‘চরিত্রহীনা’ পর্ব-১০(শেষ পর্ব)
– Mahian Khan (সব পর্বের লিঙ্ক কমেন্টে দেওয়া হবে)
.
(২১)
.
সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। হয়ত ঈশ্বরের জন্যও না। সময় তার নিজ গতিতে চলতে থাকবে অন্ততকাল। অনেক সময় হয়ত একদিন কাটানো এক বছর মনেহয় আবার এক বছর কাটাতে একদিন মনেহয় । কিন্তু মানুষের এই মনে হওয়ার মাঝে কেটে যায় সময়, কেটে যায় আমাদের জীবন। হয়ত সময় একজন ধোঁকাবাজ, ধোঁকা দেওয়াটাই তার কাজ। সময়ের ধোকাটা অনেকের কাছে অনেক প্রিয় আবার অনেকের কাছে উত্তপ্ত কয়লার মত আবার অনেকের কাছে কিছুই না। সময়কে হয়ত নানাভাবে ব্যাখা করা যেতে পেরে কিন্তু দিনশেষে সময় একজন স্বার্থপর যে কাউকে নিয়ে চিন্তা করে না, কাউকে পাত্তা দেয় না শুধু উম্মাদের মত দৌড়াতে থাকে, কোনো গন্তব্য নেই তবে লক্ষ্য আছে। লক্ষ্য হল,মানুষকে তার দাস হিশেবে ব্যবহার করা। সময় যেখানে খোদ ঈশ্বরের জন্য বসে থাকে না। জাভেদ,তিন্নি এরা তো সামান্য মানুষ। সময়ের দাস। একে একে ৪ টা বছর সময় কেড়ে নেয় তাদের জীবন থেকে। ৪ বছরে সহস্রাধিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে যা বর্ননা করা হয়ত কাগজে লিখে সম্ভব না।
.
৪ বছর পর আজও প্রায় প্রতিদিন সকালের ন্যায় তিন্নি দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। এই তিন্নি আর সেই ১৯ বছরের তিন্নির মধ্যে রাত-দিন তফাৎ। আগে সকালে কফি খাওয়ার অভ্যাসটা ছিল না। এই দুই-আড়াই বছর হল নতুন এই অভ্যাসটার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। সকালের হালকা মিষ্টি রোদ তিন্নির দেহকে ছুয়ে যায়। রোদটা খুব একটা খারাপ লাগে না। শীতকাল না এলেও বৃষ্টিতে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা তাই এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় রোদের ছোয়া তিন্নি বেশ আনন্দের সাথেই উপভোগ করে। কফিতেও বেশ ধীরে ধীরে চুমুক দিতে থাকে। এই ৪ বছরে তিন্নি বিশাল বিবর্তনের পথ অতিক্রম করে সম্পুর্ন এক নতুন তিন্নিরে পরিনত হয়েছে। এখন তাকে অনেকাংশেই একজন তরুণী নারীর মত দেখতে এই ৪ বছরে নিজের সৌন্দর্য অল্প হারিয়েছে অবশ্য ১৮-১৯ বছরের সৌন্দর্য কারো ক্ষেত্রে অক্ষুণ্ণ থাকে না। কিন্তু তাই বলে তিন্নি মোটেও অরুপবতী হয়ে যায় নি বরং এখনো ১৯ বছরের যেকোন ১০টা সুন্দরি মেয়ের তুলনায় তিন্নির সৌন্দর্য কোনো অংশে কম না। তবে হ্যা তিন্নির মধ্যে পুর্নাঙ্গ তরুণী নারীর ছাপ এখন একেবারে স্পষ্ট। আগের মত চঞ্চলতা, রাগ কোনোকিছু খুব একটা নেই তা তিন্নিকে দেখলে যেকোন পরিচিত কেউ খুব সহজেই ধারণা করতে পারবে। কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে এই ৪ বছরে! তিন্নির চোখদুটোর মাঝে কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে! একজন কিশোরীর তরুণী নারীতে রুপান্তরের সাক্ষী হল চোখ দুটো। এই ৪ বছরে তিন্নির জীবনে অনেক কিছু ঘটলেও অতীত খুব একটা পরিবর্তন হয়নি । ৪ বছর ধরে রনির আশাতেই বসে আছে কয়েক দিনের মাঝে নাকি আসবে এবার বহু কষ্টে বাবা-মায়ের কাছ বেড়াতে যাওয়ার নাম নিয়ে তিন্নির সাথে দেখা করতে আসছে। ৪ বছর রনির সাথে কথা হয়েছে অনেক প্রতিদিন ৩-৪ ঘন্টা মোবাইলে, মিনিমাম আধা-এক ঘন্টা স্কাইপে তাদের কথা হয়েছে যদিও প্রেগনেন্সির শেষের দিকে রনির সাথে খুব একটা কথা বলত না। কেননা রনিকে এ বিষয় সম্পর্কে সে কোনোভাবে কোনোকিছু জানাতে ইচ্ছুক ছিল না। যদিও এই ৩ বছরে তাদের যোগাযোগ পুনরায় বেশ মজবুত হয়ে ওঠে। রনি এবার নাকি আসবে! তাও মাত্র কিছুদিনের মাঝে! তিন্নির যথেষ্ট ধৈর্য আছে আগের মত মুহূর্তে অস্থির হয়ে যাওয়ার স্বভাব আর নেই। তাই বেশ ধৈর্য সহকারেই অপেক্ষা করছে। ৪ বছরে তিন্নি একজন স্বাবলম্বী নারী হিশেবেও নিজেকে তৈরী করেছে। একজন আর্টিস্ট, লেখিকা এবং ফটোগ্রাফার হিশেবে যথেষ্ট নাম কুড়াতে পেরেছে। বেশ কিছু পুরষ্কারও পেয়েছে। জাভেদ আর ইন্টারনেট এই দুইয়ের যথেষ্ট অবদান। তার নিজস্ব ফটোগ্রাফি,আর্ট এবং লেখালেখির পেইজে ফেইসবুকে প্রায় ৫০,০০০ অধিক লাইক আছে জাভেদের কিনে দেওয়া ডি.এস.এল.আর ল্যাপটপ এবং নিজস্ব আর্ট আর পেইন্টিং এবং লেখার দক্ষতা দিয়ে যথেষ্ট নাম কুড়াতে পেরেছে তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিং জবও করে অনলাইনে যা অর্থ আয় হয় তা দিয়ে একটা ৫-৬ সদস্যের পরিবার বেশ সুখে কাটিয়ে দিতে পারবে।
.
দেখতে দেখতে কফির কাপটা প্রায় খালি হয়ে আসে রোদের প্রখরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে, বারান্দায় আর দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হয় না, নিজের বেডরুমে চলে আসে। বিছানায় বেশ অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ইরা শুয়ে আছে। দেখে মনেহচ্ছে যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও কিছু একটা ভাবছে। নিজের ক্যামেরাটা আলমারি থেকে বের করে একটানে প্রায় ইরার ৩০-৪০ টা ছবি তুলে ফেলে। ছবিগুলোতে বারবার খালি চোখ বুলাতে থাকে। নিজের চোখে বিশ্বাস হয় না যে,এত সুন্দর জিনিসটা শুধু তিন্নির এই জিনিসটা তার শরীরের অংশ। ছোটবেলা থেকে তিন্নির পুতুলের প্রতি আকর্ষন ছিল এখন খুব একটা নেই হয়ত একারণে নেই কেননা পৃথিবীর সবথেকে দামী আর সুন্দর পুতুলের মালিক সে। ইরার এত গভীর ঘুম ভাঙার কোনো ইচ্ছা নেই তিন্নির। মোবাইলটা বের করে জাভেদকে একটা ফোন দেয়। জাভেদ মোবাইলটা ধরে না।
.
– সকাল প্রায় ৮ টার মত বাজে এসময় জাভেদ অবশ্যই ঘুম থেকে উঠেছে। কিন্তু তবুও মোবাইলটা ধরল না কেন? কে জানে?
.
