“এমন একটা ভান করছো যেন আজ প্রথমবার মিলিত হচ্ছি তোমার সাথে।” অত্যন্ত বিরক্তির সাথে মেহমাদ শাহ্ বলে উঠে যামিনীকে।
ষোল বছরের যামিনীর বদ্ধ চোখজোড়া থেকে অলক্ষ্যেই দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বয়সটা তখন প্রায় পনেরো ছুঁই ছুঁই ছিল, যখন তার বাবু মশাইয়ের সাথে তার বিয়ে হয়।
সদ্য কৈশোরের বাতাস লাগা যামিনীকে নিজের জন্মলগ্ন থেকে পরিচিত হিন্দুত্ব সংস্কৃতিকে ভুলে আপন করে নিতে হয়েছিল এই নব পৃথিবীকে। মুসলিম হলেও যে বাবা-মায়ের কর্মদোষে বড়ো হতে হয়েছিল হিন্দু পরিবারে। যদিও আপনটা সে একাই শ্বশুরালয়কে করেছিল, শ্বশুরালয় তাকে নয়।
এ বাড়িতে প্রথম দিনই দূর-দূর করে বিদায় করে দেয় তাকে সকলে। ভালো জায়গায় থাকলেও স্বামীর ভিটেতে স্থান হয়নি তার, না ঠিক-ঠাক স্থান পেয়েছিল স্বামীর বক্ষে। আল্লাহর নিকট কত প্রার্থণার পর মেহমাদ শাহকে মনে, শয্যায় ও বাহুতে জায়গা করে নিয়েছে সে।
কিন্তু স্বামীর ভিটে বা শ্বশুরগৃহে আজও স্থান হয়নি তার। সেই রক্তভেজা দিনটি আজও মনে পড়লে অস্থির হয়ে উঠে যামিনী। সেদিনের ঝড়ো হাওয়াতেই গোটা জীবনটাই বদলে গিয়েছিল যামিনীর। আহা! কী দুঃস্বপ্নময় সেই দিনটি!
“কী হলো চন্দ্রমল্লিকা? কথা বলছো না কেন বেগম? আমার সুকেশিনী, আমার তেজস্বী চন্দ্রিমা, আমার সোনামুখী পাখির মুখখানা মলিন ক্যানো গো আজ?”
ঘোর ভাঙে যামিনীর। তীব্র আক্ষেপ নিয়ে শুধায়,
“মেহনূর বুবুকেও বুঝি এমন ভাবে ডাকবেন বাবু মশাই? এমন আদরমিশ্রিত গলাতেই! বিশ্বাস করেন আমার দেহে যেন হাজারটা সাপ কামড়ে যায় কথাটা ভাবতেই। মেহনূর বুবুকে কেন বিয়ে করতে হবে আপনার? আমি…”
সাথে সাথে ক্রোধান্বিত হয়ে যামিনী থেকে ধাক্কার সহিত ছিটকে সরে গেল মেহমাদ শাহ্। চোখে-মুখে তার আক্রোশ।
“তোমার এত বড়ো স্পর্ধা যামিনী, তুমি আমার সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করো! আমার সিদ্ধান্তকে! ভুলে যেয়ো না আমি এই শেরপুরের কর্তা-ধর্তা সব, এই শেরপুরের জমিদার মেহমাদ শাহ্ আমি! আমার স্ত্রী হয়েছে বলে আমার নিকট জবাবদিহিতা চাওয়ার ভুল করবে না।”
হনহন করে বেরিয়া যায় মেহমাদ। যাওয়ার আগে ঠাশ করে দরজাটা লাগাতে বাদ যায় না।
যামিনী বিবস্ত্রা অবস্থায়ই হাত-পা গুটিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদবে নাই বা কেন? এই রূঢ়, গম্ভীর মানুষটির যে একান্তই তার হওয়ার কথা ছিল, শুধু তার মাঝে আবদ্ধ থাকার কথা ছিল। তবে কেন আসবে নূর নামক কোনো রমণীর মেহমাদ শাহের আঙিনায়?
