#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ১২
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
পিচ ঢালা চওড়া রাস্তা।দু’ধারে নজরকাড়া কাশফুল।অপরাহ্নের ঝিরিঝিরি ঠান্ডা হওয়ায় কাশফুলগুলো হালকা দুলছে।শুভ্র আকাশের নিচে দক্ষিণা হাওয়ায় দুলে ওঠা থরে থরে কাশফুলের সৌন্দর্য মোহনীয়।কাশবনের এই অপার রূপের দর্শন পেয়ে চন্দ্ররেখার বিচলিত মন কিছুটা শান্ত হয়েছে!এক চিলতে স্বস্তির পরশ বয়ে গেছে হৃদয় জুড়ে।গাড়ির জানালা দিয়ে কাশবনকে রীতিমতো নিরীক্ষা করছে সে।অপরদিকে শারাফ ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে তার অপ্সরাকে অবলোকন করছে।রেখা বর্তমান মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে।
হসপিটাল থেকে বের হয়ে এক প্রকার জোর করে রেখা নিয়ে লাঞ্চ করছে শারাফ!সেখান থেকেই রেখাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছে।রেখার দৃষ্টি সামনে,রাস্তার পাশে বিশাল বড় একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে!সেখানে কিছু লেখা।গাড়ি যতো এগোচ্ছে লেখাটা ততো স্পষ্ট হয়ে আসছে’মির্জা গ্রুপ ওফ ইন্ডাস্ট্রিজ”ফাউন্ডার চাহান মির্জা;কোম্পানিটি দীর্ঘ সাতাশ বছর যাবত প্রতিষ্ঠিত।
ইতিমধ্যে তাদের গাড়িটি সাইনবোর্ড অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে।বিশাল বড় একটা গেইটের সামনে আসতেই গাড়িটি থেমে গেল।গেইটের ওপরে সাইনবোর্ডের ন্যায় একই লেখা।দারোয়ান শারাফের গাড়িটি দেখে তড়িঘড়ি করে গেইট খুলে দিলো!গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করতে চন্দ্ররেখা বেশ বিস্মিত হলো।গ্রাম ও শহরের মাঝামাঝি জায়গায় মির্জা গ্রুপের কোম্পানি গড়ে তোলা হয়েছে।দূর থেকে বেশ ছোট মনে হলেও,ভিতরে কমপক্ষে ষাট একর জায়গা জুড়ে কোম্পানির বিভিন্ন সেক্টরের বিল্ডিং ও গোডাউন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।চারটে বিল্ডিং মাঝারি সাইজের।দুটি সেক্টর সম্পূর্ণ শারাফের তত্বাবধানে!বাকিগুলোর দায়িত্বে আছেন সুধা মির্জা,হামিদ মির্জা ও হাফিজ মির্জা।তাদের অধীনে মূলত ভোগপণ্য,কাগজ ও তন্তু শিল্পের কাজগুলো সম্পন্ন হয়।তাদের কোম্পানি খুব বেশি ছোট বলাও চলে না।খুব শীঘ্রই মাসুককেও তার সেক্টরের এর দায়িত্ব দেওয়া হবে।এক বছর যাবত প্রোডাক্টগুলো স্বল্প পরিসরে দেশের বাহিরে এক্সপোর্ট করা হয়।ফ্যাক্টরি,অফিস,গোডাউন সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ এলাকা বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরাও করা!সেই সাথে সিসিটিভি আওতাভুক্ত।বিল্ডিংগুলো ছোট হলেও বেশ অত্যাধুনিক ভাবে তৈরি!শারাফের অফিস ভবনটি বাকিগুলো থেকে কিঞ্চিৎ বড়।
