চাদোঁয়া মহল পর্ব -০৫

#চাদোঁয়া_মহল
পর্বঃ০৫
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

এই ছয় মাসে তাদের জীবনের গতিপথ পুরোটাই যেন বদলে গেছে।তাদের আগের সেই বাড়িটা তারা ছেড়ে দিয়েছে। দাদিকে সাথে নিয়ে কমদামের ভাড়া বাসায় উঠেছে। চন্দ্ররেখার নামে তার বাবা দুটি ফ্লাট বরাদ্দ রেখেছিলো।শহরের এপার্টমেন্টগুলোর রেন্ট মোটামুটি বেশি। তা দিয়ে তাদের সংসার কোনোরকমে চলে যেতো।কিন্তু মাঝে বাবার চিকিৎসার খরচ সামলাতে যেয়ে হিমশিম খেতে হতো চন্দ্ররেখাকে!!!!এই কিছু সময়ে চন্দ্ররেখা উপলব্ধি করেছে যে কোনো সমস্যা থেকে পালিয়ে বেড়ানো কোনো সমাধান হয় না।বরং সাহসের সাথে সেই সমস্যার নিষ্পত্তি করতে হবে।বাবার জন্য যে লড়তে হবে তাকে!!নিজেকে আপাদমস্তক ভালোভাবে আবৃত করে সে লোকাল বাসে চড়েছে, বাজারে গিয়েছে, বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কোর্টের দারস্থ হয়েছে। বহু নরপশুর চোখে তার নিজের জন্য সে লালসা দেখেছে।দেখেছে প্রতিনিয়ত কি করে মেয়েরা রাস্তায় যৌ’ন হয়রানির শিকার হয়েছে!!চন্দ্ররেখার মনে প্রগাঢ় ধারণা ছিলো,তার প্রলয়ংকরী রূপের জন্য হয়ত সে পুরুষের রূপমোহের লক্ষ্য হয়েছে।কিন্তু যেদিন সে দেখেছে দশ বছরের এক ফুল বিক্রেতা মেয়ের সংবেদনশীল অঙ্গে মাঝবয়সী এক লোকের কুৎসিত দৃষ্টি সেদিন থেকে তার মনের বদ্ধমূল সেই ধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।চন্দ্ররেখার দুর্ভাবনা হয় এসবের জটিলতার মধ্যেই হুট করে শারাফকে জড়িয়ে সে ভুল কিছু করে নি তো!!

————–

এক সপ্তাহ আগে,

নিত্যদিনের মতো বাবাকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিলো চন্দ্ররেখা।আইসিইউয়ের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে,বাসার যাওয়ার উদ্দেশ্য বের হয়েছে।এমন সময় বোকা বোকা চেহারার এক লোক মুখে হাসি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। চন্দ্ররেখা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো।লোকটি একটি কাগজ তার দিকে এগিয়ে দিলো।কিছু একটা মনে করে, চন্দ্ররেখা কাগজটি হাত নিয়ে নিলো।কাগজটি খুলে ভিতরের লেখাটি সে পড়লো।মুহূর্তে তার মুখের রং পরিবর্তন হয়ে গেলো!!মাক্সে মুখ ঢাকা থাকায় সামনে থাকা লোকটি হয়ত বুঝতে পারলো না।রেখার খোলা চোখ দুটি জ্বল জ্বল করে উঠলো।হন্তদন্ত পায়ে সে পথ চলতে শুরু করলো,তার পিছন পিছন সেই লোকটিও হাঁটা ধরলো।

————-

চামচের টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। আশেপাশের মানুষ খোশমেজাজে গল্প করছে।দূরে থাকা দশ/বারো জন ছেলেমেয়েদের একটা গ্রুপ থেমে থেমে হইচই করছে।চন্দ্ররেখা সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে টেবিলে থাকা মেনু বুকে নজর দিলো।ফুড স্টেশন রেস্টুরেন্টে বসে আছে সে।এখানে এসেছে ইতিমধ্যে পনেরো মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে!! বেশ বিতৃষ্ণাবোধ করলো চন্দ্ররেখা।আচমকা কেউ একজন চেয়ার টেনে সামনে তার সামনে বসে পড়লো।সামনে থাকা সুদর্শন পুরুষকে দেখে রেখার শ্বাস কি থেমে গেলো!!রেখা ডান হাত তার বুকের ওপর চেপে ধরলো।