তিন্নির নাকমুখ মুহূর্তে শোকের ছায়ায় ভরে যায়। তবে শোকের ছায়া মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে কাটিয়ে রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে চলে যায়। কিন্তু তবুও জাভেদের ইদানিং আচরণ নিয়ে বেশ অদ্ভুত লাগতে থাকে তিন্নির। অতীতের প্রায় কিছুই পরিবর্তন না হলেও শুধু জাভেদ পরিবর্তন হয়েছে। একটা ঠান্ডা, ভদ্র মানুষ থেকে একটা খিটখিট,রাগী মেজাজের মানুষে পরিনত হয়েছে।
.
(২২)
.
বেশ দ্রুত নাস্তা বানানোর কাজ সেরে টেবিলে পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে দরজার বেল বেজে ওঠে।
.
দরজাটা খুলে দেখে, জাভেদ হাতে একটা প্যাকেট খুব সম্ভবত নাস্তা এনেছে।
.
– কেমন আছ?
.
– ভাল, আপনি? সকালে ফোন দিয়েছিলাম ধরেন নি কেন?
.
– বাথরুমে ছিলাম। মনেছিল আজকে বলেছিলাম, সকালে এখানে নাস্তা করব।তাই আর ব্যাকও করিনি।
.
– হুম, আমিও ভেবেছিলাম আপনি যখন বলেছেন তখন আসবেন যদিও ইদানিং প্রায় এভাবে বলে আর আসেন না। তারপরও এক্সট্রা নাস্তা বানিয়েছিলাম। কিন্তু প্যাকেটে কি নাস্তা।
.
– হ্যা।
.
– তো এটা খাবে কে?
.
– ভাবলাম ইদানিং প্রায় বলে তারপর আর আসা হয় না। যদি সীমিত নাস্তা বানিয়ে থাকতে! তাই নিয়ে আসলাম।
.
– তো এই নাস্তাটার হবে কি?
.
– বাসায় গিয়ে ফ্রিজে রেখে দিব! দুপুরে রোজ রোজ ভাত খেতে ভাললাগে না। এই ভাজি, পরাটা খেয়ে ফেলব, অসুবিধা কোথায়? কিন্তু এখন তোমার হাতের নাস্তা খাব।
.
– ঠিকআছে। তাহলে টেবিলে বসুন।
.
জাভেদ গিয়ে চুপচাপ টেবিলে বসে পড়ে।
.
– গতকালকে রাতে আরো ২ টা পেইন্টিং করেছ নাকি?
.
– হুম করেছি। খেয়াল করলেন তাহলে? কেমন হয়েছে?
.
– অনেক সুন্দর।
.
– আজকে কি মুড বেশ ভাল?
.
– ভাল, খারাপের কি আছে?
.
তিন্নি জাভেদের প্লেটে নাস্তা পরিবেশন করে দেয়।
.
– আছে অবশ্যই আছে। আজকাল যেরকম রাগে, অভিমানে থাকেন সেরকমটা আগে কখনো থাকতেন না।
.
– জানি না। আমার তো মনেহয় না।
.
– নিজের দোষ কেউ খেয়াল করে না।
.
– আচ্ছা ইরা কৈ?
.
– ঘুমিয়ে আছে।
.
– ও সকালে কিছু খাবে না?
.
– খাবে কিন্তু ওকে আমার ঘুম থেকে উঠাতে কেমন জানি কষ্ট লাগে।
.
– হুম ওকে ঘুম থেকে উঠাতে আসলেই সাহসের প্রয়োজন। এত সুন্দরভাবে ঘুমায়!
.
– হুম আজকে ৩০-৪০ টার মত ওর ছবি তুলেছি। আচ্ছা সেদিন আপনার সাথে নিচতলার ঐ লোকটার সাথে ঝামেলা হয়েছিল কেন?
.
– কিছু না। ঐ ইরাকে নিয়ে আর তোমাকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছিল।
.
– লোকটা প্রচুর রেগেছিল। গতকালকে বাইরে যাচ্ছিলাম একেবারে চোখ গরম করে তাকিয়ে ছিল!
.
– পাগল মনে হয়।
.
