চুক্তির বিয়ে পর্ব ৯,১০ এবং শেষ

###__চুক্তি_বিয়ে__###”
পর্ব -৯+১০(শেষ)

তন্ময় সোহার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার মাথায় কি হয়েছে? তুমি কথা বলছো না কেন?
– তুমি আমাকে মেরেছো, এখন আবার জিজ্ঞেস করছো?
– আমি তোমাকে কেন মারবো?
– মনে পড়ছে না তোমার? কি হয়ে যায় তোমার? কে মারবে তোমায়, কেন এসব করো মনে হচ্ছে কিছু?
– না, আমার কিচ্ছু মনে পড়েনা। উফ্, কি হয়েছে আমার। আমি আমি…
বলে তন্ময় মাথা খামচে ধরলো।
– থাক কিছু মনে করা লাগবে না। এখন বলো তুমি আর আমাকে দেখে রাগবে না তো?
– না, কিন্তু তুমি কে?
– আমি! আমি তোমার বউ!
– বউ! আমি তোমাকে বিয়ে করছি..!?
সোহা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, হুমম। তুমি ভুলে গেছো। এখন এসব বাদ দেও। তুমি শুয়ে থাকো, আস্তে আস্তে সব মনে পড়বে। আমি আসছি একটু পরে।
কিছুক্ষন পরে সোহা বাচ্চা টা কে নিয়ে রুমে ঢুকলো, ” এই দেখো আমাদের ছেলে, ওর নাম আমি রাখবো শান। ও আমাদের শান, সম্পদ। বলে সোহা তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তন্ময় তখন রাগে ফুঁসছে, ও চিৎকার করে বললো, যাও ওকে নিয়ে বেরিয়ে যাও। আমি ওকে সহ্য করতে পারছি না। তারপর বালিশে মাথা চেপে ধরলো।
সোহা এসব দেখে নিরবে বেরিয়ে গিয়ে বাচ্চা টাকে রেখে আসলো।
তন্ময় শুয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সোহা তন্ময়ের পিঠে হাত রেখে বললো, ঠিক আছে আমি ওকে আর তোমার কাছে আনবো না। তুমি শান্ত হও, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তুমি ঘুমাও।
সোহা তন্ময়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আর তন্ময় সেই পরশে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সকাল বেলা থেকে তন্ময়ের খুব বেশি জ্বর হলো। জ্বরের ঘোরে বেহুশ হয়ে পড়ে রয়েছে।
ডাক্তার এসে দেখে বললেন, এতদিন সিডাকটিভ ওর শরীরে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে তা বন্ধ করে দেওয়ায় এই অবস্থা। তিনি ইনজেকশন আর ঔষদ লিখে দিলেন।
– এই ইনজেকশন গুলো দিলে ঔষদের প্রতিক্রিয়া কেটে যাবে আর নিয়মিত ঔষদ গুলো ও খাওয়াতে হবে। আশা করি তন্ময় পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে।

একটানা ১৫ দিন জমে মানুষে টেনে তারপর তন্ময় কিছুটা সুস্থ হলো। কিন্তু মাথা পুরোপুরিভাবে কাজ করে না। সোহা এই কয়দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে তন্ময় কে সুস্থ করে তোলার জন্য।

তন্ময় সুস্থ হওয়ার পর সবার সাথে কথা বলছে, সবাইকে চিনেছে। কিন্তু এখনও মনে করতে পারছে না কেন নীরা তাকে ছেড়ে চলে গেল। কাদের সাথে কি বিষয় নিয়ে শত্রুতা মনে করার চেষ্টা করলেই মাথাটা কেমন করে উঠে। এবং এখন ও শান কে ওর কাছ থেকে আড়ালে রাখা হয়।