পরনে হালকা আকাশি রঙের একটা ফর্মাল শার্ট সাথে ফর্মাল জিন্স।লোকটির গৌরবর্ণের দেহে শার্টটি কেমন সেঁটে আছে!!ওয়েল ট্রেন্ড বডি!!!নিয়মিত জিম করে বিধায় হয়ত এমন।বা’হাতে রোলেক্সের একটা ঘড়ি।পাতলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে,গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,চোখ দুটো ভীষণ শীতল,স্নিগ্ধ!!ছেলের মানুষ রূপও যে ঠিকরে পড়তে পারে,সামনে থাকা পুরুষটিকে না দেখলে বিষয়টি হয়ত তার কাছে অজানাই থাকতো!! চন্দ্ররেখা চোখ সরিয়ে নিলো।পুরুষোচিত কন্ঠ কানের পর্দায় বেজে উঠতেই,রেখার বুকে কিছু একটা কামড়ে ধরলো।

——“আপনার জন্য কি অর্ডার করবো,চন্দ্ররেখা?”

সামনে থাকা ব্যক্তিটি তার থেকে তো বেশ বড়োই হবে!!তারপরও তাকে আপনি বলে সম্মোধন করায় রেখা বেশ অবাক হলো।চন্দ্ররেখা নামটা কি আসলেও সুন্দর?? নাকি এই লোকটির কন্ঠের জন্য এতো সুস্নিগ্ধ মনে হচ্ছে!! ছি,কি ভাবছে সে!!এখানে আসার উদ্দেশ্য কি ভুলে গেছে রেখা!!শক্ত কন্ঠে রেখা জবাব দিলো,

—-“আমি এখানে খেতে আসি নি!!আপনি আমার কাছে যে কাগজ পাঠিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিলো,আমার বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।আমি এখানে সেই ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি!!”

——“বাবাকে নির্দোষ প্রমাণের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলেও শক্তি দরকার আর সেজন্য নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া করা প্রয়োজন।আমরা খেতে খেতে কথা বলি!!”

সামনে থাকা পুরুষটির মুখনিঃসৃত বাক্যের বিপরীতে,চন্দ্ররেখা কড়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো।ওয়েটার অর্ডার নিতে আসায় সে দমে গেল।অচেনা লোকের সামনে বসে থাকতে তার ভীষণ বিরক্তের সাথে তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু বাবার ফিরে পেতে হলে যে তার সবকিছু সহ্য করতে হবে।চন্দ্ররেখা একটা বিষয় লক্ষ্য করলো লোকটি আসার সাথে সাথে যেনো পুরো রেস্টুরেন্ট মূহুর্তেই ফাঁকা হয়ে গেছে।দূরে কেবল রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। তার পাশে হসপিটালের সেই কাগজ দেওয়া লোকটি দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

——“আরিফ!!”

সম্মুখে থাকা লোকটির গুরুগম্ভীর শব্দে রেখার ধ্যান ভাঙলো।ওয়েটার তার কাঙ্ক্ষিত অর্ডার নিয়ে চলে গেছে।সে লক্ষ্য করলো,, ম্যানেজারের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

——“জি স্যার,এখনই দিচ্ছি।”

কথাটি বলে আরিফ নামের লোকটি রেখার দিকে একটা ফোন এগিয়ে দিলো।তারপর আগের জায়গায় চলে গেলো!! ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চন্দ্ররেখার সারা দেহে কম্পন উঠলো।দৃষ্টি কেমন অস্পষ্ট হতে লাগলো!!

সারোয়ার নামের কদর্য সেই লোকটি চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।দেখে বুঝা যাচ্ছে বেশ টর্চার গেছে তার ওপর দিয়ে। কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে বলছে,

—-“তাজওয়ার চৌধুরীর কোনো দোষ নাই,যা করার আমি করছি!!সব দোষ আমার।”

চন্দ্ররেখার সামনের চেয়ারে থাকা লোকটি ছোঁ মেরে ফোনটি নিয়ে নিলো।রেখার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো।কিছু না ভেবে মুখের মাক্সটি খুলে রেখা ঢকঢক করে পানি খেলো। ঠোঁটের পাশ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।সামনে বসে থাকা লোকটিকে অসংলগ্ন করতে এতোটুকই যথেষ্ট ছিলো। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মানুষটি।