– আমারো মনেহয়। রনি নাকি ৩-৪ দিনের মধ্যে আসবে বলল।
.
– তাহলে অবশেষে তোমার ঐ “একদিন আসবে। ” ডায়লগটা সত্যি হতে চলল?
.
– হয়ত।
.
– তো ইরার কথা এবার জানাবে?
.
– অনেক চিন্তা করে দেখলাম এবার জানানো দরকার।
.
– এটা আগে জানানো উচিত ছিল, প্রায় ৪ বছর বিষয়টা গোপন কিরে কি লাভ হল? যদি কোনো ঝামেলা হয়?
.
– আমার বিশ্বাস আছে।
.
– হুম আমি জানি তুমি অনেক সৎ সহসা কারো উপর অবিশ্বাস কর না।
.
এর মধ্যে জাভেদের ফোনটা বেজে ওঠে।
জাভেদ বেশ তারাহুড়া করে কলটা রিসিভ করে।
.
– হ্যালো ইতি
.
– একটু বাসায় আস, প্লিজ!
.
– কেন? এমনি একটি কাজ আছে।
.
– কি কাজ?
.
– এত প্রশ্ন কেন?
.
– আচ্ছা আসতেছি।
.
জাভেদ বেশ দ্রুতগতিতে পরাটা ছেড়া শুরু করল।
.
– ঐ যে সেদিন যে মেয়েটাকে কথা বলতে দেখলাম সে ইতি না?
.
– হুম।
.
– আস্তে খান, তো সে কোথাও যেতে বলেছে?
.
– হুম, আমি এখন একটু আসি পরে কথা হবে কাজ আছে।
.
– আহ! নাস্তাটাও শেষ করলেন না!
.
– এখন ইচ্ছা করে না। কাজ আছে।
.
– দুপুরে আসবেন?
.
– না মনেহয়।
.
তিন্নি এখন আর আগের মত রাগী নেই। আগে এরকম হলে হয়ত জাভেদের সাথে ঝগড়া করত। কিন্তু কিছুই বলে না বরং চুপচাপ জাভেদের আচরণ সহ্য হয়ে যায়। তবে জাভেদের এরকম আচরণে তিন্নি যে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অবহেলিত মনেহয়। নিজের নাস্তাটুকু সম্পুর্ন করে না। নাস্তাটুকু যথেষ্ট সুস্বাদু কিন্তু তিন্নি হয়ত নাস্তার স্বাদ হারিয়ে ফেলেছে। ইরার পাশে গিয়ে ইরাকে আস্তে চেপে ধরে শুয়ে থাকে। যেন ইরার স্পর্শে সব বেদনা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ইরা তিন্নির কাছে একটা শক্তির নাম। একটা অলৌকিক শক্তির নাম যে তিন্নির সব দু:খ, ব্যাথা ধ্বংস করে দিতে পারে। ইরার মায়ের আদরে ঘুমে ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে নিজের মায়ের কাছ থেকে অদ্ভুতভাবে অন্তরঙ্গ হয়ে মায়ের আদর নিতে থাকে। ইরাকে কোলে জড়িয়ে ধরে ডাইনিং রুমে নিয়ে যায়। ইরার জন্য নাস্তা রেডি রাখতে তিন্নির কখনো ভুল হয় না। আজকেও হয়নি। ইরার প্রতিদিন সকালে একটা কমন ডায়লগ আছে,
.
– খুদা লেগেচে!
.
এই একটা কথাই যেন তিন্নির সমগ্র দেহকে চার্জের জন্য যথেষ্ট। এই একটা কথায় তিন্নির সব দু:খ ভুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
.
– এই তো আম্মু এখনি খাবার দিচ্ছি।
.
ইরার খাবার প্রস্তুত করায় তিন্নি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ বেলটা বেজে ওঠে।
.
– এই সময় কে আসতে পারে?
.
দরজাটা খুলতেই তিন্নি প্রায় পাথর হয়ে যায়। নিজের দুই চর্ম চক্ষু দিয়ে এখনো বিশ্বাস হয় না!
.
– তিন্নি।
.
