চাদোঁয়া মহল পর্ব -০৪

#চাদোঁয়া_মহল
পর্বঃ০৪
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

আজকের আকাশটা এতো উদাস কেন? সে কি রেখার মনের উৎকন্ঠা বুঝতে পেরেছে!!শুনতে পেরেছি কি হৃদয়ের মনিকোঠার সেই আতর্নাদ?
ফার্ম হাউজের পূর্ব পাশে মাঝারি সাইজের একটা সুইমিংপুল।সেখানে পা ঝুলিয়ে বসে আছে চন্দ্ররেখা।সুইমিংপুল পানি শূন্য।সন্ধ্যার পরিবেশটা তার কেমন গুরুগম্ভীর মনে হচ্ছে।এসবের মধ্যে সবচেয়ে ভালো যে বিষয় রয়েছে সেটা হলো, ঝিল্লিপুরের বাতাস!!হে ঠিক তাই,রেখার মাঝে মাঝে মনে হয় এই বাতাসে শীতল স্নিগ্ধ একটা পরশ আছে,সেই সাথে আছে মা মা গন্ধ।নিজের ভাবনাতে নিজেই কেমন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলো।আসলেই কি মা মা গন্ধ আছে!!দাদীর কাছে শুনেছে তার মায়ের বাড়ি নাকি ঝিল্লিপুরে।মায়ের গ্রামে আসার পর থেকে সবকিছুতে কেমন যেনো মা মা গন্ধ পাচ্ছে সে।রেখা নিজেকে শুধালো, “কোন মা!!যেই মা জন্মের এক বছরের মাথায় তাকে ফেলে এসেছে,সেই মা!!”ছোট থেকেই সে বাড়ির কাজের লোকদের থেকে শুনে এসেছে তার মা নাকি পরপুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছে।সেই পরপুরুষটা নাকি তার আপন চাচা। আচ্ছা একবার কি তার মায়ের খোঁজ করবে সে?রেখার খুব ইচ্ছে তার মায়ের সামনা-সামনি হবার।তার দোষটা কোথায় একবার জিজ্ঞেস করবে সে।কিন্তু সে তো মায়ের নাম অবদি জানে না।কখনো দেখেও নি,চিনবে কি করে?আদোও কি তার মা এখানে থাকে!!সে হয়তো নিজের সংসার সামলাচ্ছে। তার মা না থাকুক, আত্নীয়স্বজন কেউ না কেউ তো থাকবে।

আচ্ছা মায়ের খোঁজ করলে কি বাবা রাগ করবে!!ছোট থেকে তার বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে মনমরা হয়ে থাকতে দেখছে।একবার তো তার সাথে রাগ করে দুদিন কথাও বলে নি!!দুনিয়াতে সে কেবল দাদি আর বাবাকে চিনতো।যার মা নেই তার যে কেউ নেই!! বাহিরের দুনিয়া দেখার সুযোগ সে পায় নি। রেখা তার শৈশবকালের কথা মনে করার চেষ্টা করলো।আট বছর বয়সের একটা অতীত ঘটনা মনে পড়লো।

বাবার এক বন্ধু একবার তাদের বাড়িতে এসেছিলো। লোকটার দৃষ্টি দেখে রেখার কেমন যেনো বিশ্রি লেগেছিলো।আদরের নাম করে লোকটা তার গালে বার-বার চুমু দিচ্ছিলো,শরীরের এখানে ওখানে তার নোংরা হাত ছুঁয়ে দিচ্ছিলো।দাদি হয়ত রেখার অস্বস্তি বুঝতে পেরেছিলো।তাকে টেনে নিয়ে ঘরে বন্দি করে রেখেছিলো।লোকটি যাওয়া পর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,

——“ওরে পোড়াকপালি!কি সর্বনাশী রূপ নিয়া জন্মাইলি।এই শ্রী যে তোর জন্য বড়োই ভয়ংকর রে,বুবু।পুরুষের নোংরা নজরের থন বাঁচতে হইলে এই চেহারা লুকায় রাখতে হইবো।এই কাপুরুষের মতো দুনিয়ায় আরো অনেক কাপুরুষ আছে, যারা মাইয়া মাইনসেরে খুবলায় খাওয়নের লইগা ওত পাইতা থাকে। তোর মায় নাই, এখন নিজের বুঝ তোর নিজে বুঝোন লাগবো।”

