চাদোঁয়া মহল পর্ব -০৩

#চাদোঁয়া_মহল
পর্বঃ০৩
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

নওশিনের মনে হলো সয়ং সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ পুড়ে যাওয়া রূপ।এই সৌন্দর্য যেন চোখের সাথে সাথে মনও পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে!মেয়েটির বয়স কতো হবে?আনুমানিক বিশ!!মুখাবয়বে আলাদা এক ধরনের লাবণ্যতা।বেশ শালীনতার সঙ্গে দেহে জামরাঙা জামদানী শাড়ি জড়িয়েছে।খোলা চুলগুলো একসাথে বাম কাঁধের পাশ দিয়ে সামনে এনে ছড়িয়ে রেখেছে।সাদামাটা এই সাজে স্বর্গ পরী মনে হচ্ছে।চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না নওশিন,শরীর কাঁপছে তার।মেয়েটি কি তার মনের অবস্থা বুঝে ফেলেছে?তীক্ষ্ণ চোখের কি জৌলুস!!নওশিনের মনে হলো এই চোখের এক পলকের চাহনি দিয়ে,সে যেকোনো মানুষকে পুরোদস্তুর আয়ত্ত করতে পারবে।

—-“কিরে বলেছিলাম না নতুন ভাবি দেখতে পরীর বাচ্চা?”

মাসুকের কথা শুনে জিমি সিমি খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলো। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো নওশিন।তাকিয়ে দেখলো তারা সকলে সোফায় বসে আছে।চন্দ্ররেখা বসেছে একদম নওশিনের বরাবর ।নওশিন মুখে ক্ষীণ বাঁকা হাসি। নিজ থেকে বললো,

—–“এই রূপেই তো শারাফ পাগল হয়েছে।কবিরা বলে রূপ নাকি ক্ষণিকের,তাহলে তো ধরা যায় শারাফের এই পাগলামিও ক্ষণস্থায়ী।”

নওশিন যে সরাসরি এমন খোঁচা মেরে কথা বলবে,উপস্থিত কেউ কল্পনাও করে নি।রেখা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলো।নওশিনের কথার প্রেক্ষিতে জিমি কিছু বলবে,এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শারাফ কাঠ কাঠ গলায় বললো,

—–“চন্দ্ররেখার জন্য শারাফের পাগলামি যদি ক্ষণস্থায়ী হয়,তাহলে এই শারাফ নিজেও ক্ষণস্থায়ী।যেদিন এই পাগলামি বিলিন হয়ে যাবে সেদিন পৃথিবীর বুকে শারাফও নিঃশেষ হয়ে যাবে।”

শারাফের কথা শুনে মাসুক তাৎক্ষণাৎ শিষ বাজালো!!জিমি সিমি হাত তালি দিয়ে উঠলো।সবার সামনে শারাফের এমন কথা শুনে রেখা ভীষণ লজ্জা পেলো।এর মধ্যে শারাফের মা মোহিনী মির্জা ও শারাফের চাচী তৃণা মির্জা দুজনেই ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো।তাদের দেখে চন্দ্ররেখা উঠে দাঁড়াল।সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না?এগিয়ে যেয়ে কি ট্রে নিজের হাতে নিবে!!কালকে রাতে আসার পর কারো সাথে তেমন কথা হয় নি তার।আজ সকালে জিমি সিমি নিজে এসে তার সাথে কথা বলেছে।
মোহিনী মির্জা হয়ত রেখার ইতস্ততবোধটা বুঝতে পারলেন।ট্রে রেখার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

–“নেও ধরো,সবাইকে সার্ভ করো।”

মূহুর্তে রেখার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে এগিয়ে গিয়ে ট্রে নিজের হাতে তুলে নিলো। প্রথমে ঘরের হেল্পিং হ্যান্ডদের দিকে ট্রে এগিয়ে দিলো। সকলের সাথে সাথে মোহিনী মির্জা সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন।এ যেনো সুধা মির্জার প্রতিচ্ছবি।চন্দ্র রেখার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মন ভালো হয়ে গেলো।একেই বুঝি বলে পৃথিবীর শুদ্ধতম সৌন্দর্য! মায়াময়ী চেহারায় স্নিগ্ধ হাসি।

