গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব -০৯+১০

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৯

পরিবেশটা থমথমে। নিঝুম! স্তব্ধতা বিরাজমান ঘরে মুখোমুখি বসে থাকা দুজন মানব ও মানবীর মাঝে। সকালের তীব্র সূর্য মামাী আলো ঘরের জানালা দিয়ে প্রবেশ করে সরাসরি সেই কাঠগোলাপে মুড়ে থাকা মানবীর মুখশ্রীতে হা’না দিয়েছে। কোহিনূর নিজেই থতমত খেয়ে গিয়েছে তার একটু আগে বলা কথাটির জন্য। বেশ অবাধ্য হয়েছে তার মুখের জবান। ইচ্ছে করছে কোনোভাবে অতীতে ফিরে গিয়ে সেই বলা কথাটা যদি মুছে ফেলা যেতো। এবার যে কন্ঠস্বর থেকে একটা বাড়তি শব্দও বের হচ্ছে না। অন্যদিকে রাগিনী স্তব্ধ সামনে থাকা মানুষটির স্নিগ্ধতা মাখানো কথাটি শ্রবণ করে। সে ভুল শুনেছে নাকি ঠিক শুনেছে সেটাই বুঝতে ব্যস্ত। দুজনের চোখ দুজনের মাঝে আঁটকে রয়েছে। দুজন দুজনের নেত্রের সাগরে হারিয়েছে যেন!

খানিকটা সময় পর ইতস্তত বোধ করল রাগিনী। তার মায়ারী চোখ দুটো নামিয়ে নড়েচড়ে বসল। তবুও আঁড়চোখে তাকালো কোহিনূরের দিকে। বোঝার চেষ্টা করল লোকটা বর্তমানে কোন মুডে আছে। স্বাভাবিক ভাবে নাকি অস্বাভাবিক? অতঃপর তার অন্যহাতে থাকা টিফিনবক্সটা এগিয়ে ধরে বলে,
“কোহিনূর! আপনার জন্য খাবার এনেছি। খাবেন না?”

কোহিনূরও এবার হালকা কেশে মাথা নাড়ায়। তার ঘাড়ে হাত দিয়ে ঘাড় কাঁত করে বলে উঠল,
“কি মিস. রাগের রানী? আমার জন্য একটুও চিন্তা নেই তোমার। সকাল সেই কখন হয়েছে। অথচ তুমি সকালের খাবার দুপুরে নিয়ে এসেছো!”

রাগিনী কোহিনূরের কথার হাবভাব শুনে বুঝতে সময় লাগে না যে সে এখন আগের মতো গম্ভীর আর একটু ভয়ানক রকম মুডি মানুষ হয়ে রয়েছেন। তাই সে দ্রুত টিফিনবক্সটা খুলতে শুরু করে। দুহাত দিয়ে খোলার সময় বাম হাতে হালকা ব্যথাও পায় সে। ঠোঁট দিয়ে হালকা শব্দ করে হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ থেমে আবারও টিফিনবক্সে হাত দেয়। হাতে চাপ পড়ায় ব্যথা কয়েক গুন বেড়ে গিয়েছে। তারপর ব্যস্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“আ…আসলে ঘুম ভাঙতে লেট হয়ে গিয়েছে আজ। তাই আসতেও দে…দেরী করে ফেলেছি।”

কোহিনূর এবার মাথা ঝুঁকে ফেলে খানিকটা নিচু হয়ে বসে রাগিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর ক্ষীণ সুরে বলে,
“আই থিংক ইউ আর এন অ্যাক্টিভ গার্ল। তো কীসের খুশিতে এতো লেট করে ঘুম ভাঙলো আপনার মিস.?”

অস্বস্তিতে পড়ে যায় রাগিনী। সেই সাথে রাগ হয় বেশ। না চাইতেও মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“কারণটা তো আপনিই। সারা রাত জ্বালিয়েছেন আমাকে!”

ভড়কে উঠে তাকায় কোহিনূর। এই কথার মানে কি? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে কিছু না বুঝে বলে,
“মানে?”

এবার নিজেকে সামলে নেয় রাগিনী। খাবার কোহিনূরের সামনে ধরে কথা এড়িয়ে যাবার জন্য বলে,
“এই নিন খাবার। খেতে শুরু করুন। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন তো। আজকে আমরা বাহিরে যাব।”

রাগিনীর সব কথায় যেন কোহিনূরের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকায় কোহিনূর। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
“বাহিরে যাচ্ছি?”