সোহা আজ সারাদিন থেকে তন্ময়ের রুমে আসেনি। ও ভাবছে, এটা চুক্তি বিয়ে কোন বৈধ সম্পর্ক নয়।। যত সামনে যাবো ততই জড়িয়ে যাবো। কিন্তু তাও কি জড়ায়নি? সোহা বুঝতে পারছে ও তন্ময়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। তন্ময়ের ঔষদ, গোসল, ঘুম, খাওয়া সবকিছুর দেখাশুনা সোহা একাই করছে। রাত জেগে তন্ময়ের সেবা করেছে, ঘুমের ঘোরে তন্ময় তাকে কতদিন জড়িয়ে ধরেছে। এ যেন এক অন্যরকম অনুভুতি। সোহা বাধা দেয়নি। কিন্তু আর নয়, এখন থেকে ওকে দূরে দূরে থাকতে হবে।
তন্ময়কে ভুলে থাকার জন্য আমাকে শান কে নিয়ে ব্যস্থ থাকতে হবে। আর একটা মাস কোনমতে কাটিয়ে দিলে আমার চুক্তি শেষ। শানকে নিয়ে বসে বসে এসব ভাবছে সোহা।
শান এখন হামগুড়ি দেয়, খিলখিল হাসে, ওকে মাম্মাম ডাকে। সারা বাড়ির চোখের মনি এখন শান। মিনহাজ সাহেব ও শান কে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারেন না।

এদিকে নীরা ও ধরা পড়েছে ঐ ডাক্তারের স্বীকারুক্তি তে। ওরা তন্ময় কে পাগল করার চেষ্টা করেছে। নীরা বলেছে- তন্ময় অনেক ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিল, ইন্টারনিশীপ এর সময় ও এমন একটা ঔষদ আবিস্কার করেছে যেটা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এটা এমন এক ধরনের ঔষদ যেটা দিয়ে মানুষকে যেমন বাঁচানো যায়, তেমনি মারাও যায়। কিন্তু কোন ডাক্তার তা ধরতে পারবে না।তাই ওকে প্রেমের অভিনয় করে ফাঁসায় ওই ফরমুলা আর ঔষদ হাত করার জন্য। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে তন্ময়ের বাবা মা বিয়ের প্রস্তাব দিবেন ভাবে নি। কিন্তু ফরমুলার জন্য তন্ময়কে বাধ্য হয়ে বিয়ে করে। তন্ময়কে অনেক বলার পর ও তন্ময় নীরাকে ঐ ফরমুলা দেখায়নি, এজন্য ও বউ সেজে ঐ বাড়িতে থেকে ফরমুলা টা খুজে বের করার চেষ্টা করে, সাথে তন্ময়কে পাগল করার জন্য ওর দুধের সাথে প্রতিদিন ঔষদ খাওয়ানো শুরু করে।
এর মধ্যে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে বুঝতে পারে নি ও কখন প্রেগন্যান্ট হয়। নীরা বাচ্চা এবরশন করাতে চাইলে তন্ময় বাধা দেয়, তখন থেকে ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়। নীরা বলে যদি আমাকে ঐ ফরমুলাটা দেও তাহলে আমি বেবি নেবো নাহলে না। কিন্তু তন্ময় ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে যায়। তাই ও বলে বাচ্চা হয়ে গেলে ফরমুলা তোমাকে দেবো। কিন্তু তন্ময় ফরমুলা নীরা কে দেয়নি। যেদিন বেবি হয় তার আগের দিন নীরা ফরমুলা চুরি করে। বেবি হওয়ার পর ওকে হসপিটালে রেখে ফরমুলা নিয়ে চলে যায়। এটা বুঝতে পেরে যায় তন্ময়। তন্ময় ওর কাছে ঔষদ আর ফরমুলা দিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। বুঝায় ওকে এতে অনেক মানুষের জীবন মরনের প্রশ্ন। ততদিনে নীরা তাদের সব সাঙ্গপাঙ্গ দের নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেটাও তন্ময় জেনে যায় আর তাই ওরা পাগলের ডাবল ডৌজ দিয়ে ওকে মানসিক ভাবে পুরা অসুস্থ করে দেয়। ঐ ডাক্তার ও তাদের সাথের একজন, ডাক্তার তন্ময় কে ড্রাগ দিয়ে এমন সব ভয়ংকর জিনিস ওর চোখের সামনে আনতো, তন্ময় পুরোপুরিভাবে পাগল আর ভয় পাওয়া শুরু করে। বাচ্চা টাকেও ওরা ভয়ের উপকরন বানিয়ে দেয়। তাই তন্ময় এখন ও বাচ্চাকে সহ্য করতে পারে না।
পুলিশ এসব কথা শুনে হসপিটালের নাম অনুযায়ী তদন্ত করে জানতে পারে এই ফরমুলা আর ঔষদ দিয়ে ওরা আরও ভয়ংকর ঔষদ বানিয়েছে। আর ওরা একটা গ্যাং, কিডনি চুরি করে বিদেশে পাচার করে ওদের মাধ্যমে অনেক মানুষ মারা গেছে।
নীরা আর ডাক্তারের দেওয়া তথ্যানুযায়ী সবাইকে ধরা হয় আদালত ওদের যাবতজীবন কারাদণ্ড শাস্তি দেয়।