রেখার বাবার নিজেরও বেশ বড় কোম্পানি ছিলো।তাজওয়ার চৌধুরীর খুব ইচ্ছে ছিলো মেয়ের হাত ধরে তাদের পুরো কোম্পানি ঘুরে বেড়াবেন!মেয়েকে ঘরের বাহিরে নেওয়ার জন্য কত-শত চেষ্টা করতেন তিনি।রেখাকে স্বাভাবিক করার জন্য কত কান্ডই না করেছে!কিন্তু রেখাকে কোনোদিন জোর করতে পারেন নি।চন্দ্ররেখা ভেবেছিলো,একদিন হুট করে সে তার বাবার অফিস হাজির হয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিবে!কিন্তু সেই সারপ্রাইজ দেওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।রেখা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,বিড়বিড় করে বললো,
—-” বাবা!দেখো!তোমার আজ মেয়ে তার স্বামীর সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছে।মনের সব ভয় ভীতি কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়েছে।”
শারাফ গাড়ি থেকে নেমে,রেখাকে নামলো।তার হাত ধরে নিজের সেক্টরের একটা বিল্ডিংয়ের প্রবেশ করলো।বেশ সময় নিয়ে শারাফের আওতাধীন সেক্টরগুলো ঘুরে দেখলো।পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক সকলে একাগ্রচিত্তে নিজেদের কাজ করছে।এখানে মহিলা শ্রমিকদের জন্য স্পেশাল ফ্যাসিলিটিস রয়েছে,যা দেখে রেখা বেশ খুশি হলো।রেখা এখানে এসে আরিফ সম্পর্কে একটি তথ্য জেনে বেশ অবাক হয়েছে।আরিফ কোম্পানির ম্যানেজারের পাশাপাশি শারাফের আপন মামাতো ভাই।অথচ তাকে দেখে সে বুঝতেই পারে নি!আরিফের মধ্যে শারাফের জন্য এক অদৃশ্য মান্যতা আছে।সব শেষে শারাফ চন্দ্ররেখাকে নিয়ে তার কেবিনে উপস্থিত হলো।চন্দ্র রেখা উৎসুক দৃষ্টিতে সবকিছু পরখ করছে।
চাঁদোয়া মহলের হলরুমের সাইজের কেবিন।কি সুন্দর!পরিপাটি করে গুছানো।চন্দ্ররেখা পুরো কেবিন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।পূর্ব পাশে ছোট খাট একটা ছাদও রয়েছে।কেবিনের সবকিছুই সাদা!চেয়ার,টেবিল, একপাশে থাকা সোফা থেকে শুরু করে কফি খাওয়ার মগও সাদা।অবশ্য শারাফের কক্ষের সব আসবাবপত্রও এমন সাদা!কেবিনে থাকা শ্বেত শুভ্র রঙের জিনিসগুলো কেমন চকচক করছে।শারাফ রেখার দিকে এগিয়ে গেলো,মৃদু স্বরে বলতে লাগলো,
—–“আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি!ফুপু মায়ের সাথে দেখা করে আসি,জরুরি কথা আছে।”
চন্দ্ররেখা মাথা নাড়ালো।শারাফ কিছুটা কাছে এসে রেখার গালে হাত রাখলো! পুনরায় বিচলিত কন্ঠে বলল,
—–“আপনি কিন্তু কোথাও যাবেন না!!কোনোকিছুর দরকার হলে কেবিনে থাকা ল্যান্ডফোনে কল করবেন,আর খুব বেশি দরকারী কিছু হলে আমাকে কল করবেন…ওকে?”