“হুমম। অন্যদিন তো ঠিকই বাহিরে পালিয়ে চলে যান। আমি আজ আপনাকে নিয়ে যাব।”

মূহুর্তেই যেন কোহিনূরের সেই ঠোঁটে দেখা যায় এক চিলতে হাসি। হাসিটা যেন কত কথা বলে দেয়। সেই কথা বোঝার ক্ষমতা নেই কারোর। রাগিনীরও হয়ত না! দ্রুত খাবারটা রাগিনীর হাত থেকে নিতে যেতেই তার হাতে ব্যান্ডেজ করা দেখে কোহিনূর। সঙ্গে সঙ্গে কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরিলক্ষিত হয় তার। চোখের ধরন পাল্টে যায়। রাগিনীর সেই হাতে আলতো স্পর্শ করে বলে ওঠে,
“হাত কিভাবে কেটেছে তোমার? কাল অবধি ভালো ছিলে।”

“তেমন কিছু না। সামান্য এক্সিডেন্ট। এমন করছেন যেন এই প্রথম কোনো মানুষের হাত কা’টা গেল।”

বলেই হেঁসে দেয় রাগিনী। আসলে যে নিজেই মানসিকভাবে অসুস্থ সে-ই মানুষটাই উল্টে তার কেয়ার নিতে আসছে। ভেবে হাসিটা চলেই আসে তার। কোহিনূর কিছু বলল না। মুখটা পানসে হলো তার। হাতে খাবার নিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে খেতে শুরু করল সে।

কোহিনূরের খাওয়া শেষ হতে না হতেই রাগিনী তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একপ্রকার কোহিনূরকে টেনেই আয়নার সামনে বসিয়ে দিল সে। কোহিনূরের মেয়েটার ভাবসাব কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
“আরে আরে কি করছো তুমি?”

রাগিনী তার কথার পাত্তা না দিয়ে তার ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করল। তখনি চোখ গোল গোল হয়ে এলো কোহিনূরের। মেয়েটার মতলব কি? কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাগিনী তার মাথায় চিরুনি চালিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“চুল গুছিয়ে রাখেন না কত বছর?”

কোহিনূর মাথা সরাতে গেলে চোখ গরম করে তাকায় রাগিনী। এবার ধমক দিয়ে বলে ওঠে,
“খবরদার নড়াচড়া করবেন না। ডোন্ট মুভ! আমি বাহিরে এই অগোছালো, এলোমেলো কোহিনূরকে নিয়ে যাব না। আমি আজ এতো যত্ন করে নিজেকে সাজিয়েছি আমার পাশে এই অগোছালো কোহিনূরকে রাখার জন্য মনে হয়? আমার পাশে শুধু কোহিনূর রত্ন থাকবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?”

কোহিনূর ভ্যাবাচেকা খায়। মুখে শুধু রাজ্যের বিস্ময়। তবে অন্য কিছু বলতে পারে না। বলতে চায়ও না। চুলগুলো ঠিকঠাক মনমতো করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাগিনী। চিরুনি করা শেষে ব্যাগ থেকে হেয়াল জেল বের করতেই চোখ বড় বড় হয়ে এলো কোহিনূরের। তা খেয়াল করে রাগিনী গমগমে সুরে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলতে চান?”

কথাটা শোনামাত্র কোহিনূর ঝড়ের গতিতে মাথা নাড়ায়। সে কিছুই বলতে চায় না। আশ্চর্য! এতো ভয় পাচ্ছে কেন সে? এতো ভীতু তো সে নয়। সামান্য ছোটখাটো একটা মেয়ের কথায় ভয় পাচ্ছে? এই ভয় পাওয়াটা কি স্বাভাবিক? নাকি এই রাগিনী নামক নারীটির কথাগুলো মানতে ভালো লাগছে তার? কোনটা?

চেয়ারে বসে থেকে কিছু ফাইল চেক করছিল রায়ান। ব্যস্ত ভঙ্গিতে মনোযোগটা ফাইলেই রেখেছে। কাজে একদম হেলাফেলা তার পছন্দ নয়। কাজের সময় কাজটাই সে প্রাধান্য দেয়। তার চেয়ার টেবিলের সামনেই খানিকটা দূরে বসে ছিল শেখর। কিছু একটা বলতে উশখুশ করছে সে। তবে রায়ানের ব্যস্ততা দেখে বলতে পারছে না। রায়ান কাজের সময় অকাজের কথা বললে বেশ ক্ষেপে যায়। তবুও কথাটা চেপে রাখতে না পেরে সে কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বলে উঠল,
“স্যার, আপনার কি মনে হয়? অফিসার নির্জন এই কেস সলভ করতে পারবে?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই রায়ানের মনোযোগ সরে গেল। তবে ফাইল থেকে চোখ সরলো না। ফাইলের পাতা উল্টিয়ে বলল,
“করতেই পারে। সেটা তার অ্যাবিলিটির উপর নির্ভর করছে। আমার মনে হয় সে পারবে।”

“কিন্তু আপনার মতো ইন্টেলিজেন্ট আর ব্রিলিয়ান্ট মানুষকে রেখে ওই নির্জনকে এই বড় কেসের ইনভেস্টিগেশন করতে দেওয়া কোনো কি দরকার ছিল?”