—-” হায়,হায় মা!কি করছো তুমি? নতুন ভাবী আসতে না আসতে কাজে লাগিয়ে দিলে!!এই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার উপরে একটু মায়াও হলো না?তুমি কি ওই স্টার জলসার অত্যাচারী শ্বাশুড়ির রোল পালন করছো!!কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বলে উঠলো সিমি।

সিমির সাথে তাল মিলিয়ে চেহারায় দুষ্ট হাসি নিয়ে জিমিও বললো,

—-“দেখ ভাই, তোর বউ আসতে না মা কেমন বদলে গেছে?এই অপ্সরা সুন্দরীকে দেখে মায়ের একটু মায়া ও লাগছে না।”

শারাফ কিছু বললো না।মুখে মৃদু হাসি নিয়ে সে তার অপ্সরা দিকে তাকিয়ে আছে। মোহিনী মির্জা দুই মেয়ের দিকে কটমট করে তাকালেন।এতো বড় মেয়েদের ঢং দেখে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তার মন খারাপ হয়ে গেলো।আসলেই কি তিনি বদলে গেছেন?একটা মাত্র ছেলের বউ তার।কাল থেকে মেয়েটার সাথে একটু ভালো করে কথাও বলেন নি তিনি।কি কথাই বা বলবেন!এর দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো দ্বায় হয়ে পড়ে।তৃণা মির্জা জায়ের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন।দুই বোনের কথার মাঝে তিনি ফোঁড়ন কেটে বললেন,

—–“এক সময় এই পুরো চাঁদোয়া মহলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোর ভাবির কাঁধে পড়বে, তখন তো করতেই হবে।তার চেয়ে ভালো এখনই অভ্যাস করুক।”

জিমি মুখ বাঁকিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,

—-“ভাই কি আমাদের একটা নাকি?চাচী,তোমার কথা শুনে তো মনে হয় মাসুককে ভবিষ্যতে বিয়ে করাবে না।বেচারাকে চিরকুমারই থাকতে হবে।”

জিমির কথা শুনে ঘরের সার্ভেন্টরা মুখ টিপে হাসতে লাগলো।মাসুক জিমির কথা শুনে কাচুমাচু মুখে মায়ের দিকে তাকালো। তৃণা মির্জা হার মেনে নিলেন,এই দুই বিচ্ছুর সাথে কথায় কোনোদিন কেউ পেরে উঠতে পারে না।জিমি সিমি বয়সে শারাফের তিন বছরের ছোট।জিমি সিমি মূলত ডিজাইগোটিক টুইন।যমজ বাচ্চাদের দুইজনের চেহারায় যেমন মিল থাকে তাদের দুজনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন।একজনের চেহারার সাথে অপরজনের চেহারা কোনো মিল নেই।তাই তাদের আলাদাভাবে শনাক্ত করার প্রয়োজনও পড়ে না।

এসব আদিখ্যেতা দেখে নওশিনের শরীর রাগে রি রি করে উঠলো।রেখা যখন নওশিনের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো তখন সে মুখ ভেঙিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—–“শুনলাম তোমার বাবা নাকি মাদক মামলার আসামী?নেশা জিনিস বিক্রি করা তোমাদের ফ্যামিলি বিজনেস নাকি!!”