চন্দ্ররেখা তার গালে থাকা শারাফের হাতের ওপর হাত রাখলো।হয়ত এই সম্পর্কটা এগিয়ে নেওয়ার ছোট্ট একটা প্রয়াস!চাপা হাসলো,শারাফকে আশ্বস্ত করতে মুখে বললো,
—“ঠিক আছে।”
শারাফ তার কেবিনে বাহিরে আরিফকে রেখে সুধা মির্জার অফিস দিকে হাঁটা ধরলো।দুইটা গোডাউনের পর সুধা মির্জার ছয়তলা অফিস বিল্ডিং।
কেবিনের পূর্ব পাশে থাকা থাইয়ের স্লাইডিং ডোর।দরজাটির ওপরে থাকা পর্দা সম্পূর্ণ সরানো,সেখান থেকে গোধুলির আলো আসছে।রেখা সেদিকে এগিয়ে গেল,ডোরটি একপাশে সরিয়ে মিনি ট্যারেসে প্রবেশ করলো।শারাফের কেবিনের অবস্থান টপ ফ্লোরে।এখানে থাকা চারটি ভবনের মধ্যে এটি সবচেয়ে উঁচু!আটতলা থেকে আশেপাশের ভিউ দেখে রেখা বেশ উৎফুল্ল অনুভব করলো।ফ্যাক্টরির এলাকা পুরো আভিজাত্যে মোড়ানো।বিল্ডিং অপেক্ষা গোডাউনে সংখ্যাই বেশি!ছাদ থেকে আশপাশ বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। নিচের কার্যরত মানুষগুলোকে দেখতে মাঝারি সাইজের লাগছে!উত্তর পাশে তাকাতেই রেখা থমকে গেল।
এতো আধুনিকতার ভিড়ে পরিত্যক্ত একটি গোডাউন,বড্ড বেমানান!বেশ কয়েক বছর পুরনো মনে হচ্ছে।ছোট্ট পরিত্যক্ত গোডাউনটি দেখতেও বেশ ভুতুড়ে!একপাশের দেয়াল আংশিক ক্ষয় হয়ে গেছে,যেকোনো সময় ধসে পড়বে!বাকি দেয়ালগুলোতে শ্যাওলার পুরু আস্তরণ পড়ে আছে,জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার ভেঙে ইট দেখা যাচ্ছে।সেগুলো রং চটে বিশ্রী একটা বর্ণ ধারণ করেছে। সবকিছু থেকে গোডাউনটিকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে।সেদিকে তেমন একটা মানুষও দেখা যাচ্ছে না!উত্তর পাশের এক কোনায় গোডাউনটির অবস্থান,তাই পেছন দিকটা ঠিক মতো বোঝাও যাচ্ছে না।সেখাকার মাটিও কেমন রুক্ষ শুষ্ক!দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিষাক্ত ক্যামিকেলের প্রভাবে এমন হয়েছে।কিন্তু এমন জায়গায় ক্যামিকেল কি করে!গোডাউনের পেছনের বাউন্ডারি সীমানা কিছুটা ভাঙা।যদিও বেশ আবর্জনা জমেছে আছে জায়গাটিতে কিন্তু অনায়াসে দু’জন মানুষ আসা যাওয়া করতে পারবে।এতো বড় বিষয়টি কারো নজরেই পড়ে নি!বিষয়টি রেখার কাছে বেশ অদ্ভুত মনে হলো।শারাফ তো আজ দু’বছর যাবৎ নীটওয়্যার ও হাউজিং সেক্টরের দায়িত্ব পালন করছে,তার চোখেও কি বিষয়টি ধরা পড়ে নি!!
রেখার বুকটা কেমন ধক করে উঠলো, এতো অস্থির লাগছে কেন তার!গোডাউনটিকে ভালোভাবে পরখ করলো।আচমকা বাউন্ডারির ভাঙা অংশে নজর পড়লো,বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।দীর্ঘ পাঁচ মিনিট তাকিয়ে থেকে রেখা সম্পূর্ণ বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করলো।মানুষটির তো সাহায্যের প্রয়োজন!তড়িঘড়ি করে ছাদ থেকে কেবিনে প্রবেশ করলো,একবার ভাবলো শারাফকে কল করবে।পরমুহূর্তেই মনে পড়লো তার কাছে তো শারাফের নম্বর নেই।কোনো কিছু না ভেবেই রেখা হুড়মুড় করে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। আরিফকেও কোথাও পেল না!লিফটে চড়ে নিচে নেমে এলো।অতপর সেই গোডাউনের দিকে অগ্রসর হলো।হাতের ফোন ও পার্স কেবিনেই পড়ে রইলো।
————-
নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছেন সুধা মির্জা।নিবেশিত সে চাহনি শারাফের দিকে।তারা উভয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে বসে আছে!একসময় ছেলেটির চোখে তার জন্য অগাধ সম্মান ছিলো,আজকাল সেই চোখে তাকালে তিনি বিতৃষ্ণা দেখতে পান।কতো বড় হয়ে গেছে শারাফ!এই ছেলেটি তো সেদিন তার ছোট ছোট হাত দিয়ে চোখে পানি মুছে দিয়েছিলো।বলেছিলো,”ফুপুমা তুমি কেঁদো না,তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।”
কতোদিন আগের ঘটনা যেনো এটা?আশ্চর্য তার কিছু মনে পড়ছে না কেনো!!আজকাল কিছুই মনে থাকে না।মাঝে মাঝে মনে হয়, ব্রেনে জং ধরে গেছে। মনে পড়েছে,পঁচিশ বছর আগের ঘটনা!!বিষাদময় স্মৃতিগুলো যে চিরকাল তারা করে বেড়ায়।চাইলেই কি ভোলা যায়?সুধা মির্জার মুখে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো। শারাফের কন্ঠ স্বরে ধ্যান ভাঙলো তার।
—–“আমাকে ডেকেছিলেন?”