এবার শেখরের দিকে চোখ তুলে তাকায় রায়ান। তার দুটো চোখেই যেন রাজ্যের গাম্ভীর্য। শান্ত একটা মানুষ। চোখ দুটো দেখেই যে কেউ শান্ত হতে বাধ্য। অতিরিক্ত কথা সে পছন্দ করে না শুনতেও বা বলতেও। ভার কন্ঠে বলে,
“আমিও মনে করি তার মধ্যে নিশ্চয় এমন কিছু একটা আছে যেটা যেকোনো কিছু সলভ করতে পারবে। আমাকে কেন কেস দেয়নি সেটা নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই। এই ধরনের কেস সাধারণত সিক্রেট টিমকেই দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে এই তদন্ত করলে আত*ঙ্কবাদী সাবধান হয়ে যাবে।”

এবার থামে রায়ান। দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। হাতটা টেবিলের উপর রেখে পায়ের উপর পা তোলে। মুখটায় দেখা যায় বিষণ্ণতা। আনমনে বলে ওঠে,
“অফিসার নির্জনের প্রতি আমার কোনো হিংসা নেই। কিন্তু আমার এখনো মনে পড়ে, তার বাবার জন্য আমার বাবা যখন পুলিশের পদ থেকে সাসপেন্ড হয়েছিল। তখন আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল চিন্তায়। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতো না কাউকে। আমি জানি আমার বাবার দোষ ছিল। কিন্তু জানি না হালকা চাপা ক্ষোভ আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না কিছুতেই। হয়ত তার ছেলে হিসেবে এটা স্বাভাবিক! কিন্তু সত্যিই আমি তাকে হিংসে করিনি।”

শেখর বাকহীন হয়ে পড়ে। রায়ানের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক তবে তার কথায় দুঃখের আভাস পেয়েছে সে। রায়ান শক্ত দৃষ্টিতে শেখরের দিকে তাকায়। আর বলে,
“অফিসার নির্জনকে তার মতো কাজ করতে দেওয়াই ভালো। দরকার পড়লে ফিউচারে আমি তাকে সাহায্য করব এই কেসে।”

শপিংমলে এসেছে রাগিনী। পাশেই হাঁটছে কোহিনূর। তাকে রীতিমতো জোর করে সেখানে আনা হয়েছে। তবে রাগিনী কেন তাকে এখানে এনেছে সেটা তার মস্তিষ্কে এখনো আসে নি। তারা গিয়ে দাঁড়াল জেন্টস্ সাইটে। সেখানে ছেলেদের জন্য বিভিন্ন কোট, শার্ট, ব্লেজার পাওয়া যায়। রাগিনী ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো জিনিসগুলো। এরপর কালো রঙের একটা ব্লেজার বের করে দেখলো কোহিনূর অন্যদিকে ঘুরে রয়েছে। তার হাত ধরে টেনেই সামনে ঘোরালো রাগিনী। কটমট করে বলল,
“কি হয়েছে আপনার?”

“আমার কি হবে? তোমার কি হয়েছে? আমাকে বাহিরের আনার নাম করে আমাকে কি জোকার বানানোর প্ল্যানিং আছে তোমার?”

চোখমুখ জড়িয়ে ফেলে রাগিনী। হাতে ব্লেজারটা তুলে ধরে চোখ রাঙিয়ে বলে ওঠে,
“এটা কি জোকার পড়ে?”

দমে গেল কোহিনূর। রাগিনী তার নিকটে এসে ব্লেজার ধরতেই দেখল ব্লেজারটা ছোট হচ্ছে। বিরবির করে সে বলে উঠল,
“মানুষটাও তো হয়েছেন দৈত্যের মতো! ফিট হতে চাইছে না গায়ে।”

কথাটা ধীরে বললেও কানে এলো কোহিনূরের। নিজেকে আবারও পা থেকে দেখে নিল। হাত দুটো ভালো করে দেখে নিল। তাকে সত্যিই দৈত্যের মতো মনে হয়? মেয়েটা কি অন্ধ? তার এতো সুন্দর চেহারা কি চোখে পড়ে না?

রাগিনী সেখানকার কর্মরত থাকা একটা মহিলাকে ডেকে বলল কোহিনূরের জন্য ঠিক কালো রঙের একটা ব্লেজার দিতে। মহিলাটি সম্মতি জানিয়ে কিছুক্ষণ পড়েই কালো রঙের ব্লেজার সহ পুরো সুট নিয়ে হাজির হতেই রাগিনী ইশারা করে বলে তাকে চেঞ্জ করে আসতে। কোহিনূরের কোনো পথ থাকে না মানা করার মতো। কথা মতো চলে যায় চেঞ্জিং রুমে।

নির্জনকে একের পর এক কল করে যাচ্ছে মেহরাজ। তার স্যারের পাত্তা নেই। একেবারেই লাপাত্তা। লাস্ট একবার কল করে ক্লান্ত হয়ে ফোনটা টেবিলে রেখে বড় শ্বাস নিয়ে চেয়ারে বসে সে। ফোনের দিকে তাকিয়ে একনিশ্বাসে বলে ওঠে,
“আমাকে রাজ্যের প্রেশার দিয়ে নিশ্চয় উনি শান্তিতে সেবা গ্রহণ করছেন! এডভান্টেজ নিতে তো উনি মাস্টার!”