নাহ! মোবাইল অথবা ভিডিও চ্যাট না এটা কোনো স্বপ্নও না। এই কন্ঠটা বাস্তব। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! প্রায় ৪ বছরের বেশি সময় এই কন্ঠটা কখনো এতটা জোরে শোনা যায় নি। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! না এটা তো বাস্তবেই ‘রনি’ কোনো কল্পনা না।
.
রনি তিন্নিকে স্বজোরে চেপে ধরে। হয়ত ৪ বছরে জমে থাকা সব ব্যাথা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে নিজের তিন্নিকে সে পেয়েছে। তিন্নির চোখ পানিতে ভিজে যায় কিন্তু রনির মত এতটা জোরে প্রায় চিৎকার দিয়ে কাদে না। রনি চুমু দিয়ে তিন্নির গাল ভরে দেয়।
.
– তুমি দেখি বললা ৩-৪ দিন পর আসবা?
.
– এসেছি তো গতকালকে কিন্তু শুধু সারপ্রাইজ দিব বলে এতটা দেরি করলাম!
.
– আমার এখনো বিশ্বাস হয় না। কেন জানি সব স্বপ্ন মনে হয়!
.
– আমারো।
.
– কিন্তু এগুলা তো স্বপ্ন না, তাই না?
.
– না কোনোভাবে হতে পারে না। আমার এত কষ্ট সব স্বপ্ন হতে পারে না।
.
– হ্যা জানি, ভিতরে আস।
.
তিন্নি রনির হাত ধরে রনিকে ভিতরে নিয়ে আসে। ভিতরে গিয়ে রনির প্রথম চোখ যায় ইরার দিকে।
.
– ঘর তো অনেক পাল্টিয়ে গিয়েছে। ঐ বাচ্চাটা কে!
.
– ইরা।
.
– ইরা কে?
.
– আমার সবকিছু।
.
– মানে?
.
– মানে অনেক আগে বলা উচিত ছিল আমি দু:খিত। ইরা আমাদের মেয়ে।
.
– মানে? ইয়ার্কি কর?
.
– না,রনি অনেক আগেই আমার বলা উচিত ছিল। তুমি টেনশন করবে বলে বলিনি এত বছর। যদি তুমি উল্টাপাল্টা কিছু করতে তাই!
.
– মানে? এগুলো কি কোনো নোংরা প্র্যাঙ্ক?
.
– না।
.
– হাহ! তুমি এরকম কাজ করবে আমি ভাবিনি তিন্নি!
.
– এরকম, কিরকম?
.
– মানে, এগুলো। মানে আমার আগের তিন্নিকে হারিয়ে ফেলেছি?
.
– মানে, তুমি কি বলতে চাও? আমার উপর বিশ্বাস কর না? না আমাদের মাঝে কোনোসময় কোনো সম্পর্ক ছিল না এটা বলবে?
.
– একটাও বলব না। দুটোই স্বীকার করলাম। কিন্তু তুমি ৪ বছর একা একা এখানে আমার কোনো আর্থিক সাহায্য ছাড়া কাটিয়েছ এটা বিশ্বাস সম্ভব। তার উপর একটা বাচ্চা তার ভরণপোষণ, তার পৃথিবীতে আসা আমাকে কি তোমার বোকা মনেহয়? তুমি এই সব কিছু টিউশনি দিয়ে করেছ আমি স্বীকার করব? এটাতো মনেহয় কোনো ৩ বছরের বাচ্চাকে বললেও বিশ্বাস করবে না।
.
– আজকে সব সত্য বলব আগে থেকেই প্রিপেয়ার হচ্ছিলাম।
.
– কি সত্য?
.
– একজন ভাল মানুষকে পেয়েছি পাশে যে এই পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছে। আমি তোমার ভাল চেয়েছি বলেই তোমাকে মিথ্যা বলেছি।
.
– কে সেই মহান লোক?
.
– আমার প্রতিবেশী।
.
– তোমার কোনো আত্মীয়?
.
– না, শুধু প্রতিবেশী ওর নাম জাভেদ।
.
