেটাকেই দিয়ে যা করানোর করতে হবে। তাই তার অফিসে আসা। মেহরাজের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে কিছু পড়তে থাকা মেহরাজ যেন চমকে ওঠে। যেন হুট করে কোহিনূরের এমন আগমন আশা করেনি সে। ঢক গিলে কিছু বোঝার আগেই তার হাতে থাকা কিছু পেছনে লুকিয়ে ফেলে সে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় কোহিনূর। কাছে এসে শুধায়,
“কী ব্যাপার? কী হচ্ছে?”

মেহরাজ আমতা আমতা করে জবাবে বলে,
“ক…কী হবে স্যার?”

কোহিনূরও সময় না নিয়ে মেহরাজ পেছনে লুকিয়ে রাখা বইটি ফট করেই টেনে বের করে নিয়ে দেখতেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয় সে। আশ্চর্য হয়ে বলে,
“কেমিস্ট্রির বই? এগুলো তো সব কেমিস্ট্রির ফর্মুলা দেওয়া! ব্যাপার কী? আজকাল পড়াশোনাও করতে লেগে পড়েছ নাকি?”

মেহরাজ শুকনো ঢক গিলে বলল,
“না স্যার। আ…আমি পড়াশোনা করব কেন? আমি যখন এতিমখানায় ছিলাম তখন আমার তো অনেকের সাথে পরিচয় ছিল। তার মাঝে একটা ছোটো বোনের পরীক্ষা। তো সে সাজেশন চাইছিল। আমি কেমিস্ট্রিতে একটু ভালো পারি তো তাই আরকি!”

কোহিনূর আর মাথা ঘামালো না এই ব্যাপারে। বই রেখে দিয়ে জোর গলায় বলল,
“অনেক হয়েছে সাজেশন দেওয়া। এখন লেটস গো! অনেক কাজ আছে।”

“কীসের কাজ স্যার?”

“বিয়ের শপিং করতে হবে! হাতে একদম সময় নেই।”

মেহরাজ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল প্রথমে। তারপর হতবাক হয়ে বলল,
“বিয়ে? কার বিয়ে? কীসের বিয়ে?”

এমন প্রশ্নে বিরক্ত হলো কোহিনূর। দম ফেলে বলল,
“অফকোর্স আমার বিয়ে।”

আরো এক দফা বিস্ময়ে যেন শক খেলো মেহরাজ। কোহিনূরকে মাথা থেকে পা অবধি পরখ করে নিলো একবার। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“সত্যি স্যার?”

“ডাউট আছে কোনো?”

মেহরাজ তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাঁকায়। আবার ঘড়ি দেখে বলে,
“বাট স্যার! এত রাতে বিয়ের শপিং?”

“হু! কেন কী সমস্যা?”

“শপিংমল খোলা না পাওয়া গেলে…”

কোহিনূর কথার মাঝেই বলে দিলো,
“খোলা না পাওয়া গেলে তোমায় দিয়ে ডা/কাতি করাব। তাও আজকের রাতে বিয়ের শপিং হওয়া চাই।”

“ইয়েস স্যার।”

কোহিনূর বেরিয়ে গেল তখনি। পিছুপিছু মেহরাজ যেতে যেতে বলল,
“বিয়েটা তাদের। ব/লির পাঠা আমি!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১ (২য় খণ্ড)