সেদিন থেকে আট বছর বয়সী রেখা কেমন যেনো হয়ে গেলো,নিজের বুঝ নিজেই বুঝতে লাগলো।তার তো মা নেই!! বাহিরে কারো সাথে মিশতো না,আট দশজনের মতো তার বন্ধু বান্ধবও ছিলো না।নিজের জন্য মহিলা টিউটর বাড়িতে ঠিক করে রেখেছিলো।প্রয়োজন ছাড়া স্কুলেও যেতো না।বাবা তার জন্য তখন আলাদা গাড়ি কিনেছিলো।স্কুলে যেয়ে শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিয়ে আসতো।তারপরও যদি কদাচিত পুরুষের নজরে পড়ে যেতো,তার মনে হতো সেই পুরুষেরা তাকে চোখ দিয়ে ধর্ষণ করছে। বাবা,দাদী,আর টিউটর মিসের কাছে থেকেই বাহিরের দুনিয়া আয়ত্ত করে নিতে শুরু করে সে।

তারপরও কি সে রেহায় পেয়েছে?তার জন্য যে বাবা আজ শয্যাশায়ী অবস্থায় হসপিটালে পড়ে আছে!!!পুলিশ কাস্টডি থেকে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।পর মূহুর্তে এক বছর আগের সেই দুর্দিনের কথা মনে পড়ে গেলো।

————

অন্যদিনের মতো সেদিনও তাজওয়ার চৌধুরী তার অফিসে গিয়েছিলেন।তখন বেলা এগারোটা!! বাড়ির ল্যান্ড ফোন কল এলো।দাদীর শরীর অসুস্থ!!আজ কিছুূদিন যাবৎ একদম হাঁটা চলা করতে পারেন না তিনি। তারই সামনে বসে ছিলো চন্দ্ররেখা।ফোনের শব্দে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো সে।পুরো বাড়িতে কেবল সে আর দাদী।এতো বড় বাড়ি তারা দু’জন একা ভাবতেই রেখার বুক কেঁপে উঠলো।দারোয়ান তার বউকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে।দারোয়ানের বউ তাদের রান্নার কাজ করতো।ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাজওয়ার চৌধুরীর আওয়াজ শুনতে পেলো।তার কন্ঠে এক প্রকার তাড়া।

—–“মামণি কি করছো?”

—–“এই তো বাবা দাদুর সামনে বসে ছিলাম। ”

—–“আচ্ছা মামণি বাবা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনো!!আমি ভুলে একটা ফাইল বাসায় রেখে এসেছি,অনেক দরকারী ফাইল। আমি আমার পি.এ সারোয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি দিয়ে দিও।”

——“কিন্তু বাবা দারোয়ান চাচা তো বাসায়….”

সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বে কল কেটে গেলো।চন্দ্ররেখা চিন্তত মুখে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো।তার মনটা কেমন কু ডাকছে,কিছু হবে না তো!!

প্রায় আধঘন্টা পর বাসায় কলিংবেল বেজে উঠলো। ওড়না দিয়ে ভালো মতো মুখ ঢেকে দরজা খুললো চন্দ্ররেখা!!মাঝ বয়সী একটা লোক দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে।মুখ ভর্তি পান নিয়ে দাঁত বের করে বিশ্রিভাবে হেঁসে যাচ্ছে সে!!দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে পান পাতার টুকরো লেগে আছে।সেই দৃশ্য দেখে চন্দ্ররেখার শরীর কেমন ঘিনঘিন করলো।লোকটি আগবাড়িয়ে বলে উঠলো।

—–“আমি সারোয়ার হোসেন। স্যার ফাইলের জন্য আমারে পাঠাইছে। ”

চন্দ্ররেখা কিছুটা আন্দাজ করেছিলো!! তাই হাতে করে ফাইল নিয়ে এসেছিলো।বলার সাথে সাথে ফাইল সেই লোকের দিকে এগিয়ে দিলো। দরজা লাগাবে এমন সময় লোকটি বলে উঠলো,

—–“মা! এক গ্লাস পানি দিবা?বাহিরে অনেক গরম”।

চন্দ্ররেখা তাকিয়ে দেখলো লোকটি ঘামছে।তার বেশ মায়া হলো।লোকটিকে ভেতরে আসতে বলে,কিচেনে গেলো পানি আনতে।
কয়েক মূহুর্ত পরেই দরজা লাগানোর শব্দ হলো, বুকটা ধুক করে উঠলো রেখার।পিছনে ফিরে তাকালো সে।যা সন্দেহ করেছিলো, ঠিক তাই হয়েছে।পান খাওয়ার ফলে জিভ লাল হয়ে গেছে লোকটার। সেই লাল রাঙা জিভ দিয়ে নিজের উপরের ঠোঁট বেশ বিশ্রি ভঙ্গিতে চাটলো। চন্দ্ররেখার মনে হলো তার সামনে হিংস্র ক্ষুদার্থ এক নেড়িকুকুর দাঁড়িয়ে আছে।এ মূহুর্তে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।ভয়ে আতংকে চন্দ্ররেখা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।নিঃশব্দে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।

—-“চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে এক পরী থাকে শুনছিলাম।আজকে সচক্ষে দেইখাও নিলাম।তয় দেখছি যখন একটু টেস্ট না কইরা ছাইড়া দেই কেমনে?”