তার হৃদয়টা যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এই পুরুষটির সাথে অন্যকারো নাম জুড়লেই। কী করে মেনে নিবে সে তার একান্তই নিজের প্রিয় মানুষটি বিগত দিনগুলোতে রাত্রিযাপন করেছে অন্যত্র?
অন্যকারো শয্যায় তার যামিনীর সমাপ্তি হয়, নব ভোরের শুরুয়াত হয়, কী যন্ত্রণাকর এক বিষয়টা! যার স্পর্শে সে সিক্ত হয়, সে অন্যকাউকেও ছোঁয় ভাবতেই তো গা গুলায় তার। তাই তো যেই মানুষটার ছোঁয়া তাকে আগে পাগল করতো, আজ গা ঘিনঘিনে অনুভূতি দিচ্ছে।
___
ভোর বেলায় মুরগির ডাকে ঘুম ভাঙে যামিনীর। শাড়িটা ঠিকঠাক করে গায়ে জড়িয়ে বিশালাকার বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায় সে।
আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“রজনীর রেশ এখনও কাটেনি ধরনীর আকাশের বুক থেকে, অথচ আমার আকাশের বুক থেকে এই যামিনীর রেশ কেটে গেছে পুরোপুরিই।”
ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলে রমণী। ঠিক তখনই আজানের শব্দে মুখোরিত হয় পরিবেশ, সেই সাথে কক্ষে প্রবেশ করে যামিনীর সেবায় নিয়োজিত দাসীরা।
যামিনীর খাস বাঁদী দিলরুবা কিছু একটা আঁচ করতে পারে তার মুখশ্রী দেখে। তাই দাসীদের উদ্দেশ্য বলে উঠে,
“তোমরা বেগমের ওজুর পানির ব্যবস্থা করো হাম্মামখানায় যেয়ে।”
দাসীরা মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিজেদের কাজ করতে। দিলরুবা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“বেগম, আপনাকে কেমন যেন চিন্তিত ও উদাসীন দেখাচ্ছে কোনো সমস্যা?”
“আমার সকল উদ্বিগ্নতার কারণ তো জানোই দিলরুবা। মেহনূরকে তোমরাই চেনালো। তবে কেন জিজ্ঞেস করে পোড়ান বাড়াচ্ছো?”
“নাউজুবিল্লাহ্, আমার আল্লাহ সাক্ষী বেগম আমার মনোবাসনা এমনটা ছিল না। আপনি নিরাশ হবেন না, আল্লাহর কাছে চান। আল্লাহ পরম করুণাময়, নিশ্চয়ই আপনাকে খালি হাতে ফিরাবেন না।”
“হুম, তার কাছেই পানাহ্ চাইতে যাচ্ছি দিলরুবা।”
“বেগম, ওজুর ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।”
একজন দাসী কথাটি জানাতেই আর দেরি করে না যামিনী। আজ বহু কথা বলার আছে, বহু অভিযোগ করার আছে তার ঐ পালনকর্তার সঙ্গে। ওজু করে নামাজ পড়ে মোনাজাতে বসে যামিনী।
আল্লাহর নিকট ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করে,
“আল্লাহ আমি জন্ম হতে কতোটা অসহায় তুমি জানো। আমার না বাপ-মা ছিল, না ছিল নিজের সঠিক ধর্ম-জাত। বাজারে নামতে চলেছিল আমার দেহ, তবুও তোমার চরম করুণায় আমি জমিদার মেহমাদ শাহকে পেলাম নিজের ঢাল রূপে। অবশেষে এই কালো বেগুনেরও বিয়ে হলো, তোমায় পাওয়া হলো, স্বামীর মন জুগানো হলো। কিন্তু আল্লাহ তুমি আবার এ কোন কঠিন পরীক্ষায় ফেলছো আমায়? মেহনূর নামক ঝড়কে আমায় নিঃস্ব করতে দিয়ো না আল্লাহ। পানাহ্ দাও আমায়, তোমার রহমতের পানাহ্।”
কারো পদচারণার আওয়াজে মোনাজাত সমাপ্ত করে জায়নামাজ ভাজ করে উঠে দাঁড়ায় যামিনী।