এক সুন্দর প্রভাত। সূর্য তখনও মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত। চারিদিকে ভোরের শীতল হাওয়া এবং দিনের ব্যবধানে ছড়িয়েছে শীতের আমেজ। রাগিনীর গোছানো ঘরটার মাঝে মিউজিক বক্সে তখন সুন্দর গান বাজছে। গানের নাম ‘হয়ত তোমারই জন্য’। গানটা যেন বেশ পছন্দ হয়েছে রিও-এর। বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বেডের উপর আধশোয়া হয়ে জিহ্বা দ্বারা নিজের শরীর পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সে। যেন আজ তার মনটাও ফুরফুরে! ওয়াশরুম থেকে ভেসে আসছে পানি পতিত হওয়ার আওয়াজ। ঝিরঝিরে ঝরনার পানিতে গা ভেজাচ্ছে রাগিনী। মুখে এক তৃপ্তিময় হাসি। সারারাতটা নির্ঘুমই কেটেছে। হয়ত কোনো নারীই বিয়ের আগের রাতটা শান্তিতে ঘুমোতে পারে না। রজনি কাটায় নানান চিন্তায়। তবে পুরো রাত ঘুম ছাড়া কাটানোর পরেও ক্লান্তির রেশ নেই রাগিনীর মুখে। বরং ধরা দিয়েছে আলাদা মুখশ্রীতে আলাদা লাবণ্য। সেই মনোহারিতা যেন চারিদিকে আ/গুনের ন্যায় ছড়াচ্ছে এবং ঠান্ডা পানিতে নিভছে। শাওয়ার নিয়ে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে বাথরোব গায়ে জড়িয়ে বের হলো রাগিনী। প্রথমে রিও-এর মাথায় হাত বুলিয়ে দৃষ্টি গেল সোফায় বেশ যত্নে রাখা টকটকে লাল বেনারসি শাড়ির ওপর। সেই বেনারসিতে ভরাট গোল্ডেন কাজ যেন রাজকীয়তা এনে দিয়েছে! রাগিনী শাড়িটা নিয়ে আনমনে হাসল। মানতে হবে তার প্রিয়তম-এর পছন্দ দারুণ! শাড়ি নিয়ে গানের তালে তালে পা মিলিয়ে ঘুরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রাগিনী। মাথার টাওয়াল খুলে ভেজা নেতিয়ে পড়া চুলের উপর আলাদা করে বেনারসি জড়িয়ে নিলো রাগিনী। নিজেকেই কেন যেন ভালো লাগছে এই রূপে! কোহিনূরকে সে আবারও আজ প্রেমে ফেলতে চায়। এসব ভেবেই হাসিটা প্রগাঢ় হলো তার। সঙ্গে সঙ্গে কান দুটো গরম হলো! শরম বুঝি দিনদিন কমছে?

বাড়িতে ধুম পড়েছে বিয়ের। প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টা কম হলেও কমতি থাকছে না কোনোকিছুরই। রাগিনীর পছন্দের সাদা লাইটিং থেকে শুরু করে সাদা গোলাপেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেসব সাজানোর পরামর্শ অভিরূপ নিজে থেকেই ক্যাটারিং-এর লোকজনদের দিয়ে চলেছে। রাশেদ সাহেবের কড়া বারণের সত্ত্বেও সে শোনে নি! একে তো সে এই বাড়ির মেহমান তার ওপর জনপ্রিয়! তাকে এসব মানায়? অভিরূপ এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না মোটেও। সে এবার লাইটিং সাজানো মনমতো না হওয়ায় নিজেই চেয়ার নিয়ে দেয়ালের কাছে উঠে পড়ল। ব্যস্ত হয়ে কাজে লেগে পড়ল সে। কিছুটা সময় অতিবাহিত হবার পর তার অনুভূত হলো চেয়ারটা কেউ জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছে। লাইট ছেড়ে দিয়ে ফট করে দেয়াল ধরে চোখ বড়ো বড়ো করে নিচে তাকাল অভিরূপ। তার অনুমানটা ভুল নয়। এই ব/দ কর্ম করা ছেলেটা নোমানই! লাফ দিয়ে নিচে নামল অভিরূপ। তার উপর চিৎকার করার পরিবর্তে জাপটে ধরিয়ে ধরে ঘুরতে শুরু করল অনবরত। দিলো খুশির উচ্চরব। নোমানও জড়িয়ে ধরল তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে। হেসে ফেলল দুজনেই। তৎক্ষনাৎ দুজন দুজনকে ছেড়ে দিলো। অভিরূপ জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যাপার? এত দ্রুত উদয় ঘটল তোর? টিকিট কোথায় পেলি এত তাড়াতাড়ি?”

“তো ঘটবে না আবার উদয়? তোকে দূরে রেখে শান্তিতে থাকা যায়। উল্টাপাল্টা কর্ম করিস তুই আর চিন্তা হয় আমার। তাই আর থাকতেই পারলাম না। তার ওপর আবার রাগিনীর বিয়ে! তাই চলেই এলাম।”

অভিরূপের বিশ্বাস হলো না। নোমানের কাঁধে ধা/ক্কা দিয়ে ঠে/স মে/রে বলল,
“মেইন রিজন-টা খুব সুন্দর করে এড়িয়ে গেলি! এক কথায় শাক দিয়ে মাছ ঢেকে দিলি!”

অভিরূপের কথার বিন্দুমাত্র ব্যাখ্যা মাথায় ঢুকল না নোমানের। মাথা চুলকাতে থাকল শুধু। তারপর না বুঝে বলল,
“মানেটা কী?”