মূহুর্তে শারাফের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।কপালের শিরা ফুলে উঠলো।তীক্ষ্ণতর চোখে নওশিনের দিকে তাকালো।

—–“বিশিষ্ট শিল্পপতি তাজওয়ার চৌধুরীর নাম শুনেছেন,নিশ্চয়ই?? আমি সেই তাজওয়ার চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে।মিথ্যে মামলায় আমার বাবাকে ফাঁসানো হয়েছে।আজ ছ’মাস যাবৎ বিনা দোষে তিনি শাস্তি ভোগ করছেন।খুব শীঘ্রই আমার বাবাকে আমি নির্দোষ প্রমাণ করবো।

আর আপনাকে বলছি,ফারদার আমাকে বাবাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করলে বেশি ভালো হবে না।”

চন্দ্ররেখার চোখ জ্বলজ্বল করছে।এক প্রকার চিৎকার করে সে কথাগুলো বলেছে। ইতিমধ্যে নাক ফুলে উঠেছে,মুুখ লাল হয়ে গেছে।তার বাবাকে নিয়ে কেউ বাজে মন্তব্য করলে সে একদম সহ্য করতে পারে না। একদম না!!আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না,তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।

রেখার তেজস্বী রূপে সবাই এক প্রকার হতভম্ব হয়ে গেছে।তাজওয়ার মির্জার নাম শুনে সকলের চেহারায় আতংক ভর করলো।শারাফের দাদী দোয়া মির্জা মাত্রই ঘরের দরজা খুলে বের হয়েছিলেন।

শারাফ বিমোহিত দৃষ্টি এতো সময় তার ক্ষ্যাপা বাঘিনীকে অবলোকন করছিলো।কোনোকিছু পড়ার শব্দ হলো। সকলে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখলো,দোয়া মির্জা ফ্লোরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছেন।সকলে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

————

পায়ের উপরে পা তুলে বসে আছেন সুধা মির্জা। তিনি এখন ঝিল্লিপুর মহিলা কল্যাণ পরিষদের অফিসে। তীক্ষ্ণ চোখে সামনে থাকা মানুষটার আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করছেন।তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকালেন। আনুমানিক ত্রিশ বছর বয়সী এক মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মহিলার কান্না দেখে পাশে থাকা সেই মানুষটি বেশ বিরক্ত হলো।তেড়ে গিয়ে মহিলার গালে চড় বসিয়ে দিলো।চড় দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারেনি সে।পালোয়ান গোছের একজন লোক তাকে এক হাতে তুলে মাটি ফেলে দিলো।সুধা মির্জার পায়ের কাছে পড়লো সে।মুখ তুলে তাকানোর পূর্বে সুধা মির্জা তার বুক বরাবর লাথি বসিয়ে দিলো। ছিটকে দূরে পড়লো সে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি পর মূহুর্তে চিৎকার করে বলে উঠলেন,

—–“জানো*রের বাচ্চা,কাপুরুষ কোথাকার!!মেয়েদের গায়ে হাত তুলিস!ঘরে বউ রেখে বাহিরে পরকীয়া করিস।মেয়ে মানুষকে যে সম্মান দিতে জানে না,সে মানুষ নামের কলঙ্ক। পশুর চেয়েও অধম তুই।শাস্তি পাবি!আমি দিবো তোকে শাস্তি। এই সুধা মির্জার হাতে তোর পাপ মোচন হবে।”

—-“বজলু,একে এখান থেকে নিয়ে যা।”

সেই পালোয়ান গোছের লোকটি এগিয়ে এলো।মাটিতে পড়ে থাকা লোকটিকে তুলে নিয়ে গেলো।সকল নারী নির্যাতনকারীর মতো একেও শাস্তি দেওয়া হবে।মুখে কালি মেখে,জুতোর মালা পড়িয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানো হবে তাকে।

কাঁদতে থাকা সেই মহিলাটি সুধা মির্জাকে জড়িয়ে ধরলেন।

—-“আপা আমি আমনের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।এই বেডায় আমারে অনেক অত্যাচার করছে,আপনে যখন ওরে মারলেন হেইডা দেইখা আমার কইলজা ঠান্ডা হইয়া গেছে।এবার আপনে হের সাথে আমার তালাকের ব্যবস্থা কইরা দেন।”

সুধা মির্জা সেই মহিলাটিকে আশ্বস্ত করে, চাঁদোয়া মহলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।মুখে তার সন্তুষ্টির হাসি। বছরখানেক যাবৎ এভাবেই তিনি অসংখ্য অসহায় মহিলাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here