একদিন সকালে সোহা শানকে নিয়ে লনে হাটছে। এমন সময় তন্ময় আসলো ওর পাশে। সোহা তন্ময়কে ভয় পেয়ে শানকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কাছ থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো।
– সোহা দাঁড়াও, যেওনা। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– জ্বি, কি কথা বলুন।
– আগে তো তুমি করে কথা বলতে এখন আপনিতে চলে আসছো?
– দেখুন আগে আপনি অসুস্থ ছিলেন তাই, এখন ভালো হয়ে গেছেন।
– তার মানে আগে বউ ছিলে এখন বউ নও?
– ইয়ে মানে। আমি আপনার বউ….
– বউ নয়, আমি জানি, মা আমাকে সব বলেছেন। আজকের যুগে কোন মেয়ে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে এতকিছু করবে না। আমি তোমার কাছে চির কৃতজ্ঞ।
সোহা বললো আমি আমার কাজ করেছি। এখানে কৃতজ্ঞতার কিছু নেই।
শান কে আমার কাছে দাও বলে তন্ময় সোহার দিকে হাত বাড়ালো।
– ইয়ে মানে,.. না দেবো না। আপনি ওকে মারতে চান।
– কি বলছো সোহা! ও আমার ছেলে। আমি এখন সুস্থ, ওকে কেন মারবো?
সোহা তারপর ও দাঁড়িয়ে আছে।
“দাও মা শান কে ওর কাছে দাও” বলে তন্ময়ের মা সামনে আসলেন। সোহা ভয়ে ভয়ে শানকে তন্ময়ের কোলে দিল। তন্ময় আলতো করে শানের কপালে চুমু একেঁ দিয়ে শান কে জড়িয়ে ধরলো।
ওর মুখে হাসি আর চোখে পানি, এতদিন পর এ যেন এক অপূর্ব মিলন। জন্মের পর থেকে তন্ময় একবারের জন্য শান কে কোলে নেয়নি।
এ দৃশ্য দেখে সোহার চোখেও পানি এসে গেল।

দেখতে দেখতে একটা মাস শেষ হয়ে গেল। এ বাড়ির সবকিছু যেন সোহার আপন হয়ে উঠলো। যতই দেশে ফিরে আসার কথা মনে পড়ছে ততই ওর কান্না পাচ্ছে। ও কিভাবে শান কে ছাড়া থাকবে। তন্ময়কে ভুলে থাকবে। যতই চুক্তিপত্র থাকুক সোহা যেন এ বাড়ির বউ হয়েছিল এতদিন সবার ভালবাসা, সুন্দর আচরন ও ভুলতে পারবে না। শান কে ও জন্ম না দিলেও মনে হয় শান যেন তার আত্মার আত্মীয়। তন্ময় ও ভাল হয়ে গেছে, সব সমস্যার ও সমাধান হয়ে গেছে। সোহা তার রুমে শুয়ে এসব ভাবছিল।

আসতে পারি ম্যাডাম?
তাকিয়ে দেখে দরজায় তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে।
জ্বি আসুন বলে সোহা উঠে দাঁড়ালো। তন্ময় এসে একটি চেয়ারে বসে সোহাকে ও বসতে বললো।
সোহা বসার পর তন্ময় বললো, শুনলাম তুমি নাকি দেশে চলে যাবে?
– জ্বি চলে যাচ্ছি, আমার সময় শেষ। বলে সোহা মাথা নিচু করলো।
– আর কিছুদিন থাকা যায়না?
সোহা ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো আর মনে মনে ভাবলো, আমি তো সারাজীবন থাকতে চাই তন্ময়, কিন্তু তা যে সম্ভব নয়।
– না মানে সোহা তুমি কিছু মনে করোনা। আমাদের পিছনে এই ছয়টা মাস সময় দিয়েছো তুমি। একটু সময় ফুরসত পাওনি আরও কিছুদিন থেকে যাও। আমরা ঘুরবো, পিকনিক করবো। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি থাকবো। এই বাহানায় নাহয় আরও কিছুদিন শান কে কাছে পাবো।
তন্ময় ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি তুমি থাকো।