কথাটি বলে লোকটি যখন চন্দ্ররেখার ওড়নার দিকে হাত বাড়ালো,রেখা তাৎক্ষণাত ফ্লাক্স ভর্তি গরম পানি লোকটির চোখের দিকে ছুঁড়ে মারলো।দু’হাতে চোখ চেপে ধরে লোকটি কান ফাটানো চিৎকার করে উঠলো।সেই সাথে চন্দ্ররেখা অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে লাগলো।

রেখা লোকটিকে সময় দিলো না, ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দিলো।ওড়না বুকের কাছে চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে উপরে চলে এলো।দাদির ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো।আছড়ে পড়লো তার দাদীর বুকে।চন্দ্ররেখার সারা শরীর অসার হয়ে পড়েছে।রেখার দাদী ইয়াসমিন বেগম নিজ থেকে চিৎকার শুনে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।তিনি রেখাকে বুকের ভেতর চেপে ধরলেন।এই মেয়েটার জন্য তার বেশ আফসোস হচ্ছে।এখন সবচেয়ে বেশি আফসোস হচ্ছে নিজের পঙ্গুত্বের ওপরে। দরজা লাগানোর শব্দে সাথে সাথে হাতের কাছে থাকা গরম পানির ফ্লাক্সের ঢাকনা খুলে রেখেছিলো রেখা।ট্রিকটা যে সত্যি কাজে দিবে একটুও ভাবে নি সে।

সেদিন তাজওয়ার চৌধুরী বাসায় আসার পর রেখার দাদী ইয়াসমিন চৌধুরী সবকথা ছেলেকে খুলে বলেন।তাজওয়ার চৌধুরী সারোয়ারের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন।পুলিশ বহু চেষ্টায়ও সারোয়ার হোসেনকে খুঁজে পায় নি।একজন মানুষ এভাবে উধাও হয় কি করে??

কিন্তু সেই ঘটনা রেখার মনে তীব্রভাবে আঁচড়ে কেটে গেলো। এরপর সে নিজেকে ঘরে এক প্রকার বন্দি করে নিলো।কোনো পুরুষ মানুষের গলার স্বর শুনলেও সে ভয়ে কেঁপে উঠতো। নিজের বাবাকেও সে তখন সহ্য করতে পারতো না।তাজওয়ার চৌধুরী মেয়ের এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।মেয়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃণার দৃষ্টি সহ্য করতে পারলেনা। রেখাকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিকের শরণাপন্ন হলেন। দীর্ঘ তিন মাসের চিকিৎসায় রেখা কিছুটা সুস্থ হলেও,মনের পুরোপুরি ভয় সে কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

বেশকিছু সময় ভালো গেলেও,কিছুদিন পর খবর এলো কোম্পানির ইনফরমেশন কে যেনো লিক করেছে।তাজওয়ার চৌধুরীর ব্যবসায় বিরাট লস হলো।এর মধ্যে চৌধুরী গ্রুপে রেইড পরলো।মাদকসহ আটক করা হলো তাজওয়ার চৌধুরীকে।এতো বড় ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে স্ট্রোক করলেন তিনি।সেই থেকে ছয় মাস যাবৎ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন।বাবাকে ছাড়া এই ছয় মাসের প্রতিদিন কতোটা যে দুর্বিষহ কেটেছে সেটা কেবল রেখাই জানে।ছয় মাসের প্রতিটি দিন ছিলো তার কাছে এক বছরের মতো।মেয়ে হয়ে কি বাবার জন্য সে কিছুই করতে পারবে না!!যার জীবনে বাবা মায়ের ছায়া নেই তার মতো উদবাস্তু কি কেউ আছে?এর মধ্যে জীবনে শারাফের অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন ঘটলো।

চলবে

আগের পর্বে একটু ভুল হয়েছে,এডিট করে দিয়েছি আমি।
আর গল্প সাজিয়ে লেখার জন্য অনেক ভাষারই প্রয়োগ করতে হয়। আশা করি কেউ নেগেটিভভাবে নিবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here