কথাটা মুখ থেকে ছোটা মাত্র ফোনটা বেজে উঠতেই ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মেহরাজ। স্যালুট করে দরজার দিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করে একনাগাড়ে বলতে থাকে,
“সরি স্যার! সরি! আমি যা বলেছি ভুল বলেছি। এগুলো কথা আর জীবনে উচ্চারণ করব না স্যার।”

এরপর মেহরাজের মনে হয় তার ফোনটা বাজছে। নির্জন এখনো আসেনি। চোখ মেলে তাকায় সে। নিজের মাথায় নিজেই হালকা চাপড় মে’রে ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করতে ভেসে আসে নির্জনের চাপা সুর।
“স্টুপিড! এতবার কল করার কি আছে?”

নির্জনের চাপা সুর শুনে মেহরাজের টনক নড়ে। ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“স্যার, আপনি কি ডেঞ্জার জোনে আছেন? এভাবে কথা বলছেন কেন?”

“সেরকমই কিছু ধরে নাও। যেটা বলার জন্য তোমাকে ফোন করেছি সেটা শোনো। তোমরা রেডি তো?”

“ইয়েস স্যার। আপনি যখন বলবেন। তখনি আমরা কাজে লেগে পড়ব। কিন্তু স্যার, বলছিলাম যে কাজটা একটু রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না?”

নির্জন এবার চাপা সুরেই ধমক দেয় মেহরাজকে।
“শাট আপ! আমি পুরোপুরি না হওয়া অবধি শান্তি পাচ্ছি না। রাতে ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে মেয়েটা আমার। ঘুমটা পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য হলেও এতো বড় রিস্ক আমাকে নিতে হবে। এই কনফিউশানে আমি ভুগতে পারব না।”

মেহরাজ কিছু একটা ভেবে দাঁত বের করে হাসে। একটু হেঁসে নিয়ে বলে,
“স্যার, মেয়েটা যদি সত্যিই রাগিনী তাজরীন হয় তাহলে আপনার কষ্ট হবে তাই না?”

“কষ্ট? কীসের কষ্ট?”

নির্জনের ক্ষুব্ধ সুর বেজে উঠতেই নিজেকে দমিয়ে নেয় মেহরাজ। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“না স্যার কিছু না।”

ওপর পাশে এবার নির্জন চুপ। কিছুক্ষণ নিরবতা রেখে সে এবার বেশ রয়েসয়ে প্রশ্ন করে,
“লিসেন মেহরাজ, একটা কথা বলো! আমাকে কি কোনোদিক থেকে দেখতে দানব বা দৈত্য টাইপের মনে হয়?”

প্রশ্নটা শুনে নিজেই বোকা হয়ে গেল মেহরাজ। থম মেরে রইল কিছুক্ষণ। তারপর তড়িঘড়ি করে জবাব দিয়ে উঠল,
“প্রশ্নই ওঠে না। আপনার মতো একটা সুদর্শন আর পারফেক্ট মানুষকে কে দানব বলল? কার এতো বড় স্পর্ধা?”

নির্জন ধীর কন্ঠে বলল,
“যার স্পর্ধা সে ঠিকই খুব সহজে বলে দিয়েছে। বাই দ্যা ওয়ে বি রেডি ওকে?”
বলেই ফোনটা ওপাশ থেকে ফট করে কেটে গেল। মেহরাজ সেই ভ্যাবাচেকা খেয়েই দাঁড়িয়ে রইল।
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১০

বসার জায়গায় বসে একমনে প্রতীক্ষা করছে রাগিনী। তার হাতের চুড়িগুলো নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল কোহিনূর চেঞ্জিং রুমে গিয়েছে। বের হবার কোনো নাম নেয় তার। লোকটা আসলেও ড্রেস চেঞ্জ করতে পেরেছে তো? শার্টের বোতামগুলো লাগাতে পেরেছেন? নাকি ভেতরে কোনো কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন। এসব ভাবতে ভাবতে বিচলিত হয়ে চেঞ্জিং রুমটার দিকে তাকালো সে। আর বসে থাকা যাচ্ছে না। উঠে দাঁড়ালো এবার। হাতের ব্যাগটা নিয়ে এগোতে লাগল সেদিকে। এরই মাঝেই খুলে গেল সেখানকার দরজা। দরজা খুলতে দেখে আর এগিয়ে গেলো না রাগিনী। ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানেই। দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে এলো কোহিনূর। ব্যস্ত পানে এখনো ব্লেজার ঠিকঠক করছে সে। রাগিনীর দুটো সুন্দরতম আঁখির পলক পড়তে আর দেখা গেল না। আঁটকে গেল ঠিক কোহিনূর নামক ব্যক্তিটির মাঝে। মনের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে এক উথাল-পাতাল! এইতো তার কল্পনার কোহিনূর রত্ন। তার চুল, হাঁটাচলা সব হবে অন্যরকম! আশ্চর্যজনক হবে তার স্টাইল! নিজের কাল্পনিক রূপকে এতো দ্রুত বাস্তবে দেখতে পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পেয়ে গিয়েছে রাগিনী। খামচে ধরেছে তার ওড়না। চোখটা সরাতে মন চাইছে না। এ যেন তার মস্ত বড় একটা রত্ন। যা যত্নের পর চকচক করছে!