আরও একটা মাস যেন স্বপ্নের মত চলে গেল। সোহা, তন্ময়, শান, আর বাবা মা সবাই মিলে অনেক ঘুরাঘুরি করলো। ইংলেন্ড এর সব আকর্ষনীয় জায়গা পিকনিক স্পট ঘুরলো ওরা। এর মধ্যে তন্ময় ফরমুলার মাধ্যমে ঔষদের প্রতিষেধক ও আবিস্কার করে ফেলেছে। হাসপাতালেও কাজে যোগ দিয়েছে। ও এই বছরের সেরা ডাক্তারের এবং গবেষকের এওয়ার্ড পাবে।
সোহা বাড়িতে ফোন দিয়ে বললো যে ও দুইদিন পর বাড়িতে আসছে। ওর বাবা জিজ্ঞেস করলেন জামাই বাবা কি আসবে না মা?
– না বাবা উনি খুব ব্যস্ত, আমি একা আসবো, আসার পর তোমাদের সাথে কথা বলবো। অনেক কথা জমা আছে বাবা।
-কেন মা, কি হয়েছে? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
– কিছু হয়নি বাবা, তুমি চিন্তা করনা তো। আমি এখন রাখি।
সোহা লাইন কেটে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
তন্ময়ের মা দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনি এসে সোহাকে ধরে বললেন তুমি থেকে যাও মা। আমি তন্ময় আর ওর বাবার সাথে কথা বলবো তোমাদের বিয়ের বিষয়ে।
– না মা, তা হয় না। আপনি উনাদের কিছু বলবেন না। বলে উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
ওর মনে অভিমানে ভরা। তন্ময় কি কিছু বুঝেনা? ও কেন আমাকে আটকায় না। আমি যে ওকে ভালবাসি ও কি বুঝেনা? ও আমাকে হয়তো ভালবাসে না তাই এতে ওর কিছু আসে যায়না।

– মা আমি এই দুইদিন শান কে নিয়ে নিরিবিলি থাকতে চাই।
– ওকে মা, তুমি যা চাও তাই হবে।
তন্ময় নিজে দৌড়া দৌড়ি করে ভিসার আর টিকেট এর ব্যবস্থা করলো।

আসার দিন সবাই সোহাকে এগিয়ে দিতে আসলো। সারক্ষণ সোহা শান কে কোলে কোলে রাখছে। শান কে ছাড়া থাকতে হবে ভেবে বার বার তারর চোখ ভিজে যাচ্ছিল। মন থেকে চাচ্ছিল একবার তন্ময় তাকে থেকে যাওয়ার কথা বলুক। তন্ময় ও মন খারাপ করে আছে। তন্ময় ও সোহাকে এই কয়দিনে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু এমনিতে সোহা তার জন্য এতকিছু করছে, এখন কোন মুখে সে বিয়ের কথা বলবে। এসব ভাবছিল।

অবশেষে সোহা একরাশ অভিমান, দুঃখ নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখলো। সবাই তাকে নিয়ে আসতে এয়ারপোর্ট এ আসছে। সোহা সবাইকে জড়িয়ে ধরলো। আজ থেকে ৭ মাস আগে সোহা এখান থেকে বউ সেজে অজানার উদ্দেশ্যে লন্ডনে গিয়েছিল। আর আজ.? আজ জীবনের মোড় টাই বদলে গেছে।

চলবে….

– “মেহজাবিন মুন”

#”চুক্তি বিয়ে”

পর্ব -১০ (শেষ পর্ব)