“তোর উর্মিলা! কাল রাতেই তো কল করে বললি তোর ঝগরুটে না হওয়া প্রেমিকা নাকি কল করেছিল। নির্ঘাত তার টানে ছুটে এসেছিস আর এখন বাহানা হিসেবে আমার নাম করা হচ্ছে। আমার জন্য চিন্তায় ফে/টে পড়ছিস! আমি বুঝিনা নাকি?”

নোমান থমকাল কিছুটা সময়ের জন্য। অদ্ভুত হলেও সত্যি কাল উর্মিলার সাথে কলে কথা বলার পর নোমানের মনে হয়েছে মেয়েটা তাকে একটু হলেও মনে করছে। মিস করছে বলেই কল করেছে। আর মানুষ তাকেই মনে করে যাকে সে একটু হলেও পছন্দ করে। নোমান ভেবে পায় না উর্মিলা কোনদিন থেকে তাকে পছন্দ করতে শুরু করল? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নোমান বলল,
“এমন ভাব নিচ্ছিস যেন আমি তোর চিন্তাই করিনা!”

“তা তো করিস! বাট এখানে আমি একটা আলাদা প্রেমের গন্ধ পাচ্ছি।”

বলেই অভিরূপ এমন হাবভাব করল যেন সে সত্যিই কোনোকিছুর গন্ধ পাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ তার নাক চেপে ধরল নোমান। চিল্লিয়ে উঠতে গিয়েও পারল না অভি।
“ছাড়, ছাড়।”

নোমান নাকটা ছেড়ে দেওয়া মাত্রই নিজের নাক ঘষতে ঘষতে অভি বলল,
“সত্যি কথার দামই নেই দেখছি।”

“কীসের সত্যি?”

অভিরূপ এবার নোমানের কাঁধে নিজের হাত রাখল। তারপর বলতে লাগল,
“দেখ, উর্মিলার সঙ্গে আমাদের যতবার দেখা হয়েছে কার সঙ্গে শুধু ঝগড়াই হয়েছে?”

নোমান না ভেবেই উত্তরে বলল,
“অবশ্যই আমার সাথে।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী? ঝগড়া হয়েছে ভাই! মধুর কথাবার্তা হয়নি। আমরা একে অপরকে যদি একশোটা কথা বলি তাহলে নিরানব্বইটা কথাই ঝগড়া করে বলেছি। এর মধ্যে তুই প্রেম-ভালোবাসা কোত্থেকে খুঁজে পেলি আমায় একটু বোঝা জনপ্রিয় গায়ক!”

বড়ো একটা শ্বাস নিলো অভিরূপ। অতঃপর আবারও তাকে বুঝিয়ে বলল,
“আরে গাধার বংশধর! ঝগড়া দিয়ে শুরু হওয়া প্রেমের কাহিনী গুলো বেশ জটিল হয়ে থাকে। সিরিয়াসলি! আমার সঙ্গে রেখেও তোকে মিনিমাম প্রেম বিষয়ক জ্ঞানটা দিতে পারলাম না। খুবই লজ্জার বিষয়!”

কথাগুলো শোনামাত্র বেশ সুন্দর করে নিজের কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে নিলো নোমান। নিজের লাগেজটা টেনে ধরে ঘরের দিকে অগ্রসর হয়ে বলল,
“লজ্জায় আঁচলের তলায় মুখ লুকোতে পারিস যা! আমার এখন তোর এসব শোনার টাইম নেই। আই নিড রেস্ট!”

হাতভর্তি শপিংব্যাগ নিয়ে সবে গাড়ি থেকে তড়িঘড়ি করে নামল নয়নতাঁরা। গাড়ির সামনে থাকা ড্রাইভার দ্রুত নেমে তার হাতের ব্যাগগুলো ধরতে চাইলে সে কড়া গলায় বলল,
“আমিই এসব নিয়ে যাব ভাবিজানের কাছে। আপনাকে ধরার দরকার নেই।”

“আপনি তো এখনো সুস্থ নন ম্যাডাম। স্যার বলেছে আপনাকে ভারী জিনিস তুলতে না দিতে। আপনার পিঠে লাগতে লাগতে পারে।”