– আহা! কি সুন্দর! আমি তো ছোট বাবু তাই না? এসব কাহীনি তো সিনেমাতেও খাটবে না তিন্নি। স্বীকার কর যে ইউ আর চেঞ্জড। ছি!
.
– ছি,মানে?
.
– বাসাটাও কত চেঞ্জড। দামী টিভি, এত ছবি, পেইন্টিং এগুলো কি? ফ্রিতে এসেছে তুমি টিউশনি করে আয় কিরেছ বা তোমার প্রতিবেশী দান করে দিয়েছে?
.
– না আমি ফটোগ্রাফি করি,ফ্রিল্যান্সিং করি,লেখালেখি করি কিন্তু বলিনি লুকিয়ে রেখেছি।
.
– তুমি এত কিছু কর সে কথা আজ শুনলাম! এগুলো করতে যে ল্যাপটপ,ক্যামেরা হাওয়া দিয়ে তৈরী হয়েছে?
.
– না, জাভেদ আমাকে ক্যামেরা আর ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিল পরে আমি জোর করে ওর সব টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছি!
.
– কি সব ফাজলামি কর বল! আমি তো বললাম এই বাচ্চায় আমার কোনো সমস্যা না। সমস্যা হল, তোমার কর্মকান্ড! তুমি এতটা নিচে নামবে ভাবতে পারিনি তিন্নি!
.
– কর্মকান্ড, নিচে নামা এগুলো দিয়ে কি বুজাচ্ছ?
.
– জান কি বুজাচ্ছি? তুমি একজন চরিত্রহীনা। হ্যা এটাই বাস্তব দয়া করে ঢাকবা না সত্যগুলো।
.
রনির মুখ থেকে কথাগুলো তিন্নি আর কোনোভাবে সহ্য করতে পারে না। রাগে রনির গালের উপরে স্বজোরে চড় লাগিয়ে দেয়। রাগে রনি নিজের দুহাত মুঠ করে জোরে,
.
– ক্যারেক্টারলেস, অসভ্য। বলে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
.
ইরা শুধু নীরব দর্শকের মত চেয়ে থাকে।ইরাকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বারবার তিন্নি শুধু চুমু খেতে থাকে। ইরাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাদতে থাকে।ইরাও হয়ত মায়ের কষ্ট একটু হলেও বুঝতে পারে। একেবারে চুপচাপ মায়ের সাথে নিজেকে লাগিয়ে রাখে। দৃশ্যটা দেখে মনেহচ্ছে যেন, ইরা তিন্নিকে সান্তনা দিচ্ছে।
.
(২২)
.
বেশ শোকাহত হয়ে তিন্নি বারান্দায় বসে আছে। কষ্ট পেলে বারান্দায় বসে থাকার স্বভাব বেশ পুরানো।
.
.
দীর্ঘ সময় হাটার পর প্রায় ১টার মত বেজে গিয়েছে। ইতি জাভেদের ডান হাত বেশ শক্ত করে চেপে ধরে রাস্তায় হাটছে দুজন।
.
জাভেদ প্রায় বাসার সামনে এসে গিয়েছে।
.
– আচ্ছা আমি যাই।
.
– না! থাক না,প্লিজ। আরেকটু হাটি।
.
– এই দুপুরে কি হাটব? ভাললাগে না।
.
– আচ্ছা তুমি এরকম কর কেন? তুমি তো আমাকে ভালোবাস,নাকি?
.
– ভালোবাসি এটা দিনে কয়বার বলতে হবে?
.
– ৫০ বার।
.
– ইয়ার্কি করতে ইচ্ছা করে না। এখন আসি।
.
– আচ্ছা দাড়াও।
.
– আর কি?
.
জাভেদের হাত ধরে ইতি চুমু খায়। জাভেদ একটা হালকা হাসি দিয়ে চলে আসে।
.
তিন্নি বারান্দায় দাড়িয়ে দৃশ্যটা স্পষ্টভাবে দেখতে পারে। তিন্নি রনিকে নিয়ে যতটা আঘাতপ্রাপ্ত ছিল সেই আঘাতে যেন জাভেদকে এই অবস্থায় দেখে নুন লাগতে থাকে। তিন্নির দুচোখ পানিতে ভিজে আসে।
.