সোহাকে নিয়ে সবাই বাড়িতে আসছে, সবাই খুশী, এটা সেটা ওকে গাড়িতে বসে জিজ্ঞাসা করলো। কিন্তু সোহা একটা কথার ও উত্তর দিলো না।
গাড়ি গেট দিয়ে ঢোকার সময় সোহা জিজ্ঞেস করলো এ কার বাড়ি বাবা? এখানে কেন নিয়ে এসেছো?
– কেন এটা আমাদের বাড়ি? তুই জানিস না?
– কি জানবো বাবা? সোহা অবাক হয়ে গেলো।
– আচ্ছা ঠিক আছে আগে তুই বিশ্রাম কর। পরে বলবো অনেক জার্নি করেছিস।
সোহা ও আর কিছু বললো না। ওর কাছে কোন কিছুই আর ভাল লাগেনা। ও যেন সব কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ও নিরবে নিজের রুম এ চলে গেলো। ওর এই নিরবতা দেখে সোহার মা বললেন, নিশ্চয়ই মেয়েটার কিছু হয়েছে। নাহলে তো মেয়েটা এত নিরব কোনদিন থাকে না।
সোহার বাবা বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছো। আমি বড় মেয়েকে আসার কথা বলছি। ও এসে জিজ্ঞেস করবে। হয়তো ওকে সব বলতে পারে।

সন্ধার সময় সোহার বাবা মা ভাই বোন সবাই সোহার রুমে আসলো।
ওর ভাই বললো, আপু এতদিন পর দেশে আসলে আমাদের জন্য কিছু আনলে না?
– না রে ভাই, এতটা ব্যস্ত ছিলাম কিছু কিনতে পারিনি।
– তুমি চাবি দেও আমরা দেখছি।
– কিচ্ছু আনিনি তো।
– তুমি দাওতো বলে সোহার বোন ওর পার্স থেকে চাবি নিয়ে চলে গেল। সোহা আর কিছু বললো না। “গিয়ে দেখুক গে আমি যে কিছু আনিনি।” মনে মনে ভাবলো।

সোহার মা বলতে লাগলেন, – কি হয়েছে সোহা তোর? তুই কেন এতটা উদাস হয়ে আছিস?
– কিছু না মা, এতদিন পর আসছি তো, শান এর কথা খুব মনে পড়ছে।
– শান? শান আবার কে?
হঠাৎ মুখ ফসকে বলে দিছে, এখন বুঝতে পারলো।
– মা শান উনাদের এক আত্মীয়ের ছেলে খুব ছোট। ওকে আমি আদর করতাম, নিজের সাথে রাখতাম। এখন এসব বাদ দেও, আগে বলো এ বাড়ি কোথা থেকে আসলো? কে বানিয়ে দিছে? এত টাকা তোমরা কোথায় পেলে?
সোহার বাবা বলতে শুরু করলেন, তুই যাওয়ার এক মাস পরে তোর শশুর আমাদের বাড়ি তে আসেন। তিনি বলেন আপনাদের সোহা ওইখানে অনেক বড় চাকরি করে। ও যখন দেশে আসবে, এসে যদি দেখে আপনারা এই বাড়ি তে এখন ও আছেন তাহলে কি মনে করবে? আমরা কিছু বলতে পারলাম না, কারন আমাদের তো কোন সামর্থ্য নাই।
উনি বললেন আপনারা কোন চিন্তা করবেন না ও যে বেতন পাবে ও আমার কাছে দেবে, আমি সব ব্যবস্থা করবো। আর সোহাকেও কিছু বলবেন না, ও এসে দেখে যেন চমকে যায়। আমরা বললাম সোহাকে খুশী করার জন্য তাই করবো।
এরপর উনি এই কয় মাসের ভিতরে জায়গা কিনে এই বাড়ি বানালেন, গাড়ি কিনে দিলেন, আর আমাদের চলার জন্য একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করলেন। সত্যিই মা তুই এত টাকা বেতন পাস? কি কাজ করিস ওখানে?
– সোহা এসব শুনে একদিকে খুব খুশী হয়েছে, এত ভাল মানুষ উনারা। কিন্তু অন্যদিকে মনে হচ্ছে এসব কিছু দয়ার দক্ষিণা। ও এই দয়া চায় না।
সে তার বাবাকে বললো, একবার তো জিজ্ঞেস করতে পারতে বাবা? আমি যে টাকা পাই সেই টাকা দিয়ে এ বাড়ির দশহাত জমিও কিনা যাবে না। এত কিছু কিভাবে করবো? আর আমি কি কখনো তোমাকে এসব বলেছি? আমার বাড়ি গাড়ি চাই? আমি তোমাদের নিয়ে শান্তিতে দু মুঠো ভাত খেতে চাই।
– ঠিক রে মা, হয়তো তোর শশুর বলে এরকম করেছেন। আসলে মা এরকম মানুষ পৃথিবী তে বিরল। এই স্বার্থেরর পৃথিবী তে এই নিঃস্বার্থ মানুষটাকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে।
সোহার মা বললেন, আচ্ছা এখন বল ও বাড়ির সবাই ভালো তো? জামাই, তোর শাশুড়ি?
সোহা এ কথা শুনে গম্ভির হয়ে গেল।
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
– হ্যা মা সবাই অনেক ভালো। তন্ময় সাহেব তো সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকেন তারপর ও যতটুকু সময় পান আমরা বাইরে যাই, পিকনিক করি। কথাটা ঘুরিয়ে বললো সোহা।
– তাহলে আসলো না কেন?
– মা ডাক্তার মানুষেরা তো নিজের খুশীর চাইতে মানুষের সেবা তেই বেশী খুশী থাকে। তাই আমিই বলছি আসা লাগবে না।
এমন সময় ওর ভাইবোন গুলো হৈ হুল্লোড় করে রুমে ঢুকলো।
– আপু তুমি না করলে কিচ্ছু আন নি? তাহলে এত কিছু কে আনলো আমাদের জন্য? সোহা দেখলো বোনের জন্য কাপড়, কসমেটিকস্ সামগ্রী, কলম, ক্যালকুলেটর আরও ওর পছন্দের অনেক জিনিস। ভাই এর জন্য ঘড়ি, মোবাইল ফোন, আরও যা যা লাগে অনেক দামি দামি জিনিস। বাবা মা এর জন্যও অনেক কিছু। সবকিছুতে প্যাকেট করে যার যার নাম লেখা। এসব তো সোহা কিনেনি, তাহলে কে কিনল? ও একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলো হাতের লিখা তন্ময়ের। ও এসব কখন করলো? হয়তো শেষ দুইদিন ও এসব কিনে প্যাকেট করেছে তখন তো সোহা একবারও তন্ময়ের সামনে যায়নি। আসার সময় ও ওর মাথায় চিন্তা ছিল বলে খেয়াল করেনি।
ও এত কিছু করলো কেন? এতকিছু না করে একবার কি বলতে পারতো না সোহা আমি তোমাকে ভালবাসি, বিয়ে করতে চাই। মনের অজান্তে চোখে পানি চলে আসলো।
সোহার ভাই সোহার চোখে পানিদেখে বললো, আপু তুমি কাঁদছো কেন? আমরা এসব খুলেছি বলে কি কষ্ট পেয়েছো?
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সোহা বললো, দূর পাগল আমি খুশী হয়েছি। এসব আমি কিনি নি, সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমার অজান্তেই তন্ময় কিনেছে। তোরা খুশী তো..?
– খুশী মানে? দুলাভাই ইজ গ্রেট” বলে ও উল্লাস প্রকাশ করলো।
– আচ্ছা যাও সবাই এখন আমি একটু একা থাকতে চাই।