কয়েকমাস আগের সেই স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠায়;চন্দ্ররেখার নিজেকে ভারসাম্যহীন লাগতে শুরু হয়েছিলো।বহু কষ্টে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে সে।এই ছয় মাসে বহুকষ্টে সে নিজেকে গড়ে তুলেছে। এক শক্ত খোলসে আবৃত করেছে।হাতে কারো উষ্ণ ছোঁয়া পেতে চন্দ্ররেখার ঘোর কাটলো!!লোকটি তার হাতের উপর আলতোভাবে হাত রেখেছে।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে,কি মমতাপূর্ণ সেই চাহনি!!চন্দ্ররেখার মনে হলো বাবার পড়ে সবচেয়ে ভরসা যোগ্য হাতের সন্ধান সে পেয়েছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে হাত সরিয়ে নিলো।এর মধ্যে ওয়েটার অর্ডারকৃত খাবার নিয়ে হাজির হলো।খাবারের গন্ধ নাকে প্রবেশ করতেই পেট মুচড়ে উঠলো।আজকাল এতো ভাবনার মাঝে ঠিকঠাক খাওয়াই হয়ে উঠে না তার।সামনের মানুষটি অতি যত্ন সহকারে প্লেটে খাবার তুলে দিলো।চন্দ্ররেখার হৃদয় হুহু করে উঠলো, কতোদিন হলো বাবা সাথে খাওয়া হয় না তার!!বাবা সবসময় ঠিক একভাবে সযত্নে রেখার পাতে খাবার বেড়ে দিতো!!মাঝে মাঝে ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে ধরতো মুখে।প্রচুর কষ্টে কান্না আটকাতে সক্ষম সে।খাওয়া শেষ হতেই,চন্দ্ররেখা সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো,

——“আমার কাছ থেকে কি চান?কোনো কারণ তো অবশ্যই আছে!শুধু শুধু বা আমার উপর অনুগ্রহ করবেন কেন?”

—–“গোটা অপ্সরাকে হাসিল করাই যে আমার একমাত্র বাসনা।বিয়ে করতে চাই আপনাকে।”

মানুষটির ঠোঁটের কোনে স্মিথ বাঁকা হাসি ঝুলে আছে। বাক্যগুলো কানে পৌঁছতেই চন্দ্ররেখার নজরে কাঠিন্যে ভর করলো। দাঁতে দাঁত চেপে সে জবাব দিলো,

——“আপনার মতো হীন ও নীচ মানসিকতার পুরুষের জন্য আজকে আমাদের এই সমাজের মেয়েরা অনির্বিঘ্ন।”

চন্দ্ররেখার কথাটি কর্ণধারে আঘাত করতেই মানুষটির চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।চোখের কার্ণিশে রক্তিম আভা জমা হলো।চেয়ার ঠেলে শব্দ করে উঠে দাঁড়ালো সে!!তরতর করে এগিয়ে এলো চন্দ্ররেখার দিকে।রেখার চেয়ার কিছুটা ঠেলে সরিয়ে দিলো।আওয়াজ করে ডান হাত চেয়ারে ও অপর হাত টেবিলের ওপরে রাখলো। দুপাশ থেকে রেখাকে আবদ্ধ করে নিলো।দীর্ঘকায় শরীরটা কিছুটা ঝুকিয়ে রেখার মুখ বরাবর নিজের মুখ আনলো।ডান হাত দিয়ে রেখার মুখে মাক্স টেনে থুতনিতে আনলো।তারপর দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষীণ কন্ঠে বলতে শুরু করলো,

——“পাশে একটা ফাইভ স্টার হোটেল আছে।একত্রে এক রাত কাটিয়ে আসি!প্রতিশ্রুতি দিলাম অভিযোগের কোনো সুযোগ দিবো না।আমার সাথে একরাত থাকলে নিজেকে আপনার পরিপূর্ণ মনে হবে।”

নিজেকে সে যতোই শক্ত রাখুক না কেনো, এমন পরিস্থিতি মিমাংসা করার মনোভাব যে তার নেই!!!ভয়ে,আতংকে রেখার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সামনে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলো।বক্ষ উত্তেজনায় দুরুদুরু করতে লাগলো।চোখের প্রান্ত থেকে নোনাজল গড়িয়ে, চন্দ্ররেখার কোমল লালচে কপোলে ভূমিষ্ট হলো ।সেদিকে নজর পড়তে সামনে থাকা মানুষটি সরে দাঁড়ালো।কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।পুনরায় চেয়ারে বসে পড়লো।

——“একটু আগের যে কথাগুলো আপনাকে বলেছি,সেগুলো একজন হীন ও গর্হিত মানুষের বচন ভঙ্গি।এই কথাগুলো যদি আপনাকে আমি শুরুতেই বলতাম,তাহলে আমাকে নীচ বলা আপনার জন্য সার্থক হতো।”

চলবে

আগামীকাল গল্প আসবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here