—–“বিয়ে করেছো অথচ একবার জানানোর প্রয়োজনও মনে করো নি?”
——“জানালে কি হতো!”
শারাফের সোজাসাপ্টা জবাব।সুধা মির্জা কিছুটা দমে গেলেন।প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন।
——“ঝিল্লিপুরে তো মেয়ের অভাব ছিলো না?চন্দ্ররেখাকেই কেন বিয়ে করলে!
শারাফের ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো।সুধা মির্জার দিকে৷ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,পরিহাসের গলায় বলে উঠলো,
—–“আপনার সুবিধার কথা চিন্তা করেই অপ্সরাকে বিয়ে করেছি। সবসময় তো দূর থেকেই তাদের পরিবারের ওপর নজর রেখেছেন।তাই ভাবলাম বিয়ে করে আমার কাছে নিয়ে আসি!আপনার আর কষ্ট করতে হবে না।তাছাড়া সময় থাকতে ভালোবাসার মানুষকে আগলে নিতে হয়!!প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কেঁড়ে নিতেও দোষ নেই।”
শেষ কথাটি বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।সুধা মির্জা আহত দৃষ্টিতে তাকালেন।এতোদিন যা ভয় পেয়েছিলেন সেটাই হয়েছে!আংশিক ব্যাপারটি হয়ত শারাফের কাছে পরিষ্কার। যখন সমস্ত সত্যটি জানতে পারবে তখন কি তাকে ঘৃণা করবে?চন্দ্ররেখাও কি তাকে ভুল বুঝবে!সুধা মির্জার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।তিনি কারো পরোয়া করেন না,সবাইকে তার কর্মের শাস্তি দিবেন।পঁচিশ বছরে পাওয়া সমস্ত আঘাতের হিসেব তিলে তিলে চুকাবেন তিনি।শারাফের কন্ঠ পেতে ভাবনা থেকে বের হলেন।সুুধা মির্জা দিকে একটা পার্স এগিয়ে দিলো,আগের মতো পরিহাস করে বলতে লাগলো,
——“রোগী দেখতে যাবেন ভালো কথা!তাই বলে চোরের মতো!কিন্তু কেন?চৌধুরী সাহেব তো সম্পর্কে আপনার বেয়াইন লাগে,সে হিসেবে তাকে দেখতে যাওয়া স্বাভাবিক। নাকি এর বাহিরেও তার সাথে আপনার অন্য কোনো সম্পর্ক আছে?
শারাফ বিশ্রি ভঙ্গিতে ভ্রু নাচালো।সুধা মির্জা শারাফের নাম ধরে গর্জে উঠেন।হাত তুললেন, চড় মারতে যেয়েও থেমে গেলেন।তার মাথা ঝিমঝিম করছে,চোখ কোনের শ্বেত অংশ ইতিমধ্যে রক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে, বিষাদ মাখা অশ্রু ঝরে পড়ছে।গলা কাঁপছে।শরীর অসার হয়ে আসছে।তারপরেও কন্ঠে যথার্থ তেজ বজায় রেখে বলতে লাগলেন,
—–“চন্দ্ররেখা তার বাবাকে নিয়ে তোমার এই কুৎসিত মন্তব্য সহ্য করতে পারবে তো শারাফ?থাকবে তো তোমার সাথে!
চলবে