তাকে দিলরুবা উৎসুক গলায় বলে উঠে,
“বেগম, জমিদার বাবু ফোন করেছে। আপনাকে তৈরি হতে বলেছে নবাব বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আজ থেকে সেখানেই সেই বাড়ির জমিদার গিন্নি হয়ে থাকবেন আপনি।”
যামিনীর অবিশ্বাস্যকর লাগে দিলরুবার কথা।
“সত্যি বলছো তুমি দিলরুবা? আমি নবাব বাড়িতে থাকবো এখন থেকে? অবশেষে নবাবের হৃদয়ের সাথে বাড়িতেও ঠাঁই হবে আমার। মেহনূর নামক কোনো যুবতী আর আসবে না আমাদের মাঝে। আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! হাজার হাজার ধন্যবাদ তোমায় আল্লাহ।”
উৎফুল্ল হয়ে নিজের সিন্দুকে রাখা সোনার দুটো হার দিলরুবের হাতে ধরিয়ে দেয়।
“মসজিদে এই হার বা হারের মূল্য পরিমাণ অর্থ দিয়ে দিয়ো। আর অন্য হারটি তোমরা নিজেদের মধ্যে বিলিয়ে নিয়ো।”
অবশেষে পালকি উঠে যামিনীর, আসলে ঠিক পালকি নয় ঘোড়ার গাড়িতে করে নিজের বাঁদীদের ও শ’খানেক দেহরক্ষীদের সাথে নবাব বাড়ির দিকে রওনা দেয়। যেতে যেতে মাথা বাহির করে যতদূর দেখা যায় পরিচিত এই বসতভিটাকে দেখে কিশোরী। জঙ্গলের মাঝখানে এই বাড়ি, খুব সম্ভব জমিদার পরিবারের পশু শিকারের প্রয়োজনে ও বিলাসিতার প্রতীক রূপে এর স্থায়ীত্ব। পরিবারের বিরুদ্ধে না যেতে পারে তাকে এখানে নিরাপদ স্থান দেয় মেহমাদ।
অনেকটা সময়ের যাত্রা শেষে গাড়ি থামে। দিলরুবাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে সে থামার কারণ। দিলরুবা মাথা বের করে দেখে অস্থিরচিত্তে জবাব দেয়,
“এসেছি পড়েছি আমরা নবাববাড়িতে বেগম।”
এর মাঝেই মেহমাদ শাহ রাশভারী কণ্ঠে হাত এগিয়ে দিয়ে আদেশ করে,
“নিচে নেমে আসো চন্দ্রমল্লিকা।”
তার কণ্ঠ শুনে দিলরুবা চোখ নামিয়ে ফেলে।যামিনী স্বামীর হাত ধরে গাড়ি থেকে নামে। নিজের প্রিয় মানুষটির হাতটি দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আবেগ সিক্ত চুমু খায়।
“ধন্যবাদ বাবু মশাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
মেহমাদ শাহের চেহারা তখনও শক্ত। তবে কালো বস্ত্রে আবৃত এই নারীটিকে কোনোকালেই সে উপেক্ষা করতে পারে না। বিশেষ করে এই রমণীর সুরমা রাঙা নয়নযুগলকে। তাই কোনোরকম ‘হু’ উচ্চারণ করে যামিনীকে নিয়ে বিশালাকার দালানবাড়িটির দিকে হাঁটতে শুরু করে।
দরজার সম্মুখে অপেক্ষারত আপাদমস্তক ঢাকা সাদা হিজাবে আবৃত একজন মধ্যবয়স্ক নারী। মেহমাদ শাহ তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
“আম্মাজান, এই আমার চন্দ্রমল্লিকা। এই চন্দ্রমল্লিকার সমস্ত দায়িত্ব আপনার হাতে দিয়ে দিলাম। এই নবাববাড়ির সকল রীতিনীতি শিখানো ও যোগ্য জমিদার গিন্নি রূপে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার।”
মোর্শেদা খাতুন মৃদু হাসলেন পুত্রের কথায়। গালে খাঁজকাটা হাসি এই বৃদ্ধ বয়সেও কেমন যেন স্নিগ্ধ।