হঠাৎ করেই রাগিনীর সামনে চুটকি বাজায় ধ্যান থেকে বেরিয়ে হকচকিয়ে তাকায়। খেয়াল করে তার অনেকটা ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে কোহিনূর। এবার ঘন ঘন চোখের পলক পড়ে তার। রাগিনীর এমন তাকানোর ধরন দেখে কোহিনূর খানিকটা ঘাড় কাঁত করে বলে,
“সো ম্যাডাম রাগিনী, ডু আই লুক মোর হ্যান্ডসাম?”

রাগিনী যেন এখনো ঘোর কাটাতে পারেনি। তাই কথাটা যেন তার কর্ণকুহরে পৌঁছেও পৌঁছালো না। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“কী?”

“এজন্যই আমি এসব ট্রাই করতে চাইছিলাম না। এমনিতেই আমাকে দেখলে আপনার মাথা ঠিক থাকে না। এখন এইসব পোশাকে দেখলে তো আরো বিপদ হয়ে যাবে। দেখুন, আপনার শ্রবণশক্তিও কমে গেছে আমাকে এভাবে দেখে।”

মুখটা বেলুনের মতো চুপসে গেল রাগিনীর। লোকটা একনাগাড়ে কি বলে যাচ্ছে এসব? অবশ্য যা বলছে তা ভিত্তিহীনও নয়। এতোক্ষণ তো রাগিনী এই ব্যক্তিতেই মেতে উঠেছিল। সে তার চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে বলল,
“অদ্ভুত কি সব কথা বলছেন আপনি? দেখি চলুন। এখনো অনেক কাজ বাকি!”

বলে হাঁটা দিতেই রাগিনী খেয়াল করে কোহিনূর শার্টের প্রথম দুটো বোতাম খোলা রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে আবারও দাঁড়ায় সে। চোখজোড়া সরু করে কোহিনূরের নিকট যেতেই কোহিনূর চোখ গোল গোল করে তাকায়। দুই কদম পিছিয়ে যায় সে। আশ্চর্য! মেয়েটা এগিয়ে আসছে কেন? দ্রুত এগিয়েই কোহিনূরের শার্টের কলার ধরে টানে রাগিনী। তার বোতামে হাত দিয়ে বলে,
“একটা বোতাম লাগাতে হবে। তবেই ভদ্রলোক, ভদ্রলোক দেখাবে।”

জোরে জোরে কেশে ওঠে কোহিনূর। চমকে প্রশ্ন করে ওঠে,
“মানে কি? আমাকে তার মানে অভদ্র দেখায়?”

“হ্যাঁ দেখায়। বখাটে ছেলেদের মতো দেখায়। যখন চুলগুলো অগোছালো রাখেন! এলোমেলো ভঙ্গিতে থাকেন তখন যে কোনো মেয়ে দেখলেই ভড়কে যেতে বাধ্য।”

সোজাসাপটা উত্তর দিল রাগিনী। তা শুনে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল কোহিনূরের। এই মেয়েটা কি সব বলে তাকে? তবে কোহিনূর তো দমে যাবার পাত্র নয়। সে আবারও পাল্টা জিজ্ঞেস করে,
“তাহলে তুমি ভয় পাও না কেন?”

রাগিনী আর কোনো কথা বলল না। কোহিনূর তার দিকে ঝুঁকে উত্তরের আশায় উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে। রাগিনী তার হাতটা কোহিনূরের বুকে রেখে আলতো ধাক্কা দিয়ে নিজে দূরে সরে গিয়ে হাঁটা শুরু করে বলল,
“এদিকে আসুন। বললাম না? আরো কাজ বাকি আছে!”