বিরক্ত হয় নয়ন। এমনিতেই তার শপিং ঠিকঠাক হয়নি। সকালে একবার শপিং-এ গেলেও যেন আরো কয়েকদিন সময় পেলে সব মনমতো হতো তার। রাগিনী এবং নিজের জন্য সবকিছুই তাড়াহুড়ো করে কিনতে হয়েছে তার। একারণে সে আগের থেকেই তার বিগ ব্রাদার-এর ওপর চরম ক্ষে/পে রয়েছে। এখন সে নিজে এসেছে কিছু গহনাগাঁটি রাগিনীর নিকট পৌঁছে দিতে। তাও ড্রাইভারের এত বাঁধা সহ্য হচ্ছেনা। বিরক্তির রেশ ধরে বলল,
“আমি এখন একদম ফিট! বিগ ব্রাদারের বিয়েতে নাচতেও পারব এখন। ব্যাগ ধরতে হবে না। আমি এখনি আসছি।”

আর বিলম্ব না করে বাড়ির প্রধান দরজা পার হওয়ার জন্য সামনের ফুটপাতে এসে দাঁড়াতেই একটা মহিলার সঙ্গে হুট করেই সংঘর্ষ হলো তার। হাতে থাকা কয়েকটি শপিংব্যাগ পড়ে গেল নয়নের কাছ থেকে। সেটা নির্দ্বিধায় হাতে নিয়ে মহিলাটির দিকে সরি বলার উদ্দেশ্যে তাকাল সে। অর্ধবয়ষ্ক মহিলা। চোখমুখের চামড়া যেন বয়সের চাইতেও বেশিই কুঁচকে গিয়েছে। উনি আশেপাশে তাকাচ্ছেন আর কী যেন একটা খুঁজছিলেন। নয়নতাঁরা নিজ থেকে বলল,
“সরি আন্টি। আমি দেখতে পাইনি।”

মহিলাটি ড্যাবড্যাব করে তাকাল নয়নের দিকে। যেন সে একটু আগে মেয়েটার সঙ্গে ধা/ক্কা খেয়েছে সেটা মাথাতেই নেই। চট করেই মহিলাটি বললেন,
“না সমস্যা নাই। আচ্ছা আমারে একটা কথা বলবা? এই বাড়িটাতে কি শাহ্ রাশেদ নামের কোনো লোক থাকে?”

রাগিনীর বাড়িটা দেখাচ্ছিলেন মহিলাটি। নয়নতাঁরা প্রথমে ভাবল হয়তবা কোনো মেহমান হবে। যেহেতু বিয়ে বাড়ি এটা। তাই সে জবাব দিলো,
“জি! এটাই তো উনার বাড়ি।”

“উনি কী বাসায় আছেন?”

এবার নয়নের সন্দেহ হলো। চোখ ছোটো করল। তবুও বলল,
“আমি জানি না তো। আমি এখানে থাকিনা। কাজে এসেছি।”

মহিলাটি বারবার বাড়িটির দিকে দেখলেন। মাথা এদিক ওদিক ঝাঁকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বললেন,
“এখানেই আমার বাচ্চা থাকবে। এখানেই আছে নিশ্চয়।”

প্রথমে অস্পষ্ট লাগলেও নয়নতাঁরা মহিলাটির সমস্ত কথা বুঝেই ফেলল। কীসের বাচ্চা, কার বাচ্চা তা আর মাথায় এলো না। এ আবার নতুন কোনো শ;ত্রুপক্ষ নয় তো? ভয়ে ভয়ে তাকাল সে। তারপর দ্রুত হেঁটে ভেতরে চলে এলো। মহিলাটিও ভেতরে যেতে চাইলে দারোয়ান সায়েদুল আঁটকে দিলো তাকে। মত বিরোধিতা চলতে থাকল। এবার গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হলেন রাশে সাহেব। তিনিও কিছু কেনাকাটা করতেই গিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা! তাড়াতাড়ি হলেও কোনো কমতি রাখতে চান না। তবে থেমে গেলেন, আশঙ্কায় পড়লেন বাড়ির সামনে সেই মহিলাটিকে দেখে। শামীমা! এই নারীটি বোধহয় তাকে এই সুন্দরতম দিনেও শান্তি দেবে না! রাশেদ সাহেব আরো ভীত হয়ে পড়লেন নয়নতাঁরাকে দেখে। পরিস্থিতি সামলাতে হবে। তাই তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। নয়ন তখনও গার্ডেনে দাঁড়িয়ে। শামীমার ভেতরে আসার জন্য পাগলামি দেখে চলেছে। রাশেদ সাহেন উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে সায়েদুল বলে উঠল,
“স্যার, এই মহিলা জোরপূর্বক বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করতেছে।”

রাশেদ সাহেবকে দেখামাত্র উত্তেজিত হয়ে পড়ল শামীমা। সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল উঁচিয়ে হিসহিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এই লোকটাকেই তো খুঁজতেছি। এই লোক! বলেন এই বাড়িতে আমার বাচ্চা আছে কিনা!”