২৩
.
জাভেদ বাসায় এসে শার্টটা খুলে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বেশ জোরে একটা নি:শ্বাস ছাড়ে। দরজায় কে জানি হঠাৎ বেল দেয়। এমনিতে রোদে হেটে জাভেদ যে পরিমাণ কাহিল তার উপর এই বেলের শব্দ বেশ বিরক্ত লাগে তবুও বাধ্য হয়েই দরজাটা খোলে। দরজা খুলে তিন্নিকে বেশ রাগান্বিত এবং শোকাহত অবস্থায় দেখে।
.
– কি ব্যাপার? কি খবর?
.
– আগে বলুন এতক্ষণ কোথায় ছিলেন।
.
– ঐ একটু কাজ ছিল, তাই একটু বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম।
.
– কোন বন্ধু?
.
– আমার বন্ধু আছে চিনবা না।
.
– নাম শুনতে পারি?
.
– অদ্ভুত তো? তুমি চিনবা কিভাবে?
.
– ঐ ইতির বাসায়?
.
– না, কেন?
.
– আপনিও মিথ্যা বলেন জাভেদ?
.
– মানে?
.
– মানে আমি দেখেছি ঐ ইতির সাথে রাস্তায়….আপনি এমন হয়ে গেলেন?
.
– কেমন?
.
– আপনি ভাল জানেন।
.
– আমি যা ইচ্ছা তা করব তোমার কি? তোমার নিজের জীবন আছে। আমি কি কখনো এরকম তোমাকে অহেতুক প্রশ্ন করেছি? আমার জীবনে নাক গলাতে তুমি কে?
.
– আসলেই, আমি কে? তাই না!
.
– তোমার হল কি?
.
– জানি না। কিন্তু আপনি আগের মত নেই জাভেদ।
.
– মানে? তুমি প্রেম করতে পারবা আর আমি আজীবন এভাবে তোমার দাসত্ব করব?
.
– জাভেদ এটা কি সত্যি আপনি? আমি কখনো আপনাকে দাসত্ব করতে বলেছি আমার?
.
– তাহলে এটা নিয়ে এত জট পাকাচ্ছ কেন?
.
– কারণ,আপনি মিথ্যা বললেন।
.
– বলেছি, সবার প্রাইভেট জীবন থাকে। তুমি রনির সাথে কি বল কথা আমি জিজ্ঞেস করি?
.
– ঠিক আছে আমি ভুল করেছি।
.
– আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলি, আমি তোমাকে ভালবাসি। যেদিন প্রথম তোমাকে অজ্ঞান এখানে তুলেছিলাম সেদিন থেকেই। কিন্তু সহ্য করেছি, ৪ বছর! কি না উপকার করেছি তোমার? ইরাকে পর্যন্ত নিজের সন্তানের মত ভালোবেসেছি। বদলে কি পেলাম? কিছু না। তাহলে আমি যদি কাউকে ভালোবাসি তোমার কি? তুমি তো রনিকে কত ভালোবাস! আমি কিছু বলি?
.
– এটাতো সেই জাভেদ না। আপনি আমাকে কত কিছু শিখিয়েছেন। দিনের পর দিন আমার রাগ, অভিমান সহ্য করেছেন। কতটা ধৈর্যশীল মানুষ কিভাবে এরকম হয়ে গেলেন?
.
– হ্যা দু:খিত সব ধৈর্য,সহ্য সব হারিয়েছি। ক্ষমা করুন।
.
তিন্নি হয়ত কিছু বলতে চায় কিন্তু কথাটা মুখে আটকে যায় চোখ থেকে ফোটা ফোটা পানি কোনোকিছুর ইশারা দিয়ে একগাদা রাগ, অভিমান আর কষ্ট নিয়ে তিন্নি বাসায় চলে যায়। রাগে জাভেদ স্বজোরে দরজা লাগিয়ে দেয়।
.
(২৪)
.