একে একে দামি জুতো, ব্র্যান্ডের ঘড়ি নিজে পছন্দ করে কিনলো রাগিনী এবং তার কথামতো কোহিনূর এক প্রকার বাধ্য হয়েই সেসব পড়ে নিল। সবকিছু শেষে জিনিসপত্রের বিল পে করে বেরিয়ে এলো রাগিনী এবং সে। গাড়িতে গিয়ে বসল দুজন। রাগিনীর কথা অনুযায়ী গাড়ি চলতে শুরু করল। রাগিনী ও কোহিনূর দুজনই পাশাপাশি বসা। তবে দুজন বেশ দূরত্ব বজায় রেখেছে। একজন এক প্রান্তে অন্যজন সিটের আরেক প্রান্তে! জানালার হাত দিয়ে ভর করে গালে লাগিয়ে বসে বাহিরের দিকটা দেখার ভঙ্গিমা ধরেছে রাগিনী। তবে সমস্যা হচ্ছে তার অবাধ্য চোখ দুটো। যারা বার বার বেহায়ার মতো ছুটে চলেছে তার পাশেই থাকা পুরুষটিকে দৃষ্টিপাত করতে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার দৃঢ় ইচ্ছে জানাচ্ছে মস্তিষ্ক। যেন এর আগে ততটুকু দেখে তারা শান্তি লাভ করেনি। হঠাৎ করেই কিছু একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনলো সে। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। আশেপাশে তাকালো। ব্যাগের চেইন খুলে ফোনটা দেখে নিল। তবুও উশখুশ করতে থাকলো সে। তারপর সামনে থাকা ড্রাইভারকে প্রশ্ন করে উঠল,
“চাচা, আপনার কি ফোন বাজছে? বাজলে ধরুন! আমি কারো ফোন ভাইব্রেশন হবার মতো অনুভূত করছি।”

“না তো। আমার ফোনে তো কেউ ফোন দিতাছে না।”
সামনে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়ে বলল ড্রাইভার। সন্দেহ কমলো না রাগিনীর। আশেপাশে তাকালো। খুঁজতে থাকলো যদি কোনো ফোন মেলে। নড়েচড়ে উঠল পাশে থাকা কোহিনূর। জোরেশোরে কেশে উঠল। তারপর হঠাৎ করেই রাগিনীর হাতটা জোরে চেপে ধরল সে। হতভম্ব হয়ে রাগিনীর পুরো মনোযোগ চলে গেল কোহিনূরের দিকে।
“শোনো রাগের রানী, আমি আর তুমি আজকে অনেক ঘুরবো। কোথাও বাদ দিব না। শুধু শুধু ওই এক ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না।”

কোহিনূরের শিশুসুলভ কথা! তার অন্য রূপ দেখে কিছুক্ষণ থম মেরে চেয়ে রইল রাগিনী। তারপর নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ অবশ্যই। আমরা অনেক ঘুরব আজকে।”

কোহিনূর ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে ওঠে। হাসির ঝংকার ওঠে আশেপাশে। রাগিনী একমনে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার জানা নেই মানুষটিকে আসলেই কি করে আগের মতো করে তুলবে! কি করে সম্ভব হবে এসব কিছু?

রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম। বেশ লম্বা লাইন গাড়ির। শহরের নৃত্য দিনের এক ঘটনা। দুপুরের ভ্যাপসা গরম! অস্থির হয়ে উঠেছে রাগিনী বসে থাকতে থাকতে। গাড়ির এসিতেও দম বন্ধ লাগছিল তার। তাই জানালাটা একটু খুলে দিয়েছে। অন্যদিকে কোহিনূর প্রতি মিনিটে জিজ্ঞেস করছে আর জেদ ধরছে কখন তারা ঘুরতে যাবে! রাগিনী কোনোমতে তাকে থামিয়ে রেখেছে। কোহিনূর ভর দিয়ে চোখটা বন্ধ করে বসে আছে। হঠাৎ করেই রাগিনী বলে উঠল,
“চাচা, আমি একর্টু নামব। একটা কাজ আছে!”

সেকেন্ডেই চোখ খুলে তাকায় কোহিনূর। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখে রাগিনী নেমে যাচ্ছে। দ্রুত গতিতে জানালার কাছে চলে গেল কোহিনূর। চোখটা নিবদ্ধ থাকলো রাগিনীর উপরেই। মাথায় প্রশ্ন এলো কোথায় যাচ্ছে সে? খুব একটা বেশি দূর যায় না রাগিনী। সে গিয়েছে কংক্রিটের রাস্তার ডাস্টবিনটার কাছে। কোহিনূর উৎকন্ঠা থাকে বিষয়টা দেখতে। কি করতে চাইছে মেয়েটা? তাকে ভারি অবাক করে দিয়ে ডাস্টবিনের কাছে গিয়ে নাক এক হাতে ধরে অন্যহাতে ভেতর থেকে সযত্নে বের করল একটা বিড়ালের ছোট বাচ্চা। বাচ্চাটিকে নিয়ে আবারও গাড়ির দিকে চলতে থাকল সে। মুখে ঢেকে রাখা ওড়না ছেড়ে দিল। মেয়েটির অদ্ভুত স্বস্তিময় হাসি চোখ এড়ালো না কোহিনূরের। মেয়েটার এই হাসি বেশ গাঢ় এবং প্রশান্তির। বিড়ালের সেই ছোট্ট ছানাটিকে মেয়ে যেন রাজ্য জয় করে ফেলেছে।

গাড়িতে এসে বসল রাগিনী। তার হাতে ছোট্ট ছানাটি মিউ মিউ করছে। তার চোখটাও হয়ত সবে ফুটেছে। সাদা রঙের বড় বড় লোমে তার ময়লায় অন্যরকম রঙ ধারণ করেছে। গায়ে বেশ ময়লা। তবুও সেই বিড়াল ছানার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করছে না রাগিনী। বরং খুশি হচ্ছে বেশ। আনমনেই রাগিনী বিড়াল ছানার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“তোমাকে কে ওখানে ফেলে রেখেছে লিটল ফেইরি?”