রাশেদ সাহেব তখন নিজেকে ধাতস্থ করলেন। নয়নতাঁরার দিকে চেয়ে বললেন,
“তুমি নয়নতাঁরা? কোহিনূরের বোন?”

নয়ন শুধু মাথা ঝাঁকাল। রাগিনীর বাবা ফের শান্ত থাকার চেষ্টায় বললেন,
“তুমি ভেতরে যাও মা! এসব নিয়ে চিন্তা করো না। উনি আমার পেশেন্ট। মেন্টাল পেশেন্ট! বোঝোই তো! উল্টাপাল্টা সব কথা বলছেন। তুমি ভেতরে যাও।”
নয়নতাঁরা মেকি হাসি দিয়ে ভেতরে চলে এলো।

কোহিনূরের বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে রায়ান এবং তার মা মিসেস. রমিলা। মাথায় হিজাব বেঁধে তিনি ছেলের ঘরে এসে দেখলেন রায়ান সবেমাত্র নিজের ব্লু শেরওয়ানির কলার ঠিকঠাক করছে। মাকে দেখে কিছুটা কাজে ব্যাঘাত ঘটলেও পুনরায় ঘড়ি পড়ার জন্য হাতে ঘড়ি তুলল সে। মিসেস. রমিলা আয়েশ করে বিছানায় বসলেন। ছেলেকে দেখলেন বেশকিছুক্ষণ। রায়ান বুঝতেই পারল তার মা কিছু বলতে চাইছে। সে নিজে থেকে জিজ্ঞেস করল,
“মা! কিছু বলতে চাও?”

গলা খাঁকারি দিলেন মিসেস. রমিলা এবার। গম্ভীর সুরে বললেন,
“দেখো তোমার বন্ধুর তো বিয়ে হয়েই যাচ্ছে। তুমি কি কিছু চিন্তাভাবনা করলে?”

“কীসের চিন্তাভাবনা?”

সবটা বুঝেও বুঝতে চাইল না রায়ান। মিসেস. রমিলা এবার বিচলিত হয়ে বলেন,
“কীসের চিন্তাভাবনা মানে? বিয়ের কথা বলছি আমি। বিয়েটা কবে করবে তুমি?”

রায়ান এবার নিজের চুল ঠিক করে মায়ের পাশে এসে বসল। মায়ের দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“করব মা! সময় এলেই করব।”

“সময়টা কখন আসবে তোমার? বয়সটা যখন পঞ্চাশের কোঠায় পড়বে?”

“ওহ হো! আচ্ছা! রিসেন্ট যেই টেরো/রিস্ট কেসটা চলছে সেটা শেষ হোক তারপর দেখা যাবে।”

মিসেস. রমিলা মোটেও সন্তুষ্ট হলেন না। ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
“আজ বলছ এই কেস শেষ হোক। কাল বলবে ওই কেস শেষ হোক। শোনো, মেয়ে হাতের কাছেই আছে। আমি চাইছি না আর দেরি করতে।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রায়ান। আগ্রহের সহিত জানতে চাইল,
“মেয়ে হাতে আছে? কার কথা বলছ?”

“নয়নতাঁরা! আর কার কথা বলব?”

বিস্ময়ে হতভম্ব হলো রায়ান। অস্ফুটস্বরে বলল,
“সিরিয়াসলি মা? ওই পিচ্চি মেয়েটা?”

“এই ছেলে! কীসের পিচ্চি? ও এখনো সেই পিচ্চি আছে নাকি? পাত্র পাত্রীর থেকে একটু বড়ো হবে এটা তো নরমাল বিষয়। আমিও তো তোমার বাবার চেয়ে প্রায় পনেরো বছরের ছোটো ছিলাম। তোমাদের বয়সের ব্যবধান তো মাত্র কয়েক বছর। ছয় কিংবা সাত বছর হবে! তাতেই পিচ্চি হয়ে গেল? ওর দিকে দেখেছ ঠিক করে? আগের পিচ্চি মেয়ে আছে নাকি সে?”