পরদিন সকালে সোহার বোন আসলো, জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে সোহা? তুই নাকি একেবারে আনমনা হয়ে গেছিস?
– কিছু না আপু এমনি।
– বল আমাকে, মনের কষ্ট হালকা হবে।
সোহা তার আপু কে সব কিছু বলে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
সোহার আপু এসব শুনে নিরবে রুম থেকে চলে গেলেন।
উনি সবাইকে এসব বললেন। ওর মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমার মেয়ে চুক্তি বিয়ে করেছে। আমাদের জন্য এত নিচে নেমেছে।

সবাই সোহার রুমে আসলো। সোহার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এসব কি শুনছি সোহা? টাকার জন্য আমার মেয়ে হয়ে তুই এত নিচে নামতে পারলি? নিজের জীবনের এত বড় ক্ষতি করলি? কেন? আমি কি মরে গেছিলাম?
– বাবা আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভালো করেছি। একটা পরিবার আর দুইটা জীবন রক্ষা করতে পারছি আল্লাহর সাহায্যে। এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া।
– না, এ হতে পারে না। আমার বোন এতকিছু করবে আর ওরা স্বার্থপর এর মত নিতে থাকবে এ হয়না। আমি উনাদের সাথে, তন্ময়ের সাথে কথা বলবো।
– না আপু, ওরা স্বার্থপর নয়। আমাদের জন্য ও তো ওরা এত কিছু করেছে। তারপর অভিমান ভরা গলায় বললো। তুমি কেন বলবে, ওর কি কিছু আসে যায়না। ও কি বুঝে না?
সবাই এ কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো সোহার মনেও অভিমান কাজ করছে। আর কিছু না বলে নিরবে চলে গেলেন রুম থেকে।

এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, মিনহাজ সাহেব আর তন্ময়ের মা নিয়মিত সোহাকে ফোন করেন। কিন্তু তন্ময় একবারের জন্যও সোহাকে ফোন, মেসেজ করেনি। যতদিন যাচ্ছে সোহা আরও মনমরা হয়ে যাচ্ছে, রুম থেকেও বেশী বের হয়না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া ও করছে না। ওর অবস্থা দেখে সোহার মা নিরবে শুধু কাঁদছেন।

একদিন সকালবেলা কি এক দরকারে পার্স খুললো। দেখলো একটা গোলাপি এনভেলাপ সাথে দুইটা গোলাপ ফুল বাধা। গোলাপ গুলো শুকিয়ে গেছে। ও কাঁপা কাঁপা হাতে এনভেলাপ টি খুললো। হাতে তন্ময়ের লেখা চিঠি। তন্ময় লিখেছে-

“সোহা”
তুমি আজ চলে যাচ্ছো, কিন্তু তোমাকে আটকানোর ক্ষমতা বা অধিকার আমার নেই। যে কয়দিন আমি ভালো ছিলাম, তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা দিন আমার কাছে স্বপ্নের মতো লেগেছে। প্রতি টা দিন আমার কাছে মনে হয়েছে, নতুন করে স্বপ্ন দেখার দিন, বেঁচে থাকার দিন। আমি জানিনা আমার মনের ভুল কিনা, আমিও তোমার চোখে আমার জন্য এক সাগর মায়া দেখেছি, ভালবাসা দেখেছি। তারপর ও কিছু বলতে পারিনি তোমায়। আমার বিবেক বাধা দিয়েছে যদি আমার দেখাটা ভুল হয়? এমনি তে তুমি আমার জন্য এতকিছু করেছো। আমি তোমার জন্য নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছি, বাঁচতে শিখেছি। হয়তো ভালো হতাম, কিন্তু সারাজীবন ভালবাসার প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকতাম। তুমি ই আমাকে শিখিয়েছো, পাওয়া নয় ত্যাগের নামই প্রকৃত ভালবাসা। আর আমার মনের কথা গুলা যদি সঠিক হয়, আমাকে যদি তুমি সত্যিই ভালবেসে থাকো তাহলে আমার নাম্বারে একটা ফোন দিও। আমি বুঝে যাবো তুমিও আমাকে ভালবাসো, তখনি আমি চলে আসবো তোমাকে আপন করে নিতে, আমার শান এর মা বানিয়ে নিতে। আমি সারাটি জীবন তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।

– তোমারই “তন্ময়”

সোহা চিঠি পড়ে থ হয়ে বসে থাকলো। তাহলে তার অনুমান ঠিক, তার ভালবাসা ব্যর্থ হয়নি। সেজন্যই তন্ময় তাকে ফোন করেনি। এতদিন থেকে কেন পার্স খুললো না চিঠি দেখলো না আফসোস করলো।
ও তাড়াতাড়ি তন্ময়ের নাম্বারে ফোন করলো।
তন্ময় ফোন ধরে বললো, সোহা আমি প্রতিটা দিন প্রতিটা ঘন্টা তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।
– বুদ্ধু কোথাকার, একবার তো বলেই দেখতেন।
– আমি পারিনি সোহা, মনে ভয় ছিল যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি। যদি আর তোমার সামনে দাঁড়াতে না পারি?
– এখন কি এসে দাঁড়াতে পারবেন মি. তন্ময়?
– ইয়াহ্ এখন পারবো মিসেস তন্ময়।
– কি..?!
– ওহ্ থুক্ষু! এখনও মিসেস হওনি। কিন্তু শান এর মা তো হয়ে গেছো তাইনা?
– হুমম।
– তাহলে আমরা আগামী দুইদিনের ভিতরেই দেশে আসছি। আসল পাগলামীর জন্য রেডি থাকো।
– “পাগল একটা বলে” সোহা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো।

গল্পটি শেষ করলাম। যদি ভালো লাগে তাহলে বলবেন আবার ও নতুন গল্প নিয়ে হাজির হবো। আর ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

– “মেহজাবিন মুন”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here