বিড়াল ছানাটি মিউ মিউ করে উঠল। যেন তার কত অভিযোগ! এই নিষ্ঠুর সমাজের প্রতি। তার কোনো জায়গা নেই এইসব মানুষের পরিবেশে। সেটাই যেন অভিযোগ করতে ব্যস্ত সে। এবার রাগিনী কোহিনূরের দিকে দৃষ্টিপাত করল। আর বলল,
“কোহিনূর! আমি বলছিলাম যে আমাদের বোধহয় আগে ভেট আই মিন এনিম্য হসপিটালে যাওয়া উচিত। দেখুন এই লিটল ফেইরির অবস্থা! আমরা আগে যাই সেখানে? তারপর না হয় যাব ঘুরতে?”

কোহিনূর নিরব হয়ে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুত সম্মতি জানাতেই হাসিটা বাড়ল রাগিনীর। সে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
“চাচা, এনিম্যাল হসপিটালে চলুন আগে।”

নিস্তব্ধ অন্ধকার ঘর। ঘরটা এতটাই নিস্তব্ধ যে ওয়াশরুম থেকে টপটপ করে পানি পড়ার অবধি আওয়াজ আসছে। চেয়ারে বসে দুলছে এক মানব। তার অবয়ব বলে দিচ্ছে কাউকে বেশ কয়েকবার ধরে ফোন করে যাচ্ছে সে। এক লম্বাটে মানুষ। সবদিক থেকে বেশ স্বাস্থ্যবানই বলা চলে। প্রশস্ত এক দেহ! অনবরত ফোন দেওয়ার পর ব্যর্থ হয়ে সেই ফোন নামিয়ে রাখে। সেই ফোনে এক রক্তিম এবং ভয়া’নক দৃষ্টি আবদ্ধ থাকে। অতঃপর দৃষ্টি সরে গিয়ে পড়ে একটা ছোট গোল টেবিলের উপর পড়ে থাকা নিউজপেপারের দিকে। নিউজপেপারটা আজকের। ফ্রন্ট পেজে বড় বড় করে লিখা, ‘আত’ঙ্কবাদীর দ্বিতীয় আ’ক্রমণের কথা আন্দাজ করতে পেরে সেখান থেকে সব শ্রমিক ও মেটেরিয়ালস্ সরিয়ে ক্ষতি এড়াতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ এবং অফিসারের দল।’

নিউজপেপারের উপর হাত রাখে সেই পুরুষ। দাঁত কিড়মিড় করার সাথে সাথে নিউজপেপার দুমড়েমুচড়ে ফেলে। তারপর তার একাংশ নিজের মুখে পুরে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে মুখ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সেই কাগজ। আর বলে ওঠে,
“এতোবার এই মেয়েকে কল করছি তাও ধরার নাম নেই। নেশা করে কি টলে পড়ে আছে নাকি! অন্য কোনো খবর রাখে না বোঝাই যাচ্ছে। নয়ত এতো বড় ব্লান্ডার কি করে হলো? কি করে ফ্যাক্টরির মতো সামান্য জিনিস ব্লা’স্ট করাতে পারল না? বোধবুদ্ধি দিন দিন লোপ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাকেই তার সাথে দেখা করতে হবে।”

এনিম্যাল হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে রাগিনী। তার স্নিগ্ধ মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। তার অস্থিরতা একমনে দেখে চলেছে কোহিনূর। মেয়েটার এতো অস্থিরতার কারণ বুঝতে এখনো সক্ষম হয়নি সে। তার এতো বিচলিত মনোভাব কীসের জন্য? সামান্য বিড়াল ছানার জন্য? হ্যাঁ সেটাই। এনিম্যাল ডক্টর ছানাটাকে দেখছে। আর বাহির থেকে সেটা উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে রাগিনী। অবশেষে ডক্টর বেরিয়ে আসে। তাতে রাগিনীর চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়। দ্রুত ডক্টরের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“ডক্টর! তাকে কেমন দেখলেন?”

“দ্যা বেবি ইজ অলরাইট। জাস্ট খিদে আর মা ছাড়া হবার কারণে এমন করছে। তাকে আমি খাইয়ে দিয়েছি। আপনি তাকে একটু পর পর খাওয়াবেন। বাচ্চাদের একটু পর পর খাওয়াতে হয়। আর একটু যত্ন নিলেই সে ঠিক হয়ে যাবে।”

রাগিনীর মাঝ থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কোহিনূর দূরে বসে থেকে সবটাই লক্ষ্য করছে। অন্য কোনো হেলদোল নেই তার। রাগিনী ভেতরে গিয়ে দুহাত দিয়ে খুব আগলে ধরে বিড়াল ছানাকে বাহিরে নিয়ে এলো। বাহিরে এসেই তার দৃষ্টি গেল কোহিনূরের দিকে। কোহিনূরের এমন চুপচাপ বসে থাকা দেখে রাগিনী কিছুটা অবাক হলো। কোহিনূর উঠে দাঁড়িয়ে ইশারা করে হসপিটাল থেকে বের হতে বলল। বলেই আগে আগে হাঁটা ধরল কোহিনূর।

সারা রাস্তা বিড়াল ছানার সঙ্গেই কথা বলতেই সময় কেটেছে রাগিনীর। তাকে নিয়েই যেন এখন তার হাজারো ব্যস্ততা। কোহিনূর রীতিমতো হতভম্ব! মেয়েটা দেখি বেশ স্বার্থপর! সামান্য বিড়াল ছানা পেয়ে তাকে ভুলে গেল? তবে কোহিনূরের পাশে থাকা এই দৃশ্যের অভাব হয় না। তাই কোহিনূরও বিন্দুমাত্র দৃশ্যটা মিস করছে না। একটি স্নিগ্ধ অপরূপ মেয়ে আরেকটা স্নিগ্ধ জীবকে জড়িয়ে কতশত কথা বলছে সেটাতেই মত্ত কোহিনূর নিজেও। সে যেন আজ অন্যরকম জগতে হারিয়েছে। রাগিনীর জোর সুরে ঘোর কাটলো তার।
“কি দেখছেন এমন করে?”

রাগিনী কোহিনূরকেই উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল। কোহিনূর সেটা বুঝতেই নিজের চোখ নামিয়ে এমন ভান ধরল যেন সে কোনোকালেই রাগিনীর দিকে তাকায়ই নি। সে নিজেই চমকে যাওয়ান ভান করে বলল,
“কি দেখব?”

“আগে তো বলতেন আমি আপনাকে দেখছি বলে আপনার সুন্দর রূপের কারণে আমার শ্রবণশক্তিও কমে গেছে।”

বলেই থামলো রাগিনী। আবারও বলল,
“ডু আই লুক মোর বিউটিফুল?”

কোহিনূর খুব করে কিছু একটা বলতে চাইলো। কিন্তু বলতে পারলো না। তার আগেই হুট করেই গাড়িটা খুব জোরে ব্রেক করল। হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। জিজ্ঞেস করল,
“চাচা, কি হলো? এভাবে ব্রেক করলেন কেন?”

“জানি না। সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।”

রাগিনী সামনে তাকিয়ে দেখে সত্যিই তাই। গ্রামের পথ। আজ তার ইচ্ছে হয়েছিল একটু গ্রাম ঘুরে দেখার। সেকারণেই এদিকে এসেছিল তারা। কিন্তু এটা কেমন বিপদ? রাগিনী কিছু একটা বুঝে বলল,
“গাড়ি ঘুরান চাচা।”

রাগিনীর কথামতোই কাজ করতে গেল ড্রাইভার। কিন্তু তাদেরকে হতভম্ব করে দিয়ে পেছন থেকেও একটা গাড়ি যেন তাদেরকে ঘিরে ধরল। দুদিকে দুটো গাড়ি। রাগিনীর মস্তিষ্ক যেন ফাঁকা হতে লাগল। কি হচ্ছে? তার রাগ হলো এবার। বিড়াল ছানাটিকে সিটের উপরে রেখে দিয়ে বলল,
“আমি বাহিরে গিয়ে দেখছি কি হয়েছে!”

ড্রাইভার তাকে মানা করল। তবে রাগিনী কি শোনার মেয়ে? সে নেমে গেল। রাগিনীর পেছন পেছন কোহিনূরও নেমে গেল গাড়ি থেকে। তা খেয়াল করে রাগিনী ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ঘুরে বলল,
“আপনি নামলেন কেন? গাড়িতে ওই ছানাটি পড়ে যেতে পারে। খেয়াল রাখুন যান!”

কথাটা শেষ হওয়া মাত্র হঠাৎ বিকট শব্দ হলো। রাগিনী নিজের কান চেপে ধরল। চোখমুখ খিঁচে ফেলল। আবারও শব্দটা শোনা গেল। রাগিনী চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করল সামনের গাড়ি থেকে কেউ রি’ভলবার বের করে তারই উপর গু’লি বর্ষণ করে চলেছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল তার। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।

চলবে…

[বি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here