ধম/ক দিয়ে কথাগুলো অনবরত বলে দিলেন মিসেস. রমিলা। রায়ানও প্রতিত্তোরে বলল,
“হ্যাঁ ওকে ঠিক করে দেখিনি বলেই তো বলছি! ওর সঙ্গে আমি কী করে?”

“দেখো নি ঠিক করে ভালো কথা! এখন থেকে ভালো করে দেখবে ওকে। কোহিনূরের বিয়েটা মিটে যাক। তারপর আমি কোহিনূরের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব।”
মিসেস. রমিলা আর কোনো কথা শুনলেন না। উনি যা বলবেন সেটা করেই ছাড়বেন এবার।

নিজের চশমা ঠিক করে পড়ে মিষ্টি হেসে রাগিনীকে তৈরি করছে উর্মিলা। লাল টকটকে বেনারসিতে জোড়ানো রাগিনী যেন সদ্য ফোঁটা এক জবা ফুল! তার কানে সুন্দর দুলগুলো পরিয়ে দিলো উর্মিলা। মাথায় টিকলি আর টায়রা ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“অবশেষে কোহিনূর জিজুর সঙ্গে বিয়ে করে তবেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছিস!”

“উনাকে ভালোবেসেছিলাম শুধু প্রেম করার জন্য নাকি?”

উর্মিলা এবার শব্দ করে হেসে রাগিনীকে জড়িয়ে ঠেলে দিয়ে বলে,
“ওরে কোহিনূরের লায়লা! তোকে দেখে তো জিজু তো পা;গলই হবে আজ সিউর। এতদিন মেন্টাল হসপিটালে পা/গলেট অভিনয় করে ছিলেন। এবার বোধহয় সত্যিই সেখানকার চিকিৎসা নিতে হবে তাকে।”

রাগিনী প্রাণ খুলে হাসে। ফট করেই লাফ দিয়ে তার কোলে উঠে পড়ে রিও। তাকেও সাজানো হয়েছে আজ। তারও বিয়ে বলে কথা! গোল্ডেন কালার সুন্দর জামা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। রিও-কে আয়নার সামনে ধরে নিজের গালে ঠেকিয়ে রাগিনী বলল,
“উই আর রেডি!”

নিচে শোরগোল শোনা গেল। রাগিনী ও উর্মিলার মনোযোগ ছিন্ন হলো। উর্মিলা দৌড়ে ঘরের বাহিরে গিয়ে কিছুটা সময় পর ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“তোর মজনু চলে এসেছে রে!”

রাগিনী ধৈর্যহারা হলো! বর বেশে কেমন লাগছে তার প্রিয়তমকে? একহাতে বেনারসিটা ধরে অন্যহাতে রিওকে নিয়ে ধীর পায়ে দরজা পেরিয়ে করিডরে দাঁড়াল সে। রেলিং ধরে চুপি চুপি লোকটিকে দেখার আশায় সুসজ্জিত হলরুমে নজর দিতেই চোখে চোখ পড়ে গেল কোহিনূরের সঙ্গে। বেশ লজ্জায় পড়ে গেল রাগিনী। সে চেয়েছিল লুকিয়ে লোকটিকে দেখতে। তবে তা আর হলো না! মানুষটি তাকে ঠিক ধরে ফেলল। লাজুক চোখে আবার দেখে নিলো কোহিনূরকে। প্রশস্ত শরীর জুড়ে খয়েরী রঙের শেরওয়ানি। মাথায় পড়া পাগড়িটা চুল ঢেকে দিয়েছে কিছুটা। ঠোঁটের প্রশস্ত হাসিটা বার বার ঘায়েল করে তুলছে রাগিনীকে। কোহিনূরের কোলে সুন্দর একটা ছোট্ট সাদা গাউন পরিহিত ফিওনাকে দেখা যাচ্ছে। মাথায় সাদা ওড়না আটকানো! মূহুর্তেই রাগিনীর হাসির সঙ্গে চোখের কোণায় অশ্রুও দেখা দিলো! কোহিনূর তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে মাথা ঝাঁকিয়ে বারণ করল কাঁদতে। ততক্ষণে অভিরূপ, মেহরাজ, রায়ান, নয়ন তাদের এই দূর থেকে প্রেম আদানপ্রদানের দৃশ্য দেখে মজা লুটতে শুরু করে দিয়েছে।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here