“যথা আজ্ঞা আমার নবাবযাদা। চন্দ্রমল্লিকা তুমি আসো আমার সাথে।”
যামিনী ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকালো মেহমাদ শাহের দিকে। সেও ইশারায় সায় দেয়। যামিনী আশ্বাস পেয়ে দিলরুবাকে নিয়ে মোর্শেদা খাতুনের পিছন পিছন যেতে শুরু করলো। মোর্শেদা খাতুন তাকে একে একে নবাববাড়ির সবকিছু চেনাতে চেনাতে অন্দরমহলে নিয়ে আসেন।
“এটা হলো অন্দরমহল। এখানেই সকল জমিদার পরিবারের সদস্য এবং বিশেষ করে নারী সদস্যরা থাকেন। জমিদার ও পরিবারের আপন সদস্য বাদে কোনো গায়রে মারহামের প্রবেশ নিষেধ। ঐ যে উপরের সবচেয়ে আলিশান কামরাটা দেখতে পাচ্ছো ওটা মেহমাদ শাহের কামরা, আর তার বিপরীত পাশে থাকা বদ্ধ কামরাটি তোমার। সব ব্যবস্থা করা আছে। তুমি যাও এখন আরাম করো।”
যামিনী নত দৃষ্টিতে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। তা দেখে মোর্শেদা খাতুন শক্ত কণ্ঠে উপদেশ দেন,
“জমিদারের বেগম তুমি। অনেক ঝড়ঝাপটা, ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে হবে। মাথা ঝুকিয়ে নয় দৃঢ় কণ্ঠে চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে কথা বলতে শিখো। কারণ এই দুনিয়া শক্তের সখা, নরমের জম।”
তিনি চলে যান। যামিনী তার কক্ষে প্রবেশ করে ক্লান্তির শ্বাস ফেলে বোরখা খুলে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। তার দেহ আর সাড়া দিচ্ছে না। দিলরুবাও মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।
___
দুপুর বেলা, ঘুম ভাঙে যামিনীর দিলরুবার ডাকে। একজন দাসী এসে তাদের খাবার দিয়ে যায়। পেট পুরে খেয়ে নেয় উভয়ে। খাওয়া শেষে অন্দরমহল ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে দিলরুবাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয় যামিনী।
একটু দূরে যেতেই দেখতে পায় উঠানে চকি পেতে বসে আছেন মেহমাদ শাহের দাদীজান ও অন্য একজন বয়স্ক নারী। সাথে এক অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতীও উপস্থিত।
যামিনী শুনতে পায় দাদীজান বলছেন,
“ঐ চালচুলোহীন আঁধারিয়া বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করে আমার নাতির জীবনটাও অন্ধকার হয়ে যেতো। এতটুকু মেয়ে জমিদারের গিন্নির দায়িত্ব কীভাবে সামলাবে এই ভয়েই আমার দেহ ডুবছে। এখন অবশ্য চিন্তা নেই। তুই এসে পড়েছিস না মেহনূর? এখন সব ঠিক হবে।”
“তা আবার হবে না! নামটাই তো মেহনূর, মানে চাঁদের আলো। তুমিই আমার ছেলের জীবন আলোয় আলোকিত করে দিবে। আল্লাহ তোমায় সুখী করুক মামনি, শত রাজপুত্র-রাজকন্যার মা করুক।”
বলেই পাশে বসে থাকা বয়স্ক নারীটি মেহনূর নামক যুবতীর ললাটে চুমু খায়।
যামিনীর পায়ের তলা থেকে যেন জমী খসে যায়। তবে কি মেহনূর নামক ঝড়টি এখনও বিদায় হয়নি তার ও বাবু মশাইয়ের জীবন থেকে? বরং, আরও ধেয়ে আসছে! এখন বাবু মশাইয়ের আশ্রয় হারিয়ে কোথায় যাবে যামিনী?
চলবে।