গতকালকে সারাদিন রাগে জাভেদ,তিন্নির সাথে কোনো কথা না বলে কাটিয়ে দেয়। রাতেও বেশ দেরি করে ঘুমিয়েছিল। সকালে উঠতে উঠতেও ১০টার মত বেজে যায়। টিউশনি আছে এরকম অলসের মত কাটালে হবে না। সকালে উঠে নাস্তা না করেই বাহিরে রওনা দেয়। দরজা খুলতেই একটা সাদা কাগজ মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখে।প্রথমে লাইটের বিল বুঝে উঠিয়ে দেখে তিন্নি কিছু একটা লিখেছে।
.
” সরি আজীবন আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি দু:খিত। ক্ষমা করবেন। আসলে আমি জীবনের প্রকৃত মানে এখনো বুঝিনি। অনেক কিছু বোঝা বাকি আছে এখনো। আপনি অনেক কিছু শিখিয়েছেন আমাকে কিন্তু এক পর্যায়ে আপনারও ধৈর্যের বাধ ভেঙে গিয়েছে দু:খিত এত কষ্টের জন্য। রনিও আমাকে,’চরিত্রহীনা’ বলেছে সব জানার পর। শুধু একমাত্র আপনি বলেননি। আপনি আসলে অসাধারণ। জীবনে ভাল মন্দ কিছুই শিখতে পারিনি। বিদায় আবার কোনো একদিন দেখা হবে আশা করি। আপাতত ইরাকে নিয়েই কাটিয়ে দেই জীবন। ”
.
কাগজটা পড়ে জাভেদ প্রায় অর্ধপাগল হয়ে যায়। দৌড়ে বাড়িওয়ালার কাছে যায়। সে তাকে জানায় তিন্নি নাকি বলেছে বাসা ছেড়ে যাবে, ফার্নিচারও নেয় নি। টিভিটা নিয়েছে, ল্যাপটপ,ক্যামেরা,অনেকগুলো ছবি আর অল্প কয়েকটা জিনিস। ফার্নিচার নিতে বলার পরও রেখে গিয়েছে। জাভেদ তিন্নিকে বারবার ফোন দেয় কিন্তু মোবাইল বন্ধ, ফেইসবুকে তিন্নিকে খোজে কিন্তু তিন্নি তাকে ব্লক দিয়েছে। নতুন একাউন্ট খুলে বারবার তিন্নিকে মেসেজ দেয় কোনো রিপ্লাই নেই।কমেন্ট সেকশন বন্ধ। তাছাড়া তিন্নি ফেইসবুকে ছদ্ম পরিচয় ব্যবহার করে তাই কিছু জানাও মুশকিল। তিন্নির ভার্সিটিতে খোজ নেয়। সেখানেও তিন্নি নেই।
.
টানা ৬ মাস তিন্নিকে খোজার পরও হার মানে না। খুজতে থাকে পাগলের মত আর আজও খুজছে। কোনো চায়ের দোকানে বসলেও হয়ত হঠাৎ তিন্নিকে খোজে,কোনো ছাত্রের বাসায় বসে থাকলেও বারান্দায় গিয়ে চারদিকে শুধু চোখ বুলায়। যদি তিন্নিকে খুজে পায়। বিশ্বাস একদিন সে পাবে তবে কবে সেটা জানে না।কিন্তু অটুট বিশ্বাস একদিন সে পাবেই। ঢাকায় পর্যন্ত গিয়েছে ২ বার শুধু তিন্নিকে খুজতে। তিন্নি আজও ফেইসবুক চালায়, ছবি তোলে, বই লেখে শুধু সে জাভেদকে ফাকি দিয়েছে এই যা! ফেইসবুকে ফলোয়ার লাখ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু তবু সে জাভেদের ধারণা থেকে দূরে অনেক দূরে। কে জানে হয়ত অন্য কোনো দেশে,হয়ত অন্য কোনো শহরে, অথবা একই শহরে কিন্তু বহুদূরে।
.
(সমাপ্ত)
.
(বি.দ্র : চরিত্রহীনা ২ আসছে।সিজন ২ তেই রনির সাথে